জড়াজড়ি করে সব নারীর ভেতরে গাঁথা থাকে মালা । আমার সাথে অন্য অনেকের । এক একটা সুতোয় এক একজন নারীর গভীর গভীরতম অনুভূতির, স্নায়ুকেন্দ্রের জটের মত জটিলভাবে যোগাযোগ থেকে যায় । এই তো জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি । এই মেয়েজন্মে । এই মেয়েজন্মই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি । লুকিয়ে খাওয়া কুল বা তেঁতুলের আচারের মত চেখে চেখে খাওয়ার প্রাপ্তি ।
আজ রাজগঞ্জের এই ছোট্ট বাড়িটাতে থাকতে এসে এইসব কথাই মনে হচ্ছিল । আমার কাছে এবারের এই আসা, বড়পিসিমার বিক্রি হয়ে যাবার আগের বাড়িতে শেষবার থাকতে আসা, কেমন করে যেন খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এবার ।
আসামাত্র এখানকার দারোয়ান স্বপনদা পিসিমার শোবার ঘরের দরজা খুলে দিয়েছে । কমদিনের তো নয় সম্পর্কটা । সেই স্বপনদা । বড়পিসি মানুষই করেছিলেন একরকম ওকে, বিহার বর্ডারের থেকে প্রায় কুড়িয়ে এনে ।
স্বপনদা সীমিত জিনিসপত্রের ভেতরেই কোনমতে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে । একটা মোটামুটি পরিষ্কার চাদর পেতে দিয়েছে জলচৌকির উপরে । বালিশ একটাই ছিল, তেলচিটেই । সেটাকেই ভালো করে ফুলিয়ে, গুছিয়ে, থাবড়েথুবড়ে, উপরে একটা পরিষ্কার হাত-তোয়ালে পেতে দিয়েছে । পিসিমার কথা মনে পড়ছে । পিসিমা চলে গেছেন । ওনার বইপত্রগুলো নিয়ে যেতে হবে আমাকে । সেই কাজেই আমি এসেছি । এবার এ-বাড়িতে শেষ আসা । যে বাড়িতে বড়পিসিমা লতার মত জড়িয়ে গিয়েছিলেন তাঁর আশি বছরের একাকী জীবনে । বাড়ি, বাড়ি, এই আর এক বন্ধন মেয়েদের । পুরুষের থেকেও কত বেশি করে এই বন্ধনটুকু তারা বোঝে, আর তার মায়ায় পড়ে যায় ।
মায়ার জিনিস কি আর কম ? এমনকি খিড়কির দরজায় বসে থাকা নেড়ি কুকুরগুলোকেও আত্মীয়তা বন্ধনে বেঁধেছিলেন আমার বড়পিসিমা । ওই যে হাঁসগুলো প্যাঁকপ্যাঁক করে পুকুরের দিকে হাঁটা দিচ্ছে সগর্বে, অতি আত্মপ্রত্যয়ী ভঙ্গিতে, ওগুলোকেও মুড়ি ছড়িয়ে খেতে দিতেন বড়পিসিমা, আমি জানি । পাখিদের ভেতরে কত বন্ধু ছিল ওঁর । আর বেড়ালগুলো তো ওঁর ক্ষীণ অসুস্থ বুকের উপরেই শুয়ে শুয়ে থাকত ।
অনেকদিন আগে দেখতে এসেছিলাম ওঁকে । তখন জানতাম না ওঁর জীবত্কালে আর আসা হবে না । আসলে আমাদের জীবনে ওই একটি অনিশ্চিতই সবচেয়ে আসল । মৃত্যুর দিনক্ষণ কেউ ঠিক করে দিতে পারে না ।
বড়পিসিমার নানারকমের মায়ার বন্ধন ছিল । তাই বছরের পর বছর, কী এক অসামান্য জেদে, অসামান্য অভয় ও নিশ্চিতি নিয়ে, এই একলা বাড়িতে শুধু স্বপনদা আর ওর বউ-মেয়ের ভরসায় থেকে গেছিলেন ।
সবাই রাগ করত । আমার মা বারবার বলত, এ সব ওর জিদ্দিবাজি । হবে না, বরিশালের মেয়ে তো । বড্ড অবুঝ । আমি যে কি ভুগেছি তোর বাবার বাড়িতে এসে, জানিস না তো ? এরা সব এক একজন এক একটি শৈলচূড়া । যেমন ঠাণ্ডা তেমনি শক্ত । তেমনি অনড় । এদের নড়ানো যায় না । মধ্যে থেকে আমি খুলনার মেয়ে, সারাজীবন সবার মন পাওয়ার চেষ্টা করে, ভুগে গেলাম ।
এই যে, আমার সাথে আমার মায়ের যত না মিল, তার চেয়ে বেশি বড়পিসির । মার কি তা নিয়ে কম আপত্তি ! অথচ আমি তো নিজেই জানি, আসলে আমি মায়ের মতই । ভেতরে ভেতরে নরমসরম । মায়ের মতই ক্যাবলা । কিছুতেই ম্যানেজ করে উঠতে পারিনা কিছু । বড়পিসিমার সঙ্গে আমার মিলগুলো বাইরের বাইরের । আপাতদৃষ্টির । আমাদের চেহারা একরকম, আমাদের দুজনেরই দীঘল লম্বাটে চেহারা, ফর্সা গায়ের রঙ, নাক টিকোল । আমাদের গলার স্বর অনাবশ্যক কর্কশ । আমাদের চোখের চাউনিতে বেশ রাগ রাগ ভাব । কিন্তু বড়পিসির মত অমন একার জীবন কাটানো, একলা একলা তিরিশ বছর, পিশেমশাইয়ের স্মৃতি জড়িয়ে থাকা ? ওরেব্বাবা ! আমার পক্ষে সম্ভব না । নারীদের মধ্যে দুরকমের সম্পর্কের কথা আমরা জেনেছিলাম । প্রথম ধরনের সম্পর্ক, আমার সাথে আমার মা, মাসি, দিদা, ঠাম্মা, পিসির । এক মাতৃতান্ত্রিক বিস্তারে আমাদের ভেতরে রয়ে গেছিল আমাদের মায়েরা, মাতৃপ্রতিমেরা ।
ওরে ও সরসী, উনুনে আগুন দিলিনি ? স্বপনদার বউ উমা বলছে মেয়েকে । কোথাও সুরের ভেতরে বেজে ওঠে রিনিরিনি করে মায়ের সাথে মেয়ের আজন্ম জড়ানো সুতো । মেয়ের বয়স মায়ের বয়সের থেকে কত কম । অথচ দুজনেই কেমন একসাথে নারী হয়ে উঠেছে ।
আমি বারান্দায় বসে আছি । বারান্দায় শীতের রোদ এসে পড়েছে । একটা মচমচে ভাঙা বেতের চেয়ার আছে, কুশনের জায়গায় পুরনো ছেঁড়া খেশ মুড়ে একটা অসমতল দলা-পাকানো বসবার আসন তৈরি হয়েছে । সেটাতেই বসে আছি । বসে বসে কেমন ঘুমমতো আসে । আর এইসব কথা মনে হয় ।
মা, পিসিমা, মাসি, দিদা । হ্যাঁ, খুব শান্তির সম্পর্ক সব । এর পর গিয়ে পড়লাম অদ্ভুত ভুল বোঝাবুঝির জায়গায় । আমার শাশুড়ি, আমার ননদ, জা । ওরাও তো মেয়ে । মা পিসিমা মাসিদের থেকে কোন অংশে কম ? অথচ কী আকচা-আকচি, কী ভীষণ বিশ্বাসের অভাব । আমি যেমন ওদের আপন করে নিতে পারিনি, ওরাও তো আমাকে পারেনি । কেউ বেশি দোষী বা কেউ কম দোষী, এমন তো নয় । অথচ বৈবাহিক সম্পর্কগুলো এমন হয় কেন ? যাক, কী আর হবে ওসব ভেবে । বিয়েও তো আর আমার কমদিন হল না । তবু রান্নাঘরের অধিকার নিয়ে লড়াই, ছোট ছোট মনোমালিন্য, এর হাত থেকে আমরা আজও উদ্ধার পাইনি । আমার বর, সুভাষ, প্রায়ই বলে, এবার তো পুরনো বউ হয়ে গেছ, বাড়ির । বৌদি বা মা তোমাকে কী এমন অপমান করেছিল যে এখনো ও বারান্দায় গামছা মেলতে যেতে পারো না ?
গামছা মেলতে কে যাবে বাবা, যত রোদই আসুক । এদিকে ঠাণ্ডা, উত্তর-পশ্চিমের কনকনে হাওয়া, কোন রোদ নেই, তবু আমার শাড়ি জামা নিচের জামা সব এদিকেই শুকিয়ে নিই । জিনিসপত্রেরও তো প্রাণ আছে রে বাবা, বড়পিসিমা বলতেন । সেই জিনিসপত্রকেও মানুষ ভেবে মানুষ কতকিছু করতে পারে । দেখলে চোখে সহ্য হয়না । আমার গামছাটা হয়ত আমার জা দূরে ঠেলে দেবে, নিজের জামা মেলার সময়ে । আমার শাড়িটা দলা পাকিয়ে দড়ির একপাশে জড়োসড়ো হয়ে থাকবে, যেমন আমি থাকতাম । ওদের বাড়িতে ।
থাকতাম কেন, এখনো তো থাকি । না, এখন আর থাকি না । এখন আমি যাযাবর । ছেলেপুলে হল না বলেই সংসারে আর আমার মন টেঁকে না । সুভাষ আমাকে প্রায়ই বলে, আমাদের এই সংসার করাটা কেমন যেন । ছাড়া ছাড়া । কোন মায়া নেই । বলেই সামলে নেয় নিজেকে । ওকে বাচ্চা দিতে পারিনি বলে আমাকে ভুলে যদি ঠেশ দিয়ে ফেলে, আমি কীভাবে আবার তার উত্তর দেব ওকে, কেমন করে কষ্ট পাওয়াবো, কোন ছলে, কে জানে বাবা ।
তো, এখন আমি বই লিখছি । বড়পিসিমার উপরে । বড়পিসিমার বইপত্র, যেগুলো একটা পুরনো, ড্যাম্পধরা, পোকায় কাটার একেবারে উপযোগী দেওয়াল আলমারিতে রেখে উনি চোখ বুজেছেন, ওখান থেকে সরিয়ে নিয়ে আমাকে যেতে হবে । এটা আমার ব্রত । একই সাথে, আমাকে বড়পিসিমার ওইসব পুরনো কাগজপত্রের মধ্যে ওনার ১৯৫৭ সালে লেখা একটা উপন্যাস খুঁজে পেতে হবে । যেটা নাকি পাণ্ডুলিপি আকারেই থেকে গেছিল, জানি আমি । আমাকে বলেছিলেন পিসিমা, অত শিক্ষিত আর প্রেমময় স্বামী, আমাদের পিসেমশাই, নাকি ওই বই ছাপাতে দিতে পারেননি । কেন যে পারেননি, এই প্রশ্নটার যেমন উত্তর হয় না, তেমন তিনি মারা যাবার পর তিরিশ বছরেও কেন পিসি সেটা ছাপলেন না, এটারও উত্তর হয় না । আর খুঁজব কিছু চিঠি, কিছু ডায়েরি, কিছু ব্যক্তিগত অ্যালবাম, যদি তা থেকে বড়পিসিকে আবার তৈরি করে তুলতে পারি ।
আজ সকালটা খুব সুন্দর । কাল সন্ধেতে যখন এসে পৌঁছই, চারিদিক কেমন একটা ম্লান, দ্রুত নেমে আসা সন্ধের অন্ধকারে স্তিমিত হয়ে ছিল । ভালো লাগছিল না । স্বপনদা ঘর খুলে দিল, ঘরে একটা স্যাঁতসেতে গন্ধ । পিসিমা চলে গেছেন, বাড়ি বিক্রি করার ব্যবস্থা করেছে মেজদা । পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি ওরই । স্বপনদারাও যে বেঘর হয়ে যাবে, এটা আগে ভাবিনি আমি । এখন বুঝতে পারলাম । ওদেরও গত কুড়ি বছরে এখানে শিকড় গজিয়ে গেছে । অথচ যে অথরিটি নিয়ে স্বপনদা আগে আমাদের বাড়িতে আসত, কথা বলত, তা এখন কেমন যেন ম্রিয়মাণ । উমাবউদি খাবার বেড়ে দিল, গরম ভাত আর মশুর ডাল । আমি রাতে রুটি খাই । স্বাস্থ্যসচেতন আমি এতটা ঘি আর আলুসেদ্ধ দিয়ে ভাত কখনো খাইনা । কাল খেলাম । উমাবউদি হাসল, গল্প করল, কিন্তু হাসিটা ফিকে, ভাবটা নার্ভাস নার্ভাস । যেন কিছু জিগ্যেস করতে গিয়েও করল না । কী করেই বা জিগ্যেস করে । জানে তো, আমার কোন ক্ষমতা নেই, আমি তো পাওয়ার অফ অ্যাটর্নিধারী নই । তবে মেজদা যখন জায়গাটা বিক্রি করে ফেলবে, তখন টাকার ভাগ তো আমরাও পাবো । কাজেই কিছুটা দায়িত্ব আমাদের উপরেও বর্তায় না কি ? আমার উপরেও ?
অথচ আমি উমাবউদিকে কিছু বলতে পারিনি । ওর উত্সুক চাউনির দিকে তাকাতে পারিনি সোজাসুজি । শুধু মাথা নিচু করে খেয়ে গেছি । আর খাবারের প্রশংসা করে ওকে আরো আরো লজ্জায় ফেলেছি । রাতের দিকে মাছ জোগাড় করে উঠতে পারেনি বলে এমনিতেই ও ভীষণ লজ্জায় আছে ।
আজ সকালে সে সব মেঘ কেটে গেছে । ভাবিনি, রাতে যে কষ্টটা নিয়ে শুতে গেছিলাম, উথালপাতাল করেছিল বুক, মনে পড়েছিল বার বার, এই বাড়িটার বিভিন্ন ঘরে কোন কোন বয়সে কি কি করেছি, কতবার মা বাবার সাথে এখানে এসে ছুটি কাটিয়ে গেছি, বছর দশেক বয়সে জীবনে প্রথম ও শেষবার গাছে চড়েছিলাম এই বাগানে (কে জানত, পেয়ারাগাছে চড়া এত সোজা হয় ? যদি না স্বপনদা তরতরিয়ে উঠে যেত আগে আগে, আর আমিও ওর দেখাদেখি নানান ডালের খাঁজে পা ফেলে ফেলে, আর তারপর সারা গায়ে কালো ডেঁয়ো পিঁপড়ে নিয়ে কোনমতে নেমে আসা), সবসময়ে পরীক্ষার পরে, মায়ের কোঁচকানো ভুরুকে অগ্রাহ্য করেই চলে আসতাম একরাশ বিভূতিভূষণ, শরদিন্দু, শরত্চন্দ্র নিয়ে নিজের বড় হয়ে ওঠার প্রথম সুখ উপভোগ করতে, মুড়ি খেতাম সরষের তেল দিয়ে, কাঁচা কড়াইশুঁটি দিয়ে বড়পিসিমার সঙ্গে । আর শুনতাম বেদ, উপনিষদের গল্প, সংস্কৃত কবিতা গড়গড় করে আবৃত্তি করতেন বড়পিসিমা, তাঁর পড়া কোন জিনিসই তিনি যে ভোলেননি, কেননা ছোটবেলা থেকে আবৃত্তি করে করে, মনে মনে বা সজোরে আউড়ে, যে-কোন ভালো লাগা কবিতা, যে কোন ভালো লাগা শ্লোক, মুখস্ত করে নিতে শিখে গিয়েছিলেন তিনি । এই সব কিছুই পর পর, বা ছেঁড়া ছেঁড়াভাবে, আমার মনে পড়ে যাচ্ছিল আবার ।
সেসব আবেগে অনেক রাত অব্দি ঘুমোতে পারিনি আমি । তারপর কখন জানিনা ঘুমিয়ে পড়লাম । একটা মশারি ছিল তাই রক্ষে । নইলে ঘুমোতে পারতাম না । তাও তো, ডানহাতটা মশারির সাথে লেগে ছিল, সকালে দেখি সেটা লালে লাল, মশারির ফুটো দিয়ে কুটকুট করে কামড়ে গেছে মশারা ।
সকালে মন কেমন ঝরঝরে হয়ে গেল । এখন গিয়ে নিয়ে বসব পিসিমার বইখাতার ঢের । ভারে ভারে বইখাতা বয়ে নিয়ে যাব, দুটো বেশ বড় বিগ শপার ব্যাগ নিয়ে এসেছি । হঠাৎ মনে ভেসে উঠল সুভাষের মুখটা, সুভাষ বলল, বা:, তোমার তো দেখছি বেশ কিছুদিনের ব্যবস্থা হয়ে গেল । এবার তো এই বই লেখার জন্য লাইব্রেরি টাইব্রেরিও যেতে হবে তোমাকে ।
যাবই তো । পিসিমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক আজকের নাকি । নিজের হাতের উল্টোপিঠের মত করে পিসিকে চিনতাম বলেই আজ পিসির একটা ডায়েরি বা একটা কুচি কাগজও আর ফেলে দিতে পারব না আমি । পিসির ব্যক্তিত্ত্বের সুগন্ধ, সৌরভ, মাখামাখি হয়ে আছে প্রতিটি জিনিসে ।
আমি লেখালেখি করব বলে, মেয়েদের লেখাই ধরেছিলাম । তখনো তো পিসির প্রশ্ন ওঠেনি । পিসি এই রায়গঞ্জে একলাই ছিল । আমি তো বাড়ি থেকে বেরিয়ে বেরিয়ে, চারিদিকে থেকে ঘুরে ঘুরে আসছি পড়াশুনার কাজেই । আমি অনেকদিন থেকেই আর গৃহকর্মে মন বসাতে পারিনা । অথচ সংসার করব বলে, ট্রেনে করে কয়েক ঘন্টা ব্যয় করে যাবার ধ্যাদ্ধেড়ে গোবিন্দপুরের সেই বিচ্ছিরি ইশকুলের চাকরিটাও ছেড়েছিলাম । তারপর কত দিন কেটে গেছে । সুভাষ বলত, মনমরা হয়ে বাড়িতে বসে থাকা, আর মা বা বউদির সাথে ঠোকাঠুকি করে গুমরে মরা, এমন জীবন কেন কাটাচ্ছো । তুমি তো পারো, কতকিছুই পারো । লেখোটেখো, কাজ কর কিছু । তখন ধীরে ধীরে আবার পড়াশুনোর কাজ শুরু করলাম । বাড়িতে বাবা বা পিসিরা তো পড়াশুনোর জগত্টা কোনদিন আমার কাছ থেকে সরিয়ে নেয়নি । আমি কেন যে নিজেকে কবর দিতে চেয়েছিলাম বিয়ের পর কয়েক বছর, কে জানে । আবার তুলে নিলাম সব ।
কুড়িয়ে নিলাম নিজেকে । প্রথমে আমাকে এক গৃহবধূর তিরিশ চল্লিশের দশকে লেখা একটা আত্মজীবনীর খাতা এনে দিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মণিকাদি । ওই আর একজন দিদি আমার, যিনি অনাত্মীয় হয়েও আত্মীয়ের বেশি । উনিই মাথায় ইচ্ছের বীজটা ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন । এডিট করো । আমরা বই করার ব্যবস্থা করছি । তারপর কত কাজ । প্রায় ডিটেকটিভের মত ঘরে ঘরে ঘুরেছি ওই ডায়েরির সাথে বাস্তবকে মিলিয়ে একটা বই খাড়া করতে ।
তখনই তো দেখেছি, আমাদের দেশে মেয়েদের লেখালেখি করাটা কেমন । মা, বা বউ, বা মাসিপিসিরা লুকিয়ে লুকিয়ে অবসর সময়ে ডায়েরিতে লিখবেন । অবসর মানে ? মানে, আসলে বাড়ির কাজ, রান্নাবান্না, ছেলেপিলে মানুষ করা, এগুলোই বেশি গুরুত্বপূর্ণ । এগুলোই আগে করতে হবে । এগুলো করার পরেও যদি অল্প সময় তুমি পাও, সেই সময়ে করো না যা খুশি । লেখো, পদ্য বা গদ্য । মেয়েদের কবিতা তো পদ্যই । গদ্যও, সাহিত্যপদবাচ্য নয় । মানে, ধরেই নিতে হবে যে সাহিত্য নয়, কেবলই আত্মগত কিঞ্চিত আলাপচারিতা, গালগল্প, আত্মজৈবনিক একরকমের গদগদ প্রলাপ ।
ওর আবার আলাদা কি মূল্য থাকবে । তা, এখন, যখন নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে, এক একটা ভুঁইফোঁড় নারীবিদ্যা, না মানবীবিদ্যা না কিসব বলে যেন, ডিপার্টমেন্ট হয়েছে, তাই এইসব আত্মগত ডায়েরির খোঁজ পড়েছে । তাই আমাদের মত কয়েকজন ঘরোয়া স্কলার একটু করেকম্মে খাচ্ছে । তো, সেইসব লেখালেখির খোঁজে বেরিয়ে আমি তো দেখতেই পেলাম, কীভাবে হারিয়ে যায়, নষ্ট হয়ে যায়, একেবারে লোপাট হয়ে যায় লেখাগুলো । আর এগুলোকে খুঁজে বার করতে পারে একমাত্র শার্লক হোমসের ভায়রাভাইরা । আমার ভেতরেও যে একটুআধটু সত্যসন্ধানীর চরিত্র আছে তা আমি এই কাজে না নামলে জানতাম না । আরে, এতো আর আমার জা-এর ঠেলে দেওয়া গামছাটা দেখে নেওয়া নয় আড়চোখে । বা রান্নাঘরে আমার আগের দিনের রান্না করা ঝোলটা যখন ঝিকে নামিয়ে দেন আমার শাশুড়ি, সেটা দেখে নিয়ে ঘরে ফিরে ফোঁসফোঁস করা নয় ।
আমাদের মেয়েরা যা কিছু লেখেন, তা যত্ন করে তুলে রেখে দেয় মেয়েরাই । যে মহিলার নিজের মেয়ে নেই, যদি বা একটা বোনঝি বা ভাইঝি থাকে, সে অন্তত কিছু একটা করে উঠতে পারে, সব নিয়েটিয়ে, নিজের আলমারির একটা কোনায় প্লাস্টিকে মুড়ে তুলে রাখতে পারে । (আমার বড়পিসিমা, যেমন, খুব ভাগ্যবতী । আমার মত এক ভাইঝিকে তিনি লালন করেছিলেন, তাঁর মানসজগতে প্রবেশাধিকার দিয়েছিলেন, এমনকি বলেই ফেলেছিলেন আমাকে, পিসে কীভাবে বাধা দিয়ে ফেলেছিলেন তাঁর জীবনের এক এবং একমাত্র উপন্যাস ছাপানোয়, আর বাড়িয়ে দিয়েছিলেন আমার আগ্রহ ।) কিন্তু যে মহিলা এমনই হতভাগা, যে তাঁর ছিল শুধুই পুত্রধন, এবং মৃত্যুর পর তার যাবতীয় সম্পত্তি গিয়ে পড়ল তাঁর বউমার হাতে ? নৈব নৈব চ । তাঁর সব জিনিস চলে যায়, সামান্য কটি বালা, চুড়ি, কানের দুল বাদ দিলে, আর সব একান্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তিই কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে । যাবেই । আমি এটা দেখেছি, এটা এক পরীক্ষিত সত্য । ছেলে চলে যাবার পরে খাতাটা যে কোথায় গেল সে তো ঠিক খেয়াল নেই ।
যাবে আবার কোথায় ? সের দরে রদ্দি হিসেবে বেচে দেওয়া হয়েছে । ক্ষমতার খেলায় হেরে গিয়েছেন ওই লেখিকা । লিঙ্গক্ষমতার অনিবার্য খেলায় ।
আজ আমাকে বসে বসে সারাদিন এইসব খাতা ঘাঁটতে হবে । এক ফ্লাস্ক চা করে দিয়ে গিয়েছে উমাবউদি । দুপুরে খিচুড়ি আর মাছভাজা খাব, ঝালবড়া করবে বউদি, বলে গেছে । একটা, দুটো, তিনটে বই উইতে একেবারে ঝুরিভাজা করে ফেলেছে । আমার পাশে বসেছে এসে সরসী, থেবড়ে বসেছে মাটিতে । হাত হলুদের দাগ, তেরো বছর বয়সেই রান্নায় একেবারে পাকা । গিন্নির মত একটা ছেঁড়া ন্যাকড়া নিয়ে বসে বসে ধুলো ঝেড়ে ঝেড়ে আমার হাতে তুলে দিচ্ছে বড়পিসিমার বইগুলো ।
আমার বুকের ভেতরে খেলা করছে মেয়েদের সাথে মেয়েদের গভীর সম্পর্কের কথাগুলি । আর বুক ভরে উঠছে আনন্দে । আমার জীবন আগামী কয়েকটি দিন, মাস, বছরে, ভরে উঠবে এক অন্যরকমের পূর্ণতায়, কাজে । আমি বাড়িতেই থাকবে, আমারই বাড়িতে, অথচ আমি রাজগঞ্জের সোঁদা টাটকা মাঠমাটির গন্ধ পাব, পেয়ারাগাছের ছায়া পাব । আমার বড়পিসিমার চশমার খাপ, পুরনো হিসেবের খাতা, একটা ছোট ডায়েরিতে লিখে রেখে দেওয়া কত কিছুর তালিকা, একটা একটা করে দেখছি, আর বিগ শপারে ঢোকাচ্ছি আমি । তালিকাগুলো কিসের ? কিছু পুরনো চিত্রতারকার নাম । কিছু, আমাদের বাড়ির আত্মীয়স্বজনের নাম । কিছু লেখকের নাম ।
তাড়াতাড়ি দেখছি সব, খুঁটিয়ে দেখার সময় পাব বাড়ি গিয়ে । এটা কিরকম তালিকা, বুঝতে না পেরে ডায়েরিটার একেবারে প্রথম পাতায় এলাম । বড়পিসিমার গোটা গোটা হাতের অক্ষরে লেখা রয়েছে, পরলোকগতদের খাতা । বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল । কতদিন ধরে পরলোকগত মানুষের এইভাবে তালিকা বানিয়ে বানিয়ে রেখেছিলেন বড়পিসিমা ? কতদিন ধরে ? এভাবে মানুষ কী করে বাঁচে ? বাঁচার ভেতরে, ক্ষণে ক্ষণে মৃত্যুকে মুড়ে নিয়ে ? কাপড়ের টানাপোড়েনের মত, জীবন আর মৃত্যুকে একসাথে ঠাসবুনোটে বেঁধে ? কাঁথার ফোঁড়ের মত প্রতিমুহূর্তে তাহলে বড়পিসিমা অবুভব করতেন পিশেমশাইয়ের অনুপস্থিতি, তাঁর অকালমৃত মেয়েটির অভাব ? হয়ত বা নিজের সব প্রিয়জন, বাবা, মা, আত্মীয়, বন্ধু, সবাইকেই এই দীর্ঘ আশি বছরের জীবনে একে একে হারিয়েছিলেন তিনি, আর প্রতিবারই, একবার করে লিখে রেখেছিলেন তাঁর ওই খাতায় । যার পাতায় পাতায় জীবন্ত মৃত্যুচেতনা ।
বড়পিসিমা কেবলই একা হয়ে যেতে চাইতেন শেষদিকে । স্বপনদাও বলছিল, ওদেরও উপরে রাগ করতেন কেবলই । বার বার বলতেন, থাকতে হবে না তোদের আমার কাছে, চলে যা । আসলে নিজেকে সবার থেকে সরিয়ে নেবার কী এক খেলা ওঁকে পেয়ে বসেছিল । কুকুরবেড়ালগুলো, পাখি হাঁস গাছপালা ছাড়া, কোন মানুষকেই আর সহ্য করতে পারছিলেন না । হয়ত মৃত্যুচেতনা ওকে এতটাই ঘিরে ফেলেছিল, জীবনের কাছে কাছে, পায়ে পায়ে ঘুরঘুর করা মানুষদের বড়পিসি আর দেখতেও চাইতেন না ।
আর পিসি তো গত ত্রিশ বছর নিজের মত থেকেছেন । পড়াশুনো করেছেন । চিন্তাভাবনা করেছেন । স্বাধীন জীবন ।
মৃত্যুচেতনার এই হঠাৎ ধাক্কায় কেমন থতমত খেয়ে যাই আমি । হঠাৎ মনে পড়ে যায়, গতকাল যখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছিলাম, গীতা ঘটকের মৃত্যুসংবাদ দেখাচ্ছিল টিভিতে । এই খবরটা পেলেও বড়পিসিমা হয়ত নিজের পরলোকগতদের খাতায় লিখে ফেলতেন নামটা । দীর্ঘ তালিকার শেষে । পাহাড়ি সান্যাল বসন্ত চৌধুরী উত্তমকুমারের তালিকায় ঢুকতেন কি, গীতা ঘটকও, মেঘে ঢাকা তারার অনবদ্য অভিনয়ের জন্য ?
হঠাতি মনে পড়ল, একটা অন্যরকম মানুষের মুখে একটা কথা শুনেছিলাম । আমার শাশুড়ি । কী যেন সব বলছিলেন । তখনই তো দেখলাম, গীতা ঘটকের খবরটা দেখানোর সময়েই । দেখলাম টিভির সামনে এসে পা দুটো ছড়িয়ে দিয়ে বসেছেন । রান্নাঘরের কাজ সেরেছেন একটু আগে, চানে যাবার আগে একটু চুপ করে বসা । বাকিরা, মানে পুরুষেরা, মানে যাদের জন্য এতসব যগ্যিবাড়ির আয়োজন করা, তারা ততক্ষণে খেতে বসে গেছে । মায়ের তো কোনদিন তিনটের আগে স্নানখাওয়া হয়না । কেবলি রান্নাঘর । হয় রাঁধছেন, নয় কাটছেন, নয় গুছোচ্ছেন, নয় পরিষ্কার করছেন । ওই ছোট চৌহদ্দিটার অধিকার তো ছাড়তে পারলেন না কোনদিন, আজও সবাইকে একধারে সরিয়ে রেখে নিজে রেঁধেছেন মাছের ঝোল, ঝিঙেপোস্তটাও কাজের মেয়েকে ছুঁতে দেননি । ওকে দিয়ে ডাল আর ভাতটা করিয়েছেন, আর সব খাবারে নিজের হস্তস্পর্শ রেখেছেন । ওর বাইরে ওনার আর যাবার জায়গা নেই জানি, তবু মাঝে মাঝে কেমন যেন অদ্ভুত লাগে ভাবতে, কত বই, কত পত্রিকা পড়ে থাকে টেবিলে, একবারও তুলে দেখেন না তো !
কাল দুপুরে, ওই একটু সময়ে, আমি তখন শাড়ি পরে, হাত ঘড়ি বেঁধে, বিগ শপারটপার ব্যাগে ভরে মা আমি রাজগঞ্জ যাচ্ছি, যা হোক দুটো খেয়ে নিই বলে খাবার টেবিলে আমার শ্বশুরমশাই আর সুভাষের সঙ্গেই বসে গেলাম তখন একটা কথা শুনেছিলাম, এখন মনে পড়ল । দায়সারা ভাবে খাচ্ছিলাম, উনিও উদাসীন ভঙ্গিতে বললেন, আমাকে তো খরচের খাতাতেই রেখে দিয়েছেন বহুদিন, বললেন পোস্তটা নিও কিন্তু, আমি বানিয়েছি কেমন হয়েছে দেখো তো ।
ওনার রান্নাকে আমি সবসময় ভালো বলি, রাজনৈতিকভাবেই বলি । উনি আমার রান্নাকে কোনদিন মন্দ নয়ের উপরে কিছুই বলেননি । একথা ভাবলেই আর ওনার রান্নাকে ভালো বলতে ইচ্ছে করে না । সুভাষ হাসে, বলে তুমি তো আরো কতকিছু পারো, লিখতে পারো, সাজতে পারো, ভাবতে পারো । রান্নার প্রশংসা না হয় তুমি না-ই পেলে । জীবনে তো এতকিছু পেয়েছো । মা তো আর কিছুই পারে না । মা তো কিছুই পায়নি । ওই রান্নার প্রশংসাটুকু ছাড়া ।
আমি বলি, কেন তুমি যে বলো, তোমার মা গানটান গাইতেন এককালে ।
আরে সে তো বিয়ের আগে । বিয়ে দেওয়ার জন্য মেয়েকে হারমোনিয়ামটাম কিনে তো দেয় অনেক বাবাই । মাকেও দাদু কিনে দিয়েছিল, বিয়ের পরেই সব লোপাট ।
তো সেই শাশুড়ি আমার কাল কেমন ম্রিয়মান মুখে বললেন, গীতা ঘটক মারা গেলেন, জানতে ?
আমি বললাম, হ্যাঁ, ওই তো টিভিতে দেখালো । কষ্ট হয় ।
মা বললেন, আমার গান শুনে অনেকে বলত, গীতা ঘটকের ছাত্রী বুঝি ?
তাই ? আলুপোস্ততে মন দিয়ে আমি অন্যমনস্কভাবে বলি ।
আজ, এই রাজগঞ্জে বসে, বড়পিসিমার খাতাবই ঘাঁটতে ঘাঁটতে, হঠাৎ এই কথা মনে পড়ল আমার । ওই মৃতের তালিকা দেখে ।
আমার শাশুড়ি বিড়বিড় করে বলছিলেন, তখনো, যখন আমি মুখ ধুয়ে বেরিয়ে যাচ্ছি ব্যাগ তুলে, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় চলে গেলেন, সুবিনয় রায় চলে গেলেন । আমার রাঙাদাটাও তো দ্যাখো, সেই গলায় ক্যানসার হয়েই চলে গেল । ওর কি কম ভালো গানের গলা ছিল । সেই গলাটাই, কী অবস্থা । ভোগের পাকে পড়লে যা হয় আর কি । আমার যা গানটান, সবই তো ওরই উত্সাহে । সে কি পাগলামো ওর, প্রথম রেকর্ড প্লেয়ার কিনে । রোজগারপাতিও তো কম করত না, আর তেমনি শৌখীন ।
কাকে বলছিলেন শাশুড়িমা ? শ্বশুরমশাইকে কি ? শ্বশুরমশাই তো তখন খেতে খেতে টিভির খবরে মন দিয়ে দেখার চেষ্টা করছেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের দিকে পশ্চিমবঙ্গ কতটা এগোল । গীতা ঘটক, শাশুড়ি বা নিজের মৃত শ্যালকের বিষয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না ।
মা নিজের মনে বকে যাচ্ছিলেন যেন । ওঁর মুখেও তো তখন মাখানো ছিল মৃত্যুচেতনা । সে মৃত্যুচেতনা কি খানিকটা নিজের গান, নিজের কুমারীজীবন, নিজের রাঙাদার মৃত্যুরই চেতনা নয় ? বা নিজের ছেড়ে আসা সঙ্গীতজীবনেরই একটা টুকরোর মৃত্যুরই ?
জানি না । তবে শুনেছিলাম, মায়ের গাওয়া নাকি একবার একটা পুরনো জার্মান স্পুল ক্যাসেটে তুলে রেখেছিলেন সুভাষের ওই মরে যাওয়া রাঙামামাই । সাহেবি কোম্পানিতে চাকরি করতেন, শখ ছিল অনেক । আচ্ছা, সে ক্যাসেটগুলো শোনার কোন ব্যবস্থা হয়না ?
সুভাষের রাঙামামি তো এখনো আছেন । ব্যারাকপুরে । রাঙামামার শ্রাদ্ধের দিন গিয়েছিলাম । বাড়িটা তো স্টেশন রোডের উপরে । মামার ছবির সাথে, হারমোনিয়ামের উপরেও মালা দিয়ে রেখেছিলেন সাদা থানপরা রাঙামামি ।
ওনার কাছে কি একটা কোন আলমারির কোণে স্বামীর স্মৃতিস্বরূপ ওই প্লাস্টিকের প্যাকেটটা কোনমতে টিঁকে নেই ?
আছে হয়ত ।
বড় পিসিমার মরতে চাওয়া, তাঁর একলা থাকা, মানুষদের সরিয়ে সরিয়ে রেখে ত্রক্রমাগত নিজেকে পাথর করা, সে তো সম্ভব হয়েছিল ওই স্বাধীন একরোখা জীবনটি পেয়েছিলেন বলেই । ভালো খারাপ জানি না, তবু এই স্বাধীনতাটুকু যার নেই, অন্যরকম হবার কোন সুযোগ যার নেই, সে যে কী করবে ?
হঠাৎ মনে হয়, একটা মানুষ যার কোন স্বাধীন জীবনই নেই, তার কী হয় ? তারও তো মৃত্যুর বোধ আসে । রোজকার রাঁধাবাড়া, ডালভাত, ফ্রিজের কোনের নোংরা পরিষ্কার করা, ঝাঁটা-ন্যাতা-সাবানের সঙ্গে থাকতে থাকতে, আর মানুষ, হ্যাঁ, মানুষের সাথে আপোষ করতে করতে, সেও কি অনুভব করে না কখনো, গোটা জীবনটাই এ ভাবে খরচ হয়ে গেছে তার ?
কার আত্মত্যাগটা বেশি, কে বলে দেবে ? আপনমনে রবি ঠাকুরের গান গুণগুণ করতে আমার শাশুড়িকে কখনো সখনো শুনেছি কি ? মনে পড়ে না । ওনাকে তো কোনদিন পাত্তাই দিই নি । শ্বশুরমশাই এখনো খেতে বসে জল, দই, পান সবকিছু চাইতে থাকেন মার কাছে । আর শাশুড়ি হাতের কাছে জুগিয়ে চলেন পরম আনুগত্যে । এক মুহূর্ত সময়ও নিজের জন্য আছে নাকি আবার ওনার ।
আমি দীর্ঘ একটা শ্বাস নিই । আমার পাশে সরসী একটা কাচে বাঁধানো ছবির ধুলো মুছতে মুছতে ছবিটার উপরে ঝুঁকে পড়েছে । ঘরের বাইরে বারান্দায় একঢাল পড়ন্ত দুপুরের রোদ এসে পড়েছে । আজ রাজগঞ্জ থেকে আমার কলকাতাতেই ফেরবার কথা ছিল । কিন্তু ফেরা হবে না । আজ আমাকে একবার যেতেই হবে অন্য একটা জায়গায় ।
ব্যারাকপুরে । সুভাষের রাঙামামার বাড়ি । একজন মহিলার মরে যাওয়া একটা সময়ের কিছু চিহ্ন সেখানে পেয়েও যেতে পারি । আমি তো চিহ্নই জমাই । আর গুছিয়ে, থাবড়েথুবড়ে, ঠিক করে রাখি । মেয়েদের চিহ্ন ।
এই তো জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি । এই মেয়েজন্মে ।
জড়াজড়ি করে সব নারীর ভেতরে গাঁথা থাকে মালা । আমার সাথে অন্য অনেকের । এক একটা সুতোয় এক একজন নারী ।
(পরবাস-৪৪, ডিসেম্বর, ২০০৯)