এতক্ষণ বসে থেকে এবার সংশয় দেখা দিলো সায়নের মনে, বিদিশা বোধহয় আজ আর এলো না । মনটা বিষাদে ভরে ঊঠতে থাকে । আর ঠিক তখনই বিদিশার আঁচলের ঘ্রাণ পেলো সায়ন । আকাশ নীল শাড়ীটায় দিগন্তের আভাস মেলে পাশে এসে বসল বিদিশা । সঙ্গে সঙ্গে সায়ন শুরু করে--
"পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি / আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী ।
(পরবাস-৪০, জানুয়ারি, ২০০৮)
রঙিন নিমেষ ধুলার দুলাল / পরানে ছড়ায় আবীর গুলাল,
ওড়না ওড়ায় বর্ষার মেঘে / দিগঙ্গনার নৃত্য
হঠাত্-আলোর ঝলকানি লেগে / ঝলমল করে চিত্ত"
মুখচোরা ছেলেটা কি করে যে বিদিশার সংস্পর্শে এমন মুখর হয়ে ওঠে ! ঝলমলে হাসি গড়িয়ে যায় বিদিশার ঠোঁটে....
-সায়ন রায় যে আজ অমিত রায় হয়ে উঠল ? এতোদিন পর আবার শেষের কবিতা নিয়ে পড়লে কেন ?
একটু অভিমানের ঝলক লাগলেও প্রকাশ করতে পারে না বেচারি, তাই বুঝি রোষটা গিয়ে পড়ল অমিত রায়ের ওপর ....
- অমিত রায়কে একহাত দেখে নিতে চাই
- হঠাৎ অমিত রায় কি দোষ করল ?
- শেষের কবিতা যে কারণে অপরাধী, তার নাম অমিত রায়
- সেকি, যে নায়ককে অবলম্বন করে বাংলা সাহিত্যে জন্ম নিলো এক নতুন গদ্যরীতি, তাকেই কিনা দোষারোপ করা ?
- করছি, কারণ রবীন্দ্রনাথ ভূল নায়ক নির্বাচন করেছিলেন ।
সহসা সায়ন কথা থামিয়ে ঝোলা থেকে বের করে টিউশনির পযসা জমিয়ে পুরনো বইয়ের দোকান থেকে কেনা একটা বই । বুদ্ধদেব বসুর "রবীন্দ্রনাথ : কথাসাহিত্য" ।
সায়নের চোখে অভিমানের ঝলকটাকে সন্তপর্ণে এড়িয়ে বিদিশা কৌতুকের আশ্রয় নিল....
- এতক্ষণে বোঝা গেল সায়ন রায়ের বিক্ষোভের কারণ !
- জানো বিদিশা, আমার আজকাল মনে হচ্ছে রবীন্দ্রনাথকে ঠিকমতো বুঝতে গেলে বুদ্ধদেব বসুর আলোচনাগুলো পড়া খুব দরকার ।
- কল্লোল ট্রায়োর অন্যতম সেই বুদ্ধদেব বসু । কিন্তু তিনি রবীন্দ্র বিরোধী নামেই বেশি খ্যাত, তাই না ! শুনেছি তিনি একদা সর্বভারতীয় প্রগতিশীল লেখক-সন্মেলনে সভাপতির ভাষণে বলেছিলেন
-আসলে আমার কি মনে হয় জানো বিদিশা, রবীন্দ্র সরোবরে আকন্ঠ অবগাহন করেছিলেন বলেই বুদ্ধদেব বসু তথা কল্লোল যুগের তরুণেরা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বাংলা সাহিত্যের জগৎ জুড়ে আছে রবীন্দ্রনাথের বিশাল প্রভাব । রবীন্দ্রনাথের এই দিগন্ত বিস্তৃত জাল থেকে বেরোবার চেষ্টায় তাঁরা এক বিকল্পের খোঁজ করেছিলেন, বাংলা ভাষার এমন এক কাব্যাদর্শ যাতে নতুনের ইঙ্গিত আছে । সেই যে পিনাকী ঠাকুর কল্লোল যুগের তরুণদের নিয়ে বলেছিলেন,
" রবীন্দ্রনাথকে সত্যিকারের যাঁরা 'পড়েছেন', হৃদয়ে ধারণ করেছেন তাঁরা রবীন্দ্র-অনুসারী নন, তখনকার দিনে নিন্দিত এই 'আধুনিক'রা-ই"।
- মনে হয় এটার সমথর্ন পাওয়া যায় বুদ্ধদেব বসু যখন বলেন,
"মনে হচ্ছে সে বই লেখার জন্য এখন আমি তৈরী হযেছি, কেননা এখানে এসে দেখছি আমাকে দারুন রবিতৃষ্ণায় পেয়েছে - রবীন্দ্রনাথ ছাড়া কিছুই পড়তে ইচ্ছে করে না, শেক্সপিয়ার প্লেটো হোমার প্রভৃতি জগদ্বিখ্যাত যে সব লেখকদের সঙ্গে এনেছি তাঁদের সকলকেই সম্প্রতি মনে হচ্ছে অর্থহীন ।"
-হ্যাঁ বিদিশা, বুদ্ধদেব বসুর সমস্ত জীবনের পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এ তৃষ্ণা তাঁর ক্ষণিক নয় । সমস্ত জীবন জুড়েই ছিল এই রবিতৃষ্ণা । জানো তো বুদ্ধদেব বসু প্রথম জীবনে শেষের কবিতার উচ্ছসিত প্রশংসা করেছিলেন । দেখো, এইখানটা পড়ো.....
"শেষের কবিতা প্রথম কিস্তি বেরোনোমাত্র বিকিয়ে যেতে হলো । মাসে মাসে এই আশ্চর্য নতুন রচনাটি পড়তে পড়তে আমাদের মনে হ'লো যেন একটা বন্ধ দুয়ার, যা আমাদের আনাড়ি হাতের আঘাতে কোনো উত্তর দেয়নি, তা এক জাদুকরের স্পর্শে হঠাৎ খুলে গেলো - দেখা গেলো আমাদেরই অনেক স্বপ্নের চোখ-ধাঁধানো মূর্তি ।"
শেষের কবিতার সঙ্গে জীবনের কতো স্মৃতি জড়িত, নামটা শুনলে এখনও যেন শিহরণ বয়ে যায় বুকের মধ্যে । বিদিশা ফিসফিস করে আবৃত্তি করে
"চুমিয়া যেও তুমি / আমার বনভূমি
দখিন সাগরের সমীরণ,
যে শুভক্ষণে মম / আসিবে প্রিয়তম -
ডাকিবে নাম ধরে অকারণ"
বিদিশার হাত মুঠোর মধ্যে নিয়ে সায়ন আস্তে করে চাপ দিলো । সম্বিতে ফিরে লজ্জা পেল যেন বিদিশা । তাড়াতাড়ি সামাল দিয়ে বলে...
-আমার কি মনে হয় জানো সায়ন, শেষের কবিতার এই চমকটা ছিল তার দ্যুতিময় ভাষায় । সেই যে প্রমথনাথ বিশী বলেছিলেন,
"এ কী ভাষা ! সরস্বতীর সম্মুখে এ কী বিদ্যুত্স্ফুরী অসিক্রীড়া ! এ যে একেবারে অভাবনীয়ের ক্বচিৎ কিরণে দীপ্ত ।"
-বুদ্ধদেব বসুও শেষের কবিতার ভাষায় রবীন্দ্রনাথের নবজন্ম স্বীকার করেছেন । বাংলা সাহিত্যের এক সন্ধিক্ষণে এই উপন্যাস সৃষ্টি হয়েছিল । সেই কল্লোলযুগে যখন কল্লোলগোষ্ঠী তারুণ্যের প্রচন্ড উত্সাহে রবীন্দ্রনাথের আদর্শ মেনে নিতে পারছে না । তারা তখন চাইছে কড়া লাইনের খাড়া লাইনের রচনা ।
-তার কারণটাও বোধহয় খুব পরিষ্কার । রবীন্দ্রনাথের ভাবধারায় জাতির অন্তর তখন আচ্ছন্ন , তাই তারই মাঝে তরুণরা নতুন পথ করে নিতে চাইছে । সায়ন তোমার মনে আছে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের সেই কবিতাটা ?
-কোনটার কথা বলছো বিদিশা ?
"পশ্চাতে শত্রুরা শর অগণন হানুক ধারালো
সম্মুখে থাকুন বসি পথ রুধি রবীন্দ্র ঠাকুর
আপন চক্ষের থেকে জ্বালিব যে তীব্র তীক্ষণ আলো
যুগ সূর্য ম্লান তার কাছে "
-হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথ এরই উত্তর দিলেন শেষের কবিতায় একেবারে বিদ্যুতের রেখার মতো, ন্যুরাল্জিয়ার ব্যথার মতো । ক্রিয়াপদের স্বল্পতায় বাংলা গদ্যের ধীর মেজাজটা যখন তরুণদের কাছে অসহ্য ঠেকছিল, পরীক্ষা চলছিল তাকে তীক্ষন ও গতিশীল করার । ঠিক তখনই সমস্ত খন্ড খন্ড প্রচেষ্টাকে বন্যার মতো ভাসিয়ে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করলেন নতুন গদ্যরীতি । ভেঙে দিলেন কল্লোলগোষ্ঠীর কল্পিত রবীন্দ্রযুগের সীমানা ।
-সেই জন্যই বোধহয় কবি অরুণ মিত্র বলেছিলেন, "শেষ বর্ষায় মরা গাঙে দেখি এলো প্লাবন"। আমার মনে একটা প্রশ্ন জাগে, শানিত তরবারির মতো এই ভাষা কোন শান পাথরে এমন দীপ্তি লাভ করল ?
-এর উত্তরটা তুমি বুদ্ধদেব বসুর কাছেই পাবে । তাঁর মতে কল্লোলের অর্বাচীনতারই প্রভাব পড়েছিল রবীন্দ্রনাথে । শেষের কবিতা রচনার কিছু পূর্বেই কল্লোল ও কল্লোলবিরোধী বির্তকসভা অনুষ্ঠিত হয় রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে ।
-তবে কি বলতে চাও শেষের কবিতার প্রথম পরিচ্ছদটির জন্ম সেই তর্কময় সাহিত্যিক আবহাওয়া থেকে ? কিন্তু কল্লোলগোষ্ঠী যার জন্য চেষ্টা করছিল তাকে তো অমিত বিদ্রুপ করেছে ।
-কিন্তু জানো বিদিশা, বিদ্রুপ করলেও অংশত তার সার্থকতা স্বীকার করেছেন রবীন্দ্রনাথ ।
অসহায় বোধ করে যেন সায়ন । রবীন্দ্রনাথ বললেই মনের মধ্যে হাজার কথা ভিড় করে আসে । শেষের কবিতা কতবার পড়েছে তার কোনো হিসেব নেই । এ যেন বাংলা গদ্যকে দুমড়ে মুচড়ে রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করেছেন এক দ্যুতিময় ভাষা যেখানে ধরা দিয়েছে আলোছায়ার নানা সুক্ষ্ম স্তর, ছন্দের নানা বৈচিত্র্য । এক একটা প্যারাগ্রাফ গোড়া থেকে বাড়তে বাড়তে হঠৎ কোন অভাবনীয় আকাশে গিয়ে ঠেকে - আর তার শেষপ্রান্ত থেকে যেন সহস্র চিত্রবর্ণ তারকা স্ফুলিঙ্গ ঝরে পড়ে । কোথায় যেন হারিয়ে যায় সায়ন । হঠাৎ বিদিশার ডাকে চেতনে ফেরে....
-কি ভাবছ সায়ন ?
-ভাবছি রবীন্দ্রনাথের কথা । কি অদ্ভুদ দেখো, নিজেরই সৃষ্ট রবীন্দ্রযুগের সীমানা ভেঙে যেন বেরিয়ে আসতে চাইছিলেন ।
-ঠিক তাই । আমার কি মনে হয় জানো, ঘরেবাইরে থেকেই রবীন্দ্রনাথ শুরু করেছিলেন কথাশিল্পের কলাকৌশল নিয়ে বিচিত্র রকমের পরীক্ষা নিরিক্ষা । উপন্যাসের এমন একটা রূপের খোঁজ করছিলেন যেখানে কবিত্ব সহযোগী হয় কথাশিল্পে ।
-আর সেই ঘরেবাইরে যে যজ্ঞের আরম্ভ হয়েছিল তা উদ্যাপিত হলো শেষের কবিতায় । যেখানে কাহিনীর প্রাধান্য ঘুচিয়ে, উনিশ শতকী প্লটের মোহ কাটিয়ে প্রধান হয়ে ওঠল পাত্রপাত্রীর মননশীলতা, উপন্যাস হয়ে ওঠল বক্তব্যপ্রধান আর ভাবনির্ভর ।
-সেই জন্য বুদ্ধদেব বসু শেষের কবিতাকে বাংলা গদ্যের মুক্তিদাতা আখ্যা দিয়েছিলেন , তাই না সায়ন ?
-কিন্তু তা সত্তেও গল্প হিসেবে দুর্বল বলেছেন বুদ্ধদেব বসু । আর তার কারণ দর্শেছেন বইটির "শোচনীয় পরিসমাপ্তি"কে ।
-শোচনীয় কেন ?
-কারণ মোহময় কাব্য-সৌন্দর্যের আকর হয়েও যে গ্রন্থটা শেষপর্যন্ত তৃপ্তিকর হয়ে উঠল না । আর সেই ব্যার্থতার জন্য দায়ি অমিত রায়ের অযোগ্যতা ।
-কিন্তু অমিয় চক্রবর্তী অমিত রায়কে "বোহিমিয়ান আর্টিস্ট" বলেছিলেন ।
-বলেছিলেন , কিন্তু আর্টিস্ট মানে যদি এখানে কবি ধরা হয় তবে সে যতই কবিতা বলুক আর কবিত্বময় উপমা টানুক অমিত রায়ের মধ্যে কবিচরিত্রের কোনো লক্ষণ নেই । আর বোহিমিয়ান ভাবকে যদি দারিদ্রের শিল্পরূপ ধরা হয় তবে আমার তো মনে হয় অমিতের বাবা যেটা চেয়েছিলেন "অক্সফোডের রঙ এমন পাকা করে ধরে যাতে দেশে এসেও ধোপ সয়"- সেটা অমিত রায় অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিল । এই যে এইখানটায় বুদ্ধদেব বসু কি বলছেন পড়ো....
"অমিতকে আমার মনে হয় কলকাতার ধনী সমাজের শৌখিন পুরুষের প্রতিমূর্তি - প্রশংসার অর্থে শৌখিন নয় ; কোনো কিছুতেই গভীরভাবে নিবিষ্ট হতে পারে না সে, শব্দতত্ত্বের বই পড়ে জানবার জন্য নয়, জানাবার জন্য, বানিয়ে বলা কথা শানিয়ে রাখে লোককে তাক লাগাবে বলে, যা বিশ্বাস করে তাই বলে না, যা চমক লাগাবে তাই বলে , এবং হয়তো কিছুই বিশ্বাসও করে না"
সায়নের সঙ্গে একমত হতে পারে না বিদিশা । তবে কি স্কুলের সেই ছোট্ট মেয়েটার মনে অমিত রায় যে রঙ লাগিয়েছিল এখনও সে রঙ ঝরল না ? ভিরু গলায় বলে...
-অন্তত প্রথম দুটো পরিচ্ছদে অমিত রায় কিন্তু আমাকে বেশ মুগ্ধ করে সায়ন ।
বিদিশার মুগ্ধতায় কি অমিত রায়কে প্রতিদ্বন্ধী মনে হচ্ছে সায়নের ? মনে পড়ছে সায়নের জন্মদিনে বিদিশা শেষের কবিতা বইটা উপহার দিয়েছিল । সায়নের তো প্রথম প্রেম রবীন্দ্রনাথ । তবে কি সেই প্রথম প্রেমই তার প্রতিদ্বন্ধী হয়ে এলো ? বুঝতে পারে না সায়ন, তবু প্রাণের আবেগেই বলে ওঠে--
-কিন্তু বিদিশা, পরের দিকে কি তার অন্ত:সারশূন্যতাই ত্রক্রমশ প্রকট হয়ে পডে না ? বইটির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সে আর কিছুই করে না , শুধু ভালো ভালো কথা বলে । শেষপর্যন্ত পাঠকের মনের কোণে এমন সন্দেহও উঁকি দেয় যে সত্যিই কি অমিত রায় কাউকে ভালবেসেছিল ? এই সন্দেহটাই শেষের কবিতার পক্ষে মারাত্মক ।
ভালোবাসার সংজ্ঞাটা নিয়ে বিদিশাও কিছু দ্বিধান্বিত যেন, বলে ওঠে,
-কিন্তু বিবাহই কি ভালোবাসার শেষ পরিণতি বলে তোমার মনে হয় সায়ন ? সেই যে লাবণ্য সম্পর্কে অমিয় চক্রবর্তী বললেন "তার হৃদয়জ্বলা আগুন দিয়ে সে বাঁধনছেঁড়া আর্টিস্টকে বন্ধনমোচনের আনন্দ দিলো"
-এর উত্তরটা বু.ব.-র থেকেই শোনো,
"অমিত লাবণ্যর বিয়ে হলেও চলতো, না হলেও চলতো - কিন্তু যেটা বেসুরো লাগে সেটা হলো তত্ত্বকথার দ্বারা ঘটনার সমর্থনের চেষ্টা"।
-আচ্ছা সায়ন বুদ্ধদেব বসু নাকি দু:খ করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ শেষের কবিতায় তাঁর কাব্য ঐশ্বর্যের অপব্যবহার করেছেন ?
-হ্যাঁ, বু.ব. বলেন ভাষায় জাদুকরী মায়া যেখানে উন্নত বিষয়ের মুখাপেক্ষী সেখানে রবীন্দ্রনাথ সাধারণ সাংসারিক প্রসঙ্গে, এমনকি পাত্রপাত্রীর সংলাপেও দরাজ হাতে কাব্যিক রঙ লাগিয়েছেন ।
-মানে সেই টলস্টয় যেমন বলেছিলেন শেক্সপিয়ারের নাটক পড়তে গিয়ে তিনি নাকি বিরক্ত হয়েছেন, কেননা তাঁর সব চরিত্রই কৃত্রিম শেক্সপিরীয় ভাষায় কথা বলে ।
-আসলে কি জানো, বু.ব. বিশ্বাস করতেন,
"সাহিত্যকলা জীবনের অনুকরণ করে না, জীবনের একটি প্রতিরূপ ও প্রতিদ্বন্ধী সৃষ্টি করে চলে, এ কথা শুধু ঘটনা বিন্যাসের ক্ষেত্রে নয়, ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও সত্য"।
তাই রবীন্দ্রনাথের পাত্রপাত্রী রাবীন্দ্রিক ভাষায় কথা বলবে এটাকে তিনি রচনার একটা রীতি হিসেবেই মেনে নিয়েছেন । তাই বলছেন,
"অমিত রায়ের বাক্যবন্ধে রাবীন্দ্রিক দীপ্তিপাত শুধু স্বাভাবিক নয়, অনিবার্য বলে ধরে নেয়া যায় - নেয়া যেতো, যদি না সে মাঝে মাঝে তুচ্ছ কথাও জাঁকালো করে বলতে গিয়ে অনুপাতবোধে ব্যাঘাত ঘটাতো ।"
-আচ্ছা সায়ন শেষের কবিতার কবিতাগুলো কি উপন্যাসের আভরণ বা গল্পের মধ্যে খেয়ালিভাবে প্রক্ষিপ্ত বলে মনে হয় ?
-না একেবারেই না, এই দেখো কবিতাগুলো নিয়ে বু.ব. কি বলছেন,
"সমগ্র গ্রন্থের মধ্যে ন্যায়সঙ্গত আসন আছে তাদের, যেন গ্রীক নাটকের কোরাসের মতো মাঝে মাঝে মন্তব্যের আলো ফেলে যাচ্ছে । শুধু তাই নয়, এই কবিতার জন্যই শেষের কবিতার সমাপ্তিটুকু অপঘাত থেকে রক্ষা পেয়েছে"।
এ যেন পাঠকের পূঞ্জিভূত অতৃপ্তি উপশম করে উপন্যাসটি শেষ করার জন্য বিপন্ন রবীন্দ্রনাথকে অবতীর্ণ হতে হয়েছিল নিজস্ব কবিসত্তায় ।
-কবিতাটার কথা মনে পড়তেই একবার তোমার গলায় শুনতে ইচ্ছে করছে বিদিশা , শোনাবে ?
"কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও ? / তারি রথ নিত্যই উধাও
জাগাইছে অন্তরিক্ষে হৃদয়স্পন্দন- / চক্রে পিষ্ট আঁধারের বক্ষ-ফাটা তারার ত্রক্রন্দন ।
ওগো বন্ধু, / সেই ধাবমান কাল
জড়ায়ে ধরিল মোরে ফেলি তার জাল- / তুলে নিল দ্রুতরথে
দু:সাহসী ভ্রমণের পথে / তোমা হতে বহু দূরে ।
মনে হয় অজস্র মৃত্যুরে / পার হয়ে আসিলাম
আজি নবপ্রভাতের শিখরচূড়ায় ;
রথের চঞ্চল বেগ হাওয়ায় উড়ায় / আমার পুরানো নাম
ফিরিবার পথ নাহি ; / দূর হতে যদি দেখ চাহি
পারিবে না চিনিতে আমায় / হে বন্ধু, বিদায় ।"
যেন কোন সুদূর থেকে ভেসে আসছে বিদিশার গভীর কন্ঠস্বর । একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকে সায়ন বিদিশার মুখের দিকে । মনে মনে উচ্চারণ করে ক্ষয় নেই ক্ষয় নেই তোমার । তবে কি সায়ন এখনও মুগ্ধ তার সেই প্রথম প্রেম রবীন্দ্রনাথে ? হয়তবা... জানা নেই । বোঝা না বোঝায় মেশা অনুভূতি নিয়ে চুপ করে বসে থাকে দুটো মুগ্ধ প্রাণ ।
সেদিন কলেজ থেকে বেরতে যাবে ঠিক তখনই পিছন থেকে শঙ্খ ডাকল
-এই বিদিশা , কোথায় যাচ্ছিস ?
-কি হলো ?
-আমার চায়ে একটু সঙ্গ দিবি ? আর কাউকে তো দেখছি না ।
-না মানে হ্যাঁ...ংআনে এই একটু.....
-কি মানে মানে করছিস ? ঝেড়ে কাশ না বাছা ।
কিন্তু বিদিশা জানে , হাটের মাঝখানে তথ্য বিতরণের অপচেষ্টা করতে গেলে গলাবাজ শঙ্খ সেটা সবাইকে না জানিয়ে রেহাই দেবেনা । সুতরাং ও রাস্তায় না যাওয়াই নিরাপদ । তাই সম্মতি জানিয়ে বলে ,
-চল্
দুজনে হাঁটতে থাকে কফি হাউসের দিকে । সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বিদিশা জিজ্ঞেস করে
-তুই অয়নকে ছেড়ে আজ আমায় স্মরণ করলি কেন রে শঙ্খ ?
-সে বেটা ধোঁকাচ্ছে
-কি হয়েছে রে ? জ্বর নাকি ?
-আরে ধুর ! জ্বর হলেও তো কথা ছিল , হয়েছে প্রেমজ্বর !
হো হো করে হাসতে হাসতে কফি হাউসে ঢুকেই বিদিশার চোখে পড়ে পশ্চিম কোণের টেবিলটায় । সায়ন এযাসট্রেটা নিয়ে একমনে ঘোরাচ্ছে । ওখানেই সায়নের বসার কথা ছিল আজ । পাশ থেকে শঙ্খ বলে,
-চল বিদিশা ঐ কোণে একটা টেবিল খালি আছে
বিদিশা কিন্তু সায়নের টেবিলটা দেখিয়ে বলে
-চল ঐখানে বসি
-মানে ?
-কিছু মানে নেই , চল না ।
কলেজের গেটে বিদিশার "মানে মানে" এতক্ষণে পরিষ্কার হলো , তবু শঙ্খ চুপ করে সেই টেবিলটার কাছে গেল । কিন্তু বিদিশা হাড়ে হাডে জানে সায়নের সামনে তাকে একহাত না নিয়ে ছেড়ে দিল বটে শঙ্খ , শোধ তুলবে কাল , ক্লাসে । যাক গে কালকের কথা কাল ভাবা যাবে । বিদিশা পরিচয় করিয়ে দেয়,
-সায়ন , যাদবপুরের কমপ্যারেটিভ লিটারেচার
সপ্রতিভ শঙ্খ হাত মেলায় সায়নের সঙ্গে,
-আমি শঙ্খ , বিদিশার ক্লাসমেট ।
স্বভাব লাজুক সায়ন কথা খুঁজে পায় না । শঙ্খই শুরু করে,
-কি দিয়ে চা টা শুরু করা যায় বলো সায়ন ?
-না মানে আমি এখন অন্য কিছু খাবো না ।
-আরে ধুর ! আমার পকেটও গড়ের মাঠ ! টা হলো গিয়ে চা এর সঙ্গে আলোচনাটা কিসের হবে ? রাজনীতি , সিনেমা নাকি সাহিত্য ?
ওয়েটারকে তিনটে চায়ের অর্ডার দিয়ে বিদিশা ফোড়ন কাটে ,
-যে কোনো সাবজেক্ট তুমি শুরু করতে পারো সায়ন , শঙ্খ সবগুলোতেই লড়ে যাবে ।
হাসির তুফান উঠল টেবিল জুড়ে । আর খুব গোপনে সায়নের বুকের মধ্যে কিসের যেন একটা কাঁটা খচ্ করে লাগল । নিজের জগৎ বেছে নেওয়াই নিরাপদ মনে করল সায়ন, বলল
-সাহিত্য
-গদ্য না পদ্য ?
সরাসরি জবাব না দিয়ে সায়ন পাল্টা প্রশ্ন করে ,
-উপন্যাস লেখা হচ্ছে সাধুভাষায় , এটা এখন আর ভাবাই যায় না , তাই না শঙ্খ ?
-রবীন্দ্রনাথকেই কি কম ভুগতে হয়েছে ! একদিকে অন্তরমহলের চলতিভাষা আর অন্যদিকে সরকারি রচনা সাধুভাষায় ।
-অন্তরমহল বলতে নিশ্চয়ই চিঠিপত্রের কথা বলছ ? কি আশ্চর্য দেখো শঙ্খ । একদিকে ছিন্নপত্র লিখছেন । অনবদ্য চলতিভাষার পত্রাবলি । অন্যদিকে সাধুভাষায় গল্প উপন্যাস । সংলাপ ইস্তক সাধুভাষায় !
- হুঁ , একান্তই মনের কথা চলতিভাষায় যা পাঠকের দরবার তক্ পৌঁছবে না ।
-আসলে কি জানো, তাঁর স্বভাবে বিপ্লবী বৃত্তি ছিল না । নিশ্চিত বিবর্তনের পথটাকেই রবীন্দ্রনাথ বেছে নিয়েছিলেন । তাই সাধু-চলিতের বিষম তর্কের যুগে তিনি তার্কিক হয়ে এলেন না , এলেন স্রষ্টা হয়ে । তাঁকে পরপর লিখতে হলো দুটো উপন্যাস
- চতুরঙ্গ আর ঘরে বাইরে ।
- কিন্তু সায়ন তুমি যে বলছো বিতর্কের জবাব , এখানে সেটা হলো কেমন করে ? একটা সাধুভাষায় আর একটা চলতিভাষায় । তাহলে !
- চতুরঙ্গ সাধুভাষায় হলেও ঠিক যেন তত্কালিন সাধুভাষা নয় । চলতিভাষার জন্য তখন রবীন্দ্রনাথের আকাঙক্ষা দুর্বার হয়ে উঠছে । তবু তিনি চলতি প্রথাকে দুমড়ে মুচড়ে তড়িঘড়ি নতুন কিছু করতে চান নি । তাই চতুরঙ্গে কেবল শরীরটাকে সাধুভাষায় রেখে চলতিভাষার আত্মিক গুণটাকে সঞ্চারিত করে দিলেন ।
-তার মানে তাঁর মন যা চাইছে সেটা সাধুভাষা থেকেই আদায় হয় কিনা সেটাই পরীক্ষা করতে চাইলেন ।
-ঠিক তাই শঙ্খ । তিনি বুঝিয়ে দিলেন সাধু-চলিতের পার্থক্য শুধু ক্রিয়াপদের রূপে নয় ।
হঠাৎ ঢ্যাঙা একহারা চেহারার সৌম্য সিগারেট খেতে খেতে হাজির হলো বিদিশাদের টেবিলে, একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বলল,
-কি রে শঙ্খ আজ তোর টা বেশ জমে গেছে দেখছি ! কিসের চলছে ?
-সাধু-চলিতের তফাৎ কি ? এই হলো বিষয় । তোর ভাষণটাও শুনিয়ে দে দেখি ।
-এটা আবার একটা বিষয় হলো ! কাল রাতেই তো খাবার টেবিলে সেজকা বলছিলেন তাঁদের সময় নাকি পরীক্ষায় চলতিভাষাকে সাধুভাষায় রূপান্তর করতে দিত । কি সোজা প্রশ্ন বল্ ?
-কেন কেন, সোজা কেন রে সৌম্য ?
-বা: ! এর আর কি আছে ? ক্রিয়াপদগুলো বদলে দিলেই তো হয়ে গেল ।
সায়ন মুখ খুলল এবার,
-না তা কিন্তু নয় ।
এতক্ষণে সৌম্যর চোখ পড়ে সায়নের দিকে ।
-আপনি... মানে ঠিক চিনলাম না তো !
শঙ্খ পরিচয় করিযে দেয়,
-ও হলো সায়ন , যাদবপুরের , বিদিশার বন্ধু ।
-আমি সৌম্য , প্রেসিডেন্সি ।
নিরীহ মুখে আলাপ করিয়ে দিলেও বিদিশার চোখে চোখ রেখে শঙ্খর দুচোখে খেলে গেল দুষ্টুমির ঝিলিক । কিন্তু বিদিশা পাত্তা না দিয়ে আরো একটা চায়ের অর্ডার দিয়ে তাদের আলোচনার খেই ধরিয়ে দিল ,
-ক্রিয়াপদ নিয়ে তুমি যেন কি বলছিলে সায়ন ?
-বুদ্ধদেব বসু কি বলেছেন সেটা বরং শোনাই ,
"বাংলা ভাষার প্রধান সমস্যাই ক্রিয়াপদ । একে তো তারা সংখ্যায় বেশি নয়, তার ওপর অনেক সময় তাদেরই জন্য ভাষা যেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে থাকে ।.... চলতিভাষার অনুরাগীদের মধ্যে অনেকে ভাবতেন যে সাধুভাষার ক্রিয়াপদগুলো বদলে দিলেই তা চলতিভাষা হয়ে ওঠে । বাংলা গদ্য স্বচ্ছ , দ্রুত সাবলীল হয়ে উঠবে , তাকে ইচ্ছেমতো বাঁকানো-চোরানো ঘোরানো ফেরানো যাবে - চলতি ভাষার আসল সার্থকতা এইখানে , তা সেই সময়ে অনেকেরই বোধোগম্য হয়নি ।
চায়ে চুমুক দিয়ে বিদিশা যোগ করে
-জানো সায়ন আমার মনে হয় সাধু চলিতের এই মূল সুত্রটা রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন তাঁর শিল্পীমনের প্রবৃত্তি দিয়ে ।
-ঠিক বলেছ বিদিশা । আর তাই বোধহয় চতুরঙ্গ পড়ে বিস্মিত হতে হয় । সাধুভাষার সংলাপগুলোও কতো সংযত আর সহজ ভঙ্গীতে রচনা ।
শঙ্খ বলে,
- কিন্তু চতুরঙ্গ পড়তে গিয়ে আমার কি মনে হয় জানিস বিদিশা , বইটায় কেমন যেন একটা হাঁপ-ধরা ভাব ।
সায়ন তখন বলল,
-জানো শঙ্খ এর কারণটা বুদ্ধদেব বসু খুব সুন্দর করে বলেছেন ,
"এ বইয়ে লেখক নিজেই নিজের উজান বেয়েছেন । যে উপাদান স্বভাবতই অনমনীয় তাকে নানা ভাবে খেলাতে গিয়ে ভিতরে ভিতরে শ্রান্ত হয়েছেন তিনি । তাই এখানে ভাষা এমন স্বল্প ও চাপা , যেন আগাগোড়া দাঁতে দাঁত চেপে বলা, কোথাও দম ফেলার জায়গা নেই"।
গতকাল বিদিশা টিভিতে আবার একবার সত্যজিতের ঘরে-বাইরে দেখেছে , হঠাৎ প্রশ্ন করে ,
-হ্যাঁ রে শঙ্খ ঘরে-বাইরে তোর কেমন লাগে ?
শঙ্খ মিচকে একটা হাসি দিয়ে বলে,
-কোনটা ? রবীন্দ্রনাথের নাকি সত্যজিতের !
তুমুল হাসির ঝড় উঠল টেবিল জুড়ে । বিদিশা করুণ সুরের অভিনয় করে বলল ,
-ট্র্যাক চেঞ্জ করিস না প্লিজ.....
সৌম্য বলে ,
-ঘরে বাইরে তো রবীন্দ্রনাথের প্রথম চলতিভাষার উপন্যাস ।
-ঠিক বলেছিস সৌম্য । কিন্তু ঘরে বাইরেতে যেন বড্ড বেশি আতিশয্য । বড্ড বেশি ঘি-মসলার রান্না !
সায়ন তখন শঙ্খকে সাপোর্ট করে বলল,
-হ্যাঁ শঙ্খ , আসলে চতুরঙ্গ লিখে রবীন্দ্রনাথের মনে তখন সাধুভাষার বাঁধভাঙ্গা উচ্ছলতা । চতুরঙ্গের কঠোর সরলতা থেকে হঠাৎ এক ঐশ্বর্যের ঘূর্ণির মধ্যে পড়ে দিশেহারা হয়ে গেছেন যেন । তাই বুঝি এত অলঙ্কারের প্রাচুর্য আর বিশেষণের ঘটা ।
বিদিশা গভীর সুরে উচ্চারণ করে ,
-ঘরে বাইরের আতিশয্য মেনে নিতে ইচ্ছে করে যখন ভাবি চতুরঙ্গ আর ঘরে বাইরে এক ভাষা আন্দোলনের শরিক । সাধু থেকে চলতি ভাষার বিবর্তনের অংশিদার ।
সৌম্য বলে,
-শুনেছি রবীন্দ্রনাথের এই সাধুভাষা থেকে চলিতভাষায় যাবার পিছনে নাকি "সবুজপত্র"ই দায়ি । সত্যি মিথ্যে জানিনা বাপু ।
বিদিশা বলে ওঠে ,
-ভাগ্যিস "সবুজপত্র" দায়টা নিয়েছিল ! না হলে আজকেও আমাদের সেই বঙ্কিমী সাধুভাষায় গদ্য পড়তে হতো ।
সৌম্য আর বিদিশার কথায় শঙ্খর মনে কোথায় যেন একটা কিন্তু কিন্তু ভাব জাগে, সে বলে,
-দেখ সৌম্য, তাঁর বয়স তখন পঞ্চাশ পার, নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন, জগত্বিখ্যাত হয়েছেন, তবু ঐ "জাত-খোয়ানো-প্রিয়া"কে প্রকাশ্যভাবে গ্রহণ করার জন্য তাঁর দরকার হয়েছিল "সবুজপত্র" এর উদ্দীপনা, প্রমথ চৌধুরীর নেতৃত্ব ! কিন্তু আমার মনে কেবলই প্রশ্ন জাগে চতুরঙ্গের পর বহুনিন্দিত অর্বাচীন চলতিভাষাকে গ্রহণ করলেন, তার পিছনে কি শুধুই "সবুজপত্র"?
সায়ন আর চুপ করে থাকতে পারে না, বলে,
-না, আমার কিন্তু তা মনে হয় না । বুদ্ধদেব বসু কি বলেন জানো,
"এই বিপ্লবের বীজ রবীন্দ্রনাথ তাঁর মনের মধ্যে প্রথম থেকেই বহন করে আসছেন, অনিবার্য ছিল তাঁর হাতে এই নতুন ভাষার জন্ম - "সবুজপত্র" শুধু নিমিত্তের মতো কাজ করেছে, এনে দিযেছে প্রয়োজনীয় অব্যবহিত উপলক্ষটি ।"
সৌম্য বলে ওঠে ,
-এবার আমি উঠি রে । তোরা কতক্ষণ আছিস ?
কথায় কথায় বাইরে কখন যে বিকেল গড়িয়ে গেছে সন্ধ্যের দিকে কেউ খেয়াল করেনি । বিদিশা উঠে পড়ে বলে,
-সন্ধ্যে হয়ে এল , এবার কিন্তু আমাকেও যেতে হবে ।
সকলেই উঠে পড়ে । সাযন সৌম্য আর শঙ্খকে বিদায় জানিয়ে বলে,
-আজকের চা এবং টা দুটোই খুব উপভোগ করলাম । আশা করি আবার একসঙ্গে বসব আমরা ।
কুচুটে শঙ্খ বিদিশাকে রাগাতে বলে ওঠে
-তা ম্যাডামের য়দি আপত্তি না থাকে তবেই.....
হাসতে হাসতে শঙ্খকে একটা কিল দেখিয়ে বিদিশা সায়নের সঙ্গে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যায় ।
পূজোর দীর্ঘ ছুটিতে হাঁপিয়ে উঠেছে বিদিশা । কতদিন যে দেখা হয়নি সায়নের সঙ্গে ! সেদিন দুপুরে হঠাৎ বিদিশা ফোন করে সায়নকে
-আমি বলছি
-বুঝেছি , কবে দেখা হচ্ছে বলো
-যদি বলি আজ
-তথাস্তু , নন্দনে, বিকেল চারটে
-হুঁ
আজ সকাল থেকেই কেমন যেন অস্থিরতা বোধ করছিল সায়ন । বইয়ের আলমারিটা ঘাঁটতে ঘাঁটতে হাতে ঠেকল রবীন্দ্রনাথের চারঅধ্যায় । মলাট ছেঁড়া বই, কবে যেন মাকে পুতুলমাসি উপহার দিয়েছিল । আনমনে পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে কখন যে ডুবে গেছে এলা-অন্তুর ভালোবাসায় খেয়ালই নেই । এলা আর অতীন্দ্রের রুদ্ধশ্বাস প্রণয়কথনের ফাঁকে ফাঁকে সুর উঠেছে মনে "পাগল হে নাবিক ভাসাও দিগিবদিক"। যখনই বইটা থেকে চোখ তুলেছে মন উড়েছে দুটো গভীর কালো চোখের সন্ধানে । মন বলেছে যদি দেখা হতো ! কি আশ্চর্য, মনের ঠিক এমনি একটা অবস্থায় এলো বিদিশার ফোন !
ছুটির দিনে বাড়ি থেকে বেরোনো মুখের কথা ! বিদিশা সাদা কাশ্মিরী সিল্কের ওপর ছোট ছোট গোলাপের কাজ করা শাড়িটা বেছে নিয়েছে আজ । লমবা চুলের বেণী ঝুলিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতেই মায়ের মুখোমুখি
-এখন আবার কোথায় চললি ?
-একটু ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরিতে যাবো
-হুটহাট বাইরে বেরোনো, কলেজে ঢুকে সাপের পাঁচ পা দেখেছো নাকি ?
-বেশি দেরী হবে না মা
মিথ্যে বলতে মুখে আটকে গেলেও উপায় নেই যে ! মায়ের সন্দেহ ভরা দুচোখের চাহনি মাথার মধ্যে নিয়ে মিনিবাস থেকে নামতেই এক্কেবারে সায়নের মুখোমুখি । কিছু ভেবে উঠবার আগেই সায়ন বলল
-ভালবাসা বড় বর্বর
যেন এই কথাটা বলবার জন্য মুখিয়েছিল সায়ন । বিদিশা হোঁচট খেল । কিছুতেই সায়নের চোখে চোখ রাখতে পারল না । পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে নিজের বোকামীটা টের পেল সায়ন, এবং সামলে নিয়ে যোগ করল,
-চারঅধ্যায়েই রবীন্দ্রনাথ বুঝি প্রথম মুক্ত কন্ঠে স্বীকার করেছেন এই কথাটা ।
স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বিদিশা চোখ তুলে তাকাল । ঠোঁটের ওপর খেলে গেল সেই ভূবনমোহিনী হাসি । চোখ ফেরাতে ভুলে গেল সায়ন । লজ্জা পেয়ে বিদিশা বলে ওঠে
-তুমি আবার চারঅধ্যায় পড়লে ?
-আজ সারাটা সকাল অন্তুর বাণীবন্যায় ভেসে গেছি বিদিশা ।
সারাটা দুপুর যেন স্বপ্নলোকে বিচরণ করেছে সায়ন । মনের মধ্যে জমে ওঠা প্রশ্নগুলো পথ খুঁজছে বেরিয়ে আসার । বুকের মধ্যে ভার হয়ে ওঠা বেদনাগুলো ভর দিতে চাইছে কারো ওপরে । কিন্তু নিশ্চিন্তভাবে ভর দেওয়ার মানুষটি যেন ধরা দিতে চায় না । ভালোবাসার ভাবের ঘরে এক অদ্ভুদ সংকোচ । যে ভালোবাসায় উন্মত্ততা আছে, আছে সর্বনাশ, তার জন্য মানুষের আকাঙক্ষাও তো শাশ্বত । তবু তার ভাষা কেন যোগায় না মুখে ?
সায়নকে চুপ করে থাকতে দেখে বিদিশা বলে
-চারঅধ্যায়ের চকচকে ঝকঝকে ক্ষুরধার ভাষায় সেদিন বাঙালি পাঠকের চোখ ঝলসে গেছিল বটে, তবু প্রকৃতপক্ষে এই ভাষা একটু কৃত্রিম । জ্যোতিভূষণ চাকি বলেছিলেন সকলের মুখে একই রকমের বাকচাতুর্য বেশ বেমানান ঠেকে ।
-জানো বিদিশা, বুদ্ধদেব বসুও বলেছেন কানাই গুপ্তর কথা শুনে তাকে হঠাৎ রবীন্দ্রনাথ বলে ভুল হয় । এই রকম শব্দবিন্যাস আর যার পক্ষেই সম্ভব হোক পুলিশের দারোগার পক্ষে সম্ভব নয় ! আর ওই যে যেখানে অতীন বলছে
"ঐ আঙিনায় রসে বিগলিত নানা রঙের লীলা সমানে চলবে দিনের পর দিন, অতীন্দ্র বিলীন হয়ে যাবে পান্ডুবর্ণ দূর দিগন্তে",
এটা রবীন্দ্রনাথের মুখে সুন্দর কিন্তু অতীনের নিজের মুখে নিতান্ত অশোভন ।
-হ্যাঁ, কথাগুলো কথা হিসেবে মুগ্ধ করে বটে, কিন্তু বক্তার সঙ্গে উক্তির ব্যবধান ভোলাতে পারে না ।
-দেখো বিদিশা আর একটা বিষয়ও বেশ ভাবায়, যেমন রবীন্দ্রনাথ যতই অন্তুর পরিবেশটাকে মাটির স্তরে নামিয়ে আনতে চেষ্টা করেছেন ততই তাঁর ভাষার মধুরিমা তাকে ঠেলে দিয়েছে উপরের দিকে, প্রায় স্বপ্নলোকে ।
-কিন্তু সায়ন, দরিদ্র চরিত্র তো আমরা দেখেছি গল্পগুচ্ছে ।
-হ্যাঁ দরিদ্র আছে কিন্তু দারিদ্র্য নেই, মানে চিত্তের দারিদ্র্য, আধুনিক যন্ত্রনির্ভর নগরসভ্যতায় যার জন্ম ।
-নাগরিক দারিদ্র্য মনুষ্যত্বকে জখম করে কেড়ে নেয় তার আত্মসম্মান । সেইজন্যই বুঝি তার স্থান ছিল না রবীন্দ্রসাহিত্যে । তাঁর শিল্পীমন ধনী দরিদ্র সকলকেই একই মনুষ্যত্বের মর্যাদা দিয়েছে ।
ওরা হাঁটতে হাঁটতে নন্দন চত্বরটা একটা পাক দিয়ে এসে বসল বাঁধানো গাছতলায় । পূজোর দিনগুলো সায়নের অদ্ভুদ ব্যস্ততার মধ্যে কেটেছে । সে জিজ্ঞেস করল,
-তোমার পূজো কেমন কাটলো বিদিশা ?
-তেমন স্পেশাল কিছু না । মায়ের সঙ্গে পাড়ার পূজোয় অঞ্জলি দিলাম আর দুচারটে ঠাকুর দেখা, এই আর কি । দুপুরগুলোয় পূজোসংখ্যা । তুমি কি করলে ?
-আমাদের তো সেই গ্রামের বাড়ির পূজো । আমরা সব আত্মিয়রাই এইসময় জড়ো হই ঐ বাড়িতে । দুর্গাপূজোর সময় আমাদের বাড়ির যে ঠাকুর আছে তার পূজো হয় খুব ঘটা করে । ঠাকুরবাড়ি সামলানোর কাজ করতে করতে সবাই হিমশিম খায় । আবার তারই মধ্যে গমগমে বাড়ির ফুরফুরে মেজাজে মনটা ভরে থাকে সব সময় । পূজো শেষ হলেই মন খারাপ করে ফিরে আসা যে যার বাড়ি । জানো বিদিশা এবারে গ্রামের বাড়ি থেকে ফিরেই খুব ইচ্ছে করছিল তোমার সঙ্গে দেখা করার ।
-পূজোর ছুটিটা আমারও বড্ড দীর্ঘ লাগছিল ।
বিদিশার হাতটা মুঠোর মধ্যে নিয়ে একটু চাপ দেয় সায়ন । সেই স্পর্শ "অনেক কথা যায় যে বলে কিছু কথা না বলে"। তখনও সায়নের মন জুড়ে আছে এলা অন্তুর মরণান্ত ভালোবাসা । সে ভালোবাসা যে তার নিজের জন্যই সার্থক । মনে পড়ছে বুদ্ধদেব বসুর কথাগুলো,
"অতীন ভাঙল তার স্বভাবকে ... এই সচেতন আত্মবিনাশের মূলে আছে, দেশপ্রেম নয়, যৌনপ্রেম, বিদেশী শাসন ধ্বংস করার পণ নয়, প্রেমাস্পদার কাছে ভালোবাসার প্রমাণ দেবার প্রতিজ্ঞা"।
ভাবতে ভাবতে আচ্ছন্নের মতো সে বলে,
-জানো বিদিশা, আসলে তাদের ভালোবাসা ঘুরে মরেছিল এক অন্ধগলির মধ্যে । সেখানে মিলনও যেমন অসম্ভব, বেরিয়ে আসাও তেমনি কঠিন ।
-বাতাসে তখন বারুদের গন্ধ । স্বাধীনতার স্বপ্নে মাতোয়ারা দুই তরুণ তরুণী ।
-কিন্তু বিদিশা সন্ত্রাসবাদ তো এখানে বিষয় নয়, বরং পটভূমি । এ যেন শুধু অতীনের ধ্বংসের পথটাকে চিহ্নিত করার জন্যই বিভীষিকার রক্তরেখা টানা হয়েছে । এ যেন এক দীর্ঘ তপ্ত প্রেমের কবিতা । গদ্যকাহিনীর ছলে লিরিকের তীব্রতা ।
-এটা কিন্তু রবীন্দ্রনাথও স্বীকার করেছিলেন । অন্তু আর এলার ভালোবাসা লিরিকের তোড়া বলেই বর্ণনা করেছিলেন ।
-আর সেইজন্যই বুদ্ধদেব বসু মনে করতেন, এই কাহিনী যদি 'কচ ও দেবযানী'র মতো কাব্যালাপে বলা যেত তবে অন্তরের সঙ্গে বাইরের মিলনে পূর্ণ হতো রচনা । চারঅধ্যায়ের আত্মা নাটকের নয়, উপন্যাসের নয়, গীতিকবিতার ।
-জানো সায়ন, লিরিকের স্বভাবটাই এমন যে আবেগের প্রাবল্যে ভাসিয়ে নিয়ে যায় তথ্যকে । রবীন্দ্রনাথও বলেছিলেন উপন্যাস রচনা করতে গেলে কবি যদি ত্রিসীমানায় থাকে তবে তাকে চাপা দেওয়া অসম্ভব ।
- কিন্তু বিদিশা শাসনে রাখা যে সম্ভব সেটা তো রবীন্দ্রনাথ 'গোরা' পর্যন্ত সমস্ত উপন্যাসেই প্রমাণ করেছেন । তবু 'ঘরেবাইরে' থেকেই তিনি যেন অদম্যরূপে কবি হয়ে উঠতে লাগলেন । সমস্ত গদ্যভূমিকেই বিগলিত করে নিলেন তাঁর কবিত্বে ।
-'বিশ্বপরিচয়' এর মতো একটা বিজ্ঞানের বইতেও তাঁর জাদুকরি ভাষা বিজ্ঞানকে ছাড়িয়ে মিশে গেছে কোন দিগন্তে । মনের মধ্যে যেন বাজিয়ে দিয়ে যায় কোনো অচেনা সুর ।
-এই সময়ের রবীন্দ্রনাথ যতগুলো চরিত্র সৃষ্টি করেছেন সেগুলো নিয়ে বুদ্ধদেব বসুর মতটা কি ভীষণ মনোগ্রাহী,
"গোরার পর থেকে - একমাত্র মধুসূদনকে বাদ দিয়ে - রবীন্দ্রনাথের পাত্রপাত্রীরা প্রায় সকলেই দ্বিরায়তনিক, যথাযোগ্য শরীরের অভাবে ঈষৎ পান্ডুর । আমাদের অতৃপ্তি থেকে যায় সেখানে, যেখানে এইসব মানুষ তাদের স্রষ্টার দ্বারা আরোপিত অসামান্যতার ভার বইতে গিয়ে, ঠিক যেন মানুষ হয়ে উঠতে পারে না । এরই মধ্যে অতীন্দ্রকে অনেকটা জীবন্ত বলে চেনা যায় । কেননা এই অসামান্যতাকে প্লাবিত করে দিয়েছে তার তীব্র প্রণয়বাসনা, হতাশার আর্তস্বর । পুরুষের মূর্ত কামনারূপেই তাকে আগাগোড়া দেখছি আমরা । এখানেই অতীন্দ্রের আর চারঅধ্যায় বইটার শক্তির উত্স"।
চলমান জনতার স্রোতের দিকে চেয়ে আনমনা হয়ে যায় বিদিশা । তার চৈতন্যের মধ্যে ছুঁয়ে যায় এলার তীব্র ভালোবাসার ঘ্রাণ ।
সেদিন কলেজ থেকে বেরিয়ে বিদিশা একা একা হেঁটে যাচ্ছে হেদুয়ার দিকে । গন্তব্য বসন্ত কেবিন । ঠনঠনে কালিবাড়ির কাছে হঠাৎ সে পাশ থেকে শুনল নীলাঞ্জনার গলা
-কি রে এমন একা একা চললি কোথা ?
একমনে পথ চলেছিল বিদিশা । থমকে গেল । বলল
-তুই !
-আঁজ্ঞে, আমি বটে !
-তোর ক্লাস শেষ ?
-আজ ক্লাসে ভঙ্গ দিয়েছি রে । তা তোর এমন উদাস চলন কেন হে ?
-তাহলে চল না একসঙ্গে যাই
-বারে ! যাবি কোথা তাই জানি না, বলে কিনা সঙ্গে চল !
খিলখিল হেসে বিদিশা বলে
-জাহান্নমে !
-তাহলে আমায় ক্ষমা দে ভাই । পার্টি ইলেকশানের আগে ওপথে যেতে পারছি না রে ।
-থাক, অত ভ্যানতারা করিস না তো , একটু হেদুয়ার দিকে যাচ্ছি, চল, একসঙ্গে যাই ।
নীলাঞ্জনা রাস্তার দিক পরিবর্তন করে বিদিশার সঙ্গ নেয় । ক্লাসে তার টিকি দেখা যায় কালেভদ্রে । কলেজটা যে শুধু পড়াশোনার জায়গা এই কথাটা সে মানতে নারাজ । আস্ত একটা মানুষ হতে গেলে শুধু পড়াশোনা করলেই হবে না, রাজনীতির হাতেখড়িটাও হওয়া জরুরি, এই তথ্যটা সে বেশ ঠুকে ঠুকে মাথায় ঢুকিয়ে দেয় । বিবেকানন্দ রোডের ত্রক্রসিং পেরিয়ে সে হঠাৎ বিদিশাকে বলে
-তা হেদুয়ায় কি সাঁতার শিখতে চললি নাকি ?
একটু দুষ্টু হাসি মেখে নিয়ে বিদিশা বলে
-সবাই কি আর জলে সাঁতার দেয় রে ?
-তা তুই ডুবে ডুবে কোন সাগরে সাঁতার দিচ্ছিস ভাই ?
দুই সখির তুমুল হাসির জোয়ারে রাস্তার লোকে ফিরে তাকায় । বিদিশা নিজেকে সামলে নিয়ে নীলাঞ্জনার দিকে তাকিয়ে বলে
-খুব খিদে পেয়েছে, তাই বসন্ত কেবিন
-বোঝো কান্ড ! খাবার জন্য কলেজ স্ট্রিট থেকে বসন্ত কেবিন !
দুজনে বসন্ত কেবিনে ঢুকতেই সায়ন হাসি মুখে তাকিয়ে হাত তুলল । পাশে শঙ্খ আর অয়ন । নীলাঞ্জনা বলল
-বাবা ! দলবল নিয়ে শঙ্খটাও এখানে হাজির দেখছি ! শঙ্খর পাশে কে রে বিদিশা ? চিনলাম না তো !
আয় বলে ডেকে নিয়ে বিদিশা সায়নের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয় । এতক্ষণে বিদিশার সাঁতারের রহস্য উন্মোচিত হলো নীলাঞ্জনার কাছে ।
সবার জন্য খাবার আর চায়ের অর্ডার দিয়ে বিদিশা শুরু করে
-আজকের বিলটা কিন্তু ফিফটি-ফিফটি, ছেলেরা অর্ধেক মেয়েরা অর্ধেক, ঠিক আছে ?
-ইয়েস বিদিশাদেবী
-দেবীর আসনে বসিয়ে আর কাজ নেই, শেষে শঙ্খ থেকে শশাঙ্ক হয়ে যাবি ।
-শশাঙ্কটা আবার কে রে ?
-কেন, রবীন্দ্রনাথের 'দুই বোন' মনে নেই ? স্ত্রীর ছবিতে ফুল দিয়ে পূজো করতে করতে শ্যালিকার সঙ্গে প্রণয়সাধন !
অয়ন হাসতে হাসতে বলে,
-তা বেচারী করে কি বল দেখি ? শর্মিলার মতো রুগ্ন স্ত্রীর পাশে যদি ঊর্মিলার মতো প্রিয়া মিলে যায় তো তার আর করার কি থাকে ?
-দেখ অয়ন আমি কিন্তু বলিছ না যে ভালোবাসাটা এখানে অস্বাভাবিক, আমি বলতে চাইছি একটু আত্মবিরোধের আভাসও কি থাকতে নেই ? রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত শশাঙ্কর ভাবালুতাকে এতদূর পর্যন্ত প্রশ্রয় দিলেন যে সত্যি সত্যি শর্মিলাকে দেবী বানিয়ে দিলেন !
সায়ন হঠাৎ মুখ তোলে, বলে
-কিন্তু আমার কি মনে হয় জানো বিদিশা, শর্মিলার এই আত্মদান রবীন্দ্রনাথ নিজেও যেন সর্বান্তকরণে মেনে নিতে পারেননি । আর তারই পরিশোধকরূপে তাঁকে অনতিপরেই লিখতে হলো 'মালঞ্চ', যেখানে নিষ্ঠুর হাতে আঁকলেন নিরজাকে ।
নীলাঞ্জনা বলে ওঠে,
-কিন্তু নির্মম না হতে পারাটা শিল্পীর পক্ষে সিদ্ধির অন্তরায় নয় কি ?
সায়ন মানতে পারে না, বলে
-কিন্তু নির্মমতা আর নিষ্ঠুরতা তো এক নয় নীলাঞ্জনা ।
শঙ্খ জানতে চায়,
-তুমি এই দুটোর মধ্যে পার্থক্য করবে কি করে ?
জবাবে সায়ন বলে,
-এই দুটোর পার্থক্যটা বুদ্ধদেব বসু করেছিন খুব সুন্দর করে,
"অবিচলভাবে সমস্ত ঘটনা দেখে যাওয়া, লিখে যাওয়া - কোনো মানুষ বা কোনো সংস্কারের প্রতি মমতাবশত সত্যকে গোপন না করা - এই হলো শিল্পীর নির্মমতা, আর নিষ্ঠুরতা হলো অবিচার ; সেই অবিচার কোনো শেক্সপিয়ার যখন শাইলকের ওপর অনুষ্ঠিত করেন তখনও আমাদের মন প্রতিবাদ না করে পারে না । 'মালঞ্চে', মানতেই হয়, নীরজার চরিত্র উত্কট অবিচারের দৃষ্টান্তস্থল"।
-শশাঙ্ক-উর্মিলার প্রেমের ব্যাপারটা কি তুমি মেনে নিতে পারো সায়ন ?
-মেনে নেওয়া আর মনে নেওয়া তো এক নয় শঙ্খ । তবে এটা বলা যায় তাদের প্রণয়বন্ধনে অনিবার্যতা ছিল ।
-কি সেই অনিবার্যতা ?
-দেখো আমার তো মনে হয় সরকারি কাজের সুখশয্যা ছেড়ে সে যখন ব্যবসায় নামল তখন সেই জীবনসংগ্রামের তরঙ্গের মধ্যে ছিটকে পড়ে তার সুপ্ত পৌরুষ জেগে উঠেছিল । দেহ মনের প্রেমের অতৃপ্তি চেতনা যা এতদিন সুপ্ত ছিল সেই গোপন তৃষ্ণা বিষয়ে সে সচেতন হয়ে উঠেছে । আর উর্মিলার মধ্যে ভালোবাসার ইচ্ছে তো ছিলই । তাই আগুন জ্বলে উঠতে দেরী হয়নি ।
-দেখো শ্যালিকার সঙ্গে প্রণয়সাধন মেনে নিতে পারলেও আমার অদ্ভূদ লাগে তাদের অন্তর্দ্বন্দ্বের অভাব ।
-এইখানটায় 'দুই বোন'এর দূর্বলতা বলতে পারো । তাদের প্রণয় যেন বড়ো বেশি মসৃণ পথে এগিয়েছে, কোথাও যেন বিবেকবুদ্ধির পিছুটান নেই, আপন অন্তরের সঙ্গে বোঝাপড়া নেই । কিন্তু এই দূর্বলতা স্বত্ত্বেও চরিত্রগুলোর প্রতি আমরা শ্রদ্ধা হরিয়ে ফেলি না ।
বিদিশার গলা শোনা যায়, সামান্য যেন ঝাঁজের আভাস,
-তুমি শ্রদ্ধা বলছ কি শর্মিলার ঐ সতীধর্মের মহিমাপ্রচার দেখে ?
সকলের সঙ্গে আড্ডার মধ্যে বসেও সায়ন গোপনে টের পায় বিদিশার ঝাঁজটুকু । মুখ তুলে তাকায় তার চোখের দিকে । নাকের পাটা সামান্য ফোলা, শাসন না-মানা চুলগুলো কপালে ঘাড়ে দোল খাচ্ছে । কোমল মনটা যেন হঠাৎ কোথায় বাধা পেয়ে রুষ্ট হয়ে উঠেছে । সায়ন গভীর গলায় উচ্চারণ করে,
-তা নয় বিদিশা । ঐ যেখানে নিজের বোনের সম্পর্কে শর্মিলা বলে, "আমি চলে গেলে ক্ষতি হবে, কিন্তু ও চলে গেলে সব শূন্য হয়ে যাবে", এইখানে বোঝা যায় তার নারী মন দিয়ে সে বুঝে নিয়েছিল পুরুষ মনের গোপন চাহিদা । এই বোধের আলোয় সে হয়ে ওঠে এক সম্পূর্ণ মানুষ । তার স্বচ্ছ দৃষ্টির মধ্যে দিয়ে শশাঙ্ক-উর্মিলার ভালোবাসাও শ্রদ্ধেয় হয়ে ওঠে ।
নীলাঞ্জনা বলে
-শশাঙ্কর চরিত্রে শ্রদ্ধার থেকে তো আমি লেখকের ব্যঙ্গটাকেই বেশি টের পাই
-ব্যঙ্গ !
-হ্যাঁ, ঐ যে যেখানটায় বলেছিলেন শশাঙ্ক-উর্মিলার মিলনসুখেই শর্মিলা সুখী, কারণ সে অসাধারণ !
-তা অবশ্য বলা যায় । দূর্বল প্রকৃতির শশাঙ্ককে আঁকতে গিয়ে খুব সুক্ষ্ম একটা ব্যঙ্গ টের পাওয়া যায় । এই হাস্যরসের ছিটেফোঁটাও যদি মালঞ্চে থাকতো, তবে সেখানে হৃদয়হীনতা এমন দু:সহ হয়ে উঠত না ।
অয়ন হঠাৎ যোগ করে,
-শর্মিলার মতো নীরজা যদি আরো একটু উদার হতো তবে...
অয়নকে শেষ করতে না দিয়েই বিদিশা বলে,
-দেখ অয়ন, আপন সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শয্যা নেওয়াটাই নীরজার মতো মেয়ের পক্ষে দু:খজনক । তার ওপর সেই সংসারের ভার অন্য মেয়ের হাতে চলে যেতে দেখে নীরজার ঈর্ষা তো স্বাভাবিক । দশ বছরের সুখী বিবাহীত জীবন কাটিয়ে আদিত্যর ভাবখানা এমন যেন নীরজা মরলেই সে বাঁচে ! সরলাকে বিয়ে করে নিশ্চিন্ত হয় ।
শঙ্খ উত্তেজিত বিদিশার রাশ টেনে বলে
-ধীরে ম্যাডাম, অন্য টেবিলের সবাই তোর কথা হাঁ করে শুনছে যে রে !
মুখ ভেংচে "বয়েই গেল" বলে বিদিশা হেসে ওঠে । আর এক প্রস্থ চা খাওয়ার বায়না ওঠে পুরুষ মহল থেকে ।
কেমন একটা বিষন্নতায় ডুবে যেতে যেতে হঠাৎ সায়ন বলে
-সেই তো নিরজা মরলো, কিন্তু সেই শেষ মুহূর্তেও তার স্রষ্টা তাকে করুণা করতে পারলেন না । মৃত্যুর দৃশ্যটিকে আঁকলেন বীভত্স রূপে । বুদ্ধদেব বসু যর্থাথই বলেছিলেন,
"ঈর্ষা, লোভ, ক্রোধ প্রভৃতি ক্ষুদ্রতা অতিক্রম করতে পারে অত্যন্ত বেশি প্রবল হয়ে উঠলেই, তখন তাদের মধ্যেও এক রকমের মহিমার রূপ দেখতে পাই আমরা । কোনো ওথেলো যখন ডেসিডমনাকে হত্যা করে, আমরা উভয়ের জন্যই সমান করুণা অনুভব করি । কিন্তু নীরজার এই স্বাধিকারমত্তা প্রেতিনী মূর্তি আমাদের মনে কোনো প্রশংসা বা করুণা জাগায় না, ভয়মিশ্রিত ঘৃণার সঞ্চার করে শুধু"
বিদিশা বলে,
-ঠিক বলেছ সায়ন নীরজার ঈর্ষা পর্যন্ত উজ্জ্বল করে আঁকেননি রবীন্দ্রনাথ ।
শঙ্খ বলে ওঠে,
-আমার কি মনে হয় জানো বিদিশা, চোখের বালিতে শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে বিধবা বিনোদিনীর অনুচিত শাস্তিবিধান সম্পর্কে সচেতন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, ভেবেই নিয়েছিলেন হৃদয়ের ওপর শাস্ত্রনীতিকে জয়ী হতে দেবেন না ।
বিদিশা মানতে পারে না কিছুতেই
-কিন্তু হৃদয়বৃত্তির খাতিরে নিরপরাধ ব্যক্তিকে দু:খের দন্ডাজ্ঞা দিতেও শিল্পীর বিবেকে বাধা উচিত ।
নীলাঞ্জনা বলে
-আসলে কি জানিস বিদিশা, আদিত্য সরলার প্রেমের আকস্মিকতা জীবনে অসম্ভব নয়, কিন্তু সাহিত্যে সেই আকস্মিকতাকে বিশ্বাস করানোর দায় থেকে যায় লেখকের । পাঠকের সেই মুগ্ধতা এখানে গড়ে ওঠেনি । আদিত্যর নিষ্ঠুরতার যথেষ্ট ভিত্তি নেই বলেই তাকে এমন অমানুষিক মনে হয় ।
সায়ন বলে ওঠে,
-জানো নীলাঞ্জনা বুদ্ধদেব বসু খুব সুন্দর করে বলেছিলেন,
"আমার জীবনের পূর্ণতাসাধনে বাধা দেবার অধিকার যেমন শাস্ত্রের বা সমাজের নেই তেমনি অমারও অধিকার নেই অন্যের জীবনকে সমূলে উত্পাটিত করার । কোন নীতি অনুসারে এটা নি:সংশয়ে জানবো যে আমি মানুষটা এতই মূল্যবান যে আমার পূর্ণতার জন্য অনেকে অনেক দু:খ পেলেও কিছু এসে যায় না ? তাদের দু:খের ক্ষতিপূরণ করবে আমার জীবনের সার্থকতা, এই যুক্তি কোনো সজ্ঞান মনই তো মানতে পারে না"।
একটা নিস্তব্ধতা বিরাজ করে টেবিল জুড়ে । বাইরে হঠাৎ শুরু হয় ঝমঝম বৃষ্টি । সকলের অলক্ষ্যে কখন যেন মেঘ করেছে আকাশ জুড়ে । সকলেই যেন বৃষ্টির শব্দ শুনছে মন দিয়ে, নাকি হারিয়ে যাচ্ছে সেই প্রায় শতাব্দী পূরোনো উপন্যাসের পাতায়, কে জানে !
নীলাঞ্জনা চোখ তুলে বলে
-এবার উঠব রে । রাজনীতির ধোঁয়ায় মনটা যেন অসাড় হয়ে গেছিল । তোদের সঙ্গে আজ বিকেলটা দারুন উপভোগ করলাম ।
পঁচিশে বৈশাখ এলেই কাকভোরে সায়ন হাজির হয়ে যায় রবীন্দ্রসদনের প্রাঙ্গনে । এবারে সঙ্গে আছে বিদিশা । হয়ত প্রতিবারেই দুজনে উপস্থিত থেকেছে এই প্রাঙ্গনে, কিন্তু আজকের মতো পাশাপাশি নয় । তখন ছিল অপরিচয়ের দূরত্ব, অচেনার গন্ডী । কিন্তু এখনও কি বলা যায় চিনিলাম তোমায় ! পীযূষকান্তি গাইছেন, "একদিন চিনে নেবে তারে / তারে চিনে নেবে"...
মৃদুস্বরে বিদিশা প্রশ্ন করে
-এবারে পার্থ ঘোষ গৌরী ঘোষ আসবেন তো সায়ন ?
-প্রতিবারেই তো আসেন, আসবেন নিশ্চয়ই । আজকের দিনটায় শুধু গান আর গান । তারই মাঝে মাঝে কবিতার পাঠ , কেমন যেন আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি ।
-কি আশ্চর্য দেখো সায়ন, একশো বছর পরেও আমরা রবীন্দ্রনাথে মজে যাই ।
-জানো বিদিশা আমি আবার একবার গোরা পড়লাম । কতদিন পর !
-কিন্তু গোরা কি আর এখন তেমনভাবে প্রাসঙ্গিক আছে ?
-বুঝি বিদিশা । হিন্দু-ব্রাহ্মের বিরোধ আজ অস্তিত্বহীন । আর সেই জন্য গোরা বা বিনয়ের সঙ্গে হারানবাবুর বিতর্কগুলো অপ্রাসঙ্গিক । কিন্তু তাই বলে কি এই উপন্যাসের মূল্য একবিন্দুও কমেছে ?
-কিন্তু যে বিষয়টাই এখানে প্রধান সেটাই যখন আজ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে, তখন বইটার আর প্রাণ রইল কোথায় ?
-কিন্তু বিদিশা ঐ বিতর্কগুলোই কি গোরার প্রাণকেন্দ্র ?
-নয় বলছ ?
-তাই তো মনে হয় । বুদ্ধদেব বসুও বলেন দুটো প্রেম কাহিনীই এই উপন্যাসের প্রাণকেন্দ্র । একদিকে ললিতা-বিনয় আর অন্যদিকে গোরা-সুচরিতা । আর এদেরকে ঘিরে হিন্দু-ব্রাহ্ম বিরোধই বলো কি ইংরেজ-ভারতীয়ই বলো, যে ঝড় তুলেছিল তা শুধু প্রেমের পর্বগুলোকে বিকশিত হতেই সাহায্য করেছে ।
-কিন্তু সে তো চরিত্রের অন্তর্দ্বন্দ্ব দিয়েও বোঝানো যেত ।
-তা যেতো, কিন্তু আমরা বোধহয় ভুলে যাচ্ছি গোরা রচনার সাল ১৯১০, মানে ভরা স্বদেশী যুগ ।
-হুঁ, তা ঠিক । আমার সব চেয়ে কোনটা আশ্চর্য লাগে জানো, স্বদেশী যুগে রচিত হয়েও এই উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ স্বদেশীয়ানার ধ্বজা ওড়াননি ।
-বু.ব. কি বলছেন দেখো,
"স্বাদেশীকতা কি ধর্মের উন্মাদনা লেখকের সত্যদৃষ্টি আবিল করেনি । সনাতনী হিন্দুয়ানি এবং একইরকম সংকীর্ণ গোঁড়া ব্রাহ্ময়ানা
- এই দুই মিথ্যাকে তিনি মূর্ত করলেন গোরা ও হারানবাবুর চরিত্রে ।"
-জানো সায়ন রবীন্দ্রনাথ নাকি একবার বলেছিলেন গোরার মধ্যে তত্কালিন প্রচলিত হিঁদুয়ানির ভালো ব্যাখ্যা আছে ।
-হ্যাঁ, ব্যাঙ্গার্থে বলেছিলেন সাহিত্যের পথে প্রবন্ধটাতে । লোকে বলে রবীন্দ্রনাথের রচনায় বাস্তবতার উপকরণ যেটুকু আছে তা নাকি শুধু এই গোরা উপন্যাসেই । সেই সূত্রেই কথাটা বলেছিলেন ।
-গোরার রঙ্গমঞ্চে হরিমোহিনীর প্রবেশের পূর্ব পর্যন্ত কিন্তু সত্যিই মনে হয় হিন্দু-ব্রাহ্ম বিরোধে রবীন্দ্রনাথ হিন্দুদের পক্ষে বলেছেন, তাই না সায়ন ?
-আর সেই ভুলটুকুও ভেঙে যায় যখন কৈলাস চরিত্রটাকে কেন্দ্র করে হরিমোহিনী চরিত্রের ধূর্ততা আর লোভের প্রকাশ পায় । তার মধ্যে দিয়ে এক গলিত কুত্সিত দিকের আবরণ উন্মোচিত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ।
সুচিত্রা মিত্রর উদাত্ত কন্ঠে ধ্বনিত হয়ে উঠল, "দারুণ অগ্নিবাণে রে, হৃদয় তৃষায় হানে রে".... একটু কি উদাস হয়ে পড়ল বিদিশা ! বৈশাখের তীব্র দাবদাহ একটু একটু করে নিজেকে প্রকাশ করছে । দূরের কৃষ্ণচুড়াটা আপন রূপের অহংকারে দাউদাউ করে জ্বলে উঠতে চাইচ্ছে । তারই দিকে চেয়ে চুপ করে বসে রইল বিদিশা । রবীন্দ্রনাথের গোরা এবং তাকে ঘিরে বুদ্ধদেব বসুর আলোচনা আর এই দুজনকে ঘিরে দুটো মুগ্ধ প্রাণের কথপোকথন কি আরও একটি প্রণয়কাব্য গাঁথতে বসল আজ ! একটু গভীর স্বরে সায়ন ডাকল
-চলো বিদিশা একটু হাঁটি ।
অন্যমনস্কভাবে উঠে এলো বিদিশা, পাশাপাশি হাঁটছে তারা ধীরে ধীরে । হঠাৎ বিদিশা ফিসফিস করে
-কলকাতাটা কেমন অদ্ভুদ, না সায়ন ?
-জানো বিদিশা রবীন্দ্রনাথ কলকাতা ভালোবাসতেন না ।
-কিন্তু বেশ কিছু উপন্যাসে কলকাতা আছে তো ।
-হ্যাঁ তা আছে । চোখের বালি বা যোগাযোগে কলকাতা উপস্থিত, তবে নামমাত্র । গোরাই বোধহয় প্রথম উপন্যাস যেখানে রবীন্দ্রনাথ কলকাতাকে স্বীকার করলেন ।
-সেটা বোধহয় এর নাগরিক পটভূমিকার জন্য ।
-বু.ব. কি বলেন জানো, নগরের নানান চিন্তার দ্বন্ধময় পরিবেশে বুদ্ধিজীবী মানুষের আত্মবিরোধ আর প্রতিদিনের জীবনকাব্যের দহনচিত্র আঁকার তাগিদে কলকাতাকে প্রয়োজন পড়েছে এই উপন্যাসে ।
-কিন্তু কি আশ্চর্য দেখো, উপন্যাসে ঘটনাস্রোতের পথচলা কেমন স্বাধীন কিন্তু সে কখনই বাস্তবের মত উচ্ছৃঙ্খল হতে পারে না ।
-সেইখানেই যে জীবনের সঙ্গে তার প্রধান পার্থক্য বিদিশা । সে যেন শিল্প সৃষ্টির এক অমোঘ নিয়মে শাসিত । উপন্যাসে এই সমগ্রতার স্বাদ দেওয়ার জন্যই রবীন্দ্রনাথ গোরা থেকে শেষের কবিতা বা তার পরের উপন্যাসগুলোতে যে বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন, তার সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসু বলেন,
"লেখক সেখানে সর্বগ ও সর্বজ্ঞ, স্বয়ং বিশ্ববিধাতার অনুকারক, কেউ সেখানে 'আমি' নয়, সকলেই 'সে', লেখক নিজে অনুপস্থিত থেকে সকলের কথাই বলে যাচ্ছেন ।"
-ভাবো তো আমাদের সেই প্রাচীন মহকাব্য দুটোর কথা । সেই যে বলে না "যা নেই ভারতে তা নেই মহাভারতে" । এমনই সমগ্রতায় সৃষ্টি হয়েছিল সেই প্রাচীন মহকাব্য ।
-কিন্তু আধুনিক উপন্যাসকে বুদ্ধদেব বসু মহাকাব্যের একটি অংশ মাত্র মনে করেন । তিনি বলেন, মানুষের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক সাহিত্য মহাকাব্যের অঙ্গন ছেড়ে বিভিন্ন শাখাপ্রশাখায় ছড়িয়ে পড়েছে । পদ্যছন্দে গল্প বলার প্রবণতা ছেড়ে সৃষ্টি হলো গদ্য । কবিতা কাহিনীর প্রলোভিত পথ ছেডে আবেগের পথে আমাদের অনুভূতিকে শিক্ষিত করতে লাগল । আর এই গল্পের ধারাটি যখন উপন্যাসে এসে ভিড়ল তখন দেখা গেল সে কেবল আমাদের গল্প শোনার আকাঙক্ষাকেই তৃপ্ত করে না, জীবনের বিভিন্ন কোণ থেকে আলো ফেলে চিরপরিচিত জীবনকে নতুন আলোয় উদ্ভাসিত করে ।
শুনতে শুনতে বিদিশা যেন কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে... ভীষণভাবে মনে পড়ছে গোরার আনন্দময়ীর কথা । একজন সর্বাঙ্গসুন্দর মানুষ । জড়িয়ে আছেন সংসারে অথচ সমস্ত ঘটনার ওপর আলো বিকিরণ করে চলেছেন । মনের মধ্যে যেন ছাপ ফেলে ফেলে তাঁর চলন । হঠাৎ সে বলে ওঠে,
-আচ্ছা সায়ন তোমার কি মনে হয় না সমগ্র পশ্চিমী সাহিত্যে চরিত্রের ভালোত্বের ধারণা প্রায় অস্বাভাবিকতায় গড়ে ওঠে ? সেখানে চরিত্রগুলোকে ভালো হতে গেলে হয় বোকা, নয় রুগ্ন বা হাস্যকর হতে হয়েছে । যেন ভালোত্বের মূল্য দিতে হয়েছে স্বাস্থের বা বুদ্ধির !
-হ্যাঁ বিদিশা, এর বীজ লুকিয়ে আছে পশ্চিমী ঐতিহ্যের মধ্যে । অথচ ভারতীয় ঐতিহ্যে ঠিক উল্টোটাই দেখা যায় । বুদ্ধদেব বসুর মতটা তোমায় বলি,
"ভারতীয় ঐতিহ্যে ঐ গুণটিকে মনে হয় স্বাভাবিক কোনো উদ্ভাসের মতো, তার জন্য অর্ধাশনে থাকতে হয় না, অত্যধিক পড়তেও হয় না, ব্রহ্মচর্যেরও প্রয়োজন নেই - মানুষের মধ্যে মানুষের জীবন নিয়ে সম্পূর্ণভাবে বেঁচে থেকেও সম্পূর্ণভাবে ভালো হওয়া যায়, এই হলো ভারতীয় মনের মৌল বিশ্বাস ।"
তবে কি এই বিশ্বাসটিরই মূর্ত প্রতীক আনন্দময়ী ? তার ভালোত্ব যেন কোনো গুণ নয়, চরিত্রের অখন্ডতা নিয়ে সে বিরাজ করে । কোথাও কুন্ঠা নেই, কার্পণ্য নেই । আছে শুধু অনাবিল মুক্তির স্বাদ । বুদ্ধদেব বসু যর্থাথই বলেছেন, গোরার আনন্দময়ী রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠতম সত্তা । অর্থাৎ সব তর্কের পরপারে যেখানে রবীন্দ্রনাথ স্থির হয়ে আছেন সেখানেই যেন আনন্দময়ীর উপস্থিতি ধ্বনিত হয়েছে ।
একটা প্রাচীন বটের নীচে পা ছড়িয়ে বসেছে দুজনে । দূর থেকে ভেসে আসছে সুবিনয়ের গলা...
"আমার প্রাণের পরে চলে গেলো কে / বসন্তের বাতাসটুকুর মতো ।
সে যে ছুঁয়ে গেল, নুয়ে গেল রে- / ফুল ফুটিয়ে গেল শত শত"
মনে পড়ে গোটা উপন্যাস জুড়ে এক প্রবল পুরুষ গোরার উপস্থিতি । তার গম্ভীর স্বর যখন পাতার পর পাতায় গড়িয়ে যাচ্ছে , মনের মধ্যে ঝরে যায় এক ঝমঝম বৃষ্টি । অন্যমনস্কভাবে বসেছিল সায়ন । হঠাৎ বিদিশার আচ্ছন্ন স্বর বেজে ওঠে....
-রবীন্দ্রসাহিত্যে গোরার মতো চরিত্র বোধহয় আর নেই, না সায়ন ?
-শুধু রবীন্দ্রসাহিত্যে কেন ? আমার তো মনে হয় গোটা বাংলাসাহিত্যেই নেই । বু.ব. বলেন কি জানো, এর কারণটাও নিহিত আছে তত্কালিন বাঙালি চরিত্রের মধ্যে । ইংরেজশাসিত পঞ্জিকা পীড়িত বাংলা দেশে পুরুষরা যেখানে স্ত্রী আর মায়ের আঁচল ধরে জীবন কাটায় সেখানে পৌরুষের ক্ষেত্র সীমিত । তাই বাংলাসাহিত্যে নায়িকাদের পাশে পুরুষ চরিত্রগুলো শোচনীয় রূপে অযোগ্য ।
খিলখিল করে ছোট্ট মেয়ের মতো হেসে ওঠে বিদিশা । সায়ন একটু অবাক হয়ে তাকায়...
-বু.ব.-র রসবোধটা লক্ষ করেছো সায়ন ?
ধন্দ্ব কেটে সায়নও এবার বিদিশার হাসিতে প্রাণ খুলে যোগ দেয়, বলে,
-এই জন্যই তো বু.ব.-র আলোচনাগুলোও এত উপভোগ্য !
-এমনিতে উপন্যাস পড়তে যত ভালো লাগে তার আলোচনা পড়তে মোটেও তেমন ভালো লাগে না, কিন্তু বু.ব.-র আলোচনাগুলো পড়তে গিযে মনেই হয় না কোনো উপন্যাসের আলোচনা পড়ছি বলে ।
-গোরা কেন শেতাঙ্গতনয় সে সম্পর্কে বু.ব. কি বলেছেন জানো, "রবীন্দ্রনাথ গোরাকে শেতাঙ্গতনয় করেছেন শুধুমাত্র গল্প জমাবার জন্য নয়, তাঁর মনের তলায় এই কথাটা ছিল যে এই দার্ঢ্য, এই আত্মনির্ভর নির্ভয় শক্তি তাঁর সমসাময়িক বাঙালি পুরুষের চরিত্রলক্ষণ নয়"
-আচ্ছা সায়ন, তোমার কি মনে হয় না গোটা উপন্যাস জুড়ে আমরা বিনয়কে দেখি, কিন্তু তার দিকে তাকাই না ?
-কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যে তাকে সেভাবেই সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন । গোরা আর বিনয় সাহিত্যের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী চরিত্র । গোরার আত্মপ্রকাশের জন্য বিনয়কে ব্যক্তিত্বহীন আঁকতে হয়েছে ।
-হুঁ, তা অবশ্য বলা যায় । কিন্তু পরেশবাবুর চরিত্রটা কেমন যেন ম্রিয়মান, তাই না সায়ন ?
-হ্যাঁ, বু.ব.ও এই চরিত্রটা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন । যেভাবে রবীন্দ্রনাথ এই উদার ধার্মিক চরিত্রটা আঁকতে চেয়েছিলেন সেভাবে এগোয় নি । আর সেজন্যই শেষপর্যন্ত সে অতৃপ্তিই বহন করে ।
মনের মধ্যে কেমন একটা অলীক ভয় নিয়ে বিদিশা প্রশ্ন করে,
-দুজন নায়িকার কথা বললে না তো সায়ন ?
সায়ন কি উত্তর দিতে একটু সময় নিচ্ছে ? কিসের ভয় বিদিশার ? সায়নের মানসী চরিত্র কোনটা - ললিতা না সুচরিতা ? সেইখানেই কি দ্বন্দ্ব বিদিশার ? কিন্তু সায়ন বুঝি নির্বিকার ভাবে এড়িয়ে গেলো বিদিশার দ্বন্দ্বটুকু ! উত্তর দিলো,
-কেমন যেন একটা সুক্ষ্ম ভেদরেখা নিয়ে আঁকা হয়েছে দুটো নারী চরিত্র । একজন কলকল বেগে ঝরনার মতো বয়ে চলেছে । আর অন্যজন শান্ত দীঘির মতো অতল দৃষ্টি নিয়ে অপরূপ ভঙ্গিমায় প্রকাশিত ।
আরো একবার আশা নিয়ে বিদিশা প্রশ্ন করল,
-রবীন্দ্রসাহিত্যে কিন্তু বেশ অনেকেই সুচরিতার আদলে গড়া, তাই না সায়ন ?
কিন্তু সায়ন কিছুতেই ধরা দিলো না । আশ্চর্যভাবে এড়িয়ে গিয়ে বলল,
-হ্যাঁ, যোগাযোগের কুমু, শেষের কবিতার লাবণ্য এরা সকলেই এইদলে পড়ে । বু.ব. যর্থাথই বলেছেন, এরা "যেন কবি কিশোরের মানসী মূর্তি"।
গোরার শেষটা যেন এখনও বিদিশার বুকের মধ্যে ঝমঝম করে বাজে । যখন গোরা সারা মনপ্রাণ জুড়ে মুক্তির আকাঙক্ষায় উন্মুখ হয়ে উঠেছে ঠিক তখনই সে কৃষ্ণদয়ালের মুখে আপন জন্মবৃত্তান্ত শুনল । আর অদ্ভুদ এক মুক্তির আনন্দে উদ্বেল হয়ে উচ্চারণ করল, "আমি হিন্দু নই, আমি আজ ভারতবর্ষীয়"।
-জানো বিদিশা, এইখানটায় এসে একদা রবীন্দ্রবিরোধী নামে খ্যাত সেই বু.ব. আপ্লুত হয়েছিলেন প্রবল আবেগে, "গোরার শেষ পরিচ্ছদটিতে রবীন্দ্রনাথকেই প্রত্যক্ষ করলাম আমরা - মানবধর্মের মহৎ পূজারী রবীন্দ্রনাথ - আর দেখতে পেলাম ইতিহাসের বিচিত্র চিত্রপটে আঁকা তাঁরই ভারতবর্ষের মানসমূর্তি" ।
আচ্ছন্ন ভাবে কখন যেন পথে নেমেছে দুজনে । পাড়ি দেবে বুঝি উজানের পথে । শ্রবণের সীমায় তখনও বাজছে .......কণিকার শিষ্যার গলায় -- "দূরে কোথায় দূরে দূরে / আমার মন বেড়ায় গো ঘুরে ঘুরে"।
তথ্যঋণ : বুদ্ধদেব বসু