(ম. ন. শ্ত্ঠধঞ [১৮৮৮-১৯৬৫])
এই ধরনের প্রোগ্রামের আয়োজন করার জন্যে সংস্কৃতির অনেক ধন্যবাদ পাওনা রইল সমস্ত নাট্যপ্রেমীদের কাছে । এই খবর যখন এই দেশের সব প্রান্তে পৌঁছবে, তখন নিশ্চয় আরো অনেক নাটকের দল এতে অংশ নিতে চাইবেন । বেড়ে উঠুক নাটকের এই আন্দোলনটা !
আমরা, দর্শকেরা দেখতে পাই ভিন্ন স্বাদের বিভিন্ন নাটক আর নাট্যকর্মীরা পান দর্শক । সংস্কৃতিকে আবার জানাই ধন্যবাদ নাটক এবং নাট্যকর্মীদের মধ্যে এই যোগসূত্র করে দেওয়ার জন্যে ।
অনুষ্ঠান শুরু হল সভাপতির ভাষণ দিয়ে, ড: সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়
(জংশূংত্ংষ্, ঈংংঋছশঞস্ংত্রঞ ধী ঈশছস্ছ) দারুণ একটা জমজমাটি বক্তৃতা দিলেন নাটকের ওপরে । উনি বললেন চমত্কার, দর্শকদের নাড়িয়ে দিয়ে গেলেন মনে হল । অনেক দর্শক কে দেখছিলাম ওনার কাছে এসে নাটকের বিষয়ে কিছু আলোচনা করতে আসছেন । সবচেয়ে ভালো লাগলো ওনার মঞ্চে সাবলীল ভঙ্গি । মনে হচ্ছিল উনি যে কথাগুলো বললেন সেগুলো কোনও এক ফর্মে অভিনয় করে দেখালে ব্যাপারটা আরো জমতো । আশা করব পরের বার উনি এরকমই কিছু একটা করবেন ।
সভাপতির যে দুটো মন্তব্য জমাটি তর্কের সূত্রপাত করতে পারে সেগুলো হল :
উনি বললেন নাটক করতে গেলে নাটক নিয়ে পড়াশোনা করতে হবে । অজিতেশ বন্দোপাধ্যায়ের মন্তব্যটা প্রাসঙ্গিক: গান করতে গেলে গান শিখতে হয়, নাচ করতে গেলে নাচ শিখতে হয়, তো নাটক না শিখে নাটক করতে চান কেন ? খুব যুক্তিপূর্ন কথা । অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত নাটকের ছাত্র এবং শিক্ষকদের জন্যে ।
কিন্তু এর অন্য একটা দিকও আছে । মনের আনন্দে নাটক করা যাবে না ? অ্যাকাডেমিক স্টাম্প ছাড়া নাটকে অংশগ্রহণ করা বাতিল ? নাটক করতে করতে শেখা যাবে না ? স্বতস্ফূর্ত অভিনয় বলেও তো একটা ব্যাপার আছে এক সময় দেখতাম
"নঞশংংঞ ঈশছস্ছ" -র মতন জনপ্রিয় জিনিস যেখানে সাধারণ দর্শকদের মধ্যে থেকে অভিনেতা ধরে আনা হত, একদম অন্য ধারার নাটক, সেগুলো ?আর বললেন এই দেশে আমাদের নাটকের
বধত্রঞংন্ঞ হওয়া উচিত এই দেশের বৃহত্তর সংস্কৃতির সাথে যোগাযোগ রেখেই । তাহলে আমরা যে দেশে বসে আগে দেখতাম "লেনিন কোথায়?" আর এখন দেখি অ্যাকাডেমিতে "মিসেস সরিআনো", সেগুলোর কি হবে ? ভত্ধঢছৎ বধত্রঞংন্ঞ বলে কি কিছু থাকবে না ? ভালো হয়না সব রকম সাবজেক্টকেই টার্গেট করলে ?তবে সভাপতির যুক্তিও কোনও ফেলনা নয় এই ব্যাপারে, বিশেষ করে এই নাটক গুলোকে আরো বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে । শুধুমাত্র নাটকের প্রয়োজনে তর্কটা চালু রাখা দরকার ।
নাটকের স্বার্থে পাঠক ও দর্শকের মতামত গুরুত্বপূর্ণ এখানে, আপনারা কি বলেন ?
আর একটা কথা, একদম সামনে বসে নাটক দেখবেন না । আমি সাধারণত সেরকম দেখিনা, কিন্তু এবার পরবাস-এর দৌলতে দেখছিলাম । সামনের সিটে বসলে স্টেজ পুরোটা দেখা যায়না স্টেজের পাশে অপ্রাসঙ্গিক কিছু দেখা যায়, আর সামনের সারির দর্শকদের আতিথেয়তার জন্যে ব্যস্ত অনেকে ঘোরেন । এর থেকে ভালো ভেতর দিকে সবার মধ্যে বসে নাটক দেখা টুকরো কমেন্টস এর মধ্যে ।
কিছু খুচরো মন্তব্য :
-ঘোষক/ঘোষিকা ভাল কাজ করেছেন । সুন্দর কন্ঠস্বর আর বলার ভঙ্গী দুজনেরই, আর চমত্কার প্রেজেন্টেশন ।
-ছিল বই/ডিভিডি-র স্টল, নাটকের বই/সিডি থাকলে জমত, চোখে পড়ে নি আমার, ছিল কি ?
-চানা-বটুরা-র কথা না বললে এই রিভিউ অসমাপ্ত থেকে যাবে । জিনিসটা তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যাচ্ছিল ! এর দৌলতে ৪৫ মিনিটের ব্রেক কে ব্রেক-ই মনে হয়নি !
-এই রিভিউ লেখা হয়েছে এক দর্শকের চোখ থেকে । কাজেই, এই নাটক এই দর্শককে যেমন ভাবে ভাবিয়েছে, ঠিক সেই ভাবেই তার রিভিউটা লেখা হয়েছে । যেহেতু ভাবনাগুলো অন্যরকম, তাই রিভিউ তে কিছু অসাম্য দেখা যেতে পারে ।
-অফিসের কাজ, ঘর-সংসার সামলে, এই ব্যস্ত জীবনের ফাঁকে সময় বার করে নাটক এর প্রস্তুতি নেওয়া কোনও সহজ কাজ নয় । এইসব নাট্যকর্মীরা সুন্দর নাটক করে আমাদের শুধু আনন্দই দিচ্ছে না, আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছেন বেঁচে থাকার একটা অন্য মানেও আছে !
দারোগাবাবু বেশ সহজ এবং ভালো অভিনয় করেছেন, বাকি চরিত্রগুলো একটু দুর্বল, তবু চালিয়ে দিয়েছেন নাটকটা । মঞ্চসজ্জা নিয়ে বাড়াবাড়ি করেননি কিছু, খুব সাধারণ মঞ্চ ।
থানার ঘড়িতে তখন রাত দশটা । এক ব্যবসায়ী এসেছেন কমপ্লেন লেখাতে নিলু গুণ্ডার বিরুদ্ধে যে ৫০০০ টাকা ছিনতাই করেছে ব্যবসায়ীর কাছ থেকে । দারোগাবাবু যখন পুরো ব্যাপারটা বুঝলেন তখন মঞ্চে নিলুগুণ্ডার উপস্থিতি । নিলুগুণ্ডা ওনার উঁচুতলার পলিটিকাল কানেকশনের সাহায্যে কেসটা অন্যদিকে নিয়ে গেলেন । দারোগা বেশ ভয় পেলেন ।
এ সবই খুব সহজে ধরা যায়, গল্প বেশ দুর্বল । তবু দর্শক হেসেছে কিছুটা ।
তবে দারোগাবাবু-র মহৎ হৃদয়, যদিও চাকরি বজায় রাখতে উনি নিলু গুণ্ডার বিরুদ্ধে কোন কেস করলেন না । কিন্তু নিলুর দেওয়া ঘুষের কিছু টাকা ব্যাবসায়ীকে দিয়ে দিলেন এবং ওঁকে পালাতে সাহায্য করলেন ।
ঘন্টার আওয়াজটা একটু বেশি জরে হচ্ছিল, আওয়াজটা কম করবেন । আওয়াজ নিয়ে অভিযোগ উঠেছে পেছনের সারির দর্শকদের থেকে, তাঁরা বিশেষ কিছু শুনতে পাননি । তাছাড়া মিউজিক এবং অডিও বেশ পীড়াদায়ক ।
সংলাপের মধ্যে গ্যাপ ছিল, মাঝে মাঝে সংলাপ ভুলেও যাচ্ছিলেন । দারোগাবাবু নাটকটা টেনে নিয়ে গেলেও, বাকি দুটি ক্যারেকটারকে আরেকটু খাটতে হবে । আরেকটু স্লো মনে হচ্ছিল মুভমেন্টগুলো, সংলাপগুলোও । গুণ্ডাকে ঠিক গুণ্ডা মনে হয়নি, ব্যবসায়ীকে ব্যবসায়ী নয় ; আর ঠিক হাসির নাটকের গুণ্ডার মতনও লাগেনি । অবশ্য স্টিরিওটাইপ গুণ্ডা বা ব্যবসায়ী না করে অন্যরকম কিছু করাটা খারাপ নয়, কিন্তু কিছু একটা বিশেষত্ব থাকতে হবে তো, যেটা আমি খুঁজে পাইনি । আরেকটু ঘষা মাজা আর প্রাক্টিসের দরকার ।
দারোগা আর অ্যাসিস্টান্ট এর সাজসজ্জা বেশ ভাল ছিল । আর অন্য কিছু সেরকম উল্লেখযোগ্য নয়, আশা করব পরেরবার এঁরা শক্তিশালী কোন গল্প নির্বাচিত করবেন । আরেকটু চেষ্টা করলে আর সময় দিলে দেখবেন এই টিম-ই দারুণ কিছু একটা করে চমকে দিতে পারে সবাইকে ।
দুটোই খুব চমত্কার নাটক । লেখাটা দারুণ জমাটি । সবচেয়ে বড় কথা নাটক দুটোই নিজেদের লেখা । শ্রুতি নাটক দুটো একদম অন্য স্বাদ এনে দিল ।
বলাকা নাটকে বিপ্লব বাবুর বাংলা মেশানো হিন্দি উচ্চারণ খুব অরিজিনাল, আর রুমি ভাওয়ালের শ্রুতি-অভিনয় বড়ো চমত্কার, গানের গলাও মিষ্টি । পরিষ্কার উচ্চারণ হিন্দি এবং বাংলাতে । বাচনভঙ্গি, কন্ঠস্বরের ওঠা-নামা, দৃশ্য পরিবর্তনের সাথে সাথে কন্ঠস্বরের পরিবর্তন এসবই দর্শককে ধরে রেখেছে । মনে হয়েছে দর্শক ডুবে ছিলেন ওঁদের এই জমাটি শ্রুতি-অভিনয়ে ।
বলাকা নাটকে বিপদে পড়ে এক নারী এসেছেন এক পুরুষের কাছে আশ্রয় নিতে, গুণ্ডার তাড়া খেয়ে । বাঙালি বীরপুরুষ একা মেয়েকে দেখে আশ্রয় দিতে ভয় পাচ্ছে, এবং হিন্দি-বাংলা মেশানো সংলাপে দর্শকদের একদম মাতিয়ে দিয়েছেন । এই শ্রুতি নাটকটা আমার মনে থাকবে অনেকদিন । একদম মিস করার মতন নাটক নয় ।
মেয়েটি দহন সিনেমার কথা টেনে আনল, যেখানে একটা মেয়েকে বাঁচাতে আরেকটি মেয়েই এগিয়ে আসে, কোন পুরুষ নয় । শ্রুতি নাটকের হিরো প্রথমে তাতে উত্সাহ না দেখালেও, পরে জিনিসটা অন্যরকম দাঁড়ায় ।
বোগেনভিলিয়া নাটকে আমেরিকান প্রতিবেশির উদ্দেশ্যে এই মন্তব্যটা মনে থাকবে : সংস্কৃতির এই আবরণ ভেদ করে মানুষকে চেনা খুব শক্ত ! দারুণ কথা । আমি এভাবে কোনদিন ভেবে দেখিনি কথাটা, যদিও এই কথাটার আনাচে কানাচে ঘুরেছি ।
আরেকটা লাইন মনে আছে এখনও : "আমি বুদ্ধি দিয়ে বাঁচি না, অনুভূতি দিয়ে বাঁচি", ওই একই নাটকের সংলাপ । কথাটা শুনে অনুভূতি দিয়েও যে বাঁচা যায় তা মনে পড়ে যেতে পারে ।
এঁদের কথা ছিল একটা পুরো টিম নিয়ে একটা আসল নাটক করার, পরেরবার অপেক্ষা করে থাকব এইরকম কোন নাটক দেখার জন্যে । যদিও শ্রুতিনাটকটা সত্যি জমেছিল ।
এই নাটকে চমত্কার অভিনয় করেছেন সান্ত্বনার মামা, মীজান । একদম স্টেজ রেডি, সপ্রতিভ অভিনয়, মনে হচ্ছিল আমাদেরই পাড়ার এক পরিচিত মামা । উনি এই নাটকটাকে জীবন্ত রেখেছিলেন ।
মূল গল্প হল প্রফেসরের ছেলে আমেরিকার ভিসা পাওয়ার চেষ্টা করছেন, অথচ বারবার ব্যর্থ । আচমকা ভিসা পাওয়ার একটা সুবন্দোবস্ত হয়ে গেল । প্রফেসরের বাল্যবন্ধু এসে উপস্থিত খোদ আমেরিকা থেকে । বন্ধুর সাথে দুই মেয়ে । এক মেয়েকে বিয়ে করে আমেরিকা যাওয়ার একটা উপায় হলো । কিন্তু ছেলের মনে পরিবর্তন ঘটে, সে আর আমেরিকা আসতে চায় না, দেশের প্রতি টান অনুভব করে । একটা মেসেজ পাওয়া যাচ্ছে, মানসম্মান সবকিছু খুইয়ে বিদেশে যাওয়ার কোন অর্থ হয়না, নিজের দেশটা খারাপ কিসে ? দেশ ছেড়ে বিদেশে আসার যে পাগলামি দেখা যায় তার জন্যে বেশ যুত্সই একটা মেসেজ । কাল আর স্থান উপযোগী ।
মেসেজটা ঠিক আছে, কিন্তু মামা বাদে অভিনয় সেরকম জমল না । সান্ত্বনা আর তাঁর বন্ধু কিছুটা লড়েছেন, বাকিরা মোটামুটি । আরেকটু গতির দরকার ছিল, একটু ঢিমে তালে মনে হল ।
নিজেদের লেখা মৌলিক নাটক হিসেবে যথেষ্ট প্রশংসার দাবী রাখে । বাংলাদেশের আর্টিস্টদের করা নাটকের মধ্যে একটা অন্য স্বাদ থাকে, যেটা আমাদের পক্ষে একমাত্র এই ধরনের নাট্যমেলাতেই দেখা সম্ভব । আশা করব প্রতি বছরের নাট্যমেলাতে এই রকম একটা ভিন্ন স্বাদের নাটক আমরা দেখতে পাব ।
বিশেষ ভাল লাগা কিছু মুহূর্ত :
১) প্রোজেক্টরে ঢাকা ইউনিভার্সিটির নীল বাস ।
২) দুই সখীর কথোপকথন সম্ভাব্য প্রেমিকের উদ্দেশ্যে ।
৩) মামাকে ঘিরে মোটামুটি সব ঘটনাই, বিশেষ করে লুঙ্গি পরে আর্বিভাব, সম্ভাব্য প্রেমিকার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা ।
৪) নাটকটা শেষ হয়েছে দুর্ধষ এক গান দিয়ে । কার গান ছিল ধরতে পারিনি ।
ঠিক এই নাটকের সাথে যুক্ত নয়, কিন্তু এই নাট্যদলেরই একটা বক্তব্য, তাই এখানেই বলে রাখছি ।
অনুষ্ঠানের একদম শেষে এই টিমের প্রতিনিধি একটি বক্তব্য রাখলেন, যেটা আমরা এর আগেও শুনেছি । ভারতবর্ষের বাঙালিরা নাকি আজকাল বাংলা ভাষায় কেউ কথা বলে না (মূলত হিন্দিতে বলেন)। মূল অভিযোগ হল পশ্চিমবাংলায় বাংলার চল নেই সেইভাবে । এতে আছে বিতর্কের সুযোগ, সেটা হাতছাড়া করি কেন ? আমি দুই পক্ষেরই কিছু যুক্তি এখানে তুলে দিচ্ছি, পাঠকদের ওপর ছেড়ে দিচ্ছি এই তর্কের বাকিটা । কারণ অভিযোগটা যদি সত্যি হয় তাহলে কিছু একটা করা উচিত, হয়ত আমাদের সবারই ।
এক পক্ষের যুক্তি :
"পশ্চিমবাংলার বাংলা ভাষা হয়ত অন্য দিকে মোড় নিচ্ছে, কিন্তু সেটা ভাষার বিবর্তনের একটা ভিন্ন বিষয় । ভারতবর্ষে প্রতি বছর প্রায় হাজারটা লিটিল ম্যাগাজিন বার হয়েছে বাংলাতে, সেই কলকাতা আর পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষার চর্চা হয়না এটা কী মেনে নেওয়া যায় ? আর এক দেশে চর্চা হয় বলে, অন্য দেশে হয়না প্রমাণ করার দরকারটাই বা কি ? বাংলা নিয়ে কোথায় কিরকম কাজ হচ্ছে সেটা পাঠক/দর্শকদের ওপর ছেড়ে দিলে ঠিক হয়না ?
বাংলা ভাষার টানে কলকাতা আর পশ্চিমবঙ্গে কি মানুষ আজও ছুটে আসেনা ? তসলিমা কেন ফিরে আসতে চাইছেন কলকাতায় ? সেই বাংলার টানেই না যেখানে খোলা মনে বাংলার চর্চা করা যায় ?"
অন্য পক্ষের যুক্তি হল :
নতুন প্রজন্ম সেভাবে বাংলাভাষার চর্চা করছে না, এই বাংলার চর্চা (পশ্চিমবঙ্গে) কেবলমাত্র এই প্রজন্মেই সীমাবদ্ধ । এই প্রজন্মের সঙ্গে সঙ্গেই পশ্চিমবঙ্গে বাংলাভাষা শেষ হয়ে যাবে । এবং হিন্দি না শিখলে সর্বভারতীয় পরীক্ষায় পাল্লা দেওয়া খুব মুশকিল ; নতুন প্রজন্মের পক্ষে এতোগুলো ভাষার ধাক্কা সামলানো সম্ভব হবে না ।
আপনাদের কী মনে হয় ? পশ্চিমবঙ্গে বাংলাভাষার মৃত্যু আসন্ন ? না, ভাষা বদলাবেই যুগের সঙ্গে পা মিলিয়ে ? নাকি, এটা সেরকম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয় ?
বে-এরিয়ার শ্ব্ংইঈ নাট্যগোষ্ঠীর করা অসাধারণ নাটক । শুরু হতেই মনে হল একটা ভিন্ন স্বাদের অন্য কিছু । চোখ ধাঁধানো মঞ্চ, পরিমিত আলো, মন ভরিয়ে দিল ।
প্রথমেই আসবে মঞ্চ সজ্জার কথা । সাংঘাতিক সুন্দর, ৪৫ মিনিটের নাটক, ৫-৬ বার সেট পাল্টেছে, কখনও স্বপ্ন, কখনও বাস্তব ! কাফকার সেই সিনেমার ("দ্য ট্রায়াল") কথা মনে পড়ে যায়, অথচ খুবই অন্যরকম । এই নাটকে স্বপ্ন আর বাস্তব গুলিয়ে যায়নি, স্বপ্নের সাথে বাস্তবকে মিলিয়ে দিয়েছেন অসাধারণ পটুতায় !
গল্পে মোট ১০টা চরিত্র । দিব্যেন্দু শনিবার অফিস থেকে বাড়ি ফিরে আসে কিছু উটকো ঝামেলা এবং অফিসের আতঙ্ক নিয়ে । অনেকটা প্রবাসের এই আতঙ্কিত উইকএণ্ডগুলোর মতন, কখন যে অফিস থেকে ডাকবে ঠিক নেই । আমাদের অনেককে দেখা যায় মোবাইল, পেজার, পাম্ আর ওয়াইন-এর গ্লাস নিয়ে ছটফট করছেন উইকএণ্ডেও .... অনেকটা সেরকম আর কি ! এই কারণে নাটকটা আমাদের প্রবাসী জীবনের সাথে সাংঘাতিকরকম ভাবে জড়িয়ে ।
ভাললাগা চরিত্র :
সবাই মোটামুটি একই লেভেলে অভিনয় করেছেন, এমন হয়নি যে কেউ খুব বেশি সুযোগ পেয়ে গেছেন । তবে একটু বিশেষ ভাল লেগেছে :
সাগরিকার অসাধারণ অভিনয় স্বপ্নে এবং বাস্তবে, স্বপ্নের দৃশ্যে একটু স্পেশাল ভাল । অফিসের আর্দালিকে দারুণ মানিয়েছে, চমত্কার বাচনভঙ্গি, স্টেজ-মুভমেন্ট এবং সহঅভিনয় । চরিত্র উপযোগী সাজসজ্জা দারুণ মানিয়েছিল ।
এছাড়া বাবা, মা এবং অফিস বন্ধু(২) বেশ ভাল । ভাল লেগেছে মায়ের শান্ত মূর্তি আর স্বাভাবিক হাঁটাচলা । সাধারনত স্টিরিও টাইপ মা-দের কিছুটা ধীর গতির দেখান হয়, আর মাথার চুল প্রচুর সাদা করে দেয় : ভাল লাগল সেই ফাঁদে পা দেননি বলে ।
ভালোলাগা দৃশ্য :
১) শুরুতেই অপূর্ব এই গান :
২) অফিস-বসের সঙ্গে স্বপ্নে কথোপকথন ।
৫) প্রথম দৃশ্যে বাস্তব থেকে স্বপ্নের দৃশ্যে সেট চেঞ্জ । আর তিনটে নাটক পর পর দেখে দর্শক ক্লান্ত ছিল,
নাটকের দুর্বলতা :
১) স্বপ্নের দৃশ্যের আগে দরজার পর্দা পালটানো হবে, তার জন্যে একজন স্টেজের বাইরে অপেক্ষারত, সেটা একটা ডিস্ট্র্যাকশন । এই সময়টা কমানো যেত একই পর্দার দুদিকে দুরকম রং করে বা অন্য কোনো
বাদল সরকারের স্ক্রিপ্ট অবশ্য এরকমই ছিল, তবু একটু আধটু এডিট করলে ক্ষতি কিছু হয় না ।
৩) প্রথম অফিসের সীনটা যে স্বপ্নের সেটা দর্শকের ধরা একটু মুস্কিল হতে পারে,
যদিও পরের সীনেই সেটা ধরা পড়ে । আবার মনোযোগী দর্শক হয়ত প্রথম সীনেই ধরে ফেলেছেন ।
(দর্শকের কমেন্ট : "এরকম অফিস দেখিনি, গেঞ্জি পরেই কাজ !)
৪) স্বপ্নের দৃশ্যে আলমারি ঘোরানোটা একটু অসুবিধাজনক । প্রতিবার আলমারিটা একটু আটকে যাচ্ছিল, একটু ছন্দপতন ঘটে যাচ্ছিল । বাকি সবকিছু এতো মসৃণ বলেই হয়তো এটা বেশি করে চোখে পড়ে ।
৫) এটা ঠিক দুর্বলতা নয়, এটা আমারই একটা প্রশ্ন : পুরুষের স্বপ্নের রঙ জানতাম সাদা-কালো হয় (যদিও হিন্দি সিনেমার স্বপ্নের দৃশ্যগুলো তা প্রমাণ করে না) । নাটকে স্বপ্নকে ঠিক স্বপ্নের অনুকরণ করতে গেলে এটা আর কি ভাবে দেখান সম্ভব ছিল ?
এই বিদেশে এই ধরনের পারফরমেন্স দুষ্প্রাপ্য । কাজেই এখানকার বিভিন্ন সংগঠনের (এন-এ-বি-সি, বঙ্গমেলা, ভিন্ন ভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন আর দুর্গোত্সব...) এঁদের উচিত এইসব স্থানীয় প্রতিভাকে
উত্সাহ দেওয়া, এঁদের আরো অনেক নাটক করার সুযোগ করে দেওয়া ।
কলকাতার গ্রুপ থিয়েটারের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে এঁরা যেটা মিস করছেন সেটা হল একই নাটক অনেকবার করে করা । এই সুযোগটা করে দেওয়ার দায়িত্ব কিন্তু এইসব সংগঠনগুলোর ।
(পরবাস, অক্টোবর, ২০০৫)
"শনিবার, আজ শনিবার", ভাল লাগা সুর, ভাল গান । শুনলাম
৩) দিব্যেন্দু-সাগরিকার প্রেমের দৃশ্য (স্বপ্নে) ।
৪) কর্তব্যপরায়ণ মা সব সময় পুরো ফ্যামিলিকে দুধ খাওয়াতে ব্যস্ত , যেটা খাওয়ার সময় বা ইচ্ছা কারো নেই । এই ঘটনাটা অনেক হাসির উদ্রেক করেছে পুরো নাটকে ।(প্রথম দিকে)
আসুন, আমরা এই নাট্য-আন্দোলনকে আরেকটু এগিয়ে নিয়ে যাই :
এলিয়টের যে-কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম তার প্রসঙ্গে টেনেই শেষ করছি । দর্শক ফিরে ফিরে যখন একটি নাটক দেখতে চাইবে তখনই সেটি সার্থক হয়ে উঠবে । এইসব সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী সেই সুযোগ না করে দিলে নাট্যকর্মী আর নাট্যপ্রেমীদের মধ্যে সেই যোগসূত্র তৈরি হবে কী করে ?
(কৃতজ্ঞতা স্বীকার : যাঁরা আমার সঙ্গে বাংলাতে যোগাযোগ করেছেন এই নাট্যমেলার পরে আর এই লেখার আগে, তাঁদের সবাইকে ।)