ছবির গোড়ায় "মিস মার্পল"কে স্মরণ করার অর্থটা প্রথমে স্পষ্ট হয়নি । শেষের দিক দেখতে গিয়ে গিন্নি বললেন, "এতো "দি মিরর ত্রক্র্যাকড" হয়ে গেল" । আমি বললাম, "কিন্তু কলকাতার হাওয়ার সঙ্গে কীরকম মানিয়ে নিয়েছে দেখ" । রাঙাপিসির সঙ্গে "মিস মার্পল"-এর মিল শুধু গল্পের কাঠামোয় । ওঁরা সম্পূর্ণ ভিন্ন জাতের লোক । গল্পের শেষে যখন খুনীকে রাঙাপিসি বলছেন, "আপনার কাছে আমার অসীম কৃতজ্ঞতা - নিজের চিন্তা করার ক্ষমতার প্রতি আমার শ্রদ্ধাকে আপনি বাড়িয়ে দিয়েছেন । আমার এই রূপটাকে আপনার জন্যই তো আমি দেখতে পেলাম ।" তখন আমাদের মা-মাসীদের ওপর পরিচালকের শ্রদ্ধাটা আমাদের অভিভূত করল । ছবির উপক্রমণিকাটাকেও বুঝতে পারলাম । ভালো বই ।
আমার মনে হয় এ গল্পে প্রধান ভুমিকায় আছে দুটো মানুষ । একজন লতি, একজন ট্যাক্সিচালক । গল্পে এদের একত্র দেখা খুব হয় না, কিন্তু যেটুকু হয়, তাতে ট্যাক্সি চালকের রূপটা আরো খোলে । লতির গল্পের মস্ত পার্শ্বচরিত্র রতন মাষ্টার । গল্পে ওঁনার অবদান যদিও অল্প নয়, এবং ওঁনার চরিত্রের মহত্ব, বিদ্যোত্সাহ সবই শ্রদ্ধেয়, কিন্তু উনি পার্শ্বচরিত্রই রয়ে গেছেন । খালি এইটুকু বলা যে এই গল্পে মহৎ চরিত্র যেন অনেক । শুধু রতন মাষ্টার, লতি বা ট্যাক্সিচালকই নয়, যে ধনী লোকটি লতিকে "রানির হালে" রাখার আস্বস্তি দিয়েছিল, তার জীবন দর্শনও সাধারণ কামুকের নয়, তার সঙ্গে একটা সুক্ষ্ম রসানুভুতির পরিচয়ও পাওয়া যায় (আবার খুব বিস্ময়ের সঙ্গে এও দেখতে হয় যে সেই লোকই কতগুলো কদর্য সিনেমা দেখছে মন দিয়ে । লতির মায়ের কছে কি তবে শুধু ভড়ং করছিল ?) ।
ট্যাক্সিচালককে সমস্ত বইটাতে দেখা যায় বলে তাকে একটা প্রধান চরিত্র বলে মনে হয় । কিন্তু ওর গল্পটা লতির গল্প থেকে আলাদা - যদিও কতগুলো অত্যন্ত বিশিষ্ট সময়ে ওদের একসাথে দেখা গেছে । ওর গল্পের প্রধান পার্শ্বচরিত্র বুড়ো-বুড়ি - যাদের জোর করে গাড়িতে তুলে দিয়ে মস্তানেরা সরে পড়ল । তাদের একগাদা খিস্তি করে লোকটা কিন্তু ওদের জন্য অনেক সময় ও অর্থ দিল, নিজের ব্যবসায়ের ক্ষতি করেও ("শালার মালিক তো দেখবে খালি টাকা; নিজের ঘাড়ে একটা বোঝা যদি পড়ত তখন দেখা যেত শা....") ।
ওকে প্রথম ভাল করে দেখা গেল লতির মার ব্যবসার বাড়িতে একটি মেয়েকে পৌঁছে দেবার সময় । ও বাড়িতে যে গাড়ি যায় না তা নয় (ট্যাক্সি করে দুয়েকজন মাতালকে সেই পৌঁছে দিয়েছে), কিন্তু মেয়েটি যেই বলল যে সে নিজের গ্রামে যাবে না, "মাসীর বাড়ি" যাবে, অমনি ট্যাক্সিওয়ালার মনটা বিরূপ হয়ে উঠল, "গাড়ি যাবে না, হেঁটে যাও ।" আমি মেয়েটিকে দোষ দিতে পারিনি, বাড়িতে তার কীরকম আদর হত আন্দাজ করতে পারি (ওর গল্পটা সিনেমায় একটু পরেই প্রকাশ হয়েছিল) । আমাদের দেশে এখনো ওই হতভাগ্য মেয়েদের জন্য কোন সামাজিক সহানুভুতি নেই । সেটা ট্যাক্সিওয়ালার ব্যবহারেও বোঝা যায় । কিন্তু মানুষটাকে আরো বোঝা যায যখন পুরো ভাড়ার জন্য গালাগাল সুরু হোল, আর মেয়েটি যখন বলল, "গতরটা নিবার হয় তো নাও, আর কিছু আমার নাই" তখন সে লোভে পড়ে খানিকটা এগোলো যদিও, কিন্তু ফিরে এল তার পরেই । মুখে সেই চিরাচরিত, "শা..ল্লা" ।
মানুষ চাঁদে যাচ্ছে, রতনমাষ্টারের স্বপ্ন তাঁকে কলকাতা নিয়ে ফেলল । শেষ মুহূর্তে ট্যাক্সিচালকের সাহায্যে লতি স্টেশনে পৌঁছল । রতনমাষ্টার তাকে ট্রেনে তুলে নিলেন । গল্পের একধরনের সমাপ্তি ।
তবু আরো কত কথা যেন বাকি রয়ে গেল । রতনমাষ্টার নি:সন্তান, কিন্তু অবিবাহিত তো নন । তাঁর স্ত্রীর কী মনে হোল লতিকে দেখে? নাকি তিনিও রতন মাষ্টারের উপযুক্ত সহধর্মিণী ? চাঁদে যাওয়ার রকেটখানার "টেক অফ" দেখিয়ে চিত্রপরিচালক যেন এই ইঙ্গিতটাই করলেন যে লতির বিপদের শেষ হল এবার ।
কিন্তু লতির মায়ের আশা পূর্ণ হোল না । তাঁর নিজের হতভাগ্য জীবনের শেষে লতির "রানির হালের" অংশভাগিনী তিনি হতে পারবেন, সে ভরসা লতির ভবিষ্যতের বাঁধা বাবু তাঁকে দিয়েছিল । কিন্তু লতির কাছে যখন ব্যাপারটা বিপদ বলেই মনে হোল, যখন লতিকে রতনমাষ্টার নিয়েই গেলেন, তখন তাঁর আর কোন ভবিষ্যত থাকল না ।
সেই দু:খের কাহিনির পাশে রইল বুড়োবুড়ির গল্প । ট্যাক্সিওয়ালার যত্নে যখন ভাল হয়ে উঠে একদিন বলল, "হাসপাতাল খুঁজে কাজ নাই আর, ভালই তো আছি, এখানেই নামায়ে দাও", সে দিনেই ওদের গল্পে যতি টানা যেত । কিন্তু লতির মায়ের চিন্তিত মুখ দেখার পরেই দেখতে পাই বুড়ো-বুড়ি গাছের তলায় ট্যাক্সিচালকের দেয়া ছক পেতে পরমানন্দে লুডো খেলছে - মুখে হাসি ।
বাংলা দেশের কোন জায়গার গল্প এটা - এটা একটা ধাঁধা রয়ে গেল আমার মনে । মানভুমের নানা অংশে প্রচূর ডাঙ্গাল জমি আছে দেখেছি, কিন্তু এ জমি যেন আরো পরিব্যপ্ত । শান্তিনিকেতনের চারদিকেও প্রচূর এরকম রুক্ষ্মতা দেখেছি বোধহয় । কিন্তু এ কীরকম দেশ যেখানে এত দূরের মধ্যেও একটা হাসপাতাল খুঁজে পাওয়া গেল না ? দেশের আর একটা চেহারাও দেখলাম নাকি ? এদিকে তো খবর পাই যে কলকাতার শপিং মল মার্কিনদের সঙ্গে টেক্কা দিচ্ছে । ধনী-দরিদ্রদের
বৈষম্যও কি মার্কিনদের অনুকরণেই চালু থাকলো ?
আবার বলি, সার্থক বই ।
(পরবাস, অক্টোবর, ২০০৫)
[ পরিচালনা : বুদ্ধদেব দাসগুপ্ত
কাহিনি : প্রফুল্ল রায়
অভিনয়ে : সমতা দাস, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, অর্পণ বাশার, প্রদীপ মুখার্জি, রামগোপাল বাজাজ]
কিন্তু লিখতে বসেছি একটু মনের দু:খ নিয়ে । "মন্দ মেয়ের উপাখ্যান" আমাকে একলা বসে দেখতে হয়েছে । গল্পের চুম্বকটা "ডি. ভি. ডি"র মোড়কে পডে গিন্নি বললেন, "এ বই আমি দেখতে পারব না" । বইটা দেখার পর আমার মনে হোল পাঁকের ভয়ে গিন্নি পদ্ম তুললেন না । একা দেখার অস্বস্তিটা শুধু নয়, উনি যে অমন একটা জিনিষ দেখতে পেলেন না, এতে আমার মন ব্যথিত হয়ে রইল ।. ওই ছবিটার কথা একটু ফেনিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে ।