গতবছর কলকাতা যাবার আগেই খবর পেয়েছিলাম যে সন্দীপন গুরুতর অসুস্থ । গিয়ে শুনলাম সে সামলে উঠেছে । যে ডাক্তার তার দেখাশুনো করছিলেন -- ডাক্তার, কবি ও সন্দীপনের ভক্ত বিশ্বজিৎ চ্যাটার্জি -- আমাদের মতোই চিকিত্সাশাস্ত্রকে নয়, অদৃশ্য ভগবানকে ধন্যবাদ দিয়ে বললেন যে সন্দীপন বিপদমুক্ত । কিন্তু তখনো সে তার তিনতলার ফ্ল্যাট থেকে বেরুচ্ছে না , কারণ সিঁড়ি ভাঙতে কষ্ট হয় । আমিও তাকে দেখতে যেতে পারলাম না কারণ আমার হাঁটুতে তখন এমনই ব্যথা যে তিনতলায় ওঠা অসম্ভব । জ্যোতি গিয়েছিলো অবশ্য, সঙ্গ নিয়েছিলো আমাদের সদ্যকিশোর নাতি নিশান যে সে বছর উপহার পেয়েছে একটি ক্যামকর্ডার । তার ছবি তোলার হাতেখড়ি হলো সন্দীপন-রীনা ও জ্যোতির আড্ডার ছবি তুলে । না জেনে সে সংগ্রহ করে ফেলেছে একটি অতি মূল্যবান দলিল, আমাদের কাছে একটি অতি মূল্যবান স্মৃতি ।
কারণ সন্দীপন যদি লেখক নাও হতো শুধু কথোপখনে তার ঝলকের জন্যই আমাদের স্মৃতিতে অক্ষয় হয়ে থাকতো সে । লেখাতে যেমন, কথাতেও তেমন, সন্দীপন ছিলো `গুরু' -- একই সঙ্গে শুষ্ক ও সরেস, (ছুরি ও সুরা) তার মতো সুক্ষ্ম রসিকতাবোধ, কি লেখায়, কি কথায়, কজনের আছে মনে করতে পারি না ।
সন্দীপনকে কবে প্রথম দেখেছিলাম মনে করার চেষ্টা করছি । জ্যোতিদের গ্রে স্ট্রীটের বাড়িতে কি ? বেকার ল্যাবরেটরির মাঠে ? কলেজ স্ট্রীট কফিহাউসে ? আমাদের কর্নফিল্ড রোডের ফ্ল্যাটে দীপকের (মজুমদার) সঙ্গে এক রবিবার সকালে সে এসেছিলো নাকি ? মনে নেই । মনে কি থাকে ? অনেক, অনেক দিনের পরিচয়, চল্লিশ, পঁয়তাল্লিশ, পঞ্চাশ বছরও হতে পারে । তখনকার, তার সেই কৈশোর পেরুনো সদ্য তরুণ চেহারাটা শুধু মনে আছে । তখন যারা লিখতে শুরু করেছে তাদের সকলের থেকে আলাদা -- ছিপছিপে বনবেতসের মতো, লম্বা জোব্বা পরিয়ে দিলে তরুণ ইয়োরোপিয় মনীষী বলে চালানো যায় ।
বস্তুত, জ্যোতি বলে, বাংলার শ্রেষ্ঠ ফরাসি লেখক সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় । স্তাঁদাল, বোদলেয়রের জগতের মানুষ সে, `আনুই'-ক্লিষ্ট । আমাদের প্রজন্মের আধুনিকতম তো বটেই ।
 
 
 
উপন্যাসের নায়কেরা সাধারণত হয় আমাদেরই মতো `স্বাভাবিক' মানুষ, তারা আঘাত পায়, আঘাত দেয়, ভালোবাসে, ভালোবাসে না, ভালোবাসা পায় কি পায় না -- উপন্যাসের প্রতি ধাপে আমরা নায়ক নায়িকার দু:খে ব্যথিত, জয়ে গর্বিত, সুখে সুখী হই । সন্দীপনের চরিত্রগুলির বেলায় এই নিয়ম খাটে না । তার নায়ক অথবা বি-নায়ক -- ত্রিঞঠ-চ্ংশধ (নায়কই শুধু, নিজেকে নিয়েই তো সে লিখে গেছে । মেয়েরা তার উপন্যাসে নেগেটিভ চরিত্র, কিছুটা বা সূক্ষ্ম অনুভূতি শূন্য ।) আমাদের একটু দূরে ঠেলে দেয়, আমরা তার সঙ্গে একাত্ম হতে পারি না, হতে চাইও না, সত্যভাষণের কারণে মাঝে মাঝে বিতৃষ্ণা বোধ করি বুঝি বা । হয়তো সেটাই লক্ষ্য ।
দুটি ঘর, একটি নীল মশারি, চাকুরিজীবী স্ত্রী, একটি কন্যা ও একটি পরকিয়া প্রেম (পরকিয়ার সবচাইতে প্রিয় জায়গা কবরখানা--জানি না তার কোনো প্রতীকী অর্থ আছে কি না) -- সন্দীপনের পক্ষে এই ছিলো যথেষ্ট । পাহাড়, নদী, সমুদ্র, দেশ-বিদেশ, নানান সম্পর্ক, সামাজিকতা, দর্শন সে এই সামান্য উপকরণ সম্বল করেই নিয়ে আসে । এইটুকুতেই তার চলে যায় । সত্যিই তো, প্রতিটি মানুষেরই কি ওই উপকরণ সম্বল করেই জীবন কাটে না ? সন্দীপন এক সত্যবাদী, অনাসক্ত অথচ রসিক লেখক, সব ভাষাতেই এই সমন্বয় বিরল । সুনীলের মতো `দৈব পিকনিকে' আসেনি সে, জীবনকে আবৃত করেনি মাধুর্যে, করেনি জীবনের সঙ্গে ফ্লার্টেশাস সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা । জীবনের সঙ্গে সন্দীপনের সম্পর্ক অতি শীতল ও অ্যানালিটিকাল । ব্যক্তিগত জীবনে যে সর্বদা সত্যভাষণ করতো তা নয়, লেখার ব্যাপারে সে পরম সত্যবাদী । খুব একটা কল্পনারও আশ্রয় নেয়নি । ওর
`প্রতিদিন'-এ প্রকাশিত একটি লেখায় সন্দীপন লিখেছিলো যে সে মেফিসটোফিলিসকে বন্ধু হিশেবে পেয়েছে--তার যে ছায়া পড়ে না তা শুধু সন্দীপনই লক্ষ করেছে । শয়তানের এই চিন্তা, এই ছায়াবিহীনতার কল্পনা ইয়োরোপিয়--ভারতীয় ভাবনায় শয়তান আসেনি ।
সন্দীপনের উপন্যাসের চেয়েও আকর্ষণীয় তার সাহিত্য সমালোচনা । আমাদের `কলকাতা' পত্রিকায় তার একটা কলাম ছিলো--`অ্যাকুইরিয়ম' । কিছুই ছিলো না পবিত্র--
স্বর্গের পথে রওনা দিয়েছেন জীবনানন্দ, রবীন্দ্রনাথ এগিয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন তাঁকে স্বাগত জানাতে । দেখেন সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি আর পাম্প-শু পায়ে কেলোকুলো লোকটা দিব্যি গটগট করে স্বর্গের দিকে হেঁটে আসছে । পথ অনেকখানি । দীর্ঘ কথাবার্তা দুজনের--সন্দীপনের মতে এরকম :
জী । চিঠি দিয়েছিলাম আপনাকে । দু-একবার ।
র । উত্তর দিইনি ?
জী । না ; তবে আশা ছিল যে পাব । বিশেষ করে হ্যারিসন রোডের প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং থেকে যেটা লিখেছিলাম । হতাশা আর আগুনের কথা যেঝানে ছিল । ছিল ইনফার্নো আর দান্তের কথা । পড়ে চটে গিয়েছিলেন বোধ করি ।
র । হুম । তখন বয়স কত ছিল তোমার ?
জী । বাইশ-তেইশ ।
র । না । যে পরে `আট বছর আগে একদিন' লিখবে, `বোধ' লিখবে -- তার কৈফিয়ৎ হিসেবে ঠিকই ছিল চিঠিটা । .... তোমার গুপ্ত গদ্য-সাধনার আগাম জামিনের জন্য আবেদন । আমার কথা বাদ দাও । আমি তো উপন্যাস লিখতেই পারলাম না ।
জী । কেন `গোরা' ?
র । হ্যাঁ । কিন্তু সে তো আর `ওয়ার অ্যাণ্ড পীস'-এর মতো নয় কিছু । প্রুস্ত বা জয়েসও নয় । দা নভেল অব বেঙ্গল প্রবন্ধে তুমি তো সেই কথাই বলেছ । আমি তো তখন পড়িনি ওই সব । ওই প্রুস্ত-ট্রুস্ত । তা, তুমি তো বাপু বিভূতি, তারাশঙ্কর, মানিককেও ঔপন্যাসিক হিসেবে মানোনি । অবশ্য ওরাও তো সব এখানে বসবাসে জন্য অ্যাপ্লাই করেছে । শরণার্থী তাঁবুতে আছেও কয়েকজন । এই সেভেন্থ হেভেনে জায়গা পাওয়া বড় চাডিডখানি কথা নয় । আমার পরে তো তুমিই প্রথম ।
জী । হ্যাঁ । `গোরা'-কে বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস হিসেবে মেনে নিতে আমার দ্বিধা ছিল । এখনও আছে ।
র । তোমার ওই কবিতাটা `কবিতা' পত্রিকায় যখন প্রথম বেরল -- কী যেন নামটা ছিল ?
জী । `মৃত্যুর আগে' ।
র । হ্যাঁ-হ্যাঁ । শেষ লাইনদুটো ছিল "কী দেখিতে চাই আর ... প্রান্তরের কুয়াশায় উড়ে যেতে দেখিনি কি কাক ?"
জী । বুঝিতে ।
র । অ্যাঁ ?
জী । `দেখিতে' ছিল না । ছিল `বুঝিতে' । তবে এখন বুঝলাম, `দেখিতে' হলেই ঠিক হত ।
র । আ হা-হা হা হা হা । পড়েই বুদ্ধদেবকে লিখলাম--
জী । লিখলেন `চিত্ররূপময়' । শুধুই চিত্ররূপময় ! আমি কি আর কিছু নয় ?
র । কিন্তু তখনও তো ওইটে ছাড়া তোমার আর কিছু পাড়িনি বাপ । ওই মন্তব্য শুধু ওই লেখার জন্য । তোমার পদ্য-গদ্য--যাবতীয় লেখা সব তো পড়া হল এখানে । টলস্টয়কে বললাম, দেখুন দেখুন । এই সেই লেখা যেখানে অথর বলে কিছু নেই -- লেখা যেখানে জন্ম দিচ্ছে লেখকের । কবিতা জন্ম দিচ্ছে কবিকে । যেখানে আগে গান, তারপর তার স্বরলিপি ; কেউ যা জানত না, এই সেই চাঁদের ও পিঠ । তখনই কথা উঠেছিল, তোমাকে এখানে আনার ।
জী । যাকগে । ভুল কার না হয় !
র । টলস্টয়ের ভুল হয়নি ? উনি তো শেক্সপিয়রকে লেখক বলেই মানতেন না । অথচ, আজ উনি মনে করেন, লণ্ডন ব্রিজ দাঁড়িয়ে আছে যে দুটো থামের ওপর -- তার একটা শেক্সপিয়র হলে আর একটা টি, এস এলিয়ট ।
জী । এখন এলিয়টকে তাহলে মানেন আপনি ? বোঝেন টোঝেন !
সন্দীপনের চিঠিও চরিত্রানুগ । জ্যোতিকে সে বেশ কিছু চিঠি লিখেছে, সবই পোস্টকার্ডে । ফেলিনি আমি একটিও, আশা করি আমাদের কলকাতার বাড়িতে সব আছে ঠিকমতো । একটা চিঠির কথা বলি । একবার সন্দীপন জ্যোতিকে বললো বেড়াতে যাবার জন্য কাছাকাছি একটা ভালো জায়গার নাম করতে । `ভালো' মানে চাই নির্জনতা, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর শস্তাও হতে হবে । জ্যোতি তার একটি প্রিয় জায়গার নাম করে বললো, `তুম্বুনি যাও' ।
সাঁওতাল পরগণা আর বীরভূমের সন্ধিস্থলে, যেখানে সবে বাংলার সমতলভূমি পাহাড়ি রূপ নিয়েছে, দেখা যাচ্ছে মোষের মতো সব টিলা, যার উপর বসে আছে পাথর -- সেরকম এক জায়গায় তুম্বুনি । তখন নকশাল আমল । ওইখানে এক আদর্শবাদী ব্যক্তি একটা স্কুল খুলেছিলেন, নকশালরা সেই স্কুল পুড়িয়ে দিয়েছিলো । আক্রমণের ঠিক পরেই জ্যোতি গিয়েছিলো । সন্দীপনও জ্যোতির কথায় তুম্বুনি চলে গেলো ।
তুম্বুনি থেকে ফিরে সন্দীপন একটা চিঠি পাঠালো । সঠিক ভাষা তো দিতে পারবো না, যা মনে পড়ছে তা হলো :
পরদিন বাজারে মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে আবার দেখা । আমাকে দেখেই তাড়াতাড়ি কাছে এসে বললেন, `আর কাউকে বোলো না যেন' । বুঝলে জ্যোতি, তুমিও যেন ...
একটা সময় ছিলো যখন আমরা দল বেঁধে বেড়াতে যেতাম--আগে থেকে স্থির করা কোনো জায়গা নয়, যেখানে সেখানে । হাওড়া স্টেশনে গিয়ে যে ট্রেন ইচ্ছে হবে উঠে পড়া, যেখানে ইচ্ছে নামা । একবার আমরা ঠিক করলাম, দোল খেলতে যেতে হবে কোথাও । আমাদের প্রিয় বন্ধু রঘুনাথ গোস্বামী বললেন, জায়গা আমি ঠিক করবো এবার । সবাই শুধু অমুক সময়ে হাওড়া স্টেশনে ঘড়ির তলায় চলে এসো ।
স্টেশনে পৌঁছে দেখা গেলো প্রায় পঁচিশ তিরিশজন এসেছে । রঘুনাথের দলে সর্বদা থাকতো গায়ক, বাদক, পুতুল-নাচিয়ে । তারা তো আছেই, আরো এসেছেন কতো লেখক, চিত্রকর, অভিনেতা, গায়ক । সন্দীপন এসেছে তার মেয়েকে নিয়ে, তৃণা তখন সে ছোট্ট ।
আমরা গিয়েছিলাম ফলতার উল্টোদিকে এক জায়গায়, যেখানে গঙ্গা ও দামোদর এসে মিলেছে । রঘুনাথের এক পরিচারকের গ্রাম । সে আগে চলে গিয়ে একটা একতলা বাড়িই ভাড়া করে রেখেছে । দু' দুটো ঘর ও বারন্দা ; এমনকি ভদ্রস্থ বাথরুম ।
পরদিন দোল, সেদিন তাই চাঁদের আলো যে কী সুন্দর । নদীতীরে কতো খেলা, কতো গান ও নাচ । অনেক রাতে আমরা শুতে এলাম । রঘুনাথের পরিপাটি ব্যবস্থা । দুই ঘরে কাহন কাহন খড় কিনে বিছোনো হয়েছে, যে যেখানে পারো শুয়ে পড়ো । সন্দীপন, আকুল (প্রশান্ত বসু, জ্যোতির সহকারী) ও নানু (দেব সিংহ, চিত্র পরিচালক) কোথায় যেন উধাও হয়ে গেলো । আমরা দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম । গভীর রাতে গ্রামের নিস্তব্ধতাকে ভেঙে দিয়ে শোনা গেলো তিনটি পুরুষ গলার সুরে ও বেসুরে গান : খুলুন, খুলুন দ্বার । রাখিবেন না আর । বাহিরে আমাদের দাঁড়ায়ে । সন্দীপন বললো, `আরে আপনি-আজ্ঞে না বললে তোমরা যদি দরজা না খোলো' !
নানু আর আকুলকে জমা করে দিয়ে সন্দীপন যে সে রাত্রে আবার বেরিয়ে পড়েছিলো তা পরে জানতে পেরেছিলাম । তার পাশে শুয়েছিলো কাঞ্চন । সে সঙ্গে করে এনেছিলো একটি অতি সুন্দর সিল্কের উপর কাঁথার স্টিচ তোলা চাদর । একসময় দেখলো, `তোর কাঁথাটা একটু দেতো কাঞ্চন' বলে সন্দীপন তার সাধের চাদর জড়িয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে । রাতে একটু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব, তাই ওই সাবধানতা ।
পরদিন সকালে সে যখন ফিরলো তাকে জিজ্ঞেস করা হলো সে কোথায় ছিলো । সে বললো, `আরে, খড়ে শুয়ে ঘুম হচ্ছিলো না । খড়ের গাদায় সাপ থাকে তো ! যতবার চোখ বুঝছি দেখছি কেউটে সাপ ফনা দুলিয়ে নাচছে ' ।
সেদিন দোল । আবির, জল রঙ, পিচকিরি -- সব কিছুর ছড়াছড়ি । আর গান । আর নাচ । কেউ বাজাচ্ছে ঢোলক, কেউ বাঁশি । রঘুনাথ মন্দিরা বাজাতেন । সব কিছুর শেষে এখন যাওয়া হবে দীঘিতে স্নান করতে । দলে বেশ কিছু অল্পবয়সী মেয়ে ছিলো, নানু আর আকুল তাদের সাঁতার শেখাতে বদ্ধপরিকর । সন্দীপন পাড়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ যুবকদ্বয়কে দেখলো । তারপর বললো, `ওভাবে কি হয় । তোমরা যাও, কলাগাছ কেটে নিয়ে এসো' । ওরাও তড়িঘড়ি উঠে এসে কোথা থেকে (বোধহয় রঘুনাথের পরিচারকের পরিবারের সাহায্যে) কলাগাছ জোগাড় করে আনলো । যেই না জলে গাছ পড়েছে, অমনি সন্দীপনের জলে ঝাঁপ । `এসো জাপানি' (একটি তরুণীর নাম ছিলো জাপানি) বলে তাকে সন্তরন শিক্ষা দানে সন্দীপন ব্যস্ত হয়ে পড়লো । নানু ও আকুল যে কী বোকাটা বনলো তা আর বলার নয় । ওদের মুখের ভাব দেখে হাসিও পাচ্ছিলো আবার দু:খও হচ্ছিলো । কিন্তু সন্দীপন চট্টৌপাধ্যায়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় কি পারা সম্ভব ?
এদিকে সন্দীপনকে জলে নামতে দেখে তার মেয়েও জলে নামতে চায় । `বাবা । বাবা' বলে সে ডাকে । তখন কে কার বাবা । সন্দীপন তো আগেই তাকে বলে দিয়েছে `ছোড় দা' ডাকতে, এখন `বাবা' ডাকে জবাব দেবার দায়িত্ব তার নেই ।
বোধহয় তরুণীদের সঙ্গে জলক্রীড়ার ফলেই সন্দীপন সেদিন দারুণ মেজাজে । অন্তহীন সময় ধরে দীঘিতে মাতামাতি করার পর গ্রামের ধনীব্যক্তির বাড়িতে বিপুল ভোজ । তারপর নদীতীরের উতল হাওয়ায় চুল উড়িয়ে হাঁটা । সন্দীপন একটার পর একটা উনিশ শতকী `বাবু সঙ্গীত' শুনিয়েছিলো । তার একটা :
ফোনে আমার মেয়ে বললো, সন্দীপনের মৃত্যুও এসেছে অকস্মাত্, প্রায় কথা বলতে বলতে ।
মাঝে একটা সময় সন্দীপনের প্রতি আমি খুব বিরূপ হয়ে গিয়েছিলাম । জরুরি অবস্থার সময় জ্যোতি যখন ইন্দিরা গান্ধীর কোপদৃষ্টিতে পড়ে `কলকাতা' পত্রিকার জরুরি অবস্থা বিরোধী সংখ্যা বার করার জন্য ব্যস্ত তখন সন্দীপন বেশ অন্যায় আচরণ করেছিলো । সেজন্য অনেকদিন তার উপর রাগ ছিলো । কিন্তু সব ব্যথাই আস্তে আস্তে প্রশমিত হয়ে আসে, তাছাড়া ওই সময়ে আমাদের অতি প্রিয় অনেক মানুষই রাষ্ট্রের শক্তির কাছে মাথা নিচু করেছিলেন, আঘাত এসেছে অনেক জায়গা থেকে, তেমনি আশাতীতভাবে সাহায্যও পেয়েছি অনেকের কাছ থেকে ।
সন্দীপন মানুষ হিশেবে কেমন ছিলো ? ঠিক তার সৃষ্ট চরিত্রের মতো । জীবনে সদা সত্য কথা না বললেও তার লেখায় সে কখনো অনৃতভাষণ করেনি । প্রত্যেকেই নিজের লেখায় নিজেকে কিছুটা নিয়ে আসেন--তবে রঙ বদলে -- একটু স্বপ্নালু, একটু বা রোমান্টিক, একটু আদর্শবাদী হয়তো বা । সন্দীপন করেছে তার ঠিক উল্টো । সে নিজেকে এমন একটা আয়নার সামনে দাঁড় করিয়েছে যা এক
সন্দীপনের প্রিয় লেখক ছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, হয়তো সবচেয়ে প্রিয় । কারণ, সে বলেছিলো, হিন্দুরা মৃতের বালিশের তলায় গীতা রাখেন, তার মৃত্যুর পর যেন তার বালিশের তলায় যদি কিছু রাখতেই হয় তা যেন হয় `পুতুল নাচের ইতিকথা' ।
র । বুদ্ধ-টুদ্ধ সবাই এলো । তুমি তো শান্তিনিকেতনে আসতে পারলে না ।
দীর্ঘ লেখার সামান্য অংশ উদ্ধৃত করলাম । এক শীতের সকালে (ফেব্রুয়ারি ?) সন্দীপন এই লেখাটি পড়ে শুনিয়েছিলো আমাকে । আমার সঙ্গে ছিলেন লণ্ডনবাসী নিমাই চট্টোপাধ্যায় ও চিত্রকর হিরণ মিত্র । ঠিক মনে নেই, বোধহয় `আজকাল' রবিবাসরীয়তে বেরিয়েছিলো । জ্যোতিকে দেবার জন্য একটি কপিও সন্দীপন দিয়েছিলো আমাকে, এখনও আমার কাছে আছে । স্পষ্টতই, এই লেখাটি লিখে সে বেশ খুশি ছিলো, নয়তো পড়ে শোনাতো না ।
 
 
 
সেদিন বাজারে আমার পুরোনো মাস্টারমশাইর সঙ্গে দেখা । বললেন, `থলি হাতে ঘুরছি, ঘুরেই যাচ্ছি, মাছের বাজারে আগুন । কাছে যেতে ভয় হয়' । বললাম, `মাস্টারমশাই, এক কাজ করুন, টিলাপিয়া কিনুন । মাত্র দু'টাকা কিলো, নতুন উঠেছে বলে কেউ কেনে না' ।
চিঠি পড়ে বুঝতে হবে তুম্বুনি তার খুব ভালো লেগেছে, এতোই, যে সে চায় না জ্যোতি আর কাউকে বলে -- ভিড় হয়ে যাবে ।
 
 
 
কমলি বে
য ছে দোকানে
ও তার কীংএ য র দোকান কে জানে !
সেদিনের কথা লিখতে লিখতে সন্দীপন এবং আমাদেরও প্রিয় বন্ধু রঘুনাথ ও সুবীরের (রায়চৌধুরী) কথা খুব মনে পড়ছে । কতো জায়গায় আমরা একসঙ্গে গেছি, কতো আনন্দ করেছি আমরা । ঘন জঙ্গলে তালাবন্ধ ফরেস্ট রেস্টহাউস দেখে জানালার কাচ ভেঙে ভেতরে ঢুকেছি । সমাজ ও পৃথিবী বিতৃষ্ণ অর্ঘ্য সেন ও গীতা ঘটক এক ৩১শে ডিসেম্বর রাত কাটিয়েছিলেন গান গেয়ে । অন্ধকার জঙ্গলে আগুন জ্বালিয়ে সারারাত আমরা নেচেছিলাম । সুবীর ও রঘুনাথ দুজনেই অসময়ে অকস্মাৎ চলে গেছে ।
(পরবাস-৩৭; মার্চ, ২০০৬)