বিস্মৃতিমেদুর
পার্থ চক্রবর্তী
মফ:স্বলের নদী মাঠ জেলখানা
রাত জেগে থাকা চাঁদ মাখা চরাচর
`নাথিং রিমেইন্স,' কেবল মাত্র কথা
রয়ে যাবে আর শুধু জন্মাবে ছবি
আমরা এখনো বেঁচে, মৃত দিন বলে
ঘাসের শিকড় উঠে আসে মুঠি ভরে
জলের ওপর অন্ধকার আর আলো
ফিরে ফিরে আসে অতীত দিনের স্মৃতি
কেউ ভুলে যাবে কেউ রেখে দেবে মনে
বিস্মৃতি এসে মৃত্যুর হাত ধরে
চলে যাবে দূরে আকাশ মাটির কাছে
সবুজ নীল আর চোরাবালি পার হয়ে
আরোগ্য
পার্থ চক্রবর্তী
গভীর অসুখ থেকে সেরে উঠবো ।
এই যে সারাক্ষণ মাথাটা হালকা লাগছে
আলোটাকে মনে হচ্ছে ঝিমধরা উজ্জ্বল আবছায়া
এসব ঠিক হয়ে যাবে ।
দিনের পরে দিন যাবে, নিয়ম মতো
শনির পরে আসবে মঙ্গল
জিহ্বায় স্বাদ আর বুকে বল ফিরবে
নির্জন ঔষধ পথ্য ছেড়ে আবার সবার সাথে খেতে
বসবো ।
তারপর একদিন একটি প্রিয় স্ফূরিতনাসা অশ্বের পিঠে চড়ে
সদর্পে চলে যাবো দিগন্তের দিকে
কেউ বাধা দেবে না, নিষেধ করবে না
বরং যাত্রা শুরুতে চিবুক স্পর্শ করে
ঈর্ষা, ভেজা হাসি আর আশীর্বাদ লিখে দেবে ।
কিন্তু জ্বলন্ত মধ্যরাতে
কপালে তোমার একান্ত শীতল হাত
আর কোনোদিন পাবো না, আর না ।
জবাফুলের কবিতা
বিভাস রায়চৌধুরী
আমি কারও সঙ্গেই একমত হতে পারছি না ...
কত দূরে একা একা বেঁচে থাকে আমার মা
যেন বুনো লতাপাতার আড়ালে
       লুকিয়ে আছে পরম একটা জবাফুল
মা'র কাছ থেকে
       কবে আমি হারিয়ে গিয়েছি
             আর ফিরতে পারিনি
কারণ
মানুষের পক্ষে নির্ভুল হওয়া অসম্ভব
কারণ
মানুষ অজান্তেই ভুল করে, আর হাস্যকর
             সংশোধনবাদী হয়ে যায়
এখন, জবাফুল জবাফুলের মতো নিরালায় বেঁচে আছে
হারিয়ে-যাওয়া মানুষও বেঁচে আছে
       তার মতো অল্পবিস্তর
শুধু,
আমি কারও সঙ্গেই একমত হতে পারছি না ...
নীল রক্তপাত
বিভাস রায়চৌধুরী
আকাশ মুখস্থ করি
প্রণয়ের সারল্য ফুরোয়
সঙ্গীতে নেমেছে চাঁদ
তারারাও পাশ ফিরে শোয়
একাকী বলার ছিল
কুত্তাটিও বিষাদপ্রতিম
শূন্যগর্ভ জলাশয়ে
অস্ত্র থেকে ঝরে পড়ে হিম
আলপথে শুয়ে আছি
এভাবেই পড়ে থাকে লাশ
কবিতা ভেবেছি আমি
তুমি ভাবো, প্রসঙ্গ বিভাস ...
কেন কবি বলেছেন ?
কৃষ্ণা বসু
কবি বলেছেন, `মেলাবেন তিনি মেলাবেন !'
কোথায় আর মেলালেন ? কে কার সঙ্গে মিলেছে বলত ?
ভাই এসে বোনের সঙ্গে মেলে না আজকাল !
স্বামী স্ত্রীতে বনিবনা নেই, কেবলি ভাঙছে সাধের সংসার !
সন্তান এসে মেলেনা মায়ের সঙ্গে, বৃদ্ধাশ্রমে পড়ে আছে মা !
মানুষ কেবলই ভাঙছে, ভাঙছে, ভাঙছে, ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে,
তবে কেন কবি বলেছেন, `মেলাবেন তিনি মেলাবেন -' ?
কোথায় কাকে মেলাবেন ? তিনি আর কবে মেলাবেন ?
কেন কবি বলেছেন মেলাবেন, যখন মানুষ কেবলি একা,
একা, একদম একা হয়ে যাচ্ছে অধুনা বিশ্বতে ?
হায় ! কবি বলেছেন, -`মেলাবেন তিনি, মেলাবেন !'
!----------
ডক্টর মৈত্রর স্বপ্ন
পার্থ পাল
ডক্টর মৈত্র - অনেক বছর ঘর ছাড়া
ষোলয় হস্টেলে প্রথম বার
আর হয়নি ঘরে ফেরা
আজ বস্টনেই তিরিশ বছর পার ।
দেশ থেকে নিয়ে আসা একশ ডলার
উচ্চাশা, শ্রম আর কপালের ককটেলে
গড়িয়েছে অনেক দূর ।
চার দেশের লোক এক ডাকে চেনে ।
আজ কি হয়েছে কে জানে -
সকালে ঘুম ভাঙলো পরপর অনেক স্বপ্নে ।
প্রথমে দেখলেন লোড শেডিং এর রাত,
বাঁশগাছ নুয়ে পড়েছে ছাতে ।
বাবা লুঙ্গি পরে মাদুরিতে, হাতে সিগারেট,
আর তিনি নিজে হাফ প্যান্ট পরা ।
সিঁড়িতে মা, আসছে মুড়ি মাখা
কত তারা তখন আকাশে ।
তারপর মনে হল হস্টেলের প্রথম দিন
সে কী রাগ, অভিমান -
আমাকে তোমরা বাড়ি থেকে তাড়ালে ।
পরক্ষণেই কাট এবং নতুন সিন
পুজোর ছুটিতে বাড়ি ফেরা -
মার ফুল তোলা শেষ হবার আগেই হাজির বাড়িতে
অন্যরা যাবে জলপাইগুড়ি,
দলবেঁধে তাই সবাই উঠেছে ভোর রাতে
দেশের পাতায় `কালপুরুষ' আর `সেই সময়'
সপ্তমীর রাতে মণ্ডপে অন্য প্রতিমা দেখা ।
বাবা নেই অনেক দিন ।
মা ভাল নেই
ঘুমটা ভেঙে গেল - কিন্তু রাত এখনো বাকী
ভারী মন নিয়ে ডক্টর মৈত্র আবার চোখ বুঝলেন ।
দেবা, অভি ? কতদিন বাদে তোদের দেখলাম
হাতে কি ? খেলার কাগজ ?
আমিও কয়েকটা জমিয়ে রেখেছিলাম ।
মনে পড়ে ফুটবল খেলে কাদা মেখে পুকুরে ঝাঁপ ?
একদিন হেডুর ক্লাসে জানলা দিয়ে শরতের নিল আকাশ দেখছিলাম ।
কি অকারন বকুনি তারপর - মনটা কোথায় ? কার মুখ ভাসছে চোখে ?
অথচ স্কুলের ছাতে উঠে পাশের গার্লস স্কুলের বাথরুমে উঁকি মারা
ধরা পড়িনি কোনদিন, তোদের মনে আছে ?
আরে কি ভাগ্য আমার, তোরাও এসেছিস ? পূষন, আশিষ ? আয়, আয় -
মনে পড়ে গঙ্গার ধারে বসন্তের বিকালে আড্ডা কৃষ্ণচূড়ার নিচে ?
তখন আমরা বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাস পড়ছি
মৈথিলি ভাষায় রাধার প্রেম
তপ্ত শ্বাসের মত দখিনা -
সূর্য নামে পাটে
মঠের আরতির ঘন্টা ।
না । ওটা অ্যালার্ম বাজল । উঠতে হবে ।
শুরু হল আর একটি দিন ।
পুরান কথা মনে করতে করতে তৈরি হয়ে
ডক্টর মৈত্র গাড়ি নিয়ে এগোলেন ।
হাতে ফোমের মুখ ঢাকা কফির কাপ ।
রেডিও তে এন পি আর ।
মেমোরিয়াল ড্রাইভে সুস্বাস্থ্য সন্ধানীদের ভিড়
সুন্দরী - আজকাল শরীরের থেকে মনের ব্যারাম বেশি যে ?
স্বামী সোমানন্দ অনেক যত্ন নিয়ে সেই কবে শিখিয়েছিলেন
ধ্যান, আত্মবিশ্লেষণ, মনসংযোগ - কিন্তু সব করেও আজ মনটা উড়ুক্কু ।
ভাবলেন - যদি পার্কিং পাওয়া যায়
চার্লসের ধারে একটু বসে যাই ।
দশটার আগে তো আজ
ইমপর্ট্যানট কাজ কিছু নেই ।
ওমা - শিঞ্জিনী ? তুই কবে এলি এখানে ?
এটা তোর মেয়ে ?
লাল জামা, কোঁকড়া চুল -
জানিস তো, তোর এই মেয়ে আমার ও হতে পারত ?
এখনো হতে পারে বলছিস ?
শুনছিস তোরা - এই বয়েসে আবার বাঁধবো গাঁটছড়া ?
ড্যানিয়েল, টম, বারবারা, শিউ-ঝু
আই ওয়াজ নট এক্সপেক্টিং ইউ
হোয়াটস গোইং অন ?
বাট ইটস নাইস অফ ইউ টু কাম ।
এক মিনিট - সেল ফোনটা বাজছে ।
মা মনি ? না আমি তোমাকে একদম মিস করছি না
কতটা সত্যি ? তা ৫০% হবে ।
তোমরা ভাল আছ ?
এখন অফিসের দিকে, না গাড়ি চালাচ্ছি না । সত্যি বলছি ।
তোমাদের ওদিকে গেলে জানাব ।
দিনটা শুরু হয়ে ছিল, শেষ হল না ।
পুলিশ রিপোর্টে লেখা হল হার্ট ফেলিওর ।
শোকসভায় কে যেন বলল ।
দ্য ম্যান ওয়েন্ট পীসফুলি
উইথ কফি ইন হিজ হ্যাণ্ড
অ্যাণ্ড স্মাইল ইন হিজ ফেস ।
-------
হিন্দোল ভট্টাচার্য
দুই হাত কানের পাশ দিয়ে আকাশের দিকে উঁচু করে
সে চিত্কার করে উঠলো
পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে যখন
মাথার উপর হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ছে নি:সঙ্গ মেঘ
বাটন ঠিক করতে করতে একফাঁকে চারদিক
মেপে নিচ্ছে সুযোগসন্ধানী
ঘাড় কামড়ে ধরে আছে যে, তাকে চেনাও যায় না
হাতের উপর চেপে বসে আছে যার হাত
পায়ের উপর পা রেখে
যার কাছে ভিখিরির মতো
বাঁচতে চাইছে মানুষ
পুকুরের জলে যার ছায়াও পড়েনা
হিংস্র ইনজেকশান অবশ করে দেয় এমন মন নিয়ে
এমন আপামর হাস্যকর রহস্যময়তা নিয়ে
আমরা কেবল পায়ের শব্দ শুনছি
এই পৃথিবীর নাকি ত্রক্রমমুক্তি হবে
আহ এই গর্ত, তুমি কী চাঁদের তৃষ্ণা জানো ?
আমি দেওয়ালের কাছে যাই
দেওয়াল ঘুমিয়ে থাকে
আমি বারবার প্রশ্ন করে যাই
দেওয়ালে একফোঁটা গর্তও হয় না
আমি আড়াল থেকে দেখি রাত আর জ্যোত্স্নার মিলনদৃশ্য
দেখি গাছ তার মৃত্যুর জন্য মাটির গায়ে ফেলে যাচ্ছে দীর্ঘনি:শ্বাস
জোয়ারের জল ধেয়ে আসছে না কি সমুদ্র
পৃথিবী ঠিক কতোটা কেঁপে উঠলে তুমি বিশ্বাস করবে
আজও ভূমিকম্পে আমাদের কবরের গায়ে জমে থাকা ছায়াও ভেঙ্গে
ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে
হিমযুগ হয়ে যেতে পারে ?
আহ কী চূড়ান্ত বোকামি
কী চূড়ান্ত বোকামি এই ভাবা যে আমরা মৃত্যুর পরেও বেঁচে থাকতে পারি
কী চূড়ান্ত এই ভাবা যে আমি ঈশ্বরের চেয়ে খাটো কেউ
রক্তের ভিতরে জল সাঁতার কাটতে কাটতে
জলের ভিতর স্নায়ু সাঁতার কাটতে কাটতে
আমাদের অবশ করে দেয়
আমাদের ঘুমের মধ্যে শুরু হয়
নরকের সূর্যোদয়
আমরা শিশির পুড়িয়ে নেটওয়ার্কিং করতে থাকি
আমাদের বন্ধুত্ব সরু তারের উপর হেঁটমুণ্ড ঊর্ধ্বপদ
ওহ ভগবান আমি তোমাকেও ভেবেছিলাম সমুদ্রের নোনা বুদ্বুদ
ভেবেছিলাম আমার চণ্ডাল আমার ঈশ্বর
আমি তাকে কোপ মেরে পুঁতে দিয়েছি
পুরনো কাগজপত্রের গায়ে সেঁটে দিয়েছি পুরনো কাগজ
রক্তছবি দেখতে দেখতে আমাদের পুরুষাঙ্গ
সরু হয়ে গেছে
ঈশ্বর
সরু হয়ে গেছে
এতো গোঁ গোঁ কোরো না তুমি
কিছুই হয়নি
বেঁচেছিলে, মরে গেছ, এই
এর চেয়ে আর কোন উচ্চাকাঙ্খা ছিলোনা তোমার
এর চেয়ে চাঁদে যাওয়া নেই
আমি বলক বলক তাকে শুষে নিতে নিতে
শিকড়বাকড় হয়ে গেছি
আমি রাস্তার ওপার থেকে
শিয়ালের মতো
আশ্চর্য সিগন্যালের গায়ে
দেখেছি
লটকে আছে আমাদের মনের জল
আমাদের
আঙুল থেকে খসে পড়া
আমাদের
জমি থেকে খসে পড়া
আমাদের
গান থেকে খসে পড়া
আমাদের
ফুসফুস থেকে খসে পড়া
হাওয়া
হাওয়া
হাওয়া
তবু কেউ কাউকে বলে নি কেন যে আমরা বেঁচে থাকতে চাই
বলেনি উল্লাস আহা
তোমার পিঠের উপর থেকে
তোমার পেটের ঠিক নিচে কীভাবে লুকিয়ে রয়েছে
একপোঁচ রঙের নিচে আমরা হাসাহাসি করছি
আমাদের হাসির শব্দে
আমাদেরই আত্মা উড়ে রাত্রিবেলা ঘুম ভাঙিয়ে যাচ্ছে আমাদের
আমরা শিউরে উঠছি
নিজেদের দিকে হাত বাড়িয়ে দেওয়া আমরা
আমাদের দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠছি
দুই হাত কানের পাশ দিয়ে চোখ বন্ধ করে
গুনে যাচ্ছি দশ নয় আট সাত
এবং যতদূর গুনে যাওয়া যায়
আর তারপর কোথায় যাওয়ার কথা ছিল
ঠিক কোথায়
কতদূর
ঠিক কী কী বলে যাওয়ার কথা ছিল তোমায়
ঠিক কতোদূর
সান্ত্বনা দেওয়ার কথা ছিল
জানি না
হেমন্তকালের ভয়ে আমাদের বিকেলগুলো
মরা মরা কাঠ হয়ে
ভেসে যাচ্ছে দিগন্তের দিকে
মৃগয়া
হিন্দোল ভট্টাচার্য
সহনশক্তির পাশে চুপচাপ নির্জন বহুদূর সৈকতের
ঝাপটা এনে রাখি
গুলিবেঁধা পাখি যেমন
আরো কোনও অন্ধকার নরকে আগুন জ্বলে আর তার
আঁচ পড়ে গায়ে
কিভাবে শিকার
শিকারীর পিছনে পিছনে যায় শিকারের ইন্দ্রিয়সমেত
জঙ্গলের অন্ধকার ঘুপচি সোঁদা গন্ধ থেকে হাহাকার
হাহাকার ঘূর্ণিপাক খায়
শতাব্দীপ্রাচীন এই ঝড়
সীমান্ত অক্ষত রেখে গরাদের অন্ধকারে যে রয়েছে
তার কাছে রাখি
এই জলবায়ুময় জানলা বন্ধ ঘরের ভিতর
কয়েদি মেঝের থেকে খুঁটে নেয় আশা
হাসপাতালের ভাষা বলে ওঠে এমার্জেনসি রুম
সবুজ সবুজ জানলা
ওড়ায় ভীষণ পর্দা, সে আসে গভীর থেকে
নিজেকে পোড়ায়
দূরে কোন জানলা আছে, রোদ পড়ে পশ্চিমের থেকে
রোদের অনেক গল্প
জীর্ণ জীর্ণ পাতা থেকে খসখস ধ্বনি ওঠে
কে কাকে গল্প বলে
কে কাকে শোনায়
শীতের এমন বিষাদের নিচে শুয়ে শুয়ে
কবর ফোঁপায়
তোমাকে আবিষ্কার করি আমিও তখন
তোমাকে আবিষ্কার করি আমিও নতুন করে
ঘাসফুলের গায়ে
কী রং কী রং তুমি
কী একদিন জীবন
স্বপ্নের তাঁবুর নিচে ভয় আসে
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আলো আসে
ছেঁড়া পালকের উড়ে আসা ইতিহাস আমি কুড়োই,
কুড়োই
বুদ্ধের মুখের কাছে আমিও কি বলিনি আমি জাতক
তোমার
কোন সে যুগের কথা আমি তা জানি না
এমন এক অভিযাত্রা যার কোন দিকচিহ্ন নেই
এমন এক ঘন রাত্রি যার কোন চাঁদ নেই অন্ধকার
কেটে
এমন এক শীতরাত যেখানে ফায়ারপ্লেস নেই
এ কী অন্ধকার তুমি কীভাবে আমাকে এই একলা
স্টেশনেই
ফেলে রেখে চলে গেছ
বিষ নেশা আচ্ছন্ন করে রেখেছে জীবন
আগুন আগুন আমরা
নিজেদের পুড়িয়ে তবুও
নিজেদের ভস্ম থেকে চিনতে পারছি না আর
সমস্ত মুখের রং একরকম
এমনকী আমার
আলাদা তেমন কোন মুখ নেই, হাসি নেই, বিষাদের
অপেক্ষাও নেই
যার যতদূর আত্মহত্যা তারা ততদূর করে
এমন চাবুক তুমি মারো যার ছোবলের মুখে যায়
আমাদের হৃদয়
এমন চাবুক তুমি মারো যার পরে কোন আত্মহত্যা
নেই
এমন চাবুক তুমি মারো যার পরে নেই আশ্রয়
কোথাও নেই কোনও
এমন চাবুক তুমি মারো যার পরে কোনও জেলখানাও
নেই
হায় আমাদের সব সুইসাইডাল নোট তুমি কতদূর
পারো
হায় ঈশ্বরের কাছে নাস্তিক সন্ন্যাসী তুমি
হায় শিল্প
হায় মেঘ
কী শব্দ লেখার পর আর লেখা মানে শূন্য
সারারাত সারারাত এই সহনশক্তি তুমি আমাকে
সিন্দুক ভেঙ্গে বলো
নিজেকে আঁকার পর নিজেকে এই যে আমরা
ভাসিয়ে চলেছি
কোথায় তোমার ঘর, - কোথায় বাগান
শিকার ছুটেছে, - তার দুহাতে শিকারী
!---------
শূন্য
হিন্দোল ভট্টাচার্য
একটা শূন্য মাঠের দিকে আমরা চেয়ে আছি বহুকাল
বহুকাল হলো বৃষ্টির মুখ দেখিনি আমরা
ঘরের ভিতর থেকে দুই চোখ ভেসে গেছে দিগন্তের দিকে
এই শীতকাল জুড়ে শুকনো পাতা আমার শৈশব
আমি শূন্যতা বলতে আর কিছুই জানি না
জানি না কিভাবে আমি নগ্ন হাত বাড়িয়ে বলবো - আমিও রয়েছি
জানি না কিভাবে মৃত্যুর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আমারও বাঁচতে ইচ্ছে হবেনা
জানি না কিছুই, তোমাকে কিভাবেই বা বলবো আমি ভালোবাসতে শিখছি
একটা মরা কাঠ আরেকটা মরা কাঠের দিকে তাকিয়ে থাকবে
হা হা করে ভেসে আসে ঝড়
সমস্ত মাঠ উড়তে থাকে
সমস্ত গ্রাম মাটির নিচে শুয়ে পড়বার কথা ভাবতে ভাবতে
একদিন পুড়ে খাক হয়ে যায়
আমরা আমাদের দিকে চাইনি কতোদিন
কতোদিন আমরা হাত নাড়িয়েছি বিদায়ী ট্রেনের দিকে
অগোছালো বাচ্চাদের মতো
আর আমাদের দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছে ঘেয়ো কুকুর
আকাশ ফাঁক করে দেওয়া হাইরাইজ
কাক চিল শকুনের মতো মৃত্যু শুনলেই ছুটে আসা সান্ত্বনার বাঁশি
আমাদের পিঠ পুড়ে গেছে
এক একদিন ঘরের ভিতর থেকে ঘর উড়ে যায়
এক একদিন জানলা খুললেই শান্ত হাওয়া উড়ে আসে
আর আকাশের দিকে তাকালেই মনে পড়ে শূন্যতার থেকে
শূন্যতা হারিয়ে যাবে আর তারপর মাথা জুড়ে
আর কিছুই থাকবে না
কিছুই থাকবে না ? মৃত্যু কি কেবলই একটা রাখালের বাঁশি ?
এই মহাশূন্যের কাছে আমরা সমুদ্রের ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়ছি
নীল ধোঁয়া হয়ে মিশে যাচ্ছি ত্রক্রমশ
সেই আকাশের দিকে চোখ মেলে শূন্যতাই কেঁদে উঠছে
বারবার বারবার আমি জানতে চাইবো বলে অবাক হয়ে পড়ছি কেবল
আমার শূন্যতা নেই, আমার শূন্যতা এক হৃদয় এক আকাশ এক পাহাড়
আমার শূন্যতা তুমি আমার শূন্যতা সব পাড় ধ্বসে যাওয়া
আমার শূন্যতা রোদ, আমার শূন্যতা বৃষ্টি
আমার শূন্যতায় ত্রক্রমশই আগুন লেগে যাচ্ছে
আমি পুড়তে পুড়তেও এই পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে রয়েছি
সেদিন মোমবাতির কাছে আমি শিখতে বসেছিলাম কিভাবে শূন্যতার দিকে
ছুটে যাওয়া যায়
সেদিন বাজারের পথে আমাকে পথ দেখাতে দেখাতে মিলিয়ে যাচ্ছিল
এক সংসারী লোক
সেদিন শীত একটা চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চাইছিলাম
কিভাবে আত্মহত্যা করা যায়
সেদিন ঘরের ভিতরে আমি তোমাকে কল্পনা করেছিলাম বিশ্বাস করো
আমার শূন্য মাথা শূন্য চোখের কথা বোঝেনা
আমার শূন্য চোখের কাছে বিশ্রাম নিতে আসে তোমার চোখের জল
আমার আঙুল জুড়ে কিলবিল কিলবিল করে তোমার নৈ:শব্দ
আমি অনুবাদ করতে পারি না
পুরোন মসজিদের ছায়া পড়েছে জলের উপর
অন্ধকারের ভিতর উড়ে যাচ্ছে সাদা সাদা বক
কার্নিস থেকে কার্নিসের দিকে লাফ দিচ্ছে আমাদের গৃহস্থালীর ছায়া
গোপন পোস্টকার্ড থেকে ঝরে ঝরে পড়ছে দীর্ঘনি:শ্বাস
আমরা ট্যাক্সিতে উঠে বসছি আর ট্যাক্সির শরীর মিশে যাচ্ছে ট্যাক্সির শরীরে
আমরা কলিংবেল বাজাতে বাজাতে আশাবাদী হয়ে উঠছি খুব
আর দূরে, একা একা চাঁদে চলে যাচ্ছে একটি মানুষ
সেও শূন্য মানে নিজেকেই ভেবে বসেছিল
আর শস্যক্ষেতগুলোর কথা নাই বা বললাম
নাই বা বললাম পাহাড়ের উপরে নেমে আসা সন্ধ্যার কথা
নাই বা বললাম সেই চুম্বন দৃশ্য
নাই বা বললাম এই মহাবিশ্ব তমিস্রার মতো হয়ে গেলে
নাই বা বললাম টানো টেনে নামিয়ে আনো
নাই বা বললাম ভাঙো
নাই বা বললাম আমি জানি
রাস্তা আমার পায়ের গোড়ালিতে ধুলো হয়ে হাঁপিয়ে পড়েছে
রাস্তা থমকে থমকে বেঁকে যাচ্ছে
সব অন্ধকার হয়ে গেলে নেমে আসছে আকাশের বিষন্নতা
আমরা টেলিফোন করছি
তুমি শূন্য, তুমি শূন্যের ভিতরে থাকা আরো বেশি শূন্যতার ভয়
আর তোমার কাছে চিঠি পাঠাবো না আমি
আর কাউকে লিখবোনা কিছুই
আমি সরে যাবো আর সেখানে এক লহমায় বসে পড়বে দশকর্মা ভাণ্ডার
শান্ত ঠাণ্ডা ধূপের গন্ধের নিচে মহাকাশ আমার
আমার একান্ত মহাকাশ
ঘুমিয়ে পড়বে
-----
সংহিতা
রোদে পুড়ে জলে ভিজে
শীতের হিমেল হাওয়া গায়ে মেখে
ওই গোলপোস্ট দাঁড়িয়ে আছে ।
হয়তো কোন বসন্ত বিকেলে
একদল যুবকের মনোযোগে
ধন্য হয়ে ওঠার প্রতীক্ষায় ।
ছল
পৃথ্বীরাজ হৌধুরী
পাহাড়ের ওপরে আর নীচে
বেঁচেই থাকে জল ।
মাঝখানে ঝরনারা
আত্মহত্যার ছল ....
ত্বকের বিজ্ঞাপন
পৃথ্বীরাজ হৌধুরী
কথাটা শুনে, ফর্সা মেয়েরা
কালি মাখুক গায় ।
শুধু কালো মেয়েদের শরীরেই,
রাতে তারা দেখা যায় ....
একুশ আসে
তোফায়েল তফাজ্জল
একুশ আসে
আমার দেশের
জলের স্থলের পথ দিয়ে
শহীদ ভাইয়ার রক্তে রাঙা
সাগর নদী হ্রদ নিয়ে ।
একুশ আসে
টিয়ে ঠোঁটে
শিশুর মুখে বোল নিয়ে
দাদুর কাছে ছড়া কাটার
হরেক রকম দোল নিয়ে ।
একুশ আসে
ফুল বাগানে
ফুল ফুটানোর সাধ নিয়ে
সারা বছর মায়ের কাছে
দুধের বাটি চাঁদ নিয়ে ।
একুশ আসে
ঘরে ঘরে
সূর্যমুখী রোদ নিয়ে
ছোট্ট বড়ো সকল ভাষা
বাঁচানোর শপথ নিয়ে ।
(পরবাস-৪৪, ডিসেম্বর, ২০০৯)