- কেন, ওই যে দশ হাজার নিলাম । করেসপন্ডেস কোর্সের জন্য । ওই কোর্সেই বি. এস. সি, এম. এস. সি । খেয়াল নেই তোমার ।
কথাটা মুকুন্দদার শিখিয়ে দেওয়া । বলেছিল এক মাধ্যমিকই লোকে যা মনে রাখে । আর তোমার তো অনার্স ছিলই অঙ্কে । বলেছিল, এম. এস. সি. প্রাইভেটেও দেওয়া যায়, বি. এস. সি করেসপন্ডেসে হয় না যদিও - তবু, এতসব খেয়াল রাখে না কেউ ।
নগেনবাবুর কথায় মানুষের একট জীবন দরকার । মানে বেঁচে থাকার একটা অবলম্বন । নেশাও বলতে পার । যেন মনে হবে এটাই আমার কাজ । বলেছিলেন, ম্যাট্রিক পাশ করার পর ঠিক কি যেন করা উচিত তোমার বাবা বুঝে উঠতে পারেনি । তখনকার দিনে এত ভাল রেজাল্ট - অথচ চাকরি নিল সেই শেষ বয়সে -প্রাইমারি মাস্টারি । মানে হয় কোনও ?
পার্টি করি কিনা জানতে চেয়েছিলেন । উত্তর শুনে অবাক । বললেন, তাহলে কর কি ? টিউশনি ? গান ? নাটক বা অন্যকিছু ?
না । কিছুই না । স্রেফ খাই আর ঘুরে বেড়াই । সকাল হলে অনিতদার দোকান । খবরের কাগজ, খেলা বা রাজনীতি বা সিনেমা নিয়ে হৈ চৈ বা স্রেফ গল্পই । দুপুরে বাড়ি ফেরা । ঘুম । ফের সাইকেল নিয়ে বেরোনো ।
নগেনবাবু ফ্রি খুব । জানতে চেয়েছিলেন, প্রেম ট্রেম আছে ? মানে কোনও মেয়ে -?
হাসতে হয়েছিল । বলেছিলাম, `না' ।
যাওয়ার আগে নিজের ঠিকানা দিয়ে দেখা করতে বলে গেলেন ।
দশ হাজারের কথা শুনে সেজকাকু তো মাথায় হাত প্রথমে । বলতে হল, বি. এস. সি করা থাকলে নগেনবাবু করে দেবেন কিছু একটা, বললেন তো উনি । আর এখন করেসপন্ডেস কোর্স ছাড়া -। সেই তখন জানা গেল, ব্যাঙ্কে টাকা আছে সেজকাকুর । লক্ষ্মীর বিয়ের জন্য নাকি রাখা ।
জানতে চেয়েছিল, চাকরি পেলে সংসারে টাকা পাঠাবি তো মাসে মাসে ? লক্ষ্মীর বিয়ের সময় পাবো তো কিছু ?
শেষ চিঠিতে সেজকাকু জানিয়েছেন, মানিককেই ভাড়া দেওয়া হয়েছে পুবের ঘর । মাসে হাজার । সেলামীও দিয়েছে কিছু । লক্ষ্মীর বিয়ের জন্য অন্তত হাজার দশের চেষ্টা করতে বলেছে । মায়ের ছবির কথা লিখলাম । বললাম, থাকলে সিন্দুকের মধ্যেই রেখে দেবে । অতিরিক্ত টাকার ব্যাপারটা মাথায় আছে আমার, জানালাম ।
পুজোয় এমনিতে কিছু টাকা বেশিই পাঠাই । জামাকাপড়ের জন্য । তেমন করে বলতে গেলে, এসব কিন্তু কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে । ছোটবেলা থেকে এই লোকটাই খাইয়েছে আমাকে, যতটুকুই হোক লেখাপড়া শিখিয়েছে । বলত, দাদা যদি ফিরে আসে কোনওদিন, বলতে তো পারবো-।
একবার মনে হয়েছিল, বরং বিহারের দিক থেকে ঘুরে আসি । স্কুলের অনেকেই যাচ্ছে অনেক জায়গায় । সত্যদারা দার্জিলিং । ওরা বলেছিল খুব । বিপিন অবশ্য যাচ্ছে না কোথাও । বলল, আমাদের কি যাওয়ার সুযোগ আছে আর ? মাথার উপর দিদি একজন নীচে দু'দুটো বোন । বাড়িতে সাতজন লোক । শুধুমাত্র বিপিনের মুখের দিকে তাকিয়ে বাকি ছয়জন । বিপিন অবশ্য টিউশনি শুরু করেছে । বলল, একবার ছোট ক্লাস শুরু করলে পরে বড় ক্লাস পাওয়া যায় না আর । বিপিন এগারো-বারো ক্লাসের ছেলে ছাড়া পড়ায় না ।
বিসর্জনের দিন লাবণ্যের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল হঠাৎ । ছাদের বাইরে এই প্রথম । বারোমন্দির ঘাটেই । এখানে প্রতিমা বিসর্জন চলে সেই আগেকার ঢঙেই । নৌকো করে ঠাকুর । একবার ডানদিক একবার বাঁদিক গিয়ে, মানে বেশ কয়েকবার ঘাটের পাশ দিয়ে যাওয়া আসা করে শেষ পর্যন্ত সেই ঘাটের কাছে এসেই দাঁড়াবে । ঘাটের কাছেই বিসর্জন যাবে প্রতিমা । এই একটি দিন দেশলাই আর সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে দাঁড়াই । পাশাপাশি তিনটে ক্লাব । তিনটেই পুরনো । একই রীতিতে বিসর্জন । বাজির আড়ম্বর নিয়ে একটু প্রতিযোগিতা চলে যেন । নৌকো থেকে ছুঁড়ে দেওয়া জল বোম । হাউই । কোনওটা উপরে গিয়ে মালা হয়ে যাচ্ছে - লাল, নীল, সবুজ আলো জ্বলছে । কোনওটা বা থাকছে অনেকক্ষণ । সবুজ বা লাল আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে একেবারে ।
নৌকো থেকে ছুঁড়ে দেওয়া জল বোমার প্রচন্ড আওয়াজ আর ছিটকে আসা জলের ঝাপটায় চমকে উঠে নীচে তাকাতেই মনে হল, লাবণ্য । নীচের ধাপে দাঁড়িয়ে । ভীড় ছাড়িয়ে । একা । একটি মেয়ের হাত ধরে । সম্ভবত ওর মেয়েই । ডাকলাম । যেন শুনতেই পায়নি । বা বুঝতে পারেনি কিছু । একবার ঘাড় ফেরাবার মতো করেই ফের সেই ঘাটের দিকে ।
বললাম, লাবণ্য -।
লিপিই মায়ের হয়ে উত্তর দিল । বলল, মা, মাস্টারমশাই, সমীরণ কাকু -।
- ও - ।
- তুমি চেন সমীরণকাকুকে ?
লিপি জিজ্ঞেস করল ওর মাকে । লাবণ্য তাকালো একবার ।
বললাম, চিনবে না কেন ? উত্তর জানা ছিল, তবু জানতে চাইলাম, গান গাইবে না কাল ?
তার মানে, বিজয়া সম্মিলনীতে । লাবণ্য তাকাল একবার মেয়ের দিকে ।
- না ।
- কেন, গতবার ভালই তো গাইলে- মনে আছে আমার, রবীন্দ্রসঙ্গীত ।
পাশের পাড়ার প্রতিমা ফিরছে । আমাদেরটা এখনও বেশ দূরে । ত্রক্রমে ছোট লাগছে বেশ । হ্যাজাকের আলোয় নাচতে থাকা দুটো একটা শরীর তবু চোখে পড়ছে এখনও ।
লিপি বলল, কাল আসবে আমাদের বাড়ি ? সকালে ।
লাবণ্য অবাক হল খুব । এ কি ? উনি কি তোর সমবয়সী ? `তুমি' বলছো ?
লিপি মুষড়ে পড়ল যেন । এখন ভাঁটা চলছে । একটু আগেই শুরু হল । জল এখন ত্রক্রমে নামবে । উপর থেকে নীচের সিঁড়ি পর্যন্ত প্রায় সব চোখই এখন নদীর দিকে । গল্প করছে কেউ, পাশাপাশি দু-একজনের সঙ্গেই । মাইক বাজছে ঘাটে । চাতালের উপর নাচছে বেশ ক'জন । রঙের আলো নিভছে জ্বলছে । কোন সিনেমার গান কে জানে ? উপরে পুলিশও আছে দু-চারজন ।
ঠাকুর বিসর্জনের জন্য অপেক্ষা না করে চলে আসব বলে, লিপিকে বললাম, চলে যাচ্ছি -হ্যাঁ- । মেয়েটা তাকাল একবার । ওর মাকেও দেখল । লাবণ্য যেন গ্রাহ্যই করল না কথাটা । বলল, ঠিক আছে ।
ঘাট ছাড়িয়ে মন্দিরের বাইরের চত্বরে এসে দাঁড়াই । সিগারেট বের করি । একটা সিংহের লেজের কংক্রিট খসে গেছে । লোহার রড বেরিয়ে । কোমরের ঢেউ এখন অবশ্য অটুট । প্রায় নিখুঁতই । রাজকীয় সৌন্দর্য্যই । অল্পবয়সী দুটো ছেলে নিমগাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে করছে কিছু একটা । আগুন জ্বলল না ? তার মানে সিগারেট । বাচ্চা একটা মেয়ে বাবার হাত ধরে যাচ্ছে । ঘাটের দিকেই । কী মনে করে দাঁড়িয়ে পড়ল কে জানে ? বাবাকে দেখাচ্ছে কিছু । বাচ্চাই । বড়জোর ফাইভ কি সিক্সের । সাধারণ ফ্রক একটা । হেয়ার ব্যান্ড । হাঁটু অব্দি উঠে আসা সোজা । শ্বেতপাথরের সেই মেয়েটার দিকে তাকিয়ে । বাবাও । কী দেখছে মেয়েটা ? ওর নিজের বয়সীই একজন । কী জানতে চাইছে ? এক-পা, দু-পা করে ওদের পাশে গিয়ে দাঁড়াই । বুঝতে দিই না কিছু । যেন যাচ্ছি, বাড়িই ফিরছি, একটু হয়ত ক্লান্তই, গতি কিছু শ্লথ আমার ।
- কী সুন্দর না বাবা ?
ভাস্কর্য্যের রীতিতে টানা চোখ দুটোর মণির জায়গা ফাঁকা । শ্বেতপাথরের শূন্যতা শুধু । আর নীচের দিক থেকে উঠে আসা লতানো গাছটি মেয়েটির লজ্জা ঢাকার চেষ্টায় ।
ভদ্রলোক হাত ধরে টানছেন মেয়েকে । একবার ঘাড় ফিরিয়ে দেখলেন যেন আমাকে । `চল'-, বলে ধমকালেন । একটু দূরেই জলবোম । জলবোমের বিস্ফোরণ । শব্দ জলের ছিটকে আসা । আকাশময় রঙ - সবুজ, হলুদ, লাল । রঙের সেই নেমে আসা ।
মেয়েটি জানতে চাইছে, ও কি উড়ে যাবে বাবা ?
বিজয়ার সকালটা পছন্দসই ছিল খুব । পালপুকুর দেশবন্ধু কলোনিতে থাকতে ঘুম থেকে উঠে মাকে প্রণাম করতে যেতাম । ছবিতেই । ছেলেবেলার কথা ভাবলে, ওই একটি দিনই । ওই একটা দিনই মাকে তাকিয়ে দেখতাম । মুহূর্তের জন্যই অবশ্য । এরপর বাবা, সেজকাকু, সেজকাকিমা । বাড়ি ছেড়ে পাড়ায় । হরিশ, দিপেন, রতনদের বাড়ি । ওরাও আসত দলবেঁধে । সেজকাকু কিনে আনত বোঁদে । আগের রাত্রের সেই লাল, হলুদ, কমলা রঙের দানা । সেজকাকি নিমকি তৈরি করত - হলুদ, কোনটা বা বেশি পুড়ে গিয়ে কালচে । চৌকোনা । অনেকটা জ্যামিতির রম্বসের মতো, চ্যাপ্টা করা চতুর্ভুজ ।
শেষ যেবার দাদুকে প্রণাম করি, দাদু তখন বিছানায় । গন্ধ হয়েছিল খুব । যতদূর মনে পড়ে, যেতে চাইনি কিছুতেই । সেজকাকি ধমকেছিল । কি বলেছিল অবশ্য মনে পড়ছে না, হয়ত বলেছিল, বছরের একটা মাত্র দিন - তোকে ভালোবাসে এত- । এটা ঠিকই ঘোলাটে চোখের সে বুড়ো আমাকে ভালবাসত খুব । লোকটার যা কিছু ঝামেলা ছিল যেন আমাকে নিয়েই । সেজকাকির কথায় আমাকে নাকি কেউ বকতেও পারত না একটু । বাবাও না । বাইরের ছেলেদের ওপর রাগের কারণটা ছিল আমার খারাপ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নিয়েই ।
অবিনাশ বসতে বলল । বিজয়ার পরদিন সকালে ঘরে ঢুকতে দেখে আসার উদ্দেশ্যটা অবিনাশের না বোঝার কথা নয় । তুলি এল । জানতে চাইলাম, পুজো কাটল কিরকম ? একটু রহস্য করেই অবশ্য । অবিনাশ তখন বাইরে । মলির জন্য ভয় করছিল খুব । ওকে না দেখতে পেলেই খুশি হব যেন ।
তুলি বলল, দিদি রান্নাঘরে ।
অবিনাশ এসে তুলিকে বাইরে যেতে বলল একটু । বলল, কাগজ পড়েছেন ?
- না, আমার ঘরে দেয়নি তো এখনও ।
- আমেরিকার ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছেন ? জাস্ট তেলের জন্য -। আফগানিস্তান হয়ে ইরাক এবার দেখবেন -।
এরপর দরজার দিকে তাকিয়ে আড়চোখে কাছে ডাকল একটু । গেলাম । বলল, লাবণ্যের সঙ্গে দেখা হল কখন ?
- তার মানে ?
লোকটা এরপর আমার জামার কলারের গা থেকে কী একটা টেনে বের করল । চুল । লম্বা । মেয়েদেরই ।
অবিনাশ বলল, আমি ঠিক এই কথাটাই বলতে চাইছিলাম । একটু জড়িয়ে টড়িয়ে ধরলে একটা আধটা চুল অন্তত- ।
- কিন্তু, এটা তো- ।
অবিনাশ বলল, এতেই চলবে । লোকটা বলছিল, একটা অন্তত চুল হলেই -।
- কিন্তু এটা তো- মানে লাবণ্যর নাও হতে পারে-।
- কেন, আর কেউ আছে নাকি আপনার ? লাবণ্যের সঙ্গে দেখা হয়েছিল তো কাল ?
সায় দিতে হল । দরজার পাশে শব্দ শুনে বুঝি দাঁড়িয়ে আছে কেউ । নির্ঘাত কান রেখেছে । তুলিই হবে । ভাবছে, ওকে নিয়ে কথা হচ্ছে কিছু । অবিনাশের বউ পাশের খাটে শুয়ে । এখনও সুস্থ হয়নি পুরো । ক্লান্তা । খাওয়ার ইচ্ছে নাকি মরে গেছে । অবিনাশ চুলটা নিয়ে দেখাল ওকে । ভদ্রমহিলা আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন একটু । সত্যিই ম্লান । আর ক্লান্তও । মাথার উপর পাখাটা ঘুরছে তখনও । ঠান্ডা নামছে । বললাম, স্পিডটা বাড়িয়ে দিতে পার একটু । অবিনাশ শুনল কিনা কে জানে ? ও তখন স্টিলের আলমারিতে চাবি লাগাচ্ছে ।
বেরিয়ে আসছি, দেখি, মলি । বললাম, দেখ তো কাগজটা দিয়েছে নাকি উপরে -।
আসলে ওকে কথাটা বলতে চাইছিলাম । যদিও এসবে কোনও বিশ্বাস নেই আমার । বাবারও ছিল না কোনওদিন । এমনকি বাড়ির লক্ষ্মী বা সরস্বতী পুজোর ব্যাপারেও বাবার আগ্রহ দেখিনি কোনও কালে ।
তখনও কাগজ না দেওয়ার খবরটা নিয়ে মলি যখন নামছে, আমি তখন একটু এগিয়ে । মলিই জিজ্ঞেস করল প্রথম, বাবা কি বলছিল ?
- কেন ?
- তুলি বলল । বলল, খারাপ কিছুই হবে ।
- খারাপ মানে ?
- তুলি বলল, মেয়ে-টেয়ে নিয়ে কোনও ব্যাপার ।
বললাম সেদিন কত করে বারণ করলাম, তোমার জন্যই চলে যেতে হবে আমাকে, জামার গায়ে মেয়েদের চুল পেয়েছে একটা ।
- চুল ?
হাসল মলি ।
- তাতে কি ?
- কি আবার, জানতে চাইল, মেয়েদের চুল কেন ?
অবিনাশ বলল, লুচি ভেজেছে মেয়েরা, খেয়ে যেতে হবে কিছু ।
লিপি সত্যিই এলো না । সুশান্ত-অয়নরা হৈ চৈ করল খুব । অনুষ্ঠানটা প্রায় ওদেরই । বাপ্টুর বাবা মঞ্চে বসেছিল । ডাকলও আমাকে । সিদ্ধার্থ বলল এসে । হাত নেড়ে না করলাম । ভীড়ের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতেই ভাল লাগে খুব । যেখানে আমাকে লক্ষ্য করছে না কেউ, কোনও চোখ বা আঙুল তুলে একজন কোনও আরেকজনের কাছে জানতেও চাইবে না, কে রে লোকটা ?
প্রায় শ'খানেক চেয়ার । গান গাইল পাড়ার ছেলেমেয়েরাই । আবৃত্তি । নাচ । বাপ্টুর বাবা ছোটখাটো বক্তৃতা দিল একটা । মৈত্রী আর ভালবাসার কথা বলল । ফের সামনের বছর সবার সঙ্গে মিলিত হওয়ার আশা প্রকাশ করল ।
মিলি রায় নামের একটা মেয়ে চমত্কার গান গাইল একটা । আধুনিক বাংলা । লতার । গান শেষ হওয়ার পর সুশান্ত-অয়নদের বয়সী ছেলেদের সে কি হাততালি । `আর একটা -আর একটা-' করে কি চিত্কার । মেয়েটার মুখ চোখ তখন লাল । স্টেজ ছেড়ে যেন পালাবে । ওর চুড়িদারের তখন কি অদ্ভুত রঙ । যেন লাল বা কমলা নয় । অন্য কিছু । আর কপালের উপর একপাশের চুল যেন নেমেই আসবে । হারমোনিয়ামের রিডের উপর রাখা আঙুল যেন পালকের মতো হালকা তখন । আর যখন তাকাল একবার, হারমোনিয়ামে বেলো করতে করতে, যখন চোখ মেলল, সবাই একেবারে চুপ তখন । সুশান্ত, অয়ন, অনিমেষ । এরপর যখন স্কুলে যাবে মিলি, ওদের কেউ নির্ঘাত গাইবে গানটা, ও আমার ময়না রে -। মিলি হয়ত বলবে, অসভ্য । অবশ্য তাকাবেও একবার । দেখবে সুশান্ত বা অয়নকে ।
লাবণ্যকে বললাম, বাধা দিচ্ছ কেন এরকম ?
- কাকে ?
- অবিনাশকে । এটা ভেঙে নতুন একটা বাড়ি হলে- ।
এতসব শোনা হয়ে গেছে আপনার ? কিন্তু ও তো তুলে দিতে চাইছে, ও বলতে চাইছে আমি কেউ নয় -। আমি, লিপি - ।
বললাম, তাতে কী ? প্রমাণ নেই তোমার, মানে তুমি যে -।
লাবণ্য উঠতে বলল । চিলেকোঠা ছাড়িয়ে বাইরে আসতে বলল একবার । দেখতে বলল চারপাশটা ।
- কি দেখছেন ?
- কেন বাড়ি, ছাদ, দেওয়াল ।
- আর ?
- আর কি ?
- বাড়িগুলির অবস্থা দেখতে পাচ্ছেন না ?
- হ্যাঁ -।
- কতটা জায়গা দেখতে পাচ্ছেন ? ডানদিক বাঁদিকের পুকুর । জঙ্গল । আর ওই পুজামন্ডপ- ওখানে পুজো হত কিন্তু- মোষ বলি হত ।
- তাই ?
লাবণ্যের কথায় এসব সে দেখেনি । শুনেছে শুধু । গোটা বাড়িতে এই মুহূর্তে সবচেয়ে সচ্ছল আর নামওয়ালা লোকের নাম জিজ্ঞেস করল । জানি কিনা জানতে চাইল ।
পুজোর কদিন ছাড় দিয়ে বৃষ্টি ফের নামবে বলে ঠিক করছে । কালো আর বেশ বড় আকারের দলা পাকানো মেঘ । ভাল করে না দেখলে অবশ্য আসছে না যাচ্ছে বোঝা মুশকিল । পুবদিকের দুটো একটা তারার কথা ছেড়ে দিলে আকাশের কোথাও আর আলোর চিহ্নমাত্র নেই । কালো ধুমসো আকারের মেঘটা চাঁদটাকে খেয়ে নিয়েছে পুরোপুরি । এখন তার মানে অনেকটা সময় অপেক্ষা করতে হবে ।
- ব্যানার্জি বাড়ির সবচেয়ে রেপুটেড পার্সন এখন অবিনাশ -মানে আপনার মালিক । এই হল ব্যানার্জি বাড়ির এখনকার হাল । বড় তরফের দুই ছেলের পান-বিড়ি-সিগারেটের গুমটি । সেজ তরফের একজনের টেলারিং-এর দোকান । দেখেছেন ?
- না । এতসব জানিই না অবশ্য । তোমার স্বামী কি করত ?
- কিছুই না । চেহারার অ্যাসেট নিয়ে চিট করত । ঠকাতো মানুষকে । আমাকেও ঠকিয়েছিল লোকটা । আমিও হয়তো ভাল নয়, কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি ওকে ঠকাইনি কখনও -। ও কিন্তু বিয়ের বছর খানেক ছেড়ে - থাক্ ।
বললাম, কি যা-তা বলছ ?
- সত্যি যা তাই । বিয়ের বছর দুয়েক পর নিজের অজ্ঞাতসারে যে রোগ নিয়ে এল, আর আমাকেও- ।
রাত এখন বড়জোর সাড়ে-সাত । গরমকাল হলে সন্ধ্যেই বলা যেত । আসলে দিন ছোট হচ্ছে এখন । ব্যানার্জিবাড়ির ছাদে সময় যেন মন্থর খুব । আর ভারীও । কথা এখানে যেন গড়ায় । বা থামেও হঠাৎ । যেন প্রতি মুহূর্তেই কোনদিকে যে সে যাবে ঠিক করে উঠতে পারে না ।
- আমি কিন্তু সত্যিই বাজে মেয়ে- মানে অবিনাশ যেমন বলে- ।
- কী বাজে বকছ ? কে শুনতে চাইছে এসব ?
লাবণ্য কাঁদেনি একটুও । বা নিজেকে দয়ার পাত্রীও করতে চায়নি । বলল, রক্তে দোষ আছে আমার । অসুখ । আমি জানি ।
- চিকিত্সা করাওনি কেন ?
- লাভ নেই-।
আমরা হাঁটছিলাম । অল্প বাতাসে প্রেমিক-প্রেমিকার মতোই । দূরে নদী । যেখানে দাঁড়ালে ঢেউগুলি দেখা যায়, আমরা এখন ঠিক সেখানেই ।
লাবণ্য বলল, আমি মৃত্যু ভালবাসি বিশ্বাস করুন- । মৃত্যু নিশ্চিত জেনে যখন একটা লোক আপ্রাণ বাঁচার চেষ্টা করছে, দেখেছেন কোনওদিন ? শরীর পচে যাচ্ছে । হাত-পা-মুখ, দেখেছেন ? রক্ত পুঁজ বেরিয়ে আসছে । তবু একটা লোক ভাবছে, সে বেঁচে যাবে- কি হাস্যকর আর অদ্ভুত ভাবুন- ।
বলল, এ বাড়িতে নতুন করে কাউকে কিছু করতে দেব না । পারবেও না অবশ্য- কাগজই নেই কোনও । শুক্রবার ওদের ছাদে গিয়েছিলাম কিনা জানতে চাইল লাবণ্য । বলল, ঘরে গেস্ট ছিল । কে যেন ধাক্কা দিয়েছিল দরজায়, খুব ভয় পেয়েছে নাকি কেউ । বলল, একটা উপকার করবেন আমার ? আমি বিশ্বাস করি আপনাকে । আমি জানি আপনি- আপনি আর পাঁচজনের মত নয় । লাবণ্য বলল, লিপিকে নিয়ে নিন আপনি । নেবেন ? ওর কিন্তু রোগ নেই কোনও -। লাবণ্য বলল, আপনি ভালবাসতে পারেন ওকে, আপনি ওকে যা খুশী-, ওর দাবিদার নেই কোনও ।
মাঝে মধ্যে সেই নাগবাবুর কথা মনে পড়ে আমার । ছোটবেলার স্কুলের সেই হেডস্যার । সেই লম্বা, গৌরবর্ণ সোজা হয়ে হাঁটা শরীর । উনি কি সত্যিই বিশ্বাস করতেন ? আসবে কেউ । ছুটির মধ্যে । সেই শব্দ কি উনি শুনতে পেতেন ? এখনও সেই ছেলেবেলার মতো এক একটা রাত্রে মনে হয় জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেই কিছু একটা চোখে পড়বে ঠিক । হয়ত আকাশজুড়ে দীপমালার মতো কিছু । অসংখ্য বিমান । হেলিকপ্টার । বা বিশাল আকারের কিছু । হয়ত সারাটা আকাশ জুড়েই । গমগম করা শব্দে সবাই জেগে উঠবে ঠিক । জানালায় চোখ রেখে দেখাবে অন্যকে । ছাদে গিয়ে দাঁড়াবে । আকাশে চোখ রেখে অবাক হবে । মনে হয়, সত্যি, কোনওদিন ঘুম ভাঙার পর যদি দেখি রাত্রি তখনও আছে, যেন এক্ষুনি উড়তে থাকা কাগজ জানালা গলে এসে বিছানায় পড়বে, ফটোগ্রাফ থাকবে কারুর, কোনও অচেনা হয়ে যাওয়া মুখ- চিনতে পারব ? চিনতে পারব এখন ? মেলাব কিভাবে ? কিছু মিল নাকি থাকেই । চোখ,মুখ, ঠোঁট, কপাল আর অসংখ্য রেখা আর বিন্দুর কিছু নাকি ঠিকই থেকে যায় । নগেনবাবু বলেছিলেন একদিন, তোমাকে দেখে তো ভুলই হয়ে যায় । যেন, সুধন- সুধনই । বলছিলেন, প্রথম দিন তোমাকে দেখে তো থ,যদিও বলিনি কিছু । ওর কথায় যেন আমি নয়, আমার বাবা । সমীরণ নয়, সুধন । নগেনবাবুর কথায় আমার হাঁটার ধরনটাও নাকি ঠিক বাবার মতোই । পেছন থেকে দেখলে যে কেউ ভুল করত ।
ওই দশ বছর বয়স পর্যন্ত বাবা মাকে নিয়ে আমাকে কোনওদিন কিছু বলেছে বলে মনে করতে পারি না । মনে পড়েওনি কিছু । শুধু পুবের ঘরের টেবিলের পাশে বেড়ার গায়ে লটকে রাখা ছবিটাই । কোথায় তুলেছিল কে জানে ? কোনও দোকানে ? নাকি অন্য কেউ, অন্য কোনও হাতের ? নাকি বাবা ?
সেজকাকু লিখেছিল, শিওয়ান ছাড়িয়ে কিছুদূর যাওয়ার পরই । ট্রেনটা কি থেমেছিল কোনও কারণে ? যেমন থামে কোনও সময় ? সামনে লাল আলো, জানালা থেকে মুখ বাড়িয়ে দেখতে পাওয়া রেললাইন - বেঁকে যাওয়া, বেঁকে হারিয়ে যাওয়া । দূরে কোনও টিলার পিছনে আকাশটা যেখানে নামে । বা গমক্ষেত, কি জোয়ার কি বাজরা । দূরে বট কি অশ্বথ্থ । একটা দুটো ঘর । কোনও লোক, অস্পষ্ট শরীর । আর রেললাইনের গা ঘেঁষে অপেক্ষা করতে থাকা কোনও ট্রেকার । অধৈর্য্য কেউ । লোকটা নাকি ডেকে উঠেছিল, সুধনদা- । ট্রেকারে বসে থাকা বা ট্রেকার ছেড়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কেউ নাকি ঘাড় ফিরিয়েছিল । দেখেছিল একবার । এরপর সেই টিলা । আর খেত জমি আর অশ্বথ্থ কি বটগাছের ছবি পড়ে থাকে কোথাও । সেই ট্রেকার নিশ্চয়ই ছাড়ে একসময় । আর যায়ও কোথাও ।
লাবণ্য মৃত্যু ভালবাসে । এটা হয়ত অভিমানের কথাই । মেয়েরা বলে এমন । সেজকাকিও মৃত্যুর কথা বলত খুব । সুবল বা সেজকাকুর উপর রেগে গিয়ে বলত । কবে যে মরব আমি - কবে যে ভগবান নেবে আমাকে -। তুলি সেদিন বলল, আর বেশিদিন নেই দেখবেন, ছাদটা কোনদিন পড়বে হুড়মুড় করে ।
ছাদের একটা দিক অবশ্য ভাঙাই । অবিনাশের কথায় অবশ্য এসব পুরনো আমলের কাজ, ভাঙবে না সহজে । তবে ঠিক করতে নাকি অনেক পয়সা - । এত পয়সা ওর নেই । এই মুহূর্তে বড়জোর তিনটে ঘর । একতলার দুটো, দোতলায় একটা । ব্যস । তুলি নাকি সুযোগ পেলেই পালাবে । বলল, সম্ভবত সামনের পুজোর আগেই । মলি সহ্য করতে পারে না অবিনাশকে, বলল, এখানে অল্প ভাড়ায় থাকতে আসবে এখানে ? ওর জন্য অবিনাশ আর কোথায় চেষ্টা করছে কে জানে ? সেদিনের পর অবশ্য অনেকদিন হল আর আসছে না মলি । ওপরেই ওঠেনি আর । এমনকি কাগজ নিতেও নয় । অবিনাশই উঠে আসে । দরজার বাইরে থেকে জিজ্ঞেস করে জানতে চায়, কি লিখল আজ ? বা আগের দিনের হয়ে যাওয়া কোনও খুনের কথা জিজ্ঞেস করে জানতে চায়, ধরা পড়ল কেউ ? পড়েনি ? আর পড়বেও না ।
অবিনাশ ভেতরে ভেতরে কোথাও ভাঙছে যেন । ইস্কুলের ব্যাপারে জানতে চাইলাম সেদিন । নগেনবাবু আর নির্মলবাবুর ব্যাপার নিয়েই । বলল, ভাল লাগে না আর । ওর কথায়, আর চার পাঁচটা বছর - কোনওমতে বাড়িঘর ঠিক করার ব্যবস্থাটা করতে পারলেই যা শান্তি - । এরপর নাকি দুজনে মিলে শুয়ে বসে থাকা ।
- শুয়ে বসে থাকা মানে ?
- মানে, বাকিটা জীবন -।
দুই মেয়ের বিয়ে দিতে পারলেই নিশ্চিন্ত । রামরাজাতলার সেই তান্ত্রিক কি করল কে জানে ? হয়ত কোনও মাদুলি বা কবহ বানাবে । মলিকে কি বলব ? তান্ত্রিকের কথা ? ওর ভালর জন্যই । মানে, অবিনাশ যে ওদের কথা ভেবে উদ্বিগ্ন খুব । ওর বিয়ের জন্য বাড়ির দখল পাওয়াটা কত জরুরি । অন্তত অবিনাশের কাছে ।
মলি বলছিল সেদিন, ও নাকি একদ্ম সহ্য করতে পারে না ওর বাবাকে, এমনকি মাকেও । এই বাড়ির গন্ধটাকেই অসহ্য ঠেকে ওর । লোনা ধরা ইট, শ্যাওলা, শ্যাওলার গুঁড়ো, ও নাকি আঙুল দিয়ে ঘষে দেখছে মাঝেমধ্যে । জিজ্ঞেস করছিল একদিন, এত ভয় কিসের আপনার ?
- ভয় ?
- হ্যাঁ- যেন কেউ তাড়া করে বেড়াচ্ছে আপনাকে ।
জানতে চেয়েছিল, লাবণ্য কি সত্যিই সুন্দরী ? ও কি সত্যিই ভাল ?
লাবণ্যর সম্বন্ধে নাকি অনেক কথা জানে ও । ওদের ফ্যামিলির কেচ্ছা নাকি অনেক । বললাম, একই তো ফ্যামিলি- । আসলে থামাতে চাইছিলাম মলিকে ।
- আমি কি ভাল বলছি নাকি আমাদের ফ্যামিলিকে ?
মলি মাঝে মাঝে এত চমত্কার কথা বলে, বলল, বাড়িটার মতোই, শুধু ছাদটাই টিকে আছে যা, দেখছেন না, নীচের দিক থেকে কেমন ভাঙছে- লাবণ্যর কথা শুনে বোঝেন না কিছু ?
স্কুলে ঢোকার আগে সার্টিফিকেটের ব্যাপারটা নিয়ে ভয়ের কোনও অনুভূতিই ছিল না আলাদা করে । তখন অন্য একটা জীবন শুরুর রোমাঞ্চই যেন । বা নগেনবাবুর ব্যবহারও হতে পারে । উনি কিন্তু দশ হাজার টাকার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আমার উপরই ছেড়ে দিলেন । পরে বলেছেন একদিন, আসলে কিছু পেতে গেলে কিছু দেওয়ার অভ্যাসটা বোঝাবার জন্যই । ওর কথায়, এটা এমন কোনও অপরাধ নয় । অসংখ্য আছে এমন । ওর কথায়, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়েই ভুরিভুরি । আর এ তো স্কুল । আর, তুমি তো অনার্স পর্যন্ত পড়েছই ।
প্রথম প্রথম ভাবতাম, যদি জিজ্ঞেস করে কেউ আলাদা করে, কত পার্সেন্ট ছিল অনার্সে । মুকুন্দদার মার্কশিটে মাত্র একান্ন পার্সেন্ট । মার্কস সাধারণই । ওর কথায়, গড় থাকাটাই হল সন্দেহের বাইরে থাকার সহজ রাস্তা । সাধারণ । যা যে কেউ হতে পারে । নগেনবাবুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমাদের স্কুলে- মানে এই হরনাথেই আছে আর কেউ ? ওর কথায় এসব বলা যায় না । তবে ক্ষতি হচ্ছে না কোনও । আর এত সমস্ত কিছুর পেছনে কী যে আছে ঠিক- আমার প্রতি ভদ্রলোকের কোনও এক ধরনের, নাকি বাবার প্রতি ভালবাসা, বুঝে উঠতে পারি না । একেক দিন হঠাৎ করেই স্কুলে আসবেন, আমাকে ডেকে পাঠিয়ে বলবেন, যেতে পার তো মাঝেমধ্যে -।
- পাবো কিনা ঠিক নেই -।
- আমাকে ?
- তাই তো, কখন কোথায় থাকবেন ঠিক আছে কিছু ? পিসিমাই তো বলেন ।
ওর কাছে আমি যেন ছোটই থেকে গেছি । নগেনবাবুর কথায় বাবার নাকি মাস্টারি নিয়ে একটা গোঁ-ই ছিল । অন্য কিছু করবে না কিছুতেই । এই আশ্রম সেই আশ্রমের কাজে গাঁ গঞ্জে ঘোরাটাই ছিল নাকি নেশা । আশ্রম মানে ধর্র্মের নয় অবশ্য । হরেক সেবা প্রতিষ্ঠান । তখন ছিল নাকি এরকম অনেক । কাজও করত তারা । গ্রামের লোকদের মৌমাছি পালন, মুরগির ব্যবসা বা পঞ্চায়েতিরাজের কাজকর্ম শেখানো । আর সময়ে অসময়ে ছোট ছেলেমেয়ে বা বয়স্ক লোকদের নিয়ে বসা । অক্ষর শেখানো ।
আমার মধ্যে নাকি উত্তরাধিকার আছে । থাকেই নগেনবাবুর ধারণায়, অনেক লোকের তুলনায় ইস্কুল মাস্টারিতে আমারই সফল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি । আর উনি নাকি খোঁজ নিয়ে দেখেছেনও । ছেলেরা নাকি আমাকে পছন্দ করে খুব ।
ছেলেটার নাম মনে পড়ল একেবারে শেষ মুহূর্তে । প্রসূন রাজবংশী । নামটা সুন্দর না ? সুন্দর মানে ওদের পারিবারিক অবস্থার তুলনায় অন্যরকম । ওর বাবার মাছের ব্যবসা । ব্যবসা শব্দটা শুনতে যেরকম ঠিক সেরকম নয় অবশ্য । ওর কথায়, বাবা ভোররাতে বেরোয়- দলবেঁধেই, মানে আরও অনেক ব্যাপারীদের সঙ্গে হাওড়ার হাট থেকে ম্যাটাডোরে শ্যামপুর - ওখান থেকে শ্যামপুর বাজার, মানে মাছ নিয়ে বসা । এসব অবশ্য পরে জিজ্ঞেস করে জেনে নেওয়া ।
ছেলেটা সেদিন বৃষ্টি দেখছিল । মাথা নীচু করে যেন বৃষ্টির সঙ্গে কথাই বলছিল । খোলা দরজা দিয়ে জলের ছাঁট আসছিল খুব । প্রসূন গল্প বলেছিল, কোনও এক হাসি আর শুনুর । ভাইবোনের । গল্পটা কি নিজেই বানিয়েছিল ? নাকি শুনেছে কারো কাছ থেকে । কী যেন ছিল গল্পটা ? হ্যাঁ, ঘুম থেকে জেগে ওঠা । জেগে উঠে টের পাওয়া । ওরা দুজন নাকি তখন একেবারে একা । কোথাও কাউকে খুঁজে না পাওয়া । মা আর বাবাকে ডেকে ডেকে হয়রান হওয়া । আর বাইরে বেরিয়ে আসা ।
প্রসূনের খাতা খোঁজা মানে পুরো বান্ডিলটা খুলে ফেলা । সেকসন বি-র । এক একজন কিভাবে যে হঠাৎ করে কাছের হয়ে যায় !
মার্কশিটের নম্বর তুলতে গিয়ে প্রসূনের খাতা পেয়ে যাই । তিয়াত্তরে । যাক আর সেই ছেলেটা, ওই যে ফেল করল গেলবার, ফাইভ-সি, মার্কশিট হাতে প্রণাম করল, ভাবলাম পাশই করেছে বুঝি, হাসাহাসি করলাম টিচার্স রুমে, নামটা ? ওর নামটা ? ফাইভ সি-র মার্কশিটে ফেল করা ছেলেদের নামগুলি দেখতে থাকি । অসীম, পিন্টু, হারুণ, শ্যামল -। না, কিছুতেই মনে পড়ছে না । প্রণাম করে ছেলেটা হাঁ করে তাকিয়ে থেকেছিল । ওর ছোট ছোট আঙুল কাঁপছিল যেন । ওর জামা, ছেঁড়া বোতাম, পায়ের চটি এত চেনা ঠেকছিল আমার ! আমাকেও চিনতো না কেউ । স্কুলে । সেবার হেডস্যারকে রাস্তায় পেয়ে প্রণাম করতে, স্যার যখন জানতে চাইলেন, `ভাল আছ তো'? স্যারের চোখ দেখেই বুঝতে পারি, মনে করতে পারছেন না কিছুতেই । এত অভিমান হল সেদিন-, এত-, যে, যখন জিজ্ঞেস করলেন, `কি করছ এখন-', আমি আর অপেক্ষা করিনি । `কিছু না', বলে সোজা হাঁটা লাগিয়েছি ।
অবিনাশকে বললাম, ওষুধ খাওয়াচ্ছ তো নিয়মমতো ? ও ঘাড় নাড়লো । বলল, আর ভাল লাগে না, প্রতিদিন ঘরে ফিরে সেই অসুখ আর অশান্তি । মেয়ে দুটোর সমস্যা । ঝগড়াঝাঁটি । বললাম, ওটার কি হল ? মানে সেই চুলের, রামরাজাতলায় তান্ত্রিকের । বলল, দিয়ে এসেছি । যাব দু-এক দিনের মধ্যেই । কালিপুজোর দিন নাকি ঠিক করে রাখার কথা ।
বললাম, আমার কিন্তু একদম বিশ্বাস নেই এসবে ।
অবিনাশ বলল, আমারও ।
- তাহলে শুধু শুধু- ।
ওর কথায়, মেয়েরা নাকি বিশ্বাস করে খুব । শুধুমাত্র ওদের মায়ের কথায় । ওর ধারণায়, শুধু বাড়ি নয়, ওর অসুখেরও মীমাংসা হবে একটা ।
- মীমাংসা মানে ?
- হয়ত ভাবছে সেরে যাবে । অবশ্য সারুক না সারুক- বাড়িটার ঝামেলা মিটলেই হল ।
লাবণ্যের সঙ্গে আর দেখা হয় কিনা জানতে চাইল অর্থাৎ ছাদে যাই কিনা আর । অবিনাশ নাকি সেভাবে লাবণ্যকে দেখেইনি অনেকদিন, ওর কথায় প্রশান্তর মারা যাওয়ার পর থেকেই-। তার মানে প্রশান্ত । প্রশান্ত ব্যানার্জি ।
বললাম, খুব নাকি হ্যান্ডসাম ছিল- সুন্দর । অবিনাশের কথায়, ওদের পরিবারের লোকেরা যেমন থাকে আর কি- । ইচ্ছে করলে ওর চেহারার কথাটা তোলা যেত । ইয়ারকিও করা যেত । করলাম না ।
- মারা গেল কিভাবে লোকটা ?
সত্যিই ভুলে গিয়েছিলাম - হয়তো সেই মুহূর্তের জন্যই । প্রশ্নটা করার পরপরই মনে হল, ভন্ড ভাবছে না তো অবিনাশ ? ও নিজেই তো বলল একদিন । মনে পড়া মাত্র `সুইসাইড' কথাটাকে মনে রেখেও, ওকে বুঝতে দিই না । যেন সত্যিই জানি না তখনও ।
`সুইসাইড' - বলেই বলে উঠল, বলিনি আপনাকে আগে ?
অবিনাশের কথায় তাও বছর সাত হতে চলল । খুব নাকি জ্বর হতো । এ ডাক্তার ও ডাক্তার করে চলতে চলতে শরীর ভেঙে পড়ছিল । আগে শোনা কথাগুলি একটু অন্যভাবে আবার শুনতে থাকি ওর মুখে । এক সময় কলকাতার কোনও হাসপাতালে- । এ রোগের কোনও ওষুধ নেই শুনেই নাকি - ।
ইদানীং কেন যেন এসব শুনতে ইচ্ছে করছে খুব । অবিনাশকে উসকে দেওয়ার জন্যই বললাম । লাবণ্যকে দেখলে কিন্তু বলবে না কেউ ।
অবিনাশ বলল, জানি- আর ওইজন্যই তো টিঁকে গেল মেয়েটা । অবিনাশের কথায় লাবণ্য আর ওর মেয়ের দুজনেরই রক্ত পরীক্ষা হয়েছে তখন । রক্তে কিছু না পেলেও, দোষ পেয়েছিল লাবণ্যর । মানে ওর রক্তের । ডাক্তারের কথায় ওর রক্তে রোগের সেই পোকা ঘুমিয়ে তখনও । তবে জেগে উঠবে যে কোনও দিন, আর যেদিন জাগবে -।
তেমন করে ভাবলে লম্বা কোনও ছুটি শেষ হওয়ার পর যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে সবাই । আমিও । বাস থেকে নামাতে না নামতেই সেই চেনা ড্রেস । চেনা শব্দ । সেই চিত্কার । হু হু করে ছুটে যাওয়া । স্কুলের গেটের সামনে সেই ভিড় । সাদা জামা আর নীল প্যান্ট । সেই হজমিওয়ালা । চাটনি । সেই বাদাম আর ছোলা । আর সেই কাগজের প্লেন । সাদা । পাতলা । প্লেনের কাঁপতে কাঁপতে সেই নেমে আসা । দোতলার বারান্দা থেকে সেই চীত্কার । আর, গেটের মুখ থেকেই, `পাশ করেছি ? পাশ করেছি সার ? বা হায়েস্ট কত হল ?' - জানতে চাওয়া । আমাকে অবশ্য লক্ষ্য রাখতে হবে । গেলবারের ফাইভ বি-র সেই ছেলেটিকে যেভাবেই হোক পাশ করাতেই হবে । এবার নিশ্চিত ফাইভ সি-তে । স্কুলে ঢোকার পর এপাশ ওপাশে হুড়োহুড়ি করতে থাকা ছেলেদের মুখগুলি লক্ষ্য করতে থাকি- গলার আওয়াজ, সিমেন্টের মেঝেতে চটির সেই ঘষটে যাওয়া - আশা করি পেয়ে যাব ঠিক ।
কৃষ্ণচূড়া গাছগুলি একেবারে অদ্ভূত । শীতের শেষে যখন পাতা গজাতে শুরু করবে । তখন একই সঙ্গে সেই লাল ফুল । একেবারে বৃষ্টির ফোঁটার মতো । সারাটা গাছ ছেয়ে আসবে । উপর থেকে দেখলে যেন লালই শুধু । এরপর বাড়তে শুরু করবে । দ্রুতই । অল্প কদিনের মধ্যেই । গাছের নীচটা তখন লাল একেবারে । বাচ্চাদের পায়ের নীচে তখন যেন কত রক্ত । ওরা খেলেও তেমন । ফুল দিয়ে কিসব বানায়- পড়বে গলায়, মাথায়- ।
এখন শুধু পাতাই । এমনকি গাছের নীচটা এখন প্রায় হলুদ । হলুদ আর সবুজও । লালের চিহ্নমাত্র নেই । যেন নির্জনতাই শুধু । মরা অনেকটা । ক্লাস শুরু হবার পরের সময়টুকুর মতোই । চুপচাপ । ঠান্ডা একেবারে । সেইসব চটি, জামার সেফটিপিন তখন স্থির একেবারে । কোথায় যেন- কোথায় যেন- ভেবে সেইসব মুখ, পায়ের আওয়াজ, ছুটির ঘন্টাধ্বনির কথা মনে পড়া মাত্রই সেইসব পাতা উড়তে শুরু করে, ডাল থেকে খসে পড়তে থাকে, বাতাসের ধাক্কায় বারান্দা, বারান্দা থেকে ঘর-ছেয়ে যায় একেবারে, এমনকি গাছের নীচে দাঁড়ালে চুলের ভাঁজে ভাঁজেও ।
ফাইভ-সি তে খাতা দেওয়ার সময় মুখগুলি দেখে নিলাম ভাল করে । বিশেষ করে ফেল করাদের । ছেলেরা তখন গম্ভীর একেবারে । চুপচাপ । বোর্ডের উপর ভারতের মানচিত্র একটা । হাতে আঁকাই অবশ্য, আগের কোনও পিরিয়ডের । গোটা চারেক নদী- সম্ভবত নদী পড়াতে পড়াতেই এঁকে থাকবে কেউ, উপর থেকে নেমে আসা- একদিক থেকে আরেকদিকে চলে যাওয়া । পাহাড় থেকে সমভূমি হয়ে একেবারে সমুদ্র । কোনও উচ্ছ্বাস অবশ্য নেই । রঙ নেই কোথাও । কালের উপর সাদা - চক দিয়েই ।
বললাম, মনে পড়ছে তোমাদের ? গতবার মার্কশিট নিয়ে দেখা করলো আমার সঙ্গে কোন ছেলেটা ? কে ? হাত তোল তো ?
চুপচাপ সব । আমার দিকে ঠায় তাকিয়ে । একটু ফিসফাস । বললাম, মনে পড়ছে না ? যারা ফেল করে আছো- তাদের মধ্যেই -।
ছেলেরা উঠে দাঁড়ায় না কেউ । মুখের পর মুখ মেলাতে থাকি । সেই ভাঙা বোতাম, কাঁপতে থাকা আঙুল । আঙুলের শীর্ণতা । চটির সেফটিপিন ।
দরজার বাইরে থেকে হুড়মুড় করে বাতাস ঢুকে পড়ে এক একবার । ঠান্ডা । দরজার ধাক্কা মারে খুব । হলুদ পাতাগুলি নামতে থাকে । কালো বোর্ডের গায়ে এঁকে রাখা সাদা নদীগুলি অবশ্য বুঝতে দেয় না কিছুই । জল আর মাটির রঙে সেখানে তখন আর তফাৎ নেই কোনও ।
অবিনাশ বলল, সামনের ডেটেই নাকি বোঝা যাবে ।
- কী বোঝা যাবে ?
- বোঝা যাবে চান্স আছে কিনা আদৌ-
আর কাউকে বলতে বারণ করে বলল, অন্যদিকেও কথাবার্তা এগিয়েছে অনেকটা । মানে হাই লেভেলের লোকজনের সঙ্গে । ও বলল, নির্মলদাই যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছে ।
অবিনাশের মতো লোকের সুবিধা আছে খুব । বিভিন্ন সময় নগেনবাবু না হয়ে নির্মলদা, নির্মলদা না হয়ে অনুপবাবু হলেও ওদের যায় আসে না কিছু । স্কুল রাজনীতি কিছুদিনের মধ্যেই পাল্টে গেছে খুব । নগেনবাবুর বিরুদ্ধে খোলাখুলিই সমালোচনা চলছে । পার্টির মধ্যে উনি নাকি একরকম কোণঠাসাই । অবিনাশ বলল, মুখ খুলবেন না একদম । সাহসও দিল অবশ্য, বলল, নগেনবাবুর লোক হিসেবে ঢুকেছেন তো কী হয়েছে ? কেউ কি কেনা হয়ে যায় নাকি কারও ? আর পার্টিও যখন করেন না তখন খুব একটা ভয়ের নেই । বিপিনের কথা বললাম, ও যেতে বলেছে, গেলে ভাল হত - এত করে বলল ।
অবিনাশ মনোযোগ দিয়ে শুনল কথাটা । জানতে চাইল, আর কিছু বলেনি ?
- ওর বাড়ির কথা বলল । একজনের উপর এতগুলি লোক ।
- ওর দিদির কথা বলেনি ?
- হ্যাঁ, বলল । গান জানে ভাল ।
- ভাল না কচু । না গিয়ে ভালই করেছেন । আসলে হয়ত গছাতে চাইছে । ভাবছে যদি কোনও মতে গছাতে পারে একবার- ।
- না মানে, শুধু ওর বাড়িতেই যাইনি কোনওদিন । হয়ত সেজন্যই - ।
অবিনাশকে আজকাল একটু অন্যরকম লাগছে । যেন ঝাঁকুনি খেয়েছে কোথায় । অনেকটা আগের মতো । হতে পারে ওর বউয়ের ত্রক্রমে সেরে ওঠার কারণেই । স্কুলেও অনেক চনমনে । বলল, নির্মলদা হয়ত লোকাল কমিটির সেক্রেটারিও হয়ে যেতে পারে । চান্স আছে । নগেনবাবুর কথা তুলে বলল, ভদ্রলোক শেষ বয়সে ডুবে গেলেন একেবারে ।
- কি করেছেন ?
অবিনাশের কথায়, এসব পার্টির ভিতরকার ব্যাপার, আর লোকটার চরিত্রেরও নাকি দোষ আছে কিছু । আমার নাকি শুনে লাভ নেই । ও অবশ্য আমার আর নগেনবাবুর মধ্যেকার এক ধরনের আত্মীয়তার কথাই জানে । এমনকী আমাকে দিয়ে নগেনবাবুকে ধরে বাপ্টুর গাড়ি বের করে আনার ব্যাপারটাও ।
নগেনবাবুর সঙ্গে দেখা করে আসব ঠিক করেও যাওয়া হচ্ছে না । আসলে হারের মুখে পড়া লোকটাকে দেখতে খারাপ লাগবে খুব । সেই ব্যস্ত লোকটাকে যদি দেখি চুপচাপ বসে আছেন বারান্দায় বা বিছানায় শুয়ে আছেন, একদম সহ্য করতে পারবো না ।
অবিনাশের কাছে জানতে চাইলাম, নগেনবাবু কি পার্টি অফিসেও আসছেন না ?
- আসবেন না কেন ? তবে আগেকার সেই দাপট আর নেই । ওর ওয়ার্ডের লোকজনই ছেড়ে দিয়েছে ওকে ।
- ওয়ার্ডের মানে পাড়ার লোকেরা ?
- সবাই নয়, আছে দু-একজন । যেমন থাকে । ওরা হয়ত শেষ পর্যন্ত দেখতে চাইছে । নির্মলদা আসলে ওকে পুরোপুরি উপড়ে ফেলতে চাইছে ।
- তুমি তো বলতে, নগেনবাবুর স্যাক্রিফাইস আছে দারুণ । দাপট ছিল খুব ।
অবিনাশ বলল, পার্টি করলে এসব নাকি বুঝতে পারতাম । সাধারণভাবে পার্টি করা আর নেতৃত্বে থাকা দুইয়ের মধ্যে বিরাট ফারাক । অবিনাশ বলল, ওর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে কিছু । আর অভিযোগ নাকি দুর্বলের বিরুদ্ধেই ওঠে । নগেনবাবুর বিরুদ্ধে অভিযোগটা অবশ্য আর জানা হয়ে ওঠে না । অবিনাশ বলল, এসব প্রায় আদার ব্যাপারী হয়ে জাহাজের খবর নিতে যাওয়া । ও একজন সাধারণ সদস্য মাত্র ।
নির্মলদা নাকি পুরো ব্যাপারটাই জানে । মানে অবিনাশের বাড়িঘরের । ব্যানার্জি বাড়ি বললে এখনও যে কেউ অবিনাশদের বাড়িটাকেই দেখাবে । পুজোমন্ডপের দুপাশে টানা বিল্ডিং । সোজাসুজি দেখলে ইংরেজী `ইউ' আকারেরই মনে হবে । দোতলা । অবিনাশদেরটা বাঁদিকে । মানে অবিনাশ আর লাবণ্যদের । ডানদিকের দোতলা অন্য শরিকদের- অবিনাশের দূরসম্পর্কের কোনও ভাই-ই হয়তো ওরা । দু বছরের মধ্যে তেমন করে দেখা হয়নি কোনওদিন । পেছনে পুকুর । বাগানের মতোও আছে খানিকটা । এখন অবশ্য আর বাগান বলা যাবে না । জঙ্গল । নারকেল গাছ কয়েকটা । পুকুরের ওপারে আমগাছ দুটো । আমগাছ ছাড়িয়ে পাঁচিল । সে অবশ্য নামেই । নির্মলদা নাকি পুরো বাগানটার কথাই ভেবেছিলেন । পরে শুধু অবিনাশের অংশটা শুনেও নাকি হতাশা প্রকাশ করেননি । জিজ্ঞেস করেছিলেন, রাস্তার ওপরই তো । ভদ্রলোক নাকি নিজেই ব্যবস্থা করে দেবেন সব কিছুর । লোক আছে ।
অবিনাশ জানতে চেয়েছিল খারাপ হবে ?
- কোনটা ?
- এই যে অন্যের উপর ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারটা ?
সেই লোক নাকি মামলার কাগজপত্র নিয়ে গেছে । মামলার মেরিট নিজের ল-ইয়ারকে দিয়ে বুঝে নিয়ে নিজেই নাকি দায়িত্ব নেবে ।
- খারাপ লাগবে না তোমার ?
- কোনটা ?
- এই যে এত বছরের পুরনো বাড়িতে হুট করে বাইরের লোক বসিয়ে দেওয়া ?
অবিনাশের কথায়, খারাপ তো লাগতেই পারে, তাই বলে, এ বাড়ির ঘরে ঘরে যা হচ্ছে তার চেয়ে আর কি-ই বা খারাপ হবে । ওর কথায় লাবণ্যকে এ বাড়ি থেকে না সরালে বাস করাই মুশকিল । যে রোগ বাসা বেঁধেছে ওর শরীরে -।
সেজকাকু চিঠি পাঠিয়েছে ফের । স্কুল থেকে ফিরে দেখি, দরজার ফাঁক দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে । লিখেছে, নৈহাটির ছেলেটির সঙ্গেই বিয়ে ঠিক হয়েছে লক্ষ্মীর । বিশ হাজার ক্যাশ চাইছে । তাছাড়া, মেয়েদের যা যা দেওয়ার । খাট, ড্রেসিং টেবিল, টিভি । লিখেছে, তাও ভাল ফ্রিজ ছাড়া শুধু টিভি-তেই রাজি হয়েছে ওরা । লিখেছে, অন্তত ক্যাশের পুরোটা আমার দেওয়া উচিত ।
বিকেলের দিকে আলো কমে আসতে থাকার জন্যই যেন কেমন ঝিমুনি আসে একটু । কেমন স্যাঁতসেতে ভাব একটা । বিছানায় শুয়ে পড়লেই ঘুমের ভাব আসে । ঘরটা রাস্তার দিকে না হওয়াতে নির্জনতা একটু বেশিই । অবশ্য দোতলার বাকি ঘরগুলির ভঙ্গুরতাও দায়ী হয়ে থাকতে পারে খানিকটা । এই ঘর নাকি দীর্ঘদিন ব্যবহার করছিল না কেউ । মলি বলছিল, ওর দাদু মারা যাওয়ার পর সেই যে বন্ধ হল, তারপর এই আমার জন্যই । অবিনাশ যেদিন বাড়ি এসে আমার থাকার কথা বলেছিল, ওরা দুই বোনই নাকি অবাক হয়েছিল খুব । জানতে চেয়েছিল, থাকবে ? এক ছাদের ব্যাপারটা ছাড়া তেমন কোনও অসুবিধা নেই এমনিতে । চারটে দেওয়ালের প্লাস্টার খসে গেলেও ইটগুলি আস্ত আছে অন্তত । কোথাও কোথাও আঙুল ঘষলে অবশ্য রঙ লেগে যাচ্ছে- গুঁড়ো মাটির, শুরকির । ঝুরঝুর করে পড়ছেও কোথাও । অবশ্য ভাড়ার কথা ভাবলে সেসব আমল না দিলেও চলে । স্বরূপবাবু বলেছিলেন, দু-একটা বছর চালিয়ে নিন । পরে পাল্টে নেবেন । পাল্টানো আর হলো কোথায় ? লাবণ্য বলেছিল, ও নাকি প্রথমদিন দেখে ভূতই ভেবেছে । না । হাসির কথা নয় । ছাদের ওপর ওঠে না তো কেউ । তাও সন্ধের পর-! জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি ? হেসে উঠেছিল কিনা মনে পড়ছে না, বলেছিল, আমি কি মানুষ ?
এদিককার ছাদের অনেকটাই ভাঙা । মানে প্রায় পুরোপুরিই । দু-এক জায়গায় পুরনো রেলিং । নীচের দিকে তাকালে একেক সময় অবাক লাগে খুব । পুজোর রাতগুলিতে মনে হয়েছে একেকবার । বিশ-ত্রিশ বছর আগেও নাকি মোষ বলি হয়েছে । পাড়াশুদ্ধ লোকের নিমন্ত্রণ থেকেছে । দূরের আত্মীয়স্বজনরা বছর বিশেক আগেও এসে এই দিনগুলিতে জড়ো হয়েছে । দোতলার এসব ঘর তখন নিশ্চিত গমগম করছে একেবারে । শাড়ি বা অলঙ্কারের উজ্জ্বলতায় তখন হয়ত রাত্রির অন্ধকার ম্লান । ছাদের রেলিং-এ ভর দিয়ে কোনও কিশোরী মোষবলি দেখছে । রক্তের সেই ফোয়ারা । বলির বাজনা তার ঘুম কেড়েছে তখন । সে তখন হয়ত জামাইবাবুর ভাইকে দেখছে ।
সেজকাকি লিখেছে, একেবারেই কি ভুলে গেলি ? অন্তত বিজয়ার প্রণাম করতে একবার যাওয়া যেত না ? বা একটা অন্তত চিঠি ?
`সমীরণ আর চিঠি লিখবে না -', `সমীরণ আর ফিরবে না কোনওদি'। কেউ বলে উঠল যেন । বা একটা আবেগ । একটু কেঁপে ওঠা । বিশ হাজার কোথায় পাব আমি ? বিশ হাজার- । ব্যাঙ্কে বড়জোর হাজার চার । বি. এড. না থাকায় ইনক্রিমেন্ট বন্ধ । ওদের অবশ্য এত বুঝিয়ে লাভ নেই । আর সেজকাকু তো দিয়েছিল ঠিকই । দশ হাজার । লক্ষ্মীর বিয়ের জন্যই রেখে দেওয়া ।
মা বেঁচে থাকলে কি করতো ? বিয়ের কথা বলতো না ? হয়ত তাড়া দিত ঠিক । যেমন করে পাঁচজন । মা বাবা । বাবা হয়ত জমি জায়গার কথা তুলতো । একটা বাড়ি । সুন্দর একটা ঘর । আলো আর ছায়া । যেমন বলে লোকে । বা বিজ্ঞাপন । মাঝেমধ্যে চোখে পড়ে । ছবি । আকাশ আর রৌদ্রের । উড়তে থাকা দু-একটা পাখি । একটা দুটো গাছের ফাঁকে ফাঁকে সুন্দর রাস্তা । গাড়ি । আর স্বামী-স্ত্রী । মাঝখানে ছেলে বা মেয়ে । অনেকটা জায়গা জুড়ে কিস্তির কথা থাকে । ইনিশিয়াল মানি । আর স্টেশন ও বাসস্ট্যান্ডের দূরত্ব । বাজার, হাসপাতাল, কলেজ ।
সেজকাকির হয়ে অন্য কেউ লিখে দিয়েছে । পরিষ্কার অক্ষর । আর সোজাও । অল্প কয়েকটা লাইনই । লিখেছে, মায়ের ছবি পায়নি কোথাও । সম্ভবত হারিয়েছে । তবে পিসির বাড়িতে নাকি থাকার কথা একটা । লিখেছে তেমন দরকার থাকলে খোঁজ করবে ।
- পুজো ? কেন ?
ও অবাক হল খুব । পুজো বন্ধ হয়েছে অনেক বছর, লাবণ্য এ বাড়িতে আসার আগেই । মন্ডপে সেই পুজোর চিহ্নমাত্র নেই । কোনও ঠাকুরই নেই । থাকার মধ্যে মেঝের দু-একজায়গায় মোজাইক । টাইলসের অলঙ্করণে । ভাঙা । ছাদের ফাঁকফোকরের বাইরে বেঁচে যাওয়া দু-একটা টেরাকোটার নকশা ।
বললাম, পুজোর দিনগুলিতে এত বাজে লাগছিল, বিশেষ করে আলো আর শব্দের ভিতর -। আমি আসলে ওর গলায় স্বর বুঝতে চাই । সত্যিই অসুস্থতা ? রাতে শুধুমাত্র আকাশের আলোয় ওর শরীরের ভেঙেপড়া বোঝা মুশকিল ।
বললাম, পুজোর দিনগুলিতে কি সত্যিই বেরোওনি ? লিপিকে নিয়েও না ? এত অন্ধকারে দমবন্ধ হয়ে আসে না ?
- আপনিই বা থাকেন কেন এখানে ? চলে গেলেই পারেন ।
ওর কাছে আমিও ঠিক এটাই জানতে চাই । বড়জোর গোটা তিনেক ঘর, -মানে দোতলার ভেঙে যাওয়া দেওয়ালগুলিকে ধরলে ।
বললাম তুমি ? অন্তত লিপির কথা ভাবলেও তো অন্য কোথাও- ।
- ছাড়ুন - ।
লাবণ্য প্রায় ধমকেই থামিয়ে দেয় । সেজকাকুর চিঠির কথা জানতে চায় । কী লিখল ?
- বোনের বিয়ে ঠিক হয়েছে ।
পুবের ঘরের কথা বললাম । লিজের কথা । মাসে হাজার টাকা খুব একটা খারাপ নয় । বললাম, সেজকাকুর চাকরি তো অনেকদিন হল নেই । ছেলেটাও অমানুষ ।
ঠান্ডা বাতাস দিয়েছে কদিন । ওকে চাদরের কথা বললাম । নদীর ওপারে কিসের যেন আলো । কোন ফ্যাক্টরির । প্রায় সার্চলাইটের মতো । মাঝে মধ্যে কিছু একটা সেই আলোতে ধরা পড়ে । কখনও সাদা কখনও বা জমাট অন্ধকারের মতোই কিছু ।
লাবণ্য বলল, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই ? জমান না ?
- ছিল না এতদিন- । জানুয়ারি থেকে -
লাবণ্য বলল, নিজের কথা নিজেকেই ভাবতে হয় ।
অবিনাশের কথা আজ ইচ্ছে করেই তুললাম না । আগের দিন সম্ভবত ও উত্তেজিত হয়ে থাকবে । আর মেয়েরা সহজেই মৃত্যুর কথা বলে । অভিমানেই । লাবণ্যের কথার উচ্চারণে কোথাও অসুখের চিহ্ন নেই । তেমন অসুখ থাকলে ধরা পড়ত না ? আর মেয়েরা তো অসুখ নিয়ে বাতিকেও ভোগে কেমন । অসুখ নিয়ে এক ধরনের বিলাসই থাকে যেন । শরীর সম্বন্ধে বাড়িয়ে বলা । খারাপ কথাই । মলিকেও দেখেছি । `আমার দিকে কে আর দেখবে বলুন ?' ওর কথায়, ও যে হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে, সেটাই নাকি আশ্চর্যের ।
ওর শরীরের কথা তুললাম । বললাম, চিকিত্সা করাবে না তোমার ?
হাসল লাবণ্য । বলল, করব না কেন ? ওই মরার জন্য যতটুকু দরকার ।
ওকে নিয়ে সত্যি কিছু বলার থাকে না । বললাম, ঠাকুর বিসর্জনের দিন ঘাটে এমন করলে কেন ? তুমি আমাকে চেন জানলে কী এমন ভাবত লিপি ? ও তো চেনে আমাকে ।
ভাঙা জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল লাবণ্য । নীচে মন্ডপ । মন্ডপের চূড়ো- ভাঙাই অবশ্য । শূন্য, হয়ত কলসিই ছিল এককালে । নীচে আলো । ঢাক । কাঁসরের আর্তনাদ । আর রক্তের সেই উচ্ছ্বাস । এখন অবশ্য অন্ধকার । ভাঙা সিঁড়ি । একটা দুটো ধাপ । সরু পথ একটা হাঁটাচলায় তৈরি হওয়া ।
লাবণ্য যেন বিদ্রুপ করল, হাসল টুকরো করে । বলল, লিপি চেনে আপনাকে ? সত্যি ?
ঘরে ফেরা থেকেই কথাটা ভাবাচ্ছে খুব । লাবণ্যের কথায় খোঁচা ছিল না একটু ? বিশেষ করে সবশেষে বলা - একটু জোর দিয়েই । `সত্যি' শব্দটাকে উচ্চারণ করা । ও কি অন্য কিছু বোঝাতে চাইল ? জানে কিছু ? মলি যদি বলে থাকে । নাকি সত্যিই বলেছে ? ওর আমার কোনও সম্পর্কের কথা । বানিয়ে বানিয়েই । হয়ত রেগে গিয়েই । মলির কথায়, লাবণ্যর কী এমন আছে ? লাবণ্যের সত্যিই কি নেই কিছু ? না থাকুক । কিন্তু লিপির ? লিপির কথা কি আমি ভাবব ? ভাবা যায় ? লাবণ্যর কথায় ওর কোনও দাবীদার নেই । কিন্তু কী করব ওকে নিয়ে ?
বিপিনের সঙ্গে জোর তর্ক হয়ে গেল সত্যদার । স্টাফ কাউন্সিলের সেক্রেটারি বলে কথা । পার্টি মেম্বারও । চাকরির আগে হোলটাইমার ছিল । লোকটার ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেল একেবারে । বিপিন বলল, চাকরি করার জন্য পার্টি করি না আমরা । রীতিমতো যোগ্যতা দিয়েই- ।
ওকে থামিয়ে রাখতে পারে না কেউ । সত্যদা বারবার বলছিল, ভাল হবে না বিপিন - সেদিনের ছেলে হয়ে এত বড় কথা - ।
- যান যান দেখাতে হবে না আমাকে -বৌদির চাকরির জন্যও তো- ।
সত্যদাকে কোনও মতে স্বরূপদার ঘরে নিয়ে গেল সবাই ।
উত্তেজনার কারণটা নিয়ে আলোচনা করছিল না কেউ । সবাই প্রায় চুপচাপ । টিচার্স রুমের দরজার পাশে কয়েকটা ছেলে উত্সুক মুখে তাকিয়ে । ধমক দিলাম জোর, কী ব্যাপার ? এখানে কী ? ওরা ক্লাসের কথা বলল । বলল স্যার নেই কোনও ।
একেকদিন ভালো লাগে না কিছু । কিছুই না । কেমন একটা আলসেমি । ক্লাসে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকতেই ইচ্ছে করে । জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকা । দোতলার ঝুলতে থাকা ঘন্টা । জল খাওয়া বা বাথরুম পাওয়ার কথা বলে বাইরে আসা ছেলেরা । বই খুলে বেশ কঠিন দেখে অঙ্ক বের করি একটা । বললাম, আঠারো প্রশ্নমালার তের । ওরা বই বের করে ব্যস্ত হয় । শব্দ হয় খুব । সুটকেশ, খাতা, পেন্সিল, জ্যামিতির বাক্স, চিত্কার করে ওঠে, হয়নি স্যার -, হয়নি স্যার- ।
- হয়নি ?
- না ।
- পারবে না ? চেষ্টা করতো- দেখি কে পারে -।
জানালার বাইরে কাক ডেকে ওঠে একটা । ছেলেরা তাকায় কেউ । আমিও । বাইরে রাস্তা । বেশ দুপুর । কলের জল পড়ছে কোথাও । মুখ খুলে রেখেছে কেউ । শব্দ হচ্ছে । `-হাউজ দ্যাট', বলে চিত্কার উঠল । খেলছে কারা যেন । স্কুল না এসে রাস্তায় । এই দেওয়ালের আড়ালে । কাকটা পা দিয়ে ঠোঁট ঘষছে । একবার-দুবার-তিনবার । কী ভাবলো যেন । একটা কিছু আছড়ে পড়ল জানালায় । বলই । ছেলেরা চমকে উঠল খুব । কে একজন বলল, শ্যামল- শ্যামল- । তার মানে এই ক্লাসেরই কেউ । স্কুলে না এসে বাইরে । ধমকে উঠলাম । কি হল ? কেউ হেসে উঠল । কে ? কেউ নয় । যে যার খাতার দিকেই তাকিয়ে ।
ফোর পর্যন্ত বাবার কাছেই পড়তাম । স্কুলে । ফোর পর্যন্ত, বাবার কাছে গিয়ে বাইরে যেতে চাইতাম । পড়া না পারলে কান ধরে দাঁড়াতাম । পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল- । বাবা জিজ্ঞেস করত, পাখির ডাক শুনেছ ? শুনেছিস কোনওদিন ? বলতাম হ্যাঁ- । নামতা পড়ার মতো করেই- যখন পাঁচ দুগুণে দশ, তিন পাঁচে পনেরো, চার পাঁচ কুড়ি । বাবা বলত, ভোরবেলা যখন সূর্য ওঠে, ঘুম থেকে উঠেছ কোনওদিন ? দেখেছ ? শোননি ?
ভোররাতে যে লাল জবাগুলি ফুটবে বলে ঠিক করেছে, ঠিক সেই ফুলগুলিকেই বাছতে হত । অন্ধকারে । কোথাও একটা কাক বড়জোর ডেকে উঠত । বা কোনও কাশির শব্দই । খুট করে আলো জ্বলে উঠত কোথাও । সূর্য উঠত একসময় । সেই সীতানাথ বসাকের আদর্শলিপির ছবির মতো করেই । সেই দল বেঁধে স্কুল যেতে থাকা বালক-বালিকারা যেমন দেখছে, সামনের আকাশ লাল । আর সেই সূর্যের শরীর থেকে বেরিয়ে আসা রেখাগুলি । ছোট আর বড় । যেন আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকা ।
বললাম, কী হল ? হয়েছে ?
অঙ্কে একানব্বই পাওয়া দীপেনকে জিজ্ঞেস করলাম, কী হল ? ও একবার হাত তুলে দেখাল আমাকে । অর্থাৎ হবে । করছি । অনেকেই অধৈর্য্য হয়ে উঠছে । খাতা সরিয়েই রেখেছে কেউ কেউ । প্রসূনকে ডাকলাম । বললাম, কী খবর ?
হাসল ছেলেটা । যেন লজ্জা পেয়েছে খুব । পায়ের দিকে তাকাল, যেন কেউ বলল কিছু পেছন থেকে । ঘাড় ফিরিয়ে বললও কী একটা । হাত তুলল ।
- কী হল ?
- কী বলছে স্যার ।
- কী বলছে ?
ফের ঘাড় ফেরালো প্রসূন । ফিসফিস করেই । বলল, বলব ? বলে দেব ?
আমি শুনেও না শোনার ভান করি । ওর ঠোঁটের ফাঁকে কালি । হয়ত চিবিয়েছে রিফিলটা । বা মুখ দিয়ে টেনেছে খুব । আটকে থাকা বাতাস । কালি । বুকের প্রথম দুটো বোতাম ছেঁড়া । নেইই একেবারে । খোলা । হা হা করছে ।
বললাম, কী হল ?
আমাকে গ্রাহ্য না করেই কাউকে বলল, আমি কিন্তু বলে দেব এবার ।
ডাকলাম, প্রসূন ?
- কী স্যার ?
ছেলেটা ঘাবড়ে গেছে একেবারে । পুরো ঘরটাই চুপ । বললাম, কবিতা মুখস্থ বলতে পারবি ? `আমি বলব-, আমি বলব-,' করে গোটা ক্লাসই ফেটে পড়ল একেবারে । বললাম, আমি যেটা বলব সেটা- ।
এরপর প্রসূনই বলতে শুরু করল । চকের দাগের মতো একের পর এক রেখা তৈরি হতে লাগল । মাটি, পাহাড়, নদী, রোদ, জল, মেঘ । বাগানের ফুল । বালম বয়সী রাখালেরা । আর সেই কুঁড়েঘর । খড়ের চালা । সেই বারান্দা । আর সেই বালকেরা । সেই নামতা পাঠ । পাঁচ একে পাঁচ, পাঁচ দুগুণে দশ, তিন পাঁচে পনের, চার পাঁচে-। আমার ঘুম পেতে থাকে । জানালা দিয়ে ঢুকে পড়ে জলকণা । বাতাস । বললাম, থামো- স্টপ ইট- ।
ওরিয়েন্টাল ফ্যাক্টরিতে গন্ডগোল হয়েছে খুব । সুশান্ত বলল । কাল নাকি কাগজে বেরুবে । বলল, পার্টি প্রায় যাওয়ার পথে ।
লাইব্রেরির বাইরে বসে গল্প করছিল ওরা । এমনিতে গঙ্গার লাগোয়া এলাকাগুলিতে পার্টির চর্চা একটু কমই । আমাদের পালপুকুরে থাকতেও দেখেছি । যা কিছু হইচই সব স্টেশন এলাকা আর স্টেশন ছাড়িয়ে ওপারে ।
রাস্তার ওপর ওদের দাঁড়িয়ে থাকা দেখে বোঝা যায় প্রত্যেকেই কম বেশি জানে ব্যাপারটা । মানে গন্ডগোল হওয়ার সম্ভাবনা সম্পর্কে প্রত্যেকেই স্চেতন । ওদের মধ্যে সুশান্ত বা অমিয় পার্টি মেম্বার না হলেও যথেষ্ট সক্রিয় । কে একজন নগেনবাবুর কথা তুলল । ওয়ার্কাররা নাকি জড়ো হয়েছিল সব ।
ওদের সঙ্গে আমার বয়সের তফাত থাকলেও সম্পর্ক খারাপ নয় । মাস্টার মানুষ হিসেবে সম্মান দেয় । সামনাসামনি হলে সিগারেট লুকোয় ।
বললাম, ফ্যাক্টরিটা বন্ধ ছিল না অনেকদিন ?
আমার আগ্রহটা নগেনবাবুর জন্যই । ওরিয়েন্টাল ওর এলাকায় । শক্তিপল্লীতে ।
ওরা সায় দিল । বলল, খোলার চেষ্টা চলছিল খুব । দিল্লী অব্দি গেছে নেতারা । খোলার কথাও হচ্ছিল । কদিন আগে কাগজে দেখলেন না ?
স্কুলের বেশ কিছু ছেলের বাবাই ওরিয়েন্টালের । প্রায় বছর তিনেক হল বন্ধ । ওরা অবশ্য অনেকেই এখন করছে কিছু না কিছু । ফুটপাতে বসছে । বা বাড়িতে তৈরি করছে কোনও জিনিস । সেদিন এইটের একটা ছেলে বলল, ওর বাবা তরকারি কাটার ছুরি তৈরি করছে । ও নিজেই জানতে চেয়েছিল, ছুরি লাগবে স্যার ? আমি তো অবাক । ছুরি ? ও নাকি কোথ্থেকে শুনেছে আমি নিজে রান্না করে খাই । বলল, তরকারি বা মাছ কাটার জন্য ছুরিই তো ভাল ।
আসল কথা হচ্ছে উদ্যোগের । নতুন কিছু করার ইচ্ছের । ওর বাবার জন্য বেশ একটু ভাল লাগা তৈরি হয় আমার । ভদ্রলোক তার মানে খোঁজ রেখেছেন ঠিক । হতে পারে ফ্যাক্টরির বিহার, ইউ. পি-র লোকদের দেখে । তরকারি বা মাছ কাটার জন্য ওরা ছুরিই তো ব্যবহার করে ।
জড়ো হওয়া লোকগুলি নাকি মালপত্র বের করা আটকাতে চেয়েছিল । সুশান্ত বলল, প্রায় জনাসাতেক মার খেয়েছে । একজন নাকি ভালমতোই-, হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছে ।
সম্ভবত আমাকে আলোচনায় ঢুকতে দেখেই সুশান্ত উত্সাহ হারিয়ে ফেলল একেবারে । চুপ করে গেল হঠাৎ । বললাম, নগেনবাবুর খবর আছে কোনও ?
একটু আগে ওর মুখেই অস্পষ্টভাবে নগেনবাবুর নাম শোনা ব্যাপারটা অবশ্য উল্লেখ করা যায় না ।
কে যেন বলল, সম্ভবত সুপ্রিয়র বাবাই, তুমি তো আবার নগেনবাবুর ।
সুশান্ত বলতে পারল না কিছু ।
তখন অন্ধকার নামছে । কালিপুজোর পোকাগুলি বালবের চারপাশে । সবুজ আর ছোট । চামড়ার গায়ে আঁকড়েই থাকে যেন ।
রাত্রে বাড়ি ফিরে অবিনাশ এসেছে কিনা খোঁজ নিই । এমনিতেই ওর সাড়ে আটটা বা নটার আগে ফেরার কথা নয় । স্টেশনের পাশে দোতলা বাড়ির পার্টি অফিসের ভিতরে বা বাইরে খুব নাকি ব্যস্ত থাকে সে । এখনকার এম. এল. এ.-র খুব কাছাকাছি থাকা লোকদের সে নাকি একজন । অন্তত ওর কথায় তো বটেই । কদিন আগে তো বলল, যতসব ফালতু -। নির্মলদার সঙ্গে আগে কথা বললেই হত । আর সেই তান্ত্রিকের মাদুলি নাকি ওর বউয়ের হাতেই । ওর বউ যদি বিশ্বাস করে, সে তখন কি-ই বা করতে পারে ।
অবিনাশ ফিরল রাত সোয়া দশটায় । তুলি একটু অবাক হয়েই জানতে চেয়েছিল, কী ব্যাপার ?
- কেন ?
- বাবার খোঁজ করছেন এতবার করে ।
ওকে অবশ্য বলিনি তেমন কিছু ।
অবিনাশ বলল, নগেনবাবু নাকি নিজের কবর নিজে খুঁড়ছেন । যেখানে অসিত বসুর মতো লোক একটা ব্যাপার করতে চাইছেন -।
- অসিত বসু মানে ?
- মন্ত্রী, রাজ্য কমিটির মেম্বারও ।
নগেনবাবু নাকি লোক খেপাচ্ছেন । অবিনাশ বলল, ও ফ্যাক্টরির আছেটা কি ? পুরনো লোহার দামেও কিনতে চাইছে না কেউ, চালু করা তো দূরের কথা ।
- শুনলাম মারপিট হয়েছে খুব ।
- খুব মানে ওদের একজনের মাথা ফেটেছে ।
নগেনবাবুর লোকজন নাকি পার্টি অফিসেও ভিড় জমিয়েছিল । হ্যাঁ, লোকজনই । নগেনবাবু আসেননি আজ ।
অবিনাশ বলল, উনি আসলে অন্যের জোরে ছুটছেন । প্রবাল সেন । প্রবাল সেন কি করবে ওর ?
ওর কথায়, অসিত বসুর উপর নির্ভর না করে উপায় আছে পার্টির ? ওর এক ডাকে -।
তাছাড়া, অসিত বসু এই জেলারই লোক । গোটা জেলাটাই বলতে গেলে ওর দখলে । অবিনাশ বলল, এটা প্রায় জলে থেকে কুমীরের সঙ্গে লড়াই ।
মাল নাকি শেষ পর্যন্ত সরানো যায়নি ।
- যেখানে ইউনিয়ন রাজি - ।
শুধু পার্টি ইউনিয়নই নয় । অন্য ইউনিয়নগুলিও । ওর মতে, যেখানে সবকটা ইউনিয়ন দায়িত্ব নিচ্ছে টাকার ব্যাপারে- ।
মালিক নাকি আটকে যাওয়া মাল বিক্রি করে পয়সা মিটিয়ে দেবে ।
- কিনবে কারা ?
অবিনাশ বলল, এসব ব্যাপার ওঅর জানা নেই কিছু । ওর কথায়, নগেনবাবুও তো পার্টির লোকই ।
ঘুমটা ভেঙে গেল আজ । ফটাফট শব্দ হল হঠাৎ করে । চমকে বাইরে বেরিয়ে দেখি আলোটা হঠাৎ করে বেড়ে গেছে যেন । তার মানে আকাশটাই । পূব দিকের ছাদের অনেকটাই খসে পড়েছে । শুধুমাত্র বিমটাই আটকে । লাবণ্য বলেছিল, দেখবেন, বর্ষার পরপরই ভাঙবে । কী যে থাকবে শেষ পর্যন্ত কে জানে ।
কাগজে বেরিয়েছে ছোট করে । ওরিয়েন্টালে হাঙ্গামা । আহত চার । নিজস্ব সংবাদদাতা । পুলিশের খবর অনুসারে জানিয়েছে, শ্রমিকরা ভাঙচুর করেছে খুব । আটকে থাকা মালে আগুন ধরাবার চেষ্টাই নাকি করেছিল । পুলিশ সময়মতো বাধা দেওয়ায় - ।
শেষের লাইনে কারও গ্রেফতার না হওয়ার খবর জানানো হয়েছে ।
লাবণ্যর কথাটা ঠিকই । বর্ষার পর শীত আসার আগেকার এই সময়টা ভয়ের । একেকদিন ঘুমের আগে ছাদে চোখ পড়ে । হয়ত এমনিই । বা কোন টিকটিকির চোখ । লাল টকটকে । বুক ঘষটে অল্প অল্প করে এগিয়ে যাওয়া, জিবের সেই লকলক । বা হঠাৎ করে স্থির হয়ে যাওয়া । যেন কোনও শিকারের গল্পই । ছাদের সিমেন্ট দু-এক জায়গায় বেশ আলগাই । দরজার মাথায় বেশ বড়সড় একটা ফাটল । প্লাস্টার সম্ভবত অনেক বছর আগে থেকেই নেই । বছর কুড়ি আগে কারা যেন পঞ্চাশ হাজার চেয়েছিল ঠিকঠাকের জন্য । গোটা বাড়িটাই ।
- পঞ্চাশ হাজার কে দেবে তখন ?
না, লাবণ্য তখন এখানে নেই । তবু বাড়ির অবস্থা দেখে বোঝাটা এমন কিছু কষ্টেরও নয় । কে দেবে ? একশ বছরের বসে খাওয়া পয়সা তখন তলানিতে । এমনকি বিক্রি করার মতো কিছুই সম্ভবত আর অবশিষ্ট নেই ।
তার মানে ছাদের প্লাস্টার এমনি করে খসেই পড়বে । শুধু বিমগুলি আটকে থাকবে কিছুদিন । কংকালের মতোই । এই ঘরটার টিকে থাকার কারণ সম্ভবত অবিনাশের বাবাই । ওই বুড়োর একটু দেরি করে মারা যাওয়ার জন্যই । আসলে কারুর টিঁকে থাকার উপরই নির্ভর করে সব কিছু । সেই পালপুকুরের বাড়ির মতোই । পুবের ঘরের মতোই । ঘর । ঘরের বেড়া । চেয়ার-টেবিল । আয়না । আয়নার পাশে বেড়ার গায়ে আটকে থাকা ফটো । এমনকি কেউ কেউ সেই উনিশ কুড়ি বছর বয়সেই থেকে যায় তবু ।
- তোমাদেরটা ?
- ভাঙবে ঠিক । কী করব ?
- অন্তত তোমাদের দিকটাও তো সবাই করতে পার ।
হাসল লাবণ্য । ধার দিতে পারব কিনা জানতে চাইল, ফেরত নাও হতে পারে । বলল, দেবেন ?
বললাম, কেন, পাশের বাড়ির । তোমার দেওর, ভাসুর - যারা আছে ওরাও কি বিরুদ্ধে তোমার ?
পুকুরের ওপারের ডুমুর গাছটা আমাকে টানে খুব । প্রায় পাড় ধরেই । আমগাছটা অবশ্য কয়েক হাত দূরেই । দেওয়ালের গা ঘেঁষেই । ডুমুরের সেই রোঁয়া লাগা পাতার কথা মনে পড়ে আমার । ছোট আর গোল সেই ফল । ডাল ভাঙতেই সাদা দুধ । আমরা বলতাম আঠা । টুনটুনির বাসা খুঁজতাম । লম্বাটে ঠোঁটের । রতন বলত, কায়দা দেখেছিস ? পাতা গুটিয়ে যেন সেলাই করা । মা টুনটুনি সেই পাতার বাইরে দাঁড়িয়ে দেখত চারদিক । একসময় `টু-ই-ই-ই' করে ডেকে উঠেই উড়ে যেত ।
ভাঙা দেওয়ালটাও সবসময় ফাঁকাই । ইট তবু কিভাবে যে ভাঙে কে জানে ? লাবণ্য বলল, হতো একসময়, সে অনেক বছর আগে - লাবণ্য এসেও দেখেছে- । আম, পেঁপে । পেঁপে গাছগুলি তো নেইই এখন ।
সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে এই শীতেই বিয়ে ঠিক হবে লক্ষ্মীর । মাঘ মাসেই । এখন মনে হচ্ছে, চিঠিতে সেই ছবিটার কথা একটু জোর দিয়ে লিখতে হতো । পিসির কাছে যদি থাকে । থাকতেও তো পারে । সেই উনিশ কুড়ি বছরের মেয়েটির আড়াআড়ি তাকিয়ে থাকা - সেই তির্যকতা ।
বিপিন আর সত্যদার ঝগড়া অনেক দূর গড়িয়েছে । একেবারে পার্টি অফিস পর্যন্ত । টিচার্স রুমে সত্যদা ইদানীং একেবারে চুপ । এমনকি পরীক্ষার ব্যাপার নিয়ে মিটিং-এ যখন ওর মতামত চাওয়া হল, শুধু বললেন, আমি আর কী বলব -।
অনেকবারই ইচ্ছে হয়েছে এ-পর্যন্ত, জিজ্ঞেস করি বিপিনকে । কী এমন হয়েছিল ? আমার দিক থেকে বুঝতেই পারছেন কিছু জিজ্ঞেস করাটাও এখন আতঙ্কের । স্রেফ নগেনবাবুর লোক- এই পরিচয়টাই ঝামেলার । আর টিচারদের মধ্যেকার ব্যাপার নিয়ে অবিনাশকে জিজ্ঞেস করাটাও আটকাচ্ছে খুব । হয়তো বলবে, আপনাদের শিক্ষিত লোকদের ব্যাপার । ওর মধ্যে লেখাপড়া জানা আর না জানা নিয়ে একটা কমপ্লেক্স কাজ করেই । আমাদেরকে কোনও মতে একটু খাটো করে দেখাতে পারলে ও তৃপ্তি পায় খুব ।
টিফিনে সুধাময় বলল, তোমাকে বলেছে কিছু সত্যদা ?
ও বলল, বলবে । সত্যদার সঙ্গে নাকি কথা হয়েছে ওর । বিপিনের ধারণায় ও নাকি এক সাংঘাতিক কিছু । এম. এস. সি-তে প্রায় ফার্স্টক্লাস । ও নাকি ইচ্ছে করলে অন্য অনেক চাকরিতে যেতে পারতো, স্রেফ নির্মলদার জন্যই- ।
- তার মানে ও কি দয়া করছে নাকি ?
সুধাময় বলল, হাবভাব তেমনিই । তাও যদি ভাল ফ্যামিলির হত । বিপিনদের বাড়ি নিয়ে নাকি অনেক কেচ্ছা । ওর দিদির ব্যাপারটা জানি কিনা জিজ্ঞেস করল ।
আমরা তখন টিচার্স রুমের বাইরে, বাইশ নম্বর ঘরের সামনে । একটা ছেলে এসে সুধাময়ের পেছনে দাঁড়াল- বুঝতে না দিয়েই অবশ্য । দূরের কোনও একজনকে যেন লক্ষ্য করছে । চোর চোর খেলছে নির্ঘাত । প্রায় গা ঘেঁষেই সুধাময়ের । ট্রেনের ছেলেগুলি তখন বড় রাস্তার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে । কেউ শিস দিল ।
সুধাময় বলল, সেদিনই বলতে পারতাম ওকে - স্রেফ চিত্কার চেঁচামেচির ভয়েই বললাম না ।
- কি হয়েছিল ?
কাগজের প্লেন উড়ছে, ছাদের উপর কিছু ছেলে লুকিয়েই, যেন দেখতে না পায় কেউ । খেলার সেই প্লেন ছুঁড়েই ওরা নীচে নেমে আসছে । খেলাই । কিন্তু পারে কেউ ? একটা প্লেন কখনও থাকে এত সময় ? আর নীচের ছেলেরা ? ছুটছে দেখ । ধরার জন্যই । আর প্লেনটা প্রথমে প্রায় সমান্তরাল ভাবেই এগিয়ে যায় অনেকটা । থামে । যেন মনে পড়ে গেল কিছু । গোঁৎ খায় । ফের এগোয় । বাতাসের ধাক্কায় কখনও ডানদিক বাঁদিক করে ।
দোষের মধ্যে সত্যদা নাকি অংকের রেজাল্টের জন্য সাবজেক্ট টিচারদের ঠাট্টা করে বলেছে কিছু । সুধাময় বলল, ঠাট্টাই । যেন, ওরা নিজেরা শিখে আসেনি কিছু । যেন ওদের সার্টিফিকেট পয়সা দিয়ে পাওয়া । হ্যাঁ, এটা তো ইয়ারকিই । এটুকু ঠাট্টা বুঝবে না ? ছেলেটা নাকি ফায়ার হয়ে উঠল একেবারে । কী মেজাজ ! চিত্কার । সত্যদাকে নাকি ব্যক্তিগতভাবেই আক্রমণ করে উঠল একেবারে । সুধাময়কে বললাম, বিপিনের কথাগুলি আমি শুনেছি । সেই কারুর দয়ায় চাকরি পাওয়ার কথা, পার্টি করার কথা, পার্টি করার উদ্দেশ্যের কথা ।
বিপিন ভালো করেনি । ছোটমুখে বড় কথাই । আর তেমন করে ভাবলে, ওর চেয়ে বেশি নম্বর পাওয়া ছেলেরাও অসংখ্য ঘুরে বেড়াচ্ছে । স্কুলের চাকরিতে মাইনেটা তেমন কম কোথায় আর ? বললাম, পরে কিছু বলেছে ? অন্তত দু:খপ্রকাশের মতো কিছু করলেও তো পারত ।
সুধাময় বলল, পার্টি অফিসে খবর গেছে । নির্মলদাকেও জানানো হবে । বললাম, পার্টি অফিস পর্যন্ত না গিয়ে নিজেদের মধ্যে একটা মিটিং ডাকলে হতো না ? বা স্বরূপবাবু নিজে যদি ডেকে পাঠাতেন ।
স্বরূপবাবু চেষ্টা করেছেন । কিন্তু বিপিনের সেই গোঁ । সত্যদাকে ক্ষমা চাইতে হবে আগে । দু:খপ্রকাশ করতে হবে ।
ওর গায়ে লেপটে থাকা ছেলেটিকে ধমকে উঠল সুধাময় । কি হল ? ছেলেটা ছিটকে বেরিয়ে গেল । দূর থেকে হেসেও উঠল কারা যেন । ছোটরাই । সুধাময় বলল, এমনিতে এটা তো ঠিকই, হাজারগুণ মনোযোগ দিলেও স্কুলের রেজাল্ট এর চেয়ে ভালো করা মুশকিল । যা সব ছেলে ভর্তি হয় । ভবময়ী স্কুলের কথা ভাবলে এরা প্রায় ভিখিরীই । ওই স্কুলের এক একটা ছেলের নাকি তিনটি করে মাস্টার রাখার ক্ষমতা । ছেলেগুলিকে দেখলেই নাকি বোঝা যায় । চোখেমুখে বুদ্ধি খেলে । আর এখানে ? সুধাময় উঠোনের দিকে তাকাল ।
শেষ পিরিয়ডে অ্যাডিশনাল ক্লাস ছিল একটা । অংক । ক্লাস নাইনের । দুটো মাত্র ছেলে । বললাম, শরীরটা খারাপ লাগছে খুব- । ওরা বলল, চলে যাব স্যার ?
এইট কি নাইনে থাকতে একবার স্কুলের ঘন্টা শুনেছিলাম । স্কুল থেকে নয় অবশ্য । অনেক দূরের সে খালপাড় থেকে । রতন আর আমি । মাছ ধরছি স্কুল পালিয়ে । জমা হওয়া জল-ঝাঁঝির দাম সরিয়ে একটু ফাঁক করে বড়শি ফেলছি । আমরা তখন চুপ করে বসে । ফাতনায় চোখ । ময়ূরের পালকের । সাদা । রতনই হঠাৎ চমকে উঠল । বলল, শুনছিস ?
- কি ?
- শুনতে পাচ্ছিস না ?
রতন বলছিল, ঘন্টা- আমাদের স্কুলের- ।
বহুকাল পর সেই ঘন্টাধ্বনি শুনতে পেলাম হঠাৎ । যেন লেগেই ছিল কোথাও শরীরে । নাকি মাথায় । চুলেই । অথবা আঙুলের ফাঁকে কোথাও । নখের ময়লায়, বা প্যান্টের সেফটিপিনে ।
জল ঝাঁঝির সেই ফাঁকের কথা মনে পড়ে আমার ।
দরজায় শব্দ হল একটা । কে ? একেক সময় টিকটিকি এমন বোকা বানায় । যেন ডাকছে কেউ । দরজায় টোকা পড়ছে যেন । ফের শব্দ হল না ? কে ?
- আমি ?
মলি । উঠে দাঁড়াতে ইচ্ছে করছিল না একদম । তার মানে কান্নাকাটি ।
- কি হল ?
দরজা খুলে দিতেই হুড়মুড় করে ঢুকল মলি । বলল, ছাদে চলুন ।
- খাইনি এখনো । খিদে পেয়েছে খুব ।
- সত্যি- । খাবার নেই কিছু ? করব ?
মলিকে বললাম, কিছু ভাল লাগছে না প্লিজ ।
সুইচ টিপে আলো জ্বালালাম । বললাম, বিশ্বাস কর, চলে যেতে ইচ্ছে করছে কোথাও ।
চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল মেয়েটা । ঘড়ির কাঁটা তখন যেন স্থির । লম্বা কাঁটাটা যেন সাত-এর ঘর থেকে নড়বেই না । মলির এই চুপচাপ থাকাটা ছিল বেশ অস্বস্তিকর । যখন আমার কথাগুলি যে ওকে আঘাত করেছে এই ব্যাপারে আমি নিশ্চিত । আর আমি ওকে আঘাত করতে চেয়েছি ।
জানতে চাইলাম, ঝগড়া হচ্ছিল কী নিয়ে ?
উত্তর নেই । ওর ভারী ঠোঁট দুটো যেন আঠা দিয়ে আটকে । চোখদুটো মাটির দিকে । নখ দিয়ে কাপড় জড়াচ্ছে ।
ফের জানতে চাইলাম, কি হল ? বলবে না ? ঝগড়া হচ্ছিল কী নিয়ে ?
টিকটিকিটা এবার ঠিকই ডেকে উঠল । আর ওর লাল চোখদুটো যেন জ্বলতে শুরু করল একেবারে । দেওয়াল বেয়ে এক পা এক পা করে এগোচ্ছে । টিকটিকিটা । ধূসর পিঠের, লেজটা সামান্য নড়ছে । হয়ত পোকা দেখেছে কোনও । বা পিঁপড়ে । আমার চোখে ধরা পড়ছে না । দেখতে পাচ্ছি না । হয়তো একটামাত্র ছবির পেছনেই- মলির দাদুর বাবা, ছবিতে অবশ্য অনেকটাই খাওয়া । উই আর জলেই সম্ভবত । বাঁদিকের কাঁধ আর গলার দিকটা একেবারেই নেই । একটা পা পুরোপুরি হলুদ । নাম নেই কোনও ? নিশ্চয়ই ছিল । অনেকদিন টুল নিয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে নাম পড়ার চেষ্টা করেছি । অনেকদিন । বোঝা যায় লেখা ছিল কিছু একটা, এখন নেই ।
টিকটিকিটা ঝাঁপাল এবারে । আরশোলা । ঘনঘন লেজ নাড়ছে । টিকটিকিটা । আরশোলার মুখটা সম্পূর্ণ অদৃশ্য । শুধুমাত্র পা-গুলিই । রোঁয়াগুলো লালচে পা-গুলি নড়ছে খুব । ছাড়া পাওয়ার আশাতেই । এমনকি পাতলা পাখনাগুলিও । আর পাখনাগুলির স্বচ্ছতাও ।
মলি বলল, আমাকে দয়া করতে পারেন না আপনি ? শুধুমাত্র এ বাড়ি থেকে অন্য কোথাও- এরপর যা খুশি করুন আপনি । যা খুশি-, এমন কি লাবণ্যও-।
দূরে কাঁসর বাজছে কোথাও । মন্দিরেই । সোনার তৈরি সেই বিগ্রহ । বিশাল সেই ঘরের প্রান্তে । যখন ছাদ জুড়ে চাঁদোয়া । ঝালর । মেঝে জুড়ে মোজাইক । জ্যামিতিক চিত্র । আর সিংহাসনের মধ্যে মালা আর ফুলের আড়ালে প্রায় অদৃশ্য সেই মূর্তি ।
তুলি নাকি আমার নাম করেই বলেছে । চিত্কার করেই । ওদের মা এমনকি পাশের বাড়ির লাবণ্যও শুনে থাকতে পারে । বলেছে, সমীরণদা দিকে হাত বাড়ানোর আগে নাকি মলির ওর নিজের দিকে তাকিয়ে নেওয়া উচিত ছিল । আমার লেখাপড়া, ডিগ্রি এসব কিছুই নাকি মলির সেভেন পর্যন্ত পড়া বিদ্যায় বোঝার মতো নয় ।
পশ্চিমের আকাশ এখন অন্ধকার । জল আর আকাশে এখন কোনও তফাত নেই আর । বললাম, বাইরে চলো, আলো নেভাবো-। একটু চাপা গলাতেই অনুরোধ করলাম ফের, একটু বাইরে চলো প্লিজ, নাটক ভাল লাগছে না আমার ।
মলি বলল, এটাই তার মানে আপনার শেষ কথা ।
বিপিনের দিদি নাকি চলে গেছে । সুধাময় বলল, বিপিন স্কুলে আসছে না কদিন । সত্যদা টিচার্স রুমে সময় দিচ্ছে আজকাল । আগেকার মতোই নস্যি নিচ্ছেন ফের । আগেকার মতোই সেই ইয়ারকির দিনগুলি ফিরে আসল যেন । কথায় কথায় ফুট কাটা । খুঁত ধরা অন্যের, আর `হো-হো-' করে হেসে ওঠা ।
- ওদের বাড়ি গেছে কেউ ?
- কে যাবে ? তাছাড়া ও কি ভালো ভাবে নেবে ? আগে হলে ঠিক-, হয়ত সত্যদাই- ।
- কার সঙ্গে-? মানে ছেলেটা- ।
সুধাময় বলল, বাচ্চাই বলা যাবে । বড়জোর চব্বিশ-পঁচিশের । ফাংশানে গান গায় ।
-বিপিনের দিদিও তো- ।
ওদের নাকি ফাংশানেই আলাপ । বিপিনের দিদির নাম জবা । দেখতে নাকি একেবারেই সাধারণ । সুধাময় বলল, ওর নামের মতোই ।
- বিপিন তো ওর দিদির জন্য তোমাকেই টার্গেট করেছিল ।
- কী বাজে বকছ- ।
সুধাময়ের কথায় বাজে নয়, সত্যি- । ও নাকি একবার সত্যদাকে বলেছিল । ও চেয়েছিল, সত্যদাই বলুক ।
সাত পিরিয়ডে বিপিনের এইটের ক্লাসটা সত্যদাই নিয়ে নিল । অংকের জায়গায় ইতিহাস । নাইনে ক্লাস ছিল একটা । না হলে আমাকেই নিতে হত ।
- ওর বয়স কত হবে ? মানে বিপিনের দিদির ?
সুধাময়ের মতে অন্তত আটাশ । আটাশ থেকে ত্রিশের মধ্যেই । ছেলেটার নাকি ভালো করে গোঁফ-দাড়িই গজায়নি । বারাসতের ওদিকে থাকে কোথায় । ছেলের বাড়ির লোকজন এসে নাকি হুজ্জতি করেছে খুব । বাবা-মায়ের এক ছেলে । অবস্থাও নাকি খারাপ নয় ।
এ সময় জানালা দিয়ে রোদ ঢোকে । ঠিক টেবিলের যেখানে আমাদের থাকার জায়গা সেখানেই । মানে সুধাময়, হরিশ আর আমার । হরিশ বলল, বিপিনের এখন না জানার ভান করলে তো হবে না ।
বোঝা গেল হরিশও শুনেছে সব । কাগজ পড়ছিল মন দিয়ে । পার্টির কাগজই । সম্পাদকের পাতায় নতুন শিল্পনীতির বিরুদ্ধে লেখা বেরিয়েছে কার । মানুষকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে ।
প্রতীম বলল, ওদের তো লাভই-, বিনে পয়সায় অমন একটা ছেলে- । সত্যিই বাচ্চা ।
- দেখেছো ?
- প্রায়ই-, আমরা ভাবতাম- ।
হয়তো সত্যিই । সন্দেহ করার কিছুই নয় । যেন ভাই-বোন । বা অন্য কোনও আত্মীয়তাও থাকতে পারে ।
অনেকেই দেখেছে ওদের । পাড়ার লোকেরা একেবারে থ । ওরা ভাবতো, গান শেখে একই লোকের কাছে । বা ফাংশানের ডাক পেয়ে যাচ্ছে কোথাও । পাড়ার লোকেরা নাকি মেনে নিতে পারছে না কেউই । তাছাড়া টিকবে নাকি এ বিয়ে ? ও আসলে শরীর-টরীর দেখিয়েই পটিয়েছে । ছেলেমানুষ, স্রেফ মোহে পড়েই- । বড়জোর দু-এক মাস । না, পুলিশে জানাবার প্রশ্নই নেই কোনও । দুজনই প্রাপ্তবয়স্ক । ছেলেটা নাকি ব্রাহ্মণ ।
পাঁচ পিরিয়ডের শেষে সত্যদা ডাকলা একবার । বলল, তোমার সঙ্গে কথা আছে একটা, থেকো ।
দু'বছর আগে এই স্কুলে যখন আসি, তখন বড়জোর গোটা ষোল রুম । একতলায় দশ আর দোতলায় ছ'টা । এখন সেখানে চব্বিশটা । একতলাতেই গেটের দিকেই দুপাশে দুটো করে হল নতুন । সামনের বছরই নাকি তিনতলা হওয়ার কথা । উঠোনটা তৈরি হবে ভাল করে । পেছনের দিকের কারনানীদের ফ্যাক্টরির কিছু জায়গা পাওয়ার চেষ্টা করছে স্কুল । ফ্যাক্টরিটা দীর্ঘদিনই বন্ধ । মানে আমার চাকরিতে আসার অনেকদিন আগে থেকেই । পুকুর আছে একটা । ওদিককার কিছু জমি পেলে ছেলেদের ছুটোছুটির সুবিধে হবে খুব । স্বরূপবাবুর একটা যুক্তি খুব পরিষ্কার । আমরা চাইব স্কুলের ভাল হোক । যে যা খুশি করুক রাজনীতিতে । আর রুলিং পার্টির লোক এলে অসুবিধাটা কোথায় ?
সত্যদা বলল, একটু কনফিডেনসিয়াল । বলল, ওকে যেন ভুল না বুঝি । এটা স্কুল, রাজনীতির জায়গা নয়, আর আমার প্রতি ওর কোনওদিনই কোনও খারাপ ধারণা ছিল না । বলল, নগেনবাবুর লোক হলেও স্কুল আমার দ্বারা উপকৃতই হয়েছে । ছেলেদের প্রতিক্রিয়া তেমনই । জানতে চাইলেন, ওর সঙ্গে বিপিনের ব্যাপারটা জানি কি না কিছু । বললাম, এমনি - মানে সুধাময়ের কাছ থেকে যা শোনা ।
স্কুল ছুটি হয়ে গেছে অনেকক্ষণ । লতানো গাছগুলিতে গোলাপি ফুলগুলি পাতলা কাগজের মতো পাঁপড়ি নিয়ে কাঁপছে । ডালগুলি যেন ভার আর রাখতে পারছে না - পিলারের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধা আছে যদিও । জানালা বন্ধ করার শব্দ হচ্ছে । হ্যাঁ, জানালা শব্দ করেই যেমন বন্ধ হয় । যেন ধৈর্য্য নেই আর । ঘরের মধ্যে তখন ছেঁড়া কাগজ । নীল কালিতে লেখা রোল নম্বর, নাম । বোর্ডের গায়ে মানুষের মুখ । থুতনিতে দাড়ি । চোখে চশমা । আর মানচিত্র- সেখানে নদী, পাহাড় । আর সংখ্যাও । বা জ্যামিতির চিত্র । তেকোনা, চৌকোনো, পাঁচকোনা সীমাবদ্ধ সমতল ক্ষেত্র ।
- কিছু বাজে রিক্রুটমেন্ট হয়েছে ।
সত্যদা বলল, না নগেনবাবুর জন্য নয় । রাজনীতির চাপেই । ওর কথা, স্রেফ পার্টির জন্য নিতে হয়েছে বিপিনকে । এমনিতে স্কুল সার্ভিস পাস করেছে যখন, হয়ত হতই কোনও না কোনও স্কুলে কিন্তু প্যানেলের উপর দিককার ছেলেদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়ার আগেই ওর নাম উঠে আসা- আর একেবারে এই স্কুলের জন্যই- এটা স্রেফ নির্মলদার মন রাখতে গিয়ে । সত্যদার কথায়, নির্মলদাকে বলা যাচ্ছে না কিছু । উনি নাকি লোক ভাল খুব । দয়ামায়া আছে । এখন কিছু লোক যদি ঠকায়- ।
বিপিনের দিদিই নাকি ধরেছিল নির্মলদাকে । বিপিনের দিদি নাকি মৌখিক পরীক্ষা ম্যানেজ করার জন্যই ধরেছিল নির্মলদাকে । হয়ত বিপিনই বলে থাকবে ওর দিদিকে । স্কুল সার্ভিসে লেখার পরীক্ষা পাস করলে চাকরি যে হবে তার গ্যারান্টি কোথায় । মৌখিকে বাদ পড়ে অনেকে । বিপিনের দিদি নাকি বলেছিল, শুধু ফাংশান করে এতগুলি লোক- । কোনও একটা ফাংশানেই- ।
- এখন কেউ যদি বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে তোমাকে ঠকায়- মানে মিথ্যে কথা বলে - জোচ্চুরি করে- ।
আমি কোনওদিনই কারও গ্রুপে নেই । স্কুলে সবার সঙ্গেই সহজ সম্পর্ক আমার । এক্সট্রা ক্লাস নিয়ে গজগজ করিনি কোনওদিন । কোনও কমিটির মেম্বার হওয়ার ইচ্ছে নেই । বললাম, আমার আবার মতামত-, আপনারা যা ভাল বুঝবেন- ।
- সবাইকে মার্কশিট, সার্টিফিকেটের অরিজিনাল উইথ জেরক্স জমা দিতে বলা হচ্ছে- ।
সত্যদা বলল, স্টাফ কাউন্সিলের সেক্রেটারি হিসাবে আমার কাছে সবাই সমান । তবু- ।
ওর কাছে নাকি খবর আছে বিপিনকে নিয়ে । ওর ধারণায়, ক্লাস টেনের ছেলেদের দিয়ে আমার বিরুদ্ধে গন্ডগোল নাকি বিপিনের হাত ছিল । যেহেতু নতুন রুটিনে ক্লাস টেন পায়নি- । সত্যদা বলল, তুমি শুধু নিউট্রাল থেকো, ওর স্বরূপটা ফাঁস করতে হবে- পুরো ফ্রড ।
সত্যদার কথায়, শুধু ওরটাই । বিপিনের মার্কশিট সার্টিফিকেটই ভেরিফাই করতে পাঠাবো । গোপনেই । লোক নাকি জানাশুনা আছে । এরপর শুধু ওকে জানানো । না চাকরি খেয়ে নেওয়ার ইচ্ছে নেই । শুধু জানিয়ে দেওয়া- উল্টোপাল্টা কথা বলার আগে নিজের পজিশনের কথাটা একটু যেন মনে রাখে ।
অবিনাশ দেখা গেল ব্যাপারটা জানে না ভাল করে । বলল, কী ব্যাপার বলুন তো, স্কুলের কিছু রেকর্ড নাকি পাওয়া যাচ্ছে না । সবার কাগজপত্র জমা দিতে বলেছে ফের ।
তার মানে ব্যাপারটা শুধুমাত্র সত্যদা আর স্বরূপবাবুরই । আমাকে বলা হয়ত গ্রুপের বাইরে বলেই । গ্রুপের সবাই নিশ্চিত জানে ব্যাপারটা । সুধাময়, হরিশ বা আর সবাই ।
অবিনাশের মতো লোকেরা সহজেই নিজেকে খাটো করে ফেলতে পারে । সহজেই নিজের হাঁটুর বয়সী ছেলেকে বলতে পারে, ওকে যেন তুমি বলেই ডাকা হয় । এতবড় বাড়ির ছেলে হয়ে কিভাবে যে পাল্টে নিল নিজেকে কে জানে ? ওর নাকি স্যাক্রিফাইস আছে অনেক পার্টিতে । আটষট্টি উনসত্তর, সত্তরে নাকি রীতিমতো নামকরা । লাল টুপি পরে মার্চপাস্ট করেছে রাস্তায় । হাতে লাঠি । রাইফেল নিয়ে ইলেকশন করেছে । সেসময় নাকি ও একাই একশ । শুধু বুথে গিয়ে দাঁড়ানো । বলছিল, ওর নাকি অনেক গল্প । জানতে চাইছিল পার্টি করিনি কেন কোনওদিন । সত্তরের দশকে নাকি কোনও না কোনও পার্টি করতেই হত আমাকে । পার্টি না করা মানেই দালাল । জানতে চেয়েছিলাম একদিন, তার মানে আমি কি দালাল ? ও বলছিল, রাজনীতির বাইরে আছে নাকি কিছু ?
অবিনাশ ইদানীং রাজনীতির উপর হারানো উত্সাহটা যেন ফিরে পেয়েছে । পার্টি অফিসে সময় কাটাচ্ছে অনেক । এম. এল. এ. নাকি ওকে একদিন দু:খ করে বলছিল, সেই সব দিন আর ফেরার নয়- সেইসব উত্তেজনার -।
ওরিয়েন্টালের ব্যাপারটা নিয়ে অবিনাশ নিজের মতটাকে বেশ শক্ত যুক্তি দিয়ে দাঁড় করিয়েছে । বলল, লোকসংখ্যা যে হারে বেড়েছে বাড়িঘর কি হয়েছে সে হারে ? হয়নি । আর সবাই দেখুন সেই শহরেই- বা শহরের কাছাকাছি- ।
ওরিয়েন্টাল বন্ধ বহুদিন ধরেই, কী সব যন্ত্রপাতি তৈরি হত । মালিকের ইচ্ছে ছিল, বিক্রি করে বাইরে চলে যাবে কোথাও ।
- যায়নি কেন তখন ?
- বললেই তো হবে না । আপনি সত্য বলছেন না মিথ্যে বলছেন কে বুঝবে ? ফ্যাক্টরির বন্ধ হওয়ার জন্য তো আর শ্রমিক দায়ী নয় । ট্রেডইউনিয়ন, গভর্নমেন্ট মিলে চেষ্টা করেছে অনেক । আর এখন যা আছে লোহার দামও উঠবে না- ।
নগেনবাবুর সম্বন্ধেও নাকি শোনা যাচ্ছে কিছু । জানতে চাইলাম । বললাম, খুব খারাপ কিছু ? ও বলতে চাইল না । সেসব পার্টির ভেতরকার ব্যাপার । তাছাড়া আফটার অল নগেনবাবু পার্টিরই একজন । ভাল খারাপ পার্টিই বুঝবে ।
স্কুল থেকে ফেরার পর আমদের দেখা হয় না বললেই চলে । ছুটির পর আমার কাজ বলতে বাড়ি ফিরে যাওয়া । আর ঘুমোনো । সন্ধ্যার পর বাইরে যাওয়া । ক্লাবঘর । গঙ্গার পাড় ধরে হাঁটা । বারো মন্দির । শ্মশান । শ্মশানের ধোঁয়া । সত্যি কথা বলতে কি এ শ্যামপুরে এসেই মানুষ পোড়ার গন্ধ প্রথম টের পাই আমি । এখন অবশ্য অভ্যাস হয়ে গেছে । প্রথম প্রথম ভাবতাম, এসব আবার কি ? কোথায় কি পুড়লো ? অবিনাশই জানালো একদিন । শ্মশান । তেমন বাতাস না থাকলে বা বিশেষ করে শীতকালে, ধোঁয়া খুব একটা দূরে যায় না । কাছাকাছিই নামে । জানতে চেয়েছিলাম, অসুবিধে হয় না ?
গঙ্গায় চড়া পড়ছে খুব । প্রায় মাঝ গঙ্গায় গিয়ে নৌকোয় উঠতে হচ্ছে আজকাল । আমি অবশ্য উঠিনি । আর একে অবশ্য নৌকা না বলে ভটভটি বলাই ভাল । হঠাৎ করেই ভটভট শব্দ তৈরি হওয়া । আর দূর থেকে দেখা সেই মানুষজন আর সাইকেল নিয়ে নৌকোর ত্রক্রমে ছোট হয়ে যাওয়া ।
রাত নটার পর ইচ্ছে করেই রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছি । আসলে অবিনাশের সঙ্গে একবার কথা বলে নিতে চাইছি । সার্টিফিকেট চাওয়ার ক্ষেত্রে আমার কোনও ব্যাপার থাকলে অবিনাশ জানতে পারবে ঠিক । আমার প্রতি কারও কোনও রাগ বা বিদ্বেষ ওর অন্তত টের না পাওয়ার কথা নয় । ওর বউকে হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে আনার পর অবিনাশ এমনকি স্বরূপবাবুকেও বলেছে, সমীরণদার জন্যই- । এমনকি ওর বউয়ের জন্য সারারাত হাসপাতালে কাটানোর ব্যাপারটাও বলতে বাকি রাখেনি কাউকে । আর সেই চুলের ব্যাপারটা ? ওর বউ পর্যন্ত কৃতজ্ঞতা দেখিয়েছে । হেসেছে তাকিয়ে ।
দোতালায় ওঠার আগে বললাম, এত লোক তোমাকে ভালবাসে কেন বল তো ? এম. এল. এ. থেকে শুরু করে- ।
হাসল অবিনাশ, বলল, আপনাদের আশীর্বাদ ।
ঘরে ফিরে দেখি জানালা দিয়ে আলো ঢুকেছে খুব । হলুদ । বিছানায় ছড়াছড়ি একেবারে ।
- শেষ পর্যন্ত অবিনাশের মন জুগিয়ে চলতে হচ্ছে- ?
- কে ?
কেউ বলল যেন । ঘরের মধ্যেই । দরজা নিজের হাতে বন্ধ করলাম এইমাত্র । মাথার উপর পাখা । পুরনো আমলেরই । ভারী খুব । আর টিকটিকিটাও কী ভেবে যেন ঠিকঠিক করে উঠল ।
- এত গোপন কথা থাকে মানুষের -।
(পরবাস-৪০, জানুয়ারি, ২০০৮)