এই কলেজে এসে গত একমাসে ওই একটা ছেলের সাথেই যা একটু ভাবসাব হয়েছে সমুর । তার প্রধান কারণ, এখানকার ছেলে হয়েও কৃষ্ণ চমত্কার বাংলা বলতে পারে । পড়তেও পারে একটু আধটু ।
গোটা ক্যাম্পাস জুড়ে অনেক গাছগাছালি । কেঁদ, মহুয়া, শাল, করমচার ঝোপও রয়েছে এখানে ওখানে । ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট পুকুর । নুড়িমেশানো লাল মাটির খাড়াই পাড় দিয়ে ঘেরা টলটলে জল । বিল্ডিংগুলোর ভিত উঁচু করবার জন্য মাটি খুঁড়ে তুলতে হয়েছিল । পুকুরগুলো তারই ফসল । সেই অর্থে কোন প্ল্যানড ল্যাণ্ডস্কেপিং হয়নি এখনো এই ক্যাম্পাসে ।
পাঁচিল ছাড়ালেই পাথরমেশা লালচে মাটি উঁচুনিচু হয়ে ছড়িয়ে গিয়েছে যদ্দূর চোখ চলে । তার মধ্যে দিয়ে ন্যাশনাল হাইওয়েটা একটা কালো, মসৃণ ব্যতিক্রমের মতোই, ঘাটির ওপাশ থেকে নেমে এসে তীক্ষণ বাঁক নিয়ে কলেজের ডানদিক দিয়ে বেরিয়ে গেছে লিটনপুরার দিকে ।
আসবার আগে চাপা একটা টেনশন ছিল বটে সমুদ্রর । যাদবপুর ইউনিভার্সিটির ওই লোকেশন থেকে গিয়ে একেবারে পাণ্ডববর্জিত একটা জায়গায় অ্যাডজাস্ট করতে পারবে কি না সে নিয়ে চিন্তা হচ্ছিল । তা, এসে অবশ্য মন্দ লাগছে না । পড়াশোনা খারাপ হয়না এখানে । প্রফেসররাও ভালো । ক্লাসে ওই এক কৃষ্ণ বাদে বন্ধুবান্ধব যে বিশেষ জোটেনি, সেটা স্থানবৈগুণ্যের জন্য নয় । বন্ধুবান্ধব সমুদ্রর কোনকালেই বেশি ছিল না । বেশি মেলামেশা ওর ঠিক আসে না ।
কৃষ্ণ বোধহয় একটু আধটু অন্যের মন পড়তে পারে । পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সটান ওর চিন্তাটার মধ্যে ঢুকে এসে বলল, কী রে ? কেমন লাগছে আমাদের কলেজ ? তোর যাদবপুর এর চেয়ে খারাপ নয় তো ?
- উঁহু । দিব্যি কলেজ । তবে কলকাতা শহরটাকে খুব মিস করছি, বুঝলি ?
- থেকেই যেতে পারতি । এলি কেন ?
- ওরে বাবা ! মা ছাড়বে ? এখনো তো কোলের ছেলে ভেবে বসে আছে ।
কথাটা পুরোপুরি ঠিক নয় । জোর করলে হয়ত পিসির বাড়িতে থেকেও যেতে পারত সমুদ্র । পিসি বলেওছিলো দু একবার । জেমস লং সরণি থেকে কতটাই বা আর দূর পড়তো ! কিন্তু মা'র আনন্দটাকে নষ্ট করতে মন চাইল না । বাবার রামদেবপুরে ট্রান্সফারের খবর পেয়ে মা বড় খুশি হয়েছিল । বলে, কবে যাবে গো ? লুহারির জঙ্গলের পাশে আমাদের সেই কোয়ার্টারগুলো এখনো থাকবে নিশ্চয় !
- সে তো আছেই । তবে এখন আর ওখানে গিয়ে ওঠা যাবে না । টাইপ ফোর কোয়ার্টার সব । জুনিয়ার ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য অ্যালট হয় । এখন এত সিনিয়ার হয়ে গিয়ে আবার সেই জুনিয়ারদের মধ্যে, ছোট ফ্ল্যাটে...
- তা ঠিক... মা একটু নিভেই গিয়েছিল যেন । তার মানে, এবারে গিয়ে বাসস্ট্যাণ্ডের কাছে টাইপ ফাইভ সিক্সের লালবাড়ি, তাইতো ? সেই ভালো । ইণ্ডিপেণ্ডেন্ট বাংলো পাওয়া যাবে । জায়গাও অনেকটা বেশি । তাছাড়া, লালবাড়িতেও আমার অনেক চেনাশোনা ছিল । বলতে বলতেই সমুদ্রর দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁ রে, তিন নম্বরের সুতপা আন্টিকে তোর মনে আছে সমু ? সেই যে রে, তোকে একবার একটা রকিং হর্স দিয়েছিল ? ভীষণ ভালোবাসত তোকে । নিয়ে গেলেই ঠেসে ঠেসে খাওয়াতো বলে তুই একদম যেতে চাইতিস না ! এখনো যদি থেকে গিয়ে থাকে, তোকে যখন নিয়ে গিয়ে দেখাব, যা মজা হবে না ! কোথায় সেই রাঙা টুকটুকে ছেলেটা, আর কোথায় একটা দাড়িওয়ালা হুদো জোয়ান ! আর তাছাড়া জলহাওয়ার তো কথাই নেই । একবার ওখানকার জল পেটে পড়লে যা খোলতাই চেহারা হবে না ! লালবাড়ির মেয়েরা দল বেঁধে তাড়া করবে দেখিস ! হ্যাঁগো, পাঁচ-এর এ-র রমাবৌদিরা এখনো আছে ওখানে ? তুমি একটু খবর নিতে পারবে ? তাহলে ক'টা জিনিস আগে থেকে জোগাড় করে রাখতে বলে দিতাম .....
... চোখমুখ চকচক করছিল মা'র । এতগুলো বছরের পরে বাড়িগুলো না বদলালেও তার বাসিন্দারা যে বদলে যায়, সরকারী হাউজিংয়ের সেই সাধারণ সত্যটাকেও মন থেকে সরিয়ে রাখছিল জোর করে । বাবা মজা পাচ্ছিল । মুখে বলছে না অবশ্য, তবে চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল বেশ । মজা পাচ্ছিল সমুও । উইশফুল থিংকিংয়ের চরম একেবারে । আসলে, বিয়ের পরে মা প্রথম সংসার পেতেছিল ওই রামদেবপুরেই । বছর তিনেক ওখানে ছিলও । সে সময়েই সমুর জন্ম । তারপর এতগুলো বছর ধরে এত শহরে ঘুরেও, থাকবার জায়গা হিসেবে ওই রামদেবপুরই মা'র ফার্স্ট চয়েস । এমনকি কলকাতার চেয়েও । মাঝেমাঝেই আক্ষেপ করে বলত, কেন যে বোকার মত জায়গাটা ছেড়ে চলে গেলাম ! কাজেই, ও'রকম প্রাণের জায়গায় আবার যেতে পাবে জেনে আনন্দ হওয়াটা অস্বাভাবিক নয় ।
সমু অবশ্য প্রথমে মনে মনে ঠিক করেই রেখেছিল মাস্টার্স শেষ না করে ও যাদবপুর ছাড়বে না । বাবা মা চলে গেলে পিসির বাড়িতে থেকে স্বচ্ছন্দে পড়া চালিয়ে নেয়া যাবে । একবার ভেবেছিল, সরাসরি কথাটা বলেই নেয় । কিন্তু তারপর, মার ওই উজ্জ্বল মুখটার দিকে তাকিয়ে, বলা আর হয়ে ওঠেনি । শুধু বাবার দিকে চেয়ে মৃদু একটা প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিল, ওখানে বি এস সির মিড সেশানে ভর্তি নেবে নাকি ? তার বদলে আমি যদি পিসির বাড়িতে থেকে পার্ট ওয়ানটা কমপ্লিট করে তারপর ... মানে, আর সাত আটটা মাসই তো ! তারপর না হয় ..
তার কথাটা শেষ করতে না দিয়েই বাবা বলে, সে আমি আজকেই দুপুরে খোঁজখবর নিয়ে নিয়েছি । নতুন সরকারি কলেজ হয়েছে ওখানে একটা । পড়ায় মন্দ না । প্রিন্সিপ্যাল সাহেবের সঙ্গে কথা হয়ে গেছে আমার । সেন্ট্রাল গবমেন্ট এমপ্লয়ির ছেলে, তার ওপর অন ট্রান্সফার যাচ্ছি; উনি বলেই দিয়েছেন কোন সমস্যা হবে না ।
মা প্রায় দম বন্ধ করে বাপ ছেলের কথাবার্তা শুনছিল । এইবারে স্বস্তির নি:শ্বাস ছেড়ে বলল, ব্যস ! তাহলে তো আর কোন সমস্যাই রইল না । সমুকে ছেড়ে আমরা দুজন একা একা .. মানে ..
বাবা হেসে ফেলেছিল । বলে, সমু, অক্সিমোরনের উদাহরণ দেখলি তো ! দুজন মিলে একা একা.... হা: হা:.... আরে আরে, ওদিকে কোথায় যাচ্ছিস ?
কৃষ্ণর ডাকে চিন্তার সুতোটা ছিঁড়ে গেল সমুদ্রর..
-কেন ! বাড়ি যাবো তো !
-না । যাবি না । আচ্ছা সমু, তোর কি কোন কথাই মনে থাকে না ?
- কী ভুললাম আবার ?
- আজ তোর আমাদের বাড়ি যাবার কথা না ? মাসিমাকে সকালে বলে এসেছিস বললি !
- ই হি ! একদম ভুলে মেরে দিয়েছিলাম ।
- ভুললে তোর আর কী ? তুই যাবি বলে মা কিসব ফুলুরি, পায়েস টায়েস বানিয়ে রাখবে বলেছে । সঙ্গে করে নিয়ে না গেলে না, আমার কপালে আজ মার হাতের পায়েসের বদলে..
বাক্যটা শেষ না করে কৃষ্ণ ঠোঁট টিপে হেসে হাত তুলে একটা চড় দেখাল ।
ইট দিয়ে উঁচু করা চৌকিদুটোর ওপর পাশাপাশি বসে দুই বন্ধু পায়েস খাচ্ছিল । ঘরের পেছনে টিণ্ডা আর আরভির খেত । কৃষ্ণরই করা । নিচু জানালা দিয়ে তার সবজেটে আভা এসে পড়েছে ওদের গায়ে মুখে ।
বারান্দায় চেয়ারে বসে সেলাই মেশিনে কাজ করছিল মালা । মাঝে মাঝেই খোলা দরজা পেরিয়ে চোখ চলে যাচ্ছে ওদের দিকে । কাজ অবশ্য আটকাচ্ছে না তাতে । নিখুঁত যান্ত্রিকতায় পাদুটি তার চাপ দিয়ে চলে মেশিনের পেডালে । অভ্যস্ত আঙুলগুলো দ্রুতসঞ্চরমান ছুঁচের সঙ্গে নিজেনিজেই খেলা করে চলেছে...
---মুখটা একেবারে বদলে গেছে সমুর । গালদুটো ভেতরদিকে ঢুকে গিয়ে একটা তীক্ষণ তেকোনা ভাব এসেছে মুখে । গালে হালকা, রোঁয়া রোঁয়া দাড়ি । শুধু গায়ের সেই টকটকে রঙ এতদিনেও টসকায়নি । আগের মতই রয়ে গেছে । চোখদুটোও তাই । সেই একইরকম টানাটানা, মায়াময় । ওই চোখ দেখেই তো মালা----
- ও মাসিমা, আর একটু পায়েস দেবে ?
- ভালো লেগেছে বুঝি ?
- ভীষণ ! আগে কখনো এ টাইপের পায়েস খাইনি । কি দিয়ে বানিয়েছো বলোতো ?
- লাউয়ের পায়েস ।
- সে কী ? লাউয়ের আবার পায়েস হয় নাকি ? কোনদিন শুনিনি তো !
ছুঁচের ওঠাপড়ার শব্দটা একটু বদলে গেছে । মালা সেইদিকে চোখ ফেরালো । রিলের সুতো ফুরিয়েছে । নতুন রিল লাগাতে লাগাতে মনে মনে হাসছিল সে । কি বকাটাই না খেয়েছিল মালা সেবারে এই লাউয়ের পায়েস নিয়ে ! দুপুরবেলা বৌদি গিয়েছিল বিবেকনগর মহিলা সমিতিতে । ছেলে তো ঘুম থেকে উঠে কেঁদেকেটে একশা । মা কোথায় গেল ? দুপুর তখন পড়ে এসেছে । কাপড়গুলো রোদ থেকে তুলে এনে কুঁচোচ্ছিল মালা । সে'সব ফেলে রেখে ছেলে ভোলাতে বসতে হল । সে ছেলে কি বোঝে ? হাত পা ছুঁড়ে কেঁদেই চলেছে । কাঁদতেও পারত কিছু ও ছেলে ! ওদিকে, হাতে দেবার জন্য একটা বিস্কুট টিস্কুটও কিছু নেই ঘরে । শেষমেষ খানিকটা লাউ ছিল ফ্রিজে, তাই দিয়ে তাড়াহুড়ো করে একটু পায়েস করে দিতে কান্না থামে । মহানন্দে গায়ে মুখে মাখিয়ে পায়েস খাওয়া চলল । ফিকফিক করে হাসছে । বলে, মাসি সোনা, মাসি লক্ষ্মী, এসো চুমু দিই ।
বাটিটা দিয়ে ওকে বসিয়ে রেখে হাতের কাজটুকু সারছে মালা, এমন সময় বৌদি ফিরল । ছেলের হাতে বাটিটা দেখেই রেগে দশখানা হয়েছে । রাগলে বৌদির কাণ্ডজ্ঞান থাকত না । যা হয় তাই করে বলেছিলো তাকে সেদিন । বলে, ছেলেকে মারতেই যদি চাও তবে অত কৌশল না করে সোজা গলাটা টিপে দিলেই তো পারো । এই অবেলায় একবাটি লাউসেদ্ধ হাতে ধরিয়ে দিয়েছো । বলি বয়েস তো কম হল না ! কাণ্ডজ্ঞান আর কবে হবে বলতে পারো ?
- কী করব বৌদি, ঘুম ভেঙে যা কান্না জুড়েছিল তোমায় না দেখে....
- তা ছেলে যাতে না কাঁদে সেইজন্যই তো পয়সা খরচা করে তোমায় রাখা । ছেলেও কাঁদলো আর তুমিও হাতে যা খুশি একটা ধরিয়ে দিয়ে দায় সারলে । অবেলায় ওসব অখাদ্য খেয়ে যদি এখন কিছু একটা বাঁধিয়ে বসে তবে ক্ষতি যা হবার সে তো আমারই হবে । তোমার তাতে কী ? ছেলে তো আর .....
আর দশবারের মত সেবারেও মালা কাজটা ছেড়ে দিয়ে ফিরে যাবে ভেবেছিল । আর দশবারের মত সেবারেও ছাড়া আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি । ছেলেটা যে কী মায়ায় বেঁধেছিল তাকে ......
..... ঘরের ভেতর থেকে ছেলেদের টুকরো টুকরো কথা আর মাঝে মাঝে হাসির আওয়াজ আসছিল । নতুন আলাপ । প্রাথমিক পরিচয় দেয়ানেয়ার পালা চলেছে এখনো । সমু, মালাকে চিনতে পারেনি । পারবার কথাও তো নয় । বৌদিরা নাগপুরে চলে গেল যখন, সমুর তখনো তিন পুরো হয়নি । আর আজ, এই উনিশ বছরেরটি হয়ে ফিরে এল । মালাই কি পথেঘাটে দেখলে চিনতে পারত ? কৃষ্ণর মুখে কলেজে নতুন আসা ছেলেটার বাবার নাম শুনে প্রথমে আন্দাজ করেছিল । তারপর লালবাড়িতে দুটো শার্ট ডেলিভারি দিতে গিয়ে একটু খোঁজখবর নিতেই সব সন্দেহ মিটে গেল ।
বুকের ভেতর একটা ধাক্কা লেগেছিল মালার । সুতীব্র দহনের একটা পুরনো স্মৃতি ফের ফিরে এসেছিল মনে । তবে তা দহন নয়, তার স্মৃতিমাত্র । দাবানল শেষ হয়ে গেছে । নিভে যাওয়া অঙ্গারে অতীতের আগুনের স্মৃতিটুকুই তো থেকে যায়; আগুন থাকে না । সে অঙ্গারটুকুও কবে যেন চাপা পড়ে গিয়েছিল নতুন মুকুলোদগমে । আজ আবার হঠাৎ করেই সময়ের পল্লল সরিয়ে বাইরে এল তা ! আচ্ছা, বৌদি কি জানে, মালা আজও রামদেবপুরে আছে ? জানলে ছেলে নিয়ে আসতে সাহস পেত ?
কৃষ্ণর গলা পাওয়া যাচ্ছিল । বলছে, না না, আমি এখানেই বর্ন অ্যাণ্ড ব্রট আপ । তবে, আমার মামাবাড়ি কোলকাতায় । ওই যে, ডানলপ ব্রিজ আছে না, ওর পাশে-- না রে, যাইনি কখনো । মা বাড়ি ছেড়ে নড়তে চায় নাকি ? কতবার বলেছি.... বাবা ? না বাবা নেই..... দেখিনি কখনো । ছবিতেও না .. আমাদের মতো সাধারণ ঘরে ছবিটবির পাট অতো.....
.... মনটা ভালো হয়ে যাচ্ছিল মালার । সত্যি, মিথ্যে, বাস্তব, কল্পনা সবকিছুর মিশেলে কী সুন্দর এক স্বর্গ যে গড়ে তোলে তার ছেলেটা ! যেন ডানা দিয়ে আগলে রাখতে চায় মায়ের গোটা জীবনটাকেই । ও না থাকলে.....
- হ্যাঁ মাসিমা । বুড়ো পেশেন্টের বেডপ্যান টেনে টেনে হাতে হাজা পড়ে গেল ।
- ভালো করে ভেবে দ্যাখ মালা । আটটা টু আটটা । রোদ বর্ষা আছে । আপদ বিপদ আছে । প্রত্যেকদিন রাত আটটায় বেরিয়ে বাঘাযতীন থেকে ডানলপ ফেরা, রাতবিরেতে একা মেয়ে....
হেসেছিল মালা । তারপর বলেছিল, এই তো কেলেকুষ্টি খ্যাংড়ার মতো চেহারা ! বয়সও তো কম হল না । ওসব বিপদের কোন ভয় মার নেই মাসিমা । ভগবান নিজেই সে উপকারটা আমার করে রেখেছেন যে । এই চেহারায় আর ...
- ছি মালা ! তোর মত ভালো মেয়ে, ও'রকম করে নিজের নামে বলতে নেই । ভগবান ঠিক দিন দেবে, দেখিস ! ঘর বর সব হবে তোর ।
- ওরে বাবা ! রক্ষেকরেন মাসিমা । আমার কীর্তিমান বাবাকাকাদের হাতে মা-কাকিমার দশা তো এতগুলো বছর ধরে দু'বেলা দেখছি ! সে শখ আমার ঘুচে গেছে সেই ছোটবেলাতেই ।
তবু কেন যেন, মাসিমার কাছ থেকে ফিরে বাড়ি আসতে আসতে মালার চোখে বারবার ভেসে উঠছিল, লাল টুকটুকে নধর একটা বাচ্চা । হলুদ রঙয়ের কাঁথায় জড়ানো । তার কোলে ঘুমিয়ে আছে । চোখদুটো বোজা । ঠোঁট একটু ফাঁক হয়ে আছে । গায়ে মুখে মিষ্টি গন্ধ ! দুধের গন্ধ ! তার দুধ.....
নর্মাল ডেলিভারি হয়নি অনামিকার । ফ্লুইড কমে গিয়ে বাচ্চার স্প্যাজম শুরু হয়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে সিজারই করতে হয়েছিল শেষপর্যন্ত । অপারেশনের সময় সমস্যাও হয়েছিল একটা । দুদিনের মাথায় জরায়ুতে রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে গিয়ে মরবার দাখিল হয়েছিল । ফলে সেরেসুরে উঠে, ছেলের মুখেভাতের পাট চুকিয়ে টুকিয়ে রামদেবপুরে ফিরে যাবার সময় যখন হল ততদিনে সমু আটমাসে পড়েছে । রওনা হবার ডেট ঠিক হতে অনামিকা একদিন মালাকে গিয়ে ধরে বসল, তুমি সঙ্গে যাবে তো মালাদি ?
- আমি ? রামদেবপুরে ? কি করে হবে বৌদি ? বাড়ির যা অবস্থা, সে তো তুমি জানো ! বাবা রাজি হবে না অদ্দূরে কাজের জন্য ছাড়তে ।
- কিন্তু সমু যে তোমার কাছে ছাড়া কারো কাছে খায়-ঘুমোয় না ! কি হবে তাহলে ?
বুকে দুধ আসেনি অনামিকার । প্রথম দুটো মাস যখন যমে মানুষে টানাটানি চলছে তাকে নিয়ে বাচ্চাটা তখন মালার বুকের কাছেই ঘুমোত । কনজেনিটাল জণ্ডিস নিয়ে জন্মেছিল । ফিড দিতে হয়েছে মেপে, মেপে, ঘড়ি ধরে ধরে । প্রথম কয়েকদিন দিনের ডিউটি করবার পর নিরুপায় হয়ে মালা জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে একেবারে এ বাড়িতেই এসে উঠেছিল কিছুদিনের জন্য । আটটা টু আটটা ডিউটি করে এ বাচ্চা বাঁচানো যাবে না । সেন্টারের আর কারো হাতে রাতের বেলাটা ছেলেকে ছেড়ে দিতে ঠিক ভরসাও হয়নি তার । সবকটা মেয়েকেই তো চেনা আছে ! ওরা বড় ফাঁকি দেয় ।
মাসখানেক পরে, ত্রক্রাইসিসটা কাটলে একদিন বিকেলবেলা মালা বাড়ি ফিরে গিয়েছিল । পরদিন সকালে ডিউটিতে এসে বাইরে থেকেই শোনে, চিল চিত্কার জুড়েছে সমু । তাড়াতাড়ি করে কাপড় বদলে সাবান দিয়ে হাতমুখ ধুয়ে এসে দেখে অনামিকা মুখভার করে শুয়ে আছে । দোলনায় শোয়ানো ছেলেকে দেখিয়ে বলল, ওই নাও । সারা রাত ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদেছে । কোলের কাছে এনে ধরলে মুখ ফিরিয়ে নেয় । এখনো থামবার কোন লক্ষণ নেই । মালা তাড়াতাড়ি কাঁথাশুদ্ধু কোলে তুলে নিয়েছিল সমুকে । তার গায়ে মুখ ঘষছে ছেলেটা । পরিচিত গন্ধটা টেনে নিচ্ছে বুক ভরে । কান্নাটা থামতে কোলে করেই দুধ বানিয়ে নিয়ে বোতলে করে মুখে ধরল । নিপলে মুখ লাগিয়ে টানতে টানতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল সমু । তাকে ফের দোলনায় শুইয়ে দিয়ে ভেজা কাঁথাগুলো নিয়ে বার হয়ে যেতে যেতে মালা শুনেছিল, অনামিকা তাকে শুনিয়ে শুনিয়েই বলছে, মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি ! আর এ ছেলেও বংশের ধারা পেয়েছে ষোলর ওপর আঠেরো আনা । নিজের মায়ের খোঁজ করে না, ওদিকে আয়ার জন্য কেঁদে ভাসানো । যতসব আদিখ্যেতা .... কাঁথাগুলো কাচতে কাচতে সেই প্রথমবার ডিউটিটা ছেড়ে দেবার কথা ভেবেছিল মালা । কিন্তু, বাচ্চাটার মুখ চেয়েই ছাড়তে পারেনি । বাড়িও ফিরতে পারেনি সেদিন রাতে । তারপর থেকে মাসের মধ্যে বিশপঁচিশ দিন এ বাড়িতেই রাত কাটাতে হয়েছে তাকে । এবারেও, রামদেবপুরে যাবেনা বলে দিয়েও শেষপর্যন্ত পারল না সে । সেদিন আর রাতে ডিউটি করেনি মালা । সন্ধের পর সেন্টারে ফিরে গিয়ে মাসিমাকে বলেওছিলো নতুন কাজ ধরে দেবার জন্য । কিন্তু রাতে বাড়িতে বিছানায় শুয়ে হঠাৎ বুকের ভেতরটা কেমন যেন ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল তার । বিদেশ বিভুঁই জায়গা । বৌদি একা ও ছেলেকে সামলাতে পারবে না । একটুতেই যা রেগে ওঠে ! সমুর কষ্ট হবে । আর, তার নিজের ! অন্ধকারের মধ্যেই গলার কাছে একটা দলা উঠে এসেছিল মালার । মা শুয়ে আছে পাশে । পাতলা ঘুম । আঁচলের কোণটা মুখের ভেতর পুরে দিয়ে শক্ত করে বালিশের ভেতর মাথা গুঁজে হাপুশ হয়ে কেঁদেছিল অনেকক্ষণ । ওরই মধ্যে কখন যে ঘুম এসেছে টের পায়নি । পরদিন সকালে ডিউটিতে গিয়ে সমুকে কোলে তুলে নিয়ে বলেছিল, আমার টিকিটও কাটতে বলে দেন বৌদি । একে ছেড়ে....
- দেখো বাপু । দূর দেশে যাচ্ছো বলে প্যাঁচে ফেলে বেশি টাকা চাইলে, তেমন কিছু মতলব নেই তো ? তেমন হলে পরিষ্কার করে বলে নাও । পোষালে রাখব, নয়তো অন্য লোক দেখে নেব । তাছাড়া, তোমার বাবা মা'র দেখাশোনার কী হবে ?
- না গো বৌদি । সেন্টারের তো বাঁধা রেট । ও আমি কমবেশি করবই বা কি করে, আর করলেও তুমিই বা দেবে কেন ? তাছাড়া, যাচ্ছি তো মোটে বারোঘন্টার পথ । বাড়িতে কোন দরকার পড়লে টুক করে এসে ঘুরে গেলেই হল । বেশি দূর হলে তো আর পারতাম না !
খুশি হয়েছিল অনামিকা । চেনা হাত । নতুন জায়গায় গিয়ে নিশ্চিন্ত থাকা যাবে । নইলে আবার আনকোরা আয়া নিয়ে অচেনা জায়গায় যাওয়া, তাকে বেসিক হাইজিন চেনানো, বাচ্চার ধাত বোঝানো, চোরটোর কি না সেদিকে নজর রাখা, সে'সব বড় ঝকমারির ব্যাপার হত । অবশ্য লোকেরা কেউই সুবিধের নয় । অন্য জায়গায় গেলে থাকা খাওয়ার একটি পয়সা খরচ নেই । মাইনের পুরোটাই থোক জমবে । নইলে ক'টা টাকার জন্য বুড়ো বাপ মাকে ছেড়ে এক কথায় রওনা দিতে পারলি তুই ? যাক গে ! এখন ভালোয় ভালোয় অনামিকার দিন পার হওয়া নিয়ে কথা ।
মালাও বেশ আছে এখানে এসে । দিনরাত ছেলে নিয়েই থাকে । কোয়ার্টারের উঠোনে বিরাট একটা জারুল গাছ আছে । প্রথম প্রথম এসে দিলীপ তিরকিকে লাগিয়ে তার ডাল থেকে একটা দোলনা ঝুলিয়ে নিয়েছিল । ছেলেকে তার মধ্যে ঘুম পাড়িয়ে রেখে হাতের কাজ সারত । মশামাছির ভয় নেই এখানে । শুধু, মাঝে মাঝে একটু দোলা দিয়ে গেলেই হল । ছেলে খানিক বড় হতে সে সুখটা গেছে মালার । বড় দুরন্ত হয়েছে সমু । সবে এক পা দু পা হাঁটতে শিখেছে । টলোমলো পায়ে সারাটা দিন দৌড়ে বেড়ায় । বাইরেও বেরিয়ে যায় একেকদিন । তাকে সামলাতে মালার গায়েগতরে ব্যথা হবার জোগাড় ।
ছেলে নিয়ে অসুস্থ শরীরে ফেরবার পর অনামিকার যত্নের কোন ত্রুটি রাখেনি হীরেন । বাচ্চার সারাদিনের ঝক্কি সামলাবার জন্য মালা তো আছেই; কাপড় কাচা, জল তোলার মত ভারি কাজগুলোও সে-ই সেরে দেয় । বাকি সব ঘরের কাজে হাতে হাতে সাহায্য করবার জন্য একটা বাচ্চা মেয়েকেও রেখে দিয়েছে । আসবার পরপর কয়েকদিন ছেলেকে নিয়ে একটু সমস্যা হয়েছিল অবশ্য । রাতে ঘুমোতে দেবেনা মোটে । ঘন্টায় ঘন্টায় বিছানা ভেজাবে । ওদিকে আসবার আগে ডাক্তার পই পই করে বলে দিয়েছিল, ঘুমটা অনামিকার এখন দরকার । খাওয়া, হালকা একসারসাইজ আর ঘুম, এ-ই তার ওষুধ তখন । বাড়িতে থাকতে অধিকাংশ দিন রাতের ঝামেলাটা মালাই সামলাতো । খাটের পাশেই মেঝেতে বিছানা করে শুয়ে থাকতো । রাতে দরকার হলে খাটে ঢুকে এসে খাওয়ানো, কাঁথা পাল্টানোর কাজটা সেরে দিয়ে যেত । অনামিকাকে কিছু করতে হত না । মাঝে মাঝে রাতে মালা বাড়ি গেলে মা-ও খানিক খানিক সামলে দিত । এখানে এসে সে সুবিধেটা গেল । শোবার ঘরে এখন আর মালাকে শোয়ানো যায় না । হীরেনও সারাদিন খাটাখাটুনি করে এসে মরার মত ঘুমোয় পাশে শুয়ে । হাজার ডাকেও তার সাড়া মেলেনা । ফলে রাতে ছেলে সামলানোর ঝামেলাটা তার ঘাড়েই এসে পড়েছিলো । অসুস্থ শরীরে মাসের পর মাস মাঝরাতে ঘুম ছেড়ে উঠে ছেলের ভেজা কাঁথা বদলাতে বদলাতে অনামিকার চোখে জল চলে আসতো । সন্তানধারণের জন্য সব শাস্তি তাকে একা কেন পেতে হবে ?
কিছুদিন যাবার পর সমস্যাটার সমাধান করে দিয়েছিল হীরেনই । একদিন সকালে অফিস যাবার সময় জামাকাপড় পরতে পরতে বলে, দেখ অনু, সারাদিন খেটেখুটে এসে যদি সারারাত ছেলের উত্পাত সহ্য করতে হয় তবে আমার কি করে চলে বল তো ?
- উত্পাত তুমি আবার সহ্য করো কোথায় ? তুমি তো দিব্যি নাক ডেকে ঘুমোও । একদিনও চোখ খুলে দেখেছ ? যত উত্পাত তো সেই আমাকেই ....
- তুমি কি চাইছ তবে ? সারাদিন বাইরে গিয়ে রোজগার করেও আনবো, আবার বাড়িতে এসে রাতও জাগব, তাহলে তুমি আছো কি করতে ? সামলাতে তো পার না একটুও । কাল রাতে দুবার আমার লুংগি ভিজিয়েছে ছেলে । আমার এসব উত্পাত পোষাবে না, পরিষ্কার বলে দিচ্ছি । বছরদুয়েক বয়েস তো হল ছেলের । এখনো এত মা আঁকড়া হয়ে থাকবে কেন ? ওকে হয় তুমি মালার সাথে শোয়াবে আজ থেকে, নাহয় আমার আলাদা বিছানা করে দেবে ।
কেঁদেছিল সেদিন অনামিকা । হীরেন অফিস চলে যাবার পর ঘরের দরজা বন্ধ করে হাউ হাউ করে কেঁদেছিল অনেকক্ষণ । বুকের ভেতর একটা হালকা মোচড়ও লেগেছিল ছেলেটাকে রাতে মালার কাছে ছেড়ে দিতে । কিন্তু সেদিন অনেক রাতে চাঁদের আলো ছাড়ানো বিছানায় তার তৃপ্ত, ক্লান্ত মুখটার ওপর হীরেনের নি:শ্বাস মেখে নিতে নিতে তার মনে হয়েছিল, এই ভালো । পাশের ঘর থেকে মালার গলার অস্ফুট গুনগুণানির শব্দ ভেসে আসছিল । ছেলেটা বোধ হয় জেগে উঠেছে, তাকে আবার ঘুম পাড়াচ্ছে থাবড়ে থাবড়ে । প্রিয়তম পুরুষটি পাশে শুয়ে থেকেও কোথায় যেন একটা সূক্ষ্ম খোঁচা লাগছিল অনামিকার বুকের ভেতর । কিন্তু পরমুহূর্তেই হীরেন জেগে উঠে আবার তাকে টেনে নিল গাড়তর আলিঙ্গনে । উদ্দাম আনন্দের জোয়ারে সে রাতে দ্বিতীয়বার ভেসে যেতে যেতে সে শুনেছিল হীরেনের ঠোঁটদুটি তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলছে,
- এবারে বুঝেছো, কেন ছেলেকে ওঘরে পাঠাতে বলেছিলাম ? মাঝখানে ও থাকলে...
- দুষ্টু, স্বার্থপর কোথাকার !
সে রাতে তারপর অনেকক্ষণ জেগে বসে হীরেন আর অনামিকা জানালা দিয়ে বাইরের ফাঁকা মাঠ, আর দুরের ঘাটির গায়ে চাঁদমাখা জঙ্গল দেখেছিল । সকালে ঘুম থেকে উঠে মালা বলল, বৌদি, শুধু তোমরা ছেলের নামে নিন্দে কর । সমু আমার কতো ভালো ছেলে ! রাতে কোলের ভেতরে ঢুকে দিব্যি ঘুমিয়েছে । একবারও জ্বালায়নি তো !
- আমিও কদিন বাদে কাল রাতে আরাম করে ঘুমিয়েছি মালাদি । বাব্বা: ! যে জ্বালান জ্বালায় রাতে ! হেসে হেসে কথাগুলো বললেও বুকের ভেতর একটা খোঁচা লাগছিল । কোন সাহসে ও সমুকে `আমার ছেলে' বলে ? অশিক্ষিত একটা আয়া, ডানলপের বস্তিতে জন্মকর্ম, সে এতটা আস্পর্ধা পায় কিসের জোরে ?
হপ্তাদুয়েক পরে সমুকে ফের একদিন নিজের কাছে এনে শুইয়েছিল অনামিকা । মালাই এসে থাবড়ে থুবড়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিল । তারপর, মাঝরাতে হঠাৎ বুকে একটা সুতীক্ষণ কামড়ের যন্ত্রণা পেয়ে চমকে জেগে উঠে অনামিকা দেখেছিল, তার দুধহীন শুকনো স্তনবৃন্তে সদ্য গজানো গুটিকয় দাঁত দিয়ে সজোরে কামড়ে ধরেছে ছেলে । প্রায় প্রতিবর্ত ক্রিয়াতে, কিছু না ভেবেই এক ধাক্কায় ছেলেকে সরিয়ে দিয়েছিল সে । ধাক্কাটা খেয়ে চোখ খুলে অনামিকার মুখটা একবার দেখেই সমু চিত্কার করে কান্না জুড়ল মা মা বলে । হীরেনের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল । ছেলে তখন চিত্কার করতে করতে নীল হয়ে যাবার জোগাড় হয়েছে । অবাক হয়ে হীরেন জিজ্ঞাসা করল, অনু, হল কী ছেলের ? মায়ের কোলে শুয়ে মা মা বলে কাঁদে কেন ?
বেডল্যাম্পের হালকা আলোয় দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা শাড়িপরা পা দুটো অনামিকার নজর এড়ায়নি । সেইদিকে জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে ধরা গলায় বলেছিল, জানিনা । এ ছেলে আমায় খেতে এসেছে । বড় হয়ে মহা স্বার্থপর আর অকৃতজ্ঞ টাইপের হবে । এতটুকু বয়েস থেকেই তার লক্ষণ ফুটে বেরোচ্ছে ।
সমুর জ্বর এসে গিয়েছিল শেষরাতের দিকে । কাঁদতে কাঁদতে গলা ভেঙে গেছে । তবু ভাঙা গলাতেই ঐ একটিমাত্র শব্দ করে ত্রক্রমাগত কেঁদে যায় । অবশেষে হার মেনে শেষ রাতে মালাকে ডাকতেই হল । মালা এসে মশারির মধ্যে মাথা গলিয়ে ছেলের গায়ে হাত দিয়েই তীব্র চোখে একমুহূর্ত চেয়ে দেখল তার চোখের দিকে । তারপর ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে বলল, নিয়ে যাবো, না এখানেই ফের ঘুম পাড়িয়ে রেখে যাবো বৌদি ? হাত দিয়ে চোখদুটো আড়াল করে রেখেছিল অনামিকা । সেই অবস্থাতেই হাত নেড়ে ইশারা করল, নিয়ে যাও ।
পরদিন দুপুরে ঘুমোলে পরে মালার মুখোমুখি হল সে ... একটা কথা তোমায় জিজ্ঞেস করব মালাদি । সমু বুকে মুখ দিয়ে কামড়াতে শিখল কোথ্থেকে বল তো ? বুকের দুধ তো ও খায়নি কখনো ! মালা মাথা নিচু করে রইল । তার চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ছিল মেঝের ওপর ।
দয়া, অভিমান, দু:খ - কোনটাই নয় । একটা তীব্র অনিশ্চয়তার বোধ এসে চেপে ধরছিল অনামিকাকে । তারপর আস্তে আস্তে তার পাশাপাশি এসে জুড়ে বসল রাগ । সেই দিনটা থেকে একটা শীতল, অথচ হিংস্র, লক্ষ্যহীন রাগ তার বুকের ভেতরে দিনরাত জ্বলত । তুষের আগুনের মতই । বাইরে থেকে তার শিখা চোখে পড়েনা, কিন্তু নি:শব্দে, মৃদু অথচ দীর্ঘস্থায়ী দহনে তা ভেতর থেকে পুড়িয়ে খাক করে দেয় তার শিকারকে । মাঝেমাঝেই কারণে অকারণে তার হলকা এসে পড়ত মালার ওপর, হীরেনের ওপর, কখনও বা শিশুটির ওপরেও । একান্তই নারীসুলভ অন্তর্দৃষ্টিতে মালা সে রাগের উত্সটিকে অনুভব করত ঠিকই, কিন্তু তার কিছু করবার ছিল না । করবার কিছু ছিল না অনামিকারও । পাশাপাশি দুটি গাছ মাটির ওপরে কেমন নীরবে, নির্বিরোধে দাঁড়িয়ে থাকে; অথচ প্রকৃতিরই বিধানে মাটির গভীরে লোকচক্ষুর আড়ালে তাদের শেকড়ে শেকড়ে চলতে থাকে মরণপণ এক অস্তিত্বের লড়াই, আশ্রয়ের মাটিটুকুর বাঁটোয়ারা নিয়ে । সে যুদ্ধে তাদের ইচ্ছে অনিচ্ছের কোন স্থান নেই । তেমনই, শিশুটির ওপরে দেহজ ও স্নেহজ অধিকারের দাবী নিয়ে দুই দাবীদারের মধ্যে একটা নীরব অথচ হিংস্র যুদ্ধের সূচনা হল সেই দিনটি থেকে ।
দিনকয়েক পরে ছেলেকে খাওয়ানো নিয়ে তুমুল একচোট অশান্তি হবার পর, সেদিন রাতে হীরেনের কাছে কথাটা পেড়েছিল অনামিকা । বলে, মালাকে এবারে ছাড়িয়ে দেবো ভাবছি । খরচ কমবে কিছু ।
- খরচের কথা তুমি ভেবো না অনু । দিব্যি তো আছে মেয়েটা ! ছেলের হাজার ঝামেলা মুখ বুজে সামলে দিচ্ছে । এতকিছু তুমি একলা সামলাতে পারবে না ।
- ওই ঝামেলা সামলাতে গিয়ে আমার ছেলেটাকে মেরে ফেললে তোমার বুকটা ঠাণ্ডা হবে তো ?
অপ্রত্যাশিত আক্রমণে হীরেন একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিল । একটুক্ষণ থেমে থেকে এই বিস্ফোরণের কারণ খুঁজতে চেয়েছিল বুঝি মনে মনে । তারপর খানিকটা স্বগত উক্তিই যেন করেছিল.. মেরে ফেলবে ! মানে ?
- যেভাবে ছেলেকে খাওয়ায় ! রোজ বলি, অত ঠেসে ঠেসে খাইও না । ছোট্ট একটা পেট । তাতে দিনে দুতিনবার অত ঠেসে ঠেসে ভাত ঢোকালে....
- তার কথাটা মাঝপথে কেটে দিয়ে হো হো করে হেসে উঠল হীরেন । তারপর নিজের পেশিবহুল হাতটা অনামিকার চোখের সামনে একবার নাড়িয়ে নিয়ে বলল, সে তো আমার মা ও আমাকে ওই একইরকম করেই খাওয়াতো । সেইজন্যেই তো স্বাস্থ্যটা ঠিকঠাক রয়েছে । নইলে, তোমাদের শহরের মেয়েদের মত তন্বী, শ্যামা, শিখরদশনা বেতসলতিকা, ফরাসি বিউটি হয়ে..... হা হা হা.....
সেই উচ্চগ্রামের হাসি আর পেশল হাতদুটির গাঢ় বন্ধনে সেই মুহূর্তটির জন্য তার সমস্ত তিক্ততাকে ডুবিয়ে দিলেও নির্মূল করে দিতে পারেনি । বাকি রাতটুকু ঘুমন্ত হীরেনের পাশে শুয়ে শুয়ে বারংবার হীরেনের ওই একটি বাক্যবন্ধই মনের মধ্যে নাড়াচাড়া করে কাটিয়ে দিয়েছিল সে ..... "আমার মা-ও"! ভেবেচিন্তে, হিসেব করে দেয়া স্টেটমেন্ট নয় । কথার মুখে স্বত:ফুর্তভাবে বার হয়ে আসা একটা বাক্যবন্ধ .. আমার মা-ও!! মাই মাদার ওলসো । আমার মা-ও একইরকম করে খাওয়াতো... তার মানে, যেমন ওর মা খাওয়ায়....... হীরেনের মনের গভীরেও তবে কি সমুর মায়ের জায়গায় ওই ডাইনিটা.....
হীরেন দুশ্চরিত্র নয় । অনুর প্রতি অনুরক্তও বটে । স্বামী ও প্রেমিক হিসেবে তার বিশ্বস্ততা প্রশ্নাতীত । তবু, যদি সেই বিন্দুটিতে কোন প্রশ্ন জাগত, শত বেদনাদায়ক হলেও, সমস্যাটা তার কাছে অপরিচিত ঠেকত না হয়ত । পুরুষের বহুভোগী চরিত্রের সম্বন্ধে মেয়েদেরকে তাদের পারিপার্শ্বিকই সচেতন করে তোলে শৈশব থেকেই । কিন্তু এ সমস্যাটা তার সম্পূর্ণ অপরিচিত । বিয়ের একবছরের মধ্যে আসা যে মাতৃত্বকে খানিকটা অবাঙ্ছিত ঠেকেছিল তার । যে মাতৃত্বের দায়ে আর সমস্ত নাগরিক আনন্দভোগ ও কাজকর্মকে গুটিয়ে এনে চারদেয়ালের মধ্যে তার আটকা পড়া তার বিরুদ্ধে মাঝে মাঝেই একটা অবুঝ রাগও গড়ে উঠত তার । এক কথায় নিজের মনের মধ্যে মাতৃত্বকে এতকাল সে একটা অবাঙ্ছিত সমস্যা বলেই চিহ্নিত করে এসেছে । অথচ আজ যখন অন্যের চোখে তার সেই মায়ের স্থানটির ব্যাপারেই ক্ষীণতম একটা ভাগাভাগির সম্ভাবনা দেখা দিল, তখন, তার শিক্ষা ও নাগরিক জীবনদর্শনের পোশাকটা ছিঁড়ে ফেলে বাইরে এল সেই চিরন্তন জন্তুমাতা .. মাতৃত্বের দাবী যার কাছে প্রথম এবং প্রশ্নাতীত; যে দাবীর রক্ষার্থে যেকোন মূল্যই দিতে সে সর্বদাই প্রস্তুত থাকে ।
তথাপি মালা রয়ে গেল । রক্তের স্বাদ পাওয়া বাঘিনীর মতই সমুকে আঁকড়ে ধরেছিল সে । সামনে ছড়িয়ে থাকা রুক্ষ, করুণ এবং একাকি ভবিষ্যৎ জীবনপথটিতে হয়ত বা একমাত্র ছায়াময় মরুদ্যানটির মরিচীকা দেখেছিল সে সমুর মধ্যে । শিশুর যত্ন, তাকে নাওয়ানো-খাওয়ানো-ঘুম পাড়ানোর যে প্রাত্যহিক কর্মচক্র, যাতে নাকি অনামিকার প্রবল অনিহা, সেই কাজগুলির মধ্যে দিয়ে নিজের অবচেতনেই শিশুশরীরটির কোমল ও সুগন্ধময় ঘনিষ্টতাকে উপভোগ করত সে .... নিজেকে তার মায়ের স্থানে বসিয়ে । আর, মাতৃত্বের সেই চেতনাই তাকে দিয়েছিল সেই বিশেষ অনুভবক্ষমতা, যার শক্তিতে সে টের পাচ্ছিল আসন্ন বিচ্ছেদের আভাসটিকে । তার প্রতিটি কাজে অনামিকার ত্রক্রমাগত খুঁত ধরে চলা, আড়াল আবডাল থেকে শোনা অনামিকা হীরেনের কথোপকথনের খণ্ড-- এইসব থেকে তার মনে এই আশঙ্কাটি গড়ে উঠছিল যে এ বাড়িতে তার কাজের আয়ু হয়তো বা শেষ হয়ে আসছে দ্রুত । অতএব তাকে আত্মরক্ষার কথা ভাবতেই হল ।
ছেলের হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে সেদিন লালবাড়িতে এসেছিল অনামিকা । তিন নম্বরের সুতপাদির কোয়ার্টারে । সুতপাদির বয়স হয়েছে । ছেলেপিলে সব বাইরে বাইরে পড়াশোনা করে । একথা সেকথা হতে হতে উনি হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলেন হ্যাঁরে, মালাকে কি তুই ছাড়িয়ে দিবি ঠিক করেছিস ?
অনামিকা সচকিত হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করেছিল, কে বলেছে দিদি ?
- না, মালা নিজেই সেদিন বলছিল । ছেলে নিয়ে বিকেলের দিকে এদিকে এসেছিল হাঁটতে হাঁটতে । বলে, ছেলে তো বড়োই হয়ে গেল; বৌদি বোধ হয় এবারে আর আমায় রাখবে না ।
- ছাড়লে তো বাঁচি দিদি । কাজেকর্মে ভয়ানক ঢিলে দিয়েছে আজকাল । তার ওপর, ছেলেকেও এখন আর তত চব্বিশ ঘন্টা কোলেকাঁখে করবার দরকার হয় না । আয়া রেখে শুধু শুধু একগাদা টাকা নষ্ট ।
- তা অবশ্য ঠিক । সে টাকাটায় ছেলের জন্য একটা রেকারিং করে দিলে ভবিষ্যতে কাজে লাগবে । তবে, আমি ভাবছি একটা কাজ করব .. তুই ছাড়িয়ে দিস যদি, তাহলে মালাকে বরং আমি আমার কাছেই রেখে দেব । বুড়োবুড়ি দুজনে থাকি ! একটা বিশ্বস্ত কেউ থাকলে সুবিধেই হবে ।
- সে বোধ হয় থাকবে না দিদি । ও আসলে কলকাতায় একটা আয়া সেন্টারে কাজ করে । তারাই ওকে পাঠিয়েছে । সেখানেই ফিরে গিয়ে নতুন কাজ নিতে হবে ওকে । তার ওপরে, বুড়ো বাপ মা রয়েছে কলকাতায় । তাদের ছেড়ে ...
সুতপাদি হাসল .. আমার কাছে কাজটা ও নিজেই চেয়েছে রে । বলে বৌদি ছাড়িয়ে দেয় যদি, আপনি আমায় রাখবেন ? কেন জানিনা, ও কলকাতায় ফিরতে চাইছে না মোটে । এই জায়গাটার ওপর মায়া পড়ে গেছে বোধ হয় । ওর সেন্টারের ফোন নম্বর দিয়ে গেল । প্রয়োজনে যাতে কথা বলে নিতে পারি । বাপ মায়ের দেখভালেরও কীসব নাকি ব্যবস্থা করেছে ।
অনামিকার কানদুটো ঝাঁ ঝাঁ করছিল । বলল, এত দূর গড়িয়েছে ব্যাপারটা, অথচ আমি তার একটা বর্ণও...
সুতপাদি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, না না অনামিকা, তুই অন্য কিছু ভাবিস না । আমায় এসে ও নিজে থেকে বলল, তাই ভাবলাম একবার তোকে সবকিছু বলে সত্যিমিথ্যেটা একবার যাচাই করে নিই । তবে, তুই নিজে থেকে না ছাড়ালে আমি কোনমতেই....
ফেরবার পথে একটা ভয়ানক আতঙ্ক ছেয়ে ফেলছিল অনামিকাকে । ডাইনি..... সাক্ষাৎ ডাইনি ! ঠিক টের পেয়ে গেছে, ওকে এবার তাড়ানো হবে; ছেলে এবার ওর খপ্পর থেকে যেতে বসেছে । তাই এমন ব্যবস্থা করে রেখেছে যাতে তাড়ালেও ছেলের কাছছাড়া হতে না হয় । পথেঘাটে, লোকের বাড়িতে ওঁৎ পেতে বসে থাকবে সুযোগের অপেক্ষায় । আর ফাঁক পেলেই.....
- কী করবে অনামিকা এবারে ? বাড়ি ফিরেই একবার কলকাতায় মা'কে টেলিফোন করতে গিয়েছিল । কিন্তু ডায়াল করেও ফোনটা ফের রেখে দিয়েছে । এসব কথা কাউকে বলে লাভ নেই । কেউ বুঝবে না ! মা-ও নয় । বলবে, বাতিক । বলবে অত ভাল কাজের লোক, শুধুমুদু তাকে.......
সারাটা বিকেল-সন্ধে একা একাই ছটফট করে, অবশেষে একরকম নিরুপায় হয়েই সেদিন রাতে হীরেনকে চেপে ধরেছিল সে । বলে, এবারে আমাদের ট্রান্সফারের বন্দোবস্ত কর । আমার আর এই জঙ্গলে মন টিঁকছে না গো । - কলকাতার জন্য মন কেমন করছে ? এত তাড়াতাড়ি হোম পোস্টিং পাবো না কিন্তু ...
- না না ! কলকাতা নয়, কলকাতা নয়.... চমকে উঠে বলেছিল অনামিকা.. অন্য কোন শহরে.... ম্যাড্রাস, হায়দরাবাদ, আমেদাবাদ--- যেখানে হোক রাজি আছি.....
- তোমার হল কী অনু ? ক'দিন আগে অব্দিও তো মাঝেমাঝে বলতে রামদেবপুরে একটা জমিটমি কিনে ফেলতে ! নাকি সারা জীবন এখানেই কাটাতে চাও ! হঠাৎ মত বদলে গেল কী করে ? আর ছেড়ে যদি যাবার ইচ্ছেই হয়, তবে কলকাতায় হঠাৎ করে অরুচি কেন ?
কী ব্যাখ্যা দেবে সে ? সত্যি কথাটা বলে দেবে ? বলে দেবে, একটা আয়ার ভয়ে সে ছেলে নিয়ে পালাতে চাইছে নিজের প্রিয় জায়গাটাকে ছেড়ে !! কী বলে নালিশ করবে মালার নামে ? সমুকে মালা বড় ভালোবাসে এই বলে ? অথবা বলবে কি, সমু তার চেয়ে মালাকে বেশি চায় ! মালার কোল থেকে তার কোলে আনতে গেলে দেহ শক্ত করে প্রতিবাদ জানায় আজকাল । এমনকি, মুখে খাদ্যের গ্রাস তুলে দেবার অধিকারটুকুও অনামিকাকে দেয়নি সে । মালা ছাড়া আর কারো হাতে খায়না, ঘুমোয় না । এমনিভাবে প্রতিটি মুহূর্তে, একান্তই শিশুসুলভ অকপটতায় অনামিকার মাতৃত্বের দাবিকে অস্বীকার করে চলেছে সে ! ছি ছি-- লজ্জার মাথা খেয়ে সে কথা কেমন করে বলবে সে ! আর বলেও যদি, পুরুষটি বুঝবে না । আত্মাকে রক্তাক্ত করা মাতৃত্বের যে দ্বৈরথে সে এই মুহূর্তে ত্রক্রমাগত হেরেই চলেছে, মায়ের মন দিয়ে অনুভব করা ছাড়া তার অস্তিত্বের আর কোন প্রমানই নেই যে তার হাতে ! ক্যালিপার্স আর স্লাইড রুলে অভ্যস্ত মানুষটার কাছে সেই অধরা প্রমানের দাম তো এক কানাকড়িও হবে না ! উল্টে, হেসে উড়িয়ে দেবে তার সমস্ত আশঙ্কা, সমস্ত অভিযোগ......
...... অতএব, আর কোন পথ না পেয়ে, নিজের দাবির ভাষাটিকে নিতান্তই শারীরিক করে তুলেছিল অনামিকা । হীরেনের হাতের আঙুলগুলো নিয়ে খেলা করতে করতে ত্রক্রমশ আরও ঘনিষ্ট হয়ে এসেছিল তার বুকের কাছে । তারপর হাতদুটি তার গলায় জড়িয়ে নিয়ে মুখের কাছে মুখ এনে গাঢ় গলায় বলেছিল, হ্যাঁ । মত বদলে গেল । তাতে কী হয়েছে ? তুমি আমাকে অন্য কোন দূরের শহরে নিয়ে যাবে কি না তাই বলো । কোন কারণ নেই । আমার ইচ্ছে হয়েছে, তাই .........
কাজেই হীরেন ট্রান্সফারের চেষ্টা দেখল । ব্যাপারটা খুব সহজ ছিল না । এই ছোট জায়গাগুলোতে সহজে রিপ্লেসমেন্ট মেলেনা । অ্যাপ্লিকেশন দিয়ে অপেক্ষা করতে হল প্রায় ছমাস । তারপর খবর পাওয়া গেল, নাগপুরে ট্রান্সফার হয়েছে তার । অ্যাপ্লিকেশনে অবশ্য সেটা তার তিন নম্বর পছন্দ ছিল । তবে তাতে অখুশি হবার কোন কারণ ছিল না হীরেনের । শহরটা ভালো । তার ওপর, নাগপুরে তার এক পিসির শ্বশুরবাড়িও বটে । বিদেশ বিভুঁয়ে কাছাকাছি একজন আত্মীয় থাকা মন্দ নয় ।
চিঠি পাবার দিনসাতেকের মাথায় রিলিজ নিয়ে হীরেন একাই নাগপুরে গেল । রামদেবপুরের কোয়ার্টার মাসখানেক মতো রিটেইন করা যাবে । তদ্দিনের মধ্যে ওদিকে কোয়ার্টার টোয়ার্টার ঠিক করে নিয়ে হীরেন এসে অনামিকাদের নিয়ে যাবে ।
মাত্রই তিরিশটি দিনের মধ্যে গোটা একটা সংসারকে গুটিয়ে বাক্সে বন্দি করে ফেলা সহজ কথা নয় । অসংখ্য ছোটবড় খুঁটিনাটি ব্যাপার থাকে; কত হারানো জিনিস খুঁজে পাওয়া, কত প্রিয় অথচ ক্কচিৎ ব্যবহৃত উপকরণকে গুছোতে গিয়ে হঠাৎ করেই ভাঙা দেখতে পাওয়া, অতিব্যবহারজীর্ণ কোন প্রিয় সাংসারিক বস্তুকে বড় কষ্টে ত্যাগ করে যাওয়া, ওখানে গিয়ে নতুন একটা কিনে নেয়া যাবে- এই ভেবে--- এই সমস্ত অজস্র কর্মব্যস্ততার মধ্যে শিশুটির জন্য অনামিকার সময় ছিল না মোটেই । সমুর তরফে অবশ্য তার চাহিদাও বিশেষ ছিল না । কোয়ার্টারের সামনে সেই বিরাট জারুলগাছটার তলায় কাঠ আর পাথরের টুকরো দিয়ে তৈরি হয়েছে তার খেলাঘর । বিশু আর দীননাথ জমাদারকে ধরে ওদের দিয়ে ওটা বানিয়ে নিয়েছে মালা । সেখানে বসে বসে কখনো বাবার মতো অফিস যাওয়া কিংবা কখনো বা মা সেজে বদলির গোছগাছে ব্যস্ত থাকে সে । এইরকম নিবিষ্ট খেলার অবসরে, অথবা যখন সে ঘুমিয়ে থাকে, সেই সময়গুলোয় অনামিকা মালাকে ডেকে নিতো তার গোছগাছের কাজে । তেমনই একটি মুহূর্তে একদিন সে কথাটা পাড়ল ।
- এবারে তুমি কী করবে মালা ?
মালা একটা কার্টনে একগোছা বই থাকথাক করে সাজাচ্ছিল । মুখ না তুলেই বলল, করব আর কী ? ছেলে ছেড়ে আর কোথাও যাবার জায়গা আছে আমার ? চোখের আড়াল হলেই তো পাড়া মাথায় করে তোলে । যেখানেই যাবেন, সঙ্গে তো যেতেই হবে !
.... অবশেষে .... ! এই মুহূর্তটির জন্য এতদিন ধরে অপেক্ষা করেছে অনামিকা । গত কয়েক মাস ধরে কত অসহায় মুহূর্তে, অন্ধকারের আড়ালে, ভেজা গাল বালিশে ঠেকিয়ে, ছেলের অনিচ্ছুক শরীরটিকে নিজের কাছে টানবার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে সে এই মুহূর্তটারই স্বপ্ন দেখেছে; এইবারে..
মাথা নেড়ে সে বলল না । তোমাকে আর লাগবে না মালা ।
একবার কেমন শিউরে উঠে সোজা হয়ে বসল মালা । বলল, কিন্তু সমু !? ওর যে ..
- কষ্ট হবে ভাবছো ? সে তো পোষা কুকুর বেড়ালটা চলে গেলেও একটু মনে লাগে । ও কিছু না । দু একদিনে ভুলেও যাবে । দরকারে নতুন জায়গায় গিয়ে নতুন লোক রেখে নেবো'খন ।
- সমু আমার বড় একগুঁয়ে বৌদি । আর যা বায়নাবাজ ছেলে হয়েছে ! নতুন লোকের সাথে বনাবনি না হলে সামলানো দায় হবে শেষে ।
অনামিকা কঠিন হল .. সে আমার ছেলে, আমি বুঝব । তুমি বরং পরের ছেলের কথা ছেড়ে নিজের বুড়ো বাপ মা'র কথা ভাব । কলকাতায় ফিরে গিয়ে বরং ওঁদের দেখাশোনা কর একটু ।
- আপনি .. আমায় ছাড়িয়ে দেবেন ? আমায় কিছু না বলে-
অনামিকা এবার একটু কঠিন হল .. এ নিয়ে আর কোন কথা নয় মালা । তোমাকে রাখবো না ছাড়ব সে ব্যাপারে তোমার সঙ্গে কথা বলার কোন দরকার তো আমার নেই ! কথা যা বলবার সে তোমার মালিক সেন্টারের মাসীমার সঙ্গেই আমার হয়ে গেছে । উনি তোমার জন্য অন্য কাজও ধরে রেখেছেন কলকাতায় ।
- কথা.... হয়ে গেছে ! ও ! মালা মাথা নিচু করে বসে বইগুলো আবার সাজাতে শুরু করল । অনামিকা বেতের চেয়ারটাতে বসে ওকে নি:শব্দে দেখে যাচ্ছিল । মাথা নিচু করে কাজ করে যাচ্ছে মালা ! কাঁধের কাছদুটো কাঁপছে না একটু একটু ? কাঁদছে । নাটুকেপনা দেখানো হচ্ছে । ছি ছি, কি ঘেন্নার কথা ! নিজের বিয়োবার মুরোদ নেই, পরের ছেলের মা সাজবার শখ ! নির্লজ্জ বেহায়া মেয়েমানুষ কোথাকার ।
নি:শব্দে খানিকক্ষণ তার কান্নাটাকে উপভোগ করে নিয়ে অনামিকা বলল, কবে যাবে বলে দিও । তোমার টিকিট করে দেবো ।
হঠাৎ হাতের কাজ বন্ধ করে এদিকে ঘুরে তাকালো মালা । ভেজা কিন্তু শান্ত, সলজ্জ চোখদুটি তার দিকে তুলে ধরে বলল, সে আপনি চিন্তা করবেন না বৌদি । আমার ব্যবস্থা আমি নিজেই করে নেবো ঠিক ।
- হ্যাঁ মাসীমা । কী করে চিনলেন ?
- ও বাবা । তোমার গল্প এত শুনি সমুর কাছে দুবেলা ! শুনে শুনেই চেনা হয়ে গেছে । রাস্তায় দেখলেও বোধ হয় ঠিক চিনে ফেলতাম ।
- সমুটা তো ওইরকমই পাগলা ।
ভারি মিষ্টি ছেলেটা । কালোকোলো একহারা গড়ন । নাক চোখ খুব ধারালো নয় । এ অঞ্চলের আদিবাসী অবয়বের পরিষ্কার পরিচয় ওর চেহারায় ।
- তুমি তো ভারি চমত্কার বাংলা বলো বাবা ! শিখলে কোথায় ?
কৃষ্ণ হাসল .. আমার মা তো বাঙালি ! কলকাতার মেয়ে ।
- এইখানে বিয়ে হয়েছিল বুঝি ? তোমার বাবা..
- আমার মা বিয়ে করেন নি তো মাসীমা । আমি অ্যাডপ্টেড চাইল্ড ।
ও । তুমি তবে একেবারে এখানকারই ছেলে ! মা কি এখানে চাকরি করেন ?
- না মাসীমা । এইটটি নাইনে আমার মা কলাকাতা থেকে এখানে এসেছিলেন এক বাড়ির ছোট বাচ্চার সঙ্গে আয়া হয়ে । ওই যে, লুহারির দিকে কোয়ার্টারগুলো আছে না ? ওইখানে । তারপর তাঁর ট্রান্সফার হয়ে চলে যাবার পর এখানেই থেকে গেলেন । জায়গাটা নাকি ভীষণ ভালো লেগে গিয়েছিল । সেন্ট মেরি'জ অরফ্যানেজ থেকে আমায় দত্তক নিয়েছিলেন তিন বছর বয়সে । তারপর থেকে মা'র কাছেই মানুষ ।
অনামিকা সচকিত হয়ে একবার চেয়ে দেখলেন ছেলেটার দিকে । দত্তক নেয়া ছেলে । চেহারায় মিল থাকতে পারে না । কিন্তু বাচনভঙ্গীটিতে কোথায় যেন সেই পুরোনো চেনা ভাবটা.. !!
- তোমার মা'র নাম কী বাবা ?
- শ্রীমতী মালা দত্ত ।
এখানকার দুপুরগুলো ভারী মায়াবী । পাথুরে পৃথিবীর বুক ছুঁয়ে ছিটকে ওঠা উত্তপ্ত থার্মালের মাথায় ডানা ছড়িয়ে অলস শয়ানে ভেসে থাকে চিল । নীল আকাশ, লাল মাটি আর উজ্জ্বল সবুজ.. এই তিন প্রাইমারি রঙয়ের সুতীব্র বর্ণবিন্যাস বুকে এসে ধাক্কা মারে । ফাল্গুনের শেষ । মহুয়া ফুলের মাদক গন্ধ থমকে রয়েছে প্রবাহবিহীন উত্তপ্ত হাওয়ায় ।
ঠিকানাটা একটুকরো কাগজে লিখে এনেছিল অনামিকা । জগদিশনগর বাজারের মুখটাতে নেমে মিনিটদশেক হাঁটতে হয় । ছাতা আছে, তবু রোদের তাত লেগে চোখদুটো জ্বালা করছিল অনামিকার । রিকশা পেলে হত একটা । আজকাল আর আগের মত অত হাঁটতে পারেনা ।
একতলা ছোট্ট বাড়িটা । চুনকাম করা নিরাভরণ দুটি ঘর । সামনে একচিলতে বারান্দা । লাগোয়া জমিতে বেশ কিছু গাছপালা, ঝোপঝাড়; তাদের গায়ে যত্নের ছাপ রয়েছে । দূর থেকেই দেখা যাচ্ছিল, বারান্দায় একটা চেয়ার পেতে একলা নিঝুম বসে রয়েছে মালা । মুখটা অন্যদিকে ফেরানো । তাকে দেখতে পায়নি । মেহেন্দির বেড়ার গায়ে কাঠের ছোট্ট গেটটা খুলে অনামিকা উঠোনের মধ্যে ঢুকে পড়ল ।
মালার চোখে কোন বিস্ময়ের ছাপ ছিল না । চশমাটা পরে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আসুন বৌদি । সমুকে সেদিন দেখে ইস্তক ভাবছি একদিন গিয়ে দেখা করে আসব । কোমরে একটা ব্যথা হচ্ছে ক'দিন ধরে । ভেবেছিলাম সেটা একটু কমলে একদিন কৃষ্ণকে বলব সাথে করে নিয়ে যেতে । তা আপনিই আগে এসে গেলেন ।
চা খাওয়া শেষ হতে হাতে করে একটা পান এনে দিল মালা । বলল, দেখুন তো ঠিক সেজেছি কি না ?
পানটা মুখে দিয়ে অনামিকা বলে, জর্দা দাওনি ?
- উঁহু । আগেকার মতই তো বানিয়েছিলাম ! খয়ের জর্দা বাদ ।
- আজকাল একটু একটু জর্দা খাচ্ছি । সুরভি হবে ?
- উঁহু । ওতে অনেক খরচ । লোকাল কাটা তামাকের জর্দা আছে । গন্ধটন্ধ নেই, তবে বেশ ঝাঁজালো । দেব একটু ?
- ঠিক আছে, তাই দাও ।
খুলে ধরা কৌটো থেকে এক চিমটি জর্দা তুলে নিয়ে মুখে ফেলল অনামিকা ।
- অভ্যেসটা একটু বদলেছে তবে বৌদি !
- অনামিকা হাসল । হ্যাঁ । সময়ে কী না হয় ? গোটা মানুষটাই বদলে যায় !
- তা ঠিক । আমাকেই দেখুন না । এখানে এখন আমায় মালা নামে কেউ চেনেই না । ছিলাম বেলঘরিয়ার মালা দত্ত, আর এখন এই জগদীশনগরে গোটা মহল্লায় আমায় সবাই কিষাণ কি মা বলেই চেনে । ওই এখন আমার নাম, ধাম, পরিচয়, সবকিছু ।
- ভারি ভালো ছেলে হয়েছে তোমার মালা । লেখায় পড়ায় চলনে বলনে সব দিকেই সেরা ।
- সে কথা বললে আমাদের সমুই বা কম কিসে বৌদি ? যখন তখন আসবে, ঐ চৌকিতে এসে বসবে, মাসি মাসি বলে ডাকবে, যেন কতকালের চেনা ! ভারী ভাব দুটিতে । কৃষ্ণ বলরাম দুই ভাই যেন ।
নিঝুম দুপুরকে সাক্ষী রেখে দুই প্রৌঢ়া মুখোমুখি বসে থাকে ছোট্ট একফালি বারান্দায় । নিরুচ্চার সংলাপে দুটি আত্মা একে অন্যকে নিজের নিজের আনন্দ বেদনার খবর জানায় । একদা একজনের আত্মজকে কেন্দ্র করে দুটি নারীতে যে তীক্ষণ দ্বন্দ্বের সূচনা হয়েছিল, সময়ের ধুলো আজ তার স্মৃতি থেকে মুছে দিয়ে গেছে তার তীব্রতার স্বাদ । আত্মজ ফিরে গেছে আপন মায়ের কাছে । আর এক অজানা মায়ের পরিত্যক্ত সন্তান এসে পূরণ করে দিয়ে গেছে অন্যজনের হৃদয়ের শূন্যস্থান । নির্জন আকাশে ভাসমান চিলগুলিকে অতিক্রম করে সূর্য তার পশ্চিমমুখী অস্তপথে ত্রক্রমাগত এগিয়ে চলে । আর, তাদের সকল আকাঙ্খার ফসলদুটি তখন এ যুগের এক বিদ্যায়তনে পাশাপাশি বসে একই সঙ্গে একই জীবনের পাঠ নেয় । জীবন বহে চলে অতীতকে অতিক্রম করে বর্তমানকে ছুঁয়ে অনির্দেশ্য ভবিষ্যতের দিকে ।
(পরবাস-৪৩, জুন, ২০০৯)