• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩৫ | মে ২০০৫ | গ্রম্থ-সমালোচনা
    Share
  • ঋকারং প্রণমাম্যহংনিবিড় পাঠ : ঋ : ঋতব্রত মিত্র

    ঋ/ তিলোত্তমা মজুমদার / আনন্দ / পৃষ্ঠা ৩২৫ / প্রথম সংস্করণ ২০০৩ ঝনজব্‌ - ৮১-৭৭৫৬-৩৬৬-১









    ॥ ১ ॥

    বয়সটা আরেকটু অল্প ছিল যখন তখন গল্প-উপন্যাস পড়তে পড়তে হারিয়ে যেতুম যেন ; একটানে শেষ না করে উঠতুমই না । বাড়িতে প্রশ্রয়ও ছিল অবাধ । কিন্তু এখন অভ্যেস খারাপ হয়ে গিয়েছে । থেমে থেমে পড়ি আর যা-ই পড়ি তারই ভেতর থেকে কবিতা নিষ্কাশন করে নিতে ইচ্ছে যায় । ফলে অনেক লুকোনো হীরে জহরত চায় না ক'বার পাঠেও ধরা দিতে । এই বইটির ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হবে না ।

    বইটি খুলতেই আচমকা ৪১ পৃষ্ঠার ওপরের দিকের একটি বাক্য একটি পংক্তি হয়ে ঝকমক করে উঠলো একেবারে । -

    "মধ্যিখানে একই জলের খরস্রোতা নদী ।"

    মধ্যিখানে /৪ একই জলের /৪ খরস্রোতা /৪ নদী //২ - মধ্যলয়ের স্বরবৃত্ত ।

    মাথায় ছন্দের নাছোড় দুলুনি নিয়ে কি আর গদ্যে উপগত হাওয়া যায় ? আনমনে আগের পাতায় তলার দিকে দৃষ্টি পড়ে আমার । আবারও শিহরণ !

    "যেন, এভাবেই কেটে ফেলা যায় যাবতীয় তর্জনী ।"

    যেন এভাবেই /৬ কেটে ফেলা যায় /৬ যাবতীয় তর্‌ /৬ জনী //২ - এ-ও মধ্যলয় । মাত্রাবৃত ছন্দ ।

    নাহ্‌, অভ্যেস খারাপ হয়ে গিয়েছে সত্যিই ব্যর্থ কবিতা জননের দুর্মর বাসনা আমাকে গদ্যে পৌঁছতে বাধা দিতে থাকে ত্রক্রমাগত । কোনো সার্থক গদ্যপ্রয়াসের নিবিড় পাঠে ব্রতী হওয়া উচিত হবে কি আমার ?




    ॥ ২ ॥

    দ্বিধা ঠেলে প্রথম গদ্যটি প্রথম থেকে পড়তে থাকি । এর আগে এঁর লেখা পড়ার সুযোগ হয়েছে -- মানুষশাবকের কথা, বসুধারা, চাঁদের গায়ে চাঁদ । লেখিকার গদ্যশৈলীর একটি বৈশিষ্ট্যে আচ্ছন্ন হয়েছি -- কাহিনির গতিকে বিন্দুমাত্র ব্যাহত না করেই দার্শনিকতার আধারে অস্তিত্বের সঙ্কট ও প্রসন্নতাকে যত্নচয়িত শব্দমালায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাওয়া, জীবনে একবারও গল্প বা উপন্যাস রচনার প্রয়াস পেয়েছেন যাঁরা তাঁরাই জানেন কত কঠিন এ কাজ ।

    সৃজনেচ্ছা একটি বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত হতে চাইলে জন্ম নেয় কবিতা আর একটি বিন্দু থেকে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়তে চাইলে জাত হয় গল্প-উপন্যাস -- এমত ধারণার বশবর্তী আমি । এই দুই প্রক্রিয়ার নিষেকে অর্থাৎ প্রেরণার একটি বিন্দুর দিকে ধাবিত হওয়া এবং কেন্দ্রীভূত না হয়ে পরমুহূর্তে দশ দিকে ব্যাপ্ত হয়ে যাওয়ার সৌজন্যে কী ধরনের রচনার সর্জন সম্ভব তার আভাস পেয়ে যাই আমি ।

    উপন্যাসোপম নামকাহিনি ঋ-তে কেন্দ্রীয় চরিত্র বিনতা "যার মাথায় ছিল ইলিকবিলিক ঘা, যে একটা বেলের আঁটি চুষতে চুষতে পার করছিল শৈশব, যার মাথায় এখন ঝাঁকড়া চুল, মুখের ওপর গুলমোহরের তোড়া, সেই মেয়েটি বিনতা, ....... সে মেয়েমানুষ তাই রাত্রি জেগে ব্রতপালন করছে - এই বোধ তাকে নিয়ে চলেছে অন্য কোনও দুনিয়ায় ।" সে দুনিয়ায় সকল নদীরই `উপলব্যথিত' গতি ; সে দুনিয়ায় আমাদের নিত্য অধিষ্ঠান । তাই কাহিনির শেষে যখন দেখি "রাধারঞ্জনের কৃত পাপ শেখরের কাঁধে ন্যস্ত করার সফল ষড়যন্ত্রে সে কি পিতৃঋণ শোধ করল, না, ঘটাল এক প্রত্যপমান, তার স্বামীর প্রতি, তা স্পষ্ট হওয়ার আগেই নিজের কাছে জয়ী হল সে", তখন আমরা চমকিত হই না, নিরাসক্ত জীবনতরঙ্গের অনিবার্য বিপুল আন্দোলনে স্তব্ধ হয়ে থাকি ।

    সেই স্তব্ধতার সূচিমুখে ত্রক্রমশ: উঠে আসে চার চারটি নাতিদীর্ঘ কাহিনি । প্রথমটি `সিলুয়েট' । মনুষ্যস্বভাবের নির্মমতাকে পরম মমতায় ধরতে চেয়েছেন লেখিকা, মতি নন্দীর ভাষা ও ভঙ্গির চেয়ে এ সম্পূর্ণ আলাদা । মূল চরিত্র দিশা একটি এয়ার ওয়েজের গ্রাউণ্ড অফিসার । সহকর্মী বরুণ শেঠি তাকে প্রত্যাখ্যান করলে সে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করে তার এক নীরব প্রেমিক প্রতিবেশীকে আত্মহত্যায় প্ররোচণা দিয়ে । দিশার বিবেকের ভাষ্যে গল্পকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন লেখিকা । এই রীতি অনুসরণের একটা বড় ঝুঁকি এতে চরিত্রগুলি অনেকক্ষেত্রেই স্বাভাবিক ভাবে বিকশিত হতে পারে না । কিছুটা পড়েই মনে হয় চরিত্রগুলির মানসিক টানাপোড়েন অনেকটাই আরোপিত । কিন্তু অনবদ্য মুন্সিয়ানায় তিলোত্তমা তাঁর অভিপ্রেত পরিণতির দিকে টেনে নিয়ে যান পাঠককে ।

    পরের কাহিনি `অঞ্জলিকাকিমার উপসংহার'-এ অকালে স্বামীকে হারিয়ে এক ব্রাহ্মণঘরের মহিলা শেষমেশ সিদ্ধান্ত নেন চাবাগানের ট্রাক্টর-ড্রাইভার দুখিয়া মুর্মুকে বিয়ে করার । স্বজাতির স্বভাববৈরিতা উপেক্ষা করে আত্মমর্যাদাকে জয়যুক্ত করার সিদ্ধান্ত সমাজ কোনদিনই মানতে পারেনি । কিন্তু সচেতন লেখকের দায়বদ্ধতা থাকে সমাজ শুভৈষণায় । তাই উপসংহার পাঠক অনুমান করে নিলেও ভাষার সৌন্দর্যের কারণে পাঠের আগ্রহ ক্ষুন্ন হয় না ।

    `হরিয়াল উড়ে যায়' শীর্ষক কাহিনিটিরও কেন্দ্রীয় চরিত্র এক মহিলা -- নাজিমুন । পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের সেই অস্তিত্বেরই স্বীকৃতি যতক্ষণ তারা যৌনপুতুলের ভূমিকায় সার্থক অভিনেত্রী । এর ব্যতিক্রমেই দাম্পত্যে ফাটল, সমাজে বিপর্যয় । এই পুরোনো সত্যটি নিজের মতো করে ফুটিয়েছেন তিলোত্তমা ।

    চারটি নাতিদীর্ঘ কাহিনির মধ্যে `স্বস্ত্যয়ন' সবচাইতে টেনেছে আমায়, এ-কাহিনির কেন্দ্রেও এক মহিলা । তারই বাচনিকে কথকতা করেছেন লেখিকা । কন্যাপক্ষ প্রতিপত্তিশালী হয় যদি তবে নিম্নবর্গের ছেলের প্রেমের পরিণতি স্বভাবতই ব্যর্থতা । -- "গরিব অর্ণব চাপে পড়ে ডিভোর্স দিতে বাধ্য হল ।" উন্মাদ আশ্রমে কাটাতে হল ওকে । প্রতিলোম বিবাহের এ-গল্প এখানেই শেষ হলে তা হত চেনাছকের বাণিজ্যিক বাংলা ছায়াছবির খাদ্য । কিন্তু লেখিকা কী করলেন ? পুনর্ভূ অনন্যার আত্মজার লেখনীতে বললেন, `পৃথিবীর সমস্ত অর্ণবদের শান্তি হোক, শান্তি হোক ।' অতিসার্থক এ গল্পের নামকরণ ।




    ॥ ৩ ॥

    অস্বীকার করবো না, ছেলেবেলায় বড়দের ছোটগল্প-উপন্যাস আমি পড়তুম মূলত চোরা যৌনতার স্বাদ নিতে । গদ্যে যৌন-উপাদানের ব্যবহার আমাকে যুগবৎ আকর্ষণ ও বিকর্ষণ করতো । ছন্দের দুলুনির সৌজন্যে কবিতায় এহেন আত্মরতির সুযোগ ছিল কম । এখন ভাবলে হাসি পায় । যৌন উপাদানের অসার্থক ব্যবহার কত সহজে উপেক্ষা করতে পারতুম তখন ! এ প্রসঙ্গটি তোলার কারণ তিলোত্তমা মজুমদারের লেখায় অন্যতম ভরশক্তি প্রাতিস্বিক যৌনচেতনা । এঁর হাতে যৌন উপাদানের ব্যবহার মনে অহেতুক উত্তেজনা সৃষ্টি করে না বরং নির্মোহতা এক জৈবিক প্রক্রিয়ার কাছে আত্মসমর্পণের দমচাপা ভার লাঘব করতে চায় । এ ধরনের শুশ্রুষা বাংলা সাহিত্যে ইতিপূর্বে পাইনি ।

    `নাসের এ কাহিনির মূলচরিত্র নয়' গল্পে বিপত্নীক চিত্রকর অরিন্দম বিশ্বাস করেন "প্রত্যেকটি মানুষের নিজস্ব বোধ, ইন্দ্রিয় ও উপলব্ধির দ্বারা নিজস্ব নীতি ও দর্শন গড়ে তোলার অধিকার আছে ।" যার অনিবার্য ফল তাঁর কন্যা মধুয়া অবাধ ও অনর্গল । "পুরুষের ছোঁয়া সম্পর্কে সে অভ্যস্ত ও উদাসীন হতে থাকে ঠিক তেমনি, যেমন একটি চারবিয়ানী-গাভী নিজের বাট দোহন করা সম্পর্কে সমস্ত আপত্তি ও সাবধানতা হারায় ।" তার কানীন শিশুর "অনাড়ম্বর পিতার ভূমিকায় অবিচলিত থাকে কবি-হতে-চাওয়া ও হতে-না-পারা" নাসের কিন্তু শিল্পী সাহিত্যিকদের বহুবিধ বিচলন অগোচর থাকে না পাঠকের । `দিবানাথের আত্মহনন রহস্য' গল্পে এরকমই এক বিচলন আত্মহননেচ্ছার বীজ রোপণ করে `সত্যিমিথ্যে' গল্পে বিষ্ণুপ্রিয়াকে দিয়ে অনায়াসে বলিয়ে নেয় : "ভালবাসা এখনও কয়েকটি বিছানায় যাওয়া বা না যাওয়ার শর্তসাপেক্ষ ।"

    প্রত্যক্ষ পরোক্ষ নানা শর্তের নিগড়ে বাঁধা আমাদের জীবন, বিশেষত মেয়েদের জীবন-পুরুষতান্ত্রিক সমাজে । `লোনা' গল্পে সদ্য বিবাহিতা তিন্নির তাই অচিরেই মনে হতে থাকে "সবাই চলছে, কেবল আমিই স্থির, নিথর । কী রকম যেন ফুরিয়ে গেছি ।" অখেদ স্বীকারোক্তি `হাউ-স দ্যা-ট !' গল্পের শেষে -- "ও বড় পরিচিত আমার ... যাকে প্রতিনিয়ত শুনতে হয়েছে -- মেয়েরা খেলার কিচ্ছু বোঝে না ।" `কোনও গৃহবধূর যে কোনও তিনটি দিন'-এও সঙ্গত আর্তপ্রশ্ন -- "আমার অস্তিত্বের মধ্যে এতখানি মরচে পড়ে গেল কখন ? আমি যে কিছুই খেয়াল করিনি ।"

    অস্তিত্বের মধ্যে মরচে নিয়েও নির্বিকার এক নারীকে পাই `অসম্পূর্ণা' গল্পে । যে এরিকা দিদিমণি প্রিয়ছাত্রী মণিমাকে শ্রেণীকক্ষের ঘেরাটোপের বাইরে নিয়ে গিয়ে দিতে চান জীবনপাঠ তিনিই কেমন অক্লেশে বিস্মৃত হন মণিমাকে যখন জানতে পারেন সে আদপে যৌনকর্মীর সন্তান । আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যে বাস্তবিকই ভান তা আবারো মনে করিয়ে দেয় `রাজু চিত্রকর' গল্পটি । রাজনৈতিক নেতাদের বিবিধ কর্তব্যের মধ্যে একটি হল জনগণকে সামাজিক নীতিশিক্ষাদান । কেমন সে কর্তব্যপালন ? -- "ভূপেশদা কড়া স্বরে বলল -- তুই আমাদের দেওয়াল এঁকেছিস আবার ওদেরটাও আঁকছিস যে ! ..... বেঁচে থাকতে চাস যদি এই কাজ বন্ধ কর রাজু ।" কিন্তু জাতশিল্পী যে, যে লোভীও নয়, ভীতুও নয়, যে বিশ্বাস করে আঁকা যেমনই হোক শুরু করলে শেষ করতে হয়, যে সত্যিকারের রং সন্ধান করে প্রত্যেকটি আঁকার জন্য তার আকুলতা কেমন করে বুঝবে মূঢ় রাজনীতিক ? ফলে "ও মারা যায় সূর্যাস্তে, তখন সূর্যের রং ঠিক রাজুর আঁকা দেওয়াল লিখন !"




    ॥ ৪ ॥

    ব্যষ্টি ও সমষ্টির ক্ষত যেমন উন্মোচন করেছেন লেখিকা তেমনি স্নিগ্ধতার বিরলস্বাদ থেকেও একেবারে বঞ্চিত করেননি পাঠককে । `গ্রহণ' গল্পে পাই এক পুত্রহারা দম্পতিকে যাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ছোট বাচ্চা আছে এরকম পরিবারকে ভাড়া দেবেন না । তাই ভাড়াটে দীপাঞ্জনের স্ত্রী সাহানা যখন গর্ভবতী হল তখন বাড়ি ছেড়ে দিতে বললেন কর্ত্রী । প্রথমে গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত নিলেও পরে মতবদল করে বাড়ি ছাড়ার মানসিক প্রস্তুতি নিল সাহানা-দীপাঞ্জন । কিন্তু গৃহকর্তা আর কর্ত্রীর মন তখন বাত্সল্যে ভরপুর । মৃত ছেলের জন্মদিনে ভাড়াটে দম্পতির অনাগত সন্তানকে সাদরে গ্রহণের হাত বাড়িয়ে দিলেন তাঁরা ।

    এরকম মনখুশির সমাপ্তি `তারিখ' গল্পেরও । যে মঞ্জুল "একই সঙ্গে গৌরিকার সৌন্দর্য দেখতে দেখতে গর্বিত হল, গর্বিত বোধ করতে করতে হীনন্মন্যতায় প্রবেশ করল, হীনন্মন্যতা কাটতে না কাটতেই ওর ক্রোধ এসে গৈরিকাকে অবুঝ ও আত্মসর্বস্ব প্রতিপন্ন করল সেই মঞ্জুলের পথ-দুর্ঘটনার হাত থেকে বেঁচে ফেরা মাত্র মনে হল "এমন অপূর্ব সুন্দর বিকেল ও আর দেখেনি । "

    অবশ্য সব দিনের পরিণতিই এমন নয় । `এক বিষন্ন সন্ধ্যার ডায়রি' গল্পটিতে আগাগোড়া একধরনের মর্বিডিটি পাঠককে আচ্ছন্ন করে রাখে । পাঠককে বুঝতে হয় "আমার মধ্যে যেন অন্য একটা আমি আছে, তার বিচারবুদ্ধি ইচ্ছে-অনিচ্ছের কোনও সন্ধানই আমি পাই না । আমায় দিয়ে সে যা ইচ্ছে করিয়ে নেয় । পরে নিজেকে নির্বোধ লাগে । অসহায় লাগে ।"

    `বল্কল' গল্পের অতসী বয়সে নবীন হলেও নিজের কাছে বেশ স্পষ্ট । এতটাই যে সহপাঠী অর্কদীপ থমকে দাঁড়িয়ে যায় । অতসী সাবলীল ভাবে তাকে চিঠিতে লেখে -- "কথা দেওয়া যদি যায়, ফিরিয়ে নেওয়া যাবে না কেন ? ..... তাই, আমার কথা আমি ফিরিয়ে নিচ্ছি ।" ফিরিয়ে নেওয়ার পেছনে যুক্তিটিও চমকপ্রদ -- "রূপ নয়, অর্থ নয়, সামাজিক সম্মান নয় -- শুধু একটা ছোট গণ্ডিতে শ্রেষ্ঠত্বের অহঙ্কার । সেও যখন রইল না তখন তোর সমানে সমানে কেমন করে দাঁড়াই !"

    `নি:স্ব মানুষ ও সাদা ঘোড়া', `অমরাবতী ও সেরা পুতুলের গল্প' `চরণ গাঁ, আলতা নদী' -- এই তিনটি গল্পের নির্মাণে একটি মিল রয়েছে । তিনটি গল্পেই রূপকথার আদল । অন্দপে আধুনিক মনুষ্যস্বভাবেরই প্রতীকী উন্মোচন । আবার `স্বপ্ন, শেষ পর্যন্ত' গল্পে আদ্যন্ত রূপকথা-সম্ভব সারল্য কিন্তু যে সারল্য তীব্র আকুতি সংরস হয়ে আমাদের দীর্ঘ গদ্যকবিতা পাঠের আমেজ উপহার দেয় ।




    ॥ ৫ ॥

    তিলোত্তমা মজুমদারের কবিতা আমি আগ্রহের সঙ্গে পড়ি । আরেক মজুমদার -- বাবুশ্রী কমলকুমার -- কবিতা লিখেছেন কিনা জানা নেই আমার । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কমলকুমারের উপন্যাস সমগ্রের ভূমিকায় লিখেছেন -- "যারা কাব্যপাঠে অভ্যস্ত, তারাই এগিয়ে যেতে পারে । এ ঠিক গদ্য নয়, কাব্যের সৌরভ সর্বত্র অথচ চকিতে এক একটি দেশজশব্দ এসে ঘোর ভেঙে দেয় ।"

    এই দুই মজুমদারের ভাষা শৈলীতে মিল শুধু এটুকুই যে লেখার বিষয়বস্তু বাদ দিলে খালি ভাষার সৌন্দর্যের কারণেই বইয়ের পাতা উল্টে যাওয়া যায়; টের পাওয়া যায় ব্রেথ গ্রুপ আর সেন্স গ্রুপ-এর সঙ্গম সঞ্জাত প্রাতিস্বিক সুরসঙ্গতি -- জন ড্রাইডেনের কথায় -- "ঞচ্ছঞ ধঞচ্‌ংশ চ্ছশস্ধত্রষ্‌ ধী ংঋশধযং" । কমলকুমারের ভাষার জাটিল্য মস্তিষ্কনির্ভর তবু ইন্দ্রিয়ঘন । তিলোত্তমার ভাষা ব্যাকরণগত ভাবে অজটিল কিন্তু মর্মন্তুদ যা গল্পের বিষয়বস্তু অনুযায়ী নিয়ত বদলে যেতে থাকে । তার প্রমাণ বিশেষ করে ডোমনি, মেরুদণ্ড, অশিব সন্ন্যাস, ফার্ণ, অবিচ্ছিন্ন, ভোগ, আকাশভরা সূর্যতারা, চন্দ্রাতিগ -- এই আটটি গল্পে ।

    `ডোমনি' গল্পে মগন ডোমের বউ, `মেরুদণ্ডে'র পাগল, `অশিব সন্ন্যাসে'র বালক ভুবন, `অবিচ্ছিন্ন' গল্পের সোনাল হীরা -- এদের সঙ্গে আমি একাত্মবোধ না করলেও এরা আমার মনে দাগ কেটে যায় ! কারণ এসব গল্পে যে অসামান্য আবহ নির্মিত হয়েছে তা ছাপোষা মধ্যবিত্ত বাঙালির বাঁধাধরা জীবন থেকে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে কিন্তু জীবনবিমুখ নয় কখনোই ।

    আবার `ফার্ণ' গল্পের গর্ভবতী বধূ তিয়া `ভোগ' গল্পের নলিনীকান্ত, `চন্দ্রাতিগে'র পড়শী মাসিমা -- এরা মধ্যবিত্তের প্রাত্যহিক জীবনের অংশ কিন্তু ভাষার দার্ঢ্যে চিরন্তন ।

    `আকাশভরা সূর্যতারা' গল্পটিতে রাজনীতি-দীর্ণ সাহিত্যজগতে কীভাবে নিজের লেখক-সত্তাকে ধারাবাহিকতায় উজ্জীবিত রাখতে হয় সেই পথনির্দেশ করেছেন তিলোত্তমা । যারা লেখে না, শুধু পড়ে তাদের ত' ভাল লাগবেই, আর যারা লেখেও তাদের ভাল লাগাটা হবে আরেকটু অন্যরকম ।




    ॥ ৬ ॥

    ১৯৯৬ থেকে ২০০৩ -- এই সময়সীমার মধ্যে লেখা চব্বিশটি ছোটগল্প (বইয়ের সংক্ষিপ্ত পরিচয় অংশে পঁচিশটি ছোটগল্পের উল্লেখ সম্ভবত হিসেবের ভুল), চারটি বড়গল্প এবং একটি উপন্যাসোপম গদ্যকাহিনিতে ঋদ্ধ এই আনন্দ-সংকলন পড়তে পড়তে কামধেনু তন্ত্রের একটি অংশ মনে পড়ছে -- মনে পড়ছে এই কারণেও যে এ বইয়ের নাম আর আমার নামের আদ্যক্ষরে অভেদ --

    ঋকারং পরমেশানি কুণ্ডলী মূর্তিমান্‌ স্বয়ং
    অত্র ব্রহ্ম চ বিষ্ণুশ্চ রুদ্রশ্চৈব রবাননে
    সদাশিব যুতং বর্ণং সদা ঈশ্বর সংযুতং
    পঞ্চবর্ণময়ং বর্ণং চতুর্জ্ঞানাময়ং তথা
    রক্তবিদ্যুল্লতাকারং ঋকারং প্রণমাম্যহং

    অভিধানে পাই ঋ শব্দের অর্থ স্বর্গ, ঋ শব্দের অর্থ নিন্দা, ঋ শব্দের অর্থ হাস্য-পরিহাস, এমনকি ঋ শব্দের অর্থ বাক্য এবং প্রাপ্তি-ও ।

    একটি ধ্বনি বা শব্দ স্বতন্ত্রভাবে বিচার করলে তার বহুবিধ অর্থের জন্য অভিধানের দ্বারস্থ হই আমরা, কিন্তু ব্যঞ্জনা বলি যাকে তার সন্ধান মেলে একমাত্র সৎ সাহিত্যেই । আগামীদিনে তিলোত্তমা মজুমদারের লেখনীতে সেই সত্সাহিত্যের, সেই অধুনা বিরল ধ্রুপদী ঘরানার ধারাবাহিকতার প্রত্যাশায় উন্মুখ হয়ে রইলুম ।

    (পরবাস, মে, ২০০৫)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments