• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩৭ | মার্চ ২০০৬ | গল্প
    Share
  • রাজা : সাবর্ণি চক্রবর্তী

    শীত, গ্রীষ্ম, বারোমাসই আগ্রায় ভিড়. লেগে থাকে - তাজমহল দেখার জন্যে । পূর্ণিমার দিনগুলো তো লোকের ভিড়ে পা ফেলা যায় না । সন্ধে হয়ে আসতে থাকে আর বাড়তে থাকে লোক । সূর্যাস্তের আগে গোধূলি আলোয় গোলাপী হয়ে ওঠে তাজমহল । তারপর সন্ধে গাঢ় হয়, চাঁদ ওপরে ওঠে । সমস্ত জোছনা শুষে নিয়ে ফুটফুটে সাদা হয়ে ওঠে তাজ - মনে হয় ওর পাথরগুলোর প্রতিটি কোন থেকে দুধসাদা আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে । এই অপার্থিব দৃশ্য দেখার জন্যে লোকের ভিড় ঠেলার কষ্ট করাটা সার্থক ।

    আরও প্রচুর লোক থাকে চত্বরের বাইরে । বিভিন্ন জিনিষ বিক্রি করে বহু লোক । তাজের ছবি, ছোট কাঠের মডেল - পাথরের মডেলও পাওয়া যায়, তার অসম্ভব দাম । পঁংউতির মালা, চুড়ি । তাছাড়া টুকটাক খাবারের জিনিষ - পকোড়া, সমোসা, কচৌড়ি, লাড্ডু, রেউড়ি । তাজ দেখতে লোকের ভিড় হয়, তবে না এ সব ফেরিওয়ালাদের পেট চলে ।

    ভিখিরিও আছে । রাস্তার দু পাশে সার সার লাইন দিয়ে বসা । খোঁড়া, নুলো, কানা, সব লোক । সামনের দিকে একটা হাত বাড়ানো । মুখে আওয়াজ - সাব, সাব, ও মেমসাব, দয়া করো - ভগওয়ান ভালা করেগা । মেয়েগুলোর অনেকের কোলে বাচ্চা - এক হাতে তাদের আঁচলের আড়াল দিয়ে মাই খাওয়ায়, অন্য হাত দিয়ে সামনে হেঁটে যাওয়া মহিলাদের শাড়ির আঁচল বা সালোয়ারের চুন্নী ধরে টান দেয় - ইয়ে বাচ্চে কো রোটি খানেকে লিয়ে এক রুপেয়া দে যাও মাজী ।

    বয়েস ছয়, সাত বা দশ, এরকম বাচ্চাগুলোও ভিক্ষে করে । বসে থাকা ভিখিরিদের চাইতে অনেক সময়েই এদের রোজগার বেশি হয় । কারণ ওরা ভিক্ষে চাইতে চাইতে লোকেদের পাশে পাশে হাঁটতে থাকে । বেশিরভাগ লোকই ওদের ধমক দিয়ে ভাগায়, তবে দুচার জন আট আনা এক টাকাও ফেলে দেয় ওদের ছোট নোংরা হাতের পাতায় ।

    মংলু আধা হেঁটে আধা দৌড়োচ্ছিল এক দম্পতির পাশে পাশে, অল্পবয়েসী যুবক যুবতী - স্বচ্ছলতার ছাপ ওদের চোখে মুখে, চলন বলন সাজপেষাকে । বিয়ে বোধহয় এখনও বেশি পুরনো হয়নি - হাতে হাত জড়িয়ে হাঁটছে ওরা । ওদের পাশে মংলু - উচ্চতা আড়াই ফুটের মত, হাড় পাঁজরা গুণে নেওয়া যায় এরকম রোগা, পরে আছে অত্যন্ত নোংরা, ধূলোকাদা মাখানো একটা হাফপ্যান্ট আর সেরকমই নোংরা একটা ছেঁড়াখোঁড়া শার্ট । ওর পায়ে কোন জুতো নেই - পা থেকে মাথা পর্যন্ত কাদা আর ধূলোর ছোপ, মুখের অনেক জায়গায় ময়লা কালির দাগ । ভিক্ষে করতে বেরোনর আগে ওর মা অনেক সময় ওর মুখে, গায়ে আরও কিছু নোংরা ময়লা লাগিয়ে দেয় । তাতে করে চেহারাটা আরও খোলতাই হয় । বেড়াতে যারা আসে তাদের পাশাপাশি হাঁটার কায়দাটা মংলু চমত্কার রপ্ত করেছে - যার কাছে ভিক্ষে চাইছে সমস্ত শরীরটা তার দিকে ঘোরানো, ডান হাত তার দিকে বাড়ানো - খালি পা দুটো পাশাপাশি ফেলে বাবু বা বিবিদের সমান তালে এগিয়ে যায় মংলু ।

    বেশিরভাগ সময়েই মংলু চেষ্টা করে মহিলাদের ঠিক পাশে চলে যেতে । পুরুষদের পাশে হাঁটলে ভিক্ষে প্রায় পাওয়াই যায় না, উল্টে জোটে জোর ধমক । মহিলাদের থেকে ভিক্ষে পাওয়া যায় অনেক বেশি, আর তাড়াতাড়িও । যদি বাবুদের সঙ্গে তাদের ছোট ছেলেমেয়ে থাকে তাহলে আরও ভাল - খালি নোংরা হাতটা বাচ্চাদের গায়ে, জামায় কোথাও একটা ঠেকিয়ে দিতে হয় । তখন চটপট হাতে এসে পড়ে কিছু রেজকী - সেটা পকেটে ভরেই ছুটে যাও আর একটা দলের কাছে ।

    মংলু হাঁটছে যুবতীটির ঠিক পাশে, সমানে নাকে কেঁদে ঘ্যানঘ্যান করছে পয়সার জন্যে । ওরা বোধহয় বংগালী । মংলু একটু একটু ওদের কথা বুঝতে পারে - প্রচুর বংগালী আসে তো তাজ দেখতে । অত্যন্ত কৌতূহলী দু চোখ যুবতীটি বোলাচ্ছিলেন মংলুর মাথা থেকে পা পর্যন্ত । তারপর তিনি ছোট্ট লেডিজ হাতব্যাগটা খুলে এক টাকার একটা মুদ্রা বার করলেন । যুবকটি অল্প একটু বিরক্তি দেখালেন, - অত দিও না এই রিফ র্যাফ গুলোকে ।

    কিন্তু ততক্ষণে মহিলাটি তার ডান হাতের বুড়ো আঙুল আর তর্জনীতে ধরে টাকাটা মংলুর দিকে এগিয়ে দিয়েছেন । মংলু একটা ছোঁ মেরে সেটা নিয়ে নিল, তারপরই ছুট মারল আর একটা বড় দলের দিকে । বেশ কয়েকটা বাচ্চা ছেলেমেয়ে রয়েছে ঐ দলটার সঙ্গে ।

    মংলু কাজ থামায় যখন পেটের ভেতরের চিনচিনে ক্ষিদেটা ওকে খোঁচায়, যখন মনে হয় পা দুটো দুমড়ে ভেঙ্গে আসছে । ওর পকেটে এখন একমুঠো টাকা, আধুংইল, রেজকী । মংলু টাকা গুণতে পারে ঠিকই, কিন্তু এক একবার গুণলে ও এক একরকম সংখ্যা পায় । সেজন্যে গোনার চেষ্টা করে না । পুরো রোজগারটা মায়ের হাতে তুলে দিতে পারলেই হোল । ওর প্যান্টটার বিভিন্ন জায়গায় ফুটো ফাটা । কিন্তু পকেট দুটো ওর মা ভালভাবে সেলাই করে রাখে - যাতে ভিক্ষের পয়সা পড়ে না যায় । ওর খুব ইচ্ছে করে ঐ পয়সায় পকোড়া বা রেউড়ি কিনে খেতে । কিন্তু সে চেষ্টা করে না । জানে ফেরিওয়ালা মার লাগাবে ওদের খাবারের ঝুড়ির কাছে গেলেই । অনেক ভিখিরি বাচ্চাই টুক করে এক আধটা খাবার তুলে নিয়ে দৌড় মারে - ফেরিওয়ালার খাবারের ঝুড়ি ফেলে ওদের পেছনে ছুটবার উপায় নেই, সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই চিত্কার করে বাপ মা তুলে গাল দেয় । চোর তখন অনেক দূরে দাঁড়িয়ে খাচ্ছে, পকোড়ার টুকরো আর হাতের ধূলো - সবই চেটে পুটে পেটে পুরছে ।

    মংলু সাহস পায় না । ধরা পড়লে পাইকিরি মার জুটবে কপালে । মংলুর দুনিয়াটা ছোট - তবুও সেটাকেই বেশ কয়েকটা ভাগে ভেঙ্গে নেওয়া যায় । এক হোল ওর বয়েস । হয়তো ছ সাত বছর হবে । ওর জানা নেই । জানার দরকারই পড়েনি । ও নিজের বয়েসের আন্দাজ করে অন্যান্য ছেলেদের সঙ্গে তুলনা করে । যাদের শরীরটা অপেক্ষাকৃত বড় আর গায়ে ওর চাইতে জোর বেশি, তারা ওর চাইতে বয়েসে বড় - সেটা ও বোঝে । তার পরে ওর নাম । ওর নাম মংলু সে কথা কেউ বলে দেয়নি । যতদূর পর্যন্ত ওর স্মৃতি পেছনে যায় তার আগের থেকেই মংলু বলে ডাকলে ও সাড়া দিয়েছে । কাজেই ওর অস্তিত্বটা এখন মংলু বলে চিহ্নিত । রাতে ও যেখানে শোয়, পোড়া রুটির টুকরোটা যেখানে জোটে সেটা ওর ঘর । মাটির দেয়াল, টিনের দরজা, টিনের চাল - ওদের ঝুপড়ির সার সার খুপরি । দরজাগুলোর সামনে চওড়া, গভীর নর্দমা, সেখানে দুর্গন্ধ পচা পাঁক আর ঘন কালো আলকাতরার মত জল । এই ঝুগ্গির ছোট বাচ্চাদের এক আধটা এই নর্দমায় ডুবে মারাও যায় মাঝে মাঝে । সামনের ছোট্ট সরু আঁকাবাঁকা রাস্তার বেশিরভাগটুকুই কাঁচা, মাঝে মাঝে কিছু খোয়া ছড়ানো আছে । এই সব ঘরগুলোর ভেতর রাস্তার কোন দিকের কত নম্বরের ঘরটা ওর সেটা ও চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারে । অনেকদিন আগে একেবারে উদোম অবস্থায় হামা দিয়ে ও এই ঘরে ঢুকত - কবে যে ওর গায়ে একটা হাফপ্যান্ট উঠল, কবে যে ও দাঁড়িয়ে উঠে বাঁদরের মত লাফিয়ে নর্দমা ডিঙিয়ে ঘরে ঢুকতে লাগল সেটা ওর আর মনে পড়ে না ।

    তবে ঘরটা ওর সেকথা বলাটা ঠিক হবে না । আরও লোক আছে সেখানে । একজন হচ্ছে লম্বা, পাকানো চেহারার একটা লোক । সে ওর বাপু । লোকটার ঠোঁটের ওপর একজোড়া খোঁচা খোঁচা গোঁফ আর চোখ দুটো সবসময় লাল । এই বাপুর সঙ্গে ওর একটা খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে, ও সেটা বোঝে । কিন্তু সেটা যে ঠিক কি তা ওর জানা নেই ।

    আরও একজন এই ঘরের বাসিন্দা । মংলুর দুনিয়ার যত সুখ, যত আনন্দ - সবই এই একজনকে কেন্দ্র করে । ওর মা । তার না-খাওয়া হাডিডসার চেহারা - সেই শরীরটা ঢাকা থাকে ঘাগরা চোলিতে । আর ওড়নার ঘোমটায় । এই মা টুকরো টুকরো করে রুটি ছিঁড়ে ওকে খাওয়ায় - তবে না ওর পেটের বোবা যন্ত্রণাটা সারে । মা ওকে কাঁচা মাটির মেঝেয় পাতা ছেঁড়া কাঁথার বিছানায় শোয়ায় - নীল উল্কি-আঁকা দু হাত দিয়ে ওকে থাবড়ে থাবড়ে ঘুম পাড়ায় । সেই সঙ্গে ইনিয়ে বিনিয়ে ভাঙ্গা গলায় গান গায় - সে গানে থাকে রূপকথার রাজা রানীর গল্প - তবে না দু চোখ বুজে আসে মংলুর ।

    রান্নাঘর, স্নানের ঘর, নিদেনপক্ষে একটা বারান্দা বা দাওয়া - এসব এই ঝুগ্গির বাসিন্দাদের কল্পনার বাইরে । ওদের ওই ছোট ঘরটার ভেতরই কাঠকুটো জ্বেলে মংলুর মা রুটি সেঁকে, কোন কোন দিন প্রায় বিনা তেলে একটা সব্জী পাকায় । ঘন ধোঁয়ায় ভরে যায় ঘরটা - রান্না শেষ হয়ে যাবার পরেও তা ঘরের ভেতর তাল পাকাতে থাকে অনেকক্ষণ ধরে । মংলু পেচ্ছাপটা বাড়ির সামনের নর্দমাতেই সারে । আর পেট মোচড় দিয়ে বেগ এলে যায় একটু আগে সামনের খোলা মাঠে । আর একটু ছোট থাকতে মংলু এ কাজটাও সামনের নর্দমাতেই সারত । ঝুগ্গির অন্যান্য ঘরগুলোর ছোট বাচ্চারা এখনও তাই করে । বয়স্করা - মংলুর বাপু, মা - সবাই যায় একটা তালাও এর পাড়ে । পুরুষরা সব এপাড়েই বসে যায়, মেয়েরা যায় পাড় ঘুরে ও পারে । মেয়েরা ঘাগরাটা কোমর পর্যন্ত তোলে, কিন্তু ওড়ানির ঘোমটায় ঢেকে রাখে মুখটা ।

    রাস্তা থেকে একটু দূরে একটা বড় গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে ভিক্ষে করে পাওয়া পয়সাগুলো নেড়ে চেড়ে দেখছিল মংলু । বেশ কিছু পাওয়া গেছে আজ - ওর ছোট হাতের মুঠোটা ভর্তি হয়ে উপচে পড়ছে । কিন্তু ও নজর করেনি - ওর পেছনে তিনটে ছেলে ছিল । এরাও ভিখিরি, মংলুর চাইতে বয়েসে একটু বড় । একজন চেপে ধরল ওর মুখ, আর একজন ওর ডান হাতটা পিঠের দিকে মুচড়ে ধরল । ওর হাতের মুঠো খুলে গিয়ে পয়সাগুলো সব ছড়িয়ে পড়ল মাটিতে । তৃতীয় ছেলেটা টকাটক দুহাতে পয়সাগুলো কুড়িয়ে নিল । তারপর ওরা মংলুকে এক ধাক্কা মারল, মুখ থুবড়ে উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ল মংলু । হাসতে হাসতে ছুটে পালাল ছেলে তিনটে । মংলু যতক্ষণে উঠে দাঁড়াল ততক্ষণে ছেলেগুলো লোকের ভিড়ের ভেতর মিশে গিয়েছে । মংলুর মুচড়ে যাওয়া হাতটায় ব্যাথা করছে - পড়ে গিয়ে লেগেছে ওর নাকে, কনুইয়ে, হাঁটুতে । ছড়ে গিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে সে সব জায়গা থেকে । বার কয়েক গলা চিরে চেঁচাল মংলু । তারপর নিজেই থেমে গেল । ওর চেঁচানি রাস্তার লোকের কানে গিয়েছে । মাথাই ঘামায়নি কেউ । কে জানতে যাবে নোংরা একটা ভিখিরি বাচ্চা ছেলে কেন মুখ হাঁ করে পরিত্রাহি চিত্কার ছাড়ছে ।

    মংলুর বাপু ঘরে ফেরে সন্ধে পার করে । পেট পুরে দেশী টেনে আসে । লালচে চোখদুটো আরও লাল হয়ে থাকে, মুখ থেকে ভক ভক করে চোলাইয়ের তীব্র গন্ধ বেরোয় । ফেরার পর বাপুর প্রথম কাজ হোল মংলুর দিনের রোজগারের পয়সাটা ওর মার থেকে নিয়ে নেয়া । আজ শুনল মংলু কিছু আনেনি । চোখদুটো ভাঁটার মত করে তাকাল মংলুর দিকে । ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়ে দেয়ালের এককোণে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়েছিল মংলু । শালা কুত্তার বাচ্চা বলে গাল দিয়ে লাফিয়ে ওর বাপু গিয়ে ধরল ওর চুলের মুঠি । একটা হ্যাঁচকা টানে ওর লিকলিকে বেতের মত ছোট্ট শরীরটাকে সামনের দিকে নুইয়ে ফেলল । পিঠে চালাতে লাগল কিল আর চড় ।

    যন্ত্রণায় পিঠ ভেঙ্গে যাচ্ছিল মংলুর । তার ওপর মনে হচ্ছে চুলগুলো বুঝি সব উপড়ে আসবে মাথার থেকে । মংলু অভিজ্ঞতার থেকে জানে - মার খাবার সময় চেঁচালে কষ্টটা একটু কম হয় । পিঠে একটা করে কিল বা চড় পড়ে - একটা করে আকাশ ফাটানো চিত্কার ছাড়ে মংলু ।

    বাপ আর ছেলের মাঝখানে এসে পড়ল মংলুর মা । টান মেরে ছাড়িয়ে নিল মংলুকে । তারপর গাল দিল ওর বাপকে - শয়তান কসাই কোথাকার । দারু পিয়ে সব পয়সা উড়িয়ে দিয়ে আসিস, তারপর ছেলের ওপর ডাকাতি করিস - তোর লজ্জা করে না ?

    মংলুর বাপু থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে একটুখানি এই গালাগালি শুনল, তারপর ওর মাকে নিয়ে পড়ল । পায়ে পরা ওদের মহল্লার মুচির হাতে তৈরি মোটা ভারি চপ্পল - তাই খুলে নিয়ে এলোপাথাডি পিটতে লাগল ওর মাকে । মংলু ঘরের এককোণে দাঁড়িয়ে কান্নার ফাঁকে ফাঁকে হেঁচকি তুলছিল আর দেখছিল - ওর মা কিভাবে নিজের দুটো হাত ওপরে তুলে মার ঠেকিয়ে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে । ওর বাপের গর্জন, ওর মার গুঙিয়ে গুঙিয়ে আর্তনাদ, সেই সঙ্গে নিজের ফোঁপানির আওয়াজ - সবই শুনতে পাচ্ছিল মংলু ।

    রাত্তিরে ওদের মধ্যে সবার আগে ঘুমিয়ে পড়ে ওর বাপ । তৈরি হওয়া রুটির বেশিরভাগটাই নিজে খেয়ে নেয়, তারপর শুয়ে পড়ে । অন্য পাশে শোয় মংলু, মাঝখানে ওর মা, আজ বাপুর নাক জোরে ডাকতে শুরু করলে মংলু সরে এল ওর মায়ের কাছে । মায়ের হাতে, মাথায়, মুখে, যেখানে যেখানে ওর বাপের জুতোর বাড়ি পড়েছে, সেসব জায়গায় হাত বোলাতে লাগল । ফিসফিসিয়ে বলল, মা, তোর খুব জোর ব্যাথা লেগেছে, নারে ? খুব জোরে জোরে মারে বাপুটা ।

    ওর মা ওকে আরও কাছে টানে । ওর মুখে ধূলোর ওপর চোখের জল গড়িয়ে পড়ার দাগ, নাকের নিচে কান্নার সময় বেরোন সর্দি, এসব মুছে দেয় । নিচু গলায় বলে, কুছ নেহীরে বেটা । তুই এখন ঘুমিয়ে পড় ।

    অনেক রাতে মংলুর ঘুম ভেঙ্গে গেল । ঘরের ভেতর অন্ধকার, তবুও অস্পষ্টভাবে মানুষের নড়াচড়া বোঝা যায় । মংলু বুঝল ওর মার ওপর ওর বাপের রাগ এখনও যায়নি । এখনও ওর মাকে মারছে ওর বাপু । ওর মা কিন্তু এখন চুপচাপ । চোখ বন্ধ করে মডার মত পড়ে রইল মংলু । ওর জানা আছে এ সময়টা খুব খতরনাক । আগে একবার দুপুর রাতে এরকম সময়ে নড়ে চড়ে উঠেছিল মংলু । উঠে এসে প্রচণ্ড এক থাপ্পড় বসাল বাপু । গর্জন করল, দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়্‌ । দুপুর রাতে এখনও জেগে আছে - শালা হারামিকা আওলাদ ।

    পরেরদিন সময়মতই মংলু বেরিয়েছিল ভিক্ষে করতে । ওদের ঝোপড়ির বস্তিটা শহরের শেষে, এককোণে - সেখান থেকে তাজমহল বেশ একটু দূর । তাজের কাছাকাছি গিয়ে ওর একটা চমক লাগল । যাওয়ার রাস্তা বন্ধ । রাস্তার মুখে পুলিস পাহারা । গাড়ি ঘোড়ার যাওয়া তো বারণই - পায়ে হাঁটা লোকেদেরও যেতে দেওয়া হচ্ছে না । এক পাহারাওলা সেপাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাতের পাতায় অন্য হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে খইনি ডলছিল । সুবিধে বুঝে ওর হাতের নীচ দিয়ে চট করে গলে গেল মংলু । তারপর দে ছুট ।

    কিন্তু আরও কাছে গিয়ে একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল মংলু । ধারে কাছে কোন তাজ দেখতে আসা লোকের চিহ্নমাত্র নেই । নেই কোন ফেরিওয়ালা । ভিখিরিগুলোও সব উধাও । একগাদা লোক লেগে গেছে কাজ করতে । পিচ ঢেলে তার ওপর মেশিন চালিয়ে রাস্তা মেরামত হচ্ছে । অনেক লোক রং লাগাচ্ছে রাস্তায়, রাস্তার পাশের গাছগুলোতে । চারপাশ তকতকে ঝকঝকে পরিষ্কার । কলা বা কমলালেবুর খোসা, চিনেবাদামের খোলা, ছেঁড়া কাগজ, শালপাতার টুকরো -এসবের কুটোটাও পড়ে নেই কোথাও । আর চারধারে গিসগিস করছে পুলিস । তার মধ্যে কতগুলো গোরা পুলিসও রয়েছে - গায়ের রং লাল, মাথায় বাদামী-সোনালী চুল, লম্বা চওড়া হোঁত্কা চেহারা । ওদের হাতের মুঠোয় কি সব ছোট ছোট যন্ত্র ধরা । একটু দূরে দেখা যাচ্ছে - খাঁ খাঁ খালি নাঙ্গা তাজমহল, দুপুরের রোদে ঝিকমিক করছে ।

    একধারে দাঁড়িয়ে ছিল মংলু আর ফ্যালফ্যাল করে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছিল । হঠাৎ দেখল একটা গোরা পুলিস ওর দিকেই তাকিয়ে দেখছে । সে মংলুকে দেখিয়ে একটা দেশী পুলিসকে কি সব বলল । খুব মন দিয়ে ওর কথা শুনল দেশী পুলিস । তারপর ছুটে এল মংলুর কাছে । বলল, এই বাচ্চা, তুই এখানে এলি কি করে ?

    মংলু ভয়ে বোবা । পুলিসটা তখন ওকে একটা ঘাড়ধাক্কা দিল, পেছনে ছোট একটা লাথি মারল । বলল, ভাগ্‌ এখান থেকে, ফের যদি এখানে দেখি তো একেবারে হাজতে ভরে দেব ।

    হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পড়েছিল মংলু । দাঁড়িয়ে উঠে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে ছুট দিল সেখান থেকে । পুলিসের লাথি পাছার যেখানটায় লেগেছে সেখানে ব্যথা করছে । জোরে ছোটা যাচ্ছে না ।

    মংলুদের ঝুগ্গিবস্তি আর তাজের মাঝখানে অনেকগুলো রাস্তা পড়ে । প্রচুর গাড়ি মোটর চলে তাতে, কিন্তু সেগুলোর তোয়াক্কা না করে মংলু রোজই ছুটে ঐ রাস্তাগুলো পার হয়ে যায় । আজ ও যখন ফিরছিল তখন শহরের স্কুলটুলগুলো ছুটি হয়েছে, স্কুলের ছেলেমেয়েরা ছোট ছোট দলে বাড়ি ফিরছে । অনেকে লম্বা লম্বা কাঠি আইসক্রীম কিনে তাই চুষছে । সুন্দর ঝকঝকে সাদা শার্ট আর নীল ফুলপ্যান্ট পরে আছে ছেলেগুলো, ওদের পায়ে পালিশ করা চকচকে কালো জুতো । মংলু মেয়েদের থেকে ছেলেদেরই বেশি করে দেখে, ওদের সাজ পোষাক দেখে ওর হিংসে হয় । ইস্‌, ওর মার যদি অনেক টাকা থাকত, মংলুকে নিশচয়ই এরকম জামা পরিয়ে দিত । টাকার কথা আর মায়ের কথা ভাবতে গিয়ে ওর মনে পড়ল, আজকে কোন রোজগার হয়নি । বাপু নিশ্চয়ই খুব পিটবে, ওর মাকেও হয়তো মারবে । স্কুলের ছেলেরা মেয়েরা সব অটোরিক্সা, সাইকেল রিক্সা এসবে উঠে চলে যাচ্ছিল, মোটরেও যাচ্ছিল অনেকে । কারোর কারোর বাড়ির লোক এসেছে নিয়ে যেতে, তাদের সঙ্গে হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছে ওরা । মংলু আনমনে এসব দেখছিল আর রাস্তা পার হচ্ছিল ।

    একটা গাড়ি প্রায় ওর গায়ের ওপর এসে ক্যাঁচ করে আওয়াজে থেমে গেল । মংলু এখন বড় রাস্তার একেবারে মাঝখানে । আর একটু হলেই ও গাড়িটার চাকার তলায় চলে যাচ্ছিল । গাড়ির ড্রাইভার দৌড়ে এসে ওর জামা টেনে ধরে ঠেসে গালে এক চড় বসাল । কুত্তার বাচ্চা - রাস্তা দেখে চলতে পারিস না ? মংলু দেখল এই মোড়টায় দাঁড়িয়ে যে পুলিসটা হাত তুলে সব গাড়ি থামায় সে এদিকে এগিয়ে আসছে । এক ঝটকা মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল মংলু, তারপর একছুটে রাস্তা পার হয়ে সামনের ছোট রাস্তাটায় ঢুকে দৌড় । ছেঁড়া জামাটা আরও ছিঁড়ে গেছে - বুকের কাছটায় জামার ছেঁড়া কাপড়টুকু এখন মংলুর পেটের ওপর ঝুলে পড়েছে । ওর ছোট্ট বুকের পাঁজরা বার করা খাঁচাটার খানিকটা এখন ঐ ছেঁড়ার ফাঁকটা দিয়ে দেখা যাচ্ছে - চামড়ার ওপর পরতে পরতে ময়লা - অনেক বছর ধরে জমেছে তো ।

    মংলুদের ঘরের কাছে একটা ফাঁকা মাঠের মত জায়গা, সেখানে মার্বেল দিয়ে গুলি খেলছিল কয়েকটা ছেলে । ছেলেগুলোর বয়েস বছর বারো তেরো হবে । বুধন আর সোমরিয়া দুই ভাই । ঐ বস্তিতেই থাকে । ওরা মঙ্গুচাচার ছেলে । মঙ্গুচাচার সাইকেল রিক্সা আছে । ওদের বাপের রোজগার বোধহয় মংলুদের চাইতে বেশি । কারণ ঐ দুই ভাই ভিক্ষে টিক্ষে কিছু করে না । টো টো করে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায় । লালন থাকে মংলুদের ঘরের পরের পরেরটায় । ওর বাপ কলের মিস্ত্রীর কাজ করে । ঝোপড়িগুলোর লাইনের ঠিক আগে একটা পাকা ইঁটের দু'ঘরের বাড়ি আছে । বাড়ির মালিক চমনলাল, বাজারে ওর মুদী দোকান আছে । ওর ছেলে বিষুণের বেশ নাদুসনুদুস চেহারা, পরিষ্কার জামা গায়ে দেয় - পায়ে চপ্পল পরে থাকে । বিষুণও আজ খেলতে এসেছে ওদের সঙ্গে ।

    মংলু দাঁড়িয়ে পড়ল সেখানে । এই খেলাটার ওপর ওর খুব লোভ । কি সুন্দর রঙচঙে কাঁচের গুলি দিয়ে খেলে ওরা । লালন খুব ভাল গুলি খেলে । বাঁ হাতের তালু টানটান করে বুড়ো আঙুল ঠেকায় মাটিতে । উঁচু করে ধরা মাঝের আঙুলটার ডগায় রাখে গুলিটা । তারপর ডান হাতের দুটো আঙুল দিয়ে গুলিসুদ্ধ বাঁ হাতের আঙুলটা পেছনে টেনে ধরে তীর ছোঁড়ার মত করে ছুঁড়ে দেয় গুলিটা । সেটা ঠিক গিয়ে লাগে দূরে মাটিতে রাখা আর একটা গুলিতে ।

    মংলু পায়ে পায়ে এগিয়ে এল । ঠিক খেলার মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, আমিও খেলব ।

    দৌড়ে এল বুধন আর সোমরিয়া । বুধন ওকে একটা ধাক্কা মেরে বলল, ভাগ্‌ হিঁয়াসে । মাঝখানে এসে খেলা নষ্ট করলে মেরে দুনিয়া দেখিয়ে দেব ।

    লালন চোখ ছোট করে শয়তানির হাসি হাসছিল । বলল, তোর নিজের গুলি নিয়ে আয় । তাহলে খেলতে নেব তোকে ।

    মংলু থাবা দিল মাটিতে রাখা গুলিটার ওপর । আমাকে খেলতে না নিলে তোদেরও খেলতে দেব না ।

    তখন তিনজন এসে ধরল মংলুকে । খালি বিষুণ একধারে দাঁড়িয়ে রইল । বনবেড়ালের মত আঁচড়ে কামড়ে দেবার চেষ্টা করছিল মংলু । বুধন আর লালন ধরল মংলুর দুটো হাত । তারপর ওকে পেছন থেকে টানতে টানতে নিয়ে চলল । হাঁ মুখ করে ফুসফুস ভরে হাওয়া নিয়ে চিত্কার করছিল মংলু । ওর দুটো পা ঘষে যাচ্ছিল মাটিতে - জ্বালা করছিল ঘষে যাওয়া জায়গাগুলোতে । খেলার গণ্ডির বাইরে নিয়ে গিয়ে ওরা ছেড়ে দিল মংলুকে । বলল, ফের এদিকে আসবি তো ঠ্যাং ভেঙ্গে দেব ।

    ওখানেই বসে বসে ওদের খেলা দেখল মংলু । আর ওদের ঘাঁটাতে সাহস হয় না । ওর একটা বড় ভাইয়া ছিল । এই লালন বিষুণদেরই বয়েসী । এসব সময়ে মংলুর বড্ড মনে পড়ে ওকে । ভাইয়া থাকতে ওকে কক্ষনো এভাবে মার খেতে হোত না । বড় রাস্তায় লরি চাপা পড়েছিল ভাইয়া - পেট ফাঁসিয়ে দিয়েছিল লরির চাকা । মংলুও তো আজ মোটর চাপা পড়ছিল আর একটু হলেই । কি জানি, পেটের ওপর দিয়েই চাকাটা চলে যেত কি না ।

    ওদের একটা বাজি শেষ হবার পর মংলু আবার ওদের কাছে গিয়ে দাঁড়াল । নতুন বাজির গোড়ার থেকেই ওরা যদি ওকে খেলায় নেয় । আর কিন্তু খেলা হোল না । নিজের মার্বেলগুলো পকেটে ভরে লালন ওর ঘরে ফিরে গেল । ওর চাচা কোন এক দূর শহরে থাকে, সে আজ এসেছে এদের সঙ্গে দেখা করতে । আজ রাতের ট্রেনেই ফিরে যাবে । তাড়াতাড়ি ঘরে না ফিরলে ওকে হাতুড়ি পেটা করবে ওর বাপ । কি খচ্চর লালনটা - মংলু ভাবছিল । মার্বেলগুলো ওদের কাছে রেখে গেলেও তো পারত । মংলু একটু খেলতে পারত তাহলে ।

    বুধন শুয়ে পড়েছিল মাটিতে । আধবসা হয়ে উঠে মংলুকে বলল, আজ ভিখ মাঙতে যাসনি যে বড় ? পয়সা না নিয়ে বাড়িতে ঢুকলে তোর বাপু তো মেরে তোর পাছার চামড়া ছাড়িয়ে নেবে ।

    তাই শুনে খ্যা খ্যা করে হেসে উঠল সোমরিয়া - ওর ভাইটা । বিষুণ একটা লাট্টুতে লেত্তি জড়াচ্ছিল - ও ও হাসি হাসি মুখ করে দেখতে লাগল মংলুকে ।

    মংলুর ইচ্ছে হচ্ছিল ছুটে গিয়ে বুধনের কোমরে ক্যাঁৎ করে একটা লাথি বসায় । কিন্তু তাতে বিপদ আছে । রাগ চাপল মংলু । বলল, তাজের কাছে কাউকে যেতে দিচ্ছে না । সব রাস্তা বন্ধ । কেউ কাছাকাছি গিয়ে পড়লে পুলিস হাঁকার দিয়ে তাড়াচ্ছে ।

    বিষুণের বাপ বাজারে দোকান দিয়ে ব্যবসা করে - কাজেই ও অনেক খবর টবর রাখে । ও লেত্তি ঘুরিয়ে ঠকাস করে ভূঁইয়ে ফেলল লাট্টুটাকে । ছুঁচলো ধারটার ওপর দাঁড়িয়ে সেটা বাঁই বাঁই করে পাক খাচ্ছিল, তাই দেখতে দেখতে বলল, ঠিক বাত । বিলাইতি রাজা তাজ দেখতে আসবে । তাই সব মেরামত হবে । সেজন্যে পুলিস কাউকে ঢুকতে দেবে না ওখানে ।

    মংলুর সঙ্গে সঙ্গে বুধন আর সোমরিয়াও হাঁ হয়ে গেল । রাজা আসছে তাজ দেখতে ? তাও আবার বিলিতি রাজা ! ব্যাপারটা কি ?

    বিষুণ মুরুব্বি চালে ওদের ব্যাপারটা বোঝায় । সমুন্দরের ওপারের এক বহুত বড়া রাজা আসছে আমাদের দেশে বেড়াতে । একদিন তাজ দেখতে আসবে । সঙ্গে থাকবে লোক, লস্কর, সেপাই, পেয়াদা । সব গোরা । আমাদের পুলিস, মিলিটারী সব থাকবে । রাজার হাওয়াই জাহাজটা আগাগোড়া সোনার । জোকা, কুর্ত্তা, পাগড়ী, সব সোনার । তাতে অনেক অনেক হীরে আর মোতি বসানো । এক একটা মোতির দামই এক এক লাখ রুপেয়া । রাজা এক জামা দুদিন পরে না । রোজ নতুন সোনার জামা তৈরি হয় তার জন্যে । সেই সব সে বড়া রাজা সোনার হাওয়াই জাহাজে চড়ে এসে নামবে তাজের সামনে । আবার সেখানে থেকেই উড়ে যাবে । রাজা ফেরৎ চলে না যাওয়া পর্যন্ত কাউকে তাজের ধারে কাছে যেতে দেওয়া হবে না ।

    সে রাতে নিজের কাঁথাটার ওপর শুয়ে খালি এপাশ ওপাশ করছিল মংলু । রাজার সোনার জামায় বসানো অ্যাতো অ্যাতো হীরে মোতি ! একটা হীরে বা মোতি ও যদি কোনভাবে পেত । কত টাকাই না পাওয়া যেত তাহলে । ওর মা অনেক রোটি বানাতে পারত - বাপু খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়বার পরেও ওর পেট ভরবার মত রোটি থাকত তাহলে । ঐ স্কুলের ছেলেগুলোর মত জামা আর প্যান্ট পরতে পারত মংলু । দু পকেট ভরে মার্বেলের গুলি কিনে নিত তাহলে - আর হ্যাঁ, আর একটা বড় লাট্টু - ঐ বিষুণের যেমন আছে ।

    দু চোখ মেলে ঠায় জেগে থাকে মংলু । বাপুর নাকডাকার গুরুগম্ভীর আওয়াজ আসছে - মা ও গভীর ঘুমের জোরালো নি:শ্বাস ফেলছে । ঘরের ভেতরে ঘন কালো অন্ধকার, কিন্তু মংলু দেখতে পায় রাজার সোনার হাওয়াই জাহাজ, রাজা বেরিয়ে আসে তার ভেতর থেকে । রাজার পাশে পাশে হাঁটে মংলু, জোব্বা ধরে টান দেয় - এই রাজা, আমাকে একটা মোতি দে না - বেশি না, খালি একটা । রাজা এখন তাজের দিকে তাকিয়ে । মংলু টুক করে রাজার জোব্বার থেকে তুলে নেয় একটা মোতি - এই এত্ত বড়ো, আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে তার থেকে । মংলু দৌড়য় সেপাইদের পায়ের ফাঁক দিয়ে । চারপাশের ঝোপঝাড়গুলোর অন্ধিসন্ধি ওর চেনা । চট করে একটার ভেতর ঢুকে পড়ে লুকিয়ে থাকতে হবে । দুটো সোনালী ডানা মেলে উড়ে যাবে রাজার জাহাজ, তখন সেপাই পুলিস সব সরে যাবে, তখন বেরোবে মংলু ।

    পরের দিন সকালে মঙ্গুচাচা ডাকতে এল ওর বাপকে । ওর বাপু তখন দরজা খুলে নর্দমার দিকে মুখ করে উবু হয়ে বসে ছাই দিয়ে দাঁত মাজছিল, আর মাঝে মাঝেই খ্যাক খ্যাক করে গলা ঝেড়ে আওয়াজ করে নর্দমায় হলদে গয়ের আর কালো ছাই মেশানো থুতু ফেলছিল । মঙ্গু চাচা বলল, শীগগির চল্‌ । থানেদার সাহেব এসেছে - ওদিকে বসে আছে । সবাইকে ডাকছে । শুনেই বাপু তাড়াতাড়ি করে মুখ ধুয়ে কাছা পেছনে গুঁজে দৌড় মারল সেদিকে - মংলুও গেল ওদের পেছনে ।

    ঝোপড়পট্টির বস্তিটার বাইরে গাছের নীচে চেয়ার পেতে বসেছিলেন দারোগাসাহেব - সঙ্গে দু জন সেপাই । দারোগার লম্বা চওড়া চেহারা, ভারী মোটা গোঁফ, মাথায় থানেদারের টুপি । স্বাস্থ্যের প্রাচুর্যটা ভুঁড়ির আয়তনটার থেকেই সবথেকে ভাল বোঝা যায় । বস্তির সব পুরুষদের সামনে দাঁড় করিয়ে তিনি চোখ পাকিয়ে ধমক দিয়ে দিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বললেন । মংলু দূরে দাঁড়িয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে কি হচ্ছে তাই দেখছিল, আর দারোগা কি বলছে তা শোনার চেষ্টা করছিল । মোটামুটি বুঝে নিল যেদিন ঐ রাজা তাজ দেখতে আসবে সেদিন সব লোকজনের ঘর থেকে বেরোন মানা । মংলু দেখছিল ওর বাপু - যার এক চড়ে ওর মাথাটা বাঁই বাঁই করে ঘুরতে থাকে - দু হাত জোড় করে মাথা ঝুঁকিয়ে দারোগার সামনে দাঁড়িয়ে আছে - মাঝে মাঝেই বলছে, হুজুর, জী হুজুর । তারপর একটা ঝুড়িতে করে দারোগা সাহেবের জন্যে ভেট এল - দুটো নধর মুরগি আর তাজা তরিতরকারি । ঝুড়ি নামিয়ে রাখা হোল তার সামনে । সঙ্গের সেপাইদের ঐ ডালা তুলতে হুকুম দিয়ে জুতো মশমশিয়ে থানেদার সাহেব গিয়ে উঠলেন পুলিস থানার জীপে । জীপ পর্যন্ত ভেটের ঝুড়ি বয়ে নিয়ে গেল বিষুণের বাপ আর মঙ্গুচাচা - তাদের পেছনে দুই সেপাই । তারপর জীপে ঝুড়ি উঠল, দুই সেপাই উঠে বসল তাতে । ধোঁয়া ছেড়ে ধূলো উড়িয়ে বেরিয়ে গেল সেই জীপ ।

    মংলুর রোজগার এখন বন্ধ - সারাদিন ও বস্তির আশে পাশে টো টো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে । ওর বাপ ওকে মারেনি রোজগার বন্ধ হওয়ার জন্যে । লোকটা নিজেও এখন বাড়িতে বসে আছে । যে ইঁটভাটায় ও দিনমজুরের কাজ করে সেটা আপাতত কর্তৃপক্ষের হুকুমে বন্ধ । রাজা চলে গেলে ফের চালু হবে । কাজেই বাপু সারাদিন উবু হয়ে বসে বিড়ি টানে, ঘরের মেঝেতেই থুতু ফেলে । সন্ধের পর নিজের ইয়ারদের আড্ডায় গিয়ে পচাই খেয়ে ফেরে । তখন লাল লাল চোখ করে তাকায় মংলুর দিকে । মংলু ভয় খায়, মা'র পিঠের কাছে ঘুরঘুর করে ।

    আজ আসবে সেই রাজা । সকালে ওর মা ওকে খেতে দিয়েছিল কালকের তৈরি বাসি রুটির একটা টুকরো আর একটু নুন । তাই খেয়ে মংলু বেরিয়ে পড়েছে । একটা মোতি ওর চাই-ই চাই ।

    কিন্তু বেশিদূর যেতে পারল না মংলু । তাজে যাবার পথে পথে প্রচণ্ড কড়া পাহারা । আজ পাহারাদারদের হাতে খৈনি নেই । তার বদলে শক্ত করে বন্দুক ধরে রেখেছে আর কটকটিয়ে এদিক ওদিক দেখছে । পথঘাট সব শুনসান - লোকজন, গাড়ি এ সব কিচ্ছু নেই । ও রাস্তা পাল্টে পাল্টে এগোবার চেষ্টা করল - সব কটায় নিশ্ছিদ্র পাহারা । মাঝে মাঝে রাস্তা দিয়ে পুলিসের গাড়ি যাচ্ছে; সব পুলিস মিলিটারিতে বোঝাই । গাড়িভর্তি করে গোরা পুলিসও যাচ্ছে, তাও চোখে পড়ল মংলুর ।

    সারাদিন মন খারাপ করে গুলিখেলার মাঠের ধারে একটা গাছের নীচে শুয়ে রইল মংলু । মোতিটা পাওয়া গেল না । ওর নিজের আর মার্বেল কেনা হবে না । বিষুণের মত লাট্টুও ঘোরাতে পারবে না ও । বেলা বাড়ছিল - রোদ সরে সরে গাছের ছায়া লম্বা হচ্ছিল । সন্ধে হয়ে গেল, তবে ঘরে ফিরল মংলু ।

    বাপু ঘরে নেই, বোধহয় সন্ধের নেশা করতে গেছে । মংলু ভাঙ্গা, চটা ওঠা, কলাই করা থালা পেতে বসে পড়ল । বলল, মা ক্ষিদে পেয়েছে, রোটি দে ।

    ওড়না দিয়ে চোখের কোণে চলে আসা জলটা মুছে নিল ওর মা । বলল, রোটি দেব কোথা থেকে ? ঘরে আটা নেই । তোর বাপুরও কাজ নেই কয়েকদিন ধরে । যে কটা পয়সা ছিল তাই নিয়ে দারু গিলতে গেল এখন । আজ আর খানা নেই - শুয়ে ঘুমিয়ে পড়, মেরে লাল ।

    অনেক রাতে ঘুম ভাঙ্গল মংলুর । ক্ষিদেটা জোরালো হয়ে পেটে ধাক্কা মারছে । বাপুর নাক যথারীতি গর্জন করছে । মংলু শুয়ে শুয়েই হাত বাড়ায় । মায়ের গায়ে ঠেকে যায় হাতটা ।

    গড়িয়ে মায়ের কাছে সরে আসে মংলু । মাকে আঁকড়ে ধরে কোলে মুখ গোঁজে । কাঠির মত রোগা দুই হাতে মা জাপটে ধরে ওকে । মায়ের কোলটা চমত্কার নরম । মংলুর ক্ষিদের খোঁচাটা ভোঁতা হয়ে আসে - ওর সারা শরীরে এই আরামের ওমটা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উঠতে থাকে । দু চোখ বুজে আসে মংলুর ।

    অনেক অনেক ওপরে একটা সোনালী রঙের মেঘ, সেখানে সব রামধনুর আলোয় রাঙানো । সেখানে মায়ের কোলে বসে মংলু দোল খায় । পায়ের নীচে বহুদূরে ধূলো, মাটি, কাদা । সেখানে থিক থিক করছে গাদা গাদা লোক । গোরা রঙের বিলিতি পুলিস, পাকানো গোঁফওয়ালা দিশি পুলিস, সেপাই, শান্ত্রী, লোক-লস্কর । রাজার আসার অপেক্ষায় আছে ওরা । ছোট ছোট সাইজ সকলের - এই আরশোলা ফড়িঙের মত ।

    মায়ের হাড় পাঁজরা বার করা বুকের সঙ্গে লেপ্টে ঘুমোয় মংলু । ওর ধূলোমাখা ঠোঁটের কোণে লেগে থাকে ছোট এক টুকরো হাসি ।

    (পরবাস, মার্চ, ২০০৬)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)