• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩৬ | অক্টোবর ২০০৫ | গল্প
    Share
  • বিজয়া : জয়শঙ্কর প্রসাদ
    translated from Hindi to Bengali by দোলনচাঁপা চক্রবর্তী

    কমলের সব টাকা উড়ে গেলো - সব সম্পত্তি বিক্রি হয়ে গেলো । বন্ধুবান্ধবের দল ভরপুর দালালি করেছে - বিশ্বাস করে যেখানেই টাকা ঢেলেছে, সেখানেই সে ধোঁকা খেয়েছে ! যারা তার সঙ্গে মৌজ-মস্তি করে দিন কাটাতো, রাত্রির আনন্দে অংশ নিতো, তারাই ত্রক্রমশ: ওর পকেট কাটতে শুরু করেছিলো । কোথাও আর কিচ্ছু তারা বাকি রাখলো না । সুখ-ভোগ করার যত রকম নিত্য-নতুন উপায় ছিলো, সাধ্যের মধ্যে থেকে সে সবের আনন্দ নেবার উত্সাহ ঠাণ্ডা হয়ে এসেছিলো ।

    বাকি পড়েছিলো একটা টাকা ।

    উন্মত্ত আনন্দে আকুল হয়ে ওঠার আকাঙ্খা যুবকের বড়ো বেশি ছিলো । বাধাহীন সুখ-ভোগের সময় পেয়েওছিলো সে- কিন্তু সব শেষ হয়ে গেলো । আজ নদীর তীরে চুপচাপ বসে তার মধ্যে স্রোতের প্রবাহে বিলীন হয়ে যাওয়ার ইচ্ছা জেগে উঠলো । ও পারে কারুর চিতা জ্বলছিলো ; ধূসর সন্ধ্যার ভিতর তা আলো ছড়িয়ে দিতে চাইছে । আকাশে মেঘ । তার মধ্যে থেকে গোল টাকার মতো চাঁদ বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করছিলো । গাছপালার হরিয়ালীর ভিতর থেকে মাঝে মাঝে গ্রামের প্রদীপের আলো ঠিকরে আসে । কমল টাকাটা বার করলো । ওই এক টাকায় কোন বিনোদন হওয়া সম্ভব নয় । সে বন্ধুদের সঙ্গে যেতে পারবে না । একবার ভাবলো, এটা নদীর জলেই বিসর্জন দিয়ে দিই । কিন্তু সাহস হোলো না - ওটাই তার শেষ টাকা । সে একদৃষ্টে নদীর প্রবাহ দেখতে লাগলো ; কানে কিছু শোনা যায় না, দেখতে পেলেও কোন দৃশ্য অনুভব করা যায় না - সে একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেলো জড়পদার্থের মতো, মূক এবং হৃদয়হীন হয়ে গেলো ।

    `মা, কুলতা এনে দে -- দছমী দেখতে যাবো' ।

    ওরে আমার সোনা ! কোথা থেকে আনি - পেট ভরে ভাত পাই না - না-না, কেঁদো না সোনা - নিয়ে আসব ; কিন্তু কি করে আনি ? হা ঈশ্বর ! ওই পাষণ্ড আমার সর্বস্ব লুটে নিয়েছে, আমার আর কিচ্ছু বাকি রাখে নি । না-না, আমার একটা ধন তো আছে ! কাঙালের অমূল্য ধন । এই তো আমার অনেক । যাবো, যেমন করে পারি একটা কুর্তা কিনে আনবো । ধার করবো । দশমী- বিজয়া দশমীর দিন আমার ছেলে ছেঁড়াফাটা পরে থাকতে পারে না ।

    পাশ দিয়ে যাবার সময় মা-ছেলের এই কথাবার্তা কমলের কানে গেলো । সে উঠে ওদের কাছে এসে ডাকলো -- সুন্দরী !

    -- বাবুজি ! -- সুন্দরী অবাক স্বরে বলে উঠলো ; বাচ্চাটাও মা'র স্বরে স্বর মিলিয়ে বলে উঠলো- বাবুজি !

    কমল টাকাটা তার দিকে বাড়িয়ে ধরে বললো, - সুন্দরী, এই এক টাকাই বেঁচেছে , এটা তুমি নাও । বাচ্চাটাকে কুর্তা কিনে দাও । আমি তোমার সঙ্গে ঘোর অন্যায় করেছি, আমাকে ক্ষমা করতে পারো ?

    বাচ্চাটা হাত বাড়িয়ে দিলে সুন্দরী তার ছোট্ট হাতদুটো নিজের হাতের মধ্যে জড়িয়ে নিয়ে বললো - না, আমার বাচ্চার কুর্তার থেকে বেশি জরুরি আপনার পেট চালানো । আমি সব জানি ।

    আমার- আজই শেষ দিন, তাই আর আমার দরকার নেই -এই পাপী জীবন রেখে কি করবো ? সুন্দরী ! আমি তোমার ওপর বড়ো অত্যাচার করেছি, ক্ষমা করতে পারো আমায় ! ওহ ! এই শেষ টাকাটা নিয়ে আমাকে ক্ষমা করে দাও । এই এক টাকাটাই সার্থক হোক !

    -- আজ তুমি নিজের পাপের মূল্য দিতে চাইছো- তাও এক টাকা ?
    -- আর একটা ফুটো পয়সাও নেই সুন্দরী ! লাখ টাকা উড়িয়ে দিয়েছি, আমি লোভী নই ।
    -- বিধবার সর্বস্ব'র দাম এত কম হতে পারে না ।
    -- আমায় ধিক্কার দাও, আমার ওপর থুতু দাও ।
    -- তার দরকার নেই -- সমাজকে ভয় পেও না । অত্যাচারী সমাজ নিজের কান হাত দিয়ে ঢেকে `পাপ পাপ' বলে চঁযাচায় । সেই পাপের শব্দ অন্যে শুনতে পায় ; কিন্তু সে নিজে কিছুই শোনে না । এসো, আমরা সমাজকে দেখিয়ে দিই যে সে কত ভ্রান্ত । আমি পরিশ্রম করে অন্তত: চারটে আনা রোজই রোজগার করি । তুমিও রূপার গয়না পরিষ্কার করে কিছু টাকা উপায় করতে পারো । অল্প পরিশ্রমেই আমরা মোটামুটি ভাবে সচ্ছল সংসার চালিয়ে নিতে পারবো । এসো তো ।

    সুন্দরী দৃঢ় হাতে কমলের হাত জড়িয়ে ধরলো ।

    বাচ্চাটা বললো -- চলো না, বাবুজি !

    কমল দেখলো -- চাঁদ পূর্ণ শোভায় বিকশিত হয়েছে । সে বাচ্চাটার হাতে টাকাটা দিয়ে তাকে কোলে তুলে নিলো ।

    অভাবের এক কঠিন ঝাপটায় ধন-দৌলতের কামনা-বাসনা পূণ্যে পরিণত হয়ে গেলো । কমল আগের কথা ভুলে পলকের মধ্যে চাঙ্গা হয়ে উঠলো । তার মন হাল্কা হয়ে গেলো । কোলে বাচ্চা আর সুন্দরীকে পাশে নিয়ে সে বিজয়া দশমীর মেলা দেখতে রওনা হল ।

    বিজয়ার আশীর্ব্বাদের মতো চাঁদ মুচকি হাসলো ।




    জয়শঙ্কর প্রসাদ হিন্দী সাহিত্যের ইতিহাসে শ্রী জয়শঙ্কর প্রসাদ (১৮৮৯-১৯৩৭) একটি সুপরিচিত এবং সর্বজনশ্রদ্ধেয় নাম । আধুনিক হিন্দী সাহিত্যের পরিকাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে । বারাণসীর অত্যন্ত সমৃদ্ধ বণিক পরিবারের সন্তান জয়শঙ্কর প্রসাদ অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর স্কুল ছেড়ে বাড়িতেই পড়াশুনা আরম্ভ করেন । ধর্মীয় এবং সাংষ্কৃতিক পারিবারিক আবহে বেড়ে ওঠার কারণে তিনি ভারতীয় ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য, এবং পুরাণ অধ্যয়নে ব্রতী হন । ইংরেজি ছাড়াও তিনি সংষ্কৃত, পালি এবং প্রাকৃত ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন । কবিতা, ছোট গল্প, ঊপন্যাস, নাটক, এবং প্রবন্ধ - সাহিত্যের সবক'টি ধারাতেই তাঁর বিচরণ ছিলো সাবলীল । প্রসিদ্ধ ছায়াবাদী ধারার কবি শ্রী প্রসাদ রচিত `কামায়নী' হিন্দী সাহিত্যের ইতিহাসে সর্বোত্কৃষ্ট বলে পরিগণিত । রামচরিতমানসের পরেই এর স্থান স্বীকৃত হয়েছে । ছায়া, আকাশ-দীপ, আঁংইধ, এবং ইন্দ্রজাল তাঁর প্রসিদ্ধ ছোট গল্প সংকলন । প্রবন্ধগুলির মধ্যে `কাব্য ঔর কলা', `রহস্যবাদ', `যথার্থবাদ ঔর ছায়াবাদ' প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য । নাটক রচনায় প্রথমদিকে সংস্কৃতের ভাবানুসারী হলেও পরবর্তীকালে তাঁর নাটকে বাংলা এবং পারস্যদেশীয় নাটকের প্রভাব পড়ে । স্কন্দগুপ্ত, চন্দ্রগুপ্ত, এবং ধ্রূবস্বামিনী অধিক খ্যাতিলাভ করলেও জয়শঙ্কর প্রসাদ বিরচিত আরো দশটি নাটক হিন্দী সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে ।

    (পরবাস, অক্টোবর, ২০০৫)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments