• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩৬ | অক্টোবর ২০০৫ | গল্প
    Share
  • ময়নাতদন্তহীন একটি মৃত্যু : মানস চৌধুরী

    ধনরাজ আর শাহাবুদ্দিন ল্যাটকা মেরে বসে ছিল । আধমরা কতগুলো ফুলের গাছ লাগানো আছে জেনারেল ওয়ার্ডের পাশ ঘেঁষে, আর লোহার গেটটা পর্যন্ত । কয়েকটা মোরগফুলের গাছে নারকেলের জমাট ছোবড়ার মত ফুল ধরে আছে । ভাল করে না দেখলে মানুষের গুয়ের মত দেখায় । এপাশে খানতিনেক দুপুরমণির গাছ গোঁয়ারের মত বেঁচে আছে । পাতাবাহারের গাছ চারটা দীর্ঘদিন কাঁচির অভাবে ডাঁটাশাকের গাছের মত ধিঙি । সেই বাগানটাকে ইটের চাতাল করে ঘেরা । সেখানে পাছা পেড়ে পা মেলে দিয়ে বসে ছিল শাহাবুদ্দিন । আর দুই-হাঁটু ভাঁজ করে সেখানে মুখ আর গলার গামছাখানা একত্রে গুঁজে রেখে বসে ছিল ধনরাজ । দুজনেরই দৃষ্টি জেনারেল ওয়ার্ড়ের বারান্দায় যেখানে ওসি সাহেবের সঙ্গে কথা বলছিল জনা তিনেক লোক । পেছনে নেহায়েৎ হুকুমসাপেক্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে নিরুপায় দুজন কনস্টেবল পুলিশ । কথা বলছিল যে তিনজন, তাদের একজন মাঝারি বয়সের পুরুষ । সে-ই হাত নেড়ে অনেক কথা বলছিল । আর ওসি সাহেব মাথা নাড়ছিল । দূর থেকে সম্মতি মনে হয় । মনে হয় ধনরাজদেরও । সেদিকে তাকিয়েই তারা ল্যাটকা মেরে বসে ছিল । কথা শেষ করে দুজন পুলিশ সমেত ওসি উঠল গিয়ে ডাইহাটসু জীপে, ওয়ার্ডের পাশের ন্যাড়ামাঠে রাখা । তারপর জীপ ঘুরিয়ে হাসপাতালের মরচে ধরা লোহার গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল, ধনরাজদের একেবারে কাছ দিয়ে ।

    জীপটা বেরিয়ে গেলে শাহাবুদ্দিন ক্লান্তভাবে উঠে দাঁড়াল ।

    ছোট্ট শহরের সবকিছুই লাগোয়া । কেবল কলেজের পাশ দিয়ে যে সড়কটার দূরপাল্লার বাসগুলো আসা-যাওয়া করে সেখানে ধান আর গমের খেত, মৌসুমে ছোলা কিংবা মুসুরি । যখন দিকভ্রান্ত বাতাসেরা শহরের ভেতরে ঢুকব ঢুকব করেও না ঢুকে পাশ দিয়ে চলে যায়, যাবার কালে সেইসব ক্ষেতের উপরে আলতো করে ছোঁয়া রেখে যায় । আর ধানের, গমের কিংবা ছোলার কচি দেহগুলো তিরতির করে কাঁপতে থাকে সেই বাতাসে । দুধের সরের মতো কাঁপন তাদের । সে কাঁপন দেখে দলছুট যে বুলবুল একমনে খুঁটির উপর বসে ছিল সে উড়ে অন্য কোথাও যায় । ধনরাজ কিংবা শাহাবুদ্দিনের দিন কেটে যায় তাই দেখে । তাই দেখে দেখে ওরা ঘুমিয়ে পড়ে, অবেলায় । আবার অবেলাতেই ঘুম থেকে ওঠে । যা কিছু কাজ ওদের তা সব রাত্রিবেলাতেই বেশি ।

    লাশ-কাটা ঘরখানা সরকারি । কিন্তু অন্যসব সরকারি অফিস থেকে কিছু দূরে । একটা তিন কামরার একতলা বাড়ি । দরজাগুলো দুই পাল্লার । এতগুলো বছরের গাঢ় স্মৃতিতে সেগুলো ভাঁজে ভাঁজে মিশ খায় না । ঠেসে ধরে লাগাতে হয় । তবে লাগানোর তেমন রেওয়াজ নেই । লাশ আসে লাশ যায় । লাশেরা সওয়ার হয়ে আসে, সওয়ার হয়েই যায় । ধনরাজরা কেবল কেউ না কেউ থাকেই ওখানে । জানালার পাল্লাগুলোর খাবলা উঠে গেছে । লোহার সমান্তরাল শিকের দুয়েকটি উধাও । যেগুলো টিকে আছে সেগুলোর নিচের দিক ক্ষয়ে গেছে । প্রায় আগরবাতির মতো দেখায় । বাইরের দেয়ালে কোনো এক কালে লাল রং করা হয়েছিল । আর এই ঐতিহ্যকে বরাবর রাখতে এখন চটা ওঠা দেয়ালেও একপ্রস্থ লাল রঙ লাগিয়ে যায় রঙের কর্মচারিরা । তারই মাঝখান থেকে বেয়াড়া রকমের বেঁচে-থাকা অশ্বথ্থের তিনখানা গাছ তিন প্রান্ত থেকে অহেতুক এক প্রতিযোগিতায় বাড়ছে । ভেতরের দেয়াল সাদা । সেই সাদা দেয়ালে রক্ত, পানের পিক, অসতর্ক কাশির শুকনো অবশিষ্ট, আর নিছক মনোযোগে আঁকা কয়লার ফুল-লতা-পাতা । বাইরের বৃষ্টিরা অবাধ ভেতরে ঢুকতে পারে না - এই যন্ত্রণায় দেয়ালটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ঢ্যাবসা হয়ে গেছে । সেই সোঁদা দেয়ালে কয়লা-শিল্পীর কসরৎ করে আঁকশিল্প জারি রাখতে হয় । তথাপি এভাবেই অলস কর্মহীন কোনো রাত্রে সে এঁকে যায় । লাশ-কাটা ঘর বলেই বোধহয় এই স্বাধীনতায় কোনো হস্তক্ষেপ হয় না এই সরকারি ভবনে । তিন কামরার একটিতে পাশাপাশি দুটো তক্তপোশ পাতা । নিমকাঠের কাঠামো লালচে হয়ে আছে । আর ওপরে আমকাঠের ছাউনি পেরেকের নিষ্ঠুরতায় ঠিকমতো বেঁকে উঠতে পারেনি । এরই মধ্যে ধনরাজ কিংবা শাহাবুদ্দিন, কিংবা মহারাজ, রামগোপাল, কার্তিক, আর মোফাজ্জল ঘুমিয়ে কাটায় । রাতে ঘুমায় যখন প্রায়শই মধ্যঘরে রাখা টিনের দেরাজে কোনো না কোনো নিষ্প্রাণ অতিথি ঘুমায় । বিক্ষত তাদের দেহ কিছুমাত্র অস্বস্তিতে ফেলে না এদের । বরং নিয়মিত লোডশেডিং-এ ষাট ওয়াটের টিমটিমে বাতিটাও যখন জ্বলে না, সেই অন্ধকার রাতে মায়াবী এক আবিষ্টতা ঘরটাকে ঘিরে রাখে । ধনরাজদের সেই মায়া আর কাটানো হয় না ।

    ঠিক কবে এই বাড়িটা বানানো হয়েছিল এবং কী উদ্দেশ্যে তা বলবার মতো কেউ নেই । ধনরাজ জন্মানোরও ঢের আগে ওর বাবা এই কাজই করেছে । ধনরাজের বাবাই বা কোথ্থেকে এসে এই লাশকাটা ঘরের সম্রাট হয়েছিল সেও এক রহস্য । কিন্তু ধনরাজ কিংবা ওর ভাই মহারাজ ছোটবেলা থেকেই জানত যে এই কাজে তালিম নেয়া তাদের কর্তব্য । সেই কর্তব্যে এতগুলো বছরেও কিছুমাত্র সংশয় দেখা দেয়নি, দেখা দেয় না ।

    ধনরাজরা জানে যে ওরা সরকারি কর্মচারি । কিন্তু সেই কথা তিরতির করে কাঁপতে-থাকা ধানগাছের শরীর দেখবার কালে তাদের আর মনে পড়ে না । এমনকি মনে পড়ে না যখন রাত্রিবেলা অপর্যাপ্ত আলোর মধ্যে দু'জন মানুষ চারপাশ থেকে তাগাদা পায় তাড়াতাড়ি শেষ করবার জন্য, আর ধ্বস্তাধ্বস্তি করতে থাকে টেবিলের ওপর শায়িত মরদেহের সঙ্গে । হাসপাতালের লোকেরা আসে, আবার চলে যায় । ডাক্তারদের আসারও কথা । তারাও আসে । সুবিধামত । আবার চলে যায় । শক্ত বাদীপক্ষ না থাকলে ডাক্তারদের কাজটা এমন কিছু না । পুলিশেরা আসে । তারা অত সহজে যায় না । মরদেহের কিছু একটা ফয়সালা করে তারপর যায় । কেবল প্রতিমাসের প্রথম সপ্তাহে ধনরাজরা আদালতের কেরানির কাছে বেতন আনতে যায় । কেরানি তাদের নাম ডেকে ডেকে বেতন দেয় । তখন ওরা সবাই একত্রেই যায় । সেটাই নিয়মের মতো হয়ে গেছে ।

    "মহারা আ আ জ"
    "জ্বি"
    "ধনরা আ আ জ"...
    "রামগোপা আ আ ল"...
    "কার্তি ই ই ই ক"...
    এত কাছে দাঁড়িয়ে থাকে ওরা যে আদালতের কেরানির পক্ষে এত জোরে না ডাকলেও চলে । এ নিয়ে ভেবেছে ওরা । কিন্তু এই একটা দিনে লাশ-কাটা ঘরের বাইরে তাদের নামগুলো প্রকাশ্যে যখন ঘোষিত হয় তখন একটা চাপা উত্তেজনা বোধ করে ওরা । এই নামগুলো এখন ওরা এরকম জোরেই এদিন শুনতে চায় । কেবল শাহাবুদ্দিন বা মোফাজ্জলকে ডাকবার সময় প্রায় প্রতিবারই কেরানি স্বরবর্ণে মনোনিবেশ না করে ব্যঞ্জনবর্ণে হোঁচট খায় ।

    "শাহাব... উদ্দিন... কীরে মুসলমানের ছেলে লাশকাটতে আসলি কেমনে ?"

    এমন নয় যে প্রতিমাসেই প্রশ্নটা করে কেরানি । কিন্তু মাঝেমধ্যেই করে । আর শাহাবুদ্দিনও প্রথম প্রায় না-জানা উত্তরটাই হাতড়ে হাতড়ে দিতে চেষ্টা করত । এখন অবশ্য বুঝতে পারে উত্তরটা দেবার বিশেষ আবশ্যকতা নেই । কেরানি চায় শাহাবুদ্দিন জানুক তার আর ধনরাজের মধ্যে বিশেষ ফারাক আছে । কিংবা জানুক ধনরাজ । কিন্তু ফারাকটা ভাল করে শাহাবুদ্দিনের কখনোই বোঝা হয় না । বিশেষত যখন শিকভাঙা জানালা দিয়ে সামনের বিস্তরণশীল ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে থাকে সে, আর পাশের তক্তপোষে ধনরাজ উপুড় হয়ে লালা-ঝরানো অঘোর ঘুমিয়ে - কিছুতেই শাহাবুদ্দিন বুঝতে পারে না । কেবল আবছাভাবে মনে করতে চেষ্টা করে কবে কোন অদৃষ্ট রহস্যে কৈশোরে লাশকাটা ঘর দেখতে সে এসেছিল । তারপর কীভাবে এখানেই থেকে গেছে । হয়তো আর কোনো কাজ ও করতেই পারত না !

    কিন্তু ধনরাজ বা শাহাবুদ্দিনের জগতে এই দিনটা, কিংবা দিনটাকে ঘিরে যে দেনাপাওনা, তার পুরা মাহাত্ম্য কখনোই স্পষ্ট হয় না । যখন বেতন হিসেবে কুড়ি টাকা পায় ওরা তখন একটা স্তম্ভিত ফ্যালফ্যালে অনুভূতি তৈরি হয় । বহুক্ষণ সেই টাকাটা কোথাও গুঁজে রাখতে ভুলে যায় ওরা । যে যার নোটের দিকে তাকিয়ে থাকে । তারপর আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসে কেরানির ঘর থেকে । আবার ওরা টের পায় এই টাকাটা ওদের কাজের স্বীকৃতি । এমনকি হয়তো একমাত্র স্বীকৃতি যে ওরা সরকারের জন্য কাজ করছে । ওরা এমন একটা কিছু করছে যেটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ । কিন্তু কিছুতেই ওরা বুঝতে পারে না সেটা এমন চোরের মতো সন্তর্পণে লুকিয়ে রাখতে হয় কেন । কেন অনায়াসে আর পাঁচজনে ওদের সঙ্গে পাঁচ-দশটা প্রাত্যহিক আলাপ করে না । কিংবা লাশ-কাটা ছাড়া আর কীইবা করতে পারত তারা । এই সংশয়ের ঘোর অন্য দিনগুলোতে, বিশেষত: যখন পেশাগত ব্যস্ততায় কাটে, তাদের মনে অনেক দাগ কাটে না । মাসের তিন, চার বা পাঁচ তারিখে বেতন তুলতে গেলে এটা প্রতিবারেই সামনে চলে আসে । অনেক আলাপ তাদের মুখে আসে না । বরং তারা হাতে-পাওয়া নোটটা নাড়তে নাড়তে প্রত্যেকেই আলাদা করে ভাবতে থাকে । তারপর ফিরে আসে । আবারো তাদের কাজে । এই তিন কামরার দূরবর্তী অফিসে ।

    তবে হিসেব করে দেখলে বোঝা যাবে ধনরাজদের আয় কেবল মাসকাবারি বেতন এই কুড়ি টাকা নয় । ওরা লাশের মালিকপক্ষ থেকেও পয়সা পায় । লাশের মালিক তো আর লাশ নিজে হতে পারে না ! তাহলে ওদের পাবার কোনো আশা থাকত না । কিন্তু লাশের মালিক পক্ষ থাকে । তারা লাশপ্রতি পঞ্চাশ টাকা এমনকি একশ টাকা পর্যন্ত দেয় । একবার মোহনপুরের এক লোক এসেই পাঁচশ টাকা ধরিয়ে দিয়েছিল ধনরাজের হাতে । ধনরাজ ভালরকম ঘাবড়ে গিয়েছিল প্রথম । সেদিনও শাহাবুদ্দিন ছিল । ধনরাজ হাতে টাকাটা পেয়ে শাহাবুদ্দিনের দিকে তাকায় । দুজনেরই মনে হয়েছে কোনো ঝামেলা আছে মামলায় । ওদের বিস্ময় আর চেপে রাখতেও পারেনি ।

    "পাঁচশো টাকা !"
    "এই তো শেষ । আর তো কোনো খরচ নাই ।"
    কথাগুলো বলতে বলতে লোকটা কেঁদে ফেলেছিল । সেবার লাশ কাটতে গিয়ে কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল ধনরাজদের ।

    এই বখশিস নেয়া নিয়েও অনেক ভেবেছে ওরা । মরা মানুষের ওপর বখশিস নেয়া ওদের ঠিক মনে হয় না ! কিন্তু ওদের এই ভাবনার অনেক ফুরসৎ থাকে না । যখন বেলার পর বেলা, দিনের পর দিন একটা লাশ আসে না বলে লাশ-কাটা ঘরের মধ্যে অলস বসে থাকে, ওরা অনুভব করে এক তীক্ষণ অপেক্ষার ভার । তারপর সচকিত হয় - লাশের জন্য অপেক্ষা করছে এই ভেবে । তাও অপঘাতে মৃত্যু ! গ্লানি বোধ করে । পরিতাপ বোধ করে । কিন্তু পরের প্রহরে আবার অপেক্ষা করে । এই চক্র থেকে অনায়াসে মুক্তি ওরা পায় না ।

    তক্তপোশে ঘুমিয়ে পড়েছিল ধনরাজ । শাহাবুদ্দিন সকাল থেকে লাপাত্তা । একটা তক্ষক সেই সন্ধ্যা থেকে শিকভাঙা জানালার ওধার থেকে ডাকছিল । জানালার ধারে গিয়ে ধনরাজ খামকাই তক্ষকটাকে দেখার চেষ্টা করে । বিকেলের আলো যখন সবটা শুষে নিল রাত, ধনরাজের বুকটা আচমকাই খালি লাগতে থাকল । তখনই ওর তক্ষকের ডাকটা নিদারুণ কর্কশ লাগতে শুরু করে । একবার ভাবল গৌরীর সঙ্গে গিয়ে দেখা করে আসে । কিন্তু ওর গায়ে বেশ ব্যথা । ধনরাজ ভাবছিল জ্বর আসবে বুঝি । তক্তপোশে গুটিসুটি মেরে শুয়ে ধনরাজ বাসায় যাবে নাকি শাহাবুদ্দিনের জন্য অপেক্ষা করবে তাই ভাবছে । কখন ঘুমিয়ে পড়েছে ।

    সারাটা ঘর আগরবাতির গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে আছে । সেই গন্ধে ধনরাজের অবশ অবশ লাগে । ও ঘুমিয়ে পড়ার জন্য খুঁজে একটা বালিশ করে । আর কোথা থেকে শাহাবুদ্দিন এসে ধনরাজকে বোঝাতে শুরু করে এখন কিছুতেই ঘুমিয়ে থাকা যাবে না । ওর নাকি টেবিলে গিয়ে শুয়ে পড়তে হবে । আর দূর থেকে `টক্কা টক' `টক্কা টক' - খুব আজব ধরনের ঢাকের বাজনা শুনতে পায় ধনরাজ । সে-কথা সে শাহাবুদ্দিনের কাছে জানতে চায় । শাহাবুদ্দিন শুকনো মুখে থাকে । এসবের কিছুই উত্তর করে না । কেবল ধনরাজকে পীড়াপীড়ি করে টেবিলে গিয়ে শুয়ে পড়তে । অথচ ধনরাজের টেবিলে গিয়ে একটুও শুতে ইচ্ছে করছে না । ওর ভীষণ ভয় করছে । আর সেই ঢাকের আওয়াজটা ত্রক্রমশ: বাড়ছে । ধনরাজের তখন সবকিছু কেমন এলোমেলো লাগতে থাকে । ওর মনে হয় শাহাবুদ্দিন এর সবকিছুই জানে । শাহাবুদ্দিনকে সে জোর করতে থাকে । `আমি ঘুমাব' । শাহাবুদ্দিন তাকে বলে সে নাকি মরে গেছে, তাই টেবিলে শুতে হবে । এরপর সে জোর করে পাঁজাকোলা করে নিয়ে যেতে চায় ধনরাজকে ।

    শাহাবুদ্দিন ঢুকেই ধনরাজের কপালে হাত দেয় । গরমে পুড়ে যাচ্ছে ধনরাজের গা । শাহাবুদ্দিন নিজের বিছানা থেকে কাঁথাটা এনে ধনরাজের গায়ে দিতেই ধড়মড়িয়ে ওঠে সে । শিকভাঙা জানালার বাইরে কাঁঠাল গাছটার ধারে তখনো তক্ষকটা ডাকছে - `টিক্‌ কো, টিক্‌ কো, টিক্‌ কো । গত একটা সপ্তাহ ধরে যে লাশের জন্য অপেক্ষায় আছে ওরা, অন্ধকারে শাহাবুদ্দিনের মনে হলো সেই লাশই বুঝি ধনরাজ । সুইচ টিপে ষাট ওয়াটের বাতিটা জ্বালায় ধনরাজ । সদ্য ঘুম ভাঙা টসটসে লাল ঘোলাটে চোখ দেখলে কোনো জীবিত মানুষ মনে হয় না । কলসি থেকে মগে পানি ঢালে শাহাবুদ্দিন । হাতে সেই পানি নিয়ে ছিটিয়ে দেয় ধনরাজের চোখেমুখে । ধনরাজ খানিক ধাতস্থ হয় ।

    "স্বপন দেখিছি ।"
    "তোর তো জ্বর দেখি ।"
    "না জ্বর টর কই ।"
    ধনরাজ খানিক বিব্রত হয় । শাহাবুদ্দিনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে । ওর ইচ্ছা করে স্বপ্নের পুরা কাহিনিটা বলে । কিন্তু গুছিয়ে বলতে আর ইচ্ছে করছে না । আর এই স্বপ্নের কোনো মাথামুণ্ডুও ও পায় না ।

    `বাড়ি যাবি ?'
    শাহাবুদ্দিনের আকস্মিক প্রশ্নে ধনরাজ কথা খুঁজে পায় না । হঠাৎ ওর ডুকরে কান্না চলে আসে । সেটা সামাল দিতেই মাথার কাছে পুটলি পাকিয়ে রাখা আঁশটে গন্ধের গামছাখানা দিয়ে মুখ মোছার ভান করে ধনরাজ । মাথা নেড়ে জানায় ভাল আছে, বাড়ি যাবে না । শাহাবুদ্দিন এরপর ভাল খবরটা দিয়ে ধনরাজকে চাঙা করবার চেষ্টা করে -

    "হাসপাতালে বিষ-খাওয়া রুগি এসিছে ।"
    অনেকক্ষণ শাহাবুদ্দিনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে ধনরাজ । তারপর সম্ভবত: কথাটাকে এগিয়ে নিতেই জানতে চায় -

    "কখুন ?"
    শাহাবুদ্দিন সেই কথার উত্তর করে না । ধনরাজের পাশে এসে বসে -
    "এই রুগির টাকাডা তুই নিস । আমারি এবারি দেয়া লাগবি না ।"
    কিছুই আড়াল নয় জীবন তাদের । দিনলিপি গড়িয়ে গড়িয়ে শিকভাঙা জানালার এপাশ ওপাশ আসা-যাওয়া করে । আর পরস্পর উন্মোচিত হয় । ফলে যে জীবন এই লাশ-কাটা-ঘরের ধনরাজ বা শাহাবুদ্দিনের, বাইরের জীবনে সে জীবনের কোনো অননুপ্রবেশ্যতা নেই । সে জীবনে হাট হয়ে খুলে থাকে তারা । কেবল লাশ-কাটা ঘরে রাখা টিনের মরচে-পড়া দেরাজগুলোর মতো এই ঘরের এক খণ্ডজীবন আড়াল হয়ে থাকে । বাইরে থাকে, আর পরস্পরের কাছেও থাকে । কখনো কোনো অন্যমনস্ক নৈকট্যেও এই জীবনের পুঁথিপাঠ করতে বসা হয় না তাদের । রীতিবদ্ধভাবে তারা রাত্রির জন্য অপেক্ষা করে, লাশের জন্য অপেক্ষা করে, রাত্রিশেষে সকালের জন্য অপেক্ষা করে । আর দুরূহ একেকটি লাশ-কাটা শেষ হলে বখশিসের টাকার জন্য অপেক্ষা করে । সেই লব্ধ টাকার ভাগাভাগিটাও তারা রীতিবদ্ধভাবে সারে, তারপর যে-যার ঘরে ফেরে, সেই ঘর যেখানে লাশ-কাটা হয় না অথচ প্রতিটা সকালে লাশ-কাটা ঘর থেকে ফেরা জীবন্ত মানুষের জন্য প্রত্যাশা থাকে ।

    সেই রাত্রিতে অত:পর, দুটি জীবন্ত মানুষ একটি লাশের জন্য অপেক্ষা করে চলে । বাইরের তক্ষক কোন কালে তার ডাক থামিয়েছে ধনরাজ বা শাহাবুদ্দিন তা লক্ষও করেনি । দূরে জেলখানার ঘন্টায় যখন রাত দুটোর ঘন্টা বাজে, কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়ে-থাকা ধনরাজকে নিয়ে শাহাবুদ্দিন বাড়ির পথে রওনা হয় । ধনরাজের জ্বর বোধহয় আরো বেড়েছে ।

    ফজরের আজানও শুনতে পেল শাহাবুদ্দিন । তারপর পুবের আকাশ আরো ফর্সা হলে ধনরাজের বাসার দিকে রওনা দেয় । যে লাশ রাতে এসে পৌঁছোয়নি সেই লাশ সকালেই আসবে হয়তো । গৌরী জানত যেন সকালে শাহাবুদ্দিন আসবে । ধনরাজের মতোই মুখ গুঁজে-থাকা ছোট্ট চালাখানার সামনে ততোধিক গুটিসুটি মেরে সে বসেই ছিল । গৌরীর ঘোলাটে চোখের দিকে শাহাবুদ্দিনের তাকাতে সাহস হয় না । গত ক'দিন ধরে শাহাবুদ্দিন শুধু মরা মানুষের মুখ দেখে - রাস্তায়, হাসপাতালের ওয়ার্ডে, কোর্টের সামনে দিনের বেলার জটলায় । শাহাবুদ্দিনকে দেখে হাসতে গেল গৌরী । শাহাবুদ্দিনের একটুও হাসি আসল না । ধনরাজ ওদের কথা শুনে বাইরে বেরিয়ে আসে । ওর চেহারা দেখে শাহাবুদ্দিন একাই হাসপাতালে আসতে চেয়েছিল । ধনরাজ তা শোনেনি ।

    হাসপাতালে এসে ওরা এমার্জেন্সিতে ঢুকতে পারেনি । গার্ড বলেছে পুলিশ আবার আসবে । লাশের লোকজন পুলিশের জন্য বসে আছে । শাহাবুদ্দিন আর ধনরাজ দুজনেই তাকিয়ে থাকে পরস্পরের দিকে । একটা আশঙ্কা ততক্ষণে শাহাবুদ্দিনকে ফ্যাকাশে করে দিয়েছে । আর ধনরাজের নিস্তরঙ্গ চোখ আরো স্থির আরো মৃতবৎ হয়েছে । পুলিশের গাড়ি ঢুকলে তারা এমার্জেন্সির মাঝারি কুঠুরিখানার কোণাকুণি ডান হাতে জেনারেল ওয়ার্ডের বারান্দাতে আসে । একটু পরে দারোগা রুগির আত্মীয় সমেত এদিকেই আসতে থাকলে ওরা ফুলের বাগানটার সামনে গিয়ে বসেছিল ।

    দারোগাকে চলে যেতে দেখে শাহাবুদ্দিন ক্লান্তভাবে উঠে দাঁড়ায় ।
    ধনরাজ তখনো গামছায় হাঁটুতে মুখ গুঁজে আছে । শাহাবুদ্দিন তাকিয়ে দেখে ধনরাজ কাঁপছে । ভয় পেয়ে বসে পড়ে ও । ধনরাজের গায়ে হাত দিতেই সে মাথা এলিয়ে দেয় শাহাবুদ্দিনের কাঁধে । কোনোমতে তাকে খাড়া করিয়ে বসিয়ে দিয়েই শাহাবুদ্দিন ছোটে এমার্জেন্সির গার্ডের সঙ্গে কথা বলতে । এ দফা এমার্জেন্সির গার্ডকে অনেক কথা জিজ্ঞেস করতে হয় না শাহাবুদ্দিনের । ওকে দেখেই ঠোঁট উল্টে গার্ড বলে দেয় `ফয়সালা শেষ ।'

    থুত্নিটা বুকের কাছে চেপে ধরে রেখে প্রাণপণে চোখ তুলে ধনরাজ তাকিয়ে আছে শাহাবুদ্দিনের আসতে থাকার দিকে । ওর আধবোজা চোখের দিকে তাকাল শাহাবুদ্দিন । সেই চোখ আরো বুজে আসছে ।

    আর শাহাবুদ্দিন ধনরাজের দিকেই আসছে ।
    খবর নিয়ে ।



    ( ৭ই মে ২০০৫ । হিগাশি-হিরোশিমা)


    (পরবাস, অক্টোবর, ২০০৫)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments
  • কীভাবে লেখা পাঠাবেন তা জানতে এখানে ক্লিক করুন | "পরবাস"-এ প্রকাশিত রচনার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট রচনাকারের/রচনাকারদের। "পরবাস"-এ বেরোনো কোনো লেখার মধ্যে দিয়ে যে মত প্রকাশ করা হয়েছে তা লেখকের/লেখকদের নিজস্ব। তজ্জনিত কোন ক্ষয়ক্ষতির জন্য "পরবাস"-এর প্রকাশক ও সম্পাদকরা দায়ী নন। | Email: parabaas@parabaas.com | Sign up for Parabaas updates | © 1997-2024 Parabaas Inc. All rights reserved. | About Us