ড্রাইভিং লাইসেন্সটা রিনিউ করতে সুমিত গিয়েছিল মোটর ভেইকল্স ডিভিসনে । মোটর ভেইকল্স সরকারি আপিস, দেশের মত এখানেও ভাবটা খানিক ঢিলেঢালা ; তবে ভিড় থাকলেও ভাট্টা নেই, আর কাজে সবার মন বলেই মনে হয় । কুপন নিয়ে অপেক্ষা করে ডাক এল সুমিতের, কাউন্টারে মধ্যবয়সী মহিলা খটাখট দক্ষতায় রিনিউ করলেন দ্রুত । তারপর প্রথামত হ্যভ এ নাইস ডে বললেন । তবে সুমিত চলে আসার আগে উক্তি এল লঘু চালে, হাউ ডু ইউ গাইজ্ গেট অল দ্য জব্স আওয়ার কিড্স ডোন্ট ?
স্থানটা মার্কিন মুলুক, কালটা একদম হালে আর পাত্র সুমিত; ভারতের ভুবনভরা সফ্টওয়ার ব্যবসার অগণিত কাণ্ডারিদের একজন ।
গত কমাসে এমন প্রশ্ন ডজনখানেকবার শুনেছে সুমিত । ট্যাক্সিচালক থেকে শুরু করে উড়ানে অল্প-আলাপির মুখে । কেউ বলেছেন মিঠে করে (ইউ গাইস্ হ্যাভ দ্য ব্রেইন্স উই নীড !) কারোর রাখ-ঢাক কম (ইউ ওয়র্ক ফর লেস পে, দ্যাটস্ হোয়াই....), তবে বলেছেন অনেকে, এবং বেশ চিন্তা নিয়ে । ভাতের থালার টানটা চিরন্তন, তাই ও খাতে টানের ভয় টনটনে, সব দেশে সব কালে । অধুনা আমেরিকা তথা প্রথম পৃথিবীতে এ নিয়ে শোর সপ্তমে উঠছে ।
পশিমের অগ্রসর দেশগুলিতে, বেশি করে আমেরিকায়, স্থানীয় বহু কর্মী এখন কাজ-হারা; আর সেইসব চাকরি ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে পেছোনো রাষ্ট্রের পিলপিলে শ্রমিকরা । এই নিয়ে অবিশ্বাস, বিস্ময়, অস্বস্তি পেরিয়ে এবার ক্ষোভের পালা ; আর তার সাথে ভয়, ভবিষ্যৎ ভেবে ।
তবে এই ভয়ের ভিত্তি কোথায়, কতটা, কেনই বা ? আর এই খাতে আমাদের হ্রাস-বৃদ্ধির আশা কেমন ?
সব হুজুগেই ক্যাচ-ওয়ার্ড বা ধরতাই থাকে, (নিখিলেশের মতে স্বদেশিদের যেমন ছিল বন্দেমাতরম্ !) । একটা শব্দ আজকাল প্রায়ই শোনা যাচ্ছে - ভ্যানভ্যান থেকে ত্রক্রমশ: গোঁ-গোঁ'তে উন্নীত - ধণ্ণঞযধণ্ণশবঠত্রভ । নতুন কনসেপ্ট বাংলায় না হলে আবার আমি বুঝি না । অনেক মাথা চুলকে তর্জমা করলাম -- বহিরুত্সায়ন । মানে বহি:+উত্সায়ন, ব্যাকরণে চিরকালই কাঁচা, সন্ধিটা বোধহয় একটু কেঁচিয়ে গেল । যাইহোক মানেটা বাঁচলেই হল, ব্যাকরণ না মানার দোহাই তো দেওয়াই আছে, ছাগলের পেটে ছিল না জানি কি ফন্দি, চাপিল বিছার ঘাড়ে; ধড়ে মুড়ো সন্ধি !
বহিরুত্সায়ন ব্যাপারটা কিন্তু নতুন নয় । তবে তার আগে দেখা যাক বহিরুত্সায়ন কেন । শিল্পোদ্যোগের নানা স্তর থাকে । একদম প্রাথমিক স্তরে মাটির একদম কাছাকাছির ব্যাপার, মাছ-ধরা, খনিজ খনন প্রভৃতি । তারপর মাধ্যমিক স্তরে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রসেসিং বা প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে পণ্য উত্পাদন ; ইস্পাত জাতীয় শিল্প । এবং তৃতীয় বা উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে মুখ্যত পরিষেবা-ভিত্তিক প্রয়াস, ব্যাঙ্কিং, বীমা ইত্যাদি । মোটামুটি এমন তিনটি ধাপ বেয়ে যে-কোনো দেশের শিল্পোন্নয়ন এগোয় ; অর্থনীতি যত দৃঢ় হয় ত্রক্রমশ: উদ্যোগ তৃতীয় স্তরের দিকে হেলতে থাকে । কিন্তু সে-ক্ষেত্রে প্রথম দু'ধরনের শিল্পজাত পণ্যের চাহিদা মেটে কী ভাবে ?
ইংরেজি কথাশিল্পী সমারসেট ম'ম একবার লিখেছিলেন,
তা ধুলো-ওড়া ধোঁওয়া-ছাড়া এইসব ময়লা শিল্প দূর দেশে থাকলে ক্ষতি কী ? উত্পন্ন মালগুলি ঠিকঠাক পেলেই তো উপভুক্তির খামতি থাকে না । আর পরিবেশটেশ জাতীয়
দামি ফাণ্ডাতেও মজে থাকা যায় ।
এমনই চলছিল, কিন্তু গোল বাধল তথ্যপ্রযুক্তি-ভিত্তিক শিল্পেও বহিরুত্সায়নের ঢল নিয়ে । এখন চারপাশের গেল-গেল রব হঠাতই কেন, তা বুঝতে হলে অন্য শিল্পের থেকে তথ্যপ্রযুক্তি পৃথক কোথায় তার খানিক হিসেব নিতে হবে ।
তামাম দুনিয়ায় বিক্রিতব্য দু ধরনের -- পণ্য ও পরিষেবা । এদের তফাত্টা স্পষ্ট, আজকের পাণ্যিক যুগে শিশুরাও এসব জেনে গেছে । পণ্য হল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য "জিনিস" আর পরিষেবাও গ্রাহ্য ইন্দ্রিয়তেই, তবে খানিক অন্য তলে । যেকোনো শিল্পোদ্যোগের উত্পাদ্য হয় পণ্য নয় পরিষেবা ; এবং তারপরে তার পসরা, ক্রেতার কাছে । সফটোয়ার একাধারে পণ্য ও পরিষেবা । এই খাতে সফ্টওয়ার'এর বাণিজ্যমূল্য ব্যাপক এবং অনন্য ।
(বলে রাখা ভাল, তথ্যপ্রযুক্তি ও সফ্টওয়ার শব্দবন্ধ সাধারণত সমার্থকভাবে ব্যবহৃত হলেও, সফ্টওয়ার ছাড়া তথ্যপ্রযুক্তিগত অন্য শিল্পও আছে । এবং কারোর মতে এই ধরনের আইটি-এনাবেল্ড-সার্ভিসেস'এর উদ্যোগ অদূর ভবিষ্যতে সফ্টওয়ারের চাহিদাকেও ছাপিয়ে যাবে । এই লেখার আলোচনা মূলত সফ্টওয়ারকে ভিত্তি করেই । এবং সফ্টওয়ার এখানে সফ্টওয়ার ইন্ডাস্ট্রি অর্থে প্রযুক্ত ।)
ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে সফ্টওয়ার'এর বয়স দেড় দশকের বেশি না । কিন্তু এরই মধ্যে প্রসারের বহুলতায় ছাড়িয়ে গেছে সভ্যতার আর সব শিল্পকেই । তা হতে পেরেছে কারণ সফ্টওয়ারের উত্পাদন-বিপণন-ব্যবহারে ভৌগোলিক দূরত্ব-নৈকট্য অবান্তর । যে ইন্টারনেট বা আন্তর্জালে আজ সারা দুনিয়া যুক্ত, তার ধমনী দিয়েই সফ্টওয়ার শিল্প ছড়িয়ে পড়েছে অবাধে । এবং এই অবাধ ছড়ানোতেই কারো পৌষ মাস, আবার কারোর সর্ব না-হলেও, খানিক নাশ ।
সেই উঠতি কলেজের ইকনমিক্সের বিদ্যায় যেটুকু কুলায়, তা'তে বুঝেছি ধনতন্ত্রের
একটা গোড়ার ছযযণ্ণস্ংঋঞঠধত্র, `লেভেল প্লেইং ফীল্ড', বা সুসম প্রতিযোগিতার জন্য সমতল মাঠ । কিন্তু শিল্প-বিপ্লবের পর থেকে ইত্যবধি তেমন কখনই হয়নি । কেন হয়নি সে আলোচনা আমার নাগালের বাইরে, তবে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অনবদ্য ছত্রে হয়ত বলা যায়, "যার হাত আছে তার কাজ নেই / যার কাজ আছে তার ভাত নেই / আর যার ভাত আছে তার হাত নেই ।" ধন আছে যাঁদের, তাঁরাই শ্রম কিনেছেন, এবং নিজেদের শর্তেই । ইদানীন্তন আলোচনায় সম্ভবত টমাস ফ্রিডম্যান সফ্টওয়্যারের ক্ষেত্রে এই `লেভেল প্লেইং ফীল্ড' নিয়ে প্রথম আলোকপাত করেছেন ।
কিন্তু সফ্টওয়ারের অতি সাবলীল সঞ্চারের জন্য, এই ইনডাস্ট্রি অনেকাংশেই `লেভেল প্লেইং ফিল্ড'এর কাছাকাছি পৌঁছতে পেরেছে । খোদ ম্যানহাটনে বসে যে সফ্টওয়ার তৈরি হতে পারে, মালদাতেও তাই হওয়া সম্ভব ; এবং বৈদ্যুতিন সংযোগ থাকলে, ক্রেতার কাছে তা পরিবেশিতও হবে পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় । এবং বুভুক্ষু তৃতীয় বিশ্বে পরিশ্রমের দাম তো চিরকালই সস্তা, প্রথম পৃথিবীর থেকে বেশ কয়েক গুণ ।
এই ঋতুতে যা হওয়ার তাই হচ্ছে । অমোঘ মুনাফার আরো বর্দ্ধিয়নের জন্য, হু হু করে সফ্টওয়ারের বহিরুত্সায়ন । ভারত ইত্যাদি আপন্ন দেশ'এর সাথে বৈদ্যুতিন সংযোগ পাতালেই কেল্লা ফতে, শিল্পোন্নত দেশ'এর ন্যূনতম মজুরিরও অনেক কমে কাজ পাওয়া যাবে একই, হয়ত আরো বেশি আর আরো ভাল । আমরাও খুশি, কারণ বৈদেশিক মুদ্রার সাথে লেজুড় থাকে ভারি গুণিতক, টাকার হিসাবে গুণফল তো বিরাট মোটা ।
কিন্তু প্রথম পৃথিবীতে হাহাকার । বাঁধে জল ধরা যতক্ষণ, ততক্ষণই স্থিতি-শক্তির উপর নিয়ন্ত্রণ চলে; যেই কপাট ওঠে, অমনি গতিশক্তি লাগামছাড়া, জল গড়াবে তলের নিরিখে । ধনই এমনি, বলেছিলেন একবার কলকাতার পুরোনো পাড়ার এক কাকু । সোভিয়েট ইউনিয়ন গলে যাবার পরে ইনি ক'বছর মুষড়ে ছিলেন, মাঝে একবার বাণী দিয়েছিলেন, বিশ্বায়ন তো বেশ্যায়নই । সম্প্রতি আবার চেগে উঠেছেন । এই সেদিন বাজারের পথে বিড়ি অফার করে বললেন, দেখেছো আমেরিকাতে দু'লাখ চাকরি গেছে, ক্যাপিটালিজ্ম ব্যুমেরাং করছে । আমি বললাম, কাকু আমি তো স্মোক করি না ।
সফ্টওয়ারে বহিরুত্সায়নের হিড়িক বড় মাপে শুরু হয়েছে গত দুবছরের অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে । টঁযাকের টান থেকেই ব্যায়-সঙ্কোচের ফন্দি, সেখান থেকেই "অফ্-শোর'এ কাজ পাঠানো । কিন্তু মন্দার সাথে বহিরুত্সায়নের গাঁটছড়া চিরন্তন নয় । বাজার আবার তেজী হলে, কূল-ভ্রষ্ট কাজ সব ফিরে আসবে উন্নত দেশে, তার সম্ভাবনা কম । আইন করে তৃতীয় বিশ্বে কাজ পাঠানো বন্ধ করার একটা তাল উঠছে ত্রক্রমশ, কিন্তু খোলা বাজারের অর্থনীতিকে মানলে, কোনো ব্যবসায়ীর কাছেই এমন কানুন গ্রাহ্য হবে না । আইন করে জেদ রাখা যায়, কিন্তু লাভ রাখা নাও যেতে পারে । একই মানের পণ্য সবথেকে সস্তায় যেখানে মিলবে, ক্রেতার সেখানে যাবার অধিকার আছে, এমন বুলি তো মন্ত্রের মতই বলা হয়েছে অনেকদিন । আর তাই পর্বতের মোসেস'এর কাছে আসার মত, উন্নত বিশ্ব আসছে আজ আমাদের কাছে, সফ্টওয়ার'এর হাটে ।
গত শতকের শিল্পায়নের ইতিহাসে দেখা যায়, যেকোনো ইন্ডাস্ট্রির প্রথম পদক্ষেপ আসে পশ্চিমে, শুরুর দিকে সব প্রগতিও সেখানেই, তারপরে যখন উত্পাদন-উপভক্ষণের ছক থিতু হয়ে আসে, তার বহিরুত্সায়ন হতে থাকে । গাড়ির শিল্প এর এক উত্কৃষ্ট উদাহরণ । আমেরিকাই বিশ্বকে চাকায় চড়িয়েছিল ; এখন সেখানের রাস্তায় এশীয় গাড়ির রমরমা, আমেরিকার নির্মাতারাও পার্ট সব বানিয়ে আনান বাইরে থেকে । সফ্টওয়ারে এই ধারাই আসছে, কিন্তু ভীষণ তাড়াতাড়ি । এই শিল্পের ভেদ-ক্ষমতা বা পেনিট্রেশন'এর সুযোগ এখনও অধিকাংশই বাকি । তাই সুযোগও অঢেল ।
প্রবাদীয় নেপোর যেমন দৃষ্টি দই'য়ের দিকে, তেমন দেখতে হবে এই ডামাডোলের বাজারে আমাদের কদর কেমন । সফ্টওয়ারের বহিরুত্সায়নে, একটি দেশীয়-গোষ্ঠী হিসেবে এতদিন ভারতীয়রাই ফায়দা পেয়েছেন সর্বাধিক । আমেরিকায় তো থই থই করছেন সুমিতের মত তাজা যুবক, পাশ করেই পাড়ি দিয়েছেন ও-পারে কোনো নামী কোম্পানির দৌলতে । কাজ-কর্মে তুখোড়, বৈদেশিক বস'রা খুব খাতির করেন, সুমিতরা ভালই আছেন । জোরে গাড়ি চালান, বছরে একবার দেশ'এ ঘুরে আসেন, বিয়ে করলে বৌকে নিয়ে আসেন কম্পানির খরচায় । তারপর আস্তে আস্তে হয়ত মিশেই যান ঐ সভ্যতায় । এর অন্য পিঠে অমিতরা ; যাঁরা দেশে বসে আউটসোর্সড কাজ করছেন, আর সুমিত হবার স্বপ্ন দেখছেন । আর এসব স্বপ্ন সত্যি হয়ে ওঠে, প্রায় সব অমিতের কাছেই ।
এই প্যাটার্নটা মন্দ না, তবে পাড়ার সেই কাকুর মত, যাঁরা দেশ-টেশ নিয়ে ভাবেন, তাঁরা বলবেন বোধহয়, অন্যের হয়ে খেটে কোনো জাতির উথ্থান হয় না । কথাটা হয়ত হক, কারণ শুধুই বহিরুত্সায়নের দোলায় চড়ে পার হওয়া যাবে, এমনটা নাও হতে পারে । ইতিমধ্যেই শোনা যাচ্ছে, কোটালের জল নাকি চৈনিক খাতে বইতে পারে শিগ্গিরিই; ওঁরা নাকি আরো সস্তায় দেবেন ।
সফ্টওয়ারের যে মস্ত সুবিধা (যা আর অন্য কোনো বৃহৎ প্রযুক্তিগত শিল্পেই নেই), অত্যন্ত কম প্রাথমিক লগ্নীতে ব্যবসা শুরু করা যায়, তা মনে রেখে আমাদের নিজেদের উদ্যোগের কথা ভাবতে হবে । গুণগত মান বজায় রেখে আকর্ষক দামে সফ্টওয়ার উত্পাদন ভারতীয়দের পক্ষে সম্ভব তা অনেকদিনই প্রতিপন্ন । আমাদের নিজেদের উদ্যোগেও যে তা করা যায়, তাই আরো ব্যাপকভাবে প্রমাণ করতে হবে । তা হলেই বহিরুত্সায়নের বাজারে মুনাফালোভী ভিনদেশি বহুজাতিকের কাছে বিকিয়ে না গিয়ে, সুমিতদের সাফল্য আমাদেরও এগিয়ে নিয়ে যাবে ।
ধন-অধন তান্ত্রিকতা নিয়ে আমরা, বিশেষত বাঙালিরা, অনেকদিন কাটালাম । এখনও বুমেরাং ইত্যাদি ভেবে নিয়ে শুধুই কি বঁংউদ হয়ে থাকব ?
দিন আগত ওই, ভারত তবু কই ? লেখা হয়েছিল কিন্তু প্রায় নব্বই বছর আগে ।
(পরবাস, অক্টোবর, ২০০৫)