"মা, মা, শিগগির এসো, দেখে যাও!"
পলা তার কলেজের ক্লাসের পড়ুয়াদের গ্রেডিং করছিল। ডিসেম্বর মাস, সবে সেমেস্টার শেষে হয়েছে। ফাইনাল পরীক্ষা মিটেছে। মাথা তোলার সময় নেই। তবুও মেয়েটার ডাকে একটু চমকায়। তিন্নির গলায় কী যেন একটা আছে। এমন করে চেঁচিয়ে ওঠার মেয়ে তো সে নয়?
টিভির সামনে এসে দেখে ওয়ার্ল্ড নিউজের চ্যানেলে লাইভ কভারেজ দেখাচ্ছে, ইয়েমেন থেকে।
"দেখো, দেখো বাচ্চাটা জলের ট্যাঙ্কের ওপর উঠে গেছে, পড়ে যাবে এক্ষু্নি, অত উঁচুতে, কী সাংঘাতিক মা!"
ইয়েমেনের জলের সংকট অনেকে বছর ধরেই খবরের হেডলাইন। যুদ্ধে, অরাজকতায় দেশটা কাবু, তার ওপর অতিমারীর বছর। মানুষজন তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালাচ্ছে। একফোঁটা জলের খোঁজে চলে যাচ্ছে দূরদূরান্তে। এরই মধ্যে কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা যতটা পারা যায় সাহায্য করছেন।
টিভিতে দেখাচ্ছে এমনই একটি ধুঁকতে থাকা গ্রাম, সেখানে পৌঁছেছে জলের ট্যাংক। সবাই ভিড় করে এসেছে। তৃষ্ণার্ত, ধুঁকতে থাকা মানুষ, একফোঁটা জলের জন্যে সব করতে পারে।
একটা রোগাপ্যাংলা বাচ্চা কী করে কে জানে উঠে পড়েছে বিরাট ট্যাঙ্কের উপর। হুমড়ি খেয়ে পড়েছে, যেন ডুব দিতে চায় ট্যাঙ্কের জলে, শুষে নিতে চায় প্রতিটি জলবিন্দু। এত তেষ্টা! চারদিকে শোরগোল, যে কোনো মুহূর্তে নীচে পড়তে পারে ও। মই নিয়ে উঠে তাকে নামানোর চেষ্টা চলছে।
তিন্নি রুদ্ধশ্বাসে দেখছে। শেষপর্যন্ত স্বেচ্ছাসেবীরা তাকে নামিয়ে আনলেন। ধাক্কাধাক্কিতে খানিকটা জল রাস্তায় ছলকে পড়েছে। নেমেই সে উপুড় হয়ে পড়ল রাস্তার সে জলটুকুর ওপর।
"মানুষ একটু জলের জন্যে এমন করতে পারে?" তিন্নি নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না।
অর্পণ কখন ঘরে ঢুকেছে কে জানে। পিছন থেকে দেখছিল সব। এবার আস্তে বলল, "মানুষ জলের জন্যে সব পারে তিন্নি, আমিও পেরেছি একসময়।"
"তুমি? বাবাই?"
"উড়িষ্যার একটা গ্রাম, অনগুল। ভুবনেশ্বর থেকে গাড়িতে যেতে প্রায় সারাদিন লেগে যায়। ভিতরকণিকা ছাড়িয়েও অনেকটা ভেতরে যেতে হয়।"
"সেই ভিতরকণিকা? যেখানে কচ্ছপ ঘুরে বেড়ায়?"
"হ্যাঁ রে মা। সেই অনগুল গ্রামে বিরাট এক অ্যালুমিনিয়ামের কারখানা। অ্যালুমিনিয়াম পার্ক। সেখানেই ছিল আমার প্রজেক্ট। এসব তোর জন্মের আগের কথা।"
"তারপর?" তিন্নি অধৈর্য।
"ছমাস ছিলাম সেখানে। প্রত্যন্ত জায়গা, কোনোকিছুরই সুবিধে নেই। সবথেকে মারাত্মক অভাব হল জলের। বৃষ্টি হয় না। রুখুশুখু দেশ, শুকনো মাটি। টিউবওয়েলে জল ওঠে না। জল না পেয়ে তেষ্টায় মানুষ মরে। সে যে কী কষ্ট!"
"তুমি কী করতে বাবাই? জল পেতে কোথায়?"
"আমি যে বাড়িতে থাকতাম, সেখানে একটা কুয়ো ছিল। সারাদিন বাদে সেখান থেকে দু বালতি জল তোলা হত। সন্ধ্যাবেলায় বাড়ির দাওয়ায় রাখা বালতিতে দেখতাম লাল রঙের জলে কিলবিল করছে পোকা। আমাদের চাকর শামু সেই জল গামছা দিয়ে ছেঁকে মাটির কলসি ভরে রাখত। সেই জলই খেয়েছি।"
"ওয়াক, বাবাই, তুমি খেতে পারলে?" তিন্নি শিউরে ওঠে।
"তেষ্টা যে কী, তুই জানিস না মা, কোনোদিন যেন জানতেও না হয়। প্রার্থনা করি দুনিয়ার সব মানুষের জন্যে পানীয় জলটুকুর অন্তত জোগান থাকুক।"
পলা এতক্ষণ শুনছিল। এবার মুখ খোলে, "আর জল থাকতেও যখন তেষ্টা? গলা শুকিয়ে মরুভূমি? তার ব্যবস্থা কী হবে?"
"জল থাকতে তেষ্টা মিটবে না? কী বলছ মা?"
অর্পণও অবাক, "সে আবার কী?"
"শোনো তাহলে তার গল্প। তোমাদের দুজনকেই শোনাই। বেশিদিন নয়, একশো বছর পিছিয়ে গেলেই হবে। কলকাতার কাছেই এক গ্রাম। অবস্থাপন্ন লোকের বাস। বাসিন্দারা সবাই প্রায় কুলীন ব্রাহ্মণ। সেখানেই থাকে চাটুজ্জেবাড়ির ফুটফুটে সুন্দরী মেয়ে কৃপাময়ী।"
"কোথায় মা? কার কথা বলছ?"
"মাকে শেষে করতে দে না তিন্নি? বলো তুমি পলা।" অর্পণ মেয়েকে থামায়।
"কৃপাময়ীর ন'বছর বয়েস হল। বিয়ে দিতে হবে। বাবা আশুতোষ সমাজের মাথা। তাঁর মেয়ের তিনি গৌরীদান করলেন।"
"গৌরীদান কী মা?"
"পিরিয়ড, মানে ঋতুচক্র শুরু হবার আগেই বিয়ে দেওয়া--তাকে বলে গৌরীদান। যেন স্বয়ং মা দুর্গাকে বালিকাবয়সে সম্প্রদান করা হচ্ছে। তাই ওই নাম।"
"এত বাচ্চা একটা মেয়ের বিয়ে? তাতে আবার মা দুর্গার নাম?"
"কুলীন ব্রাহ্মণ যে, এ নিয়ম মানতেই হবে। দুর্গার মতোই রূপ ছিল কৃপাময়ীর। পাত্র জুটতে দেরি হল না। পাত্রের বয়েস কম, কেউ বলতে পারবে না আশুতোষ বুড়ো পাত্রের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিচ্ছেন। বিয়ের রাতে দেখা গেল বর ঢুলে ঢুলে পড়ছে। সম্প্রদান হল, বর যেন পারলে সেখানেই শুয়ে পড়ে। বাড়ির সবাই ফিসফিস করছে, 'ওমা, শরীরটরির খারাপ নাকি গো?'"
"সত্যি অসুস্থ ছিল?"
"হ্যাঁ রে তিন্নি। কুসুমডিঙায় বর-বউ বসবে, সিঁদুর পরানো হবে, তার আগেই সে শুয়ে পড়ল মাটিতে। চারদিকে হই হই, সবাই মিলে পাঁজাকোলা করে তাকে বিছানায় শোয়ালো। গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই সব শেষ। ন'বছুরে কৃপাময়ী বিধবা হলেন।"
"বিয়ে তো শেষ হয়নি মা? সিঁদুর তো পরানো হয়নি? তুমিই তো বললে?"
"তাতে কী? সম্প্রদান তো হয়েছে। আশুতোষ বিধান দিলেন, 'মেয়ে বিধবা।'"
"তারপর?"
"তারপর তো সেই একই গল্প। চুল কেটে, থানকাপড় পরে, দিনে একবার আতপচালের ভাত দিয়ে নিরামিষ খাওয়া। পূর্ণিমা, অমাবস্যা, একাদশীর উপোস। এমনি এক একাদশীতে কৃপাময়ীর খুব জ্বর। গলা শুকিয়ে কাঠ। তেষ্টায় যেন ছাতি ফেটে যায়। আশুতোষ ভয় পেলেন, মেয়ে যদি জল খেয়ে ফেলে? জ্বরের ঘোরে যদি তেষ্টার জ্বালা সহ্য করতে না পারে? কৃপাময়ীকে আটকে দিলেন ঘরে।"
"মা?!" তিন্নির গলা চিরে আর্তনাদ। বালিকা কৃপাময়ীও কি এমনিই আর্তনাদ করেছিলেন?
"ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার সময় আশুতোষ একবার চোখ বুলিয়ে নিচ্ছেন ঘরে, কোনো জলের জায়গা পড়ে নেই তো? নাহ। নিশ্চিন্ত হয়ে বেরিয়ে যাবেন, চোখে পড়ল ঘরের কোণে রাখা আছে জল-ভরা গাড়ু। সে জল শৌচের কাজে লাগে। গাড়ুটা সরিয়ে নিলেন আশুতোষ। বলা তো যায় না..."
অর্পণের চোখ বিস্ফারিত, হাত মুঠি পাকিয়ে গেছে। সেও যে মেয়ের বাবা!
পলা বলে চলে, "কৃপাময়ী দেখল সব। কথা বলার ক্ষমতাও আর নেই। বাড়ছে গায়ের তাপ, বুজে আসছে চোখ, বালিকা নেতিয়ে পড়ছে, আর বেশিক্ষণ সে যুঝতে পারবে না। হঠাৎ গায়ে ভিজে বাতাসের স্পর্শ। ঠিক যেন মায়ের নরম হাতের আদর। কষ্টে চোখে খুলে কৃপাময়ী দেখে আকাশ ভেঙে নেমেছে বৃষ্টি। জানলা দিয়ে আসছে ভিজে হাওয়া। জলের ছাট ঢুকে এসেছে জানলা দিয়ে। মেঝের ওপর জলের ফোঁটা।"
বাবা আর মেয়ে দুজনেই স্তব্ধ।
পলা একটু দম নেয়, নিজেকে গুছিয়ে নেয় বোধ হয়। তারপর বলে, "ছোট্ট কৃপাময়ী কোনোমতে বিছানা থেকে নামে, হামাগুড়ি দিয়ে যায় জানলার কাছে। জিভ দিয়ে চেটে নিতে থাকে জীবন। জলই জীবন যে।"
"কৃপাময়ী কে মা?" তিন্নির চোখে জল।
"তোর দিম্মা, মানে আমার মায়ের পিসিঠাকুমা। এ গল্প আমার মায়ের কাছেই শোনা। কৃপাময়ীই বলেছিলেন আমার মাকে, তাঁর নাতনীকে। কৃপাময়ী বেঁচে ছিলেন অনেকদিন। আমি আমার মায়ের কোলে জন্মেছি, দেখে গেছেন। বড় ভালোবাসতেন আমার মাকে।"
ঘর জুড়ে তখন শুধুই নৈঃশব্দ্য।