`ভাল ! খুব ভাল !' রিংকু বেশ মজা করে বলল । `অন্তত: তোর আরও ক'দিন থাকা হচ্ছে ।' আমি নিশ্চিত করলাম `অবশ্যই' । কোলকাতায় বসেই যদি এই ছবিগুলো দেখা যায় তাহলে একটা নড়বড়ে সিডি-রম আর গোললেলে সিডি দিয়ে দেখার কী মানে ? এবং অবশ্যই কয়েক মাস পর ঢাকায় ওগুলো পৌঁছানোর পর । রিংকুকে আমি জিজ্ঞেস করলাম - `তুই জানিস এবছরের আগে পর্যন্ত পদ্মা নদীর মাঝি -ই ছিল ঢাকাই শিক্ষিত শ্রেণীর শেষ আপন ছবি ?' `তোর ভাল্লেগেছে ?' ও জানতে চাইল । `আরে সেটা তো একদম ভিন্ন প্রশ্ন ।' `হ্যাঁ কিন্তু আমি জানতে চাচ্ছি ।' ও ছাড়বে না । `আচ্ছা, না আমার ভাল্লাগেনি ... হ্যাঁ আমি বলছি । অন্তত: এ কারণেও যে ছবিটা কুবের এবং কপিলার সম্পর্ক ধরতেই পারেনি ।' রিংকু মাথা নাড়ল ।
পরের দু'দিনে আমি ছবিটার প্রেক্ষাপট নিয়ে খানিক জানতে পারলাম । জানলাম যে ছবির প্লটটা সত্যজিৎ রায়ের অরণ্যের দিনরাত্রি -র একটা পরিবর্ধন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একই নামের উপন্যাস নিয়ে যেটা তিনি বানিয়েছিলেন । কাহিনী নিয়েও কিছু জানা হলো তা আমি জানতে আদৌ উত্সাহী থাকি বা না থাকি । আর্থিক ক্ষতিটাও কম গুরুত্ব দিয়ে ভাবার কিছু নেই । একই পয়সা দিয়ে টিকেট কেটে আনকোরা গল্প উপভোগ করার সুযোগ আপনার থাকছে না ! কিন্তু কাকে বলবেন এসব কথা ! ছবিটার অতি অল্প দর্শকদের মধ্যেই আমার দু'জনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল । এবং আমাকে খানিকটা প্রস্তুত করে দেবার ব্যাপারে তাঁদের ষোল আনা আগ্রহ । সঙ্গত কারণেই মন খারাপ করে রিঙ্কু আর ওর বাচ্চা ইরাবতী সমেত মেট্রো সিনেমা হলের সামনে তাপসের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম, অফিস থেকে ও আসবে বলে । অচিরেই আমার দুশ্চিন্তা অসার প্রমাণিত হলো । দয়ালু দর্শকেরা বড়জোর কাহিনীটার খুব মোটাদাগে একটা কিছু বলেছিলেন । ছবিটা আসলে এক এলাহী কারবার, এতটাই বিরাট যা এটার পোস্টারের মাপের সঙ্গে বেশ মানানসই । `শালিমার নারকেল তেল নিবেদন করছে...।' এভাবেই পোস্টারটা শুরু হয় । তারপর আপনি দেখবেন গৌতম ঘোষের নাম এর কাহিনীকার, সিনেমাটোগ্রাফার, সঙ্গীত পরিচালক এবং অবশ্যই পরিচালক হিসেবে । তবে পর্দায় অবশ্য বেশ বিচক্ষণ এবং নারকেল তেল কোম্পানি কয়েক সেকেণ্ডের বেশি আপনার চোখের সামনে থাকবে না । এদিক থেকে ভাবলে সচল ছবি সবসময়েই দেয়ালে সাঁটা কোনো পোস্টারের থেকে ভাল ।
শিগগিরই আমি প্রেক্ষাগৃহ এবং ছবির জমজমাট উপস্থাপনের মধ্যে ডুবে গেলাম । আমি গত রাতে দেখা পরস্পর ছবিটার কথা ভাবতে বসলাম । পুরোটাই কি পরিচালকীয় দক্ষতার ব্যাপার ? অধিকাংশ দর্শকই সেভাবে ভাবতে চাইবেন আমি জানি । আর পরস্পর দেখবার জন্য সাকুল্যে আমরা জনা বিশেক ছিলাম পুরো ছবিঘরে । ঢাকার সিনেমা হলের সঙ্গে এতগুলো বছরের যোগাযোগহীনতায় আমি টিকেটের ভেদবিচার ভুলতেই বসেছিলাম, কেবল `রিয়ার স্টল' ছাড়া, সন্দেহ নেই যে সবচেয়ে নিচের তলার টিকেট এটা । এর তার মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে থাকলাম আমরা । তারপর মোটামুটি খানিক দামী টিকেট কেটে দোতলায় কেবল আমরাই দর্শক হলাম । হলের গাইড বেশ কর্কশ, কিছুতেই ইরাবতীকে একটা আলাদা চেয়ারে বসতে দেবে না যদিও পুরা দোতলাই খালি । ইরাবতীর টিকেট ছিল না এবং ও ওর মা আর আমার কোলে বসে আরামেই আছে । হর্ষ দত্তের খুবই একটা ভাল গল্প নিয়ে পরস্পর ছবি । একজন সাবেক আর্টকলেজ মডেল, অমলিনা, এখন ষাটের কাছে বয়স, তাঁর ছেলে, ছেলে-বৌ এবং ষোল বছরের নাতনির সঙ্গে থাকেন । কিন্তু তাঁর ছেলে তাঁকে মা বলে ডাকে না যেহেতু ছেলে নিশ্চিত মনে করে যে একজন নারী হিসেবে এবং বিধবা হিসেবে অমলিনা সঙ্গত আচার আচরণ করেননি । সে দেখে এসেছে মা'র একজন পুরুষ আঁকিয়ে বন্ধু নিয়মিত আসছে এবং ধীরে ধীরে সে মায়ের পেশা সম্বন্ধে জেনেছে । সেই বাচ্চা বয়স থেকেই মা'কে সে ঘৃণা করে আসছে । কিন্তু এখন লম্বা সময় ধরে ধর্মঘট চলছে তার কারখানায় এবং সে বেতন পাচ্ছে না । তার স্ত্রী সংসার চালানোর নিদারুণ চেষ্টা করে যাচ্ছে; ফলত: একজন গৃহশ্রমিক হয়ে পড়ল । অমলিনাকেও রাস্তায় লজেন্স বিক্রি করতে দেখা গেল । পরিস্থিতির চাপে একসময়ে অমলিনা আর্ট কলেজে তাঁর পুরনো যোগাযোগ নতুন করে দাঁড় করালেন এবং নাতনিকে একই পেশায় লাগিয়ে দিলেন । তাঁর একটা সময়ে কাজটা ছাড়তে হয়েছিল যেহেতু তাঁর বয়স শিল্পীদের কাছে আর বিশেষ নান্দনিক লাগেনি । অমলিনার ছেলে গোড়া থেকেই পুরুষালি অহংকারে ভুগছে - বিশেষত: মাকে এত উদ্যমী আর পরিশ্রমী দেখে, এমনকি বউয়েরও একই অবয়ব । সবসময়েই সে নানান বাহানায় মেজাজ দেখাচ্ছে । একদিন তার স্ত্রীর গৃহকর্তা তাকে ধর্ষণ করল । প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠে সে মনোযোগ দেবার চেষ্টা করল যে-টাকাটা পাওয়া গেছে সেটার দিকে, ২০০ টাকা । সেই একই সন্ধ্যায় আর্ট কলেজ কর্তৃপক্ষকে অমলিনা রাজি করিয়ে ফিরেছেন, এবং তিন প্রজন্মের তিন নারী বাসায় বসে প্রাণবন্ত এক আড্ডা দিচ্ছেন, যাই হোক না কেন । অমলিনার পুত্র এতে একদম ক্ষিপ্ত কিন্তু সবকিছু থেকে ছাড়া ছাড়া লাগতে থাকলে তার, এবং পরিশেষে একেবারে বিযুক্ত । এই ছিল পরস্পর -এর কাহিনী । প্রথম কিছু মিনিট ধরে পর্দায় প্রজেক্ট করেন যিনি আপ্রাণ চেষ্টা করলেন যে ছবিটাকে আয়তাকার বানানো যায়, পরে হাল ছেড়ে দেন তিনি । পর্দারূপ একেবারে ভোঁতা এবং অনাকর্ষণীয় । বেশিরভাগ সময়ে এমনকি আমরা কথাবার্তাও বুঝতে পারছিলাম না । ফলে ছবিটাতে মনোযোগ দেয়া আসলে সোজা কাজ ছিল না । তারপরও মাত্র জনা ২০ দর্শক দেখে আমার হতাশ লেগেছে । ইরাবতী থেকে থেকে মনে করিয়ে দিচ্ছে এই ছবি না-দেখে অন্য কী কী করা যেতে পারত । অভিনয়কারেরা সবাই ভাল করেছেন, বেশিরভাগই থিয়েটার থেকে আসা, দু'একজন টেলিভিশনেও কাজ করেন । চিত্রনাট্যটাও ভাল । তারপরও আমি নিশ্চিত ছিলাম কিছু একটা নাই ছবিটাতে । হতে পারে সমস্যাটা গতিতে, কখনো কখনো রূপসজ্জাও প্রকট । তবে আমাকে বিস্মিত করেছে প্রমোটারদের উস্কানিমূলক বিজ্ঞাপন । ছবিটা কষ্টকর জীবনযাপন প্রসঙ্গে, নারীসংহতি প্রসঙ্গে, পৌরুষ প্রসঙ্গেও একভাবে বলা যায় এবং পরিশেষে একটা ভারী সিদ্ধান্ত নিতে পারার বিষয়ে । কিন্তু নির্মাতারা দর্শকদেরকে ভাবানোর চেষ্টা করেছেন নগ্নতা বিষয়ে এবং যৌনতার সঙ্গে এর সম্পর্ক বিষয়ে । এই কাজটা তাঁদের তরফে একেবারেই অপ্রয়োজনীয় । একটা দৃশ্য অবশ্য ছিল, প্রায় শেষদৃশ্যই বলা যায়, যেটাকে ক্যাটেগরিক্যালি নগ্নতা বলা যায় বোধ হয় । সবকিছুর পরও আমি আসলে ছবিটার আর একটু গ্রহণযোগ্যতা আশা করছিলাম । পরে শুনলাম এই ছবির পরিচালক প্রণব কুমার দাস, এবং তাঁর স্ত্রী শুভ্রা বসু, যিনি আর্ট কলেজে নবাগতা মডেল নাতনি হিসেবে অভিনয়ও করেছেন, তাঁদের সহায়সম্পদের সবটাই এই ছবির পিছনে ঢেলেছেন । আমি অবাক হব না, অবশ্যই বেদনার্ত হব, যদি পরের ছবি বানানোর জন্য কোনো কিছু অবশিষ্ট না থাকে তাঁদের ।
এসব কারণেও পরের সন্ধ্যায় গৌতম ঘোষের ছবিটা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে ছিলাম । এতটাই উতলা ছিলাম যে হিসিখানায় যাবার জরুরি দরকার থাকা সত্ত্বেও ঢুকলাম না । আমি আসলে পর্দায় ছবির নামটাও মিস করতে চাইছিলাম না । এবং প্রেক্ষাগৃহে ঢুকে আমি আসলেও হারিয়ে গেলাম । পেল্লায় বড় একটা পর্দা, স্পষ্ট জোরালো স্পীকার, সর্বোপরি একটা পরিপাটি-বানানো ছবি । তারপরও অনেক দর্শক আসলে ছিল না, সাকুল্যে ২০০ হবে হয়তো । রিয়ার স্টল প্রায় খালি । কিন্তু স্বচ্ছল দর্শকেরা ছিলেন, যেহেতু সিনেমা হলে গৌতম ঘোষের ছবি মধ্যবিত্তের জন্য বরাবরই বড় একটা উপলক্ষ্য, অন্তত: সত্যজিৎ রায় গত হবার পর থেকে । পয়লাতেই কলাকুশলীর দলটাকে লক্ষ করুন । তালিকাটায় আছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শর্মিলা ঠাকুর, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, শমিত ভঞ্জ, রূপা গাঙ্গুলি, বাংলাদেশ থেকে গুলশান আরা চম্পা এবং মুম্বাই থেকে টাব্বু । গৌতমের কান পাশ্চাত্যের এবং হালের গানে তামিলপ্রাপ্ত । প্রথম কয়েক সেকেণ্ড থেকেই কারো সেটা মন কাড়বে । দোকান থেকে যে স্ন্যাকস কিনে এনেছিলাম কিছুক্ষণের জন্য খোলা অবস্থাতেই কোলের উপর থেকে গেল । আমরা পর্দার দিকে ঝুঁকে থাকলাম । কাহিনী পটভূমি শুরু হয়েছে আম্মুন (টাব্বু, অন্য চরিত্রগুলোর নাম মনে পড়ছে না, ফলে অভিনয়কারদের নামেই চালাতে হবে), ভারাক্রান্ত ও বিষন্ন, এবং ওর মাকে (শর্মিলা) নিয়ে । ওর মা ওকে নিয়ে উদ্বিগ্ন । আম্মুনের বাবা-মা দু'জনেই সত্যজিৎ রায়ের সাবেক ছবি অরণ্যের দিনরাত্রি থেকে এসেছেন । ওঁরা ছাড়াও সৌমিত্রের দুই বন্ধু (শমিত ও শুভেন্দু) একই উত্স থেকে আসা, যেহেতু এই ছবিটা রায়ের পটভূমির একটা পরিবর্ধন যেটা সেই ১৯৬৯ সালে বানানো হয়েছিল । মানে হলো নির্মাতা পটভূমিটায় ৩০ বছর যোগ করতে এবং অবশ্যই চরিত্রগুলোতে `পারিবারিক জীবন' যোগ করতে চেয়েছেন । গৌতম ঘোষ যাপিত ও চলচ্চিত্রীয় বাস্তবতার সীমানাকে পরখ করে কাজ করেছেন - যেমন সত্যজিতের ছবিতে বন্ধুবর্গের একজন রবি ঘোষ মারা গেছিলেন ইতোমধ্যেই; এবং শমিত ভঞ্জ দীর্ঘদিন ধরে ক্যান্সারে ভুগছিলেন (ছবি মুক্তির কিছুদিন পর ভঞ্জ মারা গেছেন) । এসব কিছু গৌতম এবারে কাহিনীপটে রেখে দিয়েছেন ।
আম্মুনের জন্য ৯/১১র সেই মর্মন্তুদ দিনে নিউ ইয়র্কে থাকা অতিশয় চাপের ছিল । এমন একটা ইঙ্গিতও আছে যে ওর খুব নিকটজন কেউ দুর্ঘটনার শিকার, যে কিনা আক্রমণের সময়ে টুইন টাওয়ারে কাজ করছিল । ওর ভোগান্তি প্রকাশিত হতেও দেখা গেল । টেলিভিশনে মানুষের দুর্গতি বিষয়ক কোনো একটা তথ্যচিত্র দেখতে দেখতে সে তার হাতের চায়ের-কাপটা ছুঁড়ে মারল টেলিভিশনের দিকে, কাপটা চূর্ণ হয়ে গেল, এবং শেষে সে ডুকরে কেঁদে উঠল `মানুষ এত নিষ্ঠুর কেন' বা এই জাতীয় কিছু একটা বলে । খানিকটা ওর চিত্তপ্রশান্তির জন্যও, ওর বাবা ভাবছিল সবাই মিলে `আবার' জঙ্গলে গেলে কেমন হয় বন্ধুদের সাথে (সত্যজিতের ছবির কাহিনীপটে যে বন্ধুরা ছিল) । এভাবেই তারা আবার অভিযাত্রায় বেরোয় । আগের বারের তুলনায় মোটামুটি জনা সাতেক নতুন চরিত্র যুক্ত হয় : রূপা আর চম্পা, দুই বন্ধুর দুই পত্নী, চম্পা-শুভেন্দুর পুত্র ও পুত্রবধূ, চম্পা-শুভেন্দু পুত্রের বন্ধু যীশু (যীশু দাশগুপ্ত), চা বাগানের ম্যানেজার রজত (রজতাভ রায়) এবং তার স্ত্রী (চৈতী ঘোষাল) এবং একটা বাচ্চা ।
সিনেমাটোগ্রাফিতে গৌতম ঘোষের মুন্সিয়ানা এখন বিদিত এবং ছবির বেশিরভাগই আউটডোর । ফলে দর্শকেরা মেলাকিছু পেয়েছেন । দারুণ সব ফ্রেম, তীক্ষণ আলো, এবং চমত্কার সব লোকেশান । এর সঙ্গে আছে অধিকাংশেরই দুর্দান্ত অভিনয়, বিশেষত: শর্মিলা, সৌমিত্র এবং রজতাভ । এবং অবশ্যই পরিচালকের নিজেরই দেয়া ঝকঝকে মিউজিক । কিন্তু তবুও পুরো সময়টাই আমার অশান্তিতে কাটল । কীভাবে এঁরা, গৌতম ঘোষ ও সত্যজিৎ রায়, `জঙ্গল' নিয়ে এমন আকাট আর বেরাজনীতিক থাকতে পারেন, এবং তাও এতগুলা বছর ধরে ? জঙ্গল-যাত্রাকে ঘোষ যেভাবে সাফাই গেয়েছেন তা ছিল `সভ্যতা থেকে দূরে' । জঙ্গল নিয়ে তাঁর উচ্চতা রায় দেখিয়েছিলেন ১৯৬৯ সালে । পরে আগন্তুক ছবির মাধ্যমে তাঁর মিশন তিনি আবার সম্মুখে এনেছেন । গৌতম তাঁর কাজ করেছেন ২০০৩ সালে । আমার সামান্যই সন্দেহ আছে যে মওকা পেলে তিনি আবারও এরকম কিছু করবেন । এবং এই সাড়ে তিন দশক পরেও জঙ্গল সেই একই রাজ্য রয়ে গেছে - সিভিল-আত্মার পরিত্রাণস্থল । এঁরা কি কখনো মনোযোগ দিয়ে জঙ্গল ও জঙ্গলবাসীদের নিয়ে ভারত সরকারের ব্যবস্থাপনা কলাকৌশলটাও পড়েননি ? আশ্চর্য ! এমনকি সেই ১৯৮৩ সালে, গোবিন্দ নিহালিনীর ছবি আক্রোশ রাষ্ট্রীয় প্রহরীগিরি, নিয়মানুগ হত্যা এবং ধর্ষণের মতো বিষয় নিয়ে কাজ করেছে । বিপরীতে আমরা পাই আম্মুনকে যে `গারো' ও ওঁরাও জনগোষ্ঠীর `সত্যিকার উন্নয়ন' ঘটানোর বিষয়ে দরদী । একজন মুক্তিদাতাও আছেন, অবশ্যই একজন বাংলাভাষী, যিনি আদিবাসী বাচ্চাদেরকে `নিজস্ব' ধর্মীয় শিক্ষাসূচীর পাশাপাশি সৌরজগত বিষয়েও লেখাপড়া করাচ্ছেন । তাঁর ভাষ্যমতে তাদেরকে `রক্ষণশীল চিন্তাভাবনা থেকে মুক্ত' করবার জন্য এটা জরুরি । `এক্সেলেন্ট !' আম্মুন কহেন । `দারুণ ছবি না' হিসিখানায় আমার পাশের লোক উদ্বেলিত বলে ফেললেন । আমি তখন রাগে রাগে ভেবে চলেছি ছবিনির্মাতাদের এই অরণ্য-দৃষ্টিকোণের আশু পরিসমাপ্তি দরকার । একজন অচেনা লোকের এরকম উত্সাহী নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করা আমার জন্য সহজ ছিল না । ফলে আমি উত্তর করলাম `হুঁম...? হুহুঁম ।'
শিক্ষায়ন এবং সভ্যায়ন খুবই মহৎ কাজ ! বিশেষত: উপনিবেশোত্তর কালে সেটা চালিয়ে যাওয়া, এবং তাও যদি আবার বাঙালি মানুষ নিজেরাই হন সেটা । কেই বা এই কাজের অতিঅবশ্য উস্কানিটাকে পাশা কাটাতে পারবেন ! ফলত: আম্মুন এরকম বৃদ্ধ মুক্তিদায়ী মাস্টারমশাই পেয়ে শেষে দিলখুশ হতে, এবং এই কল্যাণকর উন্নয়ন প্রকল্পে শামিল হতে মনস্থির করতে পেরেছে । কাহিনীটা মোটামুটি এরকম : এক চাঁদনী রাতে, সকল ধরনের আনন্দ এবং উত্সবমুখরতা সমেত গান ও নাচ সহযোগে, এবং একটি বারের জন্য বিলাতি মদের বদলে স্থানীয় মহুয়া-মদিরাতে ডুবে ইত্যাদি, রূপা পড়ে গিয়ে ব্যথা পান । যীশু তখন আম্মুনের সঙ্গে, এ দুয়ে মিলে তখন বিলাতি কিসিমের একটা নাচও নেচে ফেলেছে । যেই না যীশু রূপা পানে দৌড়ে গেছে, অমনি নেশামত্ত আম্মুন গেল হারিয়ে । ছবির সবচেয়ে শিহরণ জাগানিয়া ঘটনা, খেয়াল করবেন কিন্তু ! পরের ২৪ ঘন্টা তুমুল উত্তেজনা, পুলিশে আম্মুনের তালাশ করছে যে কিনা একজন শিল্পপতির মেয়ে, রূপা ব্যথা পেয়েছেন, শমিতের ক্যান্সারের ব্যথা তুমুল হয়েছে, সর্বোপরি আম্মুনের খোঁজ মিলছে না । পরের সন্ধ্যায় তাঁরা আম্মুনের কাছ থেকে একটা চিরকূট পেলেন, একজন ওঁরাও যুবক সেই চিরকূটটি বয়ে এনেছেন যে এর আগে মহুয়া-রস সরবরাহ করেছিলেন এই নগরাত্মাকূলে । আম্মুন লিখেছে যে সে অপহৃত হয়নি, বরং নদীগর্ভ থেকে মাস্টারমশাই দ্বারা উদ্ধার পেয়েছে, এবং তাঁদের `যথার্থ উন্নয়ন' প্রকল্পে ৩ লক্ষ টাকা প্রয়োজন । সে আরও যোগ করেছে এটা মোটেই মুক্তিপণ নয় যেহেতু সে বন্দি নয় এবং ওর মা-বাবার কিছুতেই পুলিশকে জানানো ঠিক নয়, এবং সে ওইসব হতভাগ্য মানুষের জন্য কাজ করবে । কিন্তু আম্মুনের বাবা এবং তাঁর পুরুষ বন্ধুরা ঠিক ওই কাজটাই করল । ফলে টাকা দেবার জায়গাটাতে পুলিশ এল এবং মাস্টারমশাইকে গ্রেপ্তার করল, ওঁরাও যুবকটি পালাতে পেরেছিল । শর্মিলা পুলিশের ব্যাপারটা জানতেন না, ফলে সৌমিত্রকে অভিযোগ করলেন । সৌমিত্র একটু আমতা আমতা করতেই শর্মিলা উচ্চারণ করলেন `হিপোক্রেইট' । এদিকে উন্নয়নবাদী দর্শন-টর্শন ফেলে মাস্টারমশাই, পুলিশ হিফাজতে যাবার পথে, খুবই ভিন্ন বিষয়ে বক্তৃতা দিলেন; এদফা ঢের ঢের র্যাডিক্যাল এবং মানুষের মুক্তি বিষয়ে । এত বছরের `এযাক্টিভিজমের' পর তিনি এরকম অরক্ষিত কোনো একটা জায়গায় যাবার মতো কাঁচা একটা কাজ কীভাবে করতে পারেন সেই প্রশ্নটা যে কাউকেই বিচলিত করবে । তাঁর সকল আস্থা বড়জোর আম্মুনের ভোলাভালা ব্যক্তিত্বের উপর দাঁড়ানো । হাস্যকর ! এরপর মাইক্রোবাস আবার শুরু করল চলতে । এরপর চোখজুড়ানো লং শট দেখতে দেখতে আমরা বুঝতে থাকলাম যে শেষ হচ্ছে ।
এরই মধ্যে আম্মুন আরেক দফা ছিঁচকাঁদুনির প্রস্তুতি নিতে নিতে - এই কাজটা মোটামুটি নির্দিষ্ট বিরতিতে সারাটা ছবিতেই সে করেছে - মাকে জানাল যে একটা ষড়যন্ত্রের মধ্যে নিজেকে সেখতে সে প্রস্তুত ছিল না । কাহিনীর একদম কেন্দ্রীয় চরিত্রটা সারাক্ষণই ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কেঁদে গেছে, বিষন্ন এবং বিহ্বল, ভঙ্গুর এবং রমণীয় ! আমি নিশ্চিত যে ঘোষের প্রকল্পের এই চরিত্রটা উদারতাবাদী সাহিত্য ঘরানার ধারাবাহিক নারী-নির্মিতির একটা পরিবর্ধন মাত্র । তার ইনোসেন্স, পরিশেষে একটা পরিত্যক্ত কল্যাণকর ভাবনা সমেত, ছবিনির্মাতার স্ব-শ্রেণীর সদস্যদের পরিতৃপ্ত করবার একটা অবধারিত অংশ । চরিত্রটা এই শ্রেণীর বুদ্ধিবৃত্তিকতার এবং উদ্যাপনমুখরতার একটা মেটাফর বিশেষ । গৌতম ঘোষের বানানো একটা এক্সোটিক এবং এসকেপিস্ট ছবি দেখে আমি না-ভেবে পারলাম না যে পার কিংবা অন্তর্জলি যাত্রা -র পর এই নির্মাতা রাস্তা হারিয়ে ফেলেছেন । হলের বাইরে আমরা পুরি-চানা খুঁজছিলাম । তপন খুশিমনে জানতে চাইল `ছবিটা নিশ্চয় দারুণ লেগেছে তোমার ।' `না কেন ?' আমি উত্তর করলাম । `পুরো দৃশ্যপটটা ভীষণ আরামের ছিল দেখতে ।' ভিতরে ভিতরে আমার ভাবতে ভাল লাগছিল যে গৌতম ঘোষ ক্যানিং নিয়ে কোনো প্রকল্পে হাত দেননি । ক্যানিং কিন্তু প্রায় জঙ্গলই, মানে ছিল এক কালে অন্তত:, আর ঘোষের দারুণ পছন্দ এরকম পরিসর । লুচি কামড়াতে কামড়াতে রিংকুকে জিজ্ঞেস করলাম `তুই কি আম্মুনের মতো ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কান্না করার কথা ভাবতে পারিস ?' `না ! প্রশ্নই আসে না ।' রিংকুর জবাব সাফ ।
(ভ্রমণকাল : জুন ২০০৩ । ইংরেজিতে প্রথম লিখিত এবং অপ্রকাশিত । অনুবাদকাল : ২২শে জানুয়ারি থেকে ১২ই এপ্রিল ২০০৭ ।)
(পরবাস-৪০, জানুয়ারি, ২০০৮)