কালো ঘোমটায় মুখ ঢাকা, আস্তে আস্তে, এসে কাঠের দরজায় টুকটুক করে আওয়াজ করবে, দ্বিজু দরজা খুলে দেওয়া মাত্র তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে প্রথমেই বলবে, `হে-ই ছেলেটা, টুইক্চা জল দ্যে দিক্যি' তার পরে পা ছড়িয়ে বসে পরে বলবে, `আহ্ বাইচ্লাম ।'
বড়ো একটা নিশ্বাস নেয় দ্বিজু, তারপরেই আরম্ভ হবে.....,
নির্যাতনের কি কোন নাম হয় ? যন্ত্রণার কোন রঙ হয় ?
যদি হতো, তাহলে তারপরেই বাইরের কালো অন্ধকারের মতোই ডুবে যাবে দ্বিজুর ছোট্ট কুটির । শুষনিয়া পাহাড়ের গায়ে একখানি ছোট্ট ঠিকানা; দ্বিজু-বাউরির কুমোর-শালা, গ্রাম-গোবরডাঙ্গা, জেলা-বাঁকুড়া, প্রদেশ-পশ্চিমবঙ্গ ।
গ্রামের অধিকাংশ পুরুষমানুষ একবেলা মাঠে আর আরেক বেলা কুমোরশালায় মাটির পুতুল গড়ে । মহিলা-সম্প্রদায় সন্তান-সন্ততি মানুষ করে, পুরুষদের জন্য রান্নাবান্না করে, আর পুতুল গড়াতে সাহায্য করে । গোবরডাঙ্গা গ্রামের নিকটবর্তী বড়ো শহর মুকুটমনিপুর । কিন্তু গ্রামবাসির সেখানে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না । উল্টে বড়ো শহরের বড়ো বড়ো বাবুরাই হাটে এসে, মাটির পুতুল `কিইনে লিয়ে যাইন'; গ্রামবাসিদের তরফ থেকে মাসান্তে একবার বড়ো হাটে গিয়ে বিক্রি করে আসলেই হলো । চাষ-বাস যা হয় তাতে ছোট্ট গ্রামটার বিলাসিতা বর্জিত আধিক্যহীন জীবন চলে যায় । পৃথিবীর মানচিত্রে গোবরডাঙ্গা একটা ফুটকি হিসেবেও গণ্য হয় না, তাই এইখানে দ্বিজু বাউরি ওরফে দ্বিজু-পাগলার কুমোরশালায় আর তার ছোট্ট কুঁড়েঘরে গত পাঁচ বছর ধরে অবিরত কি নাটক হয়ে চলেছে তা জানার কোন অবকাশ, বৃহত্তর জগতের হয়নি ।
দ্বিজুর জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে গ্রামে বেশ কিছু গুঞ্জন চালু আছে ।
বৃষ্টি বাদলার মাস নয়, বাঁক্ড়োর অন্য অনেক হেমন্তের মতো, শুকনো খটখটে দিনের আকাশে কোনো কোনায় একফোঁটা মেঘের চিহ্নও ছিল না । সেই কাকভোর সকাল থেকে ঘরে-ক্ষেতে কাজ করে দ্বিজুর পোয়াতি মা, মায়া বাউরি বিকেলের পড়ন্ত আলোয় ঘরে ফেরার বেলায় ক্লান্ত স্বরে নন্দ-বাগচির ঘরনি তারা বাগচিকে বলেছিল, `পেটের শত্তুরটা বড় জ্বালায় লো !, দিবা রাত্র বড়োই লরাচরা কইরে' ।
`পুতুল গরতেছে লো.........., ছেলেট পুতুল গরতেইছে, তর প্যটে আর কুন মাটি লাই, তাই হাকর পাকর কইরতেছে বাইরে আইসবার তরে,' সই তারা বাগচি বলেছিল ।
`আরো তিন-তিনটা মাস লো !, সবুর সইবে তো' মায়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে । `বাপটাও কবে থেকে শহরে, মনটা ভালো ডাইকছে লা সই !'
কথিত আছে, `মায়ের আর মায়ের সখীর কথা শুনতে পেইয়ে ছিল ছেলেটটা, সনঝ্যেইর দিকে যেই না ঘনঘটা করে আকাশ সেজে বইসল, ওমনি বাইর হইবার তরে হাঁচর-পাঁচর করতে শুরু করলো কইচ্যাটা' ।
গোবরডাঙ্গার জীবন মাটি-ভিত্তিক । মাটির সঙ্গে গ্রামবাসীর সম্পর্ক একটা উপলব্ধির বিষয়, এই লাল, কালো মাটি কখনো মা, বন্ধু আবার কখনো সন্তানের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় গ্রামবাসীর জীবনে ।
এই মাটিতে ধান ফলে, আবার এই সরেশ মাটি ছাড়া এখানে এমন কুমোরপাড়া গড়ে উঠে পারতো না । মাটি বলতে গ্রামের বাসিন্দারা জমি বোঝায় না, গোবরডাঙ্গায় একচিলতে জমি অনেকেরই আছে, এই গ্রামে সেটা তেমন কিছু আহামরি ব্যাপার নয় । যাদের আছে তাদের আছে ; যাদের নেই তারা মালিকের সাথে এক সাথে লাঙল দেয়, ঝড়বৃষ্টিতে একসাথে বীজ বপন করে, তারপরে যখন ছোটছোট একফোঁটা চারাগুলো তির-তির করে হাওয়ায় কাঁপা বড়ো হয়, সদ্যজাত শিশুর উপযুক্ত যত্নে সেই চারা একটা একটা করে তুলে নিয়ে বপন করে গ্রামের বাসিন্দা সবাই মিলে ।
ধান পাকা থেকে মাড়াই, সব কিছুই গ্রামের সমস্ত সক্ষম নারী-পুরুষেরা মিলে মিশে একসাথে করে । এই একই কারণে, গোবরডাঙ্গায় কোনদিন কারোর ঘরে তালা চাবির প্রয়োজন হয় না, ঘর তৈরির সময়ে ঘরের আঙ্গিক হিসাবে শিকলের যোগ করা হয় মাত্র । তত্সত্ত্বেও এক অলিখিত আচারে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কেউ অনাহুত কারো ঘরে ঢোকে না ।
আগে বলেছি, মাটির সঙ্গে গ্রামবাসীর সম্পর্ক একটা উপলব্ধির বিষয়, কিন্তু কার্তিক বাউরির ছেলে কুমোর মাটির সেই সম্পর্ককে সম্পূর্ণ এক অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে । এই গ্রামের ইতিহাসে, এই গোটা তল্লাটে, যত দূর সম্ভব অতীতে যাওয়া যায়, গ্রামের বাসিন্দা কুমোর বংশে এই রকম পুতুল গড়ার কাহিনী অসাধারণ ক্ষমতা দেখা যায়নি । দ্বিজু এই গ্রামের পুতুল গড়ার ইতিহাসে এক কিম্বদন্তি কথাটা বললে দ্বিজুর অসাধারণত্ত সম্পর্কে কিছুই বলা হয় না ।
গ্রামের বয়স্ক সম্প্রদায় দ্বিজুকে নিয়ে গর্বিত । ছেলেপিলেরা সহজ পাঠের ছড়া পালটিয়ে অনায়াসে পাঠশালায় দাঁড়িয়ে আবৃত্তি করতে পারে `দ্বিজু কুমোরের গরুর গাড়ি, বোঝাই করা পুতুল সারি', তাতে শিক্ষক মহল কিছু মাত্র আপত্তি করবেন না, বড্ড জোর বলে উঠবেন, `ঠিক করে বল বাপ !, রবি ঠাহুরের কবিতা লিয়ে মস্করা কইরিস না বটেক, অতে পাপ লাগে হে, পাপ লাগে !'
হাটে বাজারে কচুরলতি কিম্বা সদ্য কাটা লাউ এর দরাদরির মাঝে কান পাতলে, এখনো দ্বিজুকে নিয়ে আলোচনা শুনতে পাওয়া যায় । `হাঁই, মোর তো এখনো জ্বলো-জ্যান্ত মইনে আছে ! হায় তখনো আপোনার একগরাস ভাত মুখে দিইতে লার, ন্যাংটো পুটো একছটাক টুইচ্কা ছেলেট, মাটি দিইয়ে একট হাল চালানো বলদ গইড়ে দিইলো ?' `হা গো, আমারও স্মরণে আছে, জগত খুড়া সেটো দেইখে কেইন্দে ফেলেইছিল !'
এইসব আলোচনার মাঝে কেউ বা ফস করে বলে বসবে, `আর আগ্যে থেইক্যে সেটা জানতে পের্যেই বা বুঝি বেহায়া বাপটা, পোয়াতি বউ-ব্যেটাকে ফেলে রেইখ্যে পলাইলো ! হারামজাদা !
`একফোটা টুকরো ছেলেটটাকে মাটা পাখির মতো আইগলে আইগলে মানুষ কইরলে.........., সে মাটাও ফস করে মইরে গেল গো, ব্যেটার বিয়েসাদি তক দিইয়ে যেইতে পাইরলো না !
ক্বØচ্চিত কখনো কেউ কেউ যোগ করে `শুইনেছি নাকি কার্তিক শহরে গিইয়ে আবার একটা নতুন সংসারও ফেঁইদেছে, তার নাম নাকি বিলাসী, মাগির নামের বাহার আছে !'
প্রতিভাশালি ছেলেটার দুর্ভাগ্যপীড়িত শৈশবের কথা তেমন একটা আলোচনা তেমন হয় না এখানে । সত্যি বলতে কি, সে ছেলেটাও তো আর ছোটটি নেই ! দেখতে দেখতে `এককুড়ি পাঁচ-ছয়' বয়স তো হয়েছেই । দুর্ভাগা ছেলেটা সেই কোন ছোটবেলা থেকে একা একা বড়ো হলো, বাপের ভালোবাসার ছিটেফোঁটাও পেলো না, কোনদিন বাইরে কারোর সাথে মিশলো না, ছেলেটাকে এমন ঘরে ঘরেই আগলে রাখলো যে মাটা, সে মরে যাওয়ার পরে ছেলেটা যে বেঁচেবর্তে আছে, গ্রামবাসীরা তাতেই কৃতার্থ ।
সডক ধার থেকে গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তে দ্বিজুর ঘর । টিনের ছাউনি দেওয়া দুটো ঘরের একটিতে দ্বিজুর পুতুল গড়ার সরঞ্জাম, অন্যটিতে একটা ছোট কাঠের আলনা, শোওয়ার চৌকি-বিছানা । ঘর থেকে অনতিদূরে একটা টিউবকল থাকার জন্য দ্বিজুকে জলের জন্যে বেশি দূরে যেতে হয় না । রান্নাঘরে মাটির চুলোতে রান্না আর মাটির পুতুল পুড়িয়ে শক্ত করা দুটোই হয় ।
জ্বালানি আসে ঘর সংলগ্ন বাঁশ-ঝাড়ের কাঠকুটো থেকে, সারা সপ্তাহের সঞ্চয় জোগাড় করতে দ্বিজুর এক-আধবেলা লাগে । রান্নাঘরের মাটির দেওয়ালে সারি সারি নানা আকারের কুলুঙ্গি ; এক মাসের উপযোগী চাল ডাল আর মাটির পুতুল রাখার কাজে আসে ।
দ্বিজু মাসান্তে একবার হাটে যায়, সারা মাসের তৈরি পুতুল বিক্রি করে সমবায়কে তাদের পাওনা টাকা দিয়ে হাট থেকে চাল, ডাল, রঙ, তেল, পুতুল সাজানোর ছোট খাটো টিনের গয়না কিনে আনে । স্বাধীনতার পরেই পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় এই গ্রামের উন্নয়ন প্রকল্পে গ্রামের চারটি কোনে চারটে টিউবকল বসানো ছাড়াও একটা সমবায় সমিতিটি তৈরি হয়েছিল । প্রত্যেকে কুমোর নিজের পুতুল বিক্রীর কিছু টাকা এখানে জমা দেয় । মাস শেষে সেই টাকা দিয়ে রঙ পুতুল বানানোর সরঞ্জাম কেনা হয়, আবার টাকা বেঁচে গেলে সেই টাকা দিয়ে বীজও আসে । দ্বিজুর মা বেঁচে থাকতেই দ্বিজুর অবদান শুরু হয়, এখন তা বাড়তে বাড়তে সবার চাইতে বেশি হয়ে গেছে ।
গ্রামের কচি কাঁচারা দ্বিজুকে বিরক্ত করে না । দ্বিজুর টিনের হাটের চালা থেকে দূরে দূরে খেলা-ধুলো করে । দ্বিজুকাকুর পুতুল বাজারে পড়তে পায় না, ওকে বিরক্ত করলে দিনের শেষে ভাত নাও জুটতে পারে সেটুকু ওরা বোঝে ।
দ্বিজু জানে গ্রামবাসি তার অবদানের জন্যে অপেক্ষা করে থাকে । পালা-পার্বণে যখন ওর কুঁড়ে ঘরের ধারে, চালটা, ধুতি, কিম্বা তরতাজা কলাটা, লাউ-মুলোটা পডে থাকতে দেখে, দ্বিজু খুশি হয় । আর তখনই, দ্বিজুর বুকের ভেতরটা মুচডে ওঠে এক অব্যক্ত বেদনায় । গ্রামের কেউ জানে না, কি দুর্বিসহ জীবনযাপন করছে দ্বিজু বিগত পাঁচ বছর ধরে ।
শীতের বেলা, তখন সদ্য মাতৃ-হারা হয়েছে দ্বিজু । রাতের বেলা মায়ের জন্য বুকের ভিতরটা মাঝে মাঝেই তার হুহু করে ওঠে, ভালো করে ঘুম হয় না । দিনের বেলা নিরবচ্ছিন্ন পুতুল গড়ায় ডুবে না থাকলে দ্বিজু হয়তো বা শোকে মরেই যেত । মায়ের পরনের একটা কাপড় জড়িয়ে কুণ্ডলি করে, তার ওপর মাথা দিয়ে উঠানে বসে, গত কয়েক রাত্রি নিদ্রাহীন ক্লান্তিতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল ।
হঠাৎ একটা ধাক্কা খেয়ে ওর চটকা ভেঙ্গে গিয়েছিল ।
এক মহিলা, তার মায়েরই বয়সি হবে ।
`কে ? হে ই........... কে আপুনি ?
`আরে ই ঢ্যেমনা, দিনির বেলা জেইগে জেইগে স্বপন দেইখে ! তর ছোটলোক ইতর বাপটা আমারে ফেইল্যে চলে গেল, তয় আম্মো এই দ্বারে চইলে এলুম ।'
`না না, এটা তো হতেই পাইরে না, আমো মায়ের এ স্তান আপুনি নিতে লারবেন,' দ্বিজু বলেছিল ।
`তাহলে ট্যাকা দে, চইলে যাই', মহিলা র্নিলজ্জ হেসে বলেছিল ।
সদ্য পুতুল বিক্রির কয়েকটা টাকার নোট দ্বিজুর কোমরের ঘুনসিতে বাঁধা ছিল সেদিন, কিছু না ভেবেই ও তাড়াতাড়ি এগিয়ে দিয়েছিল ।
টাকাগুলো একটা একটা করে গুনে, শাড়ির আঁচলে ভালো করে বেঁধে, এক ঝটকায় আঁচলটাকে কাঁধের ওপর ফেলে মহিলা বলেছিল `তাইলে ফির পরের মাসকে আইসবো ।'
সেই শুরু, প্রথম দুই-চার বছর বিলাসী মাস শেষ করে আসতো, টাকা নিয়ে চলে যেতো । টাকা নিয়ে বিলাসী কি করে তা দ্বিজু কোনদিন জানতেও চায়নি । তাই দ্বিজু জানে না, ছোট্ট মুদিখানার ব্যবসা লাটে তুলে একটা ভাড়া করা বাড়িতে পায়ের ওপর পা তুলে বাকি জীবন কাটিয়ে নিশ্চিন্তে কাটিয়ে দেওয়ার ফন্দি আঁটতে শুরু করেছে বিলাসী । গ্রামে অন্য সবার চাইতে বিলাসীর সাজ পোষাক, বেশি দামের । যেখানে গ্রামের অন্য সবাই ট্যনা পড়ে দিন নির্বাহ করে বিলাসীর পরনে শহুরে চকমকে শাড়ি । জানলে বা দেখলেও হয়তো নির্বিকার দ্বিজুর কিছু এসে যেত না, দ্বিজুর নির্লিপ্ত জীবনে যতক্ষণ না কোন প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে, কিন্তু গত একবছর ধরে সেটাই হতে শুরু করেছে, এবং তাতে দ্বিজু নাজেহাল হয়ে যাচ্ছে । গত এক বছর যাবৎ বিলাসী বেলা শেষে সন্ধের দিকে আসছে এবং এসেই নানা জমাখরচ কৈফিয়েত দাবী করছে দ্বিজুর কাছ থেকে । কটা পুতুল হলো, কি দামে বিক্রি হলো, বাকি টাকা কোথায় ইত্যাদি নানা প্রশ্নে দ্বিজুকে নাস্তানাবুদ করেও বিলাসী ক্ষান্ত হয়নি, তীব্র ভাষার সমালোচনা ও আলসেমি কমানোর উপদেশও দিয়েছে, নিরুপায় দ্বিজু তাও সহ্য করে নিচ্ছিল মুখ বুজে ।
কিন্তু সম্প্রতি দ্বিজুর সহ্যের সীমা পেরিয়ে যাচ্ছে । ইদানিং ওকে আরো পরিশ্রম করানোর জন্য বিলাসী এক অদ্ভুত উপায় আবিষ্কার করেছে । কোনো পুতুল বিলাসীর ভালো লাগলে, আঁচলে জড়িয়ে সেটাকে আত্মসাৎ করে নিচ্ছে, আবার খারাপ লাগলে, উঠোনের শক্ত মাটিতে ছুড়ে ভেঙ্গে দেওয়া শুরু করেছে । তার সাথে যোগ হয়েছে তীর বেঁধানো প্রবল তিরস্কার । `তুর মা মইরছে, ইবার আমি তু-কে মাটিতে গেড়ে দিব, শিয়াল-কুকুরে ছিইড়ে ছিইড়ে খাবে' ।
সারা জীবন একলা মানুষ হওয়া দ্বিজ যে প্রতিবাদ করতে কোনদিন শেখেনি বুদ্ধিমতি বিলাসীর সেটা জানতে বাকি নেই, আর পিতৃ-মাতৃ-বন্ধু-বান্ধবহীন দ্বিজুর পক্ষে এই লজ্জা যে আর কারোর কাছে প্রকাশনীয় নয়, সেটাও ।
দ্বিজু কর গোনে মাস শেষ হতে চলল, পাঁচদিন বাদে হাটবার, তার মানে বিলাসীর আসার সময় হয়ে এসেছে । হাট শেষ হলেই বিলাসী এসে উপস্থিত হবে ।
সদ্য গড়া শিশু-পুতুলটার বন্ধ করা হাতের মুঠোর ওপর মাটি দিয়ে গড়া পাঁচটা আঙ্গুল বসায় দ্বিজু, মাথা সরিয়ে এদিক ওদিক, নানা দিক দিয়ে দেখে........, ভাবে, মানুষের বাচ্ছা হলে শিশুটাকে তিন মাসের বলা যেত ! কাজ প্রায় শেষ, বাকি রইল শুধু তেল রঙ করাটা ।
মুখ তুলে বিকেলের আকাশ দেখে দ্বিজু, মা বেঁচে থাকতে, এই সময়টা তার খুব ভালো লাগতো । সারাদিনের কাজ শেষ করে ওর কাছে এসে বসত মাটা । ছোট্ট একটা কাঠের জলচৌকির উপর বসে ছেলের সেই দিনের সদ্য-বানানো পুতুল দেখে দেখে মায়ের আশ মিটতো না....... `তর হাতে মনে লয় মাটি যেন্ জেইগে ওঠে' দ্বিজুর বুকটা ভারি হয়ে আসে ।
আবার একটা বড়ো নিশ্বাস নিয়ে আস্তে করে পুতুলটা চৌকির পাশে নামাতে গিয়ে দ্বিজু চমকে ওঠে, খুব কাছ থেকে একটা অস্পষ্ট নিশ্বাস আওয়াজ হলো না ? আর একটু হলে নতুন গড়া পুতুলটা হাত থেকে মাটিতে পড়ে যেত । বিলাসী এতো তাড়াতাড়ি আসে না, নিজেকে সামলে নিয়ে দ্বিজু গলা উচু করে তাকায়, আর একবার দেখে নিয়ে নিশিন্ত হয়, নাহ্ সত্মা এখনো আসেনি ! `অ কুনো ব্যাপার লয় !'
নিশ্চিন্ত ভাবটা কাটতে বেশিক্ষণ লাগে না, ও ছাড়া এখানে আর কেউ নেই ! তাহলে আওয়াজটা এলো কোথা থেকে ? সত্মার জ্বালায় এবার বুঝি দ্বিজু সত্যিই পাগল হতে চলল............, গ্রামের লোক পাগলা বলে ডাকে বটে, কিন্তু সে তো আহ্লাদ করে ।
দ্বিজুর গলা শুকনো লাগে, মনটাও ভারী, একটু জল খেলে ভালো লাগবে হয়তো, যে কোন সমস্যায় মা বলতো `একটু জল খা ছিলাট মোরি'.....
পিঠে ছেলে-বাঁধা-কৃষক-রমণী যুগল মূর্তি গ্রামের রাস্তায় চলেছে, শহরের বাবু-বিবিদের খুব পছন্দ, ভালো দামে বিকোয় । দ্বিজুর ইচ্ছা ছিল শিশু-মূর্তি তৈরির সব কাজ আজই সন্ধের আগে শেষ করে ফেলে মায়ের মূর্তি তৈরি শুরু করা । বেশি সন্ধে হয়ে গেলে কাজ করতে মেলা অসুবিধে, লন্ঠন জ্বালো রে, হ্যাঁনা ত্যানা হাজার গেরো ।
এমন সময়ে অস্পষ্ট দীর্ঘশ্বাসের আওয়াজটা আবার হলো । কোন কাজ কি নিয়ম মেনে হওয়ার যো আছে ?
আত্মগ্লানিতে নিমজ্জ দ্বিজু চৌকির পাশে মাটি, তেল রঙ, তুলি ছড়িয়ে রেখে চৌকি থেকে নেমে পড়ে, রান্নাঘরে মাটির কলসিতে খাওয়ার জল আছে । মা বলতো, `জল খেইলে পরে সব ব্যামো সেইরে যায়' ।
কুঁজোর জলটা বেশ শীতল, রান্না ঘরের কুঁজো থেকে ধীরে ধীরে এক গেলাস জল গড়ায় নিজের জন্য । জলটা মুখে দিয়ে বুঝতে পারে পিপাসা ছিল । আরো অনেকটা জল গড়িয়ে খায় । একটা লন্ঠন জ্বালিয়ে বিছানার ধারে রাখে । ছোট একটা কুপি জ্বালিয়ে উঠানে জল-চৌকির ধার থেকে পুতুলটা তুলে নিয়ে বিছানায় এসে বসে, নি:শ্বাসের শব্দটা এবার আরো একটু স্পষ্ট ।
হঠাৎ একটা ঠাণ্ডা কনকনে অনুভূতি দ্বিজুর শিরদাড়া দিয়ে বয়ে যায়, এক অনুপলের জন্য ওর মনে হয়েছে ছোট্ট মাটির পুতুলটার ছোট্ট শরীর থেকেই আওয়াজটা এলো ।
`না: ! আইজকে আর কুনো কাজ হইবেক লাই, মায়ের মূর্তি কাইলই হবে' একটা হতাশা দ্বিজুকে ছেয়ে ফেলে, `তার চাইতে বরম......' শিশু পুতুলটাকে বিছানার পাশে নামিয়ে রেখে কুলুঙ্গী থেকে অসম্পূর্ণ রাধা-কৃষ্ণ নামিয়ে নেয় দ্বিজু । বেশি রাত হওয়ার আগে আরো একটু কাজ করে নিয়ে ক্লান্ত দ্বিজু ঘুমিয়ে পড়ে ।
সড়কধারে লক্ষ্মী পালের উঠে যাওয়া মিষ্টির দোকানের পাশে বড়োসড়ো একটা গাড়ি, প্রায় সকাল থেকে দাঁড়িয়ে আছে সেটা প্রথম লক্ষ করে লক্ষ্মী পালের ছোট ছেলে নাতু । এই অঞ্চলে এটাই একমাত্র সিমেন্টের তৈরি দোকান, কলকাতার কোনও বাবু পয়সা খরচ করে বসিয়েছিল, গ্রামের লোকের অত সৌখিনতা পোশায় না......, দোকান চলেনি, কিন্তু কাঠামোটা রয়ে গেছে একটা অবাস্তব ঠাট্টা হয়ে । সকাল বেলায় পাঠশালা যাওয়ার পথে দেখে গেছে, আবার ফেরার পথেও সেটা ঠিক তেমনিই দাড়িয়ে আছে ! নাতু বুঝতে পারে গাড়ির মালিক সেই সকাল থেকেই দোকান খোলার অপেক্ষায় আছে । নাতু ঘর থেকে বৃদ্ধা পিসিমাকে ডেকে আনে ।
ময়লা শাড়ি পরিহিতা এক গ্রাম্য মহিলাকে গাড়ির সামনে দেখে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসে `আজকের কলকাতা'র রিপোর্টার রিকি মল্লিক । সার্ট-প্যান্ট পরিহিতা কলকাতার তরুণী জার্নালিস্ট মহিলাটিকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে নাতুর পিসি, গ্রাম্য সহজাত প্রবৃত্তি দিয়ে যাচাই করে কোন দোষ দেখতে না পেয়ে প্রশ্ন করে `মাসির এই থানে কি প্রয়োজন ?'
`না..... মানে, হ্যাঁ, হ্যাঁ,..... এইটা কি গোবরডাঙ্গা গ্রাম ?'
`হা গা মাসি, ক্যেনো ?'
`তোমাদের মানে..........., আপনাদের এখান থেকে অসাধারণ সব মাটির মূর্তি চালান আসে, এই গ্রামকে নিয়ে একটা আরটিকাল........ মানে খবরের কাগজে লিখতে চাই' ।
`ও ! তাই বলো ! খপরের কাগজ !, এখানে কেবা খপরের কাগজ পড়ে ! তা এখানে বইস্যে থাকলে হবেক ? আমাদের কোওপটির গোপালকে ধরো, ও অনেক খপর জানে' ।
রিকি মল্লিক মাথা নাড়ে, ও জানে । আস্যাইনমেন্ট দেওয়ার সময়েই চীফ রিপোর্টার মি: বক্সীর কাছে শুনেছে গ্রামের লোক একসাথে কাজ করে, এখানের সমবায় সমিতিই সব কিছু । উনি বলেছিলেন `প্রথম কাজ গ্রামবাসীর বিশ্বাস উত্পাদন করা' ।
গ্রাম্য মহিলাটি ওকে সাহায্য করতে ইচ্ছুক হয়েছে, গাড়ি থেকে খাতা পেনসিল বার করে আনে রিকি, মহিলাকে দেখিয়ে দেখিয়ে খাতায় নোট নেয়, ছবি আঁকে । অনুভব করে ছোট্ট ছেলেটা ফ্যাল ফ্যাল করে ওকে দেখছে ।
বেশি নয়, দু-তিনঘন্টা আশে পাশে ঘুরে নিয়ে লাল মাটির ধুলো উড়িয়ে পার্শ্ববর্তী বড়ো শহর মুকুটমনিপুরের পথ ধরে রিকি, আবার কাল আসতে হবে, একদিনে হবে না । ধীর, স্থির এবং সঠিক গতিতে এগোতে হবে । ভাগ্যিস বুদ্ধি করে মি: বক্সী ওর জন্যে সস্তার হোটেল `মুকুট-বিশ্রামশালায়' একটা ঘর সংরক্ষণ করে রেখেছেন একসাথে অনেকদিনের জন্য ।
অন্যদিনের মতোই সূর্য-ওঠা ভোরে দ্বিজুর ঘুম ভাঙ্গে, বিছানার পাশে, এখানে ওখানে ছড়ানো ছেটানো নানা সম্পূর্ণ-অসম্পূর্ণ মূর্তি মধ্যেখানে । কাল ও কখন ঘুমিয়ে পড়েছে মনে করার চেষ্টা করে । বিক্রী করার জন্যে উপযুক্ত রাধা-কৃষ্ণ মূর্তিটাকে বিছানার পাশ থেকে কুলুঙ্গীতে তুলতে গিয়ে ওর মনে পড়ে, কালকের ঘটনা ।
এদিক ওদিক দেখে দ্বিজু, সারা ঘর নানা পুতুল ছড়িয়ে, কয়েকটার রঙ বাকি, কয়েকটা আগুনে পোড়ানো বাকি, কোথাও কোন অস্বাভাবিকতা নেই । হাসতে হাসতে খিড়কির দরজা খুলে দেয় দ্বিজু, তার মানে গত রাত্রে শিশু পুতুলটাকে নিয়ে একটা মজার স্বপ্ন দেখেছিল তাহলে । সকালের সূর্যের রেখা যখন উঠোনে এসে পড়ে ওর খুব ভালো লাগে । হাত মুখ ধুয়ে রঙ খেলনা নিয়ে বসে পড়ে, অন্যমনস্ক চোখে নজর করে দেখে কাল রাত্রে যেখানে রেখে গিয়েছিল শিশু পুতুলটা, ঠিক সেখানেই আছে, কিন্তু যেন দিনের আলোয় আকারে পুতুলটাকে একটু বড়ো মনে হয় । পুতুলটার থেকে উল্টো দিকে ফিরে আরো কয়েকটা অসম্পূর্ণ মূর্তি শেষ করার কাজে ডুবে যেতে চেষ্টা করে দ্বিজু ।
কিন্তু শিশু পুতুলটার চিন্তা মাঝে মাঝেই দ্বিজুকে অন্যমনস্ক করে দেয়, কাজ করতে করতেও বারংবার মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কৌতুহলি চোখে পুতুলটাকে দেখতে গিয়ে দ্বিজু বিরক্তি বোধ করে । উল্টো দিকে ফিরে বসেও কোন লাভ হচ্ছে না !
দুপুরের রোদ এসে ওর মাথায় লাগে, ক্ষিদেও পেয়েছে, একটু পরেই উঠতে হবে, সকালবেলা যেই রকম দেখেছিল পুতুলটা ঠিক সেই রকমই আছে, গত রাত্রের পর আর বড়ো হয়নি তো ! কি করেই বা হবে ? `অর কি পরান আচে নাকি ?' দ্বিজু নিজের মনে হাসে । `পাইগলে গেলি নাকি ? অ দ্বিজু ?' নিজের অজান্তেই পুতুলটাকে হাতে তুলে নেয় দ্বিজ, একটু উষ্ণ না ! `এতকটা ক্ষন রোদে পড়েযসিল না ? তেতে যাবেনি যেন !'
দ্বিজু মনের সাথে যুক্তি করে, এই অশান্তির পুতুল তৈরির কাজটা যদি একবারে শেষ করে দেওয়া যায়, তা হলে আর চিন্তা থাকে না । ও কাজে নিমগ্ন হয়ে যায় । ঘরের সামনে বিরাট বট গাছের ছায়ায় যখন অন্ধকার ঘনিয়ে আসে, তখন ওর কাজ শেষ হয় । এতক্ষনে দ্বিজুর খেয়াল হয়, সকাল থেকে নাওয়া খাওয়া কিছু হয়নি ! সারাদিনের ক্লান্তি একসাথে ওর চোখে জড়ো হয়, ভাতেভাত কিছু খেয়ে ঘুমোনোর জন্য তৈরি হয় । কি মনে করে শিশু পুতুলটাকে সদর দরজার বাইরে রেখে, শিকল লাগিয়ে দ্বিজু নিশ্চিন্ত বোধ করে । হাটের আগে ওর দিকে আর তাকাবে না পণ করে । কি মনে করে রান্নাঘর থেকে ছোট্ট তেলের কুপিটা বিছানার পাশে জ্বালিয়ে রেখে টান টান হয়ে শুয়ে পড়ে দ্বিজু ।
হেমন্তর রাত, আর পাঁচটা রাতের মতোই, কুয়াশাচ্ছন্ন, ভারী, নিস্তব্ধ । আচমকা ঘুম ভেঙে যেতে দ্বিজু একটু যেন অবাকই হয়, কিছুক্ষণ বিছানা থেকে না উঠেই ভাঙা ঘুমটাকে জোড়াতালি দিয়ে লাগাতে চেষ্টা করে, এমন সময় আওয়াজটা আবার হয় । দ্বিজু ঠাহর করে, না তো ! ঠিক করাঘাত নয়, একটা ভারী কিছু জিনিষ নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে বারে বারে দরজার ওপর এসে পড়ছে । এইভাবে ঘুমোনো সম্ভব নয়, দ্বিজু উঠে পড়ে । কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে কুপি নিয়ে দরজাটা খুলে ফেলে । এক রাশ ঠাণ্ডা হিমেল হাওয়া ঘরে ঢুকে পড়ে দ্বিজুকে কাঁপিয়ে দেয়, কুপিটা দপ দপ করে ওঠে, কিন্তু তার মধ্যেই দ্বিজু দেখে নিয়েছে !
সকালে তিনমাসের আকারের শিশু পুতুলটা এখন আকারে প্রায় একবছরের সাঁওতাল শিশুর মতো, যেন ওর মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য বার বার করে গড়িয়ে এসে দরজায় পড়ছে । ওর মনে পড়ে সকালে চোখ-নাক-মুখের সব কাজ শেষ করে মিশকালো রঙে চোবানোর সময় পুতুলটা যেন নড়ে উঠেছিল । গলার স্বর নামিয়ে ঘুমজড়ানো গলায় দ্বিজু প্রশ্ন করে `ঠাণ্ডা লাইগসে ?' হাতের কম্বলটা ছুড়ে দেয়, হিসহিসে গলায় বলে ওঠে, `বলাই, রাইত-দুপুরে গলোযোগ করিসনি ! সবাই ঘুমায়' । দরজা বন্ধ করে আর একবার শিকল লাগিয়ে দিয়ে ঠাণ্ডায় কুঁকড়ে মুঁকড়ে শুয়ে পরে, আজকের রাতটা যাক, হপ্তা শেষে হাট থেকে কতকগুলো জিনিষ কিনতে লাগবে ।
রিকি মল্লিকের কানে গ্রামের বিখ্যাততম কারিগর দ্বিজুর নাম, তার শৈশবের গল্প-কথা এসেছে, রিকি বুঝেছে এমন একজনের সাক্ষাত্কার নিতে পারলে, তার সাংবাদিক জীবনের প্রথম প্রতিবেদন বেশ সাড়া ফেলে দেওয়া হবে । চিফ মি: বক্সীও এই ব্যাপারে একমত । `তা কাজ কেমন হচ্ছে ? সাবধান, মিস মল্লিক, গ্রামের শান্ত জীবনে বিঘ্ন ঘটাবেন না যেন, রেগে গেলে এরা কি করবে কেউ বলতে পারে না,' মি: বক্সীর একটাই সতর্ক বার্তা ।
মি: বক্সীর কথায় রিকির বাবাকে মনে পড়ে, জার্নালিজিম নিয়ে পড়বে শুনে যে বাবার মাথায় বাজ পড়ে গিয়েছিল, সেই বাবাই কেঁদে ফেলেছিলেন মেয়ের প্রথম বিভাগে প্রথম হওয়ার রেজাল্ট শুনে । তারপরে যখন বিখ্যাত দৈনিক `আজকের কলকাতা'এ রির্পোটারের চাকরী পেলো রিকি, সেই তার বাবা মি: মল্লিক কলকাতার পাঁচতারা হোটেলে বিরাট নেমন্তন্ন করে লোক খাইয়েছিলেন ।
রিকি যেটা করবে বলে মনে করে সেটা সে করেই ছাড়ে, এটা তার বাবা যেমন বুঝেছেন, মি: বক্সীকেও দ্বিজু-বাউরির সাক্ষাত্কার নিয়ে সেইরকমটা দেখিয়ে দেবে রিকি । রিকি মল্লিক সাংবাদিক জীবনের শপথ নিয়েছে, জীবনের প্রথম কাজকে শতকরা একশো ভাগ সফল না করে সে ছড়বে না ।
`চিন্তা করবেন না স্যার, আমি সাবধানে এগোচ্ছি' রিকি ফোন নামিয়ে রেখেছিল ।
যে দু তিন-জন গ্রামবাসি রিকির সাথে কথা বলতে রাজি হয়েছে তাদের মাধ্যমে রিকি বুঝেছে দ্বিজুপাগলাকে ইন্টারভিউ এর জন্য রাজি করানো প্রায় অসম্ভব । রিকিকে দ্রুত পরবর্তী পদক্ষেপ চিন্তা করতে হবে, মুকুটমনিপুরে বেশিদিন পড়ে থাকা চলবে না । কলকাতাতেও প্রচুর কাজ আছে । রিকি তক্কে তক্কে থাকে তথ্যের সন্ধানে, দ্বিজু মাসে একবার হাটে আসে, জল আনতে দিনে দুবার বেরোয়, পাতা-জ্বালানী বেরোয় সপ্তাহে একবার, কোন মেয়ের দিকে তাকায় না, কোন ছেলে ছোকরার সাথে হাড়িয়া কিম্বা ধেনো খেতে ওকে কেউ কখনো দেখেনি । গ্রামবাসিরা নিজেদের স্বার্থে যে নির্জনতা দ্বিজুকে দিয়েছে, রিকি সেই নির্জনতারই সুযোগ নেবে ।
গোবরডাঙ্গায় ভোর হয় । ঘুম ভেঙ্গেই দ্বিজু দৌড়ে গিয়ে দরজা খোলে, ঠিক যা সন্দেহ করেছিল ! বলাই বেড়ে দুই বছরের সাঁওতালি ছেলের মতো আকারে হয়েছে । ঠিক দুদিনে বলাই দুবছরের বাড় বেড়েছে । দ্বিজু ওকে ঘরে নিয়ে আসে, অন্য আর চারটে পুতুলের সাথে না রেখে বিছানার পাশে একটা মাদুর বিছিয়ে তার ওপর শুইয়ে দেয় । পুতুলটা কিছুক্ষণ জোরে জোরে নি:শ্বাস নিয়ে থেমে যায় । ওকে অগ্রাহ্য করে দ্বিজু অসম্পূর্ণ কৃষক রমনী মাতৃমূর্তি তৈরি করার কাজে মনোনিবেশ করার চেষ্টা করে, আর দুদিন বাদেই হাট, তার আগে অন্তত: চার-পাঁচটা মূর্তি তৈরি না করলে শুধু গ্রামবাসি বিপদে পড়বে, বসন্তের শুরুতেই নতুন ধানের বীজ লাগবে ।
কিন্তু তার থেকেও বড়ো দুর্ভাবনা হাট শেষেই বিলাসী এসে উপস্থিত হবে এবং পছন্দ মতো মাসকাবারি তোলা না পেলে তিক্ষণ কটুক্তি করতে থাকবে, ছুড়ে ছুড়ে পুতুল ভাঙবে । যে গ্রাম বা গ্রামবাসির সঙ্গে কোন সম্পর্ক বিলাসীর গড়ে ওঠেনি তাদের জন্য নিজের শহুরে বিলাসে কার্পন্য বিলাসী মেনে নেবে না, সেটাও পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে । আগের মাসেই বিলাসী এক তাল মাটি ছুড়ে দ্বিজুকে মারতে এসেছিল, `হারামী ছোড়া, তুর মাকে মাইরছিস, অখন আমায় মাইরবি ? আয় লে:' এর মধ্যে বলাই আর এক নতুন উপদ্রব । ওর কাজ বেশি দূর এগোচ্ছে না ! সব ছেড়েছুড়ে তিতিবিরক্ত দ্বিজু মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে, কি যে করে ও ! ও চুপ করে বসতেই বলাই এর নি:শ্বাস আবার শুরু হয় এবং একটানা চলতেই থাকে ।
অনেক ভাবনা চিন্তা করে দ্বিজু ওর দিকে ফিরে তাকায়, অনুনয়ের স্বরে বলে, `বলাই চুপ কইর ! অনেক কাম আছে,' একটা বুদ্ধি দ্বিজুর মাথায় এসেছে, কিছু খাবার দিলে হয়তো বলাই চুপ করবে । দ্বিজু উঠে পড়ে । তাড়াহুড়ো করে চুলোয় আগুন দেয়, জোরে জোরে হাওয়া দিয়ে আঁচ ওঠায়, এক কৌটো চাল অনেক বেশি জল দিয়ে চুলোয় বসায়, মুখ বাড়িয়ে বিছানার পাশে দেখে, ঘর যেন নিস্তব্ধ হয়ে আছে না ! যতক্ষণ ও ভাত তৈরির কাজে ব্যস্ত, বলাই চুপ করে গেছে । গলা-গলা সেদ্ধ ভাত বলাই এর সামনে এক বসিয়ে দ্বিজু দপ দপ করে ঘর ছেড়ে উঠানে গিয়ে বসে । `হায়, সইনেঝ্য গইড়িয়ে গেইল, কুন এট কাম কইরতে লারলাম ।'
আরো কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে দ্বিজু শান্ত হয়ে আস্তে আস্তে ঘরে ঢোকে, বলাই অন্য সব মাটির মূর্তির মতোই চুপ করে শুয়ে আছে যেন ঘুমোচ্ছে ও লক্ষ করে বলাই এর ঠোঁটের কোনে একটা তৃপ্তির হাসি । একমাত্র কম্বলটা তখনো বলাই এরই গায়ে, দ্বিজু নিতে গিয়েও হাত সরিয়ে নেয় আশঙ্কায়, কম্বল সরাতে গেলে বলাই এর ঘুম ভেঙে যায় যদি । পরিত্যক্ত একটা কাঁথা গায়ে দিয়ে সারা দিনের অভুক্ত দ্বিজু ক্লান্তিতে এলিয়ে পড়ে ।
অন্যদিনের মতো খোঁজ খবর সেরে, মুকুটমনিপুরের হাইওয়েতে তখন উঠে পড়েছে, রিকির মনে পড়ে চায়ের দোকান থেকে বেরুবার পথে কালি হাজরা বলেছিল, `এ গাঁয়ের, মাসি, দুইটো গব্ব করার বস্তু, একটা হু-ই পাহাড় শুশনিয়া আর অন্যট দ্বিজু, রাতের অন্ধকারে পাহাড় বড়ো সোন্দর মাসি, না হেরে চলি যাইও না, তোমার ওই ফোটকমেসিন লিয়ে যেও' দোকানে বসা আরো তিন জন সমস্বরে সায় দিয়েছিল ।
পাহাড়ের রূপ দেখে পাগল হয়ে যাওয়ার গল্প শোনার পর থেকে রিকির ইচ্ছেটা ছিলো, গাড়ি চালাতে চালাতে সেই ইচ্ছেটা একেবারে যেঁকে বসে । এদিকে বিকেল গড়িয়ে গেছে, পরস্পর বিরোধী কয়েকটা চিন্তা ওর মনের মধ্যে খেলে যায়, `ক্ষিদে পেয়েছে !', `রাস্তায় অঢেল খাওয়ার দোকান' `কালই হাটবার !' `আজই ভালো সময়', `হোটেলে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যাবে !', `সকাল সাতটায় হাট বসবে', কিন্তু শেষ পর্যন্ত জার্নালিষ্টের ঝুঁকি নেওয়া মনকেই জিতিয়ে দিয়ে রিকি গাড়ি ঘুরিয়ে একেবারে উল্টো দিকে বাঁক নিয়ে নেয়, গোবরডাঙ্গার গ্রাম ছাড়িয়ে আরো পাঁচকিলোমিটার উত্তরে শুষনিয়া পাহাড়, তার আগে ও থামছে না ।
বাইরে থেকে বড়োজোর একটা কি দুটো আলোর রেখা এসে পড়ছে, সূর্য এখনো দিকচক্রবালের অনেক নীচে, দ্বিজুর চটকা ভেঙে যায় । এখনো সকাল হয়নি, অপরিসীম ক্লান্তিতে দুচোখের পাতা বুজে এসেছিল, দুহাতে চোখ রগড়ে দ্বিজু বলাইয়ের দিকে ফেরে । গত পাঁচদিন ধরে একটা নিদারুন দু:স্বপ্ন দেখেছে আশা এক মুহূর্তে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় । ঘরের আধো আলো অন্ধকারে, কুপির আলোয় দেখেছে ওর বিছানার পাশে বলাই বসে আছে, প্রায় যেন একটা পাঁচ বছরের খোকা । কম্বলটা অবহেলায় পাশে পড়ে আছে । কাল সারা দিনেরাতে বলাই এর জন্য ভাত করতে হয়েছে পাঁচবার, আর প্রত্যেকবারই ভাত করে ওর সামনে থেকে অন্য ঘরে চলে যেতে হয়েছে । রাত প্রায় বারোটার সময় ভাত করতে গিয়ে দ্বিজু দেখেছে চালের টিন তলানিতে এসে দাঁড়িয়েছে ।
আবার ভাত না বানিয়েই উপায় ছিল না, বলাই নানা আওয়াজ করে দ্বিজুর কানে তালা ধরিয়ে দেওয়ার উপক্রম করেছে । এই ভাবে চললে না পারবে বলাইকে ঘরে রাখতে, না পারবে বলাইকে ঘরে রাখতে, না পারবে বাইরে রাখতে, যে ভয়ানক পরিস্থিতি সম্মুখীন ও, তা এই সকালের আলো আঁধারিতে হঠাৎ যেন দ্বিজুর কাছে স্পষ্ট হয়ে দাঁড়ায়, সমস্যার ভারে ওর চোখ বাষ্পায়িত হয়ে যায়, শরীর টলতে থাকে । কোন রকমে বিছানার ধার ঘেঁষে দ্বিজু নিজেকে সামলায় । অনুভব করে যেন ওর মাথা চোখ বেয়ে একরাশ কালো ডেয়ো পিঁপড়ে হেঁটে চলেছে, ওর শরীরের প্রতিটি অনু-পরমানু গলাধ:করণ করে ওদের ভয়ানক ক্ষুন্নিবৃত্তি হবে........, একটু রাগত স্বরে বলে ওঠে, `এযা: নোলা এক্কবারে সকসক, এতো অন্ন আমি যোগাতে পারবো না বলাই, কোন কাজকর্মে নেই, শুধু খ্যাটন !'
বলাই একটু নড়াচড়া করে ওঠে, যেন কিছু বলবে বলে ফিরে তাকায়, এমন সময় দুম দুম করে সদর দরজায় করাঘাতে দ্বিজু সচকিত হয়ে উঠে দাঁড়ায় ।
`কি র্যা ছেকড়া ঢ্যামনা. কবে থেইক্যে আবার ছেকল লাগাচ্চিস ? হা ! ভাবখানা যেন্ ছেকল দিয়ে বিলাসীকে আটকাবি ? দ্বার খোল, ঘাটের মড়া কোথাকার ! অনবরত ধাক্কায় রদ্দি কালের মরচে পরা শিকল ভাঙতে দেরি হয় না । `সাহস কম না, আটকুড়ির ব্যেটা !' ঘরের ভিতরে পা রেখেই মারমূর্তি বিলাসী সহসা চুপ করে যায় । দ্বিজুর রক্তবর্ণ চোখ, ভাতের গন্ধ, ছড়ানো ছেটানো রঙ-কালি, লণ্ডভণ্ড বিছানা, সব মিলিয়ে একটা অন্যরকম ভাব ওর নজরে পড়েছে ।
`কি করছিলি ? ধেনো না হাড়িয়া ? কুনটা শালা ?' বিলাসী চোখ সুচালো করে দ্বিজুকে দেখে, দ্বিজু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে, সাধারণত বিলাসী হাটের দিন পার করে আসে, কিন্তু এখন কেন এসেছে প্রশ্ন করতে গিয়েও থেমে যায় দ্বিজু, মুখ তুলে দেখে বিলাসী মাদুরের উপর বসে পড়েছে । `উদরভূরিংগা কুথাকার ! এই এত্ত বড়ো একট ছেলেট বানাইলি কেনে, তাও দেখো ছ্যেনার চ্যোখ টেরা । মরন !'
`তা আপুনি আইজকে !' দ্বিজু বিলাসীর নজর বলাইর কাছ থেকে সরানোর চেষ্টা করে । কিন্তু ছ্যেনার চোক টেরা মন্তব্যটা ওর কানে গেছে, লক্ষকরে বিলাসীর অভিযোগ মিথ্যা নয়, বলাই নিদারুনভাবে ট্যেরা । দুই ফালা ফালা সাওতালি চোখ দিয়ে সম্পূর্ণ দুই বিপরিত দিকে তাকিয়ে আছে বলাই ।
`আগের মাসে ফাঁকি দিয়েছিস ঢ্যামনা ! কত টাকার মাল যাচ্ছে হাটে দেকা আগে,' বিলাসীর দৃষ্টি এখন পুরোপুরি বলাই এর দিকে `এযা:, আবার মাদুর পাতা হয়েছে, টেরা চোকের মাল দু-পয়সাতেও বিকোবে না ! দে দেখি, এক্কাবারে নিকুচি করে আসি,' জরদ্গবের মতো বসে থাকা দ্বিজুকে ডিঙ্গিয়ে, এক ঝটকায় বলাইকে তুলে নিয়ে বাইরের শক্ত মাটিতে ছুড়ে ফেলার জন্য বিলাসী হন হন করে বাইরে বেড়িয়ে যায় ।
রাত প্রায় চারটে বাজে, আর একটু পরেই সূর্যোদয় আরম্ভ হবে, রিকি তাড়াতাড়ি ফেরার পথ ধরে । যদিও ক্লান্ত লাগছে, জ্যোত্স্নার আলো-অন্ধকারে শুষনিয়া পাহাড়ের রূপ দেখে রিকির মন ভরে গেছে । গ্রামের লোক ঠিকই বলেছিল । বড়ো বড়ো দুটো হাই পর পর তুলে রিকি নিজের মনে বলে ওঠে, `অভূতপূর্ব, সত্যিই পাগল হওয়ার মতোই, কিন্তু বড্ড ঘুম পাচ্ছে যে, হাইওয়েতে এইরকম ঘুম চোখে চলাটা ঠিক হবে না' আর তখনই একটা বুদ্ধি রিকির মাথায় খেলে যায়, একঢিলে দুই পাখি মারার এক দারুন অবকাশ পাওয়া গেছে । রিকি ঠিক করে লোকজন উঠে পড়ার আগে গ্রামের রাস্তায় কোথাও দাঁড়িয়ে একটু ঘুমিয়ে নেওয়া যাক, সেই দিক দিয়ে দেখলে গ্রামের উত্তরপূর্ব কোনটা সবথেকে সুবিধেজনক, উপরন্তু ঐ দিকটাতেই দ্বিজু থাকে ।
`দেখাই যাক না ! সাতসকালে গিয়ে হাজির হলে তাড়িয়ে তো দেবে না নিশ্চই' উত্সাহের সাথে রিকির মনে দ্বিজুর ঘরের দিকের পথ ধরে । দ্বিজুর ঘরের কাছাকাছি এসে রিকি সজোরে ব্রেক চেপে দাঁড়িয়ে পড়ে । এখনো ভালো করে সূর্য ওঠেনি, এই সকালে এক শহুরে মহিলা নাতির হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে ঠিক দ্বিজুর ঘরের বাইরে ! যেন নাতির সাথে দৌড়ে বেড়িয়েছে মহিলাটি, অথচ এই শীতের রাত্রে বাচ্ছাটার পরনে একটা সুতো পর্যন্ত নেই । আরো বিপদের কথা, আর একটু হলে গাড়িতে চাপা পড়তে পারতো ! রিকি অত্যন্ত বিরক্ত বোধ করে, এই গ্রাম্য লোকগুলো শহরে গিয়েও কি কিছু শিখবে না ? কিছুক্ষণ আগের পরিতৃপ্ত ভাব অর্ন্তহিত হয়ে গেছে । মি: বক্সীর সাবধান বাণী স্মরণে এনে নিজেকে কোন রকমে সামলে রিকি ছোট্ট একটা হর্ন দেয়, গাড়ির হেড লাইট উঁচু করে ধরে, দাঁতে দাঁত চেপে গাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসে ।
`কি হচ্চে কি ? সরো এখান থেকে' দুজনের চোখ ভেসে যাচ্ছে গাড়ির ফ্লাড লাইটে, কিন্তু কনামাত্র না সরে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে ।
`স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে মজা হচ্ছে ?' কথাটা মুখ থেকে বাইরে যাওয়ার আগেই রিকি থেমে যায় । স্ট্যাচুই তো !
দ্বিজুর ঘরের সামনে মানুষ আকারের মাটির প্রতিমা, শহুরে দিদিমার হাত ধরা সাঁওতালী বাচ্ছা । যেন রিকির গাড়ির আলো পড়ার আগের মুহূর্তে জীবিত ছিল দুটো মানুষ !
অপূর্ব কারিগরি দক্ষতা ! ভীতি মিশ্রিত শ্রদ্ধার অনুভূতিতে আপ্লুত রিকি মাটির রাস্তায় বসে পড়ে । অভিজ্ঞতা থেকে রিকি জানে, পাড়াগাঁয়ের হাটে নয়, আর্ন্তজাতিক সংগ্রহশালায় সঠিক মূল্যায়ন হবে এই দিদিমা আর নাতির যুগল মূর্তি । এই অজ পাড়াগাঁয়ে যে গ্রাম্য কুশলী হাতের স্পর্শ দিয়ে মাটিতে এমন প্রাণের ছোঁয়া এনেছে তার সঙ্গে দেখা না করে, সাক্ষাত্কার না নিয়ে রিকি মল্লিক কলকাতায় ফিরছে না ।
দ্বিজুর ঘরের দিকে তাকায় রিকি, উঠানের ওপর বসা মানুষটাই যে দ্বিজু সেটা বুঝতে অসুবিধে হয় না; যেন রিকির মতোই অবাক হয়ে ফ্লাড লাইটের আলোয় নিজের সৃষ্টির দিকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছে মানুষটা ।
রিকি ধীরে ধীরে গাড়িতে গিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করে, দ্বিজুর দিকে ঘুরে তাকায়, ক্ষণিকের জন্য উঠানে বসা রোগা চেহারার গ্রাম্য সরল মুখটাতে সহজ হাসির আভাস দেখল যেন ! একটা আমন্ত্রণও আছে কি ঐ হাসিতে ? মি: বক্সী এখন ঘুম থেকে উঠেছেন কি ? এই গ্রাম্য মানুষটিকে বোঝাতে হবে এই দিদিমা-নাতির যুগল মূর্তির স্থান পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কোন সংগ্রহশালায় ।
আপাতত তো সাক্ষাত্কারটা হোক । গাড়ি থেকে টেপ রের্কডার, ক্যামেরা, নোটবই বার করে আস্তে আস্তে দ্বিজুর ঘরের দিকে এগোয় রিকি ।
(পরবাস-৪৩, জুলাই, ২০০৯ )