![]() |
দোলপূর্ণিমা রাতে ছিঁড়ে-খুড়ে খেলো তাকে কয়েকটাএক ধর্ষিতা মেয়ের মায়ের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে এই কবিতার কথক, গভীর অভিমান থেকে তার এই শপথ : `এসো সব কন্যাভ্রুণ ধ্বংস করি, এসো ।' তীব্র রাগ আর চূড়ান্ত অসহায়তার বোধ থেকে উঠে আসে এমন শপথ । এর বিপরীতে থাকে প্রতিবাদ, মণিপুরে ধর্ষিতা এবং নিহত মনোরমার মায়েদের প্রতিবাদ, কবিতার ভাষায় : `আমি আর আমি আর আমি মিলে আমরা সকলে / আমাদের শাণিত নগ্নতা আজ বজ্র হয়ে থাক ।'
শেয়াল-শকুন । আমার বুকের দুধে যত ধার, তারো
চেয়ে খরতর জ্যোত্স্না ছিল, তবু তাতে শুশ্রুষা ছিল
না কোনো । তাহলে সে ঈশ্বরী-প্রতিমা কেন
তিল তিল করে গড়ে ছিলে ? কেন বলেছিলে তাকে
ভালোবাসা ভেসে আসে রজনীর রন্ধ্রে রন্ধ্রে ?
তোমাকে বিশ্বাস করে সে খুব সহজ হাতে
তুলে নিয়েছিল ফাগ কুমকুম আবীর ।
তার কালসিটে ছুঁয়ে এসো সব কন্যাভ্রুণ
ধ্বংস করি, এসো ।
ধর্ষণ নামে অনন্য অপরাধটির এই তবে দুই দিক - অসহায়তা আর প্রতিবাদ । এই দুই দিকেরও আছে অজস্র শাখা-প্রশাখা । সেইসব শাখা-প্রশাখা নিয়ে অনন্য এই অপরাধটিকে বুঝতে চেয়েছে একটি বই :
'A Unique Crime Understanding Rape in India' । বইটির সম্পাদনা করেছেন স্বাতী ভট্টাচার্য । স্বাতীর ভূমিকা ছাড়া আরো ষোলোটি প্রবন্ধ রয়েছে বইটিতে, প্রবন্ধগুলিতে তথ্য যেমন আছে, তার সঙ্গে আছে বিশ্লেষণ । রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস আমাদের জানা ছিল না এমন নয়, তবু এ বই থেকে মিলিটারি তথা পুলিশের ধর্ষক ভূমিকা পড়ে শিউরে উঠতে হয় । রাজা বা রাজপুরুষের ক্ষমতাদম্ভ ছাড়া ধর্ষকের আরো একটি কালো পরিচয় আছে, যেটা উন্মোচিত হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়, এক সম্প্রদায় আরেক সম্প্রদায়ের ধনসম্পত্তি লুন্ঠনের সঙ্গে সঙ্গে সে সমপ্রদায়ের মেয়ের ইজ্জত ও লুট করে, আধিপত্য কায়েমের নারকীয় উল্লাসের সঙ্গে । ধর্ষকের তৃতীয় ধরণ হল নিছক লাম্পট্য, মেয়েদের শরীর নিয়ে ফূর্তি করতে পারলে এ জাতীয় ধর্ষক মনে করে ভারি পৌরুষ দেখানো হল । এই তিন জাতীয় ধর্ষক এবং ধর্ষণের নানা তথ্য নিয়ে এ বই-এর অধিকাংশ প্রবন্ধের আলোচনা ।ধর্ষণের ঘটনা যত সংখ্যক জানা যায়, প্রকৃত সংখ্যা তার থেকে আরো অনেক বেশি । অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধর্ষিতা বা তার আত্মীয়-স্বজন ধর্ষণ-ঘটনা আড়াল করেন । কেন না সচরাচর ধর্ষকের কোনো শাস্তি হয় না, বিশেষ করে তার যদি থাকে রাজপুরুষের তকমা । বিচারের বাণী তো সেখানে নীরবে নিভৃতে কাঁদবেই । আর যেখানে বিচার হয়, সেখানে অপরাধীকে ততটা নয়, যতটা জেরা করা হয় অপরাধের শিকারকে, জেরার নামে চেষ্টা চলে ধর্ষিতার চরিত্র হননের । কেননা ধর্ষিতা দুশ্চরিত্র হলেই নাকি ধর্ষকের অপরাধ আর অপরাধ থাকে না । অন্যদিকে, ধর্ষিত হওয়ার ফলেও তো মেয়েটি সমাজের কাছে পরিবারের কাছে ঘৃণাই হয়েই যায় ! তাই যতটা সম্ভব ধর্ষিতার প্রয়াস থাকে ধর্ষণ-ঘটনা গোপন রাখার । আইনের এই প্রহসন নিয়ে, বিচারকদের আশ্চর্য সব মতামত নিয়েও একাধিক লেখা আছে এ বইতে ।
সে সব লেখা থেকে বুঝতে পারি, ধর্ষণের ক্ষেত্রে বিচার চলে আইনের পথে নয়, সামাজিক মূল্যবোধের পথে । সে সমাজ পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, সে মূল্যবোধ পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ । সে মূল্যবোধে নারী নিছক যৌনবিষয়মাত্র, তাকে অধিকার করাতেই পুরুষের পৌরুষ, আর অধিকৃত নারীর ইজ্জত পুরুষেরই ইজ্জত । তাই অধিকৃত নারীর ক্ষেত্রে বিচারক ধর্ষণকারীকে অপরাধী ভাবতে রাজি হতেও পারেন, কিন্তু যে নারী কোনো পুরুষের অধিকারে নেই, তার প্রতি বিচারক বিন্দুমাত্র সহানুভূতি দেখাতে রাজি নন । তাই চলতে থাকে তার চরিত্রের মন্দ-ভালো নিয়ে চাপান-উতোর, শুধু ধর্ষিতা মেয়েটিরই নয়, তার পক্ষে কথা বলে যদি কোনো নারী, তবে তারও । ধর্ষণের বিচার যদি বাধ্যতামূলকভাবে নারীবিচারকের এজলাসে করা হয়, তবে কি অন্যরকম হতে পারে ? জানি না । কেন না এই বই থেকে জানলাম গুজরাটে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মেয়েরা তুমুল উত্সাহ যুগিয়েছে সংখ্যালঘু নারীদের ধর্ষণকাজে !
ধর্ষণের একটি প্রতিশব্দ বলাত্কার । এই শব্দটিতে বলপ্রয়োগ ব্যাপারটি স্পষ্ট । সন্দেহ হয় বলাত্কারী নিজে নিজেকে কখনো অপরাধী বলে ভাবে না । তার কোনো বিবেকদংশন হয় না । কেন না মেয়েদের মতো পুরুষকেও তো বন্দী করে রেখেছে সমাজ তার লিঙ্গভূমিকায় । মেয়েদের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে - লজ্জা, নম্রতা, দুর্বলতা, আর পুরুষের জন্যে নির্লজ্জতা (তাই তারা রাস্তায় ঘাটে যেখানে সেখানে ...), ঔদ্ধত্য, বলপ্রাবল্য । তাই ধর্ষণ পুরুষের লিঙ্গভূমিকাকে উজ্জ্বল করে, যেমন করে রাজ্যজয় । পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ধর্ষককে আদৌ ঘৃণা করে না, ঘৃণা করে ধর্ষিতাকে, দণ্ড দেয় ধর্ষিতাকে । শুনেছি পাকিস্তানে ইসলাম আইনে ধর্ষিতার দণ্ড বড় ভয়ানক ! এরই নাম পুরুষতন্ত্র !
ধর্ষককে সমাজ তো দণ্ড দেয়ই না, ধর্ষিতাকেই দেয় ! কিন্তু আইন তো পারে তাকে দণ্ড দিতে । আইনি বিচার যে বহুক্ষেত্রেই বিচারের প্রহসন, সে কথা বলেছি আগে । কচিৎ কখনো আইন দণ্ড দিতে চায় । কী হবে সেই দণ্ড ? একজন বহুখ্যাত রাজনীতিবিদ্ বলেছিলেন ধর্ষণের মৃত্যুদণ্ডই হওয়া উচিত । মৃত্যুদণ্ড যে কেন অনুচিত, তাই নিয়ে একটি আলোচনা আছে এ সংকলনে । একটি লেখায় একজন বিচারকের মন্তব্য পাই ধর্ষণকারীর দণ্ড হওয়া উচিত নপুংশকত্ব । মনে পড়ে যায় `জখমী আউরত' নামে একটি সিনেমার কথা, সে সিনেমায় বিচার চেয়ে বিচার না-পাওয়া কয়েকজন ধর্ষিতা কিংবা তার নিকট-আত্মীয়রা সংগঠিতভাবে ধর্ষক পুরুষদের ভুলিয়ে নিয়ে এসে অপারেশন করে নপুংশক করে দিচ্ছিল । আমি ব্যক্তিগতভাবে এ শাস্তিব্যবস্থা বেশ পছন্দ করেছিলাম । কিন্তু বাস্তবে শাস্তির ছবিটি কীরকম ? রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস যেখানে ধর্ষণে মদত জোগায়; যেখানে অগণিত নারী ধর্ষিত হয়, যেমন কাশ্মীরে, যেমন উত্তর-পূর্বাঞ্চলে, সেখানে তো শাস্তির প্রশ্নই ওঠে না, অপরাধীরাই, ভক্ষকরাই সেখানে রক্ষক । সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাতেও বিরাট সংখ্যায় ধর্ষণ ঘটলেও, ধর্ষকের সম্প্রদায়গত ক্ষমতা থাকায় কেউ দণ্ড পায় না । বিচার যখন হয়, কারাবাস দণ্ড হয় ধর্ষকের, তখনও একটা অদ্ভুত উপায়ে দণ্ড মকুব হয়ে যেতে পারে । সে উপায়টি হল - ধর্ষক ধর্ষিতাকে বিয়ে করে নেয় । ধর্ষক বা তার পরিবার জানে, যে মেয়ের ইজ্জত চলে গেছে, তাকে তো আর কেউ বিয়ে করবে না । ধর্ষিতার পরিবার রাজি হয়ে যায় বিয়েতে, বিয়ে হলেই সাজা মকুব হয়ে যায়, তারপর একসময় মেয়েটি বিতাড়িত হয় স্বামীগৃহ থেকে ! এই সংকলনে রয়েছে এমন দৃষ্টান্ত । <Þ> এই সবরকম বিচার বা বিচার-প্রহসনের মূলে আছে পিতৃতন্ত্রের লিঙ্গনির্মিতি । সে নির্মাণ নারীকে যৌনবিষয়ে পর্যবসিত করে । সেই বিষয়টি আবার টাকাপয়সাজমিজমার মতো পুরুষ-মালিকানার অধীন, পুরুষের কিংবা তার পরিবারের কিংবা তার সম্প্রদায়ের `ইজ্জত' । এই লিঙ্গনির্মাণ নারীকে এতটাই নির্মিত করে, সে নিজেও ভুলে যায় তার বিষয়িতা, সে মনে রাখে সে যৌনবিষয়, যৌনতাতেই তার `ইজ্জত', লজ্জার মূল্যবোধ সেই ইজ্জতরক্ষার জন্য একান্ত প্রয়োজন । বুঝতে পারি মণিপুরে মনোরমার ধর্ষণ এবং হত্যার প্রতিবাদে মনোরমার মা এবং মায়েরা কেন নগ্নতাকেই হাতিয়ার করেন, তাঁরা দেখিয়ে দিতে চান রাষ্ট্রতন্ত্র আর পুরুষতন্ত্র কতটাই গলাগলি, তাই তাঁরা ভেঙে কেনেন পুরুষতন্ত্র রচিত নারীনির্মিতি - লজ্জা বা হারা যার প্রধান উপকরণ । যে নারীশরীর অথবা নারীযৌনতা পুরুষপ্রধান রাষ্ট্র যথেষ্ট ব্যবহার করে থাকে, তাকে তাঁরা নিজেদের ইচ্ছায় নগ্ন করেই তাঁদের শাণিত প্রতিবাদ রাখেন । এ ঘটনার অনেক আগে লেখা গল্প মহাশ্বেতা দেবীর `দ্রৌপদী', সে গল্পে মহাভারতের দ্রৌপদী - পুরাণের দ্রৌপদীর মতো কৃষ্ণের কাছে তার লজ্জা বাঁচানোর প্রার্থনা জানায়নি দোপদি মেঝেন, বরং গণধর্ষিতা দোপদী তার নগ্নতাকেই হাতিয়ার করেছে রাষ্ট্রশক্তির মোকাবিলায় । কবিতা পাঞ্জাবী একটি লেখায় যথার্থ মন্তব্য করেছিলেন :
She refuses to accept the significance of the rape as symbolic defeat. She tears asunder the notion of the female body as an object through which domination is asserted. The first sylables of a new language : responses to sexual violence, Woman Heritage and Violence, ed. by Shefali Maitra, 1996, p63) সাহিত্যে রাজনৈতিক ধর্ষণের ডিসকোস, তার ভাষা ব্যবহারের বৈশিষ্ট্য নিয়ে এ লেখায় আলোচনা করেছেন কবিতা । আমার আলোচ্য সংকলনে এই লেখাটি গৃহীত হতে পারত । সাহিত্যে ধর্ষণের উপস্থাপনা বিষয়ে কোনো আলোচনাই সংকলনটিতে গৃহীত হলো না কেন, ঠিক বুঝতে পারি নি ।ধর্ষণ যা ক্ষতি করে তার শারীরিক দিকটির প্রতিবিধান হয়তো স্বাস্থ্য এবং চিকিত্সা সংক্রান্ত বিধিবিধান দিয়ে করা সম্ভব, তবে সে পথও মসৃণ নয় । সংকলনটিতে একাধিক লেখা আছে এ বিষয়ে, চিকিত্সা দেওয়া অথবা পাওয়ার নানারকম সমস্যার আলোচনা আছে । কিন্তু মানসিক দিকটির প্রতিবিধান করা খুবই কঠিন আমাদের সমাজে, যে সমাজ মেয়েদের পুরুষ অধিকৃত যৌনবিষয় হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত, তার পুরুষদৃষ্টি ঠিক করে দেয় মেয়েদের মূল্যবোধ - তার ইজ্জতধারণা, তার লজ্জাবোধ । কবিতা পাঞ্জাবীর যে লেখাটির উল্লেখ করেছি আগে, সেখানে তিনি `দ্রৌপদী' গল্প প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছিলেন :
'Dopdi ... tears her cloth away and walks defiantly wards Senanayak, and in doing so, rejects all social and moral definitions of shame associated with the rape of a woman.' ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত লজ্জাবোধ অবমাননার বোধকে এমন প্রত্যাখ্যান করতে পারাতেই বোধহয় ধর্ষিতার মানসিক ক্ষতির প্রতিবিধান সম্ভব । কোনো মেয়ে তার বিষয়িতা থেকেই এ প্রত্যাখ্যান করতে পারে । আলোচ্য সংকলনে দুটি লেখায় মেয়েদের সেই বিষয়িতাকে মান দেওয়া হয়েছে । বিশেষ করে সুষমা আগরওয়ালের 'I am not a victim' লেখাটির মধ্যে সেই নারীনির্মিত সুতীব্র প্রত্যাখ্যান দেখতে পেলাম । একটি ধর্ষিতা মেয়ে তখনই বলতে পারে 'I am not a victim', যখন সে নিজের বিষয়িতা বিষয়ে সজাগ, সচেতন । সে জানে তার `ইজ্জত' তার যৌনাঙ্গতে সীমিত নয় । সে জানে শরীরে যে-কোনো অঙ্গে প্রচণ্ড আঘাত পাওয়ার যন্ত্রণা আর যৌনাঙ্গে আঘাত পাবার যন্ত্রণার মধ্যে শুধুমাত্র তখনই ফারাক ঘটে যখন পুরুষতন্ত্র নির্দেশিত নারীনির্মিতির খাঁচায় বদ্ধ থাকে তার আমিত্ব । আলোচ্য সংকলনটির ভূমিকায় সম্পাদক স্বাতী ভট্টাচার্যও সে কথা বলেন : 'Rape is a unique crime, because the meaning described to the act is far more terrible than the act itself. Demolishing that construction is no less crucial than prevention of individual incident of rape.' বস্তুত, শুধু ধর্ষণ কেন ? আমরা দুর্বৃত্তদের কোন কাজটারই বা 'prevention' -এর উপায় জানি ? নির্জন স্থানে পুরুষ কি আক্রান্ত হচ্ছে না, সর্বস্বান্ত হচ্ছে না, দিল্লী, মুম্বাই কিংবা কলকাতার মতো জৌলুষী শহরে । দুর্বৃত্তরা আছে, থাকবে, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আক্রান্ত হচ্ছে, হবে । মেয়েদের ক্ষেত্রে শুধু ধনদৌলতের সঙ্গে তাদের `ইজ্জত'ও লুট করবে লুটেরারা । নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দুর্বৃত্তের সঙ্গে লড়বার সাহস-শক্তি যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন লুন্ঠিত হলে ভেঙে না পড়ার মতো মনোবল । সেইসঙ্গে প্রয়াস করতে হবে সমাজ-মূল্যবোধের, সামাজিকের দৃষ্টিকোণের পরিবর্তন ঘটানোর । 'Why did you go there' শিরোনামে লেখাটিতে শাশ্বতী ঘোষও মেয়েদের বিষয়িতার দিক থেকে প্রশ্ন তুলেছেন - ধর্ষণের ভয়ে মেয়েদের যাপন-পরিসর কেন সংকুচিত থাকবে ? পুরুষতন্ত্র-নির্দিষ্ট লিঙ্গনির্মিতি ভাঙার প্রয়োজনীয়তার দিকটি বিশেষভাবে উঠে এসেছে তাঁর লেখায় ।কিন্তু শাশ্বতী বলেছেন বাহির-পরিসরের কথা, তাঁর শিরোনামও সেই ইঙ্গিত দেয় । তাহলে কি ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে মেয়েদের যাপন-সমস্যা নেই ? আছে যে, সংকলনটির কোনো কোনো লেখায় সে কথা উঠে এসেছে । সদরে, রাস্তায় ঘাটে স্টেশনে ময়দানে মেয়েদের নিরাপত্তা নেই - সে নিরাপত্তা দেওয়া হোক - এ দাবি আমরা করতে পারি সরকারের আছে । কিন্তু ঘরের চার দেওয়ালের সুনিশ্চিত নিরাপত্তার মধ্যে, পূজনীয় অভিভাবকদের তত্ত্বাবধানে, শিশুবয়সে বালিকাবয়সে যে মেয়েরা ধর্ষিত হয়ে চলে - তার প্রতিকার চাইব কার কাছে ? শিশুধর্ষণ নিয়ে একটি লেখা আছে এ সংকলনে, যথার্থ ভাবেই সেখানে বলা হয়েছে শিশুধর্ষণ মানবাধিকার লঙ্ঘনের জঘন্যতম দৃষ্টান্ত । আর এই জঘন্যতম দৃষ্টান্তর সংখ্যার দিক থেকে আমাদের `আধ্যাত্মিক' ভারত নাকি প্রথম হবার দাবিদার ! শিশু- যার উপর ক্ষমতা আছে বয়স্কর, আছে গুরুজনকে মান্য করার সামাজিক শিক্ষা, গুরুজনের উপর ভরসা করার পারিবারিক দীক্ষা, তাকে ধর্ষণ করা, দিনের পর দিন ধর্ষণ করা, ভয় দেখিয়ে শিশুটির মুখ বন্ধ রাখা - এসব তো পুরুষসিংহদের জন্য বড়ই সহজ এবং সুবিধাজনক ! এর প্রতিকারের কোনো পথ আছে ? এখনো যে দেশে বালিকাবিবাহ গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত এবং পালনীয় প্রথা, সে দেশে স্বামীশয্যায় ধর্ষণের কি কোনো প্রতিকার আছে ? ফুলশয্যার রাত্রিতে, সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন পুরুষ শুধু স্বামীত্বের অধিকারে স্ত্রীকে ধর্ষণ করার ফলে মেয়েটি পাগল হয়ে যায় - এমন দৃষ্টান্ত আমি শহরাঞ্চলেও একাধিক শুনেছি । এতটাই গাঢ় সিঁদুরের অন্ধকার রঙ !
এরই নাম সভ্যতা । এ সভ্যতাকে মানবিক হতে হলে নারীকে যেমন তার সমাজনির্দিষ্ট নারীনির্মিতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, পুরুষকেও তেমনি সমাজনির্দিষ্ট পৌরুষের ধ্বজা ভাঙতে হবে, মনে রাখতে হবে, পুরুষত্ব নয়, মনুষ্যত্বই তার অন্বিষ্ট । শুধুমাত্র জৈবিক ক্রিয়াকর্মের কর্তা হওয়া মানেই বিষয়ী হওয়া নয় । যে পুরুষ বিষয়িতার অধিকারী, তিনি কখনো ধর্ষক হতে পারেন না । যুগ যুগ ধরে সভ্যতা শিখিয়ে এসেছে পৌরুষের অর্থই দখলদারি : `জিতে নিতে হবে ভূমি / সেই জেদে রোখা তুমি ... জিতে নিতে হবে নারী / লিঙ্গই তরবারি ।' কিন্তু লিঙ্গকে অস্ত্র করার সঙ্গে সঙ্গে সে কি পশুত্বে পর্যবসিত হয়ে যায় না ? - `ধর্ষক, তুমি ভুলো না / পশুই তোমার তুলনা' । উদ্ধৃতিগুলি যে কবিতা থেকে নেওয়া, সেখানে কবির আশ্বাস ছিল : `সে পশুকে ফিরে মারবে / দ্রৌপদী বেণী বাঁধবে' । কিন্তু সে আশ্বাস কি ফলবান হবে ? অন্তত এ সংকলন তেমন কোনো আশ্বাসের কথা বলে না ।
(পরবাস-৪৩, জুন, ২০০৯)