কালে খাঁ সাহেবকে সাক্ষাৎ করার পূর্বসূচনা ছিল শ্যামলালজীর বৈঠকে । সে বত্সর, অর্থাৎ ইং ১৯১৪ সালের বর্ষার এক সন্ধ্যা ; শ্যামলালজী ও আমরা অল্প কয়জনা বসে; মনে পড়ছে বাবুজী, তন্নুলালজী ও চিরঞ্জীবকে মাত্র । বাবুজী ফরাশ ছেড়ে পৃথক আসনে গড়গড়ায় তামাক সেবন করছেন । তাকিয়া-কোলে তন্নুলালজী বাবুজীকে সাময়িক সংবাদ গোচর করাচ্ছেন ।
কালে খাঁর নাম এর পূর্বে মাত্র একবার শুনেছিলাম ওস্তাদ বিশ্বনাথজীর মুখে; মহারাজ নাটোরের বাড়ীতে বসে । বিশ্বনাথজী স্বল্পভাষী ছিলেন । একদিন কী একটা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, "খেয়ালী ত রয়মৎ (রহমত্) খাঁ সাহেব আর কালে খাঁ সাহেব ।" চপলমতি আমি তত্ক্ষণাৎ জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ওঁদের মধ্যে কে বড় আর কে ছোট । বিশ্বনাথজী তেমনি গম্ভীর স্বরে বলেছিলেন, "কে বড় কে ছোট তার মাপ নেইনি । তাঁদের মধ্যে তফাৎ এই যে, রয়মৎ খাঁ কবরে, আর কালে খাঁ কবরের বাইরে ।" আমার চপলতা দূর হয়ে গেল ঐ রকমের কথা শুনে । সেদিনকার মত আমার মুখ বন্ধ হয়ে গেল । তখন ঐ গম্ভীর, রাশভারী, মহানুভব ব্যক্তির স্বরূপের পরিচয় পাইনি । বিশ্বনাথজীর কথাই বলছি । যাই হ'ক - সে তো গাইয়ে কালে খাঁ । আর আজ যার কথা উঠল, সে কালে খাঁর আঙুলে মোটা মোটা মেজ্রাব । অবশ্য মাত্র মেজ্রাব দিয়ে যথার্থ পরিচয় হয় না । ...
নিকুন্ আর আমি আমহার্স্ট স্ট্রীটের মোড়ে হাওড়ামুখো ট্রামে চেপে বসলাম; ট্রামের মাঝারি একটা সারিতে । ভিড় নেই বললেই হয়, প্রথম শ্রেণীতে । সকাল বেলার হলুদ রং-এর আলো আর আমাদের নবীন মন-প্রাণ; কী করি, কীই বা না করি রকমের খাপছাড়া নিরুদ্দিষ্ট উত্সাহে আমরা সর্বক্ষণ সজাগ ।
উঠেই লক্ষ করলাম, ড্রাইভারের নিকটে প্রথম সারিতে জানালা ঘেঁষে একজন মুসলমান ভদ্রলোক বসে; ড্রাইভারের দিকে মুখ করে জানালার মধ্যে দিয়ে তাঁর দৃষ্টি ছিল সামনের পথের দিকে । সেটা কিছু নয় । আসল কথা, সামনে খাড়া-করা মাপসই একটা লাঠির হাতলের উপর তাঁর দু'হাতের পাঞ্জা ভর করে আছে । এটাও কিছু নয় । সত্যকারের আসল কথা, তাঁর হাতের মোটা মোটা বেঁটে আঙুল, আর বাঁ হাতের অনামিকাকে জড়িয়ে রয়েছে বিলক্ষণ মোটা তারের গোটা দুই মেজ্রাব ! বিদ্যুতের গতিতে মনে পড়ে গেল- বাবুজী-ঠান্ডীরামের মুখে কালে খাঁ সাহেবের বিষয়ে কৌতুক-প্রসঙ্গ । ...
বন্ফিল্ডস লেনের নিকটে একটি সরু গলির মধ্যে দিয়ে আমরা যখন তাঁর অনুগমন করছি, দেখি - মাঝে মাঝে পথ-চল্তি দু'পাঁচ জন লোক খাঁ সাহেবকে `বন্দগি' জানিয়ে তাঁর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে আপন আপন কাজে চলে গেল ।
সে গলির এমন গড়ন-পেটন যে, মনে হল - সূর্য কখনও তাকে বে-আবরু করতে পারে না । এতক্ষণে নিকুনের মুখ ফুটল; জিজ্ঞাসা করল, "পাঁচ্দা ! ব্যাপার কি ? কিছুই ত বুঝছিনে ।" তার গলার আওয়াজের মধ্যে ভয়ের খাদ ছিল ।
আমি গম্ভীর দৃষ্টিতে নিকুনের পায়ের দিকে তাকালাম । তার পায়ে নূতন চক্চকে `সু' জুতা । নিকুন্ ও তার জুতার মধ্যে পরস্পর গোলামী সম্বন্ধ ছিল চিরকাল । জুতার সেবা করতে নিকুনের মত লোক দেখিনি; নিকুনের জুতার মত অমন নিত্যসহচর গোলামও দেখিনি । নিকুন্কে বললাম, "জুতার ফিতে আল্গা করে ফ্যাল; যত শিগ্গির পারিস ।" বিস্মিত হয় সে বলল, "কেন ? তার মানে ?"
আমি চুপে-চাপে বললাম, "বলা যায় না ত কি হয় । যদি দৌড় ধরতে হয়, চট্পট্ জুতা খুলে নিয়ে হাতে করে দৌড়তে পারবি । জুতার মায়াটা তোর বেশী কি না, তাই বলছি । আমার পুরান এলবাটখ শ্লিপার, ফেলে দিয়েই দৌড়ব । বুঝলি কি না ।"
নিকুন্ থমকে গেল । বলল, "কী যে বলছেন আপনি তার ঠিক নেই । এতক্ষণ গহ্র-টহ্র কত কী নাম করে গেলেন । আবার এখন বলছেন সাব্ধান হতে ! কাজে কাজ নেই পাঁচ্দা ! ফিরে যাওয়া যাক্", বলে হাত চেপে ধরে আমার ! নিকুন্ সত্য সত্যই ভয়ে ইতস্তত: করছে দেখে আমি খুব সংক্ষেপে ব্যাপারটি বুঝিয়ে দিলাম । তখন সে আশ্বস্ত হয়ে চলতে লাগল । অবশ্য নিকুন্ যে বিলক্ষণ সঙ্গীতপ্রিয় ছিল, এ কথা তার শত্রুরাও স্বীকার করত ।
খাঁ সাহেব একটি বাড়ীর দরজায় থামলেন । বাড়ীর নম্বর বুঝবার উপায় ছিল না; আমাদের পকেটে দেশলাই থাকত না । কিন্তু আমার চোখ বেঁধে দিলেও সে বাড়ী ঠাহর করে নিতে পারতাম তখন । সে গলিতে খোলা চোখ আর বাঁধা চোখ দুই-ই সমান । দু'দিকে হাত বাড়িয়ে দিলে দু'দিকের বাড়ীর দেওয়াল ছুঁয়ে চলা যায় । এমনি সুন্দর ব্যবস্থা সে গলির ।
দরজা ঠেলতেই দরজা খুলে গেল । খাঁ সাহেব এমন ভাবে আমাদের চলে আসতে বললেন, যেন সেটা তাঁর নিজেরই বাড়ী । দুর্গানাম স্মরণ করে খাঁ সাহেবের সঙ্গে বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করলাম; পুরান ঢংএ খিলান-করা ঘুটঘুটে প্রবেশপথ দিয়ে । অল্প অগ্রসর হয়ে মোড় ফিরতেই একটি দেড়-মহল্লা বাড়ীর খোলা উঠান দেখা গেল । লোকজনের নামগন্ধ নেই । একটা তেলাপোকা নেই, টিক্টিকিও নেই !
ডান দিকে ঘুরে খাঁ সাহেব বাহির-বাড়ীর সংলগ্ন একটা কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলেন; আমরাও মহাজনের পদানুসরণ করলাম । সিঁড়িতে উঠতে উঠতে একটা দেয়ালের ব্যবধানে অনতিদূরে একটি ছোট চত্বর দেখলাম; তার পাশেই একটি শূন্য চন্ডীমন্ডপও প্রকাশ পেল । সে জায়গাটা পায়রাদের অবাধ লীলাভূমি হয়ে অত্যন্ত অপরিষ্কার হয়ে আছে । অপরিষ্কার চন্ডীমন্ডপ দেখে নিকুন্ একটা স্বস্তির নি:শ্বাস ত্যাগ করল । বাড়ীটা তা হলে হিন্দুরই নিশ্চয় ।
সিঁড়ির শেষে উপরে অপ্রশস্ত বারান্দায় উঠে খাঁ সাহেব ঘুন্সিতে বাঁধা একটি চাবি দিয়ে খুব কায়দা করে ডান দিকে একটি ঘরের তালা খুলে ফেললেন; দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকতে আমাদেরও আসতে বললেন নি:সঙ্কোচে । ঘরের মধ্যে উপস্থিত হলাম আমরা । দেখলাম, জারুল কাঠের উলঙ্গ তক্তাপোশ; কোণে একটি জড়ান মাদুর, ঠেশ দে ওয়া; তার পাশে মেঝেতে একটি বদনা; একটা লম্বালম্বি দড়িতে ময়লা গেঞ্জি, লুঙ্গি, ল্যাঙ্গোট আর একটি ধূসরবর্ণের গামছা টাঙ্গান রয়েছে । এর অতিরিক্ত আর কোনও আসবাব বা ছবি সে ঘরে ছিল না । পাশেও একটি ঘর আছে, কিন্তু তালা লাগান । ঘরের দু'টি জানালা; একটি খাঁ সাহেব নিজহাতে খুলে দিলেন । এরকম রিক্ত পরিবেশের মধ্যে অমন একজন নামজাদা গুণী কি করে থাকেন, ভেবে ঠিক করতে পারলাম না । তাঁর কোনও সাথী বা সঙ্গী সেখানে বাস করে, এমনও ত লক্ষণ বুঝলাম না ।
খাঁ সাহেব ঐ ছ-পায়া তক্তা দেখিয়ে দিয়ে আমাদের বললেন, "আপনারা বসুন, আরাম করুন", বলে গায়ের মের্জাইটা খুলে দড়িতে টাঙ্গিয়ে দিলেন, লাঠিটা এক কোণে ঠেশ দিয়ে রেখে এলেন, আর পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটি রুমাল বার করলেন । খাঁ সাহেব আসন না নিলে আমরা বসতে পারিনে । তিনি ঝপ্ করে বসলেন তক্তার একদিকে । ডবল সাইজের তক্তা সেটা । খাঁ সাহেবের বসার সঙ্গে সঙ্গে তক্তার একটি পায়া আওয়াজ দিল `ঠিক্' । বুঝলাম- সেটা খাঁ সাহেবের গুরুত্বের প্রতি সেলামী নিশানা । আমি একটু ব্যবধান করে সাবধানে বসে পড়তে তক্তাটি বলে উঠল `ঠিক্' । অদ্ভুত ! আমরা অতিথি; এটা বোধ হয় অতিথির সেলামী । নিকুন্ ভয়ে ভয়ে আমার পাশে বসতেই তক্তা আওয়াজ দিল `ঠি-ঠিক' । নিকুন্ অবাক্ । ...
খাঁ সাহেবকে বললাম, "কিছু হুকুম ফরমায়েশ করুন মেহেরবানি করে ।" খাঁ সাহেব তত্ক্ষণাৎ বললেন, "আপনার কাছে সিগারেট আছে ?" আমি অত্যন্ত লজ্জিত হলাম । বললাম, "এক মিনিটের মধ্যে আনিয়ে দিচ্ছি"; বলেই, নিকুন্কে বললাম পান-সিগারেট-জরদা নিয়ে আসতে বড় রাস্তার সেই মোড়ের দোকান থেকে । নিকুন্ নড়েছে কি তক্তার আওয়াজ হল `ঠিক্' ! হঠাৎ একটা খেয়াল হল । খাঁ সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলাম, "কিছু নিম্ কি-মিঠাই আনিয়ে নেব কি ?" নিম্ কি অর্থ যে কোনও নোন্তা খাবার । কিছুমাত্র সঙ্কোচ বা লৌকিকতা না করে সরল প্রাঞ্জল ভাষায় তিনি বললেন, "হাঁ হাঁ, কুছ্ পুরি-জিলেবিভি মঙ্গাইয়ে, ক্যা হরজ্ ?" অর্থাৎ সেই আসন্ন শরতের প্রাতে যদি দোকানীর দোকান থেকে পান সিগারেট সমেত পুরি-জিলিপি প্রভৃতি কিছু বস্তু সংগ্রহ করা যায়, তাতে জগতের কার কী এমন ক্ষতি বা আপত্তি হতে পারে ! বাস্তবিক কথা, ক্ষতি আমার নয়, খাঁ সাহেবের নয়, দোকানীর ত নয়ই । আর নিকুনো আপত্তি করতে পারে না; কারণ, ট্রামে উঠবার আগে সে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, যাওয়া-আসার সমস্ত খরচ, মায় রাস্তায় (ভগবান না করুন) কোনও অপঘাত হলে টিংচার-আওঅডিন ব্যান্ডেজ প্রভৃতির সমস্ত খরচ, অধিকন্তু সাময়িক জলযোগের খরচ - ইত্যাদি করে সমস্ত রকমের সম্ভাবনার জন্য সে প্রস্তুত; এতই ভক্তিশ্রদ্ধা করে সে আমাকে । অতএব নিকুন্কে বললাম, "টাকা-খানেকের মতো কচুরি-জিলিপি নিয়ে আসবি; পুরিও নিয়ে আসবি যদি পাস; হালুয়া আর তরকারি ফাউ নিবি বেশি করে । তা ছাড়া এক প্যাকেট সিগারেট, একটা দেশলাই বাক্স, পান আর জরদাও নিয়ে আসবি । মিঠা পান, মনে থাকে যেন ।" নিকুন্ ভালমানুষের মতো তক্তা ছেড়ে উঠেছে কি আওয়াজ হল `ঠিক্-ঠিক্'। নিকুন্ চলে গেল ।
গম্ভীর হয়ে খাঁ সাহেবকে বললাম "খাঁ সাহেব ! খুব হুঁশিয়ার আর আজব্ তখ্ত (সিংহাসন) এইটে আপনার ! এর আদমিয়তি (মানবতা) এসে গিয়েছে, মানুষের মতো জবাব দিচ্ছে ! দু'চার রোজ বাদে হয় ত রেখব-গান্ধার বলতে থাকবে মনে হচ্ছে; আপনার মতো গুণীর সঙ্গত্-সুহবৎ (সঙ্গ ও মিলন) পেলে কী না হতে পারে"। খাঁ সাহেব সম্ভবত হাসবার চেষ্টা করেছিলেন; তাঁর চোখ বুজে গেল, গোঁফজাড়া উঁচু হল, মুখব্যাদানও হল । কিন্তু হাসি এতই গভীরে ছিল যে, বাইরে প্রকাশ হল না । মাত্র বললেন "আপ দিল্লগি কর রহে হ্যায় ।" অর্থাৎ আপনি বুঝি ঠাট্টা করছেন । বুঝলাম, খাঁ সাহেব ও-ধরনের কথার রস গ্রহণ করলেন না ।
প্রসঙ্গ বদলে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, "খাঁ সাহেব, আপনার সাজ্ (বাদ্যযন্ত্র) কোথায় রেখে এসেছেন ?" অর্থাৎ আমি তাঁর বীণার কথাই তুললাম । তিনি যথেষ্ট সপ্রতিভ হয়ে বললেন, "লাহোরে রেখে এসেছি তাকে, মেরামতের জন্য । তুম্বার জোড়ী বিগড়ে গিয়েছে তার ।" তুম্বার জোড়ী অর্থাৎ বীণার লাউ যা বশের যুগল ।
[এখানে গান বাজবে] এতোক্ষণ অমিয়নাথ আমাদের শোনালেন কালে খাঁ'র গল্প । সঙ্গে সঙ্গে বলে গেলেন আরো অনেকের কথা । কয়েকজনের গান একটু শুনে রাখলে মন্দ হয় না । সেই রেশ ধরেই আবার আমরা আসরে বসব অমিয়নাথের সঙ্গেই ॥
(ডিসেম্বর, ২০০৮; পরবাস-৪২)