আমার বয়স তখন দশ । মিষ্টিমাসির চোদ্দ । কাজের লোক শৈলার কাছে ওর নেপালের গ্রামের ভূতের গল্প শুনতে শুনতে ও মামাতো পিসতুতো ভাইবোনেরা মিলে গুলতানি করতে করতে অনেক রাত হয়ে গেছে । তেতালার ছাদে শতরঞ্জি ও খেশ বিছিয়ে সবাই মাছপাতুরি হয়ে শুয়েছি । রাস্তার কুকুরদের এ ওকে বকুনির মতো ডাক ও ছাদের রেলিঙের ওপর উপচে পড়া নিমগাছের ডালের পাতার শিরশিরানি শুনে প্রথমে কিছুতেই ঘুম আসছিল না । শৈলার গল্পের শাঁখচুন্নি ব্রহ্মদত্যি কারিয়াপিরেতরা মাথার মধ্যে ওলোটপালট খাচ্ছিল । তারপর কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না ।
হঠাৎ বাথরুম যাওয়ার জন্যে ঘুম ভাঙতে দেখি যে মিষ্টিমাসি পাশে নেই । ছাদের এক পাশে আমিষ রান্নাঘর । তার বাতি জ্বলছে । রাতে সবার খাওয়া মিটতে রাঁধুনি বামুনদিদি অবশিষ্ট মাছ তরকারি ভাত মীটসেফে তুলে, মেঝে ধুয়ে, পিঁড়িগুলো দেয়ালের গায়ে দাঁড় করিয়ে বাড়ি গেছে । মাঝরাতে হেঁশেলের দরজার ভারি শিকল খুলে আলো জ্বালিয়ে কার কি দরকার পড়লো ? চোর নাকি ? মিষ্টিমাসিই বা গেলো কোথায় ?
উঠবো কি উঠবো না ভাবছি । ভূত আর চোরের দ্বৈত ভয় আমার বুকে দামামা বাজাচ্ছে । এমন সময় দেখি একটি সালোয়ার কামিজ পরা মূর্তি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসছে । মিষ্টিমাসি । আশ্বস্ত হলাম । যাক্ চোরের সিঁধের গুঁতো বা ভূতের থাপ্পড় খেতে হবে না ।
কিন্তু পরক্ষণেই আবার ভয়ে আমার হৃত্পিণ্ড একটা গোঁত্তা খেল । মিষ্টিমাসি অমন ধীরে ধীরে হাঁটছে কেন ? ভূতে পেয়েছে নাকি ? এক বগলে একটা কি ধরা, মিষ্টিমাসি আস্তে আস্তে রান্নাঘরের পাশের সিঁড়ি দিয়ে নামছে । রান্নাঘর থেকে আসা আলোয় দেখলাম মিষ্টিমাসির মুখে একটা অবাস্তব উদ্দেশ্যবিহীন হাসি । এক একটা সিঁড়িতে দাঁড়াচ্ছে আর টলছে, বোতল হাতে পায়ের জোর চলে যাওয়া মাতাল যেমন ফুটপাথে দ্বিধায় পা ফেলে । সাথে চুলের লম্বা মোটা বিনুনি বাড়িতে বাবার ঘরের দেয়ালঘড়ির পেন্ডুলামের মতো দুলছে । এই বুঝি পা ফস্কে পপাতধরণীতলে ।
ও পাশে শোওয়া রাঙামামি তখন নারীসুলভ মৃদু নাসিকাগুঞ্জরণে সারা দিনের ক্লান্তি ভঞ্জন করছেন । আমি ওনাকে বাচ্চার দোলনা দোলাবার মতো করে পরপর ধাক্কা দিলাম, আর সিঁড়ির দিকে চিত্কার করে ডাকলাম, - এই মিষ্টিমাসি, কোথায় যাচ্ছো ?
মিষ্টিমাসির কোনো বিকার হল না । ওই হাসি হাসি মুখ করে নামতেই থাকলো । আমি তখন ছুটে সিঁড়ির কাছে গিয়ে মিষ্টিমাসির উড়নিরহিত কামিজ খামছে ধরেছি । রাঙামামিও ততক্ষণে শাড়ি সামলাতে সামলাতে ও ফাটা গোড়ালিতে লাগানো কোল্ডক্রীমে ইষৎ পিছলাতে পিছলাতে এসে পড়েছেন ।
মিষ্টিমাসির চোখ খোলা, কিন্তু ভাবলেশহীন । দম দেওয়া বিদেশি পুতুলের পুঁথির চোখের মতো । একটা কথারও জবাব দিচ্ছে না । মনে হচ্ছে জেগে আছে কিন্তু কিচ্ছু শুনতে পারছে না । বগলের তলায় একটা শিশি, শক্ত করে ধরা । ছাড়ানো যাচ্ছে না । জাঁতিকলের মতো ধরে আছে । কি এই মূল্যবান বস্তু ?
ও হরি, মিষ্টিমাসির জামার সামনেটা তেল চুঁইয়ে পৃথিবীর কাননকান্তারের ম্যাপ হয়ে গেছে । গন্ধ বেরোচ্ছে মশলা টক মিষ্টি ঝাল ঝাঁঝের । বগলের তলায় আচারের বয়াম । বড়মামির করা জলপাইয়ের আচার । বামুনদি, দিদাই আর বড়মামি ছাড়া কারোর হাত দেওয়ার অধিকার নেই । নিষিদ্ধ ফল ।
সোরগোল শুনে বাড়ির সকলেই প্রায় উঠে পড়েছে । বড়মামা, রাঙামামা ধরাধরি করে মিষ্টিমাসিকে দোতলায় নীচে নিয়ে যেতে দিদাই উঠে পেয়ালায় জলে রুমাল ভিজিয়ে মিষ্টিমাসির চোখেমুখে পুলটিসের মতো দিয়েছেন । এত কাণ্ডের পর মিষ্টিমাসি ছটফটিয়ে জেগে রাগ রাগ মুখে বললো, - তোমরা আমায় এ রকম বিরক্ত করছো কেন ? - যেন অন্য সবার দোষ !
মামিরা সবাই মিষ্টিমাসির তেল ভেজা জামা বদলিয়ে দিদাইয়ের একটা ঢোলা সূতির সেমিজ পরিয়ে দিল ।
- অত আঁট জামা পরে শুতে হবে না, হজম না হয়ে পেট গরম হবে । - বললেন বড়মামি ।
- আর অত ভূতের গল্প শোওয়ার আগে শুনতে হবেনা, মাথা গরম হবে, - ফোড়ন কাটলো অর্ক, বড়মামার ছেলে ।
- অর্ক-বৈভব, গৌরাঙ্গ-প্রতিম, দীপা-অমৃতা, সবাই শুতে যাও । দিদাই বললেন ।
আমার উদ্বিগ্ন মুখ দেখে দিদাই জড়িয়ে ধরে বললেন - ভয় পাস না, তোর মিষ্টিমাসি এরকম ঘুমের মধ্যে মাঝে মাঝে হাঁটে । ওকে নিশি ডাকে । তাই ওকে আমরা একলা শুতে দিই না । - মিষ্টিমাসি দিদাইয়ের সাথে দোতলায় নীল ঘরে শুয়ে পড়ল ।
আমি তেতলার ছাদে বড়মামি, মনিমামি, রাঙামামির শরীরের বেষ্টনির মধ্যে তা দেওয়া পাখির ডিমের মতো গুমশুম এবার এক নিটোল ঘুম ঘুংএমালাম ।
পরের দিন দোতলার বারান্দায় লালজীর গোধূলিয়া বাজারের চেনা দোকান থেকে আনানো ডালপুরি ও আলু-কুমড়ো হিং-এর অমৃত তরকারি খেতে খেতে সবাই মিষ্টিমাসিকে গত রাত্রের ঘটনা নিয়ে খেপালো । বড়দের খাওয়া হয়ে তারা যে যার কাজে গেলে, গৌরাঙ্গ চোখ খোলা রেখে, সামনে দুটো হাত টানটান করে যন্ত্রচালিত রোবটের মতো করে মিষ্টিমাসির স্বপ্নাচরণ অনুকরণ করাতে, আমরা কয়েকদিনের ঠাট্টার খোরাক পেলাম ।
বড় যৌথ পরিবারের পিছনে লাগা, ইয়ার্কি, উত্যক্ত করা ইত্যাদিতে মিষ্টিমাসির বেশ অভ্যেস ছিল । তাই বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে আমাকে পরে আরো ওর এই নিশিভ্রমণের গল্প শোনালো ।
ছয়সাত মাস অন্তর নাকি মিষ্টিমাসির এরকম ঘুমের মধ্যে হাঁটাচলার ঘটনা ঘটে । চোখ খোলা থাকে, কিন্তু দৃষ্টি থাকে না । শরীরটা চলে কিন্তু জ্ঞান থাকে না । ওর কিছুই মনে থাকে না । একবার নাকি দরজা খুলে বেরিয়ে সদরের লোহার গেটের গ্রীলে পা দিয়ে বেয়ে উঠবার চেষ্টা করেছিল । সেবার নাকি বিড়বিড় করে কথাও বলেছিল । যে রাজেন্দ্রপুরীতে হিন্দি সিনেমা দেখতে যাবে সে । অর্থাৎ মামাবাড়ির চোখে নিষিদ্ধ, নিষিদ্ধ অভিসার ।
দুই বছর আগে মিষ্টিমাসির বিয়ে হয়ে গেছে । ত্রিপুরার এক জমিদার বাড়ির ছেলের সাথে । খুব ধূমধাম করে বিয়ে হয়েছিল । তিরিশ জন বরযাত্রীকে প্রায় চারদিন ধরে ভেলুপুরায় ডায়মণ্ড হোটেলে রেখে, তাদের রাজার হালে তোষামদ করে, তাদের পাঁচটা বজরা করে কেদারঘাট থেকে মণিকর্ণিকার চিতা-জ্বলা আধিভৌতিক আধিস্বর্গীয় রূপ দেখিয়ে, দশাশ্বমেধঘাট অবধি গঙ্গার হাওয়া খাইয়ে আমাদের বাড়ির লোকেরা জেরবার হল ।
মনে আছে রামনগরের রাজা ও রাণী নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন । রাজবাড়ি থেকে ভাড়া করা হাতির পিঠে সোনার কাজ করা হাওদায় বসে নতুন মেশো বর বেশে এসেছিল । বরের টিকোলো নাক, বড়বড় চোখ, কবাট বক্ষ দেখে বাড়ির মেয়েদের সব মূর্ছা যাবার জোগাড়, আর কি । তবে আমার কেমন যেন মনে হয়েছিল যে একটু রাগি রাগি চেহারা । সিনেমার খুব হ্যাণ্ডসাম ভিলেনের মতো । আমার বুকটা কেঁপে উঠেছিল । দিদাই ও মারও বোধহয় তাই মনে হয়েছিল । দিদাই বর বরণ করার আগে - দুগ্গা-দুগ্গা হরিনারায়ণ, - ইত্যাদি কয়েকবার বলে নিয়েছিলেন । মা ঘোমটা দিয়ে বরণডালা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার আগে অস্ফুটে স্বগোতক্তি করেছিলেন, - মেয়েটা বড় অভিমানি-
চার মামিমারা মিলে মিষ্টিমাসিকে সাজিয়েছিলেন । চন্দন কুমকুম টিকলি কাজল ঘোমটায় রোজকার স্বল্পাভরনা আল্গা ঢলঢলে সৌন্দর্যের মিষ্টিমাসিকে এক সাজানো অচেনা রাজকন্যা পুতুলের মতো লাগছিল । পদ্ম আঁকা পিঁড়িতে করে আমার চার মামা পাল্কিবাহিদের মতো যখন ওকে সোনারপুরার মামাবাড়ির ওই দালানবাড়ির উঠোনের সিঁড়ি দিয়ে নামাচ্ছিল তখন মনে হচ্ছিল যেন রাজপ্রাসাদ থেকে ভেল্কি গালিচায় পরীদের সম্রাজ্ঞী নামছেন । এতো রূপ, এতো অবাককরা রূপ মিষ্টিমাসির এই বিয়ের সাজে । উত্তেজনায় আমার ও আমার মামাতো ভাই বোনেদের তিন রাত্রি চোখে ঘুম ছিল না ।
কি না দিয়েছিলেন দাদু দিদাই বিয়েতে । চোখ ধাঁধাঁনো গয়না । থরে থরে নানান রঙের বেনারসী শাড়ি বড়মামার চেনা দোকানে বিশেষ অর্ডার দিয়ে বানানো । মানানসই চটি, বটুয়া, টিপ, রুমাল, লিপস্টিক । ঝকমকে ব্রোচ, কাশ্মীরী কাজ করা শাল, পাগলকরা গন্ধের বিদেশি সেন্ট । কুট্টিমামির বন্ধুকে দিয়ে লণ্ডনের মার্কস এণ্ড স্পেন্সার থেকে আনানো কালো লেসের প্রজাপতির মতো ফুরফুরে অর্ন্তবাস । নানান আশ্চর্য মোড়কে মোড়া মানুষের প্রত্যেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গের প্রসাধনের জন্যে ত্রক্রীম, লোশান, সাবান, তেল । তাছাড়া যাবতীয় উপযোগিতামূলক জিনিষ । রাজস্থানী ধাঁচের আসবাবপত্র, আয়না লাগানো গড্রেজ আলমারি, ফিলিপ্স ফ্রীজ, মার্ফি রেডিও, গ্রুনডিগ্ টেপরেকর্ডার, উষা টেবিলফ্যান, বার্মার টীকের পালঙ্ক আর ষোলটা গুপ্ত ড্রয়ার দেওয়া ড্রেসিং টেবিল ।
এত যৌতুক সত্ত্বেও পরে বড়দের মহলে কানাঘুষো শুনেছিলাম যে গাড়ি দেওয়া হয়নি বলে মিষ্টিমাসিকে শ্বশুরবাড়ি থেকে নাকি অনেক খোঁটা শুনতে হয়েছিল । বড়দের আরো টুকরো গল্পের জোড়াতালি দিয়ে বুঝেছিলাম যে দাদুর যদিও গোধুলিয়াতে রেকর্ডের বিরাট ব্যবসা ছিল - গুপ্ত এণ্ড সন্স - শেয়ারমার্কেট তার আগের বছর পড়ে যাওয়াতে অনেক টাকা হারিয়েছিলেন । বড় মেয়ে ও চার ছেলের বিয়েতে যথেষ্টই জাঁকজমক করেছিলেন । কিন্তু ছোট মেয়ের বেলায় গোপন অর্থকষ্টের সাথে জমিদার বেয়ানবাড়ির সাথে পাল্লা দিয়ে সম্মান বজায় রাখতে গিয়ে যৌতুকে গাড়ি দেবার মতো সামর্থ ছিল না । পণপ্রথার প্রতি আমার একটা স্বাভাবিক মানসিক অসহযোগিতার সাথে জুড়েছিল মিষ্টিমাসিকে এই নিয়ে কথা শোনানোর অবিচারি রুচিহীনতার প্রতি এক অর্ধস্পষ্ট ক্ষোভ ।
তারপরে অবশ্য সেসব কথা মনের মধ্যে ক্ষীণ হয়ে এসেছে । যখন মিষ্টিমাসির শ্বশুরবাড়িতে শীতের তত্ত্ব পৌঁছাতে গেছি, তখন শাড়ি-গয়না-লুডোর বড়গুটির মতো সিঁদুরের টিপ-অলংকৃত জ্বলজ্বলে মুখের মিষ্টিমাসিকে দেখে আশ্বস্ত হয়েছি । মিষ্টিমাসির ননদ আমাদের নিয়ে সারা বাড়ি, মিষ্টিমাসির বৌভাতে পাওয়া শাড়ি গয়না দেখিয়েছে । নতুন মেশো বড় বড় চোখে হাসির ঝিলিক এনে মামাদের আপ্যায়ন করেছেন । নতুন মেশোর মা আমাদের ক্ষীরকদম্ব ও তালশাঁস জমিদার বাড়ির রূপোর রেকাবে করে আম পোড়া সরবতের সাথে খেতে দিয়েছেন । মামিমাদের হাতে দিদাই-এর জন্যে গরদের শাড়ি পাঠিয়েছেন । আমি নিশ্চিন্ত হয়েছি যে মিষ্টিমাসি ভালো আছে ।
সেবার হায়ার সেকেণ্ডারি পরীক্ষার পরে বেনারসে গেছি । এক টানা মাস তিনেক থাকব । কলেজের অ্যাপ্লিকেশন লিখব আর মামাবাড়ির আদরে গত কয় মাসের পড়ার চাপের হাড়মাস কালি করা ধকলের অবসান ঘটবে । মিষ্টিমাসিও ওই সময়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে আসবে, তাই সোনারপুরার আমজনতা নিদারুণ উত্তেজিত ।
নির্দিষ্ট দিনে আমরা মুঘলসরাই স্টেশন থেকে মিষ্টিমাসিকে আনতে গেলাম, যাতে আবার ট্রেন চেঞ্জ করে বেনারস লোকাল না ধরতে হয় । গাড়িতে বড়মামার ছেলে অর্ক, মণিমামার ছেলে গৌরাঙ্গ, রাঙামামার মেয়ে দীপা ও আমি । সাথে ফ্লাস্কে মধু দেওয়া মকাইবাড়ি চা ও ধামা ভরা মটরশুঁটির কচুরি ।
প্ল্যাটফর্ম টিকিট কেটে আমরা ভাই বোনেরা ডামাডোলের ভয়ে হাত ধরাধরি করে বুকস্টলের কাছে দাঁড়িয়ে আছি । ট্রেনের পা দাপানো গর্জন আস্ফালন, লোকের পিপীলিকা ভিড়, পকোড়া-মুম্ফলি-চাটমশালার ঘ্রাণ অতিক্রম করে আমাদের দৃষ্টি উদগ্রীব হয়ে র্ফাস্টক্লাস গুলোর দিকে তাকিয়ে আছে । মিষ্টিমাসির বর, নতুন মেশো আসবেন না জানি । জমিদারির অনেক কাজ । ড্রাইভার লালজি প্যান্টের তলা কয়েক পরত গুটিয়ে, হাওয়াই চটি ফট্ফটিয়ে ট্রেন ও জনতার সাথে দৌড়াচ্ছে ।
দূরে দেখি দুই মেরুন উর্দি পরা কুলির মাথায় চারটে সুটকেস চাপিয়ে মিষ্টিমাসি আসছে । ট্রেনের ক্লান্তিতে চুল উশকো খুশকো, শাড়ির প্লীট অর্ধস্খলিত, কপালের সিঁদূরে উল্কার মতো পুচ্ছ ।
মিষ্টিমাসির সাথে এক বুড়ো ভদ্রলোক । আমরা সব ছুটে গিয়ে মিষ্টিমাসির হাত থেকে ব্যাগগুলো নিলাম । মালপত্র গুলো মারুতি ভ্যানের পিছনে ভরা হল ।
- ইনি দেওয়ান কাকা--, মিষ্টিমাসি পরিচয় করিয়ে দিল ।
দেখলাম ভদ্রলোক গাড়িতে উঠলেন না । বা কাঁধের ঝোলাটাও নামালেন না ।
-- এবার আমি যাই, বৌমা, -- উনি মিষ্টিমাসিকে সম্বোধন করে বললেন ।
-সে কি, বাড়িতে যাবেন তো । -মার শেখানো ভদ্রতাগুলি ব্যস্ত সুরে আমি বললাম, যেহেতু আমিই স্টেশনের সম্বর্ধনা সমিতির মধ্যে বাড়ির তরফ থেকে সবচেয়ে বড় ।
-- না, মা, আমায় ফিরতি ট্রেনেই ত্রিপুরা ফিরতে হবে । ধান বোনার সময় এটা । একটুও বসার উপায় নেই । ভদ্রলোক একটু ম্লান হাসলেন ।
মিষ্টিমাসি ওনাকে প্রণাম করল । মনে হল যেন চোখে জল ।
- বাড়িতে কিছু বলতে হবে ? -- ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন ।
- না না -। দ্বিধাগ্রস্ত মিষ্টিমাসির গলা ।
ভদ্রলোক স্টেশনের দিকে ফিরে চললেন ।
আর আমরা গাড়ি করে রওয়ানা হলাম বেনারসের দিকে ।
পথে প্রায় হাতাহাতি লেগে গেল গৌরব আর দীপার মধ্যে, মিষ্টিমাসির পাশে কে বসবে । শেষ পর্যন্ত দুজনে মিষ্টিমাসির দুই ধারে বসলো । আমি এক কোনায় জানালার ধারে । অর্কের বয়স প্রায় চোদ্দ, ঠোঁটের উপরে সরু তুলির পরশ বোলানো গোঁফের ইশারা । তাই লালজির পাশে সামনে বসলো ড্রাইভারের শাগরেদ হিসেবে ।
গাড়ি চলতে লাগলো । জানলার হু হু হাওয়ায় ট্রেনের ধুলোয় রুক্ষ মিষ্টিমাসির চুল মামাবাড়ির সদর গেটের পাশের বোগন্ভিলিয়া ফুলের গর্ভকেশরের মতো ইতি উতি উড়ছিল । যাত্রার ক্লান্তি মুখে । দুবছর আগের থেকে রোগা হয়ে গেছে । মিষ্টিমাসির ওই পাড়ার ছেলে পাগল করা সুন্দর চোখের নীচে নৌকার গলুইয়ের মতো ত্রিকোন কালির বিস্তার । কিঞ্চিৎ রুগ্ন, উদাস ভাব । ভাবলাম, বাচ্চা হবে নাকি ? অন্ত:সত্বা হলে শুনেছি চেহারার জৌলুষ বাড়ে । কিন্তু কারো কারো হয়ত উল্টোটা হয়, কে জানে ।
বাড়ি পৌঁছাতে দেখি দরজায় ভিড় । দাদু, দিদাই সবচেয়ে আগে দাঁড়িয়ে আছেন । অবাক হলাম ওনাদের মুখের ভাব দেখে । কোথায় হাসি মুখে সবাই দৌড়ে আসবে । তা না, উদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে দরজার কাঠগোড়ায় সব স্থবির মূর্তির মতো প্রস্তরিত ।
নেমেই মিষ্টিমাসি দিদাইকে জড়িয়ে কেঁদে ফেললো । দাদু অস্থির হয়ে, -মা, সোনামা, -ইত্যাদি বলে মাসির মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন । একটু সুস্থির হয়ে বড় ঘরের সোফায় বসে মিষ্টিমাসি রেক্স অরেঞ্জ স্কোয়াশ আর রাঙামামির করা কালাকাঁদ সন্দেশ খেলো । আমরা ছোটরা কেউ বাড়িতে পরার হাওয়াই চপ্পল এনে দিলাম, কেউ পাখা করতে লাগলাম, কেউ পা রাখার ছোট মোড়া এনে দিলাম । বড়মামি ও ডি কলোন মাখা ভিজে ছোট তোয়ালে দিয়ে মিষ্টিমাসির মুখ মুছিয়ে দিল ।
কিছুক্ষণ পরে দিদাই মিষ্টিমাসিকে বললেন, - যাও স্বামীজিকে প্রণাম করে এসো ।
মামাবাড়িতে `সন্ন্যাসীর ঘর' বলে একতালায় একটা ঘর আছে । দিদাই কোনো বৃদ্ধ বা অসুস্থ সন্ন্যাসীকে বছরের পর বছর, এমন কি আজীবন রেখে তার সেবা শুশ্রুষা, ভরণপোষণের ভার নেন । দাদুর ধর্মকর্মে বিশেষ মন না থাকলেও, দিদাই-র এই সেবাপ্রীতিতে আপত্তি করেন না । আমার ছোটবেলায় ছিলেন প্রভান্জি । ওনার সিদ্ধি ছিল, লোকে বলত । হাত ঘুরিয়ে দিদাইকে উনি হরিতকি, ডুমুর ইত্যাদি ভেল্কির মতো বের করে দিতেন নাকি । যকৃতের ক্যানসারে বহু বছর কষ্ট পেয়ে মারা যান ।
গত তিন বছর ধরে আছেন শুকদেব বাবা । অল্প বয়সে চোখের অসুখে দুই চোখ অন্ধ । কুড়ি বছর বয়সে সন্ন্যাস নেন । বেনারসে মদনপুরার এক আশ্রমে গুরু সকাশে ভালোই ছিলেন । গুরু মারা যাবার পরে গুরুভাইরা অন্ধ অসহায় আশ্রমিককে দেখাশোনা করার দায়িত্ব নিতে চাইলেন না ও অবহেলায় ফেলে রাখলেন ।
শুকদেব বাবা রাস্তার ধারে গান করে নিজের অন্ন সংস্থান করার চেষ্টা করতেন । বর্ধমানে কৈশোরে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের শিক্ষা ছিল । অন্ধত্বের পরে গান আর ধর্মের অন্বীক্ষাই হয়ে উঠেছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান । গুরুর দেহলাভের পরে পথের ধারে গান করতেন আর বলতেন, - আমায় পয়সা দিও না, একটু খেতে দাও ।
এক অন্ধের পক্ষে পয়সা নিয়ে দোকানে খরিদ করা, নিজে রান্না করা দুষ্কর হয়ে উঠত । দিদাই-এর সত্সঙ্ঘ সমিতি ওনার করুণ দশার কথা দিদাইকে জানায় । দিদাই খবর পেয়ে ভেলুপুরার এক অখ্যাত ধর্মশালা থেকে ওনাকে তুলে বাড়িতে নিয়ে আসেন ।
সেই থেকে শুকদেব বাবা সোনারপুরার মামাবাড়ির সন্ন্যাসীর ঘরে থাকেন । শনিবারে শনিবারে দিদাই-এর সত্সঙ্ঘ অধিবেশন নিচের হলঘরে হয় । শুকদেব বাবা রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, উপনিষদ, দর্শনের কথা বিস্তার করে বলেন । উনি ও অন্যান্যরা ভক্তিমূলক গান করেন । সাত্ত্বিক নিরামিষ খাওয়া হয় । বাড়ির সব পুজোগুলি উনি করেন । এ ছাড়া সারা দিন নিজের ঘরে বসে রেডিও বা টেপরেকর্ডারে গান শোনেন ও গুনগুন ভাঁজেন । দাদু ও মাদের রেকর্ডের দোকান থেকে ক্লাসিকাল্ ও ভক্তিগীতির অডিও টেপ থরে থরে জোগান হয় । যেন ভগবান শুকদেব বাবাকে বেছে বেছে সঠিক স্থানে আশ্রিত করেছেন ।
মিষ্টিমাসির সাথে শুকদেব বাবার ঘরে আমিও গেলাম । ওনার ঘরে সর্বদা মিষ্টি মৃদু চন্দন ও বিশ্বনাথ গলির কর্পূর গন্ধী ধূপের সুবাস । আমার ওখানে যেতে খুব ভালো লাগে । মনে হয় যেন পবিত্র কন্বমুনির আশ্রমে শকুন্তলার সখি আমি প্রিয়ংবদা এসেছি ।
দেখি জানলার সামনে শুকদেব বাবা দাঁড়িয়ে আছেন । পায়ের শব্দে মুখ ফেরালেন । লম্বা ফর্সা দোহারা চেহারা । বছর পঁয়তাল্লিশ বয়স । গেরুয়া পাজামা ও ফতুয়া পরা । বুকের উপর গেরুয়া তসরের শাল । বড়মামা শিলাইদহ থেকে এনে দিয়েছিলেন । সন্ন্যাসীদের ইউনিফর্ম । কিন্তু ছিমছাম । আলখাল্লার মতো ঢোলা নয় । বিবেকানন্দের মতো বড় বড় চোখ । কে বলবে যে উনি অন্ধ । পূর্ণকুম্ভের গঙ্গাজলের মতো অতল টলটলে দৃষ্টি । যেন সব দেখতে পাচ্ছেন । যা না দেখার, তাও ।
- একটা পাখি ডাকছিল । খুব সুরেলা । পরজ্বসন্তের মতো অনেকটা । একটু কাছ থেকে শোনার চেষ্টা করছিলাম । - উনি বললেন ।
- মিষ্টিমাসি এসে গেছে । -আমি বললাম ।
- মি -, ও কে উজ্জ্বলা-মা ? এসো ।-
মিষ্টিমাসির নাম উজ্জ্বলা-কৌশিকি । দিদাই-এর দেওয়া । দিদাই-এর বাবা বাঙলার মাস্টার ছিলেন । দিদাই-এর অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়াতে স্কুলের পড়াশুনা বেশি ছিল না কিন্তু ভাষার উপর অপরিসীম ঝোঁক ছিল । ছেলেমেয়েদের ও নাতি-নাতনিদের নাম উনি এইভাবে জোড়া বেঁধে দিয়েছিলেন । ওনার বিশ্বাস যে জোড়া বাঁধা নামে নামের সৌন্দর্য ও গূঢ়ত্ব বাড়ে । বড়মামার ছেলে অর্কের পুরো নাম অর্ক-বৈভব । মণিমামার ছেলের নাম গৌরাঙ্গ-প্রতিম । রাঙামামার মেয়ের নাম দীপা-অমৃতা । আমার মার নাম স্বাতী-বন্দনা । আমার বাবার বাড়িতে আমার একটাই নাম - কাজরী । দিদাই ডাকেন কাজরী-অর্পিতা । তবে দিদাই-এর মুখে মার ও আমার নাম অন্য ভাবে শুনতে প্রথম প্রথম হাসি পেতো । কিন্তু তারপর সয়ে গেল । এমনিক ভালোও লাগতে লাগলো । যেন আমরা একেকটি কবিতার উপবাক্য ।
মিষ্টিমাসি ঝুঁকে শুকদেব বাবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো । ফর্সা সুদর্শন পা । সারনাথে দেখা শ্বেতপাথরের বুদ্ধের ভাস্কর্যিত পদযুগলের মতো ।
- সব ভালো তো ? -- জিজ্ঞেস করলেন উনি ।
- হ্যাঁ, - অস্পষ্ট স্বরে বলল মিষ্টিমাসি । গলায় তখনও যাত্রার ক্লান্তি ।
পাশের টেবিলে ওনার প্রয়াত গুরু রামানন্দের ছবির সামনে রাখা গ্যাঁদাফুলগুলির দিকে আন্দাজে হাত বাড়ালেন শুকদেব বাবা । একটি ফুল তুলে মিষ্টিমাসির দিকে নিজের অঞ্জলিবদ্ধ হাত বাড়ালেন ।
- শান্তি হোক । - বললেন ।
মিষ্টিমাসি কিছু বলল না । একটু ম্লান হেসে ফুল নিয়ে ধীরে বেরিয়ে আসলো । শুকদেব বাবার জ্যোতিহীন চোখ কি মিষ্টিমাসির চেহারা ও অনুজ্জ্বল হাসি দেখতে পেল ?
কদিন মিষ্টিমাসির পাত্তাই পাওয়া গেল না । রাত্রে দিদাই-এর ঘরে শুলো মিষ্টিমাসি । দিনেও তথৈবচ । মামিরা ট্রেতে করে খাবার ঘরে দিয়ে আসছেন । আমরা ওর নাগাল পাওয়ার জন্যে ছুকছুক করছি । কিন্তু মিষ্টিমাসির না হল ছোটদের সাথে রাত জেগে গুলতানি, না একসাথে রেডিওতে ক্রিকেটের কমেন্টারি শোনা, না এক সাথে সিনেমার গানের অন্তাক্ষরী খেলা । ভাবলাম, মিষ্টিমাসির শরীর নিশ্চয় বেশ খারাপ, তা না হলে এমন ভাবে বিছানায় আশ্রয় নেয় ! বিরক্ত না করাই ভালো । রোয়া ক্লিষ্ট ভাব মানে নিশ্চই ব্যাপার গুরুচরণ । অর্থাৎ দোহদ লক্ষণ ।
চার দিনের দিন মিষ্টিমাসি আমাদের সাথে খেতে বসলো । কদিন বাড়ির বড়দের তদারকে থেকে, নিরবসান ঘুমিয়ে আর তিনবার করে ওভাল্টিন দিয়ে গরম দুধ খেয়ে দেখলাম কিছুটা চাকচিক্য ফিরেছে । স্নান করে গোলাপি পাড় দেওয়া ভুট্টার পাতার মতো সবুজ রঙের শাড়ি পরে প্রায় আগের মতোই সুন্দর লাগছে । দেখলাম ঠোঁটের কোনায় পুরনো সেই হাসিটা তিরতির করে গ্রীষ্মের পাহাড়ি ঝর্নার মতো শীর্ণকায় বইছে, কিন্তু চোখ পর্যন্ত তার সেচন পৌঁছায়নি । খাওয়ায় দেখলাম রুচি নেই । আবার সন্দেহ হল । আচার টাচার খাবে নাকি । এই সময় মার অনুপস্থিতিটা খুব অনুভব করছিলাম । মা থাকলে ঠিক রহস্য খুলে বলতেন । দিদাই বা মামিদের কাছ থেকে কোনো খবরই উদ্ধার হল না । সবারই এক ধরনের কয়েকটা পেটেন্ট জবাব, -- এত বড় শ্বশুরবাড়ির উপরনিচ করতে করতে রোগা হয়ে গেছে ।
- শরীরটা ভালো করতেই তো বাপের বাড়ি আসা ।
আমার সন্দেহের নিরসন হল না ।
এক সপ্তাহ পরে এক বিকেলে মিষ্টিমাসি বলল - চল একটু ছাতে হাওয়া খেতে যাই । সকালে এক পসলা বৃষ্টি হয়ে গুমোট কমেছে কিছুটা । বিশ্বকর্মা পুজো উপলক্ষ্যে দূরে প্যাণ্ডেলে লাউডস্পিকার বাজছে, - চাঁদ সা মুখ্রা, কিঁউ শরমায়া ?
দোকানে দোকানে আলোর মালা টাঙানো । কয়েকদিন আগে গণেশ চতুর্দশীর ভাসান গেছে । গণেশ বাণিজ্যের ও বিশ্বকর্মা কারিগরদের দেবতা । তাই সারা মাস ধরেই প্রায় উত্সব চলছে । মামাবাড়ির রেকর্ডের ব্যবসা বলে `গুপ্ত এণ্ড সন্স্'-এর নিয়ন । বিজ্ঞাপনটায় লাল নীল টুনি বাল্ব দিয়ে আরো প্রজ্জ্বলিত করা হয়েছে । সোনারপুরার চৌমানি থেকে ভেলুপুরা চৌমানি অবধি লাইটহাউসের সার্চলাইটের মতো দ্যুতিময় দেখা যাচ্ছে । দোকানে গণেশ ও বিশ্বকর্মার মূর্তি ফুল ও বাতি দিয়ে সাজানো ।
ভাদ্রের নীল উত্তরীয়ের মতো আকাশে নানান রঙের ও আকারের ঘুড়ি উড়ছে । উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশে বিশ্বকর্মা পুজোর দিন ঘুড়ির লড়াইয়ের দিন । কত রকমের মজার নাম বিভিন্ন ঘুড়ির, অর্কের কাছে শিখলাম । পেটকাটি, চাঁদি.য়াল, মোমবাতি, বগ্গা, চৌরঙ্গি, ময়ূরপঙ্খী । কোনোটা চাঁদের মতো, কোনোটা বেলুনের মতো । কোনোটার সাপের মতো গলা, মানুষের মতো মুখ । সুকুমার রায়ের হাঁসজারু বকচ্ছপের মতো - আমরা নাম দিলাম `সানুষ' ।
রাত জেগে অর্ক, গৌরাঙ্গ ও ড্রাইভার লালজি বোতল ভেঙে, কাঁচ গুঁড়ো করে, ভাত চটকিয়ে লেই করে সুতোয় মাঞ্জা দিয়েছে । সুতো নয়তো ধারাল রামদা, পাঁঠাবলি দেওয়া যায় । ময়দা গুলে আঠা করে লাল, হলুদ, বেগুনি, পাতলা কাগজ পাটকাঠি, ঝাঁটার কাঠির ফ্রেমে আটকিয়ে বেশ কয়েকটা জব্বর ঘুড়ি তৈরি হয়েছে ।
মিষ্টিমাসি কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে ছাতের রেলিং ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল ।
- তুই আর কতদিন থাকবি ? - জিজ্ঞেস করলো ।
- আড়াই মাস । - বললাম ।
- ভালো হল । তুই থাকলে আমার মন ভালো লাগবে ।
- কেন, তোমার মন খারাপ কেন ?
পাশের বিশ্বাস বাড়ির ছাতের আকাশে একটা প্রকাণ্ড সূর্যমুখির মতো কমলা রঙের ঘুড়ির সাথে আরেকটা নীল লেজ-ওয়ালা সাদা ঘুড়ি লড়ছিল । সূতোর সাথে সূতোর প্যাঁচ । পাশের বাড়ির বাবলুর হাতের লাটাই থেকে সাঁই সাঁই করে সূতো খুলতে লাগলো । বাবলু ঘুড়ির লড়াইয়ে চ্যাম্পিয়ন । দুই হাত ঘুরিয়ে, লাটাইটা গাড়ির স্টিয়ারিঙের মতো চালাতে লাগলো । হাতের কায়দা আর সূতোর ধার নির্ধারিত করবে বিজয়ী কে ।
হাওয়ার ঝোঁকে আমাদের ছাতের উপরে পাক দিয়ে দিয়ে লড়তে লাগলো ঘুড়িরা । অর্ক আর গৌরাঙ্গ ছাতের একদিক থেকে আরেক দিক দৌড়াতে লাগলো, যদি কাটা ঘুড়ি লুটতে পারে । পাড়ার বহু ছেলে কাটা ঘুড়ির লোভে রাস্তায় ছুটছে । বড়মামার কঠিন আদেশ, রাস্তায় কেউ দৌড়াবে না । বহু মারাত্মক দুর্ঘটনা এইভাবে হয়েছে ।
- ভোঁ-কাট্টা হলুদ !! জিন্দা রহে সফেদ-ওয়া ! - অর্ক চেঁচাচ্ছে । বাবলুর ঘুড়িটা সাদা । গৌরাঙ্গের চোখ উত্তেজনায় বিস্ফারিত ।
- দেখ, আমি ওই হলুদ ঘুড়িটার মতো । - মিষ্টিমাসি অনেকক্ষণ পরে বলল ।
আমার সোজাসুজি প্রশ্নের এরকম হেঁয়ালির মতো উত্তর শুনে আমি একটু বিভ্রান্ত হলাম ।
- তার মানে ?-
- ওই ঘুড়িটার মতো বেশ আকাশে উড়ছিলাম । হঠাৎ একটা সাদা নীল ডাকাত এসে আমার গলা কেটে দিল । --
-- এ রকম বলছো কেন, মিষ্টিমাসি ? - আমি আকুল হয়ে ওর দুই কাঁধে হাত রেখে ওর মুখের দিকে তাকালাম ।
মিষ্টিমাসি পাল্টে আমার দিকে তাকাল না । একটু হাল্কা ভাবে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল ।
- তা আর শুনে কি করবি ?
- বলই না । -
- আমার বিয়েটাই আমার জীবনকে ভোঁ-কাট্টা করে দিয়েছে ।
- সে কি, কি বলছ তুমি ? মিষ্টিমাসি, কি হয়েছে বল ।
আমার মনে হল যেন দধীচির হাড় দিয়ে বজ্র তৈরি করে বিশ্বকর্মা ইন্দ্রকে দিলেন । আর এই মুহূর্তেই সেই বাজ যেন আমার বুকে বাজলো । মনে পড়ল সেই ধুমধাম করে বিয়ে, বিয়ের সাজে রাজকন্যার মতো ভুবনমোহিনী মিষ্টিমাসি, টোপর পরা লম্বা গম্ভীর বর ।
- আর দুদিন পরে তোর বিয়ে হবে । সুখী মনে বরের ঘর করতে যাবি । তোকে বিয়ের ব্যাপারে কিছু খারাপ বলা আমার উচিৎ নয় ।
ভয়ংকর অভিমান হল । ছোটবেলা থেকে সব প্রাণের গল্প আমাদের পাশাপাশি শুয়ে হয়েছে । বড় হওয়ার, মেয়ে হওয়ার, কুসুমিত হওয়ার সব দুর্মদ গোপন কথা আমি মিষ্টিমাসির কাছে শুনেছি । এখন হঠাৎ এই দূরত্ব কেন ।
- নতুন মেশো কেন এল না তোমার সাথে ? - আমার হৃদয়ের টালমাটালকে স্তব্ধ করতে এই প্রশ্ন করলাম ।
হঠাৎ সোরগোল বেড়ে যাওয়াতে লক্ষ করলাম যে হলুদ ঘুড়ি ঘাড় লটকে নেতিয়ে পড়েছে । বাবলু এক শেষ মোক্ষম খ্যাঁচ টান দিয়ে নিজের নীল সাদা কে এই টুকরো আকাশের আওতায় একমেবাদ্বিতীয়ম করে তুলেছে । আর হলুদ ভাসতে ভাসতে নামছে নিচে পৃথিবীর দিকে, যেন অকুলপাথারে তলাচ্ছে ।
এমন সময় মামাতো বোন দীপা লাফাতে লাফাতে এসে খবর দিল যে বিকেলের চা-এর সাথে বেনারসের বিখ্যাত চূড়া-মটর আর দই সমেত গোলগাপ্পা জলখাবারে পরিবেশিত হয়েছে দোতলার খাবার ঘরে ।
এরপর আর মিষ্টিমাসির সাথে এই প্রসঙ্গে কথা এগোলো না ।
আর কদিন বাদে মিষ্টিমাসি দোতলার নিজের কোনার ঘরে চুতে শুরু করল । আর নিজের জিনিসপত্র নিয়ে ছড়িয়ে বসল । মাঝে মাঝে গুনগুন করে গানও ভাঁজতে লাগলো । মনে হল একটু নিজেকে প্রকৃতিস্থ করার চেষ্টা করছে । আমিও ভরসা পেয়ে ওর ঘরে আগের মতো শুতে লাগলাম ।
একদিন দেখলাম কোনার ঘর থেকে তানপুরাটা উদ্ধার করে তার কাপড়ের খোলশ থেকে বের করছে ।
- জানিস তো ত্রিপুরায় গিয়ে পর্যন্ত আমি এক দিনও গান করিনি । মিষ্টিমাসি তার টুংটাং করতে করতে বলল ।
- সে কি, তুমি এত ভালো গান কর । - আমি অবাক হয়ে বললাম ।
বাড়িতে কাশী থেকে দাড়িওয়ালা ওস্তাদ আনিয়ে দাদু দিদাই মিষ্টিমাসিকে বহু বছর গান শিখিয়েছেন । দিদাই ঠায় পিছনে বসে থাকতেন গানের ক্লাসের সময়, পর্দা ও পাহার.ংআর খাতিরে । মনে আছে প্রথম প্রথম একই গান দিনের পর দিন চলত । সব গুণীজন ইমন গাওয়াতো, রাগ ইমন ।
মামারা খ্যাপাতো মিষ্টিমাসিকে । - কি রে, আর কত দিন চলবে তোদের সেই সব গুণী ? - তারপর অবশ্য আরো অনেক ধাপ, অনেক পথ চলেছিল মিষ্টিমাসি এই সঙ্গীত মার্গে । অনেক কিছু পাশও করেছিল, আমার সব মনে নেই । অল ইন্ডিয়া রেডিও দিল্লীতে কয়েকবার ছোটে খেয়াল গেয়েছিল । মনে আছে মা সেগুলো রেডিও থেকে টেপ করেছিলেন । একবার বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটির অনুষ্ঠানে ওর ঠুংরি শুনে বিজয়নগরমের মাহারাজা ও তার ছোট ভাই `ভিজি' যে ক্রিকেটের কমেন্টারি করত - একেবারে খুশিতে শিবনেত্র ।
-- জমিদার বাড়ি । ওদের এসব ভালো লাগে না । - মিষ্টিমাসি তানপুরার কানে মন:সংযোগে জিভ কামড়ে মোচড় দিচ্ছিল ।
-- আমি তো জানতাম জমিদার বাড়িতে গান বাজনার খুব কদর আছে । - আমার জমিদার সংক্রান্ত সিনেমার ছবিগুলো মনে আসতে লাগল । জলসাঘর, সাহেব বিবি গুলাম, ঘরে বাইরে, সন্ন্যাসী রাজা ।
-- সে সব গান বাজনা তো বাইজিদের করা । বাড়ির বৌ গান করবে- নৈব নৈব চ ।
আমি আস্তে হুঁ বলে চুপ করে ওর ব্লাউজগুলো ভাঁজ করে তাকে রাখতে লাগলাম । গান ছেড়ে দিতে হয়েছে বলেই কি শ্বশুরবাড়ির উপর অভিমান মাসির ?
-- জানিস তো, আমি আর শ্বশুরবাড়ি ফিরছি না । - মিষ্টিমাসি ওর পুরনো গানের খাতার পাতাগুলো ফড়ফড়িয়ে খুলে নজর বোলাচ্ছিল ।
-- নতুন মেশো এসে তোমায় ঠিক নিয়ে যাবে, দেখো । - অর্থাৎ পিছনের পুকুরের শিশির মাখা পদ্মফুলের মতো সুন্দর যে বৌ, তাকে ছেড়ে মেশো থাকবে কি করে ।
-- আমার কোনো মূল্যই নেই সে বাড়িতে । - মিষ্টিমাসি সব সেন্টের শিশিগুলো খুলে খুলে শুঁকে দেখছিল ।
-- কি যা তা বলছ । নতুন মেশো কে একটা ফোন করে দেখো না ।
আমার আঙুলে একটা সেফ্টিপিন আল্তো ভাবে ফুটে গেল । মিষ্টিমাসিটা যেন কি হয়ে গেছে । আগে কেমন ফিটফাট থাকতো, সব কিছুর যত্ন ছিল । এখন সেফ্টিপিন, আল্পিন, ব্রুচ পিন-সব লাগানো অবস্থাতে জামাগুলো কাচতে দেয় ।
-- মা'র কথায় যে ছেলে ওঠে বসে তা কে ফোন করে কি লাভ ?
-- তুমি সব কথায় এতো নেগেটিভ হলে কি করে চলবে । - আমি একটু বড়রা আমায় যা বলে জ্ঞান দেয়, সেই দিলাম ।
-- প্রথমে খোঁটা দিত বাবা গাড়ি দিতে পারেনি বলে । তারপর সব ব্যাপারে খুঁত ধরতো । কই তখন তো ছেলে কোনো প্রতিবাদ করেনি ।
-- বা রে, মাকে মুখের উপর প্রতিবাদ করা কি বুদ্ধিমানের কাজ নাকি !
-- ছেলেও খুঁত ধরতে কম নয় । এ বছরের ধুয়া আমার কেন দু বছর হওয়া সত্ত্বেও বাচ্চা হচ্ছে না । আমি নাকি বাঁজা । ছেলের আবার বিয়ে দিতে হবে । বংশের প্রদীপ চাই ।
-- সে কি, আজকালকার দিনে আবার দুটো বিয়ে হয় !
-- কেন হবে না । আমি ডিভোর্স দিলেই বিয়ে করতে পারবে ।
-- তুমি ডিভোর্স পেপারে না সাইন করলে ওরা কি করবে ?
-- চাপ দেবে, কোর্টকাছারি করবে ।
-- দু বছর বাচ্চা নাহলেই বুঝি বাঁজা হল । তোমরা ডাক্তার দেখিয়েছো ?
-- আমি দেখিয়েছি । সে দেখাবে না । তাদের মানে লাগে ।
-- ডাক্তার কি বললো ?
-- আমার সব কিছু ঠিক আছে ।
-- দাদু দিদাই কি গিয়ে তোমার শ্বশুরবাড়িতে কথা বললে লাভ হবে ?
-- ও রে বাবা, না না । ওদের তাতে আরো রাগ বাড়বে আর বাবা মা'কে অপমানিত হয়ে ফিরে আসতে হবে ।
-- বারে, এটা একটা কথা হল ! ডাক্তার দেখাবে না তাহলে এর সমাধান হবে কি করে । আর কিছু দিন দেখুক না ।
-- সে আর কে বোঝাবে তাদের । আমাকে তো বাতিল করে দিয়েছে ।
আমার আজীবনের সখি, সই, বন্ধু মিষ্টিমাসির ব্যথা আমার বুকে এক করাল আততায়ীর অয়োমুখী তীরের মতো বিঁধল । তবু মনে হল, এখনও আশা আছে । আমরাই মিষ্টিমাসির প্রেমে পড়ে আছি, ওর বর কি শরবিদ্ধ হয়নি ? আর কিছু দিন গেলেই মেশোর মন মাসির জন্য উতলা হবে । তারপর এসে নিয়ে যাবে । অত:পর ভাব, ভালোবাসা ও ভুরিভুরি ভজনা । এখনও তো ডিভোর্স হয়নি । যতক্ষন শ্বাস ততক্ষন আশ ।
সারাদিন শুকদেব বাবার বিশেষ সাড়া শব্দ শোনা যায় না । ওনার ও ওনাকে নিয়ে বাড়ির সকলের একটা বাঁধা রুটিন আছে । ভোরবেলা বড়মামি চা আর চারটে বিস্কুট দেবেন । তারপর ওনার স্নান, পূজা ও ধ্যানের পর মণিমামি সকাল দশটা নাগাদ আনবেন জলখাবার, কম চিনি দেওয়া সুজির হালুয়া বা দই চিড়ে বা আলুকপির সাদা তরকারির সাথে দুটো লুচি । দুপুরে রাঙামামি ওনার স্টিলের থালায় আনবে একটা হাতরুটি, শশার রায়তা ও আচার । বিকেলের চা-জলখাবারের ভার কুট্টিমামির । কুট্টিমামি আবার টুকটাক শৌখিন দেশি বিদেশি রান্না করতে ভালোবাসেন, তাই আমরা উদগ্রীব হয়ে থাকি । কখনও চীজ টোস্ট, কখনও শশা টমেটো দিয়ে স্যাণ্ডউইচ, কখনও ছোলে ভটুরে, দইবড়া, রাজমা । শুকদেব বাবার জন্য নিরামিষ হেঁশেল, দিদাই-ই বেশির ভাগ দৈনন্দিন রান্নাগুলো করেন ।
সন্ধে হলে শুকদেববাবা ঘর থেকে বেরিয়ে পুজোর ঘরে যান । আমরা কেউ ওনাকে পথ সংরক্ষণ করে নিয়ে যাই । একটা আলতো হাত রাখেন উনি পথ প্রদর্শকের হাতে আর যখন যান তখন মনে হয় না যে উনি অন্ধ । দীপা বা আমি শাঁখ বাজাই । একটা প্রদীপ উঠোনের তুলসীতলায় আর একটা পুজোর ঘরে লক্ষ্মীর পটের সামনে । ঠাকুর ঘরে উনি আরতি করেন । সকলে মিলে আমরা আরতির গান - জয় জগদীশ হরে - গাই ।
মিষ্টিমাসি শ্বশুরবাড়ি থেকে এসে পর্যন্ত একদিনও আরতির সময়ে যায়নি, এত সুন্দর গান করতে পারা সত্ত্বেও ।
কদিন আগে দুপুরে আমরা ছোটরা শুকদেব বাবার সাথে ধাঁধার খেলা খেলছিলাম রামায়ণ আর মহাভারতের চরিত্র নিয়ে । দুই টিমের প্রতিযোগিতা । এক দিকে অর্ক আর গৌরাঙ্গ, আর অন্য দিকে দীপা আর আমি । শুকদেব বাবা মডারেটর আর প্রশ্নকর্তা । বল তো রাবণের মা'র নাম কি ? বল তো সঞ্জয়ের কি বিশেষ গুণ ছিল ? বল তো যক্ষের যুধিষ্টিরকে করা প্রশ্নের উত্তর - পৃথিবী অপেক্ষা গুরুতর কে, তৃণ অপেক্ষা বহুতর কি, বেগ দ্বারা কে বৃদ্ধি পায় ?
দীপা ছোটো বলে কিছুই প্রায় পারছে না, তাই আমাদের টিম গো-হারান হারছে । মিষ্টিমাসিকে ডাকতে গেলাম খেলতে, তাহলে আমাদের দলের একটু জোর হবে, তাছাড়া ওর মনটাও ভালো লাগবে । কিন্তু তা কি হবার জো আছে ? মিষ্টিমাসি নিজের ঘরে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আপন মনে একটা কলমের পিছন দাঁতে কাটছিল । আমি জিজ্ঞেস করাতে বলল যে বাচ্চাদের খেলা খেলতে ওর এখন ভালো লাগছে না । বললাম, - মাত্র তো একুশ বছর বয়স তোমার, এই তো সেদিনও আমাদের সাথে খেলতে ।
ও উল্টিয়ে সোজা হয়ে শুয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, - জানিস তো, বিয়ে হলে জীবনটা খুব বদলে যায় । বাচ্চাদের খেলা আর খেলা চলে না ।
আমি খুব ক্ষুব্ধ হয়ে বললাম, - একটু শুকদেব বাবার কাছে গিয়ে ভালো ভালো কথা শুনলে তোমারি ভালো লাগবে ।
মিষ্টিমাসি আমার দিকে অপলক ভাবে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ । ওর চোখ যেন বলতে রইল আমাকে, - কেউ আর আমার ভালো করতে পারবে না ।
এমন কি দিদাইও মিষ্টিমাসিকে বলে পার পেলেন না । অনেকবার উনি মিষ্টিমাসিকে শুকদেব বাবার কাছে মন খুলে কথা বলতে সাধ্য সাধনা করলেন । মাসি এড়িয়ে গেল । কি আর বলব ওনাকে ।
ভাবলাম হয়ত লজ্জা পাচ্ছে নিজের নারীত্বের গোপন বেদনার কথা বলতে । শুকদেব বাবা সাধু হলে কি হয়, পুরুষ তো । অনেকে যেমন পুরুষ ডাক্তারের কাছে নিবিড় অন্ত:স্থলের কথা বলতে সংকোচ করে । পুরুষের বদলে দিদাই মাসিকে তুলসী মানস মন্দিরের এক সাধ্বীর সাথে দেখা করতে বললেন । কিন্তু তাতেও মিষ্টিমাসির আপত্তি । বলল যে তুলসী মন্দিরের দেওয়ালে আঁকা রাম সীতার কাহিনী দেখে ওর আরও মন খারাপ হবে ।
রাত্তির বেলা শোওয়ার আগে ওর চুলে বেড়া বিনুবি বাঁধার সময়ে আবার যেই তুলসী মন্দিরের কথা উথ্থাপন করেছি, মিষ্টিমাসি অনেকক্ষণ আয়নার দিকে তাকিয়ে বলল, জানিস তো, আমি হলাম সীতার মতো জনমদুখিনী । নিজের দু:খের অ্যালবাম কি কারো বারবার উলটে দেখতে ভালো লাগে ?
আর বিশেষ কিছু বলতে পারলাম না ।
মিষ্টিমাসি যেন দিন দিন একটা বিচ্ছিন্নতার পাঁতিকুয়োয় ডুবে যেতে লাগলো । আত্মলাঙ্ছনার শৈবাল তাকে চেপে ধরে আর ভাসতে দিচ্ছিল না । সব কিছুতেই যেন নিজের অবাঙ্ছনীয় অবস্থার উপমা বালতিবাহী ছেঁড়া দড়ির মতো ঝুলে থাকতো । আমি ওকে ভোলাবার চেষ্টা করেও পেরে উঠতাম না ।
মিষ্টিমাসির ঘরের বাইরে দোতলায় এক চিলতে ছাদ, নাম ছাগলের ছাদ । ছাদে লম্বা লম্বা ন্যাকড়ার ফালিতে আমসত্ত্ব রোদে দিয়ে ছিলেন দিদাই । বাতাসে খিদে-পাওয়ানো আমের গন্ধ ভেসে আসছিল । কাকের উত্পাতের থেকে বাঁচতে শৈল আর লালজি মিলে খবরের কাগজ, বাঁশ, ধামা ইত্যাদি দিয়ে এক বিকট কাকতাড়ুয়া বানিয়েছিল । সেটার দিকে তাকিয়ে মিষ্টিমাসি কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেল ।
- কি মিষ্টিমাসি, কি ভাবছ ?
- না, ভাবছি আমার ভাগ্যটা এই কাকগুলোর মতো ।
- যা: । কি যা তা বলছো ।
- দেখ্ না, কাকগুলো কেমন অভাগা । আমসত্ত্ব চোখের সামনে থাকলেও খেতে পারে না । বাধা পায় ।
আরেকদিন আমরা পুরনো স্মৃতির পুনরচর্চা করছি মিষ্টিমাসির মনে আরেক তুলনার দৃষ্টান্ত এল ।
এক সময়ে দুটো ছাগল পোষা হয়েছিল গান্ধীজির মতো কুট্টিমামার ছাগলের দুধ খাবার শখ হয়েছিল বলে । তারা ছাগলের ছাদে বাঁধা থাকত আর বড়মামি ওদের ঘন্টায় ঘন্টায় তরকারির খোসা, কপির ডাঁটা আর ঢ্যাঁড়শ খাইয়ে খোদার খাসির মতো মোটা করে তুলছিলেন । কিছুদিন বাদে বন্ধুদের সাথে রাজনৈতিক মতভেদ হওয়াতে কুট্টিমামার পানবিলাসিতা অন্য মোড় নিল । তাছাড়া ছাগলের দেহ নিষ্কাশিত মলপদার্থের সংস্কার করা এক বিরাট দায়িত্বে পরিণত হয়ে উঠেছিল ।
এক কোজাগরী পূর্ণিমার দিনে লক্ষ্মীপূজার জন্যে সম্পূর্ণ বাড়ি ধুয়ে মুছে সাফ করার কালে দিদাই সিদ্ধান্ত নিলেন যে পশুর চারণভূমির দরকার, তাদের ইঁট-সিমেন্ট-কংক্রিটের গণ্ডিতে রাখলে তাদের বড়ই নির্যাতন করা হয় । বাড়ির গোয়ালা রামবিলাসকে ডেকে মোহিনী আর রোহিণীকে দিয়ে দেওয়া হল । পরে কোলে বাচ্চা আসার পর বড়মামির শোকের উপশম হয়েছিল । তবে যত দিন না প্রাকৃতিক আবর্তনে তাদের ইহলীলা সাঙ্গ হয় ছাগলরা রামবিলাসের গ্রামের বাড়িতে মাঠে খেতখামারে সবুজ পরিবেষ্টিত হয়ে ভালোই ছিল শুনেছিলাম ।
মিষ্টিমাসি একটা গহন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, - আমার অবস্থা ঠিক মোহিনী রোহিণীর মতো । নিজের বাড়ি থেকে বিতাড়িত ।
প্রতিবাদ করে বলার চেষ্টা করলাম যে অজদ্বয়ের ভালোর জন্যই তাদের গ্রামবাসে পাঠানো হয়েছিল, বনান্তরে নির্বাসনের জন্য নয় । কিন্তু তা বলাতে মিষ্টিমাসি দারুণ বিরক্ত হয়ে বলল, - বলির পাঁঠার আবার স্থানগৌরব । শহরের আলিশান বা বনগাঁয়ের আল, কি যায় আসে ।
মিষ্টিমাসির জন্যে কষ্ট হল, রাগও হল । বাড়িতে এক জলজ্যান্ত জ্ঞানী সাধু থাকতে, কোথায় তার কাছে পরামর্শ নেবে তা না, দু:খবিলাসিতা করে বেড়াচ্ছে ।
প্রতি বৃহস্পতিবার সকালে শুকদেববাবা গঙ্গায় চান করতে যান । বাড়ির কাছেই কেদার ঘাট । লালজি শর্টকাটে ছোট ছোট গলি দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যায় ওনাকে । আর জোরে জোরে বলতে বলতে যায়, - সুরদাস যাওত হৈ, সুরদাস কো রাস্তা ছোড়তানি । - অর্থাৎ অন্ধজন যাচ্ছে । অন্ধকে রাস্তা ছেড়ে দাও । বিহার, উত্তরপ্রদেশে অন্ধ মানুষকে অন্ধ না বলে সম্ভ্রম জানিয়ে `সুরদাস' বলার চল আছে ।
এর মধ্যে সেদিন শুকদেববাবাকে ঘিরে আমার এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা হল । স্নান করে শুকদেববাবা লালজির হাত ধরে ফিরছেন । হাসতে হাসতে গল্প করতে করতে আসছেন । ঋজু লম্বা চেহারা, বয়সের তুলনায় অনেক স্বল্পবয়স্ক লাগছে । যেন কলেজের কোনো ছেলে । গৌরবর্ণ বুকে সাদা উপবীত ঝুলছে । এক কাঁধে তোয়ালে । একটা সাদা পাজামা পরে আছেন । ঘরে এসে স্নানের পরিধান ছেড়ে গেরুয়া ধারণ করবেন । কেশহীন মুখ, রোজ সকালে শৈল ওনার দাড়ি সযত্নে ক্ষুর দিয়ে কামিয়ে দেয় । মুণ্ডিত মস্তক, মঙ্গলঘটের উপর কচি ডাবের মতো মসৃণ । টপ্টপ্ করে দু একটা জলের ফোঁটা এখনও গায়ে ঝরছে - যেন শিবের মাথা থেকে গঙ্গার নিচে অবতীর্ণ হওয়ার সূচনা ।
হঠাৎ ওনাকে সেদিন ওই বেশে দেখে মনে হল যেন ওনাকে আগেও অন্য কোথায়, অন্য কোনোখানে, অন্য কোনো পরিস্থিতিতে দেখেছি । ওনাকে না ওনারই মতো অন্য কাউকে ? তাহলে কি ওনাকে পূর্বজন্মে, বা অন্য কোনো গ্রহে - না, না, কি সব ভাবছি ।
দেখতে দেখতে আমার মধ্যে এক অবর্ণনীয় অনুভূতির সঞ্চার হল । মনে হতে লাগল, এত অনিন্দ্যসুন্দর যে, এমন কন্দর্পনিন্দিতকান্তি, সে কেন কুড়ি বছর বয়সে সন্ন্যাস নিলেন ? চিরকৌমার্যের দু:সাধ্য ব্রত এক নবযুবক কেন স্বেচ্ছায় বেছে নেয় ? অর্ন্তজগতে সন্ন্যাসের আহ্বান কি সর্বদাই ঈশ্বরের ডাক না অন্য কারণেও হয় ? ব্যর্থ প্রেম সৃজিত কি এই সংসার ত্যাগ ? প্রেয়সীর বিশ্বাসঘাতকতা ? অন্য কোনো আঘাত ? নাকি অন্ধত্বের জন্যে ?
ভাবতে লাগলাম, তাহলে কি এই বুকে কেউ কোনো হাস্নুহানার উদ্বেল শেষ গোধূলিতে মাথা রেখেছিল ? এই বাহু কি কাউকে এক আম জাম জামরুলের ছায়াকীর্ণ দুপুরে কাছে টেনেছিল ? এই চোখ কি না দেখেও দেখেছিল কোনো এক কামরাঙা সূর্যোদয়ে কারো চোখে দুর্বার ভাষার সহজ পাঠ ? এই ওষ্ঠ কি পোখরাজ হলুদ রোদের সকালে - না:, আর ভাববো না ।
পিছনে ফিরে যেতে গিয়ে দেখলাম দোতলার জানলা দিয়ে কে যেন আমারই মতো ওনাকে এক দৃষ্টিতে দেখছে । দেখলাম মিষ্টিমাসি জানলায় । আমাকে দেখে চোখ নামিয়ে সরে গেল ।
পাঞ্জালড়াইয়ের খেলার মতো আমাদের মধ্যে একটা মানসিক ব্যাপার চলতে লাগলো । আমি যতই চেষ্টা করতে থাকলাম মিষ্টিমাসিকে খুশি রাখার বা এই বিপত্তিতে পথ বাতলাবার, ততই সে নিজের উদাসীন দু:খে থিতু হয়ে বসতে থাকল ।
বললাম, নতুন মেশোকে একটা চিঠি লেখো । সে কলমের নিব নখ দিয়ে খুঁটলো, কাগজে আঁকিবুকি কাটলো, সেই কাগজ দিয়েই আবার গাধার টুপি আর নৌকা বানালো । কিন্তু চিঠি তার হাত দিয়ে বেরলো না । অথচ পিওনের পথ দেখে বসে থাকাটাও চলছিল, সে স্বীকার না করলেও । ডাক আসার সময় হলেই দেখতাম জানলার কাছে পথহারা কানা ভোমরার মতো ঘুরপাক খাচ্ছে ।
একদিন অবশ্য চিঠি এল । তবে মেশোর কাছ থেকে নয়, তাঁর মার কাছ থেকে । দাদু দিদাই মিষ্টিমাসিকে আলাদা করে ওনাদের শোওয়ার ঘরে ডাকলেন । অনেকক্ষণ পরে যখন বেরিয়ে এল তখন ওর চোখমুখ লাল, মুখের ভাব থমথমে । বুঝলাম, অশনিসংকেত ।
সারা দিন কিচ্ছু খেলো না মিষ্টিমাসি । মামিরা কত নানারকম বানিয়ে এনে সাধলেন । দিদাইও দেখলাম সেদিন কিছু খেলেন না । রাত্রে ঘরে দরজা বন্ধ করে বড়দের এক বৈঠক বসল । আমরা অপ্রাপ্তবয়স্করা ইতিউতি উঁকি মারার ও কান পেতে শোনার চেষ্টা করলাম কিন্তু বিশেষ লাভ হল না । বুঝলাম মিষ্টিমাসির ব্যাপার আরো কিছু গুরুতর হয়েছে ।
রাত্রে আমি ঘুমিয়ে পড়ার অনেক পরে মিষ্টিমাসি শুতে এল । আমি এক কান খাড়া করেই ঘুমাই অবশ্য । মাসির যে স্লীপওয়াকিং বা নিশিচারণের রোগ আছে, সেটা যাতে এই মানসিক চাপে আবার চাগিয়ে না ওঠে, বাড়ির সবার চিন্তা । তবে গত পাঁচ ছয় বছরে সেই ঘুমের মধ্যে হাঁটাচলা করার ঘটনা আর হয়নি । দিদাই-এর ধারণা যে অনেক রোগের যেমন একটা বয়সের পরে আপনি নিরাময় হয়, এই ক্ষেত্রেও তাই হতে পারে । তবু আমার অবচেতন অর্দ্ধজাগ্রত প্রহরীর মতো মিষ্টিমাসিকে আল্তো ভাবে পাহারা দেয় ।
মিষ্টিমাসি ঘরে শুতে আসাতে আমি জেগে গেলাম । অন্ধকারে দুজনেই উশখুশ করছি ।
-- কি হল, মিষ্টিমাসি ?
-- ত্রিপুরা থেকে চিঠি এসেছে শাশুড়ির । তার সাথে ডিভোর্সের কাগজ ।
-- একেবারে ডিভোর্স !
-- ছেলের বিয়ে ঠিক করে ফেলেছেন । আমি বাড়ি ছেড়ে রাগ করে বেরিয়ে এসেছি বলে অ্যাবাণ্ডনমেন্টের অনুযোগ । ও কোর্টে বিবাহ বিচ্ছেদের ফয়সালা চেয়েছে ।
-- তুমি কি করবে ?
-- ডিভোর্স সাইন করে দেব ।
-- সে কি, এত সহজে !
-- যার এত সহজে দ্বিতীয় বিয়ে করার শখ তার সাথে আর নিজের জীবনটা জুড়ে রাখার কোনো মানে দেখছি না ।
কিছুক্ষণ চুপচাপের পরে মিষ্টিমাসি বলল, - জানিস তো, পারলে প্রমাণ করতে ইচ্ছে করে যে বাচ্চা না হওয়ার দোষটা আমার নয় ।
-- সে যদি ডাক্তারি পরীক্ষা করতে না রাজি হয়, তাহলে আর তুমি কি করবে ?
-- শুধু প্রমাণ নয়, মুখে ঘষে দিতে ইচ্ছে করে । - প্রায় স্বগতোক্তির মতো বলল মিষ্টিমাসি ।
আমি আর কি বলব কথা খুঁজে পেলাম না ।
ঘরের অন্ধকার আমাদের দুজনের মনেই ঘনীভূত হয়ে জমছিল । আমার উদ্বেগ আর মিষ্টিমাসির রাগাবৃত বেদনা পরস্পরকে আরো তিমিরাচ্ছন্ন করে রাখছিল । সে রাত্রির মতো সব কথা পাথরচাপা পড়ে গেল ।
এই চিঠির ঘটনার পরে মিষ্টিমাসির মধ্যে একটা সূক্ষ্ম পরিবর্তন দেখলাম । লক্ষ করলাম যে উদাস দু:খী ভাবটা শনিগ্রহের বলয়ের মতো ওকে ঘিরে ছিল সেটা যেন আঁটো বেড়ি থেকে আল্গা হয়ে একটা শিথিল লাগামে পরিণত হয়েছে ।
ঘরে খাটে সারাদিন শুয়ে থাকা, এক দৃষ্টিতে কড়িকাঠ নিরীক্ষণ করা, নিজে থেকে প্রসাধন না করা, খাওয়া দাওয়া শখ আহ্লাদের প্রতি নিবিড় অনীহা - এ সবের কিছুটা কম্তি দেখতে লাগলাম । একটু যেন হাল্কা বোধ করছে, মনে হল । সেদিন দিদাইয়ের বিয়ের সময়কার ঝুমকো কানের দুল পরে আয়নায় কিছুক্ষণ নিজেকে দেখলো । আরেক দিন বড়মামিকে বলল ওর চুলে আট গাছি ভাগ করে শীতলপাটি প্যাটার্নের বিনুনি করে দিতে । আমরা বেড়াতে গেলে যেতে চাইতো না এক সপ্তাহ আগের যে মিষ্টিমাসি, সে মণিমামির সাথে বিশ্বনাথ গলিতে গিয়ে এক হাত কাঁচের চুড়ি কিনে বাড়ি ফিরল । রাঙামামির বিদেশি পারফিউমগুলো এক এক বেলা এক একটা নিজের গলায়, কব্জিতে, হৃত্স্পন্দনের গুপ্তস্থানে ছেটালো । কুট্টিমামির হাইহিল পরে ঘটর ঘটর ঘরময় ঘুরে বেড়ালো । মামাদের সাথে খাওয়ার পরে বসে রেডিওতে `সপ্তপদী' নাটক শুনল । অর্ক আর গৌরের সাথে ক্যারাম প্রতিযোগিতায় জিতল । দীপার সাথে স্নেক ল্যাডার খেলল ।
মিষ্টিমাসি এসে পর্যন্ত ঠাকুরঘরে যায়নি । কিন্তু এখন সন্ধ্যায় দীপার আর আমার সাথে পালাপালি করে শাঁখ বাজাতে লাগল । লক্ষ্মীবারে দিদাইয়ের সাথে বসে নাড়ুর জন্যে কুড়নি বঁটি দিয়ে দুর্গাবাড়ি থেকে আনা ঝুনো নারকেল ডাঁই করে কুড়োল । এমনকি দিদাইয়ের বহু নির্দেশনা - যাও, উজ্জ্বলা কৌশিকি, স্বামীজির সাথে একটু মন খুলে কথা বল, -যাও উজ্জ্বলা কৌশিকি, একটু সত্সংগে বসে স্বামীজির গীতাপাঠ শুনে যাও, মন পথ খুঁজে পাবে, -- সত্ত্বেও যে একবারও কোনো উত্সাহ প্রদর্শন করেনি, সেই মিষ্টিমাসি মাঝে মধ্যে দুপুরে নিচের তলায় শুকদেব বাবার ঘরে গিয়ে বেশ কিছুটা সময় আলোচনা করে কাটাতে লাগলো ।
শুধু গান করাতে দেখলাম মানসিক বাধাটা রয়ে গেছে । মাঝে মাঝে তানপুরা আর পুরানো গানের খাতাগুলো ঝেড়ে রাখছে, গুণগুণও করছে - কিন্তু তার বেশি না ।
এর মধ্যে দাদু আর দিদাইয়ের মন কিন্তু সমানে খারাপ যাচ্ছিল । দিদাই মাঝে মাঝেই রাগত মুখে বামুনদির ঝাঁটা দিয়ে সপাসপ রান্নাঘরের মাছি মারছিলেন । যেন অন্য কাউকে মারছেন । দাদু নিজেদের রেকর্ডের দোকানে খুব অল্প সময় গিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসতেন আর ভ্রুঘোঁচ করে নীল ঘরের সোফায় বসে থাকতেন ঘন্টার পর ঘন্টা । যেন কোনো দুষ্কৃতিকারির কড়ানাড়ার অপেক্ষায় । তার গর্দান নেবেন ।
মামাদের বক্তব্য ছিল, জামাই একটা অমানুষ, পৌরুষহীন কাপুরুষ । আমাদের বোনের যোগ্য নয় । চলো কোই বাত নেহি, আমাদের সুন্দরী বোন - ডিভোর্স হয়ে যাক, আরেকটা বিয়ে দেব । মামিমারা সকলে তাঁদের সন্তানবৎ - প্রিয়, দেবকন্যা-প্রতিম ছোট ননদটির দু:খের সময় তার সর্ব আবদার আর্জি ঝোঁক পালন করার জন্যে তত্পর হয়ে থাকতেন ।
তাদের ছোট পিসির সেই আগের কিছুটা হাসিখুশি ভাবের প্রত্যাবর্তনে যেন বৃষ্টিপাতের পরে রামধনুর আবির্ভাবের নিশানা পেল অর্ক, গৌরাঙ্গ, দীপা ।
শুধু আমার মন নিশ্চিন্ত হতে পারছিল না । মনে হচ্ছিল মিষ্টিমাসির এটা সব ভান, ছলনা, অভিমানের লোকদেখানো অভিনয় । আশঙ্কা বুকের মধ্যে টাইমবোমার মতো টিক্টিক্ করছিল ।
একদিন দেখি মিষ্টিমাসি গানের খাতার পিছনে কি লিখছে ।
জিজ্ঞেস করলাম, - গান লিখছ নাকি, মিষ্টিমাসি ?
--- শুকদেব বাবা অনেকগুলো শ্লোক বললেন । ওনার মুখস্থ । অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ ।
একটু সন্দিহান হলাম । ভগবদগীতার বদলে কালিদাস ?
-- জানিস তো, শকুন্তলা সন্তানসম্ভবা হওয়া সত্ত্বেও রাজা দুষ্ম্যন্ত ওকে অস্বীকার করেছিলেন । আর আমি তো কোন ছার । সব রাজা-রাজরা জমিদাররাই এক ।
-- দুষ্ম্যন্তের তো দুর্বাসার শাপে মতিভ্রম হয়েছিল । তারপরে আঙটি দেখে মোহভঙ্গ হল । আমিও এ সব গল্প জানি, হুঁ হুঁ, বাবা ।
-য আমার তো সে গুড়ে বালি । আমি প্রেগন্যান্টও নই, আর আমার বেলা দুর্বাসার শাপ না হওয়া সত্ত্বেও দুষ্ম্যন্তের মতিভ্রম ।
-- তুমি এ সব পড়ে আরো মন খারাপ করছো কেন ? তোমার না ধর্মের কথা শুনে মন ভালো করার কথা ।
-- আরে দুর, মন খারাপের কি আছে ! শুকদেব বাবা যা দারুণ সংস্কৃত আবৃত্তি করলেন তাতেই আমার মন ভালো হয়ে গেল । ওনার ঘরে টেপগুলো দেখে আমিইতো জানতে চাইলাম । জানিস তো উনি টেপ শুনে শুনে সব মুখস্থ করেন ।
মিষ্টিমাসির কথাগুলো যে কি ভাবে নেব, চিন্তা করতে লাগলাম ।
-- দেখ আমি লিখে নিয়ে এসেছি । -মধুরগম্ ভীরাকৃতি: চতুরং প্রিয়ম্ আল্পন্ প্রভাববান ইব লক্ষ্যতে । - অর্থাৎ রাজা দুষ্ম্যন্তকে দেখে শকুন্তলার সখি প্রিয়ংবদা বলছে, কি মধুর ও সৌম্য মূর্তি । চতুর ও প্রিয় আলাপে এঁকে প্রভাবশালী কোন ব্যক্তি বলে মনে হচ্ছে ।
চিন্তিত হলাম । কোথায় মনের কথা স্বামীজিকে বলে মনের ভার লাঘব করবে আর পথ ভাবার চেষ্টা করবে, তা না করে মিষ্টিমাসি সংস্কৃত কাব্যচর্চা করছে । শুকদেববাবা ওকে চোখে দেখতে পাচ্ছেন না বলে হয়ত ওর মনের ভাবও স্পষ্ট বুঝতে পারছেন না । মিষ্টিমাসি মনের কথা খুলে তো বলছেই না, বরং একটা দুর্বোধ্য অভিমানের তাড়নায় সবার কাছে, বাড়ির লোকদের কাছে, শুকদেববাবার কাছে একটা ভণিতা করে যাচ্ছে । কিন্তু এই ভণিতার পেছনে কি উদ্দেশ্য ? নাকি উদ্দেশ্যবিহীন এক আত্মগ্লানি ? আর আত্মগ্লানির গভীরে ? আত্মহনন ?
আরো কিছুদিন পরে শনিবারে সত্সঙ্ঘ বসেছে নিচের বড়ঘরে ।
শুকদেব বাবা শ্রীমদ্ভাগবদগীতার ধ্যানযোগ থেকে পড়ছেন । - কৃষ্ণ বলছেন, অসংশয়ং মহাবাহো মনো দুর্নিগ্রহং চলম্ । অর্থাত্, হে মহাবাহো (অর্জুন) মন যে দুর্নিরোধ ও চঞ্চল তাহাতে সন্দেহ নাই ।
আমি পিছনে বসে দেখছি । সামনে পটে শুকদেববাবার গুরুর ছবি, চন্দনচর্চিত, পুষ্পমণ্ডিত । বাতের ব্যথায় বড় গদি ও তাকিয়া পরিবেষ্টিত দিদাই, লাল পাড় গরদ পরা মামিমারা, পাড়ার ধর্মানুসন্ধানী কিছু নারী পুরুষ বাঙালি অবাঙালি মেশানো, দীপা, লালজি, শৈলা ও থান পরিহিতা বামুনদি । দাদু ও মামারা দোকানে ব্যবসায়, অর্ক ও গৌরাঙ্গ হোমটাস্ক করতে তাদের ঘরে । যে অনুপস্থিতির কারণে বিশিষ্ট সে হল মিষ্টিমাসি ।
শুকদেব বাবা শ্লোকের পর শ্লোক কন্ঠস্থ আবৃত্তি ও ব্যাখ্যা করে যাচ্ছেন । ওনার কন্ঠস্বর বড়ঘরের চার দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে আরো ধ্বনিময় লাগছে । কিছুক্ষণ ওনার দিকে তাকাতে তাকাতে আবার আমার মধ্যে এক অস্বাভাবিক অনুভূতি হতে লাগল, যেমন ওনাকে গঙ্গাস্নানের পরে বারান্দায় দেখে মনে হয়েছিল ।
দেবদূতের সাথে রাজমানবের সাথে সাত্ত্বিক তপস্বীর সংমিলনে যা সৃষ্টি হয়, ইনি তাই । ওনার গৌর কপালের বিস্তারে এক লাল চন্দনের গোলাঙ্কন । দু একটি স্বেদবিন্দু তার নাকের উপরে তাঁর রক্ত মজ্জা অস্থি গ্রন্থিত মনুষ্য শরীরের পরিচয় । কোরকোদ্গম স্থলপদ্মের মতো দু চোখ সবার দিকে ন্যস্ত, আবার কারোর দিকেই নয় । সূর্যাস্তের মতো গেরুয়া রঙের চাদরের নিচে তাঁর শরীর যোগব্যায়ামে ঋজু, সুঠাম । আমি কল্পনা করলাম - না ; আর না ।
শুকদেব বাবা গান শুরু করলেন । রাগাশ্রয়ী ভজন । - আঁখিয়া লাগে রহত নিস্দিন । তবলা বাজাচ্ছেন পাশের বাড়ির বিশ্বাসবাবু ।
হঠাৎ ঝুপ করে আমার পাশে ঈষৎ আন্দোলন ও আওয়াজ অনুভব করলাম । ঘোর কেটে চমকে উঠলাম । মিষ্টিমাসি ।
আমাকে ফিসফিস করে বলল, - রাগ আশাবরী ।
গান শেষ হতে মিষ্টিমাসিকে দেখে দিদাই বললেন, - উজ্জ্বলা কৌশিকি, তুমি গান করবে ?
ভাবলাম মিষ্টিমাসি তার ইদানীংকার যথারীতি নেতিবাচক জানিয়ে কিছুতেই গান করবে না । কিন্তু আমায় অবাক করে দিয়ে মিষ্টিমাসি উঠে শুকদেব বাবার কাছে গিয়ে বসলো আর ওনার সাথে নিচু গলায় সম্ভবত গানের স্কেল সংক্রান্ত কিছু আলোচনা করে, হারমোনিয়ামটা টেনে নিল । তারপর সা পা সা টিপে শুরু করল - পগ্ ঘুঙরু বাঁধ মীরা নাচি রে । আগেও মিষ্টিমাসির গলায় শুনেছি, রাগ মালকৌষ । মধ্যরাত্রের তুরীয় অনুরণনের সুর ।
তারপর চলল পালা করে দুজনের মধ্যে গান । কখনও মিষ্টিমাসির আলাহিয়া বিলাওয়ল, ভীমপলশ্রী, কেদার । কখনও শুকদেববাবার ভৈঁরো, দেশ, দরবারি কানারা । মীরার গান, রাধার গান । নিষিদ্ধ প্রেম । কৃষ্ণপ্রেমের আগুনে নিকষিত হেম । যুগলবন্দীর মতো দুই সঙ্গীতপ্রেমীর ভজন বহুক্ষণ চলল । আমি চোখ বুজে শুনতে লাগলাম । এতদিন গান না করেও এত সুন্দর গলা মিষ্টিমাসির । যাক্ বিয়ে ভেঙে গেলেও বড় রেডিও আর্টিস্ট হয়ে মাসি জীবনে এক সার্থকতা পেতে পারবে । এত রূপ আর এত গুণ যার, তার ভাগ্যে--
চোখ খুলে দেখি দিদাই মিষ্টিমাসির দিকে পলকহীন তাকিয়ে আছেন । গোল কাঁচের সোনালি ফ্রেম চশমার পিছনে চোখের জল অতলান্ত সমুদ্রে জ্যোত্স্নার মতো চিক্চিক্ করছে ।
অনেকগুলো গান হতে থাকল । হঠাৎ লোডশেডিং-এর দরুন লাইট চলে গিয়ে ছোটখাটো উত্তেজনার সৃষ্টি হল । লালজি ও শৈলা দৌড়াদৌড়ি করে হারিকেন ও পেট্রোম্যাক্স আনতে গেল । হারিকেনের আলোয় আলো আঁধারির খেলায় হঠাৎ চোখ রগড়ে চমকে বসলাম । মিষ্টিমাসি ও শুকদেব বাবা পাশাপাশি বসে । আধ অন্ধকারে শুকদেব বাবার ফর্সা রং, মুখের কমনীয় ভাব আর চোখের দৃষ্টির বিশেষত্ব বোঝা যাচ্ছে না । বড়বড় চোখ, উন্নত নাসা, লম্বা সোজা বসার ভঙ্গি শুধু পরিলক্ষিত হচ্ছে । কি রকম অন্যরকম লাগছে । অন্য কার মতো ? কার ?
মনে পড়ল, বিয়ের সময়ে দেখা, পরে ওদের বাড়িতে দেখা, আরো পরে মিষ্টিমাসির অ্যালবামে দেখা - নতুন মেশোর মতো । দুজনের চেহারার মধ্যে অদ্ভুত সাযুজ্য, বিশেষ করে আধা অন্ধকারে সিলুয়েটে গায়ে কাঁটা-দেওয়া মিল ।
মিষ্টিমাসি কি এই মিল লক্ষ করেছে ?
সেদিন রাত্রে মিষ্টিমাসিকে এই মিলের কথা বলতে গিয়ে পারলাম না । ভাবলাম ওকে আর কষ্ট দিয়ে কি হবে এ ব্যাপারে আলোচনা করে । আকাশপাতাল ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি । মাঝরাতে জেগে দেখি পাশে কেউ নেই । মিষ্টিমাসি কোথায় গেল ? ওর সম্বন্ধে আমার অবচেতনায় দুশ্চিন্তা থাকেই । ওর উপর এত মানসিক চাপ যাচ্ছে শেষে আবার ছাদ থেকে ঝাঁপ টাপ না দেয় । তখনও লোডশেডিং । লাইট জ্বালবার উপায় নেই । টর্চ হাতে ছাদের দরজার কাছে গিয়ে দেখি, না হুড়কো আঁটা, কেউ খোলেনি ।
তাহলে কি সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল ?
নিচের তলার সিঁড়ি দিয়ে নেমে বারান্দায় যেই ঘুরেছি এমন সময় দেখি দরজার আড়ালে সাদা কাপড় পরা কে । ভয়ে চেঁচিয়ে উঠবো, এমন সময় দেখি সে দিদাই । মুখে আঙুল দিয়ে ইঙ্গিত করলেন আওয়াজ না করতে । আমি টর্চটা নিবিয়ে দিদাই-এর পাশে দরজার আড়ালে গুটিশুটি দাঁড়ালাম । কি দেখছেন দিদাই ?
দেখলাম একটি মূর্তি অন্ধকার বারান্দায় ও দিক থেকে ধীরে হেঁটে আসছে । অস্পষ্ট জ্যোত্স্নায় দেখি - মিষ্টিমাসি । আমি কিছু বলতে যাব, কিন্তু আবার দিদাই আমাকে হাত চেপে বারণ করলেন । মিষ্টিমাসি ধীরে যন্ত্রচালিতের মতো চলছে । চোখ খোলা, মুখে একটা অস্বাভাবিক হাসি । পুতুল পুতুল ভাব । ঘুমের মধ্যে হাঁটছে মিষ্টিমাসি । নিশির ডাক ।
কোথায় যাচ্ছে ? ও কি, ওই কোনার ঘরে ? ওটাতো - ওটাতো শুকদেব বাবার ঘর ।
আমি আবার এগিয়ে ওকে ধরতে যাব । কিন্তু একি, দিদাই আমার হাত চেপে রয়েছেন । দিদাই আমার মুখেও একটা হাত দিয়ে রয়েছেন আল্গা ভাবে । টপ করে এক ফোঁটা জল পড়ল আমার কানের পাশ ঘেঁষে । দিদাই কাঁদছেন ।
উঠোনের কলাগাছটা রাতের হাওয়ায় পাতা ঝাপটালো । একটা রাত জাগা পাখি চমকিয়ে ডাক ছাড়ল । আমি আর দিদাই পরস্পরকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম । মনে হল হয়ত কয়েক মুহূর্ত কাটলো, কিংবা অযুত যুগ । মনে হল কোনো কিছুরই মানে নেই, কিংবা সব কিছুরই বহু পূর্বনির্ধারিত মানে বিদ্যমান ।
(পরবাস-৪০, ফেব্রুয়ারি, ২০০৮)