বাংলাভাষায় আত্মজীবনীর সংখ্যা নেহাত কম নয় । আত্মজীবনীর শর্ত মেনেই হয়ত বেশিরভাগ বইতেই থাকে ব্যক্তি প্রাধান্য, `আমি'-র গল্প, পারিপার্শ্বিক, চাটুকার ও নিন্দুকের আলোচনা, কিছু রসাল কেচ্ছা আর তার সঙ্গে আরও কিছু বিখ্যাত ব্যক্তির আনাগোনা । এই আত্মজীবনীটিতে `তথাকথিত' এইসব বৈশিষ্ট্যগুলির অনেক কিছুই গরহাজির । আর ঠিক এই কারণেই বইটি অসাধারণ, কাহিনিও তার ব্যতিক্রমী । পড়তে পড়তে বোঝাই যায় না কখন `আমার' গল্প হয়ে উঠেছে `আমাদের' কথা ।
বইটির প্রকাশ-কাহিনি একটু বিচিত্র । প্রথমে বইটি ফরাসিভাষায় প্রকাশিত হয় ১৯৯৭-সালে
বইটি তাহলে কি জন্য ব্যতিক্রমী ? এতে কিন্তু কোন তত্ত্বের কচকচি বা জটিল অর্থনৈতিক সূত্রের বিশ্লেষণ নেই, তবে হ্যাঁ বইটি জুড়েই যেন রয়ে গেছে এক দিক-বদলের আভাস । লেখক মানুষের সীমাহীন সৃজনশীলতার প্রতি বারে বারে আস্থা জ্ঞাপন করেছেন । তাঁর লক্ষ্য, স্বপ্ন ও বিশ্বাস আবর্তিত হয়েছে এক দারিদ্র্যমুক্ত পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য । তিনি বিশ্বাস করে আসছেন এমনটা সম্ভব বলে, বিশ্বাস করেন যে মানুষ শুধুমাত্র ক্ষুধার জ্বালা ও দারিদ্য্র সহ্য করার জন্য জন্মায়নি । মানুষকে দরিদ্র করে রাখা হয় । তাঁর মতে আমরাই এই বিশ্বের চালক ও দিকনির্দেশক । তাই আমরা যদি চাই পৃথিবীকে দারিদ্র্যমুক্ত করতেই পারি । তবে সেটা সম্ভব সমবেত প্রচেষ্টায় । এক প্রচেষ্টার শুরু তিনি করেছেন `ক্ষুদ্রঋণ' ও `গ্রামীণ ব্যাঙ্ক' প্রকল্পের মাধ্যমে । একে এগিয়ে নিয়ে যাবার দায়িত্ব আমাদের । তাই এই বইটি যেন সেই দারিদ্র্য-বিরোধী সংগ্রামের এক মূল্যবান দলিল হয়ে উঠেছে ।
আমরা অনেকেই ক্ষুদ্রঋণ ও গ্রামীণ ব্যাঙ্ক নিয়ে কিছু না কিছু শুনে এসেছি । আমরা শুনেছি গ্রামীণ ব্যাঙ্কের প্রসারের কথা, সারা পৃথিবীব্যাপী তার গ্রহণযোগ্যতা এবং একটা রোল মডেলের স্থান অধিকার করার কথা । এই সব শোনার পর আমার মতো অনেকেই হয়ত উত্সাহী হয়ে উঠবেন ড: ইউনূসের প্রথম কাজ শুরুর অভিজ্ঞতার কথা জানতে, সেই দীর্ঘ পথ কি করে তিনি অতিক্রম করলেন সব বাধা এড়িয়ে - সেই উপলব্ধির কথা জানতে । এই বইটিতে সেইসব বর্ণিত হয়েছে এক অদ্ভূত সাবলীলতায় ।
প্রায় ৩০০ পাতার বইটি সাতটি পর্বে বিভক্ত এবং এর সাথে আছে নানা
তথ্যসমৃদ্ধ পরিশিষ্ট । প্রথম পর্বে আছে তাঁর শৈশব, কৈশোর ও ছাত্রজীবনের কথা, কথা প্রসঙ্গে চলে এসেছে তাঁর বিবাহ ও মুক্তিযুদ্ধের কাহিনি । দ্বিতীয় পর্বের নাম দেওয়া হয়েছে `পরীক্ষামূলক' অধ্যায়, এবং তৃতীয় পর্বে বলা হয়েছে কেমন ভাবে সেই পরীক্ষামূলক প্রকল্প ত্রক্রমশ ব্যাংকের রূপ নিল ।
এই ফাঁকে ড: ইউনূসের জীবনীটা সংক্ষিপ্তভাবে বলে নেওয়া থাক । তাঁর জন্ম ১৯৪০ সালে চট্টগ্রামের বাণিজ্যিক এলাকা বক্সিরহাট রোডে । তাঁর বাবা পেশায় ছিলেন স্বর্ণকার । তিনি ছিলেন বিশাল পরিবারের সন্তান । তাঁর পিতামাতার ১৪টি সন্তান জন্মেছিল যার মধ্যে পাঁচটি শৈশবেই মারা যায় । সেই ৯ জন ভাই বোনের মধ্যে থেকেই তিনি মানুষ হয়েছেন । ইউনূসের যখন নয় বছর বয়স তখনই তাঁর মা মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন । এই সবই খুব ছোট্ট পরিসরের মধ্যে বর্ণনা করেছেন । লক্ষ করলে দেখা যায় যে মাত্র ১০ পাতার ভিতরেই তিনি শৈশব থেকে চলে এসেছেন সরাসরি কর্মক্ষেত্র ও আমেরিকায় ক্যাম্পাসের দিনগুলিতে । এটাই কিন্তু এই বইটির বৈশিষ্ট্য । যেমন আগেও বলেছি - সেই `আমি'কে যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত রেখে `আমাদের' কথায় চলে আসা । এরপর ১৯৬১ সালে ২১ বছর বয়সে, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক হবার পর চট্টগ্রাম কলেজে অধ্যাপনার সুযোগ পান । ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত সেখানে অধ্যাপনা করার পর, ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে তিনি পি. এইচ. ডি করতে যান আমেরিকার টেনেসিতে ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে । সেখানেই তাঁর প্রেম ভিরা ফোরোস্টেনকোর সাথে এবং বিবাহ ১৯৭০ সালে । এরপর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ পেল স্বাধীনতা । দেশকে নতুন করে গঠন করার কাজে ব্রতী হবার জন্য ১৯৭২ সালে ফিরে এলেন বাংলাদেশে । ভিরার সাথে বিবাহবিচ্ছেদ ১৯৭৭ সালে তাঁর প্রথম সন্তান মনিকার জন্মের পর । ১৯৮০ সালে তিনি দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন আফরোজীকে যিনি পেশায় ছিলেন শিক্ষক এবং পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে রিসার্চ করছিলেন । এঁদের আদরের সন্তানের নাম দীনা ।
কোন ঘটনা তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিল `গ্রামীণ ব্যাঙ্ক' প্রতিষ্ঠা করতে ? এই বইটির মূল ইংরেজি সংস্করণের গ্রন্থ সমালোচনা বেরিয়েছে অনেক বিখ্যাত বিদেশী পত্র-পত্রিকাতে । সেই সুফিয়া বেগমের কথা প্রায় সব আলোচনাতেই আছে । সুফিয়া বেগম জোবরা গ্রামের একজন দরিদ্র মহিলা । তিনি মাত্র পাঁচটাকার অভাবে পাইকারের কাছ থেকে ধার করতে বাধ্য হন । আর সেই ধার করার জন্য পূর্ব চুক্তি অনুযায়ী অনেক কম দামে তাঁর তৈরি মোড়া বিক্রি করতে বাধ্য হন । এই ঘটনা হয়ত বিদেশী পাঠকদের অলোড়িত করবে, কিন্তু আমরা যাঁরা গ্রাম বাংলার মানুষ তাদের কাছে এটা কোন বিচ্ছিন্ন বা নতুন ঘটনা নয় । আমরা দেখে আসছি অনেকদিন ধরেই এই শোষণ, এই ধার করার পদ্ধতি । আমরা এটা স্বত:স্বিদ্ধ বলে ধরে নিয়েছিলাম - কিন্তু ইউনূস সেটা নেননি । তিনি ভাবতে বসেছিলেন কেন এই অবর্ণনীয় দারিদ্র্য ? সত্যই কি মুক্তি নেই এর থেকে ? তিনি অনুভব করেছিলেন যে অর্থনৈতিক তত্ত্ব আর বাস্তবের মধ্যে কোথাও একটা ফাঁক থেকে গেছে । ওইসব তত্ত্ব সব সমস্যারই সহজ সমাধান করে দেয় ! তাহলে অর্থনীতির এইসব তত্ত্বে কঠোর বাস্তবের প্রতিফলন কোথায় ? তিনি পাঠ্যপুস্তক, গুরুগম্ভীর তত্ত্ব থেকে মুক্তি চেয়ে বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়াতে চেয়েছিলেন জোবরা গ্রাম থেকে । তিনি অনুভব করেছেন যে দারিদ্র্যের ইতিহাসও পৃথিবীর ইতিহাসের মত প্রাচীন । আমরা সবাই বড় হই অগণিত গরিবের মাঝে - কিন্তু কখনও প্রশ্ন করি না কেন তারা গরিব ? ইউনূস প্রশ্ন করেছেন নিজেকে, বিশ্বজুড়ে হাজার হাজার বুদ্ধিদীপ্ত অর্থনীতির অধ্যাপকেরা কেন চেষ্টা করেননি গরিবদের বুঝতে ? সত্যই যাদের সাহায্যের দরকার তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে কেউ দেননি কেন ?
সেই প্রকৃত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেই উদভব `গ্রামীণ ব্যাঙ্কের' । তাহলে গ্রামীণ ব্যাঙ্ক কি ? এককথায় এক অন্যধারার ব্যাংকিং । বিশ্বজোড়া প্রচলিত ব্যাংকিং-এর মূল নীতিই হচ্ছে যার যত বেশি আছে তাকে তত দাও । অর্থাৎ ধার পেতে হলে জামানত দাও । কিন্তু যাদের জামানত রাখার ক্ষমতা নেই ? প্রচলিত ব্যাংকিং সিস্টেমে তাদের ঋণ নেবার কোন অধিকার নেই । এখানেই গ্রামীণ ব্যাংকের স্বকীয়তা । গ্রামীণ ব্যাংকে ঋণ নিতে হলে কোন জামানত দিতে হয় না । এখানে ধার দেওয়া হয় পারস্পরিক বিশ্বাস আর দ্বায়িত্ববোধের উপর ভিত্তি করে । এর সাথে যুক্ত হয় দলগত প্রচেষ্টা ও মানুষের সৃজনশীলতা । গ্রামীণ ব্যাংক ঋণদানের ক্ষেত্রে মহিলাদের অগ্রাধিকার দেয় ।
"আমরা যদি এমন একটা ব্যবস্থা তৈরী করতে পারি যাতে করে সবাই ঋণ নিতে পারবে, এবং সাথে সাথে সেই ঋণ যাতে পরিশোধ হয় তা নিশ্চিত করতে পারি - তাহলে আমার বিশ্বাস যে এই পৃথিবীতে দারিদ্র্য থাকবে না ।" -- এটা ইউনূসের বিশ্বাস । আপনি হয়ত বিশ্বাস করবেন না কিন্তু বইটি জুড়ে অসংখ্য উদাহরণ পড়ে আপনার মনেও বিশ্বাস জন্মাবে যে, এমনটা সম্ভব !
গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যপ্রণালী অত্যন্ত সরল । ঋণশোধের নিয়মাবলী -
-- এক বছরের জন্য ঋণ ।
১) শৃঙ্খলা, একতা, সাহস ও পরিশ্রম -- গ্রামীণ ব্যাংকের এই চার নীতি
কেন্দ্রের সদস্যের মাধ্যমে জীবনের প্রতিটি কাজে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলব ।
যাঁরা আরও বিশদ জানতে আগ্রহী তাঁরা
-- সমান অংকের সাপ্তাহিক কিস্তি ।
-- ঋণদানের এক সপ্তাহ পরেই ঋণশোধের প্রথম কিস্তি শুরু হয় ।
-- ১০০০ টাকা ঋণ নিয়ে একবছরে পরিশোধ করে দিলে মোট দিতে হয় ১১০০ টাকা অর্থাৎ অতিরিক্ত মাত্র ১০০ টাকা ।
-- ঋণশোধের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে দুই শতাংশ হারে ৫০ সপ্তাহ ।
-- এক হাজার টাকা ঋণের জন্য প্রতি সপ্তাহে ২ টাকা করে সুদ দিতে হবে ।
গ্রামীণ ব্যাংকের মূল লক্ষ্য যেহেতু যথাসম্ভব দারিদ্য্র দূরীকরণ, তাই এর গ্রাহকদের মধ্যে গড়ে তোলা হয়েছে একটা সামাজিক যোগ । এদের ষোলটি সিদ্ধান্তের মধ্যে নিহিত আছে সদস্যদের জীবনের অর্থ ও উদ্দেশ্য । অভিজ্ঞতা বলেছে যে এই সব সিদ্ধান্ত গ্রামীণ ব্যাংকে গ্রাহকদের জীবনের আরো কাছাকাছি এনেছে । ষোলটি সিদ্ধান্তের কয়েকটি হল -
২) আমরা সংসারের উন্নতি আনবই ।
৩) নিজে অন্যায় করব না, অন্যকেও অন্যায় করতে দেব না ।
৪) একে অন্যের সাহায্য করব ।
ইত্যাদি ।
আজ গ্রামীণ ব্যাংক পৃথিবীর অসংখ্য দেশের কাছে রোল মডেল বলে বিবেচিত হয়েছে । জুলাই ২০০৪ সালের তথ্য অনুযায়ী এর গ্রাহক সংখ্যা ৩.৭ মিলিয়ন, যার মধ্যে ৯৬ শতাংশ মহিলা । প্রায় ১২৬৭ শাখার মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংক ৪৬,০০০ গ্রামে পরিষেবা পৌঁছে দিয়েছে এবং বাংলাদেশের প্রায় ৬৮% গ্রামে এরা ছড়িয়ে পড়েছে । গ্রামীণ ব্যাংক ২০০৫ সালে ১০ কোটি গরিব মানুষের কাছে পৌঁছবার আস্থা রাখে ।