তখন আমার ভালো লাগার কারণগুলো ছিল, (শঙ্খ ঘোষের ভাষায়) শক্তির কবিতার `তীব্র এক ইন্দ্রিয় বোধের চাপ', `চলতি ভঙ্গিমাটাকে মুচড়ে দেবার এক প্রগাঢ় প্রবণতা', ভালোবাসার তীব্র আকুতি, রোমান্টিকতার নব্য অভিব্যক্তি । সত্যি সত্যিই এসব প্রবণতা শুধু শক্তির নয়, তাঁদের গোষ্ঠীর অনেকের মধ্যেই ছিল, কিন্তু একমাত্র শক্তিই জলোচ্ছ্বাসে উথাল পাতাল ঐরাবতের অজস্রতা দিয়ে, বিপুলতা দিয়ে আমাদের অবাক করে দিচ্ছিলেন । আর ছিল - কবিতায় আত্মজৈবনিকতা, খোলাখুলি নিজের ভালোলাগা মন্দ লাগার কথা বলা । শক্তির উদাত্তকন্ঠের রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনার সৌভাগ্য হয়েছে আমার, এই গান গাওয়াও যেন উচ্ছ্বসিত আত্ম অভিব্যক্তির অকুন্ঠ প্রকাশ - যা সুনীল বা সন্দীপনের, শরতের, তারাপদর ছিল না ।
আজ বাংলা কবিতার ঐতিহ্যে শক্তি চট্টোপাধ্যায় এক অপ্রতিরোধ্য নাম । শক্তির জীবনবোধ এবং কাব্যবৈশিষ্ট্য সূত্রে সেসব কথার অবতারণা করি । শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শৈশব ও কৈশোর কেটেছে বহড়ুতে, `ছোটবেলায় একা একা গ্রামে কাটিয়েছি - কিছুটা কল্পনাবিলাসী ছিলাম' । এই আত্মজৈবনিক মুগ্ধতার নানান ছবি আছে তাঁর গদ্যে, উপন্যাসে । ছোটবেলাটা শৈশবে পিতৃহীন কবির কেটেছে টোলের শিক্ষা, সংস্কৃত শাস্ত্র, সংস্কৃত সাহিত্য চর্চায় । তারপর ১৯৪৮ থেকে কলকাতা, বাগবাজারে, কাশিমবাজার পলিটেকনিক স্কুলে, মির্জাপুরের সিটি কলেজে কমার্স পড়া, সেটা ছেড়ে প্রেসিডেন্সিতে আই. এ. পড়া, ১৯৬০ - এ বহিরাগত হিসেবে পাশকোর্সে স্নাতক হওয়া । স্কুলে পড়তে পড়তে মার্কসবাদে আকর্ষণ, ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে অংশগ্রহণ, প্রগতি পাঠাগার তৈরি এসব শেষ কয়েক বছরের মধ্যে । রাজনীতির সঙ্গে ছেদ ১৯৫৮-এ, বোহেমিয়ান ও স্বেচ্ছাচারী জীবনের সূত্রপাত । এটা লক্ষ্য করবার পঞ্চাশের দশকের যারা অগ্রগণ্য কবি বা কথাসাহিত্যিক হবেন ভবিষ্যতে, তারা সবাই মার্কসবাদে আকৃষ্ট, বীতশ্রদ্ধ হয়ে চলে আসেন বোহেমিয়ান জীবন যাপনে । এর কারণ তত্কালীন বাঙালী মার্কসবাদী পার্টিতন্ত্রের যান্ত্রিক ব্যবহারের মধ্যে - যা নিয়ে খুব বেশি কিছু অনুসন্ধান হয় নি । শক্তির ক্ষেত্রে কি হল ? ক) `নোংরা রাজনীতিকে ঘেন্না করতে শিখেছিলাম' । খ) `রাজনীতি স্পষ্ট ও সোচ্চার নয় আমার লেখায়; আমি অমন উচ্চারণময় উচ্চকন্ঠ লেখা মনে মনে এড়িয়ে যেতে ভালবাসি । (১৯৭০ এ বলা) গ) কবিতা ঘোরতর অসামাজিক (`কবিতার প্রতি সমীহ' প্রবন্ধে) ঘ) যা কিছু ব্যক্তিগত তাই পবিত্র । শেষের কথাটি বুদ্ধদেবের । তিনিও একদা সাম্যবাদীদের থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন । বুদ্ধদেব বসু ও তাঁর `কবিতা পত্রিকা' হয়ে উঠল শক্তিদের পরম পবিত্র তীর্থ, বুদ্ধদেব বসুর বোদলেয়র এর বাংলা অনুবাদ পঞ্চাশের বোহেমিয়ান কবিতার পরম প্রেরণা । তাঁর প্রথম কবিতার বই `হে প্রেম হে নৈ:শব্দে'র উত্সর্গ পত্রটি বোদলেয়রের কবিতা পংক্তি দিয়ে রচিত । শঙ্খ ঘোষ বলেছেন বোদলেয়র বা হাংরি জেনারেশন শক্তির কবিতার `একটা সূচনাবিন্দু মাত্র' হয়তো তাই । কবিতা বা জীবন যাপনকে যেভাবে ঘোরতর অসামাজিক করে তুলতে চেয়েছিলেন বোদলেয়র তা শক্তিরা পারেন নি, তারা অসামাজিক জীবনকে `চেখেছেন' কিন্তু সে জগতের বাসিন্দা হন নি । অচিরেই শক্তি হিমেনেথ থেকে রবীন্দ্রনাথে, প্রকৃতি ও প্রেমে পায়ের তলার মাটি খুঁজতে শুরু করেন, ঈশ্বর বিশ্বাস লালন করেন এক আধুনিক উপায়ে, আনন্দবাজারে চাকরি, দাম্পত্যের সুখ, হুল্লোড় স্বভাবী ভক্তবৃন্দ, পুলিস-প্রীতি, আরও কতরকমের adjustment যে তাঁর ছিল । বোদলেয়রীয় চিত্রসাহিত্য রসাস্বাদন দক্ষতা শক্তির ছিল না, তিনি কবিতায় বলেন - `সবার বয়স হয় আমার বালকবয়স বাড়ে না কেন' - অব্যর্থ এ কথা । বালকোচিত বিস্ময় তাঁর কবিতাকে করে তুলেছে অদ্ভুত প্রাণবন্ত তা আমাদের হৃদয়ে কড়া নাড়ে, অবনী বাড়ি আছে কি না জিজ্ঞাসা করে, মননে কড়া নাড়ে না তেমন করে ।
শক্তির কবিতার অব্যাহত জনপ্রিয়তার কথায় আসা যাক । যে কোনো কবিতা-ঐতিহ্য সচেতন পাঠক জানেন, শক্তির কবিতা মনন নির্ভর নয়, যুগ ও বিশ্বের জটিল যন্ত্রণা সেখানে কেলাসিত রূপ পায় না, বরং তাঁর কবিতা আবেগ নির্ভর, সরল সহজ তার প্রকাশভঙ্গি (অনেকক্ষেত্রে) । প্রথমাবধি তার কবিতার মুখ্য বিষয় প্রেম এবং এই প্রেম প্রকৃতি নির্জনতা মৃত্যুবোধ মিশে এক অভূতপূর্ব রূপ লাভ করেছে । প্রথম বইতেই পাই -
অথবা
কুন্তল চট্টোপাধ্যায় লক্ষ্য করেছেন শক্তি ভালোবাসার কথা বলতে গিয়ে শিকড়ের উপমান ব্যবহার করেন বারংবার । যেমন -
`ভালোবাসা কথা বলো, হোক না সে ছুঁচের মতন / নিষ্ঠুর, ন্যঞর্থ কথা, কথা বলো আমার ভিতরে / বৃষ্টির মতন কথা, বিদ্যুতের, শিকড়ের কথা' (বলো, ভালোবাসা)
আমি বলতে চাইছি প্রেম তাঁর কবিতায় প্রকৃতি সন্নত হয়ে ছড়িয়ে যায় আনন্দ আর বিষাদ নিয়ে - জীবনানন্দ যেমন ভেবেছিলেন তাঁর বনলতা সেন থেকে মহাপৃথিবী পর্বে - পৃথিবীর ত্রক্রমমুক্তির এ একটা পথ - সন্দেহ নেই । দ্বিতীয়ত: এই যে শিকড় মনস্কতা ভালোবাসার প্রণতিতে এও মুক্তির সংকেত বহন করে । এই দুটি ব্যাপারেই তিনি কিন্তু বোদলেয়র অনুবর্ত্তী নন, আর এই দুটি ব্যাপারেই পঞ্চাশের কবিদের মধ্যে তিনি স্বতন্ত্রস্বরের ধারক । মৃত্যু নিয়ে মৃত্যুস্পৃষ্ট তাঁর কবিতা তাঁর সতীর্থদের মধ্যে সর্বাধিক, অথচ এ মৃত্যু আমাদের স্তব্ধ করে দেয় না । শক্তির কবিতায় বারংবার আমরা পাই `যাত্রা'র কথা, পথের কথা -
জন্ম আগে - মৃত্যুর কাছে যেতে হলে পথ, / পথের পরে পথ ফেলে যেতে হবে আমাদের / সেখানে মাইলপোস্ট নেই ... (তুমি আছো)
অথবা,
অথবা,
এভাবেই শক্তির মৃত্যুর কবিতা হয়ে ওঠে জীবনের কবিতা । পাঠক জানেন, শক্তি অজস্র ভ্রমণ করতে ভালোবাসতেন । এই ভ্রমণ - জীবন পথের ভ্রমণ, প্রকৃতির কাছে যাওয়া, প্রকৃতি থেকে সঞ্চিত কৃষ্ণত্ব সরিয়ে আলো নেওয়া - এই ভাবে প্রেম-প্রকৃতি বিষয়ক কবিতা হয়ে ওঠে জীবনাবেগের কবিতা । সন্দেহ নেই, বোদলেয়র নয়, রবীন্দ্রনাথ তাঁকে নানাভাবে পথ দেখিয়েছেন । শক্তির রবীন্দ্রপ্রেম পঞ্চাশের দশকের কবিতা-ঐতিহ্য অতুলনীয় । বোদলেয়র এবং অমঙ্গলবোধ আক্রান্ত আধুনিকতার থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে পেরেছিলেন একদা শক্তি । রাবীন্দ্রিক সুন্দরের অভ্যর্থনা, প্রেমের সার্থকতা তাঁর কবিতায় রাবীন্দ্রিক নয়, রাবীন্দ্রিক উত্তরাধিকার । যেমন - `সুন্দর আমার কাছে শুয়ে আছে মানুষের মতো' অথবা `আজ সে সুন্দর এসে বসে আছে মানুষের পাশে' - এতো পূর্বজ ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় । রবীন্দ্রনাথের মতো শক্তিও বলেছিলেন - `মানুষের মধ্যে থেকে ভালোবাসা শূন্য হয়ে গেলে' সে হবে `মৃত্যুর ও অধিক' । রবীন্দ্রনাথের কথা মনে পড়ে যখন তাঁর কবিতায় যাত্রা, যাত্রী, পথ, পথিক এসব শব্দ বার বার এসে পড়ে । আর রবীন্দ্র পংক্তি ও অনুষঙ্গ তাঁর কবিতায় অজস্র । বিষ্ণু দে রবীন্দ্র পংক্তিকে একদা আয়রনি প্রকাশে, পরে আত্মভাবনার উন্মোচনে ব্যবহার করেছেন, শক্তিও তাই । রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে মনে পড়বে শক্তির কথা - `এবং তোমার গানে আমি নিই সহজ নিশ্বাস ।' এ যে কেবল কথার কথা নয়, রবীন্দ্রসাগর যে কবিকে এ যুগেও বাঁচায় - শক্তি বা অলোকরঞ্জনের কবিতা তার প্রমান দেয় । শক্তির কবিতায় রবীন্দ্র পংক্তি ব্যবহারের কিছু উদাহরণ উপস্থিত করি - `দূরদেশী ও রাখাল ছেলে, কই ধেনু উচ্ছন্ন গোষ্ঠ', `নীল দিগন্তে ফুলের আগুন - সেই আগুন পোড়াচ্ছে কবে ?' `আমার যেদিন ভেসে গেছে ...', `না চাহিলে যারে পাওয়া যায় ...' `এ পরবাসে রবে কে, কে রবে সংশয়ে', `স্বস্তিতে আজ থাকতে দে না আপন মনে', `শুনায়ো আমারে ফিরে সেই গান, সেই অন্ধকারে / যেখানে ঝড়ের রাতে আবার তোমারই অভিসার' - ইত্যাদি । পাঠক লক্ষ্য করবেন, এখানে সব ব্যবহারই কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গান থেকে । গান যে তাঁর কন্ঠ থেকে কবিতায় নেমে এসেছে বেশী করে স্বকীয় উচ্চারণের সঙ্গে সেটা বুঝতে কষ্ট হয় না ।
শক্তির কবিতার মধ্যে একটি ব্যতিক্রমী দিক আছে । তা হল - ঈশ্বর প্রসঙ্গ । বিংশ শতাব্দীর কবিতায়, বাংলা কবিতায় ঈশ্বর আর পরিগ্রহণের স্তরে নেই, বড়ো জোর তিনি ব্যঙ্গ বিদ্রুপ পরিহাসের সূত্রে ব্যবহৃত । পঞ্চাশের দুজন কবি আধুনিক হয়েও ঈশ্বর প্রসঙ্গ যে বোধের অন্তর্গত তা স্বীকারে কুন্ঠা করেন নি । শক্তি বলছেন - তাঁর মধ্যে - `ঈশ্বরে বিশ্বাস আছে । ফল্গু নদীর মতন অন্তর্বিশ্বাস । কোনো পুজো-আচ্চা, ফুল চন্দন নয় - প্রত্যক্ষ, তাঁর সঙ্গে এই আমার অনিবার্য যোগ ।' তিনি বলেন - বারবার তিনি নষ্ট হয়ে যাচ্ছেন - `প্রভু, তুমি আমাকে পবিত্র / করো ...।' তাঁর একটি কবিতার বইয়ের নাম - `ঈশ্বর থাকেন জলে' । (১৯৭৫) সেখানে আছে - `অদ্ভুত ঈশ্বর এসে দাঁড়িয়েছেন, মৃন্ময় উঠোনে / একদিকে শিউলির স্তূপ, / অন্যদিকে দ্বাররুদ্ধ প্রাণ / কার জন্যে এসেছেন -/ কেউ কি তা স্পষ্ট করে জানে ?' (কার জন্যে এসেছেন ?) অথবা, বলছেন - `ঈশ্বর থাকেন জলে / তার জন্য বাগানে পুকুর / আমাকে একদিন কাটতে হবে / আমি একা - / ঈশ্বর থাকুন কাছে, এই চাই - জলেই থাকুন ।' (আমাদের সম্পর্কে) এ ছাড়া - `শুনেছি ছিলেন তিনি গাছের বাকলে গা এলিয়ে / যতটুকু ছায়া তাঁর প্রয়োজন, ছিল ততটুকু / ' অথবা - `ভেবে রাখ / যেখানেই থাক / তোমাকে তাঁহার কাছে যেতে হবে ।' (তাঁর কাছে) অথবা - `কী তবু কামনা বাকি, আজো কেন তৃষ্ণা নাহি সরে - / কিছুতেই; / সে কি থাকে ভগবান তোমার ভিতর ?' অথবা, `সভায় যে কাঁদে সে সংসদে / মানুষের শুভ পণ্য বিক্রি ক'রে দেশবন্ধু সাজে ....... সে কখনো ঈশ্বর দ্যাখেনি ।' একটু বেশি উদ্ধৃতি দিলাম । শক্তির এই শরণ্য দেব নিসর্গের পবিত্রতার সঙ্গে একাকার হয়ে যায় । এ ঈশ্বরের `দুটি চোখ দিগন্তবিস্তৃত / কাজ নেই / শুধু চোখ মেলে দেখা / তাঁরই নাম প্রকৃত অবলোকিতেশ্বর ।' আমাদের মনে পড়বে অলোকরঞ্জনের কথা, যিনি তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ `যৌবন বাউল' - এই বলে ছিলেন - পটভূমিকা অন্ধকার, কিন্তু হাল ছাড়তে নারাজ । বন্ধুরা বিদ্রুপ করে ঈশ্বরে বিশ্বাস করি বলে । কিন্তু বন্ধুরা নির্ভরযোগ্য নন, তাই তো ঈশ্বরের কাছে যেতে হয় । পাঠকের হয়তো মনে পড়বে শক্তি অলোকরঞ্জনকে সমকালীনদের মধ্যে `সকলের চেয়ে গুরুত্বপূর্ন' মনে করেছিলেন । (স্থির বিষয়ের দিকে - অলোকরঞ্জন) শক্তি অন্যত্র বলেন - `ছন্দ, বাক্চাতুর্য ও আপাত তরল বাংলাভাষা' শিখেছেন অলোকরঞ্জনের কাছে । যারা এই দুজনের কবিতা অনেকটা পড়েছেন তারা বুঝবেন, কথা দুটোয় যথেষ্ট অতিশয়োক্তি আছে । জীবনযাপনে, বিষয় নির্বাচনে, বিষয় উপস্থাপনায়, শব্দ সজ্জায় - তাঁদের দুজনের মধ্যে মিল যতটা, অমিল তার থেকে অনেক অনেকগুণ বেশি ।
অসংখ্য কবিতা লিখেছেন তিনি, বইয়ের সংখ্যাও বিস্তর, সত্যই সে কাব্যসমুদ্র `জলোচ্ছ্বাসে উথাল পাতাল' । এই কবিতা সমুদ্রের কারুকার্য নিয়ে কথা বলা, সংক্ষেপে বলা, কঠিন । চেষ্টা করা যাক । তিনি গীতিকবিতা লিখেছেন, সনেট লিখেছেন, দীর্ঘ কবিতা লিখেছেন, বেশ কিছু ছিন্ন বিচ্ছিন্ন কবিতা আছে । সে সব কবিতায় লৌকিক শব্দ আছে (হাটের কাচকড় কুপি, ভাঙা আগল, হাঁটু ভেঙে কাত্), তত্সম ও সমাসবদ্ধ শব্দ আছে (কার্যব্যপদেশ, অনন্ত স্রোতসা, আকর্ণবিস্তৃত, অশ্বঅক্ষরেখাব্যপ্ত, নাট্য প্রতিনাট্য বোধ) ইংরেজি, ইংরেজি বাংলা মিশ্র শব্দ আছে (অ্যারিস্টোক্র্যাট, ধর্ম-মিউজিয়াম, পলিথিন সমুদ্র, একাডেমি), অজস্র নাম শব্দ আছে (কঙ্কালীতলা, সামসিং, জোড়বাংলো), সঙ্কর শব্দ আছে (তদবির-ভরা, পেটি-বাবুয়ানি), চলিতের মধ্যে সাধু ব্যবহার আছে, কিছু হেঁয়ালি শব্দ আছে (ফ্যান জোলেঙ্গা, হোহেনজোলার্ন), অশ্লীল শব্দ আছে (পোঁদ, উল্লুক, গুহ্যদেশ), পাশে অতিশালীন শব্দ । আসলে, কবিতার অন্তর্বয়নে শব্দ খাপ খাচ্ছে কি না সেটাই বিবেচ্য । তাঁর কবিতায় চাঁদ, বৃষ্টি, গাছ এর ব্যবহার অসংখ্য এবং বিচিত্র । চাঁদের কথাই ধরা যাক - ফুলে ফেঁপে একাকার চাঁদ, চাঁদ ছিল চাঁদে লেগে, চাঁদের আলস্য, ডাকহরকরা চাঁদ, চাঁদ উঠছে যেন বাঘের মুড়োর মতন, ঠুনকো চাঁদের ভাঁড়, তরমুজ ফালির চাঁদ, চাঁদের লন্ঠন, চাঁদ চলে লুটিয়ে কাপ.দ, আকাশে চাঁদ শায়া শুকোচ্ছে ইত্যাদি ।
তেমনি বৃষ্টি - ভারি ব্যাপক বৃষ্টি আমার বুকের মধ্যে ঝরে, বুকের মধ্যে বৃষ্টি নামে, চিরবৃষ্টি, বৃষ্টির মুখ-ঝোঁকা মেঘ, সারাবেলা বৃষ্টিতে বিষন্ন, বৃষ্টি-ভরা কিশোর দু:খ, বৃষ্টিও হয়েছে বুড়ো ইত্যাদি ।
গাছের ব্যবহার - একটি নিষ্পাপ গাছ, তুমি যেন গাছ, কিছু দিন গাছ হয়ে থাকো, পাশে দাঁড়িয়েছে দীর্ঘ গাছ কাঙালের মতো, হে দেবদারুর বিস্তার - আমি শুনতে পাচ্ছি / তোমার মধ্যে ভাঙছে ঢেউ ইত্যাদি ।
শক্তির কবিতায় গ্রাম, গ্রামীণ অনুষঙ্গ বেশী, জীবনানন্দ মনে পড়ায় । তবে জীবনানন্দের মতোই তিনিও নাগরিক অভিজ্ঞতালব্ধ চিত্রকল্প কম প্রয়োগ করেন নি । সেরকম কিছু উদাহরণ - পা থেকে মাথা পর্যন্ত টলমল করে, দেয়ালে দেয়াল, কার্নিশে কার্নিশ, ফুটপাত বদল হয় মধ্যরাতে, মৃত্যু, তুমি রাসবিহারীর ট্রামলাইন, রাজনৈতিক মানুষ নাচে মনুমেন্টের নিচে, মানুষ ডালহৌসির মুষ্টি থেকে আঙুলের ফাঁকে পড়ছে ছড়িয়ে, কলকাতার রাস্তায় / ভিখিরিরা ইঁট পেতেছে, তিজেলে সিদ্ধ হচ্ছে ভাতের সঙ্গে ছাঁই পাশ, গলির ঘুমন্ত পিঠ মাড়িয়ে মাড়িয়ে, ময়দাসের ঘাস ছিঁড়ে ঝড় ঢুকবে আনন্দবাজারে ।
পুলিশের বড়কর্তা, মেজকর্তা, ছোটকর্তা, সবাই জানে, শক্তিকে চিনতো, তারা বিপর্যস্ত, বিব্রত হয়েছে, ধরেছে, ছেড়েছে বারংবার । শক্তির কবিতায় পুলিশ চলে এসেছে নানাভাবে । যেমন - প্ল্যাটফর্ম দৌড়ে গেল পিছনে পুলিশের মতো, কুচকাওয়াজ- অন্তে গাইলো পুলিশেও রবীন্দ্রসঙ্গীত, চৌমাথার কাছে পুলিশের মতো কর্তব্যপরায়ণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম আমি ... ।
আমার ভালো লাগা, ভাবনা উসকে দেওয়া কিছু চিত্রকল্পের তালিকা প্রস্তুত করি । যেমন - মাঝে মাঝে আমাদের অবস্থা - বন্দিত্বে আসে রোদ, তুমি বেদনার হালখাতা করো টেরিটিবাজারে, তু তু করে ডাকে ন্যাংটো রক্তের নিজস্ব টেলিফোনে, গাভীন গরুর মতো কালো ছায়া ফলের বাগানে, কানা - লন্ঠন মাথার ওপর টলছে যেন গরঠিকানী পান্থ, মেঘের মতন ঠাণ্ডা সাঁতারু দুজন শোল, চন্দ্রমল্লিকার মাংস ঝরে আছে ঘাসে, আজ আমার সারাদিনই সূর্যাস্ত, লাল টিলা, নদী যেমন বসতি ভাঙে নখরে / ভিতরে ভয় তেমন করে ভাঙছে, একটি মধ্যবয়স গাছে নিজেকে বিন্যস্ত / করে দেখেছি দীর্ঘকাল, শাখার মতো আপন / কেউ কিছু নেই, শব্দের নিজস্ব কিছু ক্ষিদে আছে, ক্ষুন্নিবৃত্তি আছে, গরুর বাঁটের থেকে স্খলিত দুধের মতো তোমাকেও মনে পড়ে অর্গলবিহীন, সোনালি ফলের মতো দিন, তাকে রাত্রি টুকরো করে / শাণিত বঁটিতে, বাতাসার মতো স্তনে দুটি ডেয়ো পিঁপড়ের সোহাগ মাখা, মন কি এখনো আছে ছাই-মাজা বাসনের মতো গভীর উজ্জ্বল ? স্মৃতির ভিতরে মৌরলা-চঞ্চল / এনেছিল পরিবেশ, অনেকদিন বাদে প্যারাসুটে তার পুরাতন ভালবাসা নেমেছে উঠানে .... ।
পাঠক লস্য করবেন, দৃশ্যগ্রাহ্য চিত্রকল্প রচনার দিকেই অন্তত: এইসব উদাহরণে প্রবণতা বেশী । সে যাই হোক, শক্তির কবিতা যেমন অজস্র, তার থেকে মুগ্ধতাবিস্তারী, শব্দ, চিত্রকল্প চয়ন করা যায় বিস্তর । এতো আয়োজন পঞ্চাশ ষাট সত্তরে আর কোনো বাঙালি কবি কি দিতে পেরেছেন ? আমার তা মনে হয় না ।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর সতীর্থ সম্পর্কে বলেছেন - "যে সময় রবীন্দ্র পরবর্ত্তী প্রধান কবিরা সকলেই জীবিত এবং সৃষ্টিশীল, তখনই শক্তি তরুণ লেখকদের দলে যোগ দেয় এবং অচিরেই কবিতার সংখ্যায় এবং বৈচিত্র্য ও মৌলিকত্বে সে প্রথম সারিতে চলে আসে ।" "তাঁর কবিতা চির রহস্যময় ।" শঙ্খ ঘোষ তাঁর সম্পর্কে বলেছেন - "এই শহরের রাখাল ।" শক্তিই এনে দিয়েছেন বাংলা কবিতায় "এক শ্বাসরোধী অভিজ্ঞতা ।" তাঁর মধ্যে দেখেছেন - "বিস্ময়কর সাহস, স্বীকারোক্তির সাহস, নিরাবৃতভাবে নিজেকে মেলে ধরবার সারল্যময় এক সাহস ।" তাঁর সহপাঠী উজ্জ্বল কুমার মজুমদার বলেছেন (ছাত্রজীবনেই) "গরল কি অমৃত যাই সে পান করুক, সে তখন প্রায় দুর্বার হয়ে পড়েছে আমাদের কাছে ।" "দেখতে পাই চারিদিকে হেমন্তের পাতা ঝরলেও ও ডাকবিলি করে বেড়াচ্ছে দ্রুতগামী পোস্টম্যানের মতো ।" "শয়তান আর ঈশ্বরের সহাবস্থানেই মহিমময় মানুষের সংজ্ঞার্থ খুঁজে পেয়েছিল কবি ।" সমকালীন বিশিষ্ট সমালোচক অশ্রুকুমার সিকদার তাঁকে "শাশ্বতভাবে আধুনিক" আখ্যা দেন । এইসব কথার ব্যাখ্যা করছি না, কিন্তু আবেগমনস্ক কবিতা পাঠকের কাছে শক্তির কবিতার আবেদন যে কমেনি তা তো সত্য । এই `সত্য' প্রেক্ষিতেই তাঁর কবিতার যাবতীয় সদর্থক ও নঞর্থক বিষয়ের বিচার করতে হবে মনে হয় ।
(পরবাস-৪৫, মার্চ, ২০১০ )
বাগানে অদ্ভুত গন্ধ, এসো ফিরি আমরা দুজনে ।
কখনো ফুটে ওঠে প্রেমের অভিমান -
হাতের শৃঙ্খল ভাঙো, গায়ে প'ড়ে কাঁপুক ভ্রমর
যা - কিছু ধুলার ভার, মানসিক ভাষায় পুরানো
তাকে রেখে ফিরে যাই দুজন দুপথে মনে মনে । (নিয়তি)
যাবো না আর ঘরের মধ্যে অই কপালে কী পরেছো
অথবা আগ্রহ -
যাবো না আর ঘরে
সব শেষের তারা মিলালো আকাশ খুঁজে তাকে পাবে না .... (পরস্ত্রী)
সারঙ্গ, যদি ঝর্ণা ফোটাই তুমি আসবে কি তুমি আসবে কি
এই বইয়েরই একটি কবিতার শেষ পংক্তি -
অলস - অলস ভালোবাসা তুমি নদীপথ আঁকো নখে - নখে, তীরে
দাঁড়িয়ে পড়েছে শাদা গাছগুলি, উপঢৌকন সবুজ জড়োয়া
ও ঝর্ণা ওগো ঝর্ণা তাহাকে ভালোবাসবে কি ভালোবাসবে কি । (ঝর্ণা)
দেবতা, সুদূর বৃক্ষে, পাবো প্রেম কান পেতে রেখে । (পাবো প্রেম কান পেতে রেখে)
তরুণ বয়সের এইসব কবিতায় যৌনতা আদৌ বড়ো হয়ে ওঠে না । যদিও পাল্লায় পড়ে শক্তি `যৌন ছড়া' লিখেছেন, তাঁর এ সময়ের কিছু কবিতায় যৌন অনুষঙ্গ, অশ্লীল শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে । কিন্তু অচিরেই তিনি এই ক্লেদাক্ততা উত্তীর্ন হয়ে যান । দ্বিতীয় ব্যাপারটি হল - তাঁর `প্রেমের কবিতা প্রকৃতি প্রেমের ও কবিতা ।' (কুন্তল চট্টোপাধ্যায়) তাঁর প্রেমের কবিতায় পরতে পরতে প্রেম অনুষঙ্গে প্রকৃতি এসে গেছে । বড়ো কবির এই যে ঐতিহ্য, আমাদের কবিতায় রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দ তাঁদের কবিতায় এই ব্যবহারের চমকপ্রদ সব উদাহরণ রেখে গেছেন । শক্তির কবিতার প্রেম আত্মসর্বস্ব নয়, ভোগমুখী কামনা স্ফুরণের কবিতা নয়, তাতে বিষাদ ও প্রেমস্মৃতি মিলে মিশে আছে অপূর্বভাবে - শ্রাবণের মেঘ কি মন্থর / তোমার সর্বাঙ্গ জুড়ে জ্বর / ছলো ছলো / যে কথা বলোনি আগে, এবছর সেই কথা বলো । (এবার হয়েছে সন্ধ্যা)
ঈশানকোণে অমনোযোগে / মেঘের ঝুঁটি ধরেছে রোগে / দুমড়ে পড়ে প্রবলা শালবন / চাঁদ উঠেছে অন্তরীক্ষে / মনোস্থাপন করি ভিক্ষে / তোমার জন্য জুলেখা ডব্সন ! (জুলেখা ডব্সন)
তাঁর প্রেমের কবিতার আর একটি বৈশিষ্ট্য - সেখানে বারে বারে চলে আসে মৃত্যুর কথা -
`নিচের পৃথিবী থেকে ওপরের পৃথিবীতে চলে যেতে হবে / বিদায় নেবে না তুমি / বিদায়-মুহূর্তে ওড়ে অসংখ্য রুমাল / নিকটের শাখা থেকে দূরে বুঝি যাবে কিশলয়ে ।'
অথবা,
অবর্তমান তোমার হাসি ঝাউয়ের ফাঁকে
অথবা,
আমায় গভীর রাত্রে ডাকে
ও নিরুপম, ও নিরুপম ও নিরুপম (ঝাউয়ের ডাকে)
`তোমায় কিছু দিয়েছিলাম প্রীতির ছায়াতলে / নীলাঞ্জন, ঝরিয়া গেলে রম্য চিতা পটে ........./'
কেন অবেলায় যাবে ? বেলা হোক, ছিন্ন করে যেও / সকল সম্পর্ক .... (কেন ?)
মৃত মুখে যেভাবে হৈ হৈ হয়ে থাকে জীবিতের / সেইভাবে, ছুটে এলো মাছি । / বেঁচে আছি, কোনো মতে আছি ... (এই সেই সিংভূম)