শহরের পাশেই সাতপুরা পাহাড়ের গহিন জঙ্গল । ফাঁক পেলেই একটা পয়েন্ট টু টু রাইফেল আর গুচ্ছের টোটা নিয়ে জঙ্গলে ঘুরতাম । এ বন্দুকে বড় শিকার হয় না । পাখিটা, খরগোশটা মরে । তবে, হাতের টিপ খারাপ ছিল না । খালি হাতে ফিরিনি কোনওদিন । সে সময়টা সরকারবাহাদুর তাঁর দোপেয়ে প্রজাদের নিয়েই মাথা বেশি ঘামাতেন । জঙ্গলের চারপেয়েদের নিয়ে এখনকার মত এত আদিখ্যেতা ছিল না । দু' একটা বনমুরগি বা খরগোশটোশ মারলে কারও মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ত না ।
এইরকম জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে ধুপগর, বোরি, নিমঘন, কাজরি, তিলপন.. কোথায় না গেছি ! এই তিলপনেই একবার একটা ঘটনা হয়েছিল.. তার পর থেকে আজ অবধি আর বন্দুকে হাত ছোঁয়াইনি । কোনও দিন আর ছোঁয়াবো না হয়ত ।
বর্ষার সময় কাঠের কোমপানিতে কাজ বেশ কম । একে তো সাপ্লাই প্রায় আসেই না । তার ওপর যেটুকু আসে, সব ভেজা কাঠ । সেটা ছিল জুলাই মাস । ঘোর বর্ষা নেবেছে । একটানা বৃষ্টিতে তিনদিন ঘরবন্দি । অবশেষে চারদিনের দিন বৃষ্টি ধরতে একরকম মরিয়া হয়েই বন্দুক ঘাড়ে করে বেরিয়ে পড়লাম । কাঁহাতক আর হাত পা কোলে করে বসে থাকা যায় ?
তিলপন উপত্যকাটা ছবির মত সুন্দর । চারপাশে খাড়া পাহাড়ের নিশিছদ্র দেয়ালে ঘেরা ঠিক একটা বাটি যেন । তার ভেতরে ঢুকতে গেলে পাহাড় টপকানো ছাড়া নান্যপন্থা । ভেতরটা সবুজে সবুজ.. একেবারে ভার্জিন ফরেস্ট । বনের ঠিক মাঝখানে একটা উঁচু টিলার মাথায় বনবিভাগের দু'কামরার বাংলো । দেড় হাত চওড়া একটা পাথরকাটা এবড়োখেবড়ো পথ প্রথমে খানিক এঁকে বেঁকে চলে তারপর একদম খাড়া উঠে গেছে বাংলোর দরজা পর্যন্ত । ওই রাস্তা আর বাড়িটুকু ছাড়া যতদূর চোখ যায় শুধু বন আর বন । মানুষের চিহ্ন নেই ।
ফরেস্ট বাংলোয় পৌঁছুলাম, বেলা তখন তিনটে হবে । তিলপনে সেই আমার প্রথমবার যাওয়া । পুবে হালকা মেঘ জমে ছিল । তার গায়ে পশ্চিমের রোদ পড়ে তখন ঝকমকে রামধনু উঠেছে । চারপাশের গামারি, সেগুন আর আমলকির বন থেকে, পায়ের নীচে ঘন ঘাসবন থেকে, বুনো গন্ধ ভরা ভাপ উঠছে । ঝিমঝিম করছে রোদ্দুর । একটা পাখি অব্দি ডাকে না, এত চুপচাপ ।
দুপুরের খাবার দিয়ে, রাতের খাবার বানিয়ে রেখে, হ্যারিকেন লন্ঠন দেখিয়ে দিয়ে চৌকিদার নেমে গেল বিকেল পাঁচটা নাগাদ । আটমাইল দূরে ওর গ্রাম । বলে গেল, ভোর ছটার মধ্যে ফিরে এসে বেড টি দেবে । লোকটা সাবধানী । বারবার বলে গেল, রাতে যেন বাইরে না বেরোই ।
চৌকিদার চলে যেতে বারান্দায় বসে বসে বেশ খানিকক্ষণ ধরে বন্দুক পরিষ্কার করলাম । বাংলোর হাতায় আমলকি গাছের ডাল বেশ কয়েকটা ঘুঘু বসে ছিল । বন্দুক দেখে ঘাবড়ালো না । ঠায় বসে রইলো সব ।
বুঝলাম আগে গুলি খায়নি কখনও । শিকার করতে বেশ সুবিধে হবে এই জায়গাটা ।
খানিক রাত বাড়তে খাওয়া দাওয়া সেরে একটা ফোল্ডিং চেয়ার নিয়ে বাইরে এসে বসলাম । বাংলোটা খুব নিরাপদ জায়গা বেছে তৈরি । ওই দেড় হাত চওড়া রাস্তা ছাড়া এই টিলার মাথায় ওঠবার আর কোনও পথ নেই । রাস্তাটার দিকে একটু নজর রাখলেই হল । ও ছাড়া আর কোনও পথে এখানে আসতে গেলে বাঘ ভালুকের ডানা গজাতে হবে ।
হালকা হাওয়া ছেড়েছে । চারপাশে আলোআঁধারি গাছগুলো থেকে শিরশির শব্দ আসছিল । তাই শুনতে শুনতে কখন যে দু'চোখ জুড়ে এসেছে খেয়াল নেই । বেশ খানিক পরে, চটকাটা আচমকা ভেঙে গেল । চাঁদ তখন খাড়া মাথার ওপর । শাঁ শাঁ করছে রাত । দীর্ঘদিন আর্মিতে, বিশেষত:, ফ্রন্টে কাজ করবার সুবাদে-- আমরা বিপদের গন্ধ পাই । আপাতদৃষ্টিতে বিপদের কোনও লক্ষণ না দেখা গেলেও কেমন একটা যেন অস্বস্তি হতে থাকে শরীরে । সেই অস্বস্তিটাই হঠাৎ ঘুম ভাঙিয়ে দিল । মনে হল যেন খুব কাছাকাছি কেউ এসেছে । শরীরটা শক্ত করে চোখের পাতা অব্দি স্থির করে বসে রইলাম বেশ অনেকক্ষণ । তারপর ঘাড় না ঘুরিয়েই টের পেলাম, বাংলোর খোলা দরজাটা দিয়ে কেউ যেন বেরিয়ে এল । চট করে ঘাড় ঘোরালাম । জ্যোত্স্নায় দিনের মত হয়ে আছে চারদিক, কিন্তু কেউ কোথাও নেই ।
আমি ফ্রন্টে গেছি । অ্যাডভান্স লাইনে মুখোমুখি শত্রুপক্ষের সৈন্যের মত বিপজ্জনক জীব আর হয় না । তার কাছে বাঘ সিংহও তুচ্ছ । তাদের মুখোমুখি হয়েও ভয় আমি পাইনি । কিন্তু সেই নির্জন রাতে পিছন দিকে মুখ ঘুরিয়ে কাউকে না দেখে বুকটা কেমন ছ্যাঁৎ করে উঠল । চেয়ারটা ঘুরিয়ে নিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম । কি একটা বুনো ফুলের তীব্র গন্ধ পাচ্ছিলাম । অনেকটা হায়দ্রাবাদি আতরের গন্ধের মত । তারপর কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি ।
ছত্তর সিং চৌকিদারের ডাকে ঘুম ভাঙল চা এনেছে । পেশাদার সৈনিকের যা অভ্যেস, চোখ খুলে প্রথমেই নজর পড়ে নিজের বন্দুকের দিকে । দেয়ালের দিকে তাকিয়ে দেখি বন্দুকটা নেই । রাতে কি ভাবে যেন নীচে পড়ে গেছে । সেটাকে তুলে আনতে আনতে ছত্তর সিং বিড়বিড় করছিল-- "ফির ওহি খুসবু"...
বন্দুক হাতে তুলে নিয়ে দেখি তার গায়েও কালকের রাতের সেই ফুলের গন্ধ । জিজ্ঞাসা করলাম, "ও কীসের গন্ধ ছত্তর সিং ?"
সে কথার জবাব না দিয়ে সে হাত কচলে বললে, "এক বিনতি হ্যায় সাব । ইঁহা শিকার মৎ খেলনা ।"
সারাদিন ঘুরে ঘুরে গোটা পাঁচেক বনমুরগি আর দুটো ঘুঘু জুটেছিল । ফিরতে ফিরতে চাঁদ উঠে গেল । ছত্তর সিং সব ঠিকঠাক করে রেখে দরজা টেনে দিয়ে নীচে নেমে গেছে । বসবার ঘর পেরিয়ে শোবার ঘরে ঢুকে চৌকির পায়ার কাছে লন্ঠন রাখা থাকবার কথা । টর্চ জ্বালিয়ে সেটা খুঁজতে যাবো, দেখি জ্বলছে না । অথচ এই খানিক আগে রাস্তা বেয়ে ওঠবার সময়েও দিব্যি জ্বলছিল । অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে লন্ঠনটাও খুঁজে পাওয়া গেল না । কোথায় রেখেছে কে জানে ! এখন সারা রাত অন্ধকারে না থাকতে হয় ! আমি অবশ্য এত সহজে ঘাবড়াই না, রুকস্যাক ঘেঁটে অর্ধেকটা মোমবাতি বের হল । সেটা জ্বালিয়ে মরা পাখিগুলোকে বসবার ঘরের মধ্যে রেখে দরজা জানালা ভালো করে এঁটে, খাওয়া দাওয়া সেরে ন'টার মধ্যে বিছানায় । মোহন সিরিজের একটা বই ছিল সাথে । তার দু'এক পাতা পড়তে পড়তেই চোখ জুড়ে এল ।
কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম জানি না । একটা খসখস শব্দে উঠে বসলাম । খুব কাছাকাছি যেন কেউ নড়াচড়া করছে । রেডিয়াম দেয়া ঘড়িতে দেখলাম, রাত দুটো বেজে দশ । জানালার খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে সার্চলাইটের মত পূর্ণিমার চাঁদের আলো এসে পড়ছিল বিছানায় ।
খানিকক্ষণ সব চুপচাপ । তারপর শব্দটা আবার পেলাম । এবারে বসবার ঘর থেকে । তবে কি মরা পাখিগুলোর গন্ধে গন্ধে ....
মোমবাতি জ্বলে জ্বলে শেষ । টর্চও জ্বলছে না । আমি তখন মরিয়া । নি:শব্দে বন্দুকটা হাতে তুলে নিয়ে পা টিপে টিপে বসবার ঘরে ঢুকে এলাম, তারপর যেখানটাতে পাখিগুলো রাখা ছিল, সেদিকটা তাক করে ট্রিগার টিপে দিলাম । কানফাটা শব্দের সঙ্গে একটা মৃদু আলোর ঝলক, হালকা বারুদের গন্ধ .............
তীব্র আতরের গন্ধটা তক্ষুণি নাকে এসে লাগলো ফের । একটা ঘন চটচটে তরলের মত, গন্ধটা আমার সমস্ত চেতনায় ছেয়ে যাচ্ছিল । সরীর অবশ হয়ে আসছিল আমার .. হাত থেকে বন্দুকটা খসে পড়ল মেঝেতে ... জ্ঞান হারাতে হারাতে আবছা মনে পড়ে, দুটো চোখ দেখেছিলাম শুধু । ভারী করুণ, মমতাময় দুটো চোখ .. একদৃষ্টে আমায় দেখছে । অনেকগুলো পাখার মিলিত ঝটপটানির মৃদু আওয়াজ হল একবার .... তারপর শরীর জুড়ে ঝাঁপিয়ে এল চেতনাহীন, স্বপ্নহীন ঘুম ।
সকালবেলায় চৌকিদার এসে চোখে মুখে জল দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়েছিল । চেয়ে দেখি, বসবার ঘরের মেঝেতে শুয়ে আছি । বন্দুকটা পাশে পড়ে । লোহার নলটা বেঁকিয়ে গিঁট পাকানো । আর কোনও দিন গুলি চলবে না ওতে । আর, পাখিগুলো নেই ! একটা রক্তের দাগ, একটুকরো পালকও পড়ে নেই কোথাও । মেঝেটা তকতক করছে ।
সব শুনে ছত্তর সিং বলেছিল, এ বনের মা উনি সাহেব । বিধর্মীরা ওনার থানের ওপরে এই বাঙলো বানিয়েছিল । কারো কোনও ক্ষতি করেন না । করতে দেনও না । যাওয়ার আগে মায়ের নামে কিছু পুজো দিয়ে যাবেন আমার হাতে ।
দশ টাকা দিয়ে এসেছিলাম ছত্তর সিংকে । তারপর পাচমাড়িতে ফিরে কাজে ইস্তফা দিয়ে সটান কলকাতায় ফিরে আসলাম । জীবনে আর কখনও প্রাণী হত্যা করিনি ।
(পরবাস-৪০, জানুয়ারি, ২০০৮)