• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪৩ | জুলাই ২০০৯ | গ্রম্থ-সমালোচনা
    Share
  • দাহ ও দ্রোহের ইতিকথা : রুনা বন্দ্যোপাধ্যায়

    মহিষকুড়ার উপকথা, অমিয়ভূষণ মজুমদার ; উর্বী প্রকাশন, কলকাতা ; ১৯৮০ ; পৃ: ৮৮; বিনিময়: ৪৫ টাকা


    অমিয়ভূষণ মজুমদারের 'মহিষকুড়ার উপকথা' এক সব হারানো নিছক মানুষের নি:শব্দ দাহ ও দ্রোহের ইতিকথা । পঞ্চমুখী ইন্দ্রিয়ের সুড়ঙ্গ পেরিয়ে যেটুকু প্রতিফলন তার চেতনের দরজায় সেখানেই তার দাহ, নিজের গর্ত থেকে বেরিয়ে আসার স্বাধীন আকাঙক্ষায় তার বিদ্রোহ । কিন্তু সেই অনুভব প্রকাশ করার ভাষা তার আয়ত্তে নেই । অথচ সেই মৌন অনুভবের বায়বীয় তুষ ত্রক্রমশ: মুখর করে তুলেছে বিদ্রোহের মুহূর্তটিকে ।

    পাঠক আপনি কি সহৃদয় হৃদয় সংবাদী ? আপনার দৃশ্যমান সমাজসচেতনতার খোলশের ভেতর কি অপেক্ষা করে থাকে এক রক্ত-স্তম্ভিত হৃদয়, যে অন্বেষণ করে লেখককে ? হয়ত সে অন্বেষণ নিজেরই স্বার্থে । তবে জেনে নিন আপনার মত অন্বেষণকারীর জন্যই লেখা হয়েছিল মহিষকুড়ার উপকথা । অমিয়ভূষণ মজুমদার বলেছিলেন,

    "আমি এ পৃথিবীতে কিছুই পাচ্ছি না । আমার নিজস্ব একটা পৃথিবী দরকার, যেখানে আমি আনন্দ পেতে পারি । যে মন নিয়ে আমি লিখতে বসি, সে মন তো আমার পাঠকের থাকতেও পারে । সে তো অন্বেষণ করছে আমাকে । সেই অন্বেষণকারীর জন্য লিখি ।"

    অকাদেমী পুরস্কার প্রাপ্ত অমিয়ভূষণ মজুমদারের মহিষকুড়ার উপকথার প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৩৬৯ সালে, 'একটি খামারের গল্প' নামে শারদীয় গণবার্তায় । তারপর প্রায় দুদশক পেরিয়ে ১৩৮৫ তে মহিষকুড়ার উপকথা নামে এই নভেলেট । নিজের লেখার বৈশিষ্ট্য নিয়ে বলতে গিয়ে লেখক বলেছিলেন, "কোন লেখা ছাপা হয়ে যাওয়ার পরে থেকে যায় আমার গল্প আমার উপন্যাস আর আমি, শিল্পটা হয়েছে কিনা এই পরীক্ষা চলতে থাকে ।" এটাই তাঁর প্রথম উপন্যাস নয়, ১৩৬১ তে প্রথম প্রকাশিত হয় 'নীল ভুঁইয়া' এবং ১৩৬৩ তে 'গড় শ্রীখন্ড'। পাবনা জেলায় স্বল্পবিত্ত গেঁয়ো জোতদারগোষ্ঠীর আশ্রয়স্থল এক নীলকুঠি, যার বহুশরিকের দাবি ও পাল্টা দাবির আক্রমণে ক্ষয়ে যাওয়া জরাজীর্ণ ভিত কাঁপছে - এমনই এক পটভূমিতে ক্ষয়িষ্ণু ফিউডাল সমাজের চিত্র এঁকেছিলেন লেখক । তারপর 'তন্ত্রসিদ্ধি', 'বারোমাসের', 'নেই কেন সেই পাখি', 'বেতাগ বাইতোড় সরশুনা' 'মৃন্ময়ী অপেরা' ইত্যাদি বিভিন্ন উপন্যাস ।

    মহিষকুড়া শাল-সারির বনরেখায় আঁচল পাতা এক নিবিড় গ্রাম । যার ওড়াআগল বুকের মধ্যে বয়ে চলে নদী ; যার আসমানী আয়নায় মুখ দেখে তীব্র স্রোতময়ী নির্ঝর । আর যেখানে নীল, নীলিমায় বাসা বাঁধে, সেই প্রান্তে নীল পাহাড়, আবেগের ঢেউ বুকে নিয়ে এগিয়ে গেছে কোনো অজানায় অচেনায় । আকাশচারী নৃতত্ত্ববিদ বা সমাজতাত্ত্বিকের মনে হতে পারে মহিষকুড়া যেন সমস্ত জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন এক ছোট দ্বীপ ; যেখানে বাসা বেঁধেছে পথ-হারানো কোনো মানবগোষ্ঠীর বংশধর ; যারা এই বিচ্ছিন্নতাকে রক্ষা করে চোখের মণির মত ।

    কিন্তু এমন আকাশচারী হয়ে মানুষকে ওপর থেকে দেখার পক্ষপাতী নন লেখক । তিনি বাসা বেঁধেছেন মহিষকুড়ার একেবারে অন্তরমহলে । তিনি যে জীবনের জন্য লেখেন । জীবনকে ছোঁয়ার, জীবনকে আদিরূপে দেখার, জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে যাওয়ার আকুল ইচ্ছায় লেখক পথ হাঁটেন মহিষকুড়ার অরণ্যে, শাল-সারির ভিতর দিয়ে সরু সরু পায়ে চলা পথে । হয়ত সে পথ চলে গেছে কোনো গ্রামের সীমায়, তুরুককাটা, ভোটমারি বা মহিষকুড়া ।

    মহিষকুড়ার উপকথা এক আদিম বন্য গভীরতার পটভূমিতে নির্মিত । যেখানে গ্রামের মানুষগুলি আরণ্যক ভালোবাসায় মুখ রাখে, ঘুমোয়, খেলা করে । তার সীমাহীন পরিসীমায় নিজেকে ধরা দেয়, দু:খে আনন্দে বেদনায় । আবার সভ্যতার অগ্রগতি এই মানুষগুলিকে শিখিযেছে লাঙলের ব্যবহার ; যার শাসনের ফলায় পশ্চাদপসরণ করে অরণ্য । সংগ্রাম ও শান্তির প্রতীক হিসেবে লাঙলের প্রচার এত বেশি করেছে ইউরোপের মানুষেরা, যে এখন আমরা লাঙলের সঙ্গে লোভ শব্দটাকে জুড়ে দিতে সংকোচবোধ করি । কিন্তু লেখক অমিয়ভূষণ মজুমদার লাঙলকে মানুষের সভ্যতার অগ্রগতির চিহ্ন ভাবতে অনিচ্ছাপ্রকাশ করেন,

    "কারণ যারা বনের বুকে ফুটন্ত, কালো গরম পীচ ঢেলে সড়ক তৈরি করে আর যারা লাঙলের পিছনে ধৈর্য ধরে এগোয় তারা একই জাতের । আগুনে পুড়লে তবু আশা থাকে, ছাই-এর তলা থেকে নবাঙ্কুর দেখা দেয়; লোভের লাঙলে পড়লে তেমন যে শাল-পদাতিকের নিরেট নিশিছদ্র ব্যূহ, এক বনস্পতির এলাকা থেকে অন্য বনস্পতির এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত বিষমুখ কাঁটালতার তেমন যে সব ব্যারিকেড - সব ধসে যায় ।"

    সভ্যতার কেলাসিত প্রাণ আর ডানাহীন ওড়াগুলোয় কেবল হলুদ পাতাঝরা দেখেন লেখক । অরণ্যের ওপর মানুষের এই নির্মম শাসনে লেখক ব্যথাদীর্ণ অন্তরে অনুভব করেন আসন্ন বিদ্রোহের পদশব্দ,

    "এত শাসন সত্ত্বেও, কোথায় যেন এক চাপা অশান্তি ধিক্ধিক্‌ করে, যেন বিদ্রোহ আসন্ন, যেন পাকা সড়কের বাইরে যাওয়া সব সময়ে নিরাপদ নয় । মনে হয় কোথাও এমন আদিম গভীরতা আছে যা একটা মানবগোষ্ঠীকে নি:শেষে গ্রাস করতে পারে, যেন সেখানে এক দারুণ বন্য হিংস্রতা আছে যা মানুষের হিসাবকে ওলটপালট করে দিতে পারে ।"

    বনভূমির নির্জন বুক চিরে সভ্য মানুষ যখন দিনক্ষণে পাথুরে সভ্যতার অহেতুক খোদাই করছে, বনস্পতির আশ্রয়ে থাকা প্রাণগুলি মৌসাড়ে ভাঙা ভাঙা নৈ:শব্দ্য নিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে বেঠিক ঠিকানায়, তখন শেকড়ের খোঁজে হাতড়ে ফেরেন লেখক ; মুখোমুখি হন এক গভীর প্রশ্নের, বনের কি চেতনা আছে ? বনকে কি সহৃদয় বা হিংস্র বলা যায় ? বনের মধ্যে যে হরিণ-হরিণী গ্রীবা কন্ডূয়নের আদর আনত, তাকেই তীক্ষন দাঁতে চিরে রক্তপান করে বাঘ । আবার সেই বাঘকেই দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করে রক্তচক্ষু মহিষরাজ । দিগন্তে ডানামেলা পাখ-পাখালী যেখানে বনস্পতির কোলে নিবিড় বাসা বাঁধে, সেখানেই বিষের থলি নিয়ে অপেক্ষমান বিষধর ফণি । এই বৈপরিত্যের সম্মুখে দাঁড়িয়ে লেখকের অন্তরমহলের প্রশ্নটি উঠে আসে,

    "সেই বাঘ সেই হাতি সেই মোষ কিংবা সেই ফণি - এরাই কি কেউ হিংস্র ?"

    এই প্রশ্নগুলি নাড়াচাড়া করতে করতে লেখকের চেতনার দরবারে মাথা তুলে দাঁড়ায় কিছু সূত্রাবলী, যেখানে তিরতির করে ছড়িয়ে পড়ে যাপনের সৌরভ, লেখকের বিশ্বাসের সুগন্ধে পাঠকও স্বপ্নবুঁদ হয়ে ওঠে,

    "বোধ হয় তুলনাটাই বদলানো ভালো । অরণ্য সম্পর্কে নানারকমের কথা যে মনে হয়, যার কোনো একটাকেই যথার্থ যে মনে হয় না, তার কারণ বোধহয় এই যে, সে বরং অবচেতন মনের মত । যেন করাতের কলের শান দেওয়া ধার, ইলেকট্রিকের উজ্জ্বল তার, বাস-ট্রাকের দ্রুতগতিতে উচ্ছসিত পীচ-সড়ক, এদিক-ওদিক বনের গভীরে ডুবে থাকা গ্রাম, আর তাদের ঘিরে থাকা প্রাণীদের নি:শব্দ, কখনও বা চাপা তর্জন-গর্জনযুক্ত পদসঞ্চারস্পন্দিত বন - এসব মিলে যেন একটাই মন, বন যে মনের অবচেতন অংশ । আর তা যদি হয় তবে মহিষকুড়ার মত গ্রামগুলি অস্ফুট আবেগের সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে ।"

    অমিয়ভূষণ মজুমদার কার্তিক লাহিড়িকে লেখা এক পত্রে (দিবারাত্রির কাব্য, অমিয়ভূষণ মজুমদার সংখ্যা, ২০০১) মহিষকুড়ার উপকথাকে ভাষা-উলঙ্গ এক অকিঞ্চনের গল্প বলে উল্লেখ করেছিলেন । যে মানুষ শব্দ জানে না, যে মানুষ নিজের অনুভূতিকে ভাষায় প্রকাশ করতে পারে না এমনই এক চরিত্রকে ঘিরে গড়ে উঠেছে এই নভেলেট । আর তাই বুঝি সেই মানুষটির চরিত্র চিত্রণে লেখকের সচেতন শব্দ প্রয়োগ এবং উপন্যাসের সামগ্রিক ভাষা এক অনন্য সম্পদ হয়ে উঠেছে । চরিত্রকে তার পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী জীবন্ত করে তুলতে লেখক আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার করেছেন । উপন্যাসের নায়ক আসফাক এমনই এক নি:স্ব মানুষ যে প্রেম শব্দটাই শোনেনি কখনও । তাই তার মুখের ভাষা যেমন তার মানসিকতার ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে, তেমনি দেখি সেই ভাষার মধ্যে কোনো কষ্ট কল্পিত ব্যঞ্জনা নেই । সে ভাষায় আঞ্চলিকতার রঙ আছে অথচ বন্ধন নেই । তাই উত্তরবঙ্গের কোনো এক অপরিচিত অঞ্চলের ভাষা হয়েও তা সংযোগ স্থাপন করতে পেরেছে বৃহত্তর বঙ্গের সঙ্গে । আসফাকের ভাষা কেমন ছিল ? মনিবের দ্বারিঘরে বসা হাকিমের কাছে তার নালিশের বয়ান শুনি,

    "হাকিম বলল, -কী চাও?
    -জে । আসফাক ঘরের আসবাব পর্যবেক্ষণ করল যেন ।
    -কী দরকার তাই জিজ্ঞাসা করলাম
    -জে । আসফাক ঘরের ছাদ পরীক্ষা করে দেখতে লাগল ।

    হাকিম চেয়ার থেকে উঠল । তখন তার বিশ্রামের সময় । .......অনেকক্ষণ পর পাশ ফিরে আসফাককে দেখতে পেল,
    -কি যাওনি ? এখানেই চাকরি কর ?
    -জে
    -কত টাকা পাও ? খেতে পরতে দেয় ? বলি মাইনা- টাইনা পাচ্ছ তো ?
    -না
    -না ?
    -না

    হাকিম অবাক হল ।
    -কতদিন পাও না ?
    -ছ-সাত মাস

    হাকিম হো হো করে হেসে উঠে আবার জিজ্ঞাসা করল
    -কার চাকর ?
    -জাফর ব্যাপারির
    -জাফর কি খুব ধনী ? তার কি অনেক জমি ?

    জে জি বলতে বলতে আসফাকের মুখে তখন হাসি ফুটে উঠেছে । নিজের বুদ্ধিমত্তায় আশ্চর্যও কম হয়নি । সে ভেবে উঠতেই পারল না এমন একটা নালিশ সে কী করে সাজিয়ে গুছিয়ে করতে পারল । কারণ হাকিমের সম্মুখে দাঁড়িয়ে তার নালিশের কতটুকু উচ্চারণ করেছিল আর কতটুকু চিন্তা করেছিল সে-হিসাব রাখার পক্ষে অনেক উত্তেজিত ছিল তার মন । বরং যা উচ্চারণ করেনি সে-কথাগুলোই স্পষ্ট করে বলেছে - এমন অনুভব করছিল সে । নতুবা মাইনা কত, মাইনা সে পায় কিনা এসব কিছুই না । নালিশ হল অব্যক্ত মনের কথা "

    আসফাকের অনুচ্চারিত সেই নালিশ, নিজের নারী ও সন্তানকে হারিয়ে ফেলার নালিশ । তাই লেখক প্রশ্ন করেন সেই নালিশের কাছে এই বেতন, জমি জিরাতের নালিশ কি অকিঞ্চিত্কর নয় ? "আদিমপুরুষের সেই যন্ত্রণায় আঁড়-আঁড় করে ডেকে ওঠে, সে কি জমি জিরাত বেতনের যন্ত্রণায়, নাকি ঘাসফুলে কার পিতলের নাকফুল দেখে ?"

    লেখক বলেছিলেন,
    "আমি লোকের কথা বলতে চেয়েছি, অঞ্চলের কথা নয় । মানুষের কথা বলতে গেলে তাকে মাটিতে দাঁড় করাতে হয়, মাথার উপরে আকাশ দিতে হয়, আবহাওয়া গাছ-গাছড়া দিতে হয় । এসব করতে গেলে নিজের চোখে দেখা মাটি, আকাশ, জল, গাছ আঁকা যত সহজ অন্যের মুখে অপরিচিত সেসবের কথা শুনে সে-আঁকা ততটা ভালো হয় না ।"('নিজের কথা' - অমিয়ভূষণ রচনাসমগ্র-১)

    আর তাই বোধকরি ডাকবিভাগের টাউন ইন্সপেক্টর হিসেবে উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলিতে তাঁর দীর্ঘকালীন যাপনের জলছাপ পড়েছে উপন্যাসের চরিত্রগুলির বপনে বয়ানে । মহিষকুড়ার পটভূমি কোচবিহার-আলিপুরদুয়ার অঞ্চলের হলেও লেখক তাঁর অসামান্য তুলির আঁচড়ে সেই সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে গেছেন, মহিষকুড়ার মানচিত্র স্থাপন করেছেন আপন মনোভূমিতে । আর তাই চরিত্রগুলির কথোপকথনে পরিবেশ এত জীবন্ত হয়ে ওঠে, এত বাস্তব হয়ে ওঠে যে পাঠক একাত্মবোধ করে ওই পরিবেশের সঙ্গে ওই মানুষগুলির সঙ্গে ।

    মহিষকুড়ার উপকথার নায়ক আসফাক । ভৈষ-বাউদিয়ার বংশধর জাফরুল্লার বাথানের এক সামান্য কর্মী । কিন্তু এই নায়কের পাশাপাশি আরো একটি চরিত্র যেন নায়কের ভূমিকায় অংশ নিয়েছে, নাম তার বুনো মোষ । পাঠক কি থমকে গেলেন এই বিবৃতিতে ? তাহলে চলুন মহিষকুড়া নামের ইতিবৃত্তে একটু ঘুরে আসি ।

    কোনো এক সময় এই নদীতেই ছিল বুনো মোষের আড্ডা । নিজ নিজ চারণভূমির সীমার মধ্যে যুথবদ্ধ মহিষ আর ছিল বেদিয়ার মত কিছু মানুষ ; যারা ওই দল থেকে কিছু মোষ ধরে, কিছুটা পোষ মানিয়ে বিক্রি করে দিত । যেখানে যুথবদ্ধ মহিষকে বনের হিংস্র পশুরাও সমীহ করে চলে সেখানে এই বেদিয়াদের দুর্জয় সাহস রূপকথার মত আজও বিরাজ করে মহিষকুড়া গ্রামের মানুষের মনে । বেদিয়াদের লাভের লোভ যেমন ছিল তেমনি নিজেদের পৌরুষকে কাজে লাগানোর নেশাও ছিল তীব্র । এইখানে এসে লেখক অনুভব করেন ভৈষ-বেদিয়ারা জীবনকে সুদূর অনিশ্চয়তার মধ্যে শিকার করে ফিরছে তাদের শিকারী জীবনের সংগ্রামশীল অস্তিত্বে । এই সমস্ত মানুষকে কোনো নীতিই তাদের জীবনের সার্থকতা দান করতে পারে না ; একমাত্র তাদের জীবন বিশ্বাস আর নিরলস সংগ্রাম ছাড়া ।

    জাফরুল্লার বাবা ফয়েজুল্লার বাথানের এক মাদী মোষকে পাওয়ার জন্য এক উত্তেজিত ত্রক্রুদ্ধ দৈত্যাকৃতি বুনো মহিষের উন্মত্ত আক্রমণ ঘটেছিল । সেই দুর্ধর্ষ রোমাঞ্চকাহিনীর শ্রোতা হিসেবেই উপন্যাসে নায়ক আসফাকের প্রথম আবির্ভাব । আর কীভাবে আসফাক প্রবঞ্চনার গভীরতম খাদে পড়ে আঁড়-আঁড় ডাকতে ডাকতে বুনো মোষ হয়ে যায় - সেটাই এই উপন্যাসের বিষয় । জীবনে জীবন যুক্ত হয়েই শিল্প এবং শিল্পীর পথচলা ; নদীখাত বেয়ে আরো গভীরে চলমান কিছু ক্রিয়া বিক্রিয়া । তবু শিল্পের মধ্য দিয়ে ব্যক্তির জীবনযাপনের যে কোনো ক্ষেত্রেই সাহিত্যে বা শিল্পে উঠে আসে একটি বক্তব্য বিষয় । বুনো মোষের চারণভূমির পটভূমিতে তাই বুঝি দাঁড় করিয়েছেন আসফাককে । "বছর ছাব্বিশ-সাতাশ বয়স হবে । রোগা লম্বাটে হলুদ-হলুদ চেহারা, আর সকলের মতো কালো চেহারা নয় । চোখ দুটো টেরচা, উপরের পাতা দুটো বড় বলে মনে হয় । চিবুকে গোটা দশ-পনের চুল তার দাড়ির কাজ করছে ।"

    আসফাক দূর্বলচিত্ত মানুষ । তারই সহকর্মী ছমির যখন অনায়াসে বাথানের গরু মোষকে মাটিতে চেপে ধরে সুন্নৎ করে, সেসময় সে পালায় । যতদূর সেই গোরু-মোষের চিত্কার শোনা যায় তার বাইরে কোথাও গিয়ে বসে থাকে । তার যেন কেমন ভয় ভয় করে । যখন তাকে নিতান্তই সেই মোষের পা ধরে থাকার জন্য সেখানে রয়ে যেতে হয় সে চোখ বন্ধ করে থাকে । মাটিতে চেপে ধরা পশুটির আর্তনাদ যন্ত্রণার ভয়ঙ্কর দৃশ্য শেষে যখন চোখ খুলে দেখে তখন সে কিন্তু পশুটির অন্তরঙ্গ দিকে না চেয়ে বরং তার চোয়ালের দিকে চায় আর মনে হয়, সেই মোষের এঁড়ের বড় বড় চোখ দিয়ে জল পড়ে সর্দির মতো শুকিয়ে আছে । যদিও লেখক আবেগ অপেক্ষা বাস্তববোধ এবং অভিজ্ঞতালব্ধ মনোভঙ্গি নিয়ে শোষিত অত্যাচারিত মার খাওয়া মানুষের বৃত্তান্তকে এই উপন্যাসের অবয়বে বাণীরূপ দিয়েছেন তবু কোথাও কোথাও এমনভাবেই আবেগের সূক্ষ্ম প্রকাশভঙ্গীটি খুব মৃদুতায় স্পর্শ করে পাঠককে ।

    এমন দূর্বলচিত্ত আসফাককেও আপন গর্ত থেকে বেরিয়ে আসার আকাঙক্ষা পিছুতাড়া করে । ইচ্ছে মানেই তো সে স্বাধীন । অথচ স্বাধীনতাকে মেনে আচরণ করার সাহস কজনেরই বা আছে এ সংসারে । পেশার সাথে জীবনের নিয়তিকে এক করে দেখে সে । মানুষ ভাবে সে সংসার চালায় । কিন্তু সত্য তার উল্টো কথা বলে । সংসারের নিয়ম মানুষকে চালায় । কোনো কোনো মানুষ সেই নিয়তির নিগড় ভাঙতে চায় আবার কেউ কেউ হয়ত সেখানেই ব্যক্তিত্বের আত্মবিসর্জন দেয় । আসফাক এমনই এক বিষণ্ণ নায়ক । আপন গর্তের মধ্যে থাকতে থাকতেই সমাজের নিগড় ভাঙতে না পেরে আত্মদ্রোহে আসফাক বুনো মোষ হয়ে যায় । মনিবের জন্য ওষুধ আনার দায়িত্ব নিয়ে আসফাক যখন বনের পথ ধরে শহরের দিকে চলেছে, তখন তার গতির বৈশিষ্ট্য বোঝাতে গাড়ির আগে জোতা মোষের ভঙ্গীর সঙ্গে তুলনা করেছেন লেখক ,

    "দেখলে মনে হবে অলস উদ্যমহীন, আসলে কিন্তু সহিষ্ণু আর অচঞ্চল । .....শিং দুটোকে পিছন দিকে হেলিয়ে মুখটা একটু তুলে সে চলেছে তো চলেছেই । যেন সে জেনে ফেলেছে যে, অস্বাভাবিক কষ্টদায়ক ব্যাপারটি তার কাঁধের থেকে ঝুলতে ঝুলতে তার পিছন পিছন চলছে - যত জোরেই যাও সে কাঁধ ছাড়বে না, পিছনে আসাও বন্ধ করবে না । বরং জোরে গেলে সে আরও জোরে পিছনে আসে, তখন হঠাৎ থামতে গেলে সে পিছন থেকে এমন ধাক্কা দেয় যেন পড়ে যেতে হবে । আবার যদি আস্তে আস্তে চলা যায় তবে পিছনের সেই বোঝার ধারাল গায়ে লেগে পিছনের পা দুটোয় ঘা হয়ে যাবে ।"

    সামাজিক জটিলতা নয়, বরং নায়কের একার মানসিক জটিলতা, সামাজিক প্রতারণার সম্মুখে তার মনোসমীক্ষণ ও চেতনাপ্রবাহের স্রোতকে লেখক একটু একটু করে এগিয়ে নিয়ে গেছেন উপন্যাসের সেই বিদ্রোহী মুহূর্তের দিকে । বনের পথে চলতে চলতে এক ঘাসবনের কাছে পৌঁছে হঠাতি আসফাকের মনে হয় সে পথ হারিয়েছে । পায়ের তলার ঠান্ডা মাটি, জল জল ভাব এবং ঘাসবনের ধারে মোষের শুকনো গোবর দেখে সে নিশ্চিৎ হয় এদিকে মোষ আসে, বুনো মোষ নাকি ? মোষের প্রিয় খাদ্য সেই মিষ্টি রসের ঘাস ছিঁড়ে চিবোতে চিবোতে সে এগিয়ে চলে ঘাসবনের ভেতর দিয়ে আর খুঁত খুঁত করে হাসে । সে হঠাৎ মাথা তুলে ডাকল, 'আঁ-আঁ-ড়'; যেন সে তার মোষদের ডাকছে । আসফাক ত্রক্রমে ত্রক্রমে মোষ হয়ে যায় । সেই প্রবঞ্চিত ভাষাহীন মানুষটি, হাকিমের কাছে যার নালিশ বেতন-না-পাওয়ার ভাষা নেয়, যেজন্য সে নিজেকে সাবাসও দেয়, সেই সব-হারানো মানুষটি মোষ হয়ে যায় । তার অস্তিত্ব, জীবনের টানাপোড়েন বুঝিয়ে দেয় আমরা যাকে বাস্তব বলি, জীবন তার চেয়েও অনেক বেশি অপ্রাকৃত, হিসেবে মেলে না,

    "সেই অবস্থায় গাছের পাতার ছায়া যেমন তার গায়ের ওপরে ছায়ার ছবি আঁকছিল, তার মধ্যেও ভয় আর সাহস, আনন্দ আর উত্তেজনার নানা রেখা টেনে নাচতে লাগল । সে এবার আরো জোরে, আরো টেনে "আঁ-আঁ-আঁ-ড় শব্দ করে উঠল । কান পেতে শুনল, প্রতিধ্বনি যেন একটা উঠছে । আর সেই মুহূর্তে সে অনুভব করল, সে মোষ হয়ে গিয়েছে । একটা বুনো মোষ সে নিজেই - এই ভেবে তার নিশ্বাস গরম হয়ে ফোঁসফোঁস করতে লাগল । সে প্রাণভরে ডেকে উঠল - আঁ-আঁ-ড় ।"

    আসফাকের জীবনবোধের মধ্য থেকেই উত্সারিত হয়েছে লেখকের মতাদর্শ, "যা কিছু জীবনকে খর্ব করে, ক্ষুণ্ণ করে, শোষণ করে, বন্দি করে পদানত রাখতে চায় তার সঙ্গে সাহিত্যের সদ্ভাব থাকতে পারে না"। সাহিত্য থেকে জীবনকে তিনি অনেক বড় করে দেখেছেন । কেবলমাত্র টাকার অঙ্কে মানুষ মাপার পৃথিবীকে অস্বীকার করে সমাজের এইসব প্রান্তসীমার মানুষগুলির দর্শন ও জীবনচর্চাকে অনুভব করেছেন আপন অস্থিমজ্জায় । আর সেই কারণেই ব্যক্তি অভিজ্ঞতার নিরিখে তাঁর বিশ্লেষণ এত প্রাঞ্জল এত বাস্তব হয়ে উঠেছে ।

    প্রায় সাত সাল আগে এই অরণ্যের পথেই আসফাক হঠাৎ দেখা পেয়েছিল কমরুন নামের সেই বেদেনির । সবুজে-নীলে মেশানো নদীর জলে এক নিরাবরণ নারী । কী এক সর্বগ্রাসী মাধুর্য তার মুখে, একটু-খোলা ঠোঁটদুটিতে, পিতলের নাকফুলে, যা আসফাককে টেনে নিয়ে গেছিল এক অদ্ভুত শক্তিশালী আকর্ষণে । বনের পথে সেই নারীর সঙ্গী হয়ে কিছুদিন স্বর্গরাজ্যে বাস করেছিল আসফাক । কিন্তু বনের ক্ষণস্থায়ী বসন্ত শেষ হয়ে যখন প্রবল বর্ষা নামল তখন কমরুনের মুখে আসফাক তার নিজের অযোগ্যতার তালিকা শুনে মলিন হয়ে উঠল,

    "তুমি কি বনের মোষ ধরতে জান ? তাদের দলের কর্তা যেমন মোষের ডাক ডেকে বনে-চরা অন্যের বাথানের মোষকে বিপথে টেনে নিয়ে ধরে ফেলে, তাও কি আসফাক পারে ?.... আসফাক কি পুলিশের হাতে ধরা না পড়ে দল নিয়ে রাতের অন্ধকারে ভাগতে পারে ? "

    না, আসফাক এসবের কোনোটাই পারে না । আর তাই বুঝি একদিন সে আবিষ্কার করে কমরুন জাফরুল্লার চার নম্বর বিবি । আর আসফাকের ঔরসজাত মুন্নাফ জাফরুল্লার একমাত্র উত্তরাধিকারী । আসফাকের প্রেমে রূপজ কামনার উচ্ছলতা নেই, প্রেম শব্দটিই তার কাছে অনাবিস্কৃত, জীবন সম্পর্কে কোনো সংগঠিত ধারণাই নেই । এই ভাষা-উলঙ্গ নিছক মানুষটির একেবারে মৌলিক তন্ত্রীতে টান পড়েছে । অকিঞ্চনের একমাত্র রত্ন সেই নারী ও তার গর্ভজাত আত্মজকে হারিয়ে আসফাক তার দাঁড়ানোর একমাত্র জায়গাটিকেই হারিয়ে ফেলেছে । সমাজ বন্ধন ও সম্প্রদায়ের শৃঙ্খলায় ব্যক্তি আসফাকের মনের চাপা পড়া কান্না উপন্যাসের পাতায় পাতায় । ব্যক্তি তো সবসময় বিদ্রোহী হয় না, বরং দু:খের দহন তাপে দগ্ধও হয় । আসফাকের ব্যক্তি চরিত্রে সেই স্পর্ধিত বিদ্রোহ তাকে ক্ষণিকের জন্য বুনো মোষ করে দিলেও সে ফিরে আসে তার নির্জন কোটরে । মানব চরিত্রের গভীরতম সংকটভূমি থেকেই প্রতিবাদী আসফাক বুঝতে পারে,

    "সব বনই কারো-না-কারো - যেমন সব জমিই কারো-না-কারো । হঠাৎ কিছুক্ষণের জন্য তুমি বুনা ষাঁড়-মোষ হতে পার, কিন্তু বন আর বনের নয়, তাও অন্য একজনের । .....শহরের রাজারা, যারা রাজ্য চালায়, তারা পোষ-না-মানা কোনো মর্দা মোষকে নিজের ইচ্ছেমত বনে চরতে আর কোনোদিনই দেবে না । যদিও হঠাৎ হঠাৎ তোমার রক্তের মধ্যে এক বুনা বাইসন আঁ-আঁ-ড় শব্দ করে ডেকে ওঠে ।"



    (পরবাস-৪৩, জুলাই, ২০০৯)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)