• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪২ | ডিসেম্বর ২০০৮ | গ্রম্থ-সমালোচনা
    Share
  • দরবারি স্বপ্নপুরাণ : রুনা বন্দ্যোপাধ্যায়

    রাজপাট , তিলোত্তমা মজুমদার ;আনন্দ, কলকাতা; ২০০৭; পৃ: ৮০৮; ঝনজব্‌: ৯৭৮-৮১-৭৭৫৬-৭৩৬-৬


    তিলোত্তমা মজুমদারের "রাজপাট" উপন্যাস যেন এক দরবারি স্বপ্নপুরাণ । এই স্বপ্ন রঙিন নয়, বরং মানুষের ব্যথাদীর্ণ জীবন বুনে নকশিকাঁথার স্বপ্ন, সব হারিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন । এই পুরাণ প্রাচীন ইতিবৃত্ত নয়, বরং আবহমানকালের মূল্যবোধ থেকে জীবনবোধে উত্তরণের ইতিবৃত্ত । আর এই স্বপ্নপুরাণ ঘটেছে মানুষেরই দরবারে । সেই উপন্যাসের সমালোচনা নয়, শুধু অনুভবে পিছু ফেরা আর পাঠের আনন্দকে স্পর্শ করা । শুধু উপন্যাসের পাতায় পাতায় ঘুরে ঘুরে মানুষের দর্পণে জীবনকে ফিরে দেখা ।

    যদিও তিলোত্তমার প্রথম উপন্যাস "ঋ" প্রকাশিত হয় ১৯৯৬ সালে, তাঁর উপন্যাসের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ২০০১ সালে, যখন "বসুধারা" ধারাবাহিকভাবে বেরোতে শুরু করল "দেশ" পত্রিকায় । মাথুরের গড়কে কেন্দ্র করে উচ্চবিত্ত , মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত মানুষের বিশ্বাস, সংস্কার, রাগ, দ্বন্দ্ব , প্রেম ও বেদনার সমন্বয়ে গঠিত সেই জীবনসংগ্রামের আলেখ্য আমাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল এক আবহমানকালের মঙ্গলধারার সামনে । ধরিত্রীর বুকে স্পন্দিত এক সামগ্রিক জীবনধারার সেই অপরূপ রূপায়ণের সামনে আমার মুগ্ধতার শুরু । তারপর "চাঁদের গায়ে চাঁদ", "শামুকখোল", "একতারা" ইত্যাদি অসামান্য উপন্যাসগুলির হাত ধরে পৌঁছে গেলাম তাঁর নবম উপন্যাসের পাতায়, যখন ২০০৬ এর এপ্রিলে "রাজপাট"-এর ধারাবাহিক প্রকাশ শুরু হল "দেশ" পত্রিকায় ।

    ধ্বংসের মধ্যে যে সৃষ্টিবীজ নিহিত থাকে, তারই উন্মোচন দেখি তিলোত্তমার "রাজপাট" উপন্যাসে । শুরু থেকেই উপন্যাসের অন্তরমহলে খুব মৃদু লয়ে ধ্বনিত হয়েছিল অনাগত ধ্বংসের পদধ্বনি । ভৈরব নদীর ভাঙনকে কেন্দ্র করে মানুষের তথা সমাজের আলেখ্য রচনা করেছেন তিলোত্তমা, যে সমাজ কেন্দ্রীভূত হযেছে মুর্শিদাবাদের গ্রাম ও শহর অঞ্চলের সীমানায় । ময়না বৈষ্ণবী , দুলুক্ষেপা, বলাই মণ্ডল, ইদরিশ, আফসানা, শিখা, মোহনলাল, নয়াঠাকুমা, মির্জা প্রভৃতি চরিত্রগুলির অন্তরের টুকরো টুকরো স্বপ্নগুলোকে স্পর্শ করতে করতে, মানবিক সত্যের প্রেক্ষাপটে চরিত্রগুলির গভীর চেতনার উন্মেষের মধ্যে দিয়ে এবং সিদ্ধার্থের মত ব্যতিক্রমী চরিত্রভাবনায় "রাজপাট" অঞ্চলের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে যায় । উপন্যাসের সংজ্ঞা দিতে গিযে তিলোত্তমা বলেছিলেন, "যেন একটা জানলা । এই জানলার ফ্রেমে যতটুকু ধরা পড়েছে, সেটাই উপন্যাস ।" সাহিত্যের এই জানলা দিযে যে-জীবনকে তিনি উপলব্ধি করেছেন এবং বিভিন্ন চরিত্রের সমবায়ে গড়ে তুলেছেন যে পূর্ণাঙ্গ সমকালীন উপন্যাস, তা বর্তমানের প্রেক্ষাপটে রচিত হলেও ব্যাপ্তি তার বহুদূর প্রসারিত । সমসময়ের বিক্ষুব্ধ রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে মুখ ফেরানো ইতিহাস চর্চা করেননি লেখক । বরং বর্তমানের নীতিহীন রাজনীতিকে ঘিরে যে চরিত্রগুলির আবর্তন দেখি, সেখানে পাঠক অনায়াসে জীবনের গ্লানিগুলোকে চিনতে চিনতে মিশে যায় এক প্রচলিত জীবনপ্রবাহে, যেখানে হিন্দু মুসলমান গায়ে গা লাগিয়ে একই মাটিকে মা বলে ডাকে । আর তারই পাশাপাশি গৌণধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষগুলির নিত্যদিনের জীবনসংগ্রাম, হাসি-কান্না আর সহজ মনুষ্যত্বের বোধ আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় এক অনন্য জীবনবোধে ।

    উপন্যাস যখন শুরু হল, দেখি ময়না বৈষ্ণবী সেফটিপিন লাগানো ছেঁড়া হাওয়াই চটি ঘষটে ঘষটে পথ চলেছে । প্রেমজুরি হাতে একা একা তার চলন আর মাধুকরী । ভারি আর খসখসে কন্ঠ সুমধুর না হোক সে যখন সুরের সঙ্গে ভাবের মেলবন্ধন ঘটিযে আখর ধরে, তখন টান পড়ে ভাবের ঘরে । নিবিড় করে জড়িযে ধরে ভালবাসায় । মন বলল, "বৈষ্ণবী, তোমার প্রেমজুরিতে প্রেম বাজে না প্রেমেতে বাজে প্রেমজুরি ।" বৈষ্ণবী তার গান নিযে বিশ্বজোড়া প্রেমে অধীর । সে বিশ্বজনীনতা হযত মুর্শিদাবাদের তেকোনা, চতুষ্কোনা আর কালান্তরের গ্রামগুলির সীমানায় বাঁধা । তবু সে যে মানুষের চোখে রঙ লাগায় । গ্রামের মানুষগুলো তার ছায়ায় এসে দুদণ্ড জিরোয় । তাদের প্রাত্যহিকতার নৈরাশ্য আর বিষাদের ছায়ামগ্ন চোখে সে মায়াঞ্জন লাগায় । এভাবেই "রাজপাট" উপন্যাসে একেবারে নায়িকার মত আবির্ভাব ঘটল ময়না বৈষ্ণবীর । আর আপন মৃত স্বামীর স্মরণে যখন সে বলল,

    "পুরুষকে কামে চিনলে হয় না । তাকে স্নেহে চিনতে হয় । সেখানেই আছে তার প্রেমের আখর । সেখানেই দেওয়া যায় সকল হৃদয় । নইলে হৃদয় দেবে কিসে ? বিষে আর সর্বনাশে ? তা কি আর হয় ? হৃদয় কি বিষে দেবার জিনিস ?"
    তখন আমার প্রেমের পারে একেবারে ভরাডুবি ঘটল । সমস্ত মন প্রাণ জিনে নিল ময়না বৈষ্ণবী । বৈষ্ণবীর পাশে দেখি গায়ে আলখাল্লা, চুড়ো করে বাঁধা চুল আর দোতারা হাতে মধ্যচল্লিশের আশ্চর্য আলোচ্য যুবক দুলুক্ষ্যাপা । রমণীমোহন সে, তার অপরূপ বাউলাঙ্গ রূপে আর সুরে জয় করে নিল মন । নারী, গান আর বাউলপনা নিয়ে সে বাঁচে নিজের রকমে । কেমন সে বাঁচা ? শুনি বরং লেখকের কলমে,
    "দুলুক্ষ্যাপা ঘরে থাকার চেয়ে অধিক পছন্দ করে খোলা আকাশের তল । আকাশকে সে কল্পনা করে নারী, বাতাসকে সে কল্পনা করে নারী । এই ভূপৃষ্ঠ সেও তার চোখে নারী । সে সারাক্ষণ থাকে নারীতে সমর্পিত প্রাণ এক কল্পনার জগতে । আর গায় । তার ভাবনক্রিয়া এক অসীম বিস্তারে বিছিয়ে থাকে সারাক্ষণ । সৃষ্টিরহস্যের সন্ধান করতে করতে তার রাত্রি ভোর হয় । লোকচরিত্র অনুধাবন করতে করতে তার সন্ধ্যা নামে । এ সমস্তে বিশ্বজগতের কোনো কল্যাণবিধান হয় না, কেবল হয় নিজের তুষ্টি ।"
    কিন্তু জগতের সব কল্যাণ তো সোজা রাস্তা ধরে হাঁটে না । কিছু পথ যায় খিড়কির দিকে । তাই তার আত্মতুষ্টিতে অতিতৃপ্তির অতৃপ্তি দেখিনি । কি এক অচিন পাখির ডাকে সে ঘরছাড়া । সে চলেছে মনের মানুষের খোঁজে, যার ঘর তার আপন বুকে । সিদ্ধার্থের পাশে পাশে সে পৌঁছে গেছে সেই সমস্ত মানুষের দরবারে, যেখানে পুড়ে পুড়ে খাক হয়ে যাওয়া দু:খ আর বেদনা থরে থরে সাজানো আছে ।

    আর এই দুলুক্ষ্যাপার প্রিয় নারী ময়না বৈষ্ণবী । দুলুক্ষ্যাপা চোখ বন্ধ করেও ছুঁতে পারে বৈষ্ণবীকে । অথচ বৈষ্ণবী ধরা দিয়েই অধরা হয়ে মিলিয়ে যায় । যৌথ সুন্দরের অলীক ভুবন গড়া হয়নি তাদের । তবু ময়না বৈষ্ণবী রয়ে গেছে দুলুক্ষ্যাপার মনের মানুষ হয়ে । তাদের বিশ্বাস আর চর্চার পথ হয়ত আলাদা তবু যেন কোথায় একপথে মিশে গেছে তাদের চাওয়া পাওয়াগুলো । তাই দুলেন্দ্রের কন্ঠে গান বাজে,

    "শুদ্ধ প্রেমের প্রেমী
    মানুষ যেজন হয়
    মুখে কথা ক'ক বা না ক'ক
    নয়ন দেখলে চেনা যায়"
    কিছু বেদনা আর অপমান নারীর নিজস্ব, যার তল পায় না কোনো পুরুষ । শুধু এক নারী ভাগ করে নিতে পারে অন্য নারীর সঙ্গে । সেই বেদনার ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে তিলোত্তমার কলমে ময়না বৈষ্ণবী এক মূর্তিমতী প্রতিবাদ । না, তার কোনো শ্লোগান নেই, নেই কোনো পতাকার আশ্রয় । সে শুধু গ্রামে গ্রামে ঘরের কোণে কোণে রটনা করে বেড়ায় নারীর লজ্জা অপমান আর অবমাননার চলন্ত ইতিহাস । কারণ লেখক আশা করেন, "হয়ত এই প্রতিবাদ একদিন লক্ষ আগুন হয়ে জ্বলে উঠবে ।" হ্যাঁ, জ্বলে উঠেছিল সেই আগুন । আর সেই আগুনেই অসহ্য নির্মমভাবে ছাই হয়ে গেল আগুনের হোতা, সেই প্রেমময়ী মানুষ, ময়না বৈষ্ণবী । যার মর্মে মর্মে ধ্বনিত হয়েছিল কমলির মত অসহায় মেয়েদের বেদনা । তাই এই নারীর মৃত্যু প্রথমে মেনে নিতে পারেনি মন । তর্ক তুলেছিল, কেন তার এই অদ্ভুত মৃত্যু ? লেখক জবাব দিলেন,
    "সে শুভশক্তি, সে প্রতিবাদী, তাই সে ধর্ষিতা... ময়না বৈষ্ণবী এক উপলক্ষ মাত্র । প্রকৃতপক্ষে যা ধর্ষিত হয়েছে তা প্রতিবাদ । যা হত্যা করা হয়েছে তা শুভবোধ ।"
    উপন্যাসের পর্ব যত এগিয়ে চলেছে ততই প্রমাণিত হয়েছে এই মৃত্যু লেখকের ভবিষ্যৎ নায়কের জন্য একান্তই প্রয়োজন ছিল । কে এই নায়ক ? সিদ্ধার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় । যার প্রথম দর্শনে বৈষ্ণবীর বুকে উথালপাথাল উঠেছিল । যৌবন অতিক্রান্ত বৈষ্ণবীর বন্ধ চোখের তলায় এই তরুণের মূর্তির সঙ্গে তার জাগতিক মৃত স্বামীর যুবক মূর্তি আর ঐশ্বরিক ধ্যেয় স্বামী কৃষ্ণের রূপ মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল । সিদ্ধার্থ আর ময়না বৈষ্ণবী দুজনেই শুদ্ধ প্রেমের প্রেমী । মানুষকে ভালোবাসায় কোনো কৃপণতা ধরে না তাদের মন । তাই বুঝি দর্শনমাত্রই তারা চিনে নিয়েছিল একে অপরকে । সিদ্ধার্থের প্রথম বর্ণনা শুনি ময়না বৈষ্ণবীর দৃষ্টিতে, বৈশিষ্ট্যহীন চেহারায় সাধারণ নাক-মুখ অথচ চোখের দৃষ্টিতে আছে এক ঝলক, এক তেজস্বিতা । তার চওড়া বলিষ্ঠ কাঁধ - জগতের সব ভার বুঝি ওই কাঁধ বয়ে চলতে পারে ।

    সংগ্রাম আর বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষাটুকুই সব । সেখানে সব মানুষই সমান । চরিত্রগুলির পৃথক ব্যক্তিত্ব যে মনুষ্যত্বের কোঠায় পৌঁছয় সেই মানবিক অস্তিত্বের সন্ধান করেছেন তিলোত্তমা মজুমদার । বহির্জগৎ থেকে লেখক যেন চরিত্রগুলির অন্তরজগতে প্রবেশ করেছেন । ময়না বৈষ্ণবীর নির্মম মৃত্যু নাড়িয়ে দিয়েছিল সিদ্ধার্থের রাজনৈতিক বিশ্বাসের ভিত । বৈষ্ণবীর উপর সংঘটিত নৃশংস ধর্ষণ, অমানবিক অত্যাচার জীবনের নীতি নির্দ্ধারণে বার বার সিদ্ধার্থকে দ্বন্দ্বে উপনীত করেছে । এক রাজনীতিজ্ঞের দ্বন্দ্বে । আপন কর্ম ফিরে দেখার দ্বন্দ্বে । "রাজপাট" উপন্যাসে আছে এক বিরাট রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট । মুর্শিদাবাদের গ্রামগুলিকে ঘিরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলির টানাপোড়েনের সার্থক রূপায়ণ দেখি তিলোত্তমার কলমে । তবু "রাজপাট" উপন্যাসকে রাজনৈতিক আখ্যা দিতে মন চায় না । বরং রাজনীতির মূল তত্ত্বগুলি উপস্থাপন করে লেখক সেই নীতির আড়ালের মানুষটিকে রূপ দিতে চেয়েছেন । সেখানে নীতির পাশেই বসত করে দুর্নীতি । সেখানে যেমন আছে রাসুদার মত অভিজ্ঞ মানুষ তেমনি আছে মিহির রক্ষিতের মত সুবিধেবাদী । নীতির পাশাপাশি বসত করে সম্পূর্ণ বেআইনি এবং অসৎ কাজের হোতা মির্জা । ন্যায়ত যার কার্যকলাপকে সমর্থন করার কথা নয়, তবু সে সিদ্ধার্থের অন্যতম শক্তি এবং ভরসাস্থল । জীবনের এই বৈচিত্র্যই প্রমাণ করে সত্য সরল হলেও জটিল, সত্য স্বচ্ছ হলেও দুর্বোধ্য । আর এই সত্যের দরজায় দাঁড়িয়ে সিদ্ধার্থ স্বপ্ন দেখে দেশ গড়ার, যে দেশে মির্জার অসামান্য পরিচালন ক্ষমতাকে চোরাচালানের পথে অযথা ব্যায় না করে প্রয়োগ করবে দেশের কাজে ।

    একদিন সাম্যবাদের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে সিদ্ধার্থ নিজেকে পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে নিযুক্ত করেছিল । সে বিশ্বাস করেছিল "সাধারণ মানুষের ভূয়োদর্শন ও বীক্ষা থেকেই তৈরি হয় পথনির্দেশ । জনমতকে উষ্ণিষ করে পথ চলার নামই নেতৃত্ব ।" কিন্তু সেই পার্টিই যখন দুর্নীতির ঘোরে পথ হারিয়ে ফেলছিল তখন সে দলত্যাগ করল বটে কিন্তু আঁকড়ে রইল তার সাম্যবাদের মন্ত্র । সিদ্ধার্থ বিশ্বাস করত নেতৃত্বের জন্য অস্ত্রধারণের প্রয়োজন নেই । মানুষই মানুষের শক্তি । তাই মানুষের প্রতি ভালোবাসা আর সহমর্মিতা নিয়ে তার কল্যাণসাধনের পথেই সে জয় করতে চেয়েছে মানুষকে । তবু দেখি আঘাতে সংঘাতে পথ চলতে চলতে সিদ্ধার্থের বিশ্বাস মাঝে মাঝে টলমল করে উঠেছে,

    "উদ্যত অস্ত্রের মুখ নমিত করতে অস্ত্রই কি একমাত্র পথ্থ নয় ? অপশক্তি ক্ষমতাশালী হয়ে উঠলে কল্যাণকে হতে হবে আরো বেশি ক্ষমতাবান । ক্ষমতাকে ক্ষমতা দিয়েই পরাজিত করা সম্ভব । আদিম এ নিয়ম । কিন্তু সত্য ।"
    লেখক বিশ্বাস করেন ব্যক্তিসত্তা ও ব্যক্তির অভিজ্ঞতার ত্রক্রমপ্রসারিত বিবর্তনে । এই বিবর্তনের পথে যেমন আছে তার কর্মজীবন, তার আদর্শ, তার জীবনপাঠ, তেমনি থাকে বুঝি ব্যক্তির মন ও মননের গঠনশৈলীর ত্রক্রমবিকাশ । ময়না বৈষ্ণবী প্রতিদিন একটু একটু করে অসামান্যা হয়ে উঠেছে সিদ্ধার্থের অন্তরে । বৈষ্ণবীকে শুভশক্তির প্রতীক ধরেই সে এগিয়ে চলেছে তার রাজনীতির পথে । কেমন সে রাজনীতি ? না, মোহনলালের মত নেতৃত্বের অন্ধ মোহে সে ভেসে যেতে চায় না । সে চায় মানুষের কল্যাণে জীবনব্যাপী কাজ । নেতৃত্বের স্বাভাবিক ক্ষমতা নিয়েই সে জন্মেছে অথচ অন্তরে আছে মানুষের সঙ্গে সঙ্গে যাওয়ার বিশ্বাস । আপন সুখ-দু:খের সঙ্গে অভেদ করে নেওয়া অপরের দু:খ সুখ । তাই সে সহজেই আদায় করে নিয়েছে সাধারণ মানুষের তথা পাঠকের হৃদয় । কারণ সিদ্ধার্থের মধ্যে আমাদের খোঁজ মিলেছে সেই নেতৃত্বের, যার ছত্রছায়ায় আমরা সাধারণ মানুষেরা একটু স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলে একটা গোটা মানুষের মত বাঁচার আশা নিয়ে পা ছড়িয়ে বসতে পারি । ব্যক্তিকে বিচিত্র পটে, পরিস্থিতিতে স্থাপন করে তার ভিতর বাহিরকে তন্নতন্ন করে দেখেছেন তিলোত্তমা তাঁর সংবেদনশীল লেখনিকে হাতিয়ার করে । বিভিন্ন চরিত্রের চিত্রায়ণ করতে করতে "রাজপাট" তার আপন পথে যতই অগ্রসর হতে থাকে Ø আমরা জীবনের গ্লানিগুলোকে চিনতে চিনতে মুক্তির আকাঙক্ষায় সিদ্ধার্থের সামিয়ানার নিচে একত্রিত হবার ইচ্ছেয় উদ্বেল হয়ে উঠি ।

    একটি অপরূপ মাটির মানুষের চরিত্র চিত্রায়ণ করেছেন তিলোত্তমা মজুমদার । তাঁর নাম বলাই মণ্ডল । যুগ যুগান্তের কৃষকের বিশ্বাস নিয়ে তিনি বাঁচেন । সেই বিশ্বাসের প্রতিধ্বনি শুনি তাঁর মুনিষের কন্ঠে,

    "ধান কি ভোগের বস্তু ? ধান ফলানো শিল্পীর কাজ । আদুরি ধান ভাদুরি ধান, তার বড় অভিমান । কীটনাশকের বিষে ধানের বুকে অসুখ ঢুকে বসে গো ।"
    বেশি ফলনের লোভ তাঁর বিশ্বাসের ভিত নড়িয়ে দিতে পারেনি । তাই অল্প ফলন হলেও তিনি পরমান্নশালী ধান ফলিয়েছেন শিল্পীর মমতা নিয়ে । এই মাটির মানুষটির অন্তরে আছে একটি কবি মন । তাঁর কবিতায় যেন লেগে থাকে সোনালি মুগের রঙ আর পরমান্নশালী ধানের গন্ধ । তিনি বিশ্বাস করেন এক নাম-না-জানা কষ্ট ভরে রাখে কবির বুক, তবু কবিতা যে ভালোবাসে সে ঈশ্বরের আশীর্বাদপুষ্ট । এইখানে এসে লেখক তিলোত্তমা হয়ে উঠেছেন কবি তিলোত্তমা । তাঁর বুক জুড়ে প্রশ্ন ওঠে, কবিতা তুমি কি শুধুই এক কষ্ট ? নামহীন রূপহীন । আছে শুধু অতলান্ত অস্তিত্ব, তীব্র অধিকাবোধ ঘিরে । কী দাও তুমি কবিতা ? অসীমের সন্ধান ? সে যে ঘরছাড়া করে । প্রেমের আবেগ ? সে যে বিজন করে । অধরার নির্জনতা ? সে য়ে পাগল করে । অচিনের ডাক ? সে যে বাউল করে ।

    বলাই মণ্ডল ইতিহাসদর্শীও বটে । তাই জাতি ধর্মের সংস্কার তাঁর নেই । মানুষের পরিচয় সে মানুষ - এমনটাই তাঁর বিশ্বাস । কারণ তিনি জানেন, "জাতি ধর্ম বিভেদ করে মানুষ কিছুই পায়নি । শুধু কিছু রক্তাক্ত সময় এবং ঘৃণার জমাট জগদ্দল প্রাচীর ।" গোটা উপন্যাস জুড়েই আছে ইতিহাস । সে ইতিহাস যেমন আলিবর্দীর ইতিহাসখ্যাত বাত্সল্য ও সিরাজদৌল্লার উচ্ছৃঙ্খল জীবনের প্রারম্ভের কথা বলে, তেমনি করে বাউল ও বৈষ্ণবদের উত্স সন্ধান । ইতিহাসের পাতাগুলো উপন্যাসকে মন্থর করার দাবি তুলতে পারত । কিন্তু সেখানে দেখি ইতিহাস বা পুরাতত্ত্বের জ্ঞান দেবার ঝোঁক নেই বরং তিলোত্তমা নিপুণ মুন্সিয়ানায় যেটুকু ইতিবৃত্ত তুলে এনেছেন, সেটুকুর প্রয়োজন আছে তীব্রভাবেই । কারণ লেখক বিশ্বাস করেন,

    "যে মানুষ ইতিহাস দেখেনা সে নিজেকে দেখবে কী করে ? মানুষ ইতিহাসের উত্পাদন । এই বর্তমান ইতিহাসের উত্পাদন । এতকালের সকল সংস্কার, বিশ্বাস, বোধ ও অভিযোজনের পুরোভাগে আজকের এক একজন মানুষ । মানুষ বিচ্ছিন্ন নয়, ভুঁইফোঁড় নয় ।"
    মুর্শিদাবাদ নদীবহুল এলাকা । নদীর পাড়ের ভাঙন স্বাভাবিক । তবু সেই ভাঙনের দায় কিছুটা প্রাকৃতিক, বাকিটা দেশের শাসনকর্তাদের অবহেলা আর অপরিণামদর্শিতা । নদী একপাড় ভাঙে, অন্যপাড় গড়ে । কিন্তু এই ভাঙাগড়ার মধ্যবর্তী সময় মানুষ হয়ে ওঠে বিপর্যস্ত । তাই সিদ্ধার্থ মানুষের পাশে এসে দাঁড়াতে চায় । নদী এবং বাঁধ নিয়ে বিভিন্ন সূত্র শুনিয়ে মানুষকে অবহিত করতে চায় । তার কিছু বা প্রাচীনকালের সূত্র, তবু সে সতর্ক বিশ্লেষণ করে ঘটমান বর্তমানের নিরিখে । নিছক ব্যালট বক্সের প্রয়োজনে তাত্ক্ষণিক খুচরো পাড় সারাইয়ের কাজ কোনো কাজ নয় । গড়ে তুলতে চায় এক সর্বব্যাপী আন্দোলন । তাই দেখি ইতিহাসের পাশাপাশি নদী বিজ্ঞানেও সমৃদ্ধ তিলোত্তমার "রাজপাট" ।

    বাউল সম্প্রদায় "রাজপাট" উপন্যাসের একটি বড় অংশ জুড়ে আছে । জাতপাতের প্রতিবাদ করতে, ধর্মবিধর্মের বিরুদ্ধাচার করতে সাধারণ জনজীবনের প্রতি এক মানবিক টানে যে বাউল সম্প্রদায়ের জন্ম, তা প্রায় চর্যাপদের সমকালীন । যখন অন্তজ ব্রাত্য মানুষগুলি সমাজ বা অর্থনীতির বিপন্ন সময়ে প্রধান ধর্মগুলির কাছে আশ্রয় পায়নি, এমনকি সাধারণ মানবস্বীকৃতিও জোটেনি, তখনই গড়ে উঠেছিল এই গৌণধর্ম সম্প্রদায়গুলি । গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম আর শরিয়তি ইসলাম ধর্মের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সহজিয়া, সুফি, বাউল ইত্যাদি সম্প্রদায়গুলি প্রেমের নামে সহজ সাধনার প্রচার করেছে । হিন্দু মুসলমান অধ্যুষিত মুর্শিদাবাদে এই সম্প্রদায়গুলির অস্তিত্বের সংকট ধ্বনিত হয়নি তিলোত্তমার রাজপাটে বরং জীবন সংগ্রামের যন্ত্রণায় আকুল লেখক খুঁজে ফিরেছেন মনুষ্যত্বকে । বৈষ্ণবই হোক কিংবা শাক্তই হোক, হিন্দু বা মুসলমান যেকোনো ধর্মের মানুষই হতে পারে বাউল । কারণ বাউল তো কোনো ধর্ম নয়, জীবনচর্চামাত্র । আর পাঠককে সেই জীবনের মুখোমুখি করতে লেখক বেশ কয়েকটি চরিত্রকে এঁকেছেন অসীম দক্ষতায় ।

    দুলেন্দ্রের বাউলচর্চার মধ্যে দিয়ে তিলোত্তমা মজুমদার বাউলাঙ্গের স্বরূপ উদঘাটন করেছেন । বিরোহী সত্তায় প্রেমের নির্মোহ অবগাহনই হল বাউলতত্ত্ব । সেখানে পুরুষ আর প্রকৃতির মিলন যেমন রচিত হয় তেমনি বিচ্ছেদও হয়ে ওঠে অবশ্যম্ভাবী । বিচ্ছেদ থেকে যে বিরহের জন্ম তাতে হয় কামের মৃত্যু । আর সেই বিরহেই জ্বলে প্রেমের দীপশিখা । লেখক বুড়িয়ার মধ্যে যে বাউল প্রকৃতি এঁকেছেন তা পূর্ণ নয়, আংশিকমাত্র । তাই বুঝি তাকে প্রতারণা করতে হয়েছে দুলু বাউলের সঙ্গে । দুলেন্দ্রের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল বুড়িয়ার মা শর্বরীর জীবনের কিছু ইতিহাস । যদিও সে স্মৃতি স্থায়ী হয়নি দুলু বাউলের জীবনে । ময়না বৈষ্ণবীর মত তীব্রভাবে বেঁচে থাকার রসদ ছিল না সেই ভালোবাসায় । কিছু মানুষ অতৃপ্তির সাধনা করে । লেখক মা-মেয়ের সেই সাধনার রূপায়ণ করেছেন বুড়িয়ার সার্থক চিত্রায়ণে ।

    "রাজপাট" উপন্যাসে বাউলাঙ্গের চিত্র দেখতে দেখতে কালকূটের "কোথায় পাবো তারে" উপন্যাস মনে পড়া অবশ্যম্ভাবী । কালকূটের মত তিলোত্তমাও বাউল জীবনযাত্রার মধ্যে এক চিরন্তন মানুষের সন্ধান করেছেন । হারাবার হাহাকার দুলু বাউলকে সঙ্গছাড়া করে একলা ছুটিয়ে দেয় । যেন ত্যাগেতেই প্রেম । ঈর্ষা এখানে ব্যথা হয়ে বাজে, বাধা এখানে হীনমন্যতার আঁধারে বাঁধা পড়ে না । লেখক বাউল সম্প্রদায়ের প্রবহমান জীবনধারার এক নিখুঁত আলেখ্য রচনা করেছেন তাঁর উপন্যাসে ।

    আর বাউল গান ? মন প্রাণ ভরে গেছে রাজপাটের গানের সম্ভারে । মন বলে, এমন গান কারা বাঁধে ? হেসে বাঁধে না কেঁদে বাঁধে ? একটু দেখতে ইচ্ছে করে । শুধু তো বাউল গানই নয়, উপন্যাসের পাতায় পাতায় ব্রত-পার্বণের ছড়া আর লোকগাথাগুলো, বিভিন্ন ঋতুর ফসল সংক্রান্ত কৃষকের প্রবচনগুলো মাটির সোঁদা গন্ধ ওড়ায় । আর মাঝে মাঝে বহুদূর ফেলে আসা জীবনানন্দীয় সুর বেজে যায় শিথিল বিস্মরণে । চুপিচুপি উঁকি দিয়ে ডাক দিয়ে যায় উজানের পথে,

    "চিরকাল ইতিহাসের পথে
    রক্ত ক্ষয় নাশ ক'রে সে এক জগতে
    মানুষের দিকচিহ্ন মাঝে মাঝে মুক্ত হ'য়ে পডে .;
    তা কোনো প্রশান্তি নয়, মৃত্যু নয়, অপ্রেমের মতো নয়,
    কোনো হেঁয়ালির শেষ মীমাংসার বার্তা নয়,
    অচিহ্নিত সাগরের মতন তা, দূরতর আকাশের মতো ;
    পেছনের পার্শ্বের দ্রুতগতি চিহ্ন ও বলয়
    অন্তর্হিত হয়ে গেলে কূলহীন পটভূমি জেগে ওঠে ;"
    কিছু টুকরো চরিত্রকেও বড় দরদ দিয়ে এঁকেছেন তিলোত্তমা মজুমদার । মাসুদা আর ইদরিশ গরিব মুসলমান ঘরের গৃহস্থ । বাড়ন্ত ভাতের সংসার অথচ স্বামী কামে না গিযে গান গায় । সে বেকাজের বেখেয়ালের মানুষ । কিছুদিন হয়ত সে মন পেতে বসত করল সংসারে । জমিতে জন খাটা, ঘর ছাওয়া, ইঁট পোড়ানো, মাছ ধরা নানা কাজেই সে দড় । কিন্তু কাজ করতে করতেই কি এক বেভুল হাওয়া তাকে করে তোলে উদাসী । সংসারের সীমায়িত পরিসরে তাকে যেন ধরে না । সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে পঞ্চরসের গান গাইতে । মাসুদা আর মেয়ে ফরিদাকে সে ভালোবাসে প্রাণেরও অধিক । তবু জীবনের স্থুলত্ব তার অধিক দিন সয় না । সে যে খাঁটি শিল্পী মানুষ, গান তার অন্তরে । তাই না গেয়ে সে পারে না । আর লেখকের নারীর প্রতি ভালোবাসা ইদরিশের গানের প্রসঙ্গে ভুখাপেট মাসুদার ঠোঁটেও উপচে দেয় খুশির আলো । ইদরিশের খামখেয়ালিপনার জন্য মাসুদার যতই যন্ত্রণা হোক, রাগ অভিমান হোক, তার আছে এক গোপন গভীর গর্ব ।

    জেলেপাড়ার এক দরিদ্র সংসারের বধূ আফসানা । শ্বশুর, শাশুডি,. স্বামী ও দেওরকে নিয়ে তার সংসার যাত্রা । টালির চালের মেটে বাড়ি, ঘরের লাগোয়া শ্বশুরের হাতের সবজি ক্ষেত, স্বামী আকবর আলির সিরাজ নৌকা আর ঋণজালে জড়িত জীবনযাপন । তবু সে প্রাণপণে ভালোবাসে এই সংসার । সামান্য সে নারী, তবু লেখকের কলম খোঁজ করেছে, তার প্রাণের মধ্যে বসত করে এক আধুনিক মনন । যখন শিশুশ্রমিক আমাদের জীবনযাত্রার অঙ্গ হয়ে উঠেছে আর আমরা নির্বিবাদে গ্রহণ করে চলেছি সেই শ্রমের ফসল, তখন রোজগার বাড়ার অজুহাতে নিজের ছোট ছেলেমেয়েগুলোকেও বিড়ি বাঁধার কাজে লাগাতে বলায় আফসানা ক্ষুব্ধ হয়, স্বামীর বক্তব্যের প্রতিবাদ করে সেই নারী,

    "সংসারে টাকার প্রয়োজন তা তো মানেই সে । তার জন্য পরিশ্রমও কম করছে না । কিন্তু তাই বলে শিশুদের দিয়ে কেন উপার্জন করানো ! গরিবের ঘরে শৈশব সংক্ষিপ্ত । আট-ন বছর হলেই জেলের ছেলে জাল ধরে, চাষার ছেলে হাল ধরে । আর মেয়েরা তো পাঁচ বত্সর বয়স থেকেই সংসারের কাজে ঢুকে যায় । তার ওপরে আবার বিড়ির ভার কি না চাপালেই নয় ?"
    অলিতে গলিতে, সমাজের আনাচে কানাচে যখন বৃদ্ধাশ্রমের বাড়বাড়ন্ত দেখি তখন লেখক দু একটি কলমের আঁচড়ে আমাদের দৃষ্টি ফেরান পিতা মহম্মদ আলি আর পুত্র আকবর আলির দিকে । মাছ ধরতে যাওয়ার সময় রোজই মহম্মদ আলি পুত্রকে একই উপদেশ দেন । আকবর আলি মন দিয়ে শোনে, কারণ সে বোঝে,
    "বুড়ো হলে মানুষের কথা জমে ওঠে । জগৎ সংসারকে সে তার আপন সংবাদ, আপন অভিজ্ঞতার ফসল দিয়ে যেতে চায় । দিন ফুরিয়ে আসে বলেই এই মহাবিশ্বের সঙ্গে তার কথা কওয়ার বিষয় বেড়ে ওঠে । একই বিষয়কে সে বহু করে নেয় পুনরুক্তির মাধ্যমে ।"
    বর্তমানের একলা হয়ে যাওয়া, বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া মলিকিউলার পরিবারে আমরা যখন প্রাচীন শাল মহুয়ার ছত্রছায়া ছেড়ে শুধু কদমনির্জনে রাধাকৃষ্ণযাপনে মত্ত, বার্ধক্যকে তারুণ্যের পথে বাধা মনে করছি, তখন আমাদের সামনে আফসানা চরিত্রকে উপস্থাপন করে আরো একবার উপলব্ধি করার জন্য আহ্বান করেন লেখক । পুত্র আকবর আলির জন্য যখন পুত্রবধূ আফসানা ভাতের পুঁটুলি বেঁধে দেয় তখন মহম্মদ আলি রোজই বলেন, "ভালো করে বেঁধেছেঁদে দাও ।" নিত্যদিন একই উপদেশ তবু আফসানা উপলব্ধি করে,
    "এই বলার মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই । কোনো আদেশ নেই । এ যেন স্বাভাবিক বিবৃতির মত । কিংবা একপ্রকার স্বীকৃতিও বলা চলে । যেন বয়ানটা আসলে এইরকম - "তুমি বেশ বেঁধেছেঁদে দাও । আমরা জানি । তোমার কাছে আমাদের এই প্রত্যাশা চিরকালের ।"
    চাটুজ্যেবাড়ির নয়াঠাকুমা শিক্ষিত পরিশীলিত এক আধুনিক মনস্ক মানুষ অথচ অন্দরমহলে তিনি প্রবল পরাক্রান্ত । তাঁর প্রবল কর্তৃত্বের অন্তরালে মোহনলালের মা, নন্দিনীর অস্তিত্বের সংকট তুলে ধরেছেন লেখক । তবু আপনার শান্ত স্নিগ্ধ রূপের মধ্যেই নন্দিনীর স্থিতি । এই দুটি চরিত্রের মধ্যে দিয়ে লেখক যেন শাশুড়ি-বৌমার চিরন্তন রূপটিকের মূর্ত করে তুলেছেন ।

    চরিত্র চিত্রণ এবং সেই চিত্রণের মাধ্যমেই চরিত্রের উত্তরণের মধ্যে রয়ে গেছে লেখকের সূক্ষ্ম সামাজিক বোধ । তাই দেখি মরমীয়া লেখকের কলমে আরো এক জীবন্ত চরিত্র শিখারানি,

    "আদ্যন্ত অসত্‌, আদ্যন্ত পাপী, আগাগোড়া এক ঝুটো মানুষ সে । তবু মাঝে মাঝে হৃদয়ের দুকূল ছাপিয়ে কান্না আসে তার । বুক ভেঙে যায় । শরীরে জ্বালা করে । জ্বালা নির্বাপণের জন্য সে স্নান করে বারংবার ।"
    কিন্তু কেন ? স্বামীকে ভালোবেসে সংসার করবে বলেই তো সে এসেছিল চতুষ্কোনার প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক অমর ঘোষালের ঘরে । কিন্তু জীবন সর্বদা সরলরেখায় চলে না । জীবন নদীর এদিকে ওদিকে বাঁক । কোথাও চোরাস্রোত কোথাও বা স্রোতহীনতা । বাঁকে বাঁকে জমে ওঠে শ্যাওলা । তাই ঘটনাচক্রে কিংবা ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে স্বামী উন্মাদ হয়ে গেলে অস্তিত্বের খাতিরে, বেঁচে থাকার তাগিদে তাকে বেছে নিতে হয়েছিল সতীপূজোর শিখণ্ডীর জীবন । সে জানে পূজোর নামে সে ঠকাচ্ছে অন্যদের । তবু আপন অস্তিত্বের সংকটের জন্য মেনে নেয় এই প্রতারণার পথ । জীবনের নিরাপত্তার জন্য স্বামী ও দুই দেবরের অঙ্কশায়িনী হয়ে সে নির্বাহ করে এক দু:সহ সংসার যাত্রা । তিনজন পুরুষের মধ্যবর্তী দু:সহ জীবনকে সে স্বাভাবিক বলেই মেনে নেয় । তবু লেখকের দরদি কলম খোঁজ করেছে তার সেই নির্মম জীবনযাপনের গ্লানি,
    "তার মনে হয়, আর পারছে না । এ জীবন আর সইতে পারছে না । ইচ্ছে করে ছেড়েছুড়ে চলে যায় কোথাও ।"
    এইখানে তিলোত্তমা মজুমদার বাস্তব জীবনের গল্প বলেন আর জীবনের সেই সরণি ধরেই জীবন থেকে উত্তরণের স্বপ্নে বিভোর করেন পাঠককে । সাহিত্য জীবনেরই জলছবি । সাদা পাতায কালো রেখায় ফেলে যায় জীবনের পদছাপ । আর সেই ছাপ অনুসরণ করতে করতে আমরা এই তেতেপুড়ে ওঠা জীবন থেকে উত্তরণের দিশা খুঁজি । এই উত্তরণের আকাঙক্ষায় তিলোত্তমা কেবল নীতিবাগীশ প্রতিষ্ঠিত আর সোজা সরল মানুষের কথাই বলেন না । উঁচু নিচু সমস্ত স্তরের মানুষ তাদের বিপন্নতা নিয়ে হাজির হয়েছে তাঁর উপন্যাসে । তাই বুঝি বাদ দেন নি শিশু হত্যাকারী দুই পাপিষ্ঠ সেই বাপি আর হাপিকে । পাপ কিংবা পূণ্য তো জীবনেরই এপিঠ ওপিঠ । তাই ওরাও বঞ্চিত হয়নি লেখকের কলমের উষ্ণতা থেকে । শিশুদের পুড়িয়ে মারার পর বাপি কাঁদে । কৃতকর্মের আত্মগ্লানিতে দগ্ধ হয় , দীর্ণ হয় । বুকের গভীর থেকে উঠে আসে উচ্চারণ,
    "দারুণ গুনাহ করেছি আমরা.... ওই হাতে তোর চাঁদকে আদর করিস না... এই পাপ আমাদের জন্মেও ছাড়বে না ।"
    এই পাপবোধ, জীবনের এই অন্ধকার থেকে মুক্তির আকাঙক্ষা বিশ্বের সকল মানুষকে দিক নতুন চেতনা - এই শর্তেই বুঝি কালি ঝরে লেখকের তীক্ষন অনুভবী স্বপ্নপুরাণ থেকে । "রাজপাট" উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রই পাঠককে নতুন নতুন জিজ্ঞাসায় যন্ত্রণার্ত করেছে । একদিকে যেমন চেতনার দিগন্ত বাড়িয়েছে অন্যদিকে তেমনি গভীরতার স্ফুরণ । লেখকের সমগ্র অনুসন্ধান এক বিস্তৃত নিরীক্ষণের ইতিহাস ।

    "রাজপাট" উপন্যাসে তিলোত্তমা আরো এক স্বপ্নময় মানুষের চরিত্র এঁকেছেন তাঁর অপরূপ কলমের ছোঁয়ায়, নাম তাঁর বোধিসত্ত্ব । জীবনের প্রতি প্রগাঢ় দ্যুতিময় ভালোবাসা নিয়ে তিনি ছায়া বিছিয়ে রাখেন সিদ্ধার্থের ওপর । তাঁর আসন্ন মৃত্যুর বিচ্ছিন্নতায় কাতর সিদ্ধার্থের হাতে হাত রেখে তিনি বলেন, "দেহাবসানকে ডেথ বলে মনে করি না আমি, মৃত্যু বলে মানি না । ডেথ হল সিজেশন, থেমে যাওয়া । পূর্ণচ্ছেদ টেনে দেওয়া জীবনের । তা তো নয়, মৃত্যু আমার কাছে সাঁকো, এক জীবন থেকে অন্য জীবনে যাওয়া, একখানে শেষ করে অন্যখানে শুরু ।" উপন্যাসের একেবারে শেষে এসে দেখি, যে ভৈরবের ভাঙনকে কেন্দ্রে রেখে এগিয়ে চলেছিল "রাজপাট" সেই নদীর পাড় অবশেষে ভেঙে পড়ল । ছলছল শব্দে, খলখল অট্টহাস্যে সে ভাসিয়ে দিল তার অববাহিকার জনজীবন । এই দুর্য়োগের প্রেক্ষাপটে মনস্তত্ত্বের সরণি বেয়ে অপরূপ মুন্সিয়ানায় তিলোত্তমা মজুমদার দেখিয়েছেন কিভাবে উপন্যাসের চরিত্রগুলি সমাজের সাম্যবাদের ধারায় মিশে যেতে চায় । আর সেই স্বপ্ন রূপায়ণের জন্য হাত বাড়িয়ে দেয় সিদ্ধার্থ, উপন্যাসের নায়ক । অসহায় মানুষের কান্না আর আর্ত চিত্কারের পটভূমিতে লেখক পাশাপাশি স্থাপন করেছেন দুই যুবককে, সিদ্ধার্থ আর নীলমাধব । নিবিড় স্বপ্নভরা তাদের দুই চোখ । তারা ভারতীয় - এই মাত্র পরিচয় । আর কিছু নয় । তবু রাষ্ট্র তাদের অমলিন ত্বকের ওপর পরিচয় দাগিয়ে দিয়েছে, একজন খুন না করেও খুনি, শৃঙ্খলাভঙ্গকারী আর একজন সন্ত্রাসবাদী । কী চায় তারা ? সুন্দর সমৃদ্ধ ভারত । যেখানে রাষ্ট প্রকৃতই মানুষের জন্য সংগঠিত হবে । কেমন তাদের আলাপ ? শুনি বরং লেখকের কলমে,

    "সিদ্ধার্থ বলল- সাধারণ মানুষের মধ্যে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে কিছু গড়ে তোলা যায় বলে আমি মনে করি না নীলমাধব । এক সন্ত্রাস আর এক সন্ত্রাস ডেকে আনে । নীলমাধব বলছে- সন্ত্রাস ? কাকে সন্ত্রাস বলো তুমি ? একটা আদর্শ রাষ্ট্রই শেষ পর্যন্ত অহিংসার কথা বলার অধিকার রাখে । কিন্তু সে কোন রাষ্ট্র ? যে রাষ্ট্র দেশের নবজাতকের ওপর চাপিয়ে দেয় ঋণের সহস্র একক ? চাপিয়ে দেয় ধর্ম ? চাপিয়ে দেয় অনাহার আর মরণ ?"
    হয়ত তাদের পথ আলাদা হয়ে যাবে তবু সেই পথ মিলে যাবে তাদের একক স্বপ্নে । এই স্বপ্নটিকেই পাঠকের তথা মানুষের মনের দুয়ারতক পোঁছে দিয়েছে তিলোত্তমা মজুমদারের স্বপ্নপুরাণ, "রাজপাট" ।

    (পরবাস-৪২, ডিসেম্বর, ২০০৮)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments