• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪৪ | ডিসেম্বর ২০০৯ | গল্প
    Share
  • কায়েন বায়েত (`বিজুদা সিরিজ'-এর পঞ্চম গল্প) : ভবভূতি ভট্টাচার্য

    একখানি সাধারণ প্ল্যাস্টিকের চিরুনি । বড় সাইজের । আর একটি খড়খড়ে ট্রেসিং পেপার--- ফোটো-এলবামের পাতার ভাঁজে ভাঁজে যেমনটা দেওয়া থাকে, সেরকম । ঐ ট্রেসিং পেপার দিয়ে চিরুনিখানি মুড়ে দু'হাতে মাউথঅরগ্যানের মত ঠোঁটের সামনে ধ'রে হালকা ফঁংউ দিয়ে দিয়ে বাজনা বাজানো--- সুর তোলা । শুনতে অনেকটা মাউথঅরগ্যানের মতই লাগছে বটে --- জম্জমে ! আর বিজুদা এই `দিশি' মাউথঅর্গানে সুরও তুলেছেন সেই বিখ্যাত সাপুড়ে-বাঁশির --- "মন ডোলে মেরা তন ডোলে মেরে....।" আর সামনে বসা শিশুর দল মগ্ন হয়ে তালে তালে ঘাড় দোলাচ্ছে, সঙ্গে আমরাও !

    এরপর হল "চল্‌ চল্‌ চল্‌, ঊর্ধ গগনে বাজে মাদল" থেকে "ও তোতা পাখি রে..... ।" আমরা বেশ মজে গেছি এই নতুন বাজনায় । এ'হেন সামান্য বস্তু দিয়েও এ'রকম মন-মাতানো সুর তোলা যায়, আর শ্রোতাদের মুগ্ধ করে রাখা যায় ! গান থামলে সীমা সে কথাটা বলেই ফেলল, আর বিজুদা ভুরু তুলে এক হাসি ছঁংউড়ে বললেন, "চমত্কার এক কাপ মেজাজি চা বানাও দেখি দিদি, এ'বাজনার হদিশটা দেবো ।"

    হদিশটা অবশ্য বিজুদাকে দিতে হল না । আমাদের ঐতিহাসিকমশায়ও তথ্য কম রাখেন না ।

    "কেন, এ'বাজনাটা আপনারই আবিষ্কার নয় ?"--আমার এ' প্রশ্নের উত্তরে শ্যামল বলল, "এটা আদতে এক ক্যারিবিয়ান বাজনা নয়, বিজনবাবু ? নামটা......।"

    "কাজু । বা তার কাছাকাছি একে কৌম-কাজু বলা যেতে পারে, কারণ চিরুনি দিয়ে বাজানো হচ্ছে । ওয়েস্ট ইণ্ডিজের মার্টিনিক দ্বীপে কালোমানুষের হাতে এর জন্ম । যুগে যুগে মেহনতি মানুষ সারাদিনের পরিশ্রমের শেষে শরীর-মন জুড়িয়ে এসেছে সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে । তাতে ভারিভুরি উপকরণ কিছু না হলেই যে চলবে না তা নয় । আমাদের দিশি ভেঁপুবাঁশি শুনেছ, অয়নবাবু, একতারা ? মেহেরপুরের এক বাউলের কাছে বাল্যকালে একবার শুনেছিলাম, আজও কানে লেগে আছে । আচ্ছা, এবার এ'সুরটা শোন........। "

    এ'সুরটা আগে কোনোদিন শুনিনি । লোকসুর, মেঠো । মন উদাস করায় । সুর শেষ হতেই নীতিন লাফিয়ে উঠল, "দাদা, ইহ্‌ জরুর কিসি থাই সুর হোগা । অভি অভি কিসি থাই ফিল্ম মেঁ সুনা, ফিল্ম ফেস্টিভাল মেঁ । মগর উহ্‌ ইন্সট্রুমেন্ট তো দিখনে মেঁ আজীব সা থা !"

    "তাই ? তাই ? সত্যি বলছিস ?" বিজুদা বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন নীতিনের এই সামান্য কথা শুনে । "কোন্‌ ফিল্ম রে ? এখনও চলছে ? আমায় দেখাতে পারিস ?" বলতে বলতে চুপ করে গেলেন শ্রীবিজনবিহারী সরকার --- বারান্দা পেরিয়ে সুদূরে চলে গেছে তাঁর দৃষ্টি ।

    লক্ষণটা আমাদের অপরিচিত নয় । এমন কি কচিকাঁচারাও ধরতে পেরেছে । রূপা তার মায়ের গা-ঠেলে কিছু ইঙ্গিত করল । ঠারেঠারে চোখ চাওয়া-চাওয়ি আমি-অয়ন-সুমিও করেছি । তারপর আমাদের গুটিগুটি ঘিরে আসা বিজুদার কুর্সিখানির চারিভিতে । বিজনদার অভিজ্ঞতা-মালিকার আরেকখানি মোতি আজ খসবে বলে মনে হচ্ছে ।

    বিজুদাকে আজ আর আমাদের কোনো উপরোধ করতে হল না । উদাসস্বরে কোন্‌ অতীত থেকে যেন ভেসে আসতে শুরু করল বিজুদার কন্ঠ :

    "গল্প আছে বৈ কি রে ! এ' থাই বাজনার পেছনে এক দীর্ঘ গল্প আছে ।

    এ'ঘটনার শুরুয়াৎ বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে । পটভূমি উত্তর-পূর্ব থাইল্যাণ্ডের মেকং নদীতীরে ঈসান প্রদেশ । চারিদিকে গভীর জঙ্গল, নিকটেই ফেটচাবুম পাহাড়, এপাশে ফু ত্রক্রাদুং শৃঙ্গ । প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অপূর্ব । জনবসতি অত্যল্প, ছোট ছোট আদিবাসী গ্রাম ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে - ইপুম, পোং, না-হো, না-দি । নিকটবর্তী শহর বা গঞ্জ বলতে দান সাই । প্রচুর বৃষ্টিপাত, নানা প্রজাতির ফুল, লতা, গাছ-গাছালি, জীবজন্তু, পশুপাখি, সরীসৃপ । পরে এ'অঞ্চলে "ফু-ক্রাদুং জাতীয় অরণ্য" হয়েছে --- এখন অনেক টুরিস্ট যায় । কিন্তু সেই বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে এই অঞ্চল ছিল ঘন জঙ্গলাকীর্ণ । সেই জঙ্গুলে পথ দিয়ে এক বিদেশি যুবক চলেছেন তাঁর মৃত বন্ধুর এক নিকটাত্মীয়ের খোঁজে --- কর্তব্যের খাতিরে । সম্পূর্ণ অপরিচিত দেশ । বিকেল হয়ে এসেছে । ভিয়াঙ্গচান পেরিয়ে মেকং নদী বেয়ে আরও পশ্চিমে এসে চিয়াং খাঙের ঘাটে বড় স্টিমার ছেড়ে শাখানদী লোইই-তে ঢুকেছেন দেশি-নৌকা করে । ব্যাঙ্কক থেকেই তাঁর সঙ্গী এক লাও-লোম উপজাতীয় ভৃত্য । সে-ই সাথী, বন্ধু ও পথপ্রদর্শক । এই শেষ-বিকেলে সেই বিদেশী ভারতীয় যুবকের বাক্স মাথায় করে পিছে পিছে চলেছে সে-ই । এমন সময় ---------

    কচি কাঁচার দলের উসখুসে গল্পে যতি পড়ল । বিজুদার গল্প শুরু হয়ে গেছে তবু বাচ্চারা গালে হাত দিয়ে তন্ময় হয়ে বসে শুনছে না --- এমনটা মনে পড়ে না । গুগ্গুল তো সটান বলেই ফেলল, "জেঠু, তোমার আজকের গল্পটা ভালো লাগছে না ।"

    সুমি সামলে দিলো, "মানে........আপনি শুরু থেকে বলুন, দাদা ।"

    "শুরু থেকেই তো বলছি রে ! ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের আগে তো এ'-গল্পের শুরুই হয় নি । আচ্ছা, উঁ.....উঁ.....উ......উঁ........, একটু ভেবে নিয়ে বলেন বিজুদা, "তোমাদের ভালো লাগছে না ? ঠিকাচে ঠিকাচে গল্পটা শুরু থেকে নয় মাঝখান থেকে বলি তাহলে, শোনো । নতুন করে গল্প শুরু করেন বিজনদা :

    "আমাদের ছোটবেলায় গরমের ছুটিতে মামাবাড়ি বেড়াতে যাবার একটা চল ছিল । দু'-একবার খুড়তুতো ভাই পল্টুর মামাবাড়ি কালনাতেও আমরা গেছি তাদের বাগানের আম খাবার নেমন্তন্নে । তবে, বেশিরভাগই যাওয়া হত বরাহনগরে গঙ্গার ধারে আমার মামাবাড়িতে --- আমার জেঠতুতো খুড়তুতো ভাইবোনের দঙ্গলও প্রায়শ:ই সামিল হত । আর এ' তোদের সকালে গিয়ে বিকেল-বিকেল ফিরে আসা নয় । একবার মামাবাড়ি যাওয়া মানে অন্তত: দুটি সপ্তার ধাক্কা । আমার মামাবাড়ির আদিদেশ ছিল হুগলিজেলার এক অজ পাড়াগাঁয়ে । সেখানেও আমরা প্রায়ই যেতাম । অনেক সময় এই বরাহনগরের বাড়িতে এসে তারপর সদলবলে সেই গ্রামে যাওয়া হত ।

    বাড়িটার জন্ম ১৯২৭-এ' ------- বাড়ির ছাদের পাঁচিলে উঁচু উঁচু সিমেন্টের হরফে লেখা । আমার দাদামহাশয়ের শেষ বয়সের আবাস । মানিকতলার ভাড়া বাড়ি ছেড়ে সপরিবার এখানে উঠে আসেন ১৯৪০-এর গোড়ায় । শোনা যায়, "লীলাপ্রসঙ্গ"-কার স্বামী সারদানন্দজীর পদধুলি পড়েছিল এ'বাড়িতে ; বাড়ির আদি মালিক পরমহংসদেবের এক গৃহীশিষ্য ছিলেন কিনা । পুরনো ধাঁচের সাবেককালের বাড়ি । বড় বড় দরোজার সাইজের জানলা সব --- খড়খড়ি দেওয়া । লাল সিমেন্টের তকতকে মেঝে । মস্ত ছাদ --- গঙ্গা দেখা যায় । হেঁটে দু'পা । দিদিমার প্রতিদিন প্রাতে গঙ্গা নাওয়া চাই-ই --- শীত-বর্ষা ভেদ নেই । মামারা একেক খুদে মিহির সেন ! মামাবাড়ির সেই আনন্দের কোনো তুলনা হয় না রে পটলচন্দ্র"--- হাল্কা মেজাজে সুদীপকে উদ্দেশ্য করে বলেন বিজুদা । বিজুদার গল্পে বারবার উঠে আসা এই শৈশবের একান্নবর্তী পরিবারের স্মৃতি আমরা বড় উপভোগ করি । সীমা বলে, সেও শৈশবে কিছুটা দেখেছে তাদের বেনারসের বাড়ির একান্নবর্তী আগরওয়াল পরিবার ।

    বিজুদা বলে চলেন, "বুঝলেন অধ্যাপক মশায়, সেই বাড়িটাই ছিল এক গল্পের আকর । একতলা দোতলা মিলিয়ে চার-চার আটটা ঘর । মস্ত ছাদ । মামাবাড়ির মোট জনসংখ্যা তেইশ । চার মামা, তাঁদের খুচরো পুত্রকন্যা, দিদিমা, রাঁধুনি বামুন, রামধন চাকর সমেত । মাসতুতো ভাই-বোনেদের আগমনও লেগেই থাকত । তবে আমাদের আজকের গল্প তাদের কারোকে নিয়ে নয়, অন্য আরেক অনাত্মীয়জনকে নিয়ে ।

    মামাবাড়ির একতলায় একদম পুবের কোণের ঘরে থাকতেন এক ভদ্রলোক । তিনি কিন্তু কোনো দূরসম্পর্কের আত্মীয়-টাত্মীয় নন, ভাড়াটে তো নন-ই । আমাদের বাল্যস্মৃতিতে তাঁর অবয়ব একই রয়ে গেছে --- বয়স যেন বাড়ে নি । রোগা সিড়িঙ্গে বেঁটে খাটো এক পুরুষ । দেখে বয়স অনুমান করা শক্ত --- বছর-পঞ্চাশ-টঞ্চাশ হবে হয়ত । তোবড়ানো গাল, চোখে চশমা নেই । দাড়ি গোঁফ সর্বদা পরিষ্কার কামানো । সাদা ধুতিটি লুঙ্গি করে পরেন । গায়ে হাফ হাতা সাদা গেঞ্জি । অত্যন্ত কম কথা বলেন, কিন্তু মুখখানা সর্বদা হাসিহাসি । মুখে মঙ্গোলিয়ন ছাপ স্পষ্ট---দেখে মনে হয় আসাম-মণিপুরের মানুষ হবেন হয়ত । আর ওনার অবয়বের মধ্যে সবচেয়ে লক্ষণীয় ছিল কপালের ঠিক মাঝখানে 'অতএব' চিহ্নের মত তিনখানি ছোট ছোট আঁচিল । এমনটি আর পৃথিবীর কারোর দেখিনি । তোমরা কেউ দেখেছ ? নেপথ্যে আমরা তাকে 'অতএব মামা' বলে উল্লেখ করতাম, তবে মামাবাড়িতে তিনি যে সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন, তাতে তাঁর সম্বন্ধে এ'হেন ব্যাঙ্গাত্মক মন্তব্য এক গর্হিত অপরাধের মধ্যে পড়ত --- সে-সম্বন্ধে আমরা যথেষ্ট সজাগ ছিলাম । ওনাকে মামাবাড়িতে সবাই "মহীবাবু" বলে উল্লেখ করত, ভালো নাম মহীতোষ-টোষ হবে বোধ হয় । দিদিমা প্রতিদিন প্রাতে গঙ্গাস্নান করে ফিরলে উনি মাতৃশ্রদ্ধায় তাঁর পায়ে হাত দিয়ে একখানি প্রণাম করতেন । আমার বড়-মেজমামারাও দেখতাম মহীবাবুকে জ্যেষ্ঠভ্রাতার সম্মান দেন । একাহারি মানুষ ছিলেন মহীবাবু । স্বপাক আহার । প্রতিদিন শেষ-দুপুরে বারন্দার কোণে এক তোলা উনুনে উনি সামান্য চালেডালে ফুটিয়ে নিয়ে খেতেন সবার অলক্ষ্যে । আর সারাদিন ওনার একতলার কোণের ওই ঘরখানিতে খুট্খাট্‌ কী যে করতেন --- আমাদের কাছে তা এক পরম কৌতুহলের বিষয় ছিল । যদিও সে বিষয়ে সামান্য ঔত্সুক্য প্রকাশ করা বা ওনার ঘরের দিকে উঁংইকঝঁংউকি দেওয়া কঠোরভাবে মানা ছিল ।

    কারও সাতে-পাঁচে থাকেন না মহীবাবু । তাঁর কোনো আত্মীয়-স্বজন নেই, কারোকে কখনও তাঁর কাছে আসতে দেখা যেত না । উনিও কখনও কোথাও যেতেন না । কেবল রোজ বিকেলে গঙ্গার পাড় ধরে হন্হন্‌ করে হাঁটতে দেখা যেত তাঁকে ঘন্টাখানেক ধরে । আর প্রায়ই সন্ধেবেলা ছাদের কোণে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এক বাঁশি বাজাতেন মহীবাবু । এত লম্বা সে-বাঁশি, বসে বাজানো যায় না -- প্রায় ফুট চারেক । সানাই বা ক্লারিওনেটের মত মুখের সামনে লম্বালম্বি ধরে নয়, বেণুর মত আড়াআড়ি ধরেও নয়, মুখের সামনে প্রায় খাড়াখাড়ি দাঁড় করিয়ে মাঝের অংশে ফঁংউ দিতে হত । অদ্ভুত-দর্শন সে বাঁশির । ওপরে-নিচে দুই সারিতে চার চার আট, চার চার আট --- ষোলোটি সরু সরু বাঁশের ফাঁপা নল । মিহি ঘেসো দড়ি দিয়ে বাঁধা । মাঝে এক ফাঁপা কাঠের গাঁটের সঙ্গে গালা বা মোম দিয়ে আটকানো । দু' হাতে মুখের কাছে ধ'রে মাঝখানটায় ফঁংউ দিয়ে দিয়ে বাজানো হত । মোহিনী সে সুর এবং স্বর । কানে লেগে যায়, মনে ধরে যায় । আমাদের বাল্যস্মৃতিতে গঙ্গাতীরের সেই অট্টালিকার সঙ্গে রহস্যময় `মহীবাবু' ও তাঁর সেই অচেনা বাঁশির অদ্ভুত সুর ওত:প্রোতভাবে জড়িয়ে আছে । অনেকপরে, `বড়' হয়ে, তখন কলেজে পড়ি, সাহস করে মা-কে দিয়ে মহীবাবুর সেই বাঁশিখানির নাম জেনে নিয়েছিলাম আমি ।

    বড়-মেজ মামাকে মাঝেমধ্যে মহীবাবুর সঙ্গে কিছু পরামর্শ করতে দেখেছি । তবে আমার মা-মাসি-মামাদের মধ্যে একমাত্র আমার মাকেই মাঝে মাঝে ওনার সঙ্গে গল্প করতে শুনেছি আমি । কোনো কাজ পড়লে উনি রিন্রিনে গলায় "নীলি" বলে আমার মাকে ডেকে নিতেন । মা-ও উচ্চৈ:স্বরে হেসে হেসে ওনার সঙ্গে কথা বলতেন । ছোটবেলা একদিন মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, "মা, মহীবাবু কী করেন ?" আমার এই নিরীহ প্রশ্নে মা মস্ত চোখ পাকিয়ে বলেছিলেন, "খবর্দার ! ওঁনাকে কক্ষনো বিরক্ত করবে না ! " যা: বাব্বা: ! বিরক্ত করলাম কখন ? অনেক বছর পরে, তখন স্কুল ছেড়ে বেরিয়েছি, মা নিজে থেকে একদিন ওনার কাছে আমায় নিয়ে গিয়ে বলেছিলেন, "ছেলে এবার ম্যাট্রিক পাশ করে বেরোলো । ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছে ।" আমি ওনার পদস্পর্শ করে প্রণাম করলাম । মহীবাবু হাসিহাসি মুখে তাঁর ঘোলাটে চোখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, "বেশ !" বলে দু'আঙুলে আমার গালটা একটু টিপে দিয়ে ছিলেন ।

    ইলেক্ট্রিক শক্‌ খাওয়ার মত চমকে উঠেছিলাম আমি ওনার স্পর্শে ! সত্যি, ওনার আঙুলে বিদ্যুৎ !!

    মা বুঝতে পেরেছিলেন । ঘরে ফিরে এসে জিজ্ঞেস করেছিলাম, "মা, উনি কে ?" । মা হেসে বলেছিলেন, "কেন, শক্‌ লেগেছে ?"
    "তু....তুমি কী করে জানলে ?" আমি দারুণ অবাক হয়েছিলাম ! মা চুপ্‌ ।
    "বলোনা মা", আমি নাছোড় । "ছোটবেলা থেকে ওনাকে দেখে আসছি এ'বাড়িতে । কেউ ওনার সম্বন্ধে কিছু বলতে চায় না । উনি কে ? কী সূত্রে উনি থাকেন এ' বাড়িতে ? ওনার রহস্যটা কী ?"
    "কেন, পরেশ বলেনি তোদের ? আর পল্টু দেখেনি কিছু ?" মা কাপড়-জামা পাট করতে করতে গম্ভীরভাবে বললেন ।

    "কী বলব তোদের", বিজুদা বলে চলেন, "কলেজে ঢুকে তদ্দিনে বেশ লায়েক হয়ে উঠেছি । কিন্তু সেই বয়সেও আমি মায়ের এ' কথাটা শুনে ভয়ে পাংশু হয়ে গেলাম । মা হাসছেন । মা তাহলে জানতেন সব । কৈ কিছু বলেন নি তো এত বছরেও ?

    ***


    ঘটনাটা তার বছর পাঁচেক আগের । আমি তখন ক্লাস সিক্স-টিক্সে পড়ি বোধহয় । যথারীতি গরমের ছুটিতে বরাহনগরে মামাবাড়ি বেড়াতে আসা হয়েছে । আমার ছায়াসঙ্গী খুড়তুতো ভাই পল্টুও রয়েছে সাথে ।

    এক বিকেলে ছাদের দৈনিক গজল্লা চলছে ছ'-সাত ভাই বোন মিলে । হঠাৎ পরেশমামা এসে হাজির । পরেশমামা আমার ছোটমামার পাড়াতুতো বন্ধু । রোগা সিড়িঙ্গে চেহারা, নিকনেম 'মিনি নবদ্বীপ হালদার' । ম্যাট্রিক ফেল, বেকার । দুনিয়ার যত উদ্ঘুট্টে খবর আছে তার কাছে, আর তার প্রত্যেকটা বিষয়ে তাঁর নিজস্ব ফাইনাল মতটাও আছে --- সে মোহনবাগানের ফুটবল বাজেট হোক্‌ বা উত্তমকুমারের চুলের ছাঁট । যদিও তার প্রত্যেকটা বিষয়ই আমাদের কাছে এমনিতে প্রায়-ট্যাবু ছিল, আর তাইজন্যেই পরেশমামার গল্পের আকর্ষণও আমাদের কাছে বড্ড বেশি ছিল । পরেশমামা প্রতিদিন হঠযোগ করত আর নিজেকে এক উঁচুদরের যোগী বলে মনে করত !

    সেদিন হঠাৎ কথাপ্রসঙ্গে মহীবাবুর কথা উঠেছিল । পরেশমামা তার স্বভাবসিদ্ধ সবজান্তা ঢঙে বলে উঠল, "তোদের ওই মহীদোল সত্যসাই সম্বন্ধে এই শর্মার চে' বেশি আর কে জানে র্যা ?" তার ডান হাতের বুড়ো আঙুলটি ঘোরানো নিজের বুকের দিকে । আমরা ভাই-বোনেরা ঘাবড়ে গেলাম । কারণ এ'বাড়িতে মহীবাবু সম্বন্ধে এ'হেন তির্যক মন্তব্যের যে ঠাঁই নেই সেটা সেই বয়সেও আমাদের বুঝতে অসুবিধে হয়নি । আমাদের এ'হেন ভেবড়ে যাওয়াটা বোধ হয় পরেশমামাকে আরও বেশি উস্কে দিয়ে ছিল । পাঁচ-সাতটা সুকুমার বাচ্চা ছেলেপুলের সামনে নিজের বিদ্যে জাহির করতে এ'হেন চরিত্ররা বিশেষ আনন্দ পায় । আমাদের সকলকে হাতছানি দিয়ে কাছে ডেকে গোল হয়ে বসে পরেশমামা ফিস্ফিসে রহস্য-গলায় বলল, "তোদের বলতে পারি । কিন্তু কথাটা যেন পাঁচকান না হয় ।" আমরা ভীত, চুপ্‌ । রহস্যের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে । পরেশমামা বলে চলে, "এই মহীবাবু আসলে এক জন গুপ্তখুনী ! শ্যামের জঙ্গলে নিজের বউকে গুমখুন করে এখানে পালিয়ে এসে লুকিয়ে আছে । তোদের দাদুর শিষ্য ছিল । তিনিই আশ্রয় দিয়ে গেছেন । ব্যাটা কিছু মন্ত্রতন্ত্র জানে । তাই টঁযা-ফোঁ করছি না । ওর পঁযাটরায় এক জ্যান্ত পাথর আছে । আর এক প্রাচীন পঁংউথি । এ' দুই-ই হল ওর শক্তির উত্স । ও' দুটো হাতাতে পারলে.......।"

    "পঁযাটরা কী ?" পল্টুর বেমক্কা প্রশ্ন । ভাইটি আমার সারাদিন কল্পনার জগতে বিচরণ করে । এ'হেন অলীক গল্পের ভণিতা ওর কল্পনাকে উসকে দিয়েছে, বুঝতে পারলাম, কারণ পল্টুর চোখ জ্বলজ্বল করছে !

    "এ--ই দ্যাকো । এই দুধের শিশুটাকে কী করে বোঝাই বলত ? পঁযাটরা হল........।"

    এমন সময় সিঁড়িতে বড়মামীর পায়ের শব্দ শোনা গেল, "কী রে, সন্ধে তো হয়ে এলো । তোরা কখন পড়তে বসবি শুনি ?" ওমনি আমরা সবাই পরেশমামাকে ছেড়ে দুড়্দাড়্‌ করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে নিচে পালালাম ।

    কিন্তু, পরেশমামার এ' গল্প যে পল্টুর মনে গভীর দাগ রেখে গেছে, তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেলাম দু'-দিনের মধ্যেই ।

    সেদিন সবে বিকেল হয়েছে । আমি একা ছাদে উঠে এসেছি । অন্য ভাইবোনেরা সব আসবে, তখন গাদি খেলা হবে, বা পিট্টু । এমন সময় হঠাৎ পল্টু সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে এসে "ছোড়দা গো" বলে আমায় জড়িয়ে ধরে প্রায় অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল । ঘটনার আকস্মিকতায় আমি হকচকিয়ে গেছি । একবার "মা" বলে চীত্কার করে উঠতে গিয়েও কী ভেবে চেপে গেলাম । যদিও পল্টুর চোখ-টোখ প্রায় উল্টে গিয়ে মুখ দিয়ে ফেনা বেরোচ্ছে ! কোনো কিছুতে অসম্ভব ভয় পেয়েছে, বোঝা গেল । কী করি ? বড়দের কারোকে ডাকবো ? ছাদের কোণে গঙ্গাজলের ট্যাঙ্ক ছিল । সারাদিন তা থেকে জল উপচে পড়েই যায় । তা থেকে আঁজলা ভরে জল এনে এনে পল্টুর চোখেমুখে ছিটিয়ে দিতে খানিকপরে সম্বিৎ ফিরে পেল পল্টু । কিন্তু চোখ তার তখনও ঘোলাটে । আমার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে ।

    আমি এবার ওর কাঁধ ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "কী হয়েছে রে পল্টু ? মনে হচ্ছে বড় কোনো একটা অপাট করে এসেছিস ? কী করে এসেছিস, বল্‌ ।"

    পল্টু এবার ভেউ ভেউ কান্না জুড়ে দিলো, "আমি আর করব না, ছোড়দা । আমি আর কোনোদিন ঢুকব না ওনার ঘরে ।"

    আমি ঠিকই অনুমান করেছিলাম । ভয়ানক রেগে চড় তুলে বললাম, "সেই তুই মহীবাবুর ঘরে ঢুকেছিলিস্‌ ? তোকে না পইপই করে বারণ করা হয়েছিল, কক্ষনো ওনার ঘরে ঢুকবি না ?"

    "আমি আর কক্ষনো করবো না, ছোড়দা । তুমি যেন আর কাউকে বলে দিও না । আমি কিছু চুরি-টুরি করতে ঢুকিনি । আমি কখনও পঁংউথি দেখিনি । তাই ওনার পঁযাটরার মধ্যে পঁংউথি কী জিনিস, তা দেখতে ঢুকেছিলাম । কী আছে জানো ছোড়দা ওনার পঁযাটরার ভেতরে ?" বলে শিউরে উঠে পল্টু থরথর করে ফের কাঁপতে লাগল । আমার রাগ হচ্ছিল ওর অবাধ্যপনায়, আবার ওর শিহরণ দেখে ঔত্সুক্যও কম হচ্ছিল না ।

    "কী দেখলি, বল্‌ ?"




    "তোমায় কী বলব ছোড়দা, মহীবাবু আজ একটু সকাল-সকালই হাঁটতে বেরোলেন দেখে টুলে উঠে দরজার শিকল নামিয়ে ওনার ঘরে ঢুকেছি । পঁযাটরা খুলেই দেখি দড়িবাঁধা সারসার লেখা লেখা তালপাতার বাণ্ডিল । তাতে হাত দিতেই কী যেন সর্সর্‌ করে নড়ে উঠল । পঁংউথিটা নাড়তেই দেখি ছোট একটা কুণ্ডলী পাকানো সাপ ! হঁযা, জ্যান্ত ! নড়ে উঠল । ঘাড়টা তুলতে লাগল । তখন দেখি, তখন দেখি" বলতে বলতে ফের শিউরে উঠল পল্টু, "তখন দেখি, ছোড়দা, ঐ পঁযাটরাটার কোণে এক মানুষের করোটি রাখা রয়েছে মুক্তোর মালা জড়ানো । আর সেই হাড়সর্বস্ব করোটির চোখ দুটো জ্বলজ্বলে, জ্যান্ত ! সাপটা নড়ে উঠতেই করোটিটা ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে ফিরলো । আর সেই জ্যান্ত চোখের পাতা দুটো খুলে গেল ! নীল চোখ --- মেমসাহেবদের মত ! চোখ পিট্পিট করতে লাগল আমার দিকে তাকিয়ে । সম্পূর্ণ জীবন্ত মানুষের দৃষ্টি, ছোড়দা । আর যেই আমি ঘর ছেড়ে পালিয়ে আসতে যাবো, শুনি একটা খিঁক্খিঁকে হাসি । দরজার পাশে দেরাজের ওপর একটা বুক-পর্যন্ত কালো পাথরের মূর্তি রাখা আছে । সেটা দেখি ঘাড় নেড়ে নেড়ে হাসছে আমার দিকে তাকিয়ে, তারও চোখের পাতা পিট্পিট্‌ করছে !!"

    মামাবাড়ির মহীবাবু রহস্যময় মানুষ, জানতাম । কিন্তু সে-রহস্যের দৌড় যে এতোদূর পর্যন্ত, তা তো ঠাহর করিনি ! পল্টুর গল্প শুনে চমকৃত হয়ে গেলাম ! ও' যে এরমধ্যেই বানিয়ে বানিয়ে গল্পটা বলল আমায়, পল্টুর ঘাবড়াহাট দেখে তেমনটা মনে হল না । এখন আমার প্রধান চিন্তা হল, কী করে বিষয়টা সম্পূর্ণ চেপে যাওয়া যায়--- বড়রা যেন কেউ জানতে না পারে । জানলে যে একটা ভয়ানক কাণ্ড ঘটে যাবে, সে-বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ ছিল না । কিন্তু আজ দেখলাম, মা ঘটনাটা জানতেন, কিন্তু কিছু বলেন নি । কী করে জানলেন ?

    ॥ ২ ॥


    বিজুদা চুপ করে যেতেই আমরা ফিরে এলাম উনিশশো ষাটের দশকের গঙ্গাতীরের বরাহনগরের বাড়ি থেকে একবিংশ শতাব্দীর হাইটেক নয়ডার ফ্ল্যাটে । বুঝলাম, একটা টি-ব্রেক চাই । সুমিকে বলতে হয় না । ফ্লাস্ক থেকে ধূমায়িত চা ঢেলে কাপটি ইতো মধ্যেই ধরিয়ে দিয়েছে বিজুদার হাতে । আমরাও প্রসাদ পেলাম । বাচ্চাদের কিন্তু তর সয় না । তারা নির্নিমেষ তাকিয়ে বিজুদার মুখের দিকে --- কখন ফের শুরু হবে গল্পটা ।

    তৃপ্তি সহকারে চা-এর কাপটি নি:শেষিত করে হাসিহাসি মুখ করে আমাদের প্রত্যেকের মুখের দিকে তারিয়ে তারিয়ে, যাকে বলে, 'অবলোকন' করতে থাকেন বিজনদা । মুখে কোনো বাক্যি নেই । সীমা তো বলেই ফেলল তার রাজস্থানী হিন্দিতে, "য়হ্‌ আপকা ইনজাস্টিস হৈ, বিজনদা । আপ কহানী কী বিচ্‌ মেঁ এংজাইটি পয়দা করকে ফির অধুরা ছোড় দেতে হেঁ । হমলোগোঁ কা টেনশন বাড় যাতা হৈ । বোলিয়ে না আগে ক্যা হুয়া ? উহ্‌ নর্মুণ্ড্‌ কিস্কি থী ?"

    "তোদের কে শুনতে বলছে, র্যা ? আমি তো বানিয়ে বানিয়ে আষাঢ়ে গপ্প শোনাতে বসেছি এই শিশুদের । তোমরা নিখরচায় গপ্প শুনতে এয়োচো ? " বিজুদা হেসে বলেন ।

    "আজ আপনি আসছেন জানলে আমি মাটন বিরিয়ানি করে আনতাম " , অনু বলল ।

    হো হো করে হেসে উঠে বিজনদা বলেন, "ঘুষ ? আমায় ঘুষ দিচ্ছিস্‌ ? মাটন বিরিয়ানি ? চলবে না । আমি ঝিঙে-পোস্ত খাব ! "

    এই নিয়ে আমিষ-বনাম-নিরিমিষ্যির ঠোক্কর চলল কিছুক্ষণ । জ্যান্ত নরমুণ্ডের রহস্যময় আবহাওয়া যখন একটু পাতলা হয়ে এসেছে তখনই হঠাৎ খেই ধরে শুরু করে দিলেন বিজনদা :

    আজ থেকে শতাধিক বত্সর আগে এক বাঙালি ডাক্তার এক বৃটিশ সওদাগরী জাহাজের সঙ্গে চিনদেশে গিয়েছিলেন । সে বৃটিশ জমানার কথা । তখনও দিল্লী নয়, কলকাতাই বৃটিশ ভারতের রাজধানী । রবীন্দ্রনাথ তখনও নোবেল পাননি, মোহনবাগান তখনও শিল্ড জেতেনি, বিশ্বযুদ্ধ কাকে বলে পৃথিবী তখনও জানেনা । এঁনার সম্বন্ধে পূর্বে কিছু বলেছি আমি তোমাদের । ইনি ছিলেন আমার দাদামহাশয়, মায়ের বাবা, জন্ম ১৮৭৩-এ । এঁনার হাতে লেখা এক দিনলিপি আছে, ইংরিজিতে নয়, বাঙলায় লেখা । না হে, পাবলিক ডোমেইনে রাখা নেই, ব্যক্তিগত সম্পত্তি । উনি একদশককাল ধরে চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ঘুরে এসেছিলেন । ডায়েরিতে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ অভিজ্ঞতা লেখা আছে । নিজের কথা উনি কমই লিখেছেন । বেশি লিখেছেন চীন-মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়া-শ্যামদেশের মানুষজনের কথা, তাদের নানান আচার-আচরণ, খাওয়া-দাওয়া, জীবনধারণ পদ্ধতি --- চিনে-মেয়েদের ফুট-বাইণ্ডিং, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির প্রবল মিশ্রণ । জানিস তো, ইন্দোনেশিয়ার ছিয়াশি শতাংশ মানুষ মুসলিম, কিন্তু তাদের নাম এখনও সংস্কৃত ভাষা-উদ্ভুত হয়ে থাকে, যেমন ধর, শ্রীমতি মেঘবতী সুকর্ণপুত্রী । প্রধানমন্ত্রী কিন্তু ধর্মবিশ্বাসে মুসলিম ছিলেন । মুসলিম হলেই যে আরবি ভাষার নামই হতে হবে, যেমন হাসিনা বা আবিদ---তার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই ।

    অত্যন্ত প্রচারবিমুখ অন্তর্মুখী মানুষ ছিলেন এই ডাক্তার সন্মথনাথ বসু । ডাক্তারি ছাড়াও প্রাচীন তন্ত্রবিদ্যা ও যোগশাস্ত্রের চর্চা করেছেন । সে-যুগে 'মাইন কাম্ফ' পড়ে হিটলারকে চিঠি লিখেছিলেন বার্খটেসগাডেনের ঠিকানায়, সে চিঠির কপি আমি দেখেছি । শেষবয়সে কম্যুনিস্ট আন্দোলনের প্রতি প্রবল উত্সাহী হয়ে ওঠেন, তখন রাহুল সাংকৃত্যায়নের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ । যাক্‌, সে অন্য গল্প । তা, দাদামহাশয় যে নিজের কথা জাহির করার অত্যন্ত বিরোধী ছিলেন, নিজের ডায়েরিতেও বিশেষ কিছু প্রকাশ করেননি, তা থাইল্যাণ্ডে এই 'মহীবাবু'-রহস্য ভেদ করতে গিয়ে আমি জানতে পারি ।

    "ভাবছিস্‌ কোথা থেকে কী ?! কোথায় বরাহনগরের গঙ্গার ধারে মহীবাবুর বাঁশি বাজানো, আর কোথায় উত্তর থাইল্যাণ্ডের প্রত্যন্ত গ্রামে পঙ্গপাল আক্রমণের গল্প ! তারসঙ্গে মহীবাবুর ডেস্কোর মধ্যে কাটা নরমুণ্ডের কী সম্পর্ক ? হয় হয় বাপু, সব হয় । সবই সংযোগ হে সবই সংযোগ ! কোথা থেকে কী যে হয়ে যায়, কার পেট থেকে কী যে কখন বেরিয়ে পড়ে --- কে জানে ? আমি তো আর এ'সব কিছু ভেবে সেবার থাইল্যাণ্ড যাইনি, যা ঘটে গেছে তা ভবিতব্য ।"

    আমরাও কম অবাক হইনি । থাইল্যাণ্ডের গ্রামে পঙ্গপাল আক্রমণ আবার কোথ্থেকে এলো ? এবার আমার দিকে ফিরে বিজুদা শুধোন, "হঁযা রে, সেই যে সেবার এনক্রিপশনের এক সেমিনারে ব্যাঙ্কক গেলাম, সেই যাতে প্রোফেসর এডেলম্যান এসেছিলেন, তুই তখন আমাদের কোম্পানি জয়েন করেছিলিস কি ?"
    "না", ঘাড় নাড়ি আমি, "আমি তখনও জয়েন করিনি । "
    "হঁযা", বিজুদা বলে চলেন, "কয়েক বছর আগে গেছি ব্যাঙ্ককে । তিনদিনের সম্মেলন । খুবই ফলপ্রদ হয়েছিল আমার সেই সম্মেলনে যোগদান । পাবলিক কী এলগোরিদমের ওপর অনেক নতুন কিছু শিখি এই সেমিনার থেকে । তখনও জানিনা অচানক এই ব্যাঙ্ককে এসে আমার ছোটবেলার এক অজানিত রহস্যের কিনারা হয়ে যাবে ।

    এখানে এসে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল আমার এক পুরনো বন্ধুর সঙ্গে -- পান্না, পান্না সুধাম । পান্না থাইল্যাণ্ডের ছেলে, জার্মানিতে আমার পোস্ট গ্রাজুয়েশনের সহপাঠী ছিল, শেষের দিকে ওর সঙ্গে আমার খুব ভাব হয়ে গিয়েছিল, তার কারণ ও তখন আমাদের হস্টেলেই এসে উঠলো আর ভারত সম্বন্ধে ছিল দারুণ উত্সাহী । এখন এক অস্ট্রেলিয় কোম্পানিতে চাকরি করছে পান্না । পান্নার বাড়ি থাইল্যাণ্ডের উত্তরে খোন-কায়েন শহর ছাড়িয়ে ।

    বহু বছর পরে পান্নার সঙ্গে দেখা । অনেক গল্প হল । আমাদের ক্লাসের ছেলেমেয়েরা সব কে-কোথায় ছড়িয়ে আছে তার খোঁজখবর নেওয়া হল । বললাম, " পান্না, তুমি তো আর কলকাতায় এলে না ।"
    "তুমিও তো বলেছিলে আমাদের মেকং নদী দেখতে আসবে ।"
    বললাম, " কপালে থাকলে যাবো ।"

    কথাটা হালকা ভাবে বলেছিলাম বটে, তখনও জানিনা যে ঘটনা-পরম্পরা দু'দিনের মধ্যেই আমায় টেনে নিয়ে গিয়ে ফেলবে উত্তর থাইল্যাণ্ডের ঈসান প্রদেশের সেই প্রত্যন্ত গ্রামে !

    এ'কথা সে-কথার পর পান্না হঠাৎ বলে উঠল, "বিজু, নোভেম্বর মাসে থাইল্যাণ্ডে এলে আর লয় ত্রক্রাথং উত্সব দেখবে না ? কালই তো পূর্ণিমা !"
    " লয় ত্রক্রাথং ? সে আবার কী ? নাম শুনিনি তো কোনোদিন ?" বলি ।
    "ভেলা ভাসানোর উত্সব ! আলোর রোশনাইয়ের মধ্যে সমস্ত রাগ-দু:খ-অপ্রাপ্তিকে ভেলায় ভাসিয়ে দিয়ে নতুন বছর শুরু করা । আদতে আমাদের উত্তর থাই-য়ের উত্সব, তবে এখন সারা থাইল্যাণ্ডে ছেয়ে গেছে । বিশেষত: আয়ুথ্থায়ার লয় ত্রক্রাথং তো জগৎ বিখ্যাত ! থাইল্যাণ্ডের লয় ত্রক্রাথং দেখবে যখন, ব্যাঙ্কক কেন, আয়ুথ্থায়া চল--- প্রাচীন রাজধানী । জানো তো বিজু, আয়ুথ্থায়া বা আয়ুদ্ধায়া নামটা এসেছে তোমাদের অযোধ্যা থেকে ?"

    ব্যাঙ্কক থেকে আয়ুথ্থায়া শহর ঘন্টা খানেকের ড্রাইভ । ট্রাফিক জ্যামে ফেঁসে আরও আধাঘন্টা গেল ।

    পৌঁছে দেখি সে এক এলাহি ব্যাপার । হাজার হাজার মানুষ, আতসবাজি ও আলোর রোশনাই, রঙিন ফানুস ওড়ানো, বাতি জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে নদীতে ছোট ছোট কলার থোড়ের ভেলা ভাসানো । তাতে আবার অনেকে নখ, মাথার চুল কেটে কেটে দিচ্ছে --- ও'গুলো কুলক্ষণের প্রতীক---ভেসে যাক্‌ ! নানান অঞ্চল থেকে কত যে লোক এসেছে, তাদের নানান বেশভুষা, নানান ভাষা --- একটাও বুঝিনা । ঘুরতে ঘুরতে পান্না বলল, ওই দিকটায় চল, আমাদের ঈসান প্রদেশের ক্যাম্প বসেছে ওই দিকে ।"

    "সেখানে যেতেই পান্নার অনেক দেশওয়ালি ভাইয়ার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, আর পান্নাও অগাধ গল্পে ডুবে গেল । এই দিকটা অপেক্ষাকৃত শান্ত । আমি সেই চত্তরেই ঘুরছি । হঠাৎ কানটা আটকে গেল । পাশের তাঁবুতেই কেউ একটা বাঁশি বাজাচ্ছে । থাই লোকসুর । যে-সুর একটু আগেই আমি তোমাদের শোনাচ্ছিলাম কাজুতে বাজিয়ে । সুর ও বাঁশির আওয়াজ দুই-ই আমার আবাল্য পরিচিত --- এ' সেই আমার ছেলেবেলা মামাবাড়িতে শোনা মহীবাবুর বাঁশি ! এ' ভোলবার নয় । দেখি, এক বৃদ্ধমানুষ তাঁবুর গেটের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একমনে বাজিয়ে চলেছেন সে বাঁশি ।

    আমি অনেকক্ষণ একা একা দাঁড়িয়ে শুনছি । পান্না কখন এসে দাঁড়িয়েছে পাশটিতে ।

    "কী, ভালো লাগছে সুরটা ? এ' হল পাক্কা উত্তর থাইল্যাণ্ডের লোক-যন্ত্র । নাম হল........"
    "কায়েন বায়েত ।" বললাম আমি ।

    অবাক হয়ে গেলো পান্না, বলল, "বাব্বা: বিজু ! সে-খবরও রাখো তুমি ? কী করে জানলে ?"

    বললাম আমার ছোটবেলার অভিজ্ঞতার কথা, " ছোটবেলা থেকে এ'বাঁশি আমি অনেক শুনেছি । আমার এক দূর-সম্পর্কের মামাই বলতে পারো, তাঁর কাছে ।"
    "মামা ? তাহলে ভারতীয়রাও কি কায়েন বায়েত বাজায় ?"
    "ভারতীয়....ং.....ংআ মানে, তিনি কি ভারতীয় ছিলেন ? জানিনা । দেখতে তো অসমিয়া বা বার্মিজদের মত । ও: না না শ্যামদেশেরই মানুষ ছিলেন বোধহয় উনি," --- আমার হঠাৎ সেই পরেশমামার গল্প মনে পড়ে গেলো ।
    "থাইল্যাণ্ডের মানুষ তোমার মামা ? বেশ ইন্টারেস্টিং লাগছে তো । খুলে বলতো আমাকে, বিজু ।" পান্না বলল ।
    "শুনেছি, তিনি নাকি আমার দাদামহাশয়ের শিষ্য ছিলেন । 'মহীবাবু' বলেই জানতাম আমরা ওঁনাকে । উনি তো বাঙলা ভাষাতেই কথা বলতেন । আসলে উনি আমার মামাবাড়িতে অতি শ্রদ্ধার আসনে ছিলেন কিনা, তাই ওনার সম্বন্ধে বেশি কৌতুহল প্রকাশ করাটা অভব্যতা ছিল । বোধহয় ওনার পুরো নাম ছিল মহীদোল সত্যসাই ।" আবার সেই পরেশমামার গল্পের স্মৃতি মনে পড়ে গেল আমার ।

    নামটা করা মাত্রই পান্না বিদ্যুত্পৃষ্টের মত চমকে উঠে আমার হাত চেপে ধরল ! "কী বলছ তুমি বিজু ? মহীদোল সত্যসাই ? কপালে তিনটি আঁচিল ? তুমি তাঁকে কী করে দেখবে ? তিনি তো আজ থেকে প্রায় একশ' বছর আগে আমাদের গ্রামের অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ হয়ে মারা যান । আজও আমাদের গ্রামে পূজিত হন তিনি -- আমাদের উ-নুন গ্রামকে একবার ভয়ঙ্কর বিপদের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন উনি । গ্রামের সন্নিকটে আছে তাঁর স্মৃতিমন্দির । তাঁর মূর্তি বসানো আছে সেখানে । নিত্য পূজা পান তিনি । আমাদের এ'অঞ্চলে তথাগত বুদ্ধের পাশাপাশি পূর্বজ-বন্দনাও ধর্মীয় উপাচারের মধ্যেই পড়ে, জানো তো ? এ'তারই অঙ্গ ।"

    এবার আমার অবাক হবার পালা । তাঁর মূর্তি ? সেই যে মামাবাড়ির এক কোণে পড়ে থাকা মহীবাবু, সাতে নেই পাঁচে নেই, সন্ধ্যেবেলা বাঁশি বাজান --- তিনি এখানে পূজিত ? তাঁর মূর্তিও আছে ? বলি, "পান্না, সম্ভবত: ভুল জানো তুমি । মহীদোল সত্যসাই একশো বছর আগে মারা যান নি । ঊনিশশো সত্তরের দশকের গোড়াতেও আমি কলকাতায় ওঁনাকে দেখেছি । নাম ও কপালের আঁচিল যখন মিলে যাচ্ছে, তখন সন্দেহের হয়ত অবকাশ নেই । তবু আমি তাঁর মূর্তিটি একবার দেখতে চাই । চলো তুমি আমাকে নিয়ে তোমাদের সেই গ্রামে । ভয় নেই, আমার এক মাসের ভিসা আছে । "

    ঈসান যাবার এখন তো চমত্কার হাইওয়ে হয়ে গেছে । যেতে যেতে পান্নাই ফের কথাটা পাড়ল , "খুং মহীদোল তোমার গ্রাণ্ডফাদারের শিষ্য বললে, তা তিনি কি পেশায় ডাক্তার ছিলেন ?"
    আমি অবাক হয়ে বলি, "সেটা তুমি কী করে জানলে, পান্না ?"
    "আরে তিনিই তো ছিলেন এ'ঘটনার হোতা । খুং মহীদোলকে দীক্ষা দিয়ে গ্রাম বাঁচালেন তো তিনিই । ডা: বসু যখন আমাদের গ্রামে আসেন তখন আমার পিতারও জন্ম হয়নি । আমার ঠাকুর্দার তখন জোয়ান বয়স । উনি খুং মহীদোলের বিশেষ বন্ধু ছিলেন । ডা: বসুকে নিকট থেকে দেখেছিলেন । সেই মহামারীর দিনেও গ্রামে উপস্থিত ছিলেন আমার ঠাকুর্দা । মাত্র বছর দশেক আগে উনি দেহ রেখেছেন, প্রায় আটানব্বুই বছর বয়সে । "
    "মহামারীর দিন মানে ? " শুধোই ।
    "পঙ্গপাল জানো ? লোকাস্ট । গঙ্গাফড়িং-এর জাত, কিন্তু ভয়ঙ্কর ! লক্ষ লক্ষ কোটি কোটির ঝাঁকে আকাশ কালো করে আসত । মাইলের পর মাইল সমস্ত সবুজ ধ্বংস করে দিয়ে চলে যেত । দেশে দুর্ভিক্ষ লাগত, মহামারী । হাজার হাজার মানুষ না খেতে পেয়ে মরে যেত । পঙ্গপাল ছিল এক জীবন্ত বিভীষিকা ! আজও পৃথিবী থেকে এ' প্রাণী সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়ে যায়নি । এই তো সেদিনই টি ভি তে দেখছিলাম পশ্চিম আফ্রিকাতে পঙ্গপাল বহু শস্য নষ্ট করেছে, দুর্ভিক্ষ শুরু হয়ে গেছে সেখানে । আমাদের গ্রামাঞ্চলের ওই ঘটনার কয়েক বছর পরেই প্যালেস্টাইনে পঙ্গপালের ভয়ঙ্কর আক্রমণ হয়েছিল, ১৯১৫ নাগাদ । বিধ্বংসী !"
    "তা এই পঙ্গপালের আক্রমণ থেকে ডা: বসু বা তাঁর শিষ্য মহীদোল সত্যসাই কী করে গ্রামবাসীদের বাঁচিয়েছিলেন ?"
    "বলব, বিজু, তোমাকে সবই বলব । চলো তুমি আমাদের গ্রামে । আমার বাবা এ' গল্প আমার চেয়ে ভালো জানেন । শুনবে চলো সব তাঁর মুখে ।"

    আমাকে তখন আর বলতে হয় ? পারলে আমি এক ছুট্টে পৌঁছে যাই সেই গ্রামে । আমার প্রাণ তখন আকুলি-বিকুলি করছে কখন সেই ঈসানের গ্রামে যাবো, সেই রোমহর্ষক কাহিনী শুনতে পাবো আর সেই মূর্তিটি দেখতে পাবো ।

    ॥ ৩ ॥


    আমাদের এই ভারতবর্ষ থেকে শুরু হয়েছে । হিমালয়ের পাদদেশের অরণ্য তো আছেই, কিন্তু মধ্যপ্রদেশ-ছোটনাগপুর-উত্তরবঙ্গ-আসাম-অরুণাচল হয়ে এই যে ভারতীয় অরণ্য শুরু হল, সে চলল বর্মা-শ্যাম-লাওস-ভিয়েতনাম হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব চিনের প্রান্তে চিনসাগরের তীর পর্যন্ত । এ' অঞ্চলে সবুজের কোনো খামতি নেই । প্রায় সারা বছর ধরেই কম-বেশি বৃষ্টি হয় । নরম মাটি । শ্যামদেশের গ্রাম দেখলে আমাদের জলপাইগুড়ির গ্রামের কথা মনে পড়ে ।

    পান্না নিজেই গ্রামে এলো চার বছর পরে । তাও বিন্‌-নোটিশে । ওদের গ্রামের বাড়িতে হৈ হৈ পড়ে গেল । সঙ্গে আসা এক ভারতীয় অতিথি-বন্ধুরও খাতির যত্ন কম হল না । আমার কিন্তু মন পড়ে আছে সেই মহীদোল সত্যসাইয়ের স্মৃতিমন্দিরে । মনে হাজারো প্রশ্ন ।

    এখন এ'অঞ্চলে যথেষ্ট ঠাণ্ডা । গরমে শুনলাম তেমনই ঘেমো গরম পড়ে । মন্দিরটি গ্রামের উপকন্ঠে । পরেরদিন সকালে পান্না ও আমি দুটি সাইকেল জোগাড় করে যাত্রা শুরু করলাম । এমনিতে গ্রামের বাইরের এ' তল্লাট শুনশান । কিন্ত পান্না দেখালো, কয়েকজন গ্রামবাসি এই পথে ফিরছে । গ্রামের ঘরে ঘরে দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া আছে । প্রতিদিন সকালে কেউ-না-কেউ মন্দির ধোয়ামোছা করে ধুপ জ্বালিয়ে চামর দুলিয়ে ব্যজন করে আসে ।

    খুং মহীদোলের মন্দির দর্শন আমার কাছে তীর্থদর্শন স্বরূপ । সেখানে সাদা পাথরের আবক্ষ মূর্তিটিও বসানো আছে । নিপুণ শিল্পীর হাতের কাজ । 'মহীবাবু' অর্থাৎ খুং মহীদোলকে চিনতে বিশেষ অসুবিধে হয় না, যদিও এ' তাঁর জোয়ান বয়সের রূপ । কপালে তিল-তিনটি পরিষ্কার রয়েছে । মঙ্গোলিয় কাট মুখের সেই সরল ও হাসিহাসি ভাব ! মহীবাবুকে আমি যখন দেখেছি তখন তাঁর বয়স তাহলে প্রায় আশি বছর হবে । আমাদের অবশ্য দেখে পঞ্চাশ-ষাটের বেশি মনে হত না । আমার হাত দুটি আপনা থেকে জড়ো হয়ে এলো, মাথা নোয়ানো ।

    বাড়ি ফিরে দেখি পান্নার বাবা পাশের গ্রাম থেকে ফিরে এসেছেন । আমার বাবার বয়সিই হবেন । বয়সকালে উনি নামি ফুটবলার ছিলেন । একবার কোন্‌ থাই দলের সঙ্গে উনি কলকাতায় আই. এফ. এ. শিল্ডও খেলে এসেছেন, মারডেকাতেও খেলেছিলেন এক বার ভারতের বিরুদ্ধে । টি আও-শৈলেন মান্নার নাম আজও তাঁর মনে আছে ।

    ওনার কাছেই জমে ছিল আসল কাহিনীর পাহাড় । গ্রামের কিংবদন্তী মহীদোল সত্যসাইয়ের গুরু ডা: বসুর নাতি এসেছে শুনে ছেলে-বুড়ো অনেকেই দেখা করতে ঘিরে এলো । আমি তখন ভিড় থেকে পালাতে পারলে বাঁচি । আমার জিজ্ঞাসা তো প্রচুর --- কোন্‌ অবস্থায় ও কেন মহীদোল সত্যসাইকে মৃত বলে ধরে নিয়েছিল উ-নুন গ্রামবাসি ? উনি এখানে পূজ্য, তবু দেশ ছেড়ে ভারতে গিয়ে সারা জীবন লুকিয়ে রইলেন কেন ? ওনার পঁযাটরার ভেতরে নরমুণ্ড থাকত কেন ? ইত্যাদি ইত্যাদি । পান্নার বাবা ও গ্রামবাসিদের কথায় অনেক রহস্যের উন্মোচন হল বটে, তবে অনেকটা যেন হলও না । ভাষা একটা সমস্যা হলেও পান্না ছিল সাহায্য করতে ।

    আমার মা তখনও বেঁচে । কলকাতায় ফিরে বাড়িতে সুটকেশ রাখতে রাখতে মাকে বলতে শুরু করেছি থাইল্যাণ্ডের গল্প । মা দেখি শুনতে শুনতে মৃদু মৃদু হাসতে শুরু করেছেন । বললাম, "তুমি এ'সবও জানতে নাকি মা ?"
    "না, এ'সব আমি জানতুম না বটে, তবে তুইও এখনো অনেক কিছু জানিস না ।"
    "কী মা ? বলো আমায় ।" আমার তখন চুয়াল্লিশ বছর বয়স । কিন্তু মায়ের কাছে আধিভৌতিক গল্প শোনার আকর্ষণ তখনও এতটুকু কমেনি আমার ।
    "গল্পটা কি জুতোমোজা না ছেড়েই শুনবি ? "মা হেসে শুধোন ।


    ॥ ৪ ॥


    "কী গো রূপা-মা, তোমরা আবার বোরড্‌ হচ্ছ না তো আমার এই লম্বা গল্প শুনে ?" বুঝলাম, বিজুদা একটা ব্রেক দিতে চান ।
    "না না বল জেঠু কী ভয়ঙ্কর কাণ্ড হয়েছিল সেই গ্রামে ," রূপার আগে গুগ্গুলই উত্তর দেয় ।

    বিজুদা ফের শুরু করেন তাঁর মায়ের বলা গল্প দিয়ে : "কী আর বলব তোকে রে বিজু, বলতে গেলে তো অনেক কথাই বলতে হয়, অনেক 'গোপন' কথা ।" আমার মা বলেছিলেন, বিজুদা বলে যেতে থাকেন, "তার মধ্যে সবচেয়ে বম্ব-ফাটানো সত্যি কথাটা হল এই যে তোরা আজন্ম যে বরাহনগরের মামাবাড়ি দেখে এসেছিস, সেটা আমাদের বাড়িই ছিল না । মহীবাবু আমাদের আশ্রিত ছিলেন না, আমরাই ছিলাম তাঁর আশ্রিত !"

    আমি চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠেছি ! "কী বলছ মা, ওই বাড়িটার মালিক ছিলেন মহীবাবু ?"
    "আজ্ঞে হঁযা মশায় । সত্যি তো সেটাই," মা বলতে থাকেন :

    "সে আমার জন্মেরও আগেকার কথা । মেজদার কাছে গল্প শুনেছি । বাবা জাহাজের চাকুরি ছেড়ে দিয়ে কলকাতায় ফিরে আসবার পরপরই এই মহীবাবু ঠিক খঁংউজে খঁংউজে এসেছেন বাবার কাছে । তিনি তখন মনোকষ্টে অতীব ক্লিন্ন । বাঙলাভাষাই তখন বলতে পারেন না, অবোধ্য ইংরিজিতে কথা বলেন । বাবার পা জড়িয়ে ধরে কেবল বলছেন, "গুরুদেব আমি ভুল করেছি, আমায় ক্ষমা করুন, আমায় পথ দেখান ।" বাবার এক কথা, "তুমি আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমার মন্ত্র নিয়ে নিয়েছ । সাধনমার্গের অনেকটাই এক লাফে উঠে গেছ পরিশ্রম না করেই । আমি আর কিছু করতে পারব না । তন্ত্রসাধনার পথ আমি পরিত্যাগ করেছি । তাই এখানে নয় তুমি চলে যাও কামাখ্যাপীঠে । সেখানে আছেন আমার গুরুভাই ত্রৈলোক্যনাথ । আমি মন: যোগে তাঁকে জানিয়ে দিচ্ছি । তুমি তাঁর কাছে দীক্ষা নাও । তিনি যেমন বলবেন, করো ।"
    "আমি তাঁকে চিনব কী করে ?" মহীদোল প্রশ্ন করে ।
    "তোমাকে চিনতে হবে না । তিনিই তোমায় চিনে নেবেন ।"

    ***


    "এর পর দীর্ঘ পঁচিশ বছর কেটে গেছে," মা বলতে থাকেন, "তখন যুদ্ধের কাল । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেধেছে । কলকাতায় জাপানী বোমা পড়ছে --- আজ টেরিটিবাজারে তো কাল মানিকতলায় । আমাদের পরিবারেরও তখন বড়ই দুরবস্থা । পরপর আমার দুই দাদা ও এক দিদি মারা গেছেন । বাবা-মা সন্তানশোকে কাতর । বাবার পশারেরও তখন বড়ই মন্দা চলেছে । আলুভাতে ভাত খেয়ে দিন কাটছে আমাদের । শিশুর মুখের দুধও বন্ধ হয়ে গেছে অর্থাভাবে । মানিকতলায় থাকাও তখন নিরাপদ নয় । গ্রামের বাড়িতে গিয়ে থাকার কথা ভাবা হচ্ছে, কিন্তু পেট চলবে কী করে ? নানা চিন্তায় বাবা-জ্যেঠুরা জর্জরিত ও কাতর । এমন সময় এক শীতসকালে আমি একতলার ঘরের জানলার খড়খড়ি তুলে রাস্তায় জল দেওয়া দেখছি, বছর ছ'-সাত বয়স হবে তখন আমার, দেখি ঘোড়াগাড়ি থেকে এক মাঝবয়সি চিনেম্যান নেমে আমার দিকেই এগিয়ে এলো, পরিষ্কার বাঙলায় বলল, "খুকি, ডাক্তারবাবু বাড়ি আছেন ?" বাবার চিনেম্যান পেশেন্ট আমি আগে দেখিনি । বললুম, "ছাদে । ধ্যানে বসেছেন । আটটার আগে রুগি দেখেন না ।"

    সেই থেকে মহীবাবু রয়ে গেলেন । শোনা গেল, তাঁর নাকি অগাধ পৈতৃক ধনসম্পত্তি ছিল, কিন্তু থাকেন অতি দীন-হীন ভাবে --- সেটাই তাঁর শিক্ষা । গুরুদক্ষিণা হিসেবে বাবাকে ওই বাড়িটা দিতে চেয়েছিলেন । কিন্তু আমার বাবা তো কোনো দান-টান নেবার মানুষ ছিলেন না । এদিকে সংসারে অনটন । আমাদের থাকার জায়গা নেই । শেষে মহীবাবু গুরু-মা কে ধরে এইটুকু রাজি করালেন যে বাড়ি ওনার নামেই থাকুক, কিন্তু ডাক্তারবাবু যেন দয়া করে সেখানে বাস করেন । বাবা শেষাবধি রাজি হয়েছিলেন বটে, তবে শর্ত রইল, মহীবাবুকেও ওই বাড়িতেই থাকতে হবে । উনি বাড়ি কিনে দিয়ে চলে যাবেন আর তাঁর গুরুজী সপরিবার সেই বাড়িতে বসবাস করতে থাকবেন --- তা চলবে না । সেই থেকে আমরা ওই বাড়িতে আশ্রিত । নৈলে, আমার বাবা গরীব মানুষ, এত টাকা পাবেন কোথায় যে অত বড় বাড়ি কিনবেন ?" এই বলে ভাত বাড়তে চলে গেলেন মা ।

    "কী যে অবাক হয়েছিলাম আমি সেদিন মায়ের মুখে এ' গোপন তথ্য জেনে, কী আর বলব তোদের, " বিজুদা বলেন, "যা হোক্‌, এ' গল্পের পটভূমি তো বিরাট কাল ও স্থান জুড়ে । আমার মা তাঁর বড় দাদাদের কাছ থেকে যা শুনেছিলেন, আমি থাইল্যাণ্ডে গিয়ে পান্নার বাবার কাছ থেকে যা শুনে এলাম ও দাদামহাশয়ের ডায়েরি থেকে সামান্য যা যা সূত্র পেয়েছি সে-সব যথা স্থানে জুড়ে জুড়ে আজকের কাহিনীর শেষটুকু উপস্থাপনা করি । তবে, গলা যে শুকিয়ে গেছে মা, এক কাপ চা না পেলে......

    চা পানের পরে গল্পের শেষটুকু শোনা গেল :

    "সন্মথনাথ কলকাতার মেডিক্যাল স্কুলে পড়তে শুরু করেন ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকের গোড়ায় । কলেজে তাঁর প্রাণের বন্ধু ছিলেন ডোমিনিক রোজারিও, এক কলকাতাবাসি এযাঙ্গলো-ইণ্ডিয়ান যুবক । রোজারিওর ছিল এঙ্গলিঙের শখ, বহুবার আমার মামারবাড়ির গ্রামে মাছ ধরতে গেছেন । সন্মথনাথও ডাক্তারি পড়ার সময় বহুদিন রোজারিওর ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের বাড়িতে থেকে যেতেন । সন্মথনাথের তান্ত্রিক যোগশক্তির কিছু পরিচয় রোজারিও কলেজে থাকতেই পেয়েছিলেন --- মন্ত্রবলে একবার শুধু পৃষ্ঠাস্পর্শ করে গ্রে-এনাটমির সিকিভাগ কন্ঠস্থ করে ফেলে ছিলেন ডোমিনিক । স্কুল ছাড়তে-না-ছাড়তেই সন্মথনাথ এক গুরু পাকড়ে প্রথমবার কামাখ্যায় গিয়ে উঠেছিলেন কিনা । সেবার তাঁর বড় দাদা গিয়ে ভাইয়ের কান পাকড়ে ঘরে ফিরিয়ে আনেন -- এ' গল্প সন্মথনাথই বন্ধুকে করেছিলেন ।

    কলেজ ছাড়ার পর রোজারিওর সঙ্গে সন্মথনাথের যোগাযোগ ত্রক্রমে ক্ষীণ হয়ে আসে, কারণ দাদামহাশয় কোনোদিনই একস্থানে বা এককাজে বেশিদিন থাকার মানুষ ছিলেন না । এ'সময়ে উনি ফের ঘর-সংসার ফেলে রেখে কামাখ্যায় গিয়ে ওঠেন । বেশ কয়েক বছর ছিলেন । পরে অবশ্য উনি ঘৃণায় এ'-সাধন পথ চিরদিনের মত পরিত্যাগ করে ঘরে ফিরে আসেন ।

    এ'দিকে সংসারে অনটন । অর্থ রোজগারের তাড়নায় সন্মথনাথ ফের কলকাতার পথে ঘুরতে লাগলেন, পুরনো যোগাযোগ ঝালিয়ে নিতে লাগলেন । প্রথমেই প্রাণের বন্ধু রোজারিওর কথা মনে পড়ল । তাদের সেই ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের বাড়ি গিয়ে জানতে পারলেন যে ডোমিনিক তদ্দিনে থাইল্যাণ্ডে চলে গেছে, সেখানেই প্রাকটিস করে । ডোমিনিকের দিদি এঞ্জেলিনা ছিলেন ট্রেইণ্ড নার্স যিনি বছর দশেক আগেই থাইল্যাণ্ডে চলে গিয়েছিলেন ও সেখানকার নামি ডাক্তার নরেশ সত্যসাইকে বিবাহ করে থিতু হন । কিন্তু তাঁর অকাল-বৈধব্যে এক শিশুপুত্র নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন দিদি । সে-সময়ই ডোমিনিক ব্যাঙ্ককে দিদির পাশে গিয়ে দাঁড়ান ও প্রাকটিস শুরু করেন --- সেকালে ও'দেশে পশ্চিমা ডাক্তার-নার্সের বড়ই আকাল ছিল, বড়ই কদর ছিল তাই । অকৃতদার ডোমিনিকই দিদির সংসারের অভিভাবক হয়ে পড়েন । এ' সবই ডোমিনিক রোজারিওর ঠিকানা জোগাড় করে, তাঁকে চিঠি লিখে জানতে পারেন সন্মথনাথ এবং বন্ধুর সুপারিশের জোরেই তাঁর জাহাজের চাকুরিখানিও হয়, কারণ এ.ই জাহাজ কোম্পানীতে ডোমিনিক নিজেই আগে চাকরি করতেন । কৃতজ্ঞ সন্মথনাথকে কথা দিতে হল ফেরার পথে অন্তত: একবার তাঁকে ব্যাঙ্ককে নেমে বন্ধুর সঙ্গে দেখা করে আসতে হবে ।

    যদিও ওপরওয়ালার ইচ্ছা ছিল অন্যরকম ।

    চীন-ইন্দোনেশিয়া ঘুরে ডা: সন্মথনাথ যখন থাইল্যাণ্ডে পৌঁছলেন, ব্যাঙ্ককের জাহাজঘাটায় ডোমিনিককে না দেখে অবাক হয়েছিলেন । তবে কি সে তাঁর চিঠি পায়নি ? কিন্তু কী করে জানবেন সন্মথনাথ যে কী ভয়ঙ্কর খবর অপেক্ষা করে আছে তাঁর জন্যে ? মাস-ছয়েক আগে এক ভয়ঙ্কর পথ-দুর্ঘটনায় রোজারিও মারা গেছেন ! প্রাণাধিক সুহৃদের এ'হেন মর্মন্তুদ মৃত্যু-সংবাদে বাক্যহারা হয়ে পড়েছিলেন সন্মথনাথ । বন্ধুর সঙ্গে শেষ দেখা হওয়া তাহলে তাঁর ভাগ্যে লেখা ছিল না ? --- চোখের জলে ভাবেন সন্মথনাথ । মেরুদণ্ডে ভয়ঙ্কর চোট পেয়েও কিছুদিন এক সরকারি হাসপাতালে বেঁচে ছিলেন রোজারিও । বন্ধু সন্মথনাথ তাঁর কথা রেখে নিশ্চয়ই ব্যাঙ্ককে আসবেন, এই দৃঢ প্রত্যয়ে তিনি বহু ক্লেশে তাঁর উদ্দেশ্যে এক পত্র লিখে রেখে যান, আরেক পত্র ভাগিনেয় মহীদোলের উদ্দেশ্যে । হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সে-চিঠি সন্মথনাথের হাতে দেন । ডা: রোজারিও বন্ধুকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করে গেছেন, তিনি যেন 'উত্তরের গ্রামে' স্বেচ্ছা-নির্বাসিত ভাগিনেয় মহীদোলের খোঁজ করে তার হাতে ব্যাঙ্ককের এক চেট্টিয়ারের কাছে গচ্ছিত লক্ষাধিক বাহ্ট তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন । লিখেছেন ডোমিনিক, "জানি, সে স্বাধীনচেতা ছেলে । অভিমান করে ছেড়ে গেছে । এ' অর্থ সে নিতে চাইবে না । তবু, সন্মথ, এ' ভার তোমায় নিতে হবে । কেউ এ'কাজ পারলে, তুমিই পারবে । মহী এ' অর্থ না গ্রহণ করলে আমি কবরে গিয়েও শান্তি পাবো না, কারণ এ'অর্থের মালিক তো আমি নই, অছি মাত্র ।"

    এ' এক গুরুদায়িত্বে ফেঁসে গেলেন সন্মথনাথ । একদিকে মৃত্যুপথযাত্রী বন্ধুর শেষ ইচ্ছা অন্যদিকে সম্পূর্ণ অপরিচিত বিদেশ-বিভঁংউই জায়গা । সেকালে সেই উত্তর থাইল্যাণ্ডের ঈসান প্রদেশ ছিল অতি ঘন অরণ্যে আচ্ছন্ন । স্থলপথ বলতে প্রায় কিছুই ছিল না সেকালে । মেকং নদী বেয়ে জলপথে ভিয়াঙ্গচান পেরিয়ে আরো পশ্চিমে উজান বেয়ে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই । তাঁর ডায়েরিতে অতি প্রশস্ত মেকং নদীর অপূর্ব বর্ণনা আছে । আমাজন-নীলনদ তিনি দেখেন নি । কিন্তু মেকং-এর বিস্তার ও বিপুল জলরাশি যে আমাদের পদ্মা-ব্রহ্মপুত্রকে হার মানায়, সেটা লিখেছেন ।

    তন্নিষ্ঠ প্রচেষ্টায় প্রায় গোয়েন্দাগিরি করে মহীদোলের খবর পেয়েছিলেন সন্মথনাথ--- মহীর প্রয়াত পিতা ডা: নরেশ সত্যসাইয়ের আদি নিবাস ছিল ঈসান প্রদেশে । সংস্কৃত 'ঈশান' অর্থাৎ উত্তর-পূর্ব কোণ থেকেই এসেছে থাইপ্রদেশ 'ঈসান'-এর নামটা । ইতিহাসপ্রেমী যুবক মহীদোল তার বাপ-পিতেমোর ভিটের খোঁজে সেখানে গিয়ে নাকি কোনো এক 'নিচু' ও মিশ্রবংশীয়া কন্যাকে বিবাহ করে । এই নিয়েই মাতুলের সঙ্গে তার বিরোধ ।

    এক সঙ্গী-কাম-ভৃত্য জোগাড় হল । লাও-লোম উপজাতীয় কিশোর আন । সে ওই অঞ্চলেরই ছেলে -- সব পথ-ঘাট চেনে । তার ভরোসাতেই বেরি.য়ে পড়লেন সন্মথনাথ অজানা-অচেনা দেশের উদ্দেশ্যে ।

    "এরপরের ঘটনা বলেই তো শুরু করতে যাচ্ছিলাম রে আজকের গল্প," বিজুদা বলে চলেন, "বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের কথা । উত্তর-পূর্ব থাইল্যাণ্ডের মেকং নদীতীরে ঈসান প্রদেশ । চারিদিকে গভীর জঙ্গল এই জঙ্গুলে পথ দিয়ে এক বিদেশি যুবক চলেছেন তাঁর মৃত বন্ধুর এক নিকটাত্মীয়ের খোঁজে ---কর্তব্যের খাতিরে । সম্পূর্ণ অপরিচিত দেশ । বিকেল হয়ে এসেছে । ভিয়াঙ্গচান পেরিয়ে মেকং বেয়ে আরও পশ্চিমে এসে বড় স্টিমার ছেড়ে শাখানদী লোইই-তে ঢুকেছেন দেশি-নৌকা করে । এখানেই উ-নুন এক ছোট গ্রাম, যেখানে ছিল প্রখ্যাত চিকিত্সক নরেশ সত্যসাইয়ের আদিভিটে । মহীদোল সত্যসাই বাপ-পিতেমোর এই প্রাচীন গ্রামেই এসে আস্তানা গেড়েছেন --- এমন খবর । মহীদোলের বাপ-পিতেমোর বংশের কেউই অবশ্য তখন আর উ-নুন গ্রামে থাকে না ।

    লোইই নদীপথে উ-নুন গ্রামের নিকটস্থ ঘাটটিতে নেমে ডা: বসু বাকি পথটুকু হেঁটে চলেছেন বনপথ দিয়ে । পিছে পিছে চলেছে আন, সেই ভৃত্য । বিকেল হয়ে এসেছে । টিপ্‌ টিপ্‌ বৃষ্টি শুরু হয়েছে । হঠাৎ অনতিদূরে শোনা গেল এক দল কুকুরের ডাক । বন্য কুকুর ! ব্যাঘ্রের চাইতেও ভয়ঙ্কর হয়ে থাকে এই বন্য কুকুরের দল । ঢোল ! অস্ট্রেলিয় বন্যকুকুর ডিংগোর চাইতে কোনো অংশে কম ভয়ঙ্কর নয় দক্ষিণ-এশিয়ার এই ঢোল কুকুরের পাল । সাত-আট-দশটার দলে ঘোরে । নিজের চেয়ে চারগুণ বড় সাইজের হরিণ, বুনোমোষকে পর্যন্ত জ্যান্ত ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায় । ভৃত্য আন মুহূর্তের মধ্যে মাথার সামান ফেলে সামনের এক বড় বৃক্ষে চড়ে পড়ল ; চেঁচামেচি ও ইঙ্গিত করে ডাক্তারবাবুকেও প্রাণ বাঁচাতে সামনের গাছে চড়তে বলতে লাগল । কিন্তু সন্মথনাথ দসাশই পুরুষ । গাছে চড়ার অভ্যেস নেই । অমনি হুট্‌ বলতে গাছে চড়তে পারেন না । কী করা যায় ? এ'দিকে কুকুরের দলও প্রায় নিকটে এসে পড়েছে । তখন প্রাণ বাঁচাতে ডা: বসু এক অদ্ভুত কাণ্ড করলেন । দৌড়ে পালানোর কোনো চেষ্টাই না করে, মাটি থেকে এক মুঠো ধুলো তুলে নিয়ে তাতে বিড়্‌ বিড়্‌ করে কী সব মন্ত্র পড়ে দিলেন । তারপর নিজের চারিদিকে সেই মন্ত্রপূত: ধুলি গোল করে ছড়িয়ে এক গণ্ডী কেটে নিলেন ও তার মাঝে ঋজু দাঁড়িয়ে রইলেন চক্ষু মুদে । মুখে চলেছে সেই বিড়্বিড়্‌ মন্ত্রপাঠ ।

    কুকুরের দল এসে পড়েছে । সামনেই এক জলজ্যান্ত সুস্বাদু খাদ্য দেখে তারা গোলাকারে ঘিরে তেড়ে এলো প্রবল ঘেউ ঘেউ করতে করতে । কিন্তু কী আশ্চর্য ! ডা: বসুর চারিদিকে যেন এক অদৃশ্য কাঁচের প্রাকার বেড়ে রয়েছে । বহু চেষ্টা হাঁকডাক ঝাঁপাঝাঁপি করেও কুকুরের দল সেই পাঁচিল ডিঙোতে পারল না । শেষে নিরাশায় হাল ছেড়ে দিয়ে তারা পালাল অন্য শিকারের সন্ধানে ।

    গাছের ডাল থেকে এ' অবাক দৃশ্য তাঁর ভৃত্য ছাড়াও আরেকজন দেখেছিল । সে গ্রামের স্কুলের নতুন শিক্ষক মহীদোল সত্যসাই । বিকেলে গ্রামের বাইরে বেড়াতে এসে দূর থেকে বুনো কুকুরের ডাক শুনে সেও কাছের আরেকটি গাছের মগডালে চড়ে বসেছিল । সে-কালে ওই অঞ্চলে ঢোল কুত্তাদলের হানা বড় বিরল ছিল না । অবাক হয়ে মহীদোল এক অচেনা আগন্তুকের এ'হেন কীর্তির সাক্ষী হয়ে রইল, কিন্তু তখন সে তা জানতে দেয় নি । পরে জানা গেল ইনিই সেই ভারতীয় ডাক্তার, মামার কাছে যাঁর গল্প বহু শুনেছে সে । এবং তিনি এসেছেন তারই খোঁজে ।

    মহীদোল সত্যসাই ছিল এক প্রকৃতিপ্রেমী আদর্শবাদী যুবক । বাপ-মামার মত ডাক্তারির দিকে না ঝঁংউকে ব্যাঙ্ককের ইংরেজি স্কুল-কলেজে সে পড়েছে য়ুরোপীয় সাহিত্য । ঈসানে এসেছিল সে তার আদি ভিটের খোঁজে । এসে প্রেমে পড়ে গেল এর নদী-পর্বত-অরণ্যের । তাই সে এই গ্রামের নতুন স্কুলে পড়ানোর পেশাকেই স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছে । আর সে বাজায় বাঁশি --- কায়েন বায়েত । উত্তর থাইয়ের নিজস্ব বাদ্য ।

    আরেক আকর্ষণেও পড়েছে সে । সে হল জাইদি--- গ্রামপ্রধানের একমাত্র কন্যা, তাঁর নয়নের মণি । সত্যিই, জাইদির নয়নের মণি ছিল দুর্লভ নীল ! এ'অঞ্চলে এমনটা দেখা যায় না । তবে এঁনারা এসেছিলেন ফরাসি-প্রধান লাওস থেকে কিনা, তাই কোনো পূর্বপুরুষে ফরাসী রক্ত থাকতেও পারে । শিক্ষিত, সাহিত্য ও সঙ্গীতপ্রেমী, শিল্পী যুবকটির প্রতি গ্রামকন্যা জাইদি সহজেই আকৃষ্ট হল । মহীদোল মুগ্ধ শুধু জাইদির নীল চোখে নয়, তার চারিত্রিক ঔদার্য ও মাধুর্যে । অচিরেই তাদের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠল । গ্রামপ্রধানও এ'হেন ছেলেটিকে জামাই করতে দেরি করলেন না ।

    হোক্‌ না নিজেরই আদিগ্রাম, লাখপতি ডাক্তারের ছেলে গ্রামের স্কুলে পড়ানোর পেশা বেছে নেবে --- এটাই মেনে নিতে পারেননি মহীর অভিভাবক । তাই মহীদোল যখন এক গ্রাম্যকন্যাকে বিবাহের সিদ্ধান্ত নেয় তাতে প্রবল আপত্তি ছিল মামার --- "আমি তোমার প্রয়াত মা-বাবার কাছে দোষী থেকে যাবো !" -- বলেছিলেন তিনি, মহী যখন বিবাহের মত নিতে যায় তাঁর কাছে ।

    "এখানে দু'টো কথা বুঝতে হবে", বিজুদা বললেন, "থাইল্যাণ্ডে বিশেষত: 'পশ্চাদপদ' ঈসানে পূর্বজ-তর্পণ এক বিশেষ মাহাত্ম্য রাখে --- প্রায় ধর্ম-পালনের পর্যায়েই পড়ে সেটা সেখানে । আর দ্বিতীয়ত:, সেই বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় সে-দেশে অভিভাবকের ইচ্ছার বিরুদ্ধে, নিজের গোষ্ঠী বা কাস্টের বাইরে বিবাহ অকল্পনীয় ছিল ।

    যাই হোক্‌, এখন সন্মথনাথ দর্শনে মহীদোলের মামার স্মৃতি উথলে উঠল । পাঁচ বছরে বাবা আর বারো বছর বয়সে মাকে হারিয়েছিল মহীদোল । ডাক্তারমামাই পুত্রস্নেহে লালন করেছেন তাঁকে । তাঁর সঙ্গে শেষদিকের মনান্তরে মর্মে মরে ছিল মহীদোল । ইচ্ছে ছিল, মামার উষ্মার কারণ একটু থিতিয়ে এলে জাইদিকে তাঁর সামনে নিয়ে গিয়ে ফেলবে । তার অপূর্ব ব্যবহারে মামাও মুগ্ধ না হয়ে পারবেন না । কিন্তু অকস্মাৎ মামার ও'হেন মর্মান্তিক প্রয়াণে বেদনায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল মহীদোল । লোকমুখে সে-খবর পেয়ে যদ্দিনে ব্যাঙ্ককে পৌঁছয় মহী, তদ্দিনে মামার সমাধির পাশে দাঁড়িয়ে অশ্রুমোচন করা ছাড়া আর কিছু করণীয় বাকি ছিল না । আজ সেই মামার বন্ধুকে কাছে পেয়ে সে-খামতিটুকু পুরিয়ে নিতে চায় মহীদোল । সন্মথনাথও অপত্যস্নেহে আপন করে নিলেন মহীদোলকে ।

    কিন্তু আশানুরূপভাবেই, সেই গচ্ছিত সম্পত্তি-সমর্পণের প্রশ্নে বেঁকে বসল মহীদোল । "যে অর্থ আমি উপার্জন করিনি তাতে আমার অধিকার নেই । ও' সম্পত্তি আমি গ্রহণ করতে পারব না ।" --- সেই এক কথা মহীদোলের । তাই, যে কাজে সন্মথনাথের ঈসানে আগমন, তা অধুরাই রয়ে গেল । এখনই বেশি জোরাজুরি না করে তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজি করাতে কিছু সময় নেবার পক্ষপাতি হলেন সন্মথনাথ । কারণ, প্রয়াত বন্ধুর `উইল' মোতাবেক কার্যোদ্ধার তাঁকে করেই ফিরতে হবে ।

    বেশ কিছু দিন উ-নুন গ্রামে থেকে গিয়েছিলেন ডা: সন্মথনাথ । রীতিমত ডাক্তারি প্রাকটিস শুরু করে গ্রামবাসির মন জয় করে নিলেন । স্থানীয় ফুয়ান ভাষার চর্চা আরম্ভ করে দিলেন । মহীদোলের পাশাপাশি আরও কিছু তরুণ-যুবার দল তাঁর ব্যক্তিত্বে আকৃষ্ট হয়ে তাঁর অনুরাগী হয়ে পড়ে, বন্ধু পান্নার ঠাকুর্দাও সে-দলে সামিল ছিলেন । শুধু খাওয়ার ব্যাপারেই একটু অসুবিধে হত সন্মথনাথের, এ'কথাটা ডায়েরিতে লিখেছিলেন তিনি : ভাতই এখানকার প্রধান খাদ্য হলেও সে-ভাত ছিল চটচটে ড্যালা ড্যালা ভাত । আর রান্নার সব পদই অসম্ভব ঝাল !

    "কিন্তু দেখ রে, মানুষ ভাবে এক, আর বিধাতাপুরুষ যে আর-কথা লিখে রেখে যান তার কপালে ! নৈলে এমনিভাবেই তো নির্লোভ-নির্বিবাদী মহীদোল-জাইদির জীবন সুখে কেটে যাবার কথা ছিল," বিজুদা এক দীর্ঘ নি:শ্বাস ফেলে বলেন, "তাহলে আর সেই বরাহনগরে মামাবাড়িতে আমিই আর কায়েন বায়েতের সুর শুনতাম কোথায় আর আজ তোদের এ' কাহানিই বা শোনাতাম কোথা থেকে ?"

    ***


    মাসখানেক পরে হঠাৎ এক সন্ধ্যা থেকে উ-নুন গ্রামে হৈ হৈ পড়ে গেল । কী ? না দূর-দূরান্তের গ্রাম থেকে খবর আসতে শুরু করছে যে সেখানে পঙ্গপালের আক্রমণে গ্রাম-কে-গ্রাম ছারখার হয়ে গেছে । "

    আমার দিকে ফিরে বললেন বিজুদা, "ছেলেবেলা সহজপাঠ-এ পঙ্গপালের কথা পড়েছিলিস, মনে আছে তো রে ? আর সঙ্গে নন্দলাল বসুর ছবি ? হঁযা রূপা-মা, তুমি সকালে বাগানে যে গঙ্গাফড়িংয়ের পেছনে দৌড়ে দৌড়ে খেলা করছিলে, পঙ্গপাল সে-ই একই জাত । তবে এরা প্রচণ্ড তাড়াতাড়ি বংশবৃদ্ধি করে । লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি পঙ্গপালের দল সব শস্য সব সবুজ ধ্বংস করে দুর্ভিক্ষ ডেকে আনে । পঙ্গপাল এক অভিশাপ !

    উ-নুন গ্রামের চারিদিকে তখন ক্ষেতে ভরা ধান । মাইলের পর মাইল । কৃষকদের সম্বত্সরের শ্রমের ফল । এ'ছাড়াও এখানকার গ্রামেই হয় রেশমের গুটিপোকার চাষ । সে-ই ঈসানের লক্ষ্মী । চাষীদের প্রধান অর্থকরী উত্পাদনই হল সিল্ক । এখন পঙ্গপালের আক্রমণ হলে গ্রামে হাহাকার পড়ে যাবে । দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে গ্রামে । কিন্ত এ' পঙ্গপালের আক্রমণ থেকে রক্ষারই বা উপায় কি আছে ? মধ্যরাত অবধি গ্রামের মাথারা সভা করলেন, মহীদোলও ছিল সে-সভায়, কিন্তু কোনো সমাধানের পথ বেরোলো না ।

    মন্ত্রণা শেষে ভীত ক্লান্ত মহীদোল ঘরে ফিরে এলে তাঁর তরুণী ভার্যা অনেক আশায় তাকাল স্বামীর দিকে । শিক্ষিত, শহুরে স্বামীর ওপর অনেক ভরসা সেই মেয়েটির । কিন্তু কী নিদান আছে মহীদোলের ঝুলিতে ? সামান্য স্কুলশিক্ষক সে । শেষে জাইদিই পরামর্শ দিল ডা: বসুকে ধরবার । তাঁর অলৌকিক ক্ষমতার গল্প সে এরই মধ্যে শুনে ফেলেছে স্বামীর কাছ থেকে ।

    গ্রামপ্রধানের গৃহের চত্বরেই ডেরা বেঁধেছিল মহীদোল । তারই এক কক্ষে ডা: বসু অধিষ্ঠান করছেন । মাঝরাত্তিরে এসে ডা: বসুর পা জড়িয়ে ধরল মহীদোল । চমকে উঠলেন পদ্মাসনে ধ্যানমগ্ন ডা: বসু ।





    "কী হয়েছে ?"
    "আঙ্কল, আপনি এই পঙ্গপালের আক্রমণ থেকে আমাদের গ্রামকে বাঁচান ।"
    "আমি ? আমি কী করতে পারি ?" ডা: বসুর প্রশ্ন ।
    "আমি মামার কাছে আপনার অলৌকিক ক্ষমতার অনেক গল্প শুনেছি । আর নিজের চোখেও সেদিন প্রত্যক্ষ করলাম কী ভাবে আপনি বুনোকুকুরের পালের আক্রমণ প্রতিহত করলেন । আপনার কাছে নিশ্চয়ই এরও কিছু-না-কিছু দাওয়াই আছে । আপনি আমাদের গ্রামকে বাঁচান ডাক্তারবাবু । আপনি থাকতে এতোজন মানুষের জীবনে মৃত্যু নেমে আসবে --- এ' হতেই পারে না ।" সত্যিই নিজের পূর্বজের গ্রামকে ভালোবেসে ফেলেছিল মহীদোল । স্ত্রীর চোখে 'হিরো' বনার আকাঙ্খাও হয়ত ছিল ।

    প্রথমটায় মহীদোলকে আমল দেননি সন্মথনাথ । কিন্তু তার উপর্যুপরি অনুরোধে শেষে কঠোরস্বর বেরিয়ে এলো তাঁর গলা থেকে, "মহীদোল, শান্ত হও । সর্বশক্তিমানের ইচ্ছের বিরুদ্ধে যাবার ক্ষমতা মানুষের নেই । খোদার ওপর খোদকারি করতে যেও না । হয়ত তাঁর মনে আরও বড় কোনো উদ্দেশ্য আছে ।"

    কিন্তু মহীদোল নাছোড় । তর্ক করতে ছাড়ে না, বলে, "তাহলে রোগের চিকিত্সা করেন কেন ? সেটাকেও ঈশ্বরের ইচ্ছে বলে ছেড়ে দেন না কেন ?" উ-নুন গ্রামকে পঙ্গপালের আক্রমণ থেকে বাঁচাতে সে বদ্ধপরিকর । সময় আর নেই । হয়ত কালই আকাশ কালো করে পঙ্গপালের দল ধেয়ে আসবে !

    শত উপরোধেও ডাক্তারবাবু গলছেন না দেখে শেষে তার তূণীর থেকে শেষবাণটি হানল মহীদোল, "ঠিক আছে, আঙ্কল, আপনি যে প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন, তাতে রাজি আমি । মামার উইল মোতাবেক সম্পত্তি গ্রহণ করতে আমি রাজি আছি, যদি আপনি আজ উ-নুন গ্রামকে পঙ্গপালের আক্রমণ থেকে বাঁচানোর পথ বাতলে দেন !"

    অযাচিতভাবে তাঁর কার্যোদ্ধারের পথ বেরোনোয় টলে গেলেন সন্মথনাথ । কী করেন ? একদিকে তাঁর নীতি, অপরদিকে কর্তব্য ! শেষে কর্তব্যেরই জয় হল । কারণ, এ' কর্তব্য পূরণ না করে তো তিনি দেশেও ফিরতে পারছেন না । কদ্দিন সেই বিজন-পুরীতে পড়ে থাকা যায় ?

    রাগতস্বরে বলেই ফেললেন সন্মথনাথ, "দেখো, তন্ত্রমতে এ' হেন বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে বলিদান দেবার নিদান আছে । যে-সে বলি নয়, নরবলি ! না না খড়্গাঘাতে মুণ্ডচ্ছেদন করতে হবে না, মন্ত্রদ্বারা সে-প্রাণশক্তিকে অগ্নিশিখায় রূপান্তরের পথ বাতলে দেব আমি, কিন্তু কে দেবে বলিদান আর কে-ই বা বলি হবে ? কেনই বা হবে ? চাই কোনো ষোড়শী কন্যা । কুমারী হলে সবচেয়ে ভালো হয় । বিবাহিত হলেও তার যেন কোন সন্তান না থাকে ।"
    "সে-ভার আমার । আপনি আমাকে দীক্ষা দিন, মন্ত্র দিন, গুরুদেব । আমি এ'কাজ সম্পাদন করব, গ্রামকে বাঁচাব আমি ।" প্রত্যয়ী কন্ঠস্বর মহীদোলের ।

    অনন্যোপায় সন্মথনাথ সে-রাত্রেই যথাবিহিত ক্রিয়া সম্পাদন করে মন্ত্রদ্বারা শক্তির সঞ্চার করলেন মহীদোলের মধ্যে । কিন্তু এ' তাঁর মতবিরুদ্ধ কাজ । প্রতিবাদে তাই সে-রাত্রেই চেট্টিয়ারের চিঠি মহীদুলের মুখের ওপর ছঁংউড়ে ফেলে দিয়ে গ্রাম ছাড়লেন তিনি । আর মহীদোল বসল তার স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করতে । শেষ রাতে সলাহ্‌ শেষে সটান চলে গেল গ্রামের বাইরে জঙ্গলের দিকে ।

    আর সেই শেষরাতেই ঘটে গেল দুর্ঘটনাটা । গ্রামপ্রধানের ঘরে তাঁর কন্যা জাইদি এসে শুয়েছিল তার মায়ের পাশটিতে । ভোর হবার আগেই হঠাৎ বিছানা থেকে ছিটকে মাটিতে পড়ে অসহ্য শারীরিক যন্ত্রণায় ছট্ফট্‌ করতে লাগল মেয়েটি । মৃগীরুগির লক্ষণ, কিন্তু জাইদির তো কখনও এ' রোগ ছিল না । বিষক্রিয়া নয়, তেমন কোনো লক্ষণ নেই । দেখতে দেখতে সুস্থ-সবল তরুণী কন্যাটি মৃত্যুমুখে পতিত হল, কারোকে কোনোরকম চিকিত্সার সুযোগ না দিয়েই । ডাক্তারবাবুর ঘরে ঢুকে গ্রামপ্রধান দেখেন সে ঘর খালি । কখন যে ডাক্তারবাবু চলে গেছেন কেউ জানে না ।

    আর ঠিক এই সময়েই আকাশে শোনা গেল `শোঁ শোঁ' শব্দ । ভোরের আলো তখন সবে ফুটতে শুরু করেছে । সেই আলো ঢেকে দিয়ে আকাশ অন্ধকার করে ধেয়ে আসছে কোটি কোটি পঙ্গপালের দল । আর রক্ষা নেই ! এখনই শেষ করে দেবে ক্ষেত ভরা ফসল । গ্রামবাসি সভয়ে চোখ মুদে ফেলল । ডা সম্নথনাথের ডায়েরিতে এই পঙ্গপাল-আক্রমণের উল্লেখ আছে, কারণ তিনি তখন সবে ফিরতি নদীপথ ধরেছেন ।

    আর এই সময়েই দেখা গেল এক অদ্ভুত দৃশ্য । গ্রাম ও শস্যক্ষেত্র ঘিরে একে একে দাউদাউ জ্বলে উঠছে লেলিহান অগ্নিশিখা ! চারিভিতের জঙ্গল জ্বলছে আর রক্ষা করছে উ-নুন গ্রাম ও তার শস্যক্ষেত্রকে । যেন গ্রাম ও তার ফসল রক্ষা করতে স্বয়ং অগ্নিদেব দিয়েছেন তাঁর করস্পর্শ । সেই অগ্নিবলয়ে দলে দলে পঙ্গপাল এসে এসে পড়ছে ও পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে ! অবাক গ্রামবাসি করজোড়ে প্রত্যক্ষ করল অগ্নিদেবের সে-মহান লীলা !

    বিজুদা বলে চলেন, ঘটনাটা অবশ্য গোপন রইল না । কেঁদেকেটে ডা: বসুর সেই ভৃত্যই সব বলতে থাকল । কী করে এক ভারতীয় চিকিত্সকের দীক্ষায় তরুণ শিক্ষক মহীদোল নিজ স্ত্রীর জীবন বলিদান দিয়ে গ্রামবাসিকে রক্ষা করেছে --- সে কাহিনী নিয়ে জয়জয়কার হতে লাগল ! উ-নুন গ্রামের সেই মহীদোল- বন্দনা আজও অব্যাহত আছে ।

    কিন্তু এর একটা বিপরীত দলও তৈরি হতে দেরি হল না গ্রামপ্রধানের নেতৃত্বে । গ্রামপ্রধানের পরিবারই মহীদোলকে খুনি সব্যস্ত করল । তাদের সঙ্গীও জুটে গেল । মনোকষ্টে জর্জরিত হয়ে পড়ল মহীদোল । সত্যিই কি তার কোনো অধিকার ছিল জাইদির জীবন নেবার, জাইদির সম্পূর্ণ মত থাকা সত্ত্বেও ? সারা গ্রামভরা উল্লাস-জয়ধ্বনির মধ্যে নিজের ঘরে ঢুকে আগল দিল মহীদোল ।

    এদিকে হৈ হৈ পড়ে গেছে । বনের আগুন গ্রামের দিকেও ধেয়ে আসছে । প্রথমেই গ্রামপ্রধানের বাড়ি । তাকেই গ্রাস করল আগুন । সকলে জল-টল ঢেলে সে-আগুন যখন নেভালো, বাড়ির হাতায় মহীদোলের কাষ্ঠকুটিরটি সর্বাগ্রে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, আর তার সঙ্গে সেই পরোপকারী যুবক যার দাক্ষিণ্যে আজ বেঁচে গেল গ্রামবাসী । মহীদোলের মৃতদেহ পুড়ে আঙরা, চেনার উপায় নেই ।

    এতক্ষণে সকলে জাইদির দেহ সত্কারের জন্য নিতে এসে দেখে কী বীভত্স ! সে-দেহে মুণ্ডটি নেই ! কেউ এই গণ্ডগোলের মধ্যে কেউ সেটি কেটে নিয়ে গেছে !

    ***


    বিজুদার গলায় গল্পশেষের সুর । শেষে এইটুকু বললেন, "মহীবাবুর গল্প এখানেই শেষ হয়েছিল । উ-নুন গ্রামের কাছে মহীদোল সত্যসাই তখনই মৃত পরিগণিত হলেও আমি এ'ঘটনার পুর্বাপর জেনে কলকাতায় ফিরেই ছুটে গিয়েছিলাম আমার ছোটবেলার সেই বরাহনগরের গঙ্গারধারের মামাবাড়িটাকে ফের একবার চোখের দেখা দেখতে । যদিও জানি মামারা আজ আর কেউ নেই, মহীবাবু শেষ পর্যন্ত কোথায় গেলেন মা-ও বলতে পারলেন না । পঁচিশ বছর আগেই সে-বাড়ির হাত বদল হয়ে গেছে । সে-বাড়ি ভেঙে এখন সেখানে এক বহুতল উঠেছে । চোখের জলে ফিরে আসছি । হঠাৎ শুনি বাড়ির সামনে ফুটপাতে এক সাপুড়ে ডেয়ো-ডাকনা নিয়ে বসে তার বাঁশিতে সুর তুলেছে । অবাক হয়ে শুনি এ' তো আমার সেই চেনা সুর । কোন মায়ামন্ত্রবলে আজ আবার সেখানে বাজছে থাই-বাঁশির সুর ।

    কায়েন বায়েত ! "

    (পরবাস-৪৪, ডিসেম্বর, ২০০৯)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments