• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩৬ | অক্টোবর ২০০৫ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • এবারে পুজোয় : মীনাক্ষী দত্ত

    কলকাতায় আমাদের পাড়ায় একটাই পুজো হতো, জমজমাট পুজো । কতোদিন আগে থেকে একটু একটু করে মণ্ডপ তৈরি হচ্ছে, পাড়ার দাদারা ভাঁজ করা চেয়ার পেতে বসে চা-সিগারেট খেতে খেতে তদারকি করছেন, ছেলের দল কোমর বেঁধে চাঁদা তুলতে বেরুচ্ছে । প্রাক-পূজা মিটিঙ বসছে, তাতে সব গুরুতর সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, কাকে কতো দিতে হবে তা ঠিক হয়ে যাচ্ছে ।

    আমাদের কাছে যা চাওয়া হতো তার অঙ্কটা আমাদের পক্ষে বেশি হলেও দিতাম, খুশি হয়েই দিতাম । বাঙালি হিন্দুর জীবনে দূর্গাপূজার চাইতে বড়ো সামাজিক উত্সব আর নেই, একে ঠিক ধর্মীয় অনুষ্ঠান বলা যায় না । চারদিনের মুক্তি, নতুন জামা, আড্ডা । কিশোর কিশোরীর প্রেমের সুযোগ, নাটকের রিহার্সেল, পুজো সংখ্যা, পুজোর রেকর্ড, ঢাকের বাদ্যি - কতো কী !

    একবার পাড়ার মহিলারা দল বেঁধে এলেন পুজোর আগে । বললেন, `আপনি কোনোবার পুজোয় যোগ দেন না । এবার আসতেই হবে।' `কেন ?' `কারণ এবার মেয়েদের পুজো,' তাঁরা জানালেন ।

    আমি ভয়ানক খুশি হলাম । সব সময় আমার মনে হয় ছেলেদের সঙ্গে মেয়েরাও কেন চাঁদা তুলতে বেরোয় না, কেন যায় না হৈ হৈ করে প্রতিমা আনতে, বিসর্জন দিতে, কেন নাচে না ভাসানের নাচ ?

    আমাদের কৈশোরে আমার মা প্রতিভা বসু আমাদের নিয়ে একটা নাটকের দল করেছিলেন । মাঝে মাঝে চ্যারিটি শো হতো । তখন মা তালিকা তৈরি করে দিতেন, লেখক, চিত্রকর, অভিনেতা, গায়কদের কাছে আমরা যেতাম টিকিট বিক্রি করতে । বাবার ছোটোবেলার বন্ধু কবি অজিত দত্তর ছেলে শঙ্কু (সত্রাজিৎ দত্ত) আর আমি ছিলাম প্রাণের বন্ধু । আমরা সারা শহর ঘুরে ঘুরে টিকিট বিক্রি করতে যেতাম সেইসব আরাধ্য দেবদেবীর বাড়ি - কন্দর্পকান্তি বিষ্ণু দে, ইন্দ্রতুল্য সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, লাজুক শামুকের মতো গুটোনো জীবনানন্দ দাশ, মধুরেক্ষণা যাঁদের কলম, সেই লীলা মজুমদার, আশাপূর্ণা দেবী, জীবনে যাঁরা রুপোলি পর্দার চেয়েও মোহিনী - সুনন্দা দেবী, ভারতী দেবী, চন্দ্রাবতী, জলদকন্ঠ বিকাশ রায়, বসন্ত চৌধুরী, মধুকন্ঠ হেমন্ত ও শ্যামল ।

    এর আগে, আরো অল্পবয়সে, আমি শঙ্কুকে অনুরোধ করতাম আমাকে তাদের ক্রিকেট খেলার ক্লাবে নিয়ে যেতে, তখন কিন্তু শঙ্কু কিছুতে রাজি হতো না, বলতো, `না, তুমি তো মেয়ে, মেয়েরা ক্রিকেট খেলে না ।' এইভাবে শঙ্কু ও তার বালক বন্ধুরা মার্বেল খেলা, ঘুড়ি ওড়ানো সব বিষয়েই আমার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলো । বস্তুত, আমার সঙ্গে খেলতে যে তাদের খারাপ লাগতো তা নয়, তাদের ছিলো পিয়ার প্রেসারের সমস্যা - অন্য ছেলেরা কী বলবে ! বলবে, `এমা ! তুই মেয়েদের সঙ্গে খেলিস !' `তুই কি মেয়ে' শোনার চাইতে অপমান একটি ছেলের আর কী হতে পারে ? এখনো যে এ সমস্যাটা গেছে তা নয় । আমার নাতি নিষাদ তার জন্মদিনে কোনো মেয়েকে নেমন্তন্ন করে না । এগারো বছরের এই বালকের মুখে প্রায়ই অবজ্ঞাসূচক `গার্লি' বিশেষণটা শোনা যায় ।

    মেয়েরা পুজো করবেন শুনে তাই আমি উত্সাহিত । বললাম, `বা: ! নিশ্চয়ই যোগ দেবো । কাকে দিয়ে পুজো করাবেন ?'

    মহিলারা বিস্মিত হয়ে বললেন, `কেন ? পুরুতমশাই পুজো করবেন !'

    আমি ততক্ষণে রমা চৌধুরী, রাধারাণী দেবী, সুকুমারী ভট্টাচার্য, আশাপূর্ণা দেবী, প্রতিভা বসুকে পুরোহিত রূপে ভাবতে শুরু করেছি । এঁরা সকলেই যে সংস্কৃত পণ্ডিত তা নয়, কেউ কেউ তো বটে ! বললাম, `তবে যে বললেন মেয়েদের পুজো ?' তখন তাঁরা জানালেন যে পুজো করবেন পুরুষ, ঠাকুর আনবে ছেলেরা, ধুনুচি-নৃত্য, ভাসানের নাচ সবই যেমন হয় তেমন হবে, শুধু মেয়েদের মধ্য থেকে হবে ট্রেজারার, হিসেব রাখার কাজটা তারা করবে কারণ আমাদের পাড়ার ছেলেরা নাকি আজকাল চাঁদার টাকা নিয়ে নয়-ছয় করে, পুজোর প্রতি রাত্রে তারা মদ খেয়ে নেশা করে হুল্লোড় বাঁধায় । মনে মনে বলি, শুধু আজকাল ? শুধু এই পাড়ার ছেলেরা ? শুধু কি পুজোর সময় ?

    এটা বছর তিরিশেক আগের কথা । যতোদূর জানি এখনো আমাদের পাড়ার পুজোয় পুরুতমশাই বিড়বিড় করে কীসব যেন মন্ত্র পড়ে চলেছেন, মেয়েরা স্নান করে, কোরা শাড়ি পরে তাঁর জোগান দিচ্ছেন, ভোগ রাঁধছেন । সেদিন মহিলারা আমাকে জানিয়েছিলেন যে কী করা যাবে, শাস্ত্রে যা আছে তাই তো করতে হবে ! এমন অবাস্তব কথা যাঁরা বলতে পারেন তাঁদের সঙ্গে তর্ক করা অনর্থক জ্ঞানে চুপচাপ চা সিঙাড়া পরিবেশন করেছিলাম ।

    `শাস্ত্রে আছে' এই কথাটির চাইতে বিপজ্জনকও আর কিছু নেই । এই কথা বলে মানুষ যতো পাপ করেছে, ধর্মের অজুহাতে যতো যুদ্ধ করেছে, আর কোনো কিছুতে তেমন হয়নি । পাঁচ হাজার বছর ধরে শাস্ত্রীয় অনুশাসন সমস্ত ধর্মের মানুষকে উন্মাদ করে ছেড়েছে । এখন সময় এসেছে শাস্ত্র ব্যাপারটা নতুন করে দেখার । কোন শাস্ত্র ? কার লেখা ? কবে লেখা ? আমরা কি চিকিত্সা কি বিজ্ঞান বিষয়ে খৃস্টপূর্ব শতকের বিশ্বাস সমর্থন করি ? তবে ধর্মচিন্তা আলাদা হবে কেন ?

    শাস্ত্র কী ? কিছু ক্ষমতাশালী লোক বা গোষ্ঠী বিভিন্ন যুগে শাস্ত্র তৈরি করেছিলেন । সেই সেই যুগের বোধ, উপলব্ধি, সংস্কার জমেছে গাছের যেমন গঁদের আঠা জমে । অনেক ব্যক্তিগত এযাজেণ্ডা, ঈর্ষা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা । স্বার্থপরতা, আত্মকেন্দ্রিকতাও এতে প্রকাশ পায় । ক্ষমতারও একটা ব্যাপার আছে-কে নেবে, কে বঞ্চিত হবে । শাস্ত্র আইন নয়, সংবিধান নয়, পৃথিবীর সকল ধর্মের শাস্ত্র আছে, অনুশাসন আছে, যা মেনে চলার প্রশ্ন আজ আর নেই ।

    শাস্ত্র আমাদের কী দিয়েছে ? শাস্ত্র শিখিয়েছে মানুষে মানুষে তফাৎ করতে । মেয়েদের তো শাস্ত্রের বচন মানার প্রশ্নই নেই, সব শাস্ত্রই তাদের বিপক্ষে ।

    শাস্ত্রে আছে :
    অষ্টবর্ষা ভবেদ গৌরী নববর্ষা তু রোহিণী
    দশবর্ষা ভবেৎ কন্যা উধ্বং রজ:স্বলা

    রজ:স্বলা হবার আগেই কন্যাকে পাত্রস্থ করতে হবে, আট বছর বয়সই তাই আদর্শ সময় । মনুসংহিতায় আছে সদ্যোজাত কন্যাকে পাত্রস্থ করতে পারলে পিতার স্বর্গবাস হয়, কেউ আটকাতে পারবে না তাঁর স্বর্গে যাওয়া ।

    শাস্ত্রে বলেছে
    পিতা বক্ষতি কৌমারে
    ভর্তা রক্ষতি যৌবনে
    রক্ষন্তি স্থবিরে পুত্রা
    ন স্ত্রী স্বাতন্ত্রমর্হতি

    স্বাধীনতায় নারীর অধিকার নেই ।

    সমস্ত শাস্ত্রই কি ভয় পেতো যাকে হিন্দুরা বলেছেন প্রকৃতি এবং যাকে এখন আমরা বন্দনা করি ংত্রংশভষ্‌ ত্রছঞণ্ণশং যংন্‌ বলে ?

    নারী হোম করতে পারবে না, উপনয়নে তার অধিকার নেই, ব্রহ্মচর্য তার জন্য নিষিদ্ধ । বলেছে : যজ্ঞকালে কুকুর, শুদ্র ও স্ত্রীলোকের দিকে তাকালে দেবগণ কুপিত হন । যজ্ঞের পবিত্রতা বিনষ্ট হয় । ভাবুন !

    শাস্ত্রানুসারে মেয়েদের নিজের ঘর নেই (বাপের বাড়ি, স্বামীর বাড়ি, ছেলের বাড়ি) নিজের সন্তানের উপর কর্তৃত্ব নেই । খুন করা লেজিটিমাইজ করার জন্য সতীদাহ প্রথা, বৈধব্য প্রথার মতো সেডিষ্টিক ব্যাপার তো ব্রাহ্মণরাই মাথা খাটিয়ে বার করেছে । সবই শাস্ত্রের নামে চালানো হয়েছিলো ! এখন কি আর আমরা শাস্ত্রের ঐসব `পবিত্র বচন' মেনে চলছি ? তবে পুজোর ব্যাপারে মানা কেন ?

    হিন্দুধর্মের দু'একটা ভালো দিক আছে যা অন্য ধর্মে নেই । নাস্তিক, আস্তিক, সংশয়বাদী, একেশ্বরবাদী - যে কেউ হিন্দু হতে পারেন । সেই অর্থে জন্মসূত্রে আমিও হিন্দু । কোনো ধর্মীয় অনুশাসন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, আচার বা পোশাকের ব্যাপারে বাধ্যবাধকতা আমার নেই । নেই টুপি, নেই পাগড়ি, নেই হিজাব । আমাদের নেই কোনো একটিমাত্র গ্রন্থ- বাইবেল, কোরান, জেন্দাবেস্তা, গ্রন্থসাহেব ।

    অনেকে বলেন বেদ অভ্রান্ত । কিন্তু কোন বেদ ? বেদ তো চারটে । অনেকে বলেন গীতা । কিন্তু গীতার তো বহুধরনের ব্যাখ্যা । কেউ কি বলতে পারে কোন ব্যাখ্যা সঠিক ? বাঙালি মুসলমান মহিলারা যেমন এক বর্ণও আরবি না জেনে মানে না বুঝে নামাজ পড়েন, হিন্দু বাঙালি মহিলা মানে না বুঝে গুরুঠাকুরের কাছে গিয়ে গীতাপাঠ শোনেন ।

    শাস্ত্রে কি সর্বজনীন পুজোর বিধান আছে ? চাঁদা তুলে পুজোর কথা কি বিশশতকের আগে কেউ শুনেছে : প্রথম যখন চাঁদা তুলে পুজোর প্রস্তাব হলো তখন তো উপবীতধারীরা গেল গেল রব তুলেছিলেন । এখন তো সব পুজোই সর্বজনীন । এবার তাহলে চালু হোক মেয়েদের দিয়ে পুজো করানো, এবং বলাই বাহুল্য অব্রাহ্মণদের দিয়ে কারণ মেয়েদের দ্বিজত্ব নেই ।

    হিন্দুধর্মের কল্পনার দিকটা
    ভধশভংধণ্ণয -এটা মানতেই হয় । নারীত্বের যতো কল্পনা আছে দূর্গা বোধহয় তার সবচাইতে সুন্দর প্রতীক । দূর্গার অপর রূপ কালী । তিনিই সর্বময়ী, তিনিই ধ্বংস করেন, তিনিই সৃষ্টি করেন, তিনিই রক্ষা করেন । পুরুষকে কখনো রাখেন মাথায় কখনো পায়ের নিচে । তিনিই কৃষ্ণবর্ণা, তিনিই গৌরী নারী -- এই কল্পনা অন্য কোনো ধর্মে নেই । হিন্দুধর্মে নারীর অপমানও যেমন, তেমনি ভক্তি ও কবিত্বের চূড়ান্ত রূপও দেখতে পাই ।

    মেয়েদের দ্বিজত্ব নেই । তাদের নবজন্ম হয় না, তাই সব মেয়েই সমান (আসলে কিন্তু দ্বিজত্ব মেয়েদেরই হয় যখন তারা ঋতুমতী হয় । আসলে বোধহয় এই আদি ও শ্রেষ্ঠ শক্তির বহি:প্রকাশকেই পুরুষ ভয় পেতো) । মেয়েদের মধ্যে তাই জাতিবিচার নেই, যে-কোনো শিক্ষিত সংস্কৃত জানা মেয়ে পুজো করতে পারেন । বেদ উচ্চারণে নাকি মেয়েদের অধিকার নেই (প্রসঙ্গত, কলকাতায় শঙ্করাচার্য এসে একথা বলায় একটি মেয়ে তাঁকে চড় মেরেছিলো, মনে আছে) । থাক তাহলে বেদের গম্ভীর-সম্ভীর মন্ত্র তোলা । সেসব কি কেউ পড়েন আজকাল ! শতাব্দীর পর শতাব্দীর ধুলো জমেছে তার উপর । তার মানেও আজকাল কেউ বোঝে না । পালন করা তো দূরের কথা ।

    বিশেষ করে দূর্গা যখন নিজে একজন মেয়ে, মেয়েদের হাতের পুজোয় তাঁর আপত্তি থাকার কথা নয় । পুরুষরাও তাতে বেশ খুশিই হবেন, শুধু পূজ্যা দেবী নন । পুজারিনিরাও তো তাঁদের উপাস্যা নারী । তাছাড়া, সংসারের বেশিরভাগ মেয়েরই দশটা হাত, আরো বেশি । দূর্গাকে তাই আমার সব মেয়ের প্রতীক বলে মনে হয় ।

    আমাদের মাথাও দশটা । কিন্তু পুরুষদের কাছ থেকে সেটা লুকিয়ে রাখতেই আমরা অভ্যস্ত ছিলাম । এখন আস্তে আস্তে উঁকি দিতে শুরু করেছি : উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম হয়ে, এরোপ্লেনের পাইলট হয়ে, স্টেম-সেল রিসার্চে নেতৃত্ব দিয়ে, মহাশূন্যে যাত্রা করে ।

    পুজোর মন্ত্র থেকে কিছু কিছু শব্দ বদলাতে হবে বা বাদ দিতে হবে । মেয়েদের নতুন পুজোয় পুরোহিত চ্যাঁচাবেন না `দেহি দেহি' করে । আমরা বলবো না ধনং দেহি, যশং দেহি, পুত্রং দেহি । যদি নেহাৎ বলতেই চান তাহলে পুত্র-র জায়গায় সন্তান শব্দটি বসিয়ে নেবেন ।




    (পরবাস-৩৬, অক্টোবর, ২০০৫)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments