• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩৬ | অক্টোবর ২০০৫ | রম্যরচনা
    Share
  • এক দর্শকের চোখে নাট্যমেলা : সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

    (১)


    "ংই ংঋত্ছষ্‌ যচ্ধণ্ণত্রু ভঠটং ষ্ধণ্ণ যধস্‌ংঞচ্ঠত্রভ ঞধ ঞচ্ঠত্রূ ছঢধণ্ণঞ. ঘচ্‌ংত্র ঝ যংং ছ ংঋত্ছষ্‌ ছত্ররু ণ্ণত্ররুংশযঞছত্ররু ঠঞ ঞচ্‌ং ংঈঠশযঞ ঞঠস্‌ং, ঞচ্‌ংত্র ঝ ংঊত্রধগ ঠঞ বছত্র'ঞ ঢং স্ণ্ণবচ্‌ ভধধরু..."

    (ম. ন. শ্ত্ঠধঞ [১৮৮৮-১৯৬৫])



    ফাটাফাটি ব্যাপার, বে-এরিয়া ক্যালিফোর্নিয়া তে বসে নাট্যমেলা দেখা ! ভাবাই যায় না । এরকম একটা সুযোগ এলে একদম মিস করতে নেই, প্রায় মানুষ ভর্তি অডিটোরিয়াম ! ব্যাস্ত মানুষ যে প্রায় ৫-ঘন্টা ধরে শুধু নাটক দেখবে এবং শেষ পর্যন্ত বসে থাকবে সেটা আমি ভাবিনি ।

    এই ধরনের প্রোগ্রামের আয়োজন করার জন্যে সংস্কৃতির অনেক ধন্যবাদ পাওনা রইল সমস্ত নাট্যপ্রেমীদের কাছে । এই খবর যখন এই দেশের সব প্রান্তে পৌঁছবে, তখন নিশ্চয় আরো অনেক নাটকের দল এতে অংশ নিতে চাইবেন । বেড়ে উঠুক নাটকের এই আন্দোলনটা !

    আমরা, দর্শকেরা দেখতে পাই ভিন্ন স্বাদের বিভিন্ন নাটক আর নাট্যকর্মীরা পান দর্শক । সংস্কৃতিকে আবার জানাই ধন্যবাদ নাটক এবং নাট্যকর্মীদের মধ্যে এই যোগসূত্র করে দেওয়ার জন্যে ।

    অনুষ্ঠান শুরু হল সভাপতির ভাষণ দিয়ে, ড: সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায় (জংশূংত্‌ংষ্‌, ঈংংঋছশঞস্‌ংত্রঞ ধী ঈশছস্ছ) দারুণ একটা জমজমাটি বক্তৃতা দিলেন নাটকের ওপরে । উনি বললেন চমত্কার, দর্শকদের নাড়িয়ে দিয়ে গেলেন মনে হল । অনেক দর্শক কে দেখছিলাম ওনার কাছে এসে নাটকের বিষয়ে কিছু আলোচনা করতে আসছেন । সবচেয়ে ভালো লাগলো ওনার মঞ্চে সাবলীল ভঙ্গি । মনে হচ্ছিল উনি যে কথাগুলো বললেন সেগুলো কোনও এক ফর্মে অভিনয় করে দেখালে ব্যাপারটা আরো জমতো । আশা করব পরের বার উনি এরকমই কিছু একটা করবেন ।

    সভাপতির যে দুটো মন্তব্য জমাটি তর্কের সূত্রপাত করতে পারে সেগুলো হল :
    উনি বললেন নাটক করতে গেলে নাটক নিয়ে পড়াশোনা করতে হবে । অজিতেশ বন্দোপাধ্যায়ের মন্তব্যটা প্রাসঙ্গিক: গান করতে গেলে গান শিখতে হয়, নাচ করতে গেলে নাচ শিখতে হয়, তো নাটক না শিখে নাটক করতে চান কেন ? খুব যুক্তিপূর্ন কথা । অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত নাটকের ছাত্র এবং শিক্ষকদের জন্যে ।

    কিন্তু এর অন্য একটা দিকও আছে । মনের আনন্দে নাটক করা যাবে না ? অ্যাকাডেমিক স্টাম্প ছাড়া নাটকে অংশগ্রহণ করা বাতিল ? নাটক করতে করতে শেখা যাবে না ? স্বতস্ফূর্ত অভিনয় বলেও তো একটা ব্যাপার আছে এক সময় দেখতাম "নঞশংংঞ ঈশছস্ছ" -র মতন জনপ্রিয় জিনিস যেখানে সাধারণ দর্শকদের মধ্যে থেকে অভিনেতা ধরে আনা হত, একদম অন্য ধারার নাটক, সেগুলো ?

    আর বললেন এই দেশে আমাদের নাটকের বধত্রঞংন্ঞ হওয়া উচিত এই দেশের বৃহত্তর সংস্কৃতির সাথে যোগাযোগ রেখেই । তাহলে আমরা যে দেশে বসে আগে দেখতাম "লেনিন কোথায়?" আর এখন দেখি অ্যাকাডেমিতে "মিসেস সরিআনো", সেগুলোর কি হবে ? ভত্ধঢছৎ বধত্রঞংন্ঞ বলে কি কিছু থাকবে না ? ভালো হয়না সব রকম সাবজেক্টকেই টার্গেট করলে ?

    তবে সভাপতির যুক্তিও কোনও ফেলনা নয় এই ব্যাপারে, বিশেষ করে এই নাটক গুলোকে আরো বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে । শুধুমাত্র নাটকের প্রয়োজনে তর্কটা চালু রাখা দরকার ।

    নাটকের স্বার্থে পাঠক ও দর্শকের মতামত গুরুত্বপূর্ণ এখানে, আপনারা কি বলেন ?

    আর একটা কথা, একদম সামনে বসে নাটক দেখবেন না । আমি সাধারণত সেরকম দেখিনা, কিন্তু এবার পরবাস-এর দৌলতে দেখছিলাম । সামনের সিটে বসলে স্টেজ পুরোটা দেখা যায়না স্টেজের পাশে অপ্রাসঙ্গিক কিছু দেখা যায়, আর সামনের সারির দর্শকদের আতিথেয়তার জন্যে ব্যস্ত অনেকে ঘোরেন । এর থেকে ভালো ভেতর দিকে সবার মধ্যে বসে নাটক দেখা টুকরো কমেন্টস এর মধ্যে ।

    কিছু খুচরো মন্তব্য :
    -ঘোষক/ঘোষিকা ভাল কাজ করেছেন । সুন্দর কন্ঠস্বর আর বলার ভঙ্গী দুজনেরই, আর চমত্কার প্রেজেন্টেশন ।

    -ছিল বই/ডিভিডি-র স্টল, নাটকের বই/সিডি থাকলে জমত, চোখে পড়ে নি আমার, ছিল কি ?

    -চানা-বটুরা-র কথা না বললে এই রিভিউ অসমাপ্ত থেকে যাবে । জিনিসটা তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যাচ্ছিল ! এর দৌলতে ৪৫ মিনিটের ব্রেক কে ব্রেক-ই মনে হয়নি !

    -এই রিভিউ লেখা হয়েছে এক দর্শকের চোখ থেকে । কাজেই, এই নাটক এই দর্শককে যেমন ভাবে ভাবিয়েছে, ঠিক সেই ভাবেই তার রিভিউটা লেখা হয়েছে । যেহেতু ভাবনাগুলো অন্যরকম, তাই রিভিউ তে কিছু অসাম্য দেখা যেতে পারে ।

    -অফিসের কাজ, ঘর-সংসার সামলে, এই ব্যস্ত জীবনের ফাঁকে সময় বার করে নাটক এর প্রস্তুতি নেওয়া কোনও সহজ কাজ নয় । এইসব নাট্যকর্মীরা সুন্দর নাটক করে আমাদের শুধু আনন্দই দিচ্ছে না, আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছেন বেঁচে থাকার একটা অন্য মানেও আছে !


    (২) : উত্সব





    উত্সব (স্যাক্রামেন্টো, ক্যালিফোর্নিয়া)-এর করা নাটক "পাবলিক সারভেন্ট" । নাটকের বিষয়বস্তু : দারোগার বিবাহবার্ষিকী কেমন কাটল ? হাসির নাটক, বুঝতেই পারছেন বিবাহ বার্ষিকী যখন দারোগার তখন এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকবে থানা । থানার নাম "বড়কুটুম থানা" যেখানে পুরো নাটকটা অভিনীত হয় । নাটকের ক্যারেকটার দারোগা, ওনার অ্যাসিস্টান্ট, ব্যবসায়ী আর নিলু গুণ্ডা (ব্যাকগ্রাউণ্ডে দারোগা পত্নীর কাঁসর ঘন্টা)।

    দারোগাবাবু বেশ সহজ এবং ভালো অভিনয় করেছেন, বাকি চরিত্রগুলো একটু দুর্বল, তবু চালিয়ে দিয়েছেন নাটকটা । মঞ্চসজ্জা নিয়ে বাড়াবাড়ি করেননি কিছু, খুব সাধারণ মঞ্চ ।

    থানার ঘড়িতে তখন রাত দশটা । এক ব্যবসায়ী এসেছেন কমপ্লেন লেখাতে নিলু গুণ্ডার বিরুদ্ধে যে ৫০০০ টাকা ছিনতাই করেছে ব্যবসায়ীর কাছ থেকে । দারোগাবাবু যখন পুরো ব্যাপারটা বুঝলেন তখন মঞ্চে নিলুগুণ্ডার উপস্থিতি । নিলুগুণ্ডা ওনার উঁচুতলার পলিটিকাল কানেকশনের সাহায্যে কেসটা অন্যদিকে নিয়ে গেলেন । দারোগা বেশ ভয় পেলেন ।

    এ সবই খুব সহজে ধরা যায়, গল্প বেশ দুর্বল । তবু দর্শক হেসেছে কিছুটা ।

    তবে দারোগাবাবু-র মহৎ হৃদয়, যদিও চাকরি বজায় রাখতে উনি নিলু গুণ্ডার বিরুদ্ধে কোন কেস করলেন না । কিন্তু নিলুর দেওয়া ঘুষের কিছু টাকা ব্যাবসায়ীকে দিয়ে দিলেন এবং ওঁকে পালাতে সাহায্য করলেন ।

    ঘন্টার আওয়াজটা একটু বেশি জরে হচ্ছিল, আওয়াজটা কম করবেন । আওয়াজ নিয়ে অভিযোগ উঠেছে পেছনের সারির দর্শকদের থেকে, তাঁরা বিশেষ কিছু শুনতে পাননি । তাছাড়া মিউজিক এবং অডিও বেশ পীড়াদায়ক ।

    সংলাপের মধ্যে গ্যাপ ছিল, মাঝে মাঝে সংলাপ ভুলেও যাচ্ছিলেন । দারোগাবাবু নাটকটা টেনে নিয়ে গেলেও, বাকি দুটি ক্যারেকটারকে আরেকটু খাটতে হবে । আরেকটু স্লো মনে হচ্ছিল মুভমেন্টগুলো, সংলাপগুলোও । গুণ্ডাকে ঠিক গুণ্ডা মনে হয়নি, ব্যবসায়ীকে ব্যবসায়ী নয় ; আর ঠিক হাসির নাটকের গুণ্ডার মতনও লাগেনি । অবশ্য স্টিরিওটাইপ গুণ্ডা বা ব্যবসায়ী না করে অন্যরকম কিছু করাটা খারাপ নয়, কিন্তু কিছু একটা বিশেষত্ব থাকতে হবে তো, যেটা আমি খুঁজে পাইনি । আরেকটু ঘষা মাজা আর প্রাক্টিসের দরকার ।

    দারোগা আর অ্যাসিস্টান্ট এর সাজসজ্জা বেশ ভাল ছিল । আর অন্য কিছু সেরকম উল্লেখযোগ্য নয়, আশা করব পরেরবার এঁরা শক্তিশালী কোন গল্প নির্বাচিত করবেন । আরেকটু চেষ্টা করলে আর সময় দিলে দেখবেন এই টিম-ই দারুণ কিছু একটা করে চমকে দিতে পারে সবাইকে ।


    (৩) : শ্রুতিনাটক





    এবারের নাটক একটু অন্যরকম, বাকি নাটকগুলির থেকে আলাদা : শ্রুতি নাটক, পরিবেশনায় বিপ্লব ভাওয়াল এবং রুমি ভাওয়াল (লস এঞ্জেল্স্‌, ক্যালিফোর্নিয়া) । প্রথমটির নাম বলাকা, পরেরটি বোগেনভিলিয়া ।

    দুটোই খুব চমত্কার নাটক । লেখাটা দারুণ জমাটি । সবচেয়ে বড় কথা নাটক দুটোই নিজেদের লেখা । শ্রুতি নাটক দুটো একদম অন্য স্বাদ এনে দিল ।

    বলাকা নাটকে বিপ্লব বাবুর বাংলা মেশানো হিন্দি উচ্চারণ খুব অরিজিনাল, আর রুমি ভাওয়ালের শ্রুতি-অভিনয় বড়ো চমত্কার, গানের গলাও মিষ্টি । পরিষ্কার উচ্চারণ হিন্দি এবং বাংলাতে । বাচনভঙ্গি, কন্ঠস্বরের ওঠা-নামা, দৃশ্য পরিবর্তনের সাথে সাথে কন্ঠস্বরের পরিবর্তন এসবই দর্শককে ধরে রেখেছে । মনে হয়েছে দর্শক ডুবে ছিলেন ওঁদের এই জমাটি শ্রুতি-অভিনয়ে ।

    বলাকা নাটকে বিপদে পড়ে এক নারী এসেছেন এক পুরুষের কাছে আশ্রয় নিতে, গুণ্ডার তাড়া খেয়ে । বাঙালি বীরপুরুষ একা মেয়েকে দেখে আশ্রয় দিতে ভয় পাচ্ছে, এবং হিন্দি-বাংলা মেশানো সংলাপে দর্শকদের একদম মাতিয়ে দিয়েছেন । এই শ্রুতি নাটকটা আমার মনে থাকবে অনেকদিন । একদম মিস করার মতন নাটক নয় ।

    মেয়েটি দহন সিনেমার কথা টেনে আনল, যেখানে একটা মেয়েকে বাঁচাতে আরেকটি মেয়েই এগিয়ে আসে, কোন পুরুষ নয় । শ্রুতি নাটকের হিরো প্রথমে তাতে উত্সাহ না দেখালেও, পরে জিনিসটা অন্যরকম দাঁড়ায় ।

    বোগেনভিলিয়া নাটকে আমেরিকান প্রতিবেশির উদ্দেশ্যে এই মন্তব্যটা মনে থাকবে : সংস্কৃতির এই আবরণ ভেদ করে মানুষকে চেনা খুব শক্ত ! দারুণ কথা । আমি এভাবে কোনদিন ভেবে দেখিনি কথাটা, যদিও এই কথাটার আনাচে কানাচে ঘুরেছি ।

    আরেকটা লাইন মনে আছে এখনও : "আমি বুদ্ধি দিয়ে বাঁচি না, অনুভূতি দিয়ে বাঁচি", ওই একই নাটকের সংলাপ । কথাটা শুনে অনুভূতি দিয়েও যে বাঁচা যায় তা মনে পড়ে যেতে পারে ।

    এঁদের কথা ছিল একটা পুরো টিম নিয়ে একটা আসল নাটক করার, পরেরবার অপেক্ষা করে থাকব এইরকম কোন নাটক দেখার জন্যে । যদিও শ্রুতিনাটকটা সত্যি জমেছিল ।


    (৪) : বীণা ( জঝব্‌ংই )





    বে-এরিয়ার আরেক নাট্যগোষ্ঠী জঝব্‌ংই -র প্রযোজনা "আমাদের গল্প" । বেশ ভালো লাগছিল ঢাকা ইউনিভার্সিটির নীল রঙের বাস দেখতে প্রোজেক্টরে । আর স্টেজটাও বেশ সুন্দর ভাবে ভাগ করেছিলেন যাতে বাড়ি আর ইউনিভার্সিটিকে আলাদা করে দেখান যায় । আলোর ব্যবহার চোখ জুড়ানো । রঙ, আলো, বিভক্ত মঞ্চ, অরগানাইজেশন এই সব আলাদা আলাদা করে দেখলে যেমন দারুণ, আবার পুরো জিনিসটা একসাথেও আকর্ষণীয় ।

    এই নাটকে চমত্কার অভিনয় করেছেন সান্ত্বনার মামা, মীজান । একদম স্টেজ রেডি, সপ্রতিভ অভিনয়, মনে হচ্ছিল আমাদেরই পাড়ার এক পরিচিত মামা । উনি এই নাটকটাকে জীবন্ত রেখেছিলেন ।

    মূল গল্প হল প্রফেসরের ছেলে আমেরিকার ভিসা পাওয়ার চেষ্টা করছেন, অথচ বারবার ব্যর্থ । আচমকা ভিসা পাওয়ার একটা সুবন্দোবস্ত হয়ে গেল । প্রফেসরের বাল্যবন্ধু এসে উপস্থিত খোদ আমেরিকা থেকে । বন্ধুর সাথে দুই মেয়ে । এক মেয়েকে বিয়ে করে আমেরিকা যাওয়ার একটা উপায় হলো । কিন্তু ছেলের মনে পরিবর্তন ঘটে, সে আর আমেরিকা আসতে চায় না, দেশের প্রতি টান অনুভব করে । একটা মেসেজ পাওয়া যাচ্ছে, মানসম্মান সবকিছু খুইয়ে বিদেশে যাওয়ার কোন অর্থ হয়না, নিজের দেশটা খারাপ কিসে ? দেশ ছেড়ে বিদেশে আসার যে পাগলামি দেখা যায় তার জন্যে বেশ যুত্সই একটা মেসেজ । কাল আর স্থান উপযোগী ।

    মেসেজটা ঠিক আছে, কিন্তু মামা বাদে অভিনয় সেরকম জমল না । সান্ত্বনা আর তাঁর বন্ধু কিছুটা লড়েছেন, বাকিরা মোটামুটি । আরেকটু গতির দরকার ছিল, একটু ঢিমে তালে মনে হল ।

    নিজেদের লেখা মৌলিক নাটক হিসেবে যথেষ্ট প্রশংসার দাবী রাখে । বাংলাদেশের আর্টিস্টদের করা নাটকের মধ্যে একটা অন্য স্বাদ থাকে, যেটা আমাদের পক্ষে একমাত্র এই ধরনের নাট্যমেলাতেই দেখা সম্ভব । আশা করব প্রতি বছরের নাট্যমেলাতে এই রকম একটা ভিন্ন স্বাদের নাটক আমরা দেখতে পাব ।

    বিশেষ ভাল লাগা কিছু মুহূর্ত :
    ১) প্রোজেক্টরে ঢাকা ইউনিভার্সিটির নীল বাস ।
    ২) দুই সখীর কথোপকথন সম্ভাব্য প্রেমিকের উদ্দেশ্যে ।
    ৩) মামাকে ঘিরে মোটামুটি সব ঘটনাই, বিশেষ করে লুঙ্গি পরে আর্বিভাব, সম্ভাব্য প্রেমিকার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা ।

    ৪) নাটকটা শেষ হয়েছে দুর্ধষ এক গান দিয়ে । কার গান ছিল ধরতে পারিনি ।

    ঠিক এই নাটকের সাথে যুক্ত নয়, কিন্তু এই নাট্যদলেরই একটা বক্তব্য, তাই এখানেই বলে রাখছি ।

    অনুষ্ঠানের একদম শেষে এই টিমের প্রতিনিধি একটি বক্তব্য রাখলেন, যেটা আমরা এর আগেও শুনেছি । ভারতবর্ষের বাঙালিরা নাকি আজকাল বাংলা ভাষায় কেউ কথা বলে না (মূলত হিন্দিতে বলেন)। মূল অভিযোগ হল পশ্চিমবাংলায় বাংলার চল নেই সেইভাবে । এতে আছে বিতর্কের সুযোগ, সেটা হাতছাড়া করি কেন ? আমি দুই পক্ষেরই কিছু যুক্তি এখানে তুলে দিচ্ছি, পাঠকদের ওপর ছেড়ে দিচ্ছি এই তর্কের বাকিটা । কারণ অভিযোগটা যদি সত্যি হয় তাহলে কিছু একটা করা উচিত, হয়ত আমাদের সবারই ।

    এক পক্ষের যুক্তি :
    "পশ্চিমবাংলার বাংলা ভাষা হয়ত অন্য দিকে মোড় নিচ্ছে, কিন্তু সেটা ভাষার বিবর্তনের একটা ভিন্ন বিষয় । ভারতবর্ষে প্রতি বছর প্রায় হাজারটা লিটিল ম্যাগাজিন বার হয়েছে বাংলাতে, সেই কলকাতা আর পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষার চর্চা হয়না এটা কী মেনে নেওয়া যায় ? আর এক দেশে চর্চা হয় বলে, অন্য দেশে হয়না প্রমাণ করার দরকারটাই বা কি ? বাংলা নিয়ে কোথায় কিরকম কাজ হচ্ছে সেটা পাঠক/দর্শকদের ওপর ছেড়ে দিলে ঠিক হয়না ?

    বাংলা ভাষার টানে কলকাতা আর পশ্চিমবঙ্গে কি মানুষ আজও ছুটে আসেনা ? তসলিমা কেন ফিরে আসতে চাইছেন কলকাতায় ? সেই বাংলার টানেই না যেখানে খোলা মনে বাংলার চর্চা করা যায় ?"

    অন্য পক্ষের যুক্তি হল :
    নতুন প্রজন্ম সেভাবে বাংলাভাষার চর্চা করছে না, এই বাংলার চর্চা (পশ্চিমবঙ্গে) কেবলমাত্র এই প্রজন্মেই সীমাবদ্ধ । এই প্রজন্মের সঙ্গে সঙ্গেই পশ্চিমবঙ্গে বাংলাভাষা শেষ হয়ে যাবে । এবং হিন্দি না শিখলে সর্বভারতীয় পরীক্ষায় পাল্লা দেওয়া খুব মুশকিল ; নতুন প্রজন্মের পক্ষে এতোগুলো ভাষার ধাক্কা সামলানো সম্ভব হবে না ।

    আপনাদের কী মনে হয় ? পশ্চিমবঙ্গে বাংলাভাষার মৃত্যু আসন্ন ? না, ভাষা বদলাবেই যুগের সঙ্গে পা মিলিয়ে ? নাকি, এটা সেরকম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয় ?


    (৫) : এনাদ ( শ্ব্‌ংইঈ )





    নাটকের নাম "শনিবার" ।

    বে-এরিয়ার শ্ব্‌ংইঈ নাট্যগোষ্ঠীর করা অসাধারণ নাটক । শুরু হতেই মনে হল একটা ভিন্ন স্বাদের অন্য কিছু । চোখ ধাঁধানো মঞ্চ, পরিমিত আলো, মন ভরিয়ে দিল ।

    প্রথমেই আসবে মঞ্চ সজ্জার কথা । সাংঘাতিক সুন্দর, ৪৫ মিনিটের নাটক, ৫-৬ বার সেট পাল্টেছে, কখনও স্বপ্ন, কখনও বাস্তব ! কাফকার সেই সিনেমার ("দ্য ট্রায়াল") কথা মনে পড়ে যায়, অথচ খুবই অন্যরকম । এই নাটকে স্বপ্ন আর বাস্তব গুলিয়ে যায়নি, স্বপ্নের সাথে বাস্তবকে মিলিয়ে দিয়েছেন অসাধারণ পটুতায় !

    গল্পে মোট ১০টা চরিত্র । দিব্যেন্দু শনিবার অফিস থেকে বাড়ি ফিরে আসে কিছু উটকো ঝামেলা এবং অফিসের আতঙ্ক নিয়ে । অনেকটা প্রবাসের এই আতঙ্কিত উইকএণ্ডগুলোর মতন, কখন যে অফিস থেকে ডাকবে ঠিক নেই । আমাদের অনেককে দেখা যায় মোবাইল, পেজার, পাম্‌ আর ওয়াইন-এর গ্লাস নিয়ে ছটফট করছেন উইকএণ্ডেও .... অনেকটা সেরকম আর কি ! এই কারণে নাটকটা আমাদের প্রবাসী জীবনের সাথে সাংঘাতিকরকম ভাবে জড়িয়ে ।

    ভাললাগা চরিত্র : সবাই মোটামুটি একই লেভেলে অভিনয় করেছেন, এমন হয়নি যে কেউ খুব বেশি সুযোগ পেয়ে গেছেন । তবে একটু বিশেষ ভাল লেগেছে :

    সাগরিকার অসাধারণ অভিনয় স্বপ্নে এবং বাস্তবে, স্বপ্নের দৃশ্যে একটু স্পেশাল ভাল । অফিসের আর্দালিকে দারুণ মানিয়েছে, চমত্কার বাচনভঙ্গি, স্টেজ-মুভমেন্ট এবং সহঅভিনয় । চরিত্র উপযোগী সাজসজ্জা দারুণ মানিয়েছিল ।

    এছাড়া বাবা, মা এবং অফিস বন্ধু(২) বেশ ভাল । ভাল লেগেছে মায়ের শান্ত মূর্তি আর স্বাভাবিক হাঁটাচলা । সাধারনত স্টিরিও টাইপ মা-দের কিছুটা ধীর গতির দেখান হয়, আর মাথার চুল প্রচুর সাদা করে দেয় : ভাল লাগল সেই ফাঁদে পা দেননি বলে ।

    ভালোলাগা দৃশ্য :

    ১) শুরুতেই অপূর্ব এই গান :
    "শনিবার, আজ শনিবার", ভাল লাগা সুর, ভাল গান । শুনলাম এনাদ -এর নিজস্ব সুর দেওয়া এই গান, নিজেদের লেখাও ।

    ২) অফিস-বসের সঙ্গে স্বপ্নে কথোপকথন ।
    ৩) দিব্যেন্দু-সাগরিকার প্রেমের দৃশ্য (স্বপ্নে) ।
    ৪) কর্তব্যপরায়ণ মা সব সময় পুরো ফ্যামিলিকে দুধ খাওয়াতে ব্যস্ত , যেটা খাওয়ার সময় বা ইচ্ছা কারো নেই । এই ঘটনাটা অনেক হাসির উদ্রেক করেছে পুরো নাটকে ।(প্রথম দিকে)

    ৫) প্রথম দৃশ্যে বাস্তব থেকে স্বপ্নের দৃশ্যে সেট চেঞ্জ । আর তিনটে নাটক পর পর দেখে দর্শক ক্লান্ত ছিল, এনাদ সেই ক্লান্ত দর্শককে চমকে দিয়ে এরকম একটা সাংঘাতিক কাজ করল । নি:সন্দেহে এই নাট্যমেলার চমকপ্রদ পারফরমেন্স ।

    নাটকের দুর্বলতা :

    ১) স্বপ্নের দৃশ্যের আগে দরজার পর্দা পালটানো হবে, তার জন্যে একজন স্টেজের বাইরে অপেক্ষারত, সেটা একটা ডিস্ট্র্যাকশন । এই সময়টা কমানো যেত একই পর্দার দুদিকে দুরকম রং করে বা অন্য কোনো ঠস্ছভঠত্রছঞঠটং উপায়ে । রোল করে যাওয়া জানলার পর্দায় এই খুঁত ছিল না । ২) মা সবাইকে দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করেছেন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত । এই ঘটনাতে দর্শক হাসলেও, শেষের দিকে একটু একেঘেঁয়ে ।

    বাদল সরকারের স্ক্রিপ্ট অবশ্য এরকমই ছিল, তবু একটু আধটু এডিট করলে ক্ষতি কিছু হয় না ।

    ৩) প্রথম অফিসের সীনটা যে স্বপ্নের সেটা দর্শকের ধরা একটু মুস্কিল হতে পারে, যদিও পরের সীনেই সেটা ধরা পড়ে । আবার মনোযোগী দর্শক হয়ত প্রথম সীনেই ধরে ফেলেছেন ।

    (দর্শকের কমেন্ট : "এরকম অফিস দেখিনি, গেঞ্জি পরেই কাজ !)

    ৪) স্বপ্নের দৃশ্যে আলমারি ঘোরানোটা একটু অসুবিধাজনক । প্রতিবার আলমারিটা একটু আটকে যাচ্ছিল, একটু ছন্দপতন ঘটে যাচ্ছিল । বাকি সবকিছু এতো মসৃণ বলেই হয়তো এটা বেশি করে চোখে পড়ে ।

    ৫) এটা ঠিক দুর্বলতা নয়, এটা আমারই একটা প্রশ্ন : পুরুষের স্বপ্নের রঙ জানতাম সাদা-কালো হয় (যদিও হিন্দি সিনেমার স্বপ্নের দৃশ্যগুলো তা প্রমাণ করে না) । নাটকে স্বপ্নকে ঠিক স্বপ্নের অনুকরণ করতে গেলে এটা আর কি ভাবে দেখান সম্ভব ছিল ?


    আসুন, আমরা এই নাট্য-আন্দোলনকে আরেকটু এগিয়ে নিয়ে যাই :

    এই বিদেশে এই ধরনের পারফরমেন্স দুষ্প্রাপ্য । কাজেই এখানকার বিভিন্ন সংগঠনের (এন-এ-বি-সি, বঙ্গমেলা, ভিন্ন ভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন আর দুর্গোত্সব...) এঁদের উচিত এইসব স্থানীয় প্রতিভাকে উত্সাহ দেওয়া, এঁদের আরো অনেক নাটক করার সুযোগ করে দেওয়া ।

    কলকাতার গ্রুপ থিয়েটারের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে এঁরা যেটা মিস করছেন সেটা হল একই নাটক অনেকবার করে করা । এই সুযোগটা করে দেওয়ার দায়িত্ব কিন্তু এইসব সংগঠনগুলোর ।


    এলিয়টের যে-কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম তার প্রসঙ্গে টেনেই শেষ করছি । দর্শক ফিরে ফিরে যখন একটি নাটক দেখতে চাইবে তখনই সেটি সার্থক হয়ে উঠবে । এইসব সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী সেই সুযোগ না করে দিলে নাট্যকর্মী আর নাট্যপ্রেমীদের মধ্যে সেই যোগসূত্র তৈরি হবে কী করে ?


    (কৃতজ্ঞতা স্বীকার : যাঁরা আমার সঙ্গে বাংলাতে যোগাযোগ করেছেন এই নাট্যমেলার পরে আর এই লেখার আগে, তাঁদের সবাইকে ।)

    (পরবাস, অক্টোবর, ২০০৫)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments