• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪৩ | জুলাই ২০০৯ | প্রবন্ধ
    Share
  • নক্ষত্র পরিক্রমা : রবিন পাল

    শেক্সপিয়র তাঁর `দ্বাদশ রাত্রি' নাটকের ২য় অঙ্ক পঞ্চম দৃশ্যে একটি চরিত্রের মুখ দিয়ে জানান - `কেউ কেউ জন্ম নেন মহান হয়ে, কেউ কেউ অর্জন করেন মহত্ত্ব, আর কারো কারো ওপরে চাপিয়ে দেওয়া হয় মাহাত্ম্য ।' এই অব্যর্থ উপলব্ধি হাতে নিয়ে বলা চলে আজকে মহান মানুষ আর নেই, চাপিয়ে দেওয়া মাহাত্ম্য ? হয়তো ক্ষণভঙ্গুর মাহাত্ম্য, আছে । মহান লেখক ? বাংলা সাহিত্যে ? হয়তো আছে, আমার জানা নেই । বুদ্ধদেব বসু রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে বলেছিলেন - `যেন এক দৈব আবির্ভাব - অপর্যাপ্ত, চেষ্টাহীন, ভাস্বর, পৃথিবীর মহত্তম কবিদের অন্যতম' । রবীন্দ্রনাথ-ও বলেছিলেন বুদ্ধদেবের রচনা-জগৎ যেন এক বিস্ময়জগৎ যেখানে ফল, লতা-পাতা, ফুল এমনকি আবহ পর্যন্ত স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত । বুদ্ধদেব চর্চা করে গেছেন লেখার বহু দিক - কবিতা, উপন্যাস, নাটক, সাহিত্য সমালোচনা, রম্যরচনা, এমনকি শিশুসাহিত্য - এমন এক ভাষায় যা প্রত্যক্ষ, জীবন্ত, যা পল্লবগ্রাহিতামুক্ত । রবীন্দ্রনাথের পরে নানাগুণ সমন্বিত শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বুদ্ধদেবের মতে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বলতে চাই কথাটা বুদ্ধদেব বসু প্রসঙ্গেও প্রযোজ্য । অপরপক্ষে, সাম্প্রতিক এক আলোচকের মতে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় `বিদ্রোহী প্রমেথিউস', আর এক প্রবীণের মতে, তিনি `শিল্পিসন্ত' - শিলার বা ডস্টয়েভস্কির মতো, টলষ্টয়ের কথা ও মনে পড়েছে কারো । (দেবেশ রায়) (ঘু. চ.)

    বুদ্ধদেবের-ও একদা মনে হয়েছিল - মানিকের মধ্যে আছে সুনীতিমনস্কতা, প্রজ্ঞাদৃষ্টি, তিনি একই সঙ্গে লজিক্যাল ও ম্যাজিকাল, তাঁর শিল্পপ্রকাশে কোনো কিছুর অভাব নেই, তিনি অনন্য । বুদ্ধদেব পরে অবশ্য, চতুষ্কোণ-পরবর্তী মানিক সম্পর্কে বলেন - রচনা সব ভোঁতা, শীতল, মৃত । তুলনায় কম আলোচিত আশাপূর্ণাকে প্রবীণ লেখক বলেছেন `সাহিত্য সারদা' (গজেন্দ্রকুমার মিত্র), তাঁর সাহিত্য প্রতিভা শুধু `কারয়িত্রী নয়, ভাবয়িত্রী' (সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়) আর এক বৈষ্ণব পণ্ডিত বলেছেন তিনি `প্রতিস্পর্ধী' (হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়) তিনি `অনন্যা' (বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়) অথবা `বিশুদ্ধ ভারতীয়' (রাধারানী), `মেয়েলি কথার অনন্য শিল্পী' (লীলা মজুমদার) `নারীজীবন সংগ্রামের নিপুণ শিল্পী, গল্প নির্মিতিতে দক্ষ' (মহাশ্বেতা) ইত্যাদি । খর্বিত মহিমা, স্বার্থকলুষিত হুজুগমনস্ক এই যুগের সীমাবদ্ধ দর্পণে এই মহান ত্রয়ীর তর্পণ আমাদের চরিত্রে যদি সামান্যতম ধাক্কা দিতে পারে, সেটুকুই লাভ ।

    এই তিন বরেণ্য কথাশিল্পীর শিক্ষা নিয়েই কথা শুরু হোক । লেখকের ক্ষেত্রে শিক্ষণ তিন প্রকার । স্কুল কলেজের শিক্ষা, বই-পত্রের শিক্ষা, জীবনের শিক্ষা । বুদ্ধদেব কৃতি ছাত্র, ম্যাট্রিকে পঞ্চম, আই. এ. তে ২য় । এম. এ. ইংরাজি সাহিত্যে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম । প্রভু গুহঠাকুরতার সূত্রে হুইটম্যান, নানা দেশের গল্প উপন্যাস পড়া হল । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা বাংলা পত্রিকা, পাঞ্চ, রিভিয়ু অব রিভিয়ুজ, কিছু ইংল্যাণ্ডজাত উঁচকপালে, আধা উঁচকপালে পত্রিকা পড়তে পড়তেই প্রগতিতে লিখেছেন `কবি জন মেইসফীল্ড' (কাতির্ক ১৩৩৫), প্রগতিতে প্রভু গুহঠাকুরতা লিখছেন - শ্যন ও কেইসী, বলশেভিক সাহিত্য, তত্কালীন ফরাসী কথাসাহিত্য, তত্কালীন জার্মানির চিন্তাধারা, জাপানের পীতনাট্য প্রভৃতি । এই পড়াশুনার পরিধি ত্রক্রমশ: বাড়তে থাকে, বাড়তেই থাকে, যদিও জীবনের অভিজ্ঞতার সীমানা কতদূর সম্প্রসারিত হয়েছিল এ নিয়ে মতভেদ আছে । স্কুলে মানিক ছাত্র হিসেবে ভালই ছিলেন । ম্যাট্রিকে আবশ্যিক ও ঐচ্ছিক গণিতে লেটার পেলেও প্রচণ্ড ভালো ছেলের মত স্বভাব ছিল না তাঁর । মানিকের মতে - "প্রথম শিক্ষা কোথায়-ও বাঁধাবাঁধি নিয়মে হয়নি । .... সমস্ত স্কুলজীবনটাই যেন ছন্নছাড়া । ক্লাসের পড়া খুব ভাল লাগত না ।" বাঁকুড়া ওয়েসলিয়ন কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আই. এস. সি ; গণিত ও পদার্থবিদ্যায় ছিলেন অসম্ভব স্ট্রং । তবে ছিল স্ট্রং পার্সোনালিটি, অমিশুক স্বভাব, কুস্তি, বাঁশি, ঘুরে বেড়ানো, ধূমপান, মদ্যপান অভ্যাস শুরু হয় । প্রেসিডেন্সীতে গণিতে অনার্স নিয়ে বি. এস. সি. তে ভর্তি হন । সাহিত্য নিয়ে তর্ক করতেন । ঝোঁকের মাথায় `অতসী মামী' লিখে বদলে গেলেন, গোপনে গল্প লেখা, বি. এস. সি. ফেল ঘটল । পাঠ্যপুস্তক পড়ার আগ্রহ চলে গেল, রাশিকৃত বিদেশী লেখকের গল্প, উপন্যাস তার মধ্যে রাশিয়ান লেখকই বেশি পড়া চলল । রবীন্দ্রনাথ পড়তেন কিন্তু নালিশ জাগত না । বুদ্ধদেব মানিক দুজনেই ছোটবেলা থেকে লেখক হবার স্বপ্ন দেখতেন । বুদ্ধদেব অ্যাকাডেমিক চর্চা ও সাহিত্যচর্চার মধ্যে ভারসাম্য রচনা করেছিলেন, মানিক অ্যাকাডেমিক চর্চা, দাদার তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও ছেড়ে দেন । সমাজ অভিজ্ঞতার প্রসারণা, পরিস্থিতির কারণ অনুসন্ধান - দুটোই বাড়তে লাগল । স্বেচ্ছাস্বীকৃত দারিদ্র্য, ভাবালুতাবিরোধিতা, ভদ্রজীবনের স্ববিরোধিতা ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলা এ সব চলতে শুরু করল । আশাপূর্ণা বলেছেন - `আমাদের বাড়ি খুব রক্ষণশীল ছিল । মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার পাট ছিল না । স্কুলে যাওয়ার সুযোগ হয়নি । তবে পড়েছি সর্বদাই । .... আমার মার ছিল ভীষণ সাহিত্য প্রীতি ।' বিদেশী সাহিত্য-ও পড়তেন, তবে অনুবাদে । অভিজ্ঞতাপ্রসারণ প্রসঙ্গে বলেন - `আমার পৃথিবী তো জানলা দিয়ে দেখা ।' ছোটদের মনটা বুঝতে চেষ্টা করতেন ছোটদের নিয়ে লেখা দিয়ে । রবীন্দ্রনাথ প্রিয়, তবে বঙ্কিমেরও ভক্ত । কোনো কোনো বই একশবারও পড়েছেন । তারাশঙ্কর বিভূতি মানিকের লেখা তো চিরকালীন । মানিকের লেখা প্রথম পড়তে তেমন মন লাগতো না । দু-চার বার পড়ার পর আশ্চর্যরকম ভালো লেগেছে ।

    বুদ্ধদেব বসুর উপন্যাসের সংখ্যা ৫১, যার মধ্যে ২টি অন্য লেখক সহযোগে, যার মধ্যে ছোটদের জন্য উপন্যাস-ও আছে । রণেন্দ্র দেব তাঁর উপন্যাসগুলিকে তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন - ক) প্রেম ও যৌবন খ) জীবন ও শিল্পকলা গ) সামাজিক ছক বা প্যাটার্নের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও প্রতিবাদ । রণেন্দ্র জানান বুদ্ধদেবের নায়কেরা `কৃতী ছাত্র অথচ বিদ্যার বৈষয়িক প্রয়োগে উদাসীন, শিল্প উপভোগে কিংবা সৃষ্টিতে তদগতচিত্ত, প্রেমের প্রবল উদাত্ত আবির্ভাবের জন্য প্রতীক্ষাশীল । কখনও প্রেম হালকা চপল মূর্তিতে, কখনও প্রেম কাব্যময় অনুভূতির সঙ্গে জড়িত । কখনো প্রেমের সঙ্গে যৌন জীবনের সম্পর্ক বিশ্লেষণ, অন্যত্র প্রেমের ব্যর্থতার আলেখ্য । সমাজ জীবনের গ্লানিকে আঘাত করতে চান বুদ্ধদেব । লক্ষ্য না পড়ে পারে না তাঁর বেশির ভাগ উপন্যাসের নায়ক কবি কিংবা শিল্পী, সাহিত্যের কৃতী ছাত্র কিংবা কবিতা প্রেমিক অধ্যাপক । গোপিকানাথ রায় চৌধুরী এ সবই বলেছেন একটু ভিন্নভাবে । যেমন - বুদ্ধদেব জীবনকে কোথাও অস্বীকার করেন নি, অবমাননা করেন নি । তবে তাঁর কথাসাহিত্যে পরিবেশগত বৈচিত্র্যহীন সংকীর্ণতা আছে । তিনি অবক্ষয়-পীড়িত যৌবনের নানামুখী প্রবণতাকে রূপ দিয়েছেন । তিনি সংকীর্ণ নগর জীবনের চিত্রকর, আলডুয়াস হাক্সলি ধাঁচের ব্যঙ্গ প্রকাশে আগ্রহী । সাম্প্রতিক প্রাবন্ধিক অর্ণব সেন জানান - বুদ্ধদেবের উপন্যাসে ঘটনাবৈচিত্র্য এবং নাটকীয়তা নেই, নেই মেলোড্রামার ঘটনা । তাঁর উপন্যাসে চরিত্রের মন আর মনন, আত্মকথনের গতানুগতিকতা, বর্ণনার পর বর্ণনা আছে । মন দিয়ে পড়লে পাওয়া যাবে চরিত্রের গভীরতম প্রদেশের আশ্চর্য রূপময় ঐশ্বর্য । উপন্যাস - রোমান্টিক, আত্মকেন্দ্রিক, সমাজ বিমুখ । চল্লিশের `কালো হাওয়া' উপন্যাসে আছে চরিত্রের ভেতর নানা প্রবৃত্তির আলোড়ন ও জটিলতা । প্রৌঢ়ত্বের উপন্যাসে মেলে - নগর জীবনের যান্ত্রিক জটিলতা, মনস্তত্ত্বের গোপন জটিলতা, চরিত্রের বিকার । তাঁর উপন্যাসে বারংবার `আমি' ঢুকে পড়ে, উপন্যাসে স্বগতভাষণ প্রায়ই চোখে পড়ে । তাঁর উপন্যাসের ভাষা জটিলতা মুক্ত, তাতে স্বচ্ছতা ও কবিত্ব । প্রথম দিকের উপন্যাসে `শেষের কবিতা'র প্রভাবের কথা বলা হয় । `তিথিডোর' (১৯৪৯) শ্রীকুমারের ভাষায় কলকাতার মধ্যবিত্ত গার্হস্থ্যজীবনের অপূর্ব রসসমৃদ্ধ আলেখ্য এবং শেষ কয়েকটি পৃষ্ঠায় চেতনাপ্রবাহের নিরীক্ষা প্রশংসিত হয়েছে । ১৯৫১র পরবর্তী উপন্যাসে পাই বিচ্ছিন্নতাবোধ, যুগযন্ত্রণা নিজস্ব নির্জন দ্বীপে বিচরণ - গোলাপ কেন কালো, পাতাল থেকে আলাপ প্রভৃতিতে । অলোকরঞ্জন `মৌলিনাথ' উপন্যাস প্রসঙ্গে জয়েস-এর Portrait of the Artist as a Young Man মনে পড়ার, এবং সঙ্গে সঙ্গে প্রেক্ষণ বিন্দুর ভিন্নতার কথাও বলেছেন ।

    মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসের সংখ্যা ৩৭, অসমাপ্ত ২ । মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর উপন্যাসকে গোপিকানাথ রায় চৌধুরী বাস্তবচেতনার দিক থেকে তিনটি কালক্রমিক পর্যায়ে ভাগ করেছেন । ১ম - দিবারাত্রির কাব্য (১৯৩৫) থেকে প্রতিবিম্ব (১৯৪৩), ২য় - দর্পণ (১৯৪৫) থেকে সার্বজনীন (১৯৫২) । ৩য় - আরোগ্য (১৯৫৩)- পরবর্তী । গোপিকানাথ ও পার্থপ্রতিম দেখান বাস্তবতা অন্বেষণের পথ মানিকের ক্ষেত্রে বহুমুখী, জটিল ও বহুধা বিভক্ত । বাস্তবতাবোধ ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি যুক্ত করতে চেয়েছেন প্রথম থেকে, তবে ন্যাচারালিস্ট এর মতো নয় । তাতে নিরুচ্ছ্বাস ভাষারীতি, নিরাসক্ত বিশ্লেষণদৃষ্টি । পদ্মানদীর মাঝি এবং পুতুল নাচের ইতিকথা - তাঁর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস । `জননী' উপন্যাসে শ্যামা জননীরূপের মধ্যে নিজেকে সম্পূর্ণ বিলিয়ে দিয়েছে, কারণ এর বঞ্চিত বধূসত্তা । এ উপন্যাস থেকেই আমরা পাব - নরনারী সম্পর্কের গূঢ় জটিলতা, অর্থনীতি নিয়ন্ত্রিত প্রেম । `দিবারাত্রির কাব্যে' রূপক সৌন্দর্যের সঙ্গে কাব্যসুরভির সংমিশ্রণ ঘটেছে জীর্ণ যুব চিত্তের প্রেম চেতনায় । লেখকের রহস্যপ্রীতি এ পর্বের অনেক লেখাতেই । `পদ্মানদীর মাঝি' আঞ্চলিক উপন্যাস নয়, তাতে কুবের মাঝির আবেগ ও কামনা, প্রেমের জটিল রহস্যে বিচিত্রস্বাদে প্রকাশিত । গ্রামীণ জীবন-আবহের বিশ্বস্ত চিত্রণ আছে । `পুতুলনাচের ইতিকথা'র নায়ক শশী মানুষের দেহ ও মনের বিচিত্র ব্যাধির তাত্পর্যকে জীবনবোধের এক গভীরতর প্রেক্ষাপটে বুঝতে চেয়েছে । বেশ কয়েকটি গ্রামীণ চরিত্রের দু:খ সুখ আকাঙ্খা ও বঞ্চনার বাস্তবতা পাই এখানে । `দর্পণ' পরবর্তী উপন্যাসগুলোতে আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং আন্দোলনের কঠিন বাস্তবতা । চিন্তামনি, চিহ্ন, জীয়ন্ত, স্বাধীনতার স্বাদ প্রভৃতিতে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার এ দেশীয় প্রয়োগের চেষ্টা আছে । যদিও অনেক সময় উদ্দেশ্য বা তত্ত্ব মানুষের পোশাক পরানো রূপে স্থাপিত । জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ, প্রচারধর্মিতা চোখে না পড়ে পারে না । ৩য় পর্বে - শ্রেণী সংগ্রামের কাহিনীর চেয়ে কিছুটা প্রথম পর্বের মতো, ব্যক্তিকেন্দ্রিক চারিত্রিক জটিলতা ও মনোবিশ্লেষণের ওপর লেখক জোর দিতে চেয়েছেন । চরিত্রগুলি প্রধানত: - নিম্নবিত্ত কেরাণী, শ্রমিক বা কৃষক । `নাগপাশ' উপন্যাসে ধর্মঘট, সামাজিক বৈষম্য নিয়ে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে চাকরি হারানো, বেকার সমস্যা - তার পাশে প্রেমের মনস্তত্ত্ব সৃষ্টির প্রয়াস ।

    উপন্যাস সংখ্যার দিক থেকে আশাপূর্ণা সর্বোচ্চ - আড়াইশো । প্রথম উপন্যাস ১৯৪৪-এ । দীর্ঘকাল তিনি সমালোচনা সাহিত্যে গুরুত্ব পাননি, সম্প্রতি তাঁর গল্প উপন্যাস নিয়ে কিছু তাত্পর্যপূর্ণ ভাবনার সূত্রপাত হয়েছে । তাঁর উপন্যাস সমূহের মধ্যে প্রথম প্রতিশ্রুতি, সুবর্ণলতা, বকুলকথা - পাঠক সমাজে তুমুল আলোড়ন তুলেছে । উপন্যাসের পটভূমি কলকাতা শহরের এক মধ্যবিত্ত পরিবার, যাদের আভিজাত্য নেই, অহঙ্কার আছে । সত্যবতী, সুবর্ণলতা বকুল এই তিন নায়িকাকে সামনে রেখে তিনি বাঙালি ঘরের মেয়েদের দু:সহজীবন, নিদারুণ অসহায়তা যেমন দেখান তেমনি তাদের প্রতিবাদিনী রূপটি সমুজ্জ্বল হয়ে ওঠে । প্রমথ নাথ বিশীর মতে - `অতীত অনতি-অতীত, বর্তমান ও আসন্ন ভবিষ্যত্‌' - একই সূত্রে এই তিনটি গ্রন্থে বিধৃত হয়েছে । নবনীতা দেবসেনের ভাষায় - আশাপূর্ণার `এলেম' বিশ্বসাহিত্যের নারী লেখিকাদের মধ্যে অনন্য । জয়া মিত্র বলেছেন - `রান্নাঘরের লেখিকা, মেয়েলি লেখা, মেয়েমহলের আরশি - এই যেন আশাপূর্ণা । অথচ খতিয়ে দেখলে এসব তিলকই তাঁর সৃষ্টির প্রকৃত অভিজ্ঞান, অহংকার । তিনি মেয়েদের কথা লিখেছেন একজন মেয়ের চোখ থেকে, মেয়ের মন থেকে, পুরুষতন্ত্রের উল্টো স্রোতে দাঁড়িয়ে । বাংলা ভাষায় নারী চেতনাবাদের পূর্বমাতৃকা তিনিই ।' আশাপূর্ণা `সুবর্ণলতা'র ভূমিকায় বলেছেন - `সমাজ বিজ্ঞানীরা লিখে রাখেন সমাজ-বিবর্তনের ইতিহাস, আমি একটি কাহিনীর মধ্যে সেই বিবর্তনের একটি রেখাঙ্কনের সামান্য চেষ্টা করেছি মাত্র ।' তাঁর `যুগান্তের যবনিকা পারে' উপন্যাসের পণ্ডিত সোমনাথ বহুবিবাহ ও অন্যান্য সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়েও সন্তান লাভের জন্যই দ্বিতীয় বিয়েতে আগ্রহী হয় । `বহিরঙ্গ' উপন্যাসের অরবিন্দ বহুজনমঙ্গলে সক্রিয় হলেও নি:সঙ্গতার শুশ্রুষা পায় বন্ধুপত্নী বিধবা নমিতার কাছে । `লঘুত্রিপাদী'তে আছে নারী পুরুষ পারস্পরিক সম্পর্কের টানাপোড়েনের মধ্যে মৌলস্বভাব সন্ধান, `শুক্তিসাগর' - এ তের বছরের কিশোরকে কেন্দ্র করে তিরিশ বছরের নারীর আকর্ষণ । আশা রাখি, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম - আশাপূর্ণার কথাসাহিত্য বিচারে প্রবৃত্ত হবেন - পাঠ্যসূচির যান্ত্রিকতা মুক্ত হয়ে এবং অন্যান্য নারী লেখিকাদের রচনার সঙ্গে তুলনা ক'রে ।

    ছোটগল্পের জগতে তিনজনই মনোযোগ কেড়ে নেন রচনা সামর্থ্যের গুণেই । চৌত্রিশটি ছোটগল্পের বইতে বুদ্ধদেব বড়োদের ছোটদের জগত্কে তুলে ধরেছেন । রবীন্দ্রনাথ `বাসর ঘর' পড়ে মন্তব্য করেছিলেন - (যদিও এটি উপন্যাস) - `এ কবির লেখা গল্প, আখ্যানকে উপেক্ষা করে বাণীর স্রোত বয়ে চলেছে ।' উদ্ভাবনী শক্তির দুর্বলতার কথা নিজেই স্বীকার করেন । তাঁর গল্পে প্রাধান্য পেয়েছে স্বপ্ন ও সৌন্দর্য, আশা ও ভালোবাসা । উপন্যাসের মতো গল্পেরও প্রধান উপাদান - ভালোবাসা - আর নস্টালজিয়া । গল্পের `উজ্জ্বল প্রসাধিত ভাষা', তার বেগবত্তা, তার আলঙ্কারিকতার অপূর্বত্ব যেমন আমাদের মুগ্ধ করে তেমনি আঙ্গিক বৈচিত্র্য, অর্থাৎ - নাট্যরীতি, পত্ররীতি, আত্মকথনরীতি, প্রথম পুরুষের উক্তি (মেজাজ) প্রভৃতি পাঠকের কৌতূহল বাড়ায় । আদর্শবাদের অপমৃত্যুতে বেদনাবোধ এবং শেষ পর্যায়ের গল্পে বিচ্ছিন্নতার বিপদ তিনি ফুটিয়ে তোলেন অতুলনীয় ভঙ্গিতে ।

    মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প সংকলন, শ্রেষ্ঠগল্প স্বনির্বাচিত ইত্যাদি বাদ দিলে সতের, তবে অগ্রন্থিত ৮২টি গল্প পাওয়া গেছে । বাংলা ছোটগল্পের এলাকায় বুদ্ধদেব বসুর মতো মানিকও এক অনন্যশিল্পী - শিল্পধর্মে নিষ্ঠ, প্রায় মজুরের মতো নিষ্ঠ, যদিও জীবনযাপনে, অর্জিত বীক্ষায় দুজনের পার্থক্য আছে । তিনি, মানিক শুরু করেছিলেন যুক্তিবাদী মন, বস্তুনিষ্ঠা এবং অভিজ্ঞতার ঐশ্বর্য নিয়ে - তাতে আদিম বলিষ্ঠ জীবনউল্লাস ও মনোবিকলনের জটিলতা, মধ্যবিত্তের অন্ত:সারশূন্যতায় নিরাসক্ত ঘাতকের ভূমিকা - পাঠককে চমকে দেয় । প্রাগৈতিহাসিক, সরীসৃপ, সমুদ্রের স্বাদ, আততায়ী স্তর পার হতে হতে লেখক ও পাঠক পৌঁছে যায় হারাণের নাতজামাই, ছোটবকুলপুরের যাত্রী, শিল্পী, ছিনিয়ে খায় নি কেন - প্রভৃতিতে । উত্তর কালের গল্প, স্বীকার করা ভালো, প্রাচুর্যময় হলেও ঐশ্বর্যময় হয়নি, তবে - `এ সব গল্প সমকালীন বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক মহাসংহিতা' - নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের এই মন্তব্য শিরোধার্য বলে মনে করি ।

    আশাপূর্ণা দেড়হাজারের মতো গল্প লিখেছেন, বলেছেন - উপন্যাস আমাকে অনেকটা প্রতিষ্ঠা এনে দিয়েছে, তবু ছোটগল্পের ওপরেই আমার পক্ষপাত ।' একটা প্রশ্নমুখর মন ও দেশকাল সচেতনতা নিয়ে আশাপূর্ণা লিখে ফেলেন দেশভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা; ঘরভাড়া দেওয়া না দেওয়া নিয়ে গল্প (উদ্বাস্তু, পাকা ঘর), সমকালীন রাজনীতি নিয়ে গল্প (পদাতিক, স্নেহ, অঙ্গার বা খুন), অষ্টমঙ্গলায় বিধবা হয়ে যাওয়া তরুণীর নি:সহায়ত্ব (প্রগল্ভা), নারীর ভালোবাসা, নির্ভরতা, স্বনির্ভরতার গল্প (দ্বন্দ্ব, দৃষ্টি), নারীমনের বিচিত্রতা নিয়ে নানা টুকরো অনুভবের গল্প (টেক্কা, অনর্থ, আশাভঙ্গ, নিরূপমা), প্রৌঢ়া জীবনে বসন্ত (গুন্ঠনবতী), ঠিকানা সন্ধানী নারী (শুধু একটি ঠিকা), আশ্রয়প্রার্থী নারী (ইজ্জত), ব্যাঘ্র গর্জনকারী গৃহকর্তা (জালিয়াত), বার্ধক্যের বেদনা (নিজের জন্য শোক) - কত বিচিত্র ভাবেই না নিম্ন বা মধ্যবিত্তকে দেখেছেন, তার তুলনা নেই । এই রাজ্যে তিনি কোনো নারীবাদী তত্ত্বাশ্রয়ী নন, কোনো বিশ্বদর্শন রূপাগ্রহী নন, প্রশ্নমনস্ক ও নি:শব্দ প্রতিবাদী মনকে লালন ক'রে গল্পের পর গল্প লিখে গেছেন । আর তাঁর ছোটদের জন্য লেখা গল্প - ছোটঠাকুর্দার কাশীযাত্রা, নিবারণের বারণ, ভীমসেন ঘটোত্কচ সংবাদ, বাবা খলেশ্বর - এ এক বিরল হাসি ও মমতার আলোক উজ্জ্বল জগৎ - বুদ্ধদেবের ছোটদের লেখাও মনে পড়ে ।

    আশাপূর্ণার প্রথম প্রকাশিত লেখা কবিতা - বাইরের ডাক (শিশুসাথী, চৈত্র ১৩২৯), পরে একঝুড়ি লিখেছেন লোকে সেগুলোকে তাচ্ছিল্য করে `পদ্য' আখ্যা দেওয়ায় অভিমান হয়, কবিতা লেখা ছেড়ে দেন । মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কবিতা লিখেছেন বেশ কিছু, একটি সংকলন গ্রন্থ-ও আছে, তবে সমাদৃত হয়নি । কারণ - প্রচলিত কাব্যসংস্কারের থেকে ভিন্নতা, এবং কাব্য কল্পনা অনুভবের ভিন্নতর প্রকাশরীতির সীমাবদ্ধতা । সে তুলনায় এবং আরো কিছু প্রাসঙ্গিক কারণে বুদ্ধদেব বসু কবিতা রচয়িতা হিসেবে পাঠকদের মধ্যে যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছেন । প্রাসঙ্গিক কারণগুলি হল - প্রগতি ও `কবিতা' পত্রিকা সম্পাদনা, বঙ্গীয় কবিকুলের কবিতার স্বীকৃতি, আবিষ্কার, প্রচার ইত্যাদিতে বুদ্ধদেবের অবদান বিস্ময়কর । কবিতা বিষয়ক একাধিক প্রবন্ধ রচনাও এই প্রাসঙ্গিকতার অন্তর্গত । `মর্মবাণী' (১৯২৪), তাঁর প্রথম কবিতার বই থেকেই তিনি রোমান্টিকতার অনুবর্তী । প্রথম বইয়ের কৈশোরক রচনাতেই ছিল কবিতাপ্রীতি, নিজস্ব ভাষাছাঁদ আবিষ্কারের স্পৃহা । `বন্দীর বন্দনা' (১৯৩০) একটি উল্লেখযোগ্য বই, যেখানে কামনার কারাগারে বন্দী মানুষের তীব্র ছটফটানি, জৈব আর্তনাদ, কবিভাষার স্বতন্ত্র স্বর - শাপভ্রষ্ট কবি প্রতিভার পরিচয়কে প্রতিষ্ঠা দিল । `কঙ্কাবতী'তে (১৯৩৬) প্রেমের উল্লাস উচ্চকন্ঠ, তীব্র উন্মাদনায় প্রেমিকার নামোচ্চারণ বন্ধনহীন । `দময়ন্তী'র কবিতা ও ইস্তাহার কাব্যরচনাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে একথা কবিই বলেছেন, যদিও আবেগতাড়না এখানেও । `শীতের প্রার্থনা : বসন্তের উত্তর' থেকে প্রৌঢ় প্রেম, যৌবন চলে যাওয়া ও রূপতৃষ্ণার তীব্রতা ভিন্নসুর বহন করে আনল । `যে আঁধার আলোর অধিক' বইয়ের অধিকাংশ কবিতাই সনেট বা সনেটকল্প, মননপ্রধান সংহত ভাষা বিন্যাসে রূপায়িত হল - এক ধরনের শিল্পমনস্কতা, শিল্প ও প্রকৃতির সম্পর্কজনিত থীম । তাঁর কবিজীবন প্রথমাবধি প্রেম ও কবিতা-প্রত্যয়ের নব নব রূপান্তরের সৃজনে পূর্ণ, বললে অত্যুক্তি হয় না ।

    আমি বলতে পারবো না, আশাপূর্ণা কোনো নাটক লিখেছিলেন কি না, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় একটি নাটক লেখেন (ভিটেমাটি) কিন্তু বুদ্ধদেব বসুর অনেকগুলি নাটক, নাটিকা, নাট্যরূপ, কাব্যনাট্য আছে, নাটক অভিনয়ের একটি স্থায়ী দল গড়ার স্বপ্নও ছিল তাঁর । পাঁচটি নাটক মহাভারত উত্স থেকে উত্সারিত, তার মধ্যে `তপস্বী ও তরঙ্গিনী' (১৯৬৬), প্রথম পার্থ বোধহয় বেশি বিখ্যাত । তিনি পুরাণের পুনর্ব্যবহার করেছেন, পুরাণসূত্র সম্প্রসারিত করেছেন, বিশ শতকী আধুনিক ভাবনার সঞ্জীবন এনেছেন, তবে পুরাণকে বিকৃত করেননি । গ্রীক মিথের ব্যবহার আছে `কলকাতার ইলেকট্রা' নাটকে আর `পাতা ঝরে যায়', `নেপথ্য নাটক' প্রভৃতি নাটক যথেষ্টই মঞ্চসফল । এই সূত্রেই বলে নেওয়া যাক - `মহাভারতের কথা' নামক বিরল বিস্ময় বইটির কথা, যাতে মহাকাব্যের সাহিত্যিক বিচারে মনস্বিতার পরিচয় আছে পদে পদে ।

    আশাপূর্ণা প্রাবন্ধিক হিসাবে খ্যাত নন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ও নন, যদিও `লেখকের কথা' এবং আরও কিছু প্রবন্ধ আমরা সকলেই পড়েছি । কিন্তু বুদ্ধদেব বসু প্রাবন্ধিক হিসাবে যথেষ্টই গুরুত্বপূর্ণ । `কালের পুতুল' (১৯৪৬) থেকে যাত্রারম্ভ, অবশ্য গ্রন্থিত হিসেবে । তার কিছু প্রবন্ধ কবি, কবিতা, সাহিত্যিক প্রতিভার পরিচয় ও বিচার, কোথাও আছে ভাষা বা স্বাদেশিকতার প্রসঙ্গ, কখনো বিদেশী সাহিত্য সাহিত্যিক প্রসঙ্গ, এমনকি রেমব্রার চিত্রকলা বা চ্যাপলিনের চলচ্চিত্র । তাঁর রান্না বিষয়ক অসামান্য রচনাগুলি এই রন্ধনশাস্ত্রে তাঁর নিবিড় মনস্কতার পরিচয় বহন করে । এবং আছে কবিতা বিষয়ক রচনাদি আর রবীন্দ্রনাথ - তাঁকে, তাঁর রচনাবলী নিয়ে, তাঁর কবিতা ছোটগল্প, উপন্যাস নিয়ে প্রবন্ধগুলি - বাংলায় এবং ইংরেজিতে - বহুবার পাঠের এবং অব্যাহত আকর্ষণের ক্ষমতা রাখে । বাংলার মতো ইংরেজিতেও তিনি সমান পারদর্শী । রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক বইটি Potrait of A Poet এবং বাংলা সাহিত্য বিষয়ক An Acre of Green Grass অদ্যাবধি জনপ্রিয় । প্রবন্ধের বক্তব্য নিয়ে মাঝেমধ্যে বিতর্ক হয়েছে, মতভেদ আসা স্বাভাবিক, কিন্তু উপস্থাপনের প্রাঞ্জলতা এবং উপকরণের আন্তর্জাতিক বিন্যাসে পাঠকদৃষ্টিকে নতুন প্রেক্ষা দেয় ।

    আশাপূর্ণা বা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোনো ভ্রমণ কাহিনীর কথা আমি জানি না, কিন্তু বুদ্ধদেব লিখেছেন - সমুদ্রতীর, আমি চঞ্চল হে, সব পেয়েছির দেশে, জাপানী জার্নাল, দেশান্তর । এগুলি স্বদেশ ও বিদেশ অভিজ্ঞতা সম্বলিত নিছক বিনোদন বা কাজের তাগিদে বেড়ানোর অপূর্ব রচনা, কালানুক্রমিক তথ্যনির্ভরতার পরিবর্তে অনুভবের স্তরান্তর অনিন্দ্য ভাষায় তুলে ধরেছেন বুদ্ধদেব, যা বারবার পাঠ করা যায় । এই সূত্রে উল্লেখ করি তাঁর অনবদ্য তিনটি স্মৃতিকথা - আমার ছেলেবেলা, আমার যৌবন, আমাদের কবিতাভবন । স্মৃতিকথাত্রয়ী শুধু সাহিত্যিক বুদ্ধদেবের নয় সমসাময়িক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের বিকাশের কথা তুলে ধরে বলেই আস্বাদ্য, এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় হয়ে আছে ।

    সবশেষে উল্লেখ করব - বুদ্ধদেবের অনুবাদ সাহিত্যের কথা । আশাপূর্ণা অনুবাদে হাত দেন নি, মানিকের একটি চীনা গল্পের অনুবাদের কথা জানি । কিন্তু বুদ্ধদেব এক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন । অনুবাদ তিনি শুরু করেছিলেন `প্রগতি'র কাল থেকেই । তারপর, অস্কার ওয়াইল্ড এর গল্প (হাউই), রূপান্তর, পিরানদেল্লোর গল্প, স্বার্থপর দৈত্য, কালিদাসের মেঘদূত, শার্ল বোদলেয়র : তাঁর কবিতা, পাস্তেরনাকের কবিতাগুচ্ছ An Anthology of Bengali Writing হেল্ডারলীন রিলকে অনুবাদ প্রভৃতি একের পর এক বেরিয়েছে । বোদলেয়র এবং রিলকে অনুবাদ দীর্ঘকালীন অনুশীলনের ফল । পরবর্তী বাংলা কবিতা এই অনুবাদের অভিঘাতে নানাভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে একথা অস্বীকার করার নয় ।

    এডওয়ার্ড সাইদ বলেছিলেন - গণনীয় বুদ্ধিজীবী তিনিই, যিনি কোনো একটা বার্তা, একটা দৃষ্টিকোণ, একটা প্রবণতা, একটা দর্শন অথবা একটা মতামত উচ্চারণের দ্বারা জনমণ্ডলীকে আলোড়িত করার প্রতিনিধিত্বের ক্ষমতা ধরেন । বুদ্ধদেব, মানিক, আশাপূর্ণা, সন্দেহ নেই এমন তিন মহৎ প্রতিনিধি । (Representations of the Intellectual) রবীন্দ্র শতবার্ষিকীর বছরে একটি প্রবন্ধে বুদ্ধদেব রবীন্দ্রনাথকে পুশকিন বা গ্যেটের সঙ্গে তুলনা ক'রে মন্তব্য করেছিলেন - "বৃহৎ জগতে তাঁর পুনরুজ্জীবনের কাজটি আরম্ভ করার পক্ষে এর চেয়ে সুসময় আর কী হতে পারে ?" (দুই রবীন্দ্রনাথ : আসলে এক) রবীন্দ্র পুনরুজ্জীবন প্রসঙ্গে বুদ্ধদেবের এই মন্তব্য আমরা ব্যবহার করতেই পারি শতবার্ষিকী সমারোহে এই তিন বরেণ্য বাঙালি সাহিত্যিক প্রসঙ্গে । কোনো চাপে পড়ে নয়, কোনো প্রলোভনের শিকার হয়ে নয়, স্রেফ বিবেকের তাগিদে আমরা এঁদের রচনাবলীর পাতা যদি ওল্টাতে শুরু করি তাহলে অনেক অনেক অনেক তাত্পর্যপূর্ণ আলোকপাত, জরুরী অভিঘাত সংগ্রহ করতে পারবো, আমরা, বিদ্যার্থীরা ।

    (পরবাস-৪৩, জুলাই, ২০০৯ )

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments