একটা বড়সড় হাই তুলল প্রবীর । ওর ডিউটি ছিল দুটো পর্যন্ত । এখন ডিউটি বেচুর - ওর পোষাকি নাম গৌতম । এই ফ্ল্যাটবাড়িটা পুরো শেষ হয়ে গিয়েছে । চারপাশে উঁচু পাঁচিল । দুটো গেট - একটায় তালা লাগানো, অন্যটায় চৌকিদার বসে থাকে । তবে লোক এখনও খুব বেশি আসেনি । অর্ধেক এখনও খালি, যদিও ফ্ল্যাটগুলো বিক্রি হয়ে গিয়েছে অনেকদিন আগেই । এ বাড়িটা শেষ হবার পর এই চৌকিদারির চাকরিটা পেয়েছে প্রবীর । সহজে হয়নি । এখানকার নেতা নেপালদার দরজায় ধন্না দিয়েছিল । নেপালদা পাঁচ হাজার টাকা নিয়েছে - তারপর বিল্ডারকে ফোন করে দিয়েছে । টাকাটা চড়া সুদে ধার করেছিল প্রবীর । সুদ সমেত সেই টাকার কিস্তি এখন ওকে মাস মাইনের থেকে শোধ দিতে হচ্ছে ।
তবে প্রবীরের উপরি কিছু রোজকার আছে । এই বাড়ির বিভিন্ন বাসিন্দার ফাই ফরমাস খেটে কিছু কিছু করে টাকা বকশিস পায় । ওর সবচেয়ে বেশি রোজগার দোতলার পেছনদিককার কোনের ফ্ল্যাটটার থেকে । একটি সুন্দরী থাকেন সেখানে । অভিনয় টভিনয় করেন - যখন বাড়িতে থাকেন লোকজন আসে তার ফ্ল্যাটে । প্রবীরকে খাবার দাবার কিনে এনে দিতে হয় । কোল্ড ড্রিংকস আনতে হয় - মাঝে মাঝে হার্ড ড্রিংক্স । এই ফ্ল্যাট বাড়ির সামনের রাস্তাটা একটু একটেরে, নির্জন - দোকান টোকান সব আছে পাঁচ মিনিট হাঁটলে জমজমাট বড় রাস্তা - সেখানে । দরাজ বকশিস পায় প্রবীর । যারা ওই মহিলার কাছে আসে তারাও পাঁচ দশটা টাকা দিয়েই যায় । জননেতা, ব্যবসাদার, পুলিশের লোক - সবাই আসে । একজন পুলিশ অফিসার ঘন ঘন আসে । লম্বা, মোটা, কালো ধূমসো চেহারা, চোখ দুটো লালচে । লোকটা পাশ দিয়ে যাবার সময় তেজালো মদের গন্ধ পায় প্রবীর । লোকটা বোধহয় বেশ উঁচুপদে কাজ করে - ওর জন্যে গাড়ি অপেক্ষা করে থাকে । সরকারি গাড়ি আর তার সরকারি ড্রাইভার - সেটা প্রবীর ঐ ড্রাইভারের সঙ্গে গল্প করে জেনে নিয়েছে ।
একটু দূরে রাস্তায় বেচুকে দেখতে পেল প্রবীর, ঠাঠা রোদ, সেই রোদের ভেতর তাড়াতাড়ি করে হেঁটে আসছে । ওর ডান হাতে একটা নাইলনের বাজারের ব্যাগ - প্রবীর জানে তার ভেতরে একটা টিফিন কেরিয়ার আর এক লিটারের একটা প্ল্যাস্টিকের বোতলে বাড়ি থেকে আনা জল । বেচু অনেক দূরে থাকে । দুটো বাস বদল করে আসতে প্রায় দু ঘন্টা লেগে যায় ওর । ও নাকি বি কম পাশ । নির্ভেজাল বোকা - নাকটা ভোঁতা, দাঁতগুলো উঁচু । কিন্তু ওর একটা মা আছে । সেই মায়ের একটা বাড়ি আছে - তার কয়েকটা ঘরে ভাড়াটে বসানো আছে । সাতশো-আটশো টাকা করে এক এক ঘর ভাড়াটে মাসে ভাড়া দেয় । বাড়ির লাগোয়া জমিতে নারকেল গাছ রয়েছে - সেই নারকেল বেচেও আয় হয় । সেই মা ওকে এখনও আহ্লাদ দেয় - রোজ ওর দুপুরের খাবার বানিয়ে টিফিন কেরিয়ারে সাজিয়ে দেয় । হাতরুটি, ঘুগনী, মোচার তরকারি, এঁচোড়ের সময় এঁচোড়, বেগুনি বা আলুর চপ । প্রবীর জানে তার কারণ প্রায় রোজই বেচুর খাবারের খানিকটা ওর পেটে যায় । বেচু ওকে একটু ভয় পায় । ও যে প্রায়ই দেরি করে আসে সেটা প্রবীর নালিশ করলে ওর চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়বে ।
সদরের গেট দিয়ে বেচু ঢোকে । দেরি হয়ে যাবার জন্যে প্রবীরের দিকে তাকিয়ে বোকার মত হাসে । প্রবীর হাসে না - ওর দিকে একবার তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে গম্ভীরভাবে বসে থাকে । ও জানে বেচু এখন পরপর কি করবে । প্রথমে ওদের চৌকিদারদের ঘরে গিয়ে হাতব্যাগটা রাখবে । একতলায় যেখানে ফ্ল্যাটগুলোর মালিকদের গাড়ি রাখার জায়গা সেখানে একটা বাথরুম আছে - এ বাড়ির চৌকিদার, গাড়ির ড্রাইভার - সকলের ব্যবহারের জন্যে । সেখানে গিয়ে মুখ হাত ধুয়ে ফেলবে । তারপর চলে আসবে চৌকিদারদের ঘরে - এখানকার সকলের ভাষায় যার নাম গার্ডরুম । ছোট্ট ঘরটায় একটা টেলিফোন রয়েছে । সকলেই তা ব্যবহার করতে পারে - ফোনপিছু দুটাকা করে দিতে হয় । বেচু ওর মাকে ফোন করবে - মা আমি পৌঁছে গেছি - হ্যাঁ, এবারে খাবারটা খেয়ে নেব । ফোন করা হয়ে গেলে একটা খাতায় তারিখ দিয়ে লিখে রাখবে - মাসের শেষে এইসব ফোনের টাকা ওর মাইনে থেকে কেটে নেওয়া হবে । তারপর ও টিফিন কেরিয়ার খুলবে । প্রবীরকে ডেকে বলবে, ও পোবীরদা - একটুখানি খাবে নাকি ? বেচু পয়ে রফলা উচ্চারণ করতে পারে না । প্রবীরকে বলে পোবীর, প্রচুরকে বলে পোচুর ।
আজও এই নিয়মে ব্যাতিক্রম হোল না । প্রবীর মোচার ঘন্ট দিয়ে রুটি খায় - তারিয়ে তারিয়ে খাবারের স্বাদটা উপভোগ করে । এ সময় বেচুর ওপর ও একটু খুশি হয়ে ওঠে । দুপুরে বেচুর ডিউটি থাকলে খাওয়াটা ওর ঘাড় দিয়েই হয়ে যায় । রাতে ওর ডিউটি থাকলে রাতের খাওয়াটাও । বেচুর ডিউটি সকালে পড়লে একটু অসুবিধে । কোনদিন দুপুরে মুড়ি চিবিয়ে কাটিয়ে দেয় - কোনদিন বড় রাস্তায় যায় । সেখানে রাস্তার ধারের একটা চালায় রুটি আর বিস্বাদ সব্জী বিক্রি হয় । তাই খায় । বেচুর খাবারের স্বাদ আলাদা - ওর মা যত্ন করে ছেলের জন্যে রেঁধে দেয় তো । প্রবীরের ওসব মা বাপের পাট ঢুকেছে অনেক বছর আগে । একেবারে ছোটবেলায় মা মারা গেছে । বাপটা পাঁড় মাতাল ছিল । প্রবীর সবে প্রাইমারি স্কুল ছাড়িয়েছে - তখন মারা গেল । তারপর অনেক ঘাটের জল খেয়েছে প্রবীর । ও কোন ঘর টর ভাড়া নেয়নি - ওসবে অনেক খরচা । রাতে এখানেই শুয়ে থাকে ।
খাওয়া শেষ করে আঙুল চাটছিল প্রবীর । বেচু গেছে টিফিন কেরিয়ারটা ধুয়ে ফেলতে । ফ্ল্যাটবাড়িটার সিঁড়ি বেয়ে মেয়েটা নেমে এল । বয়েস এই চোদ্দ-পনেরো । প্রবীর আড়চোখ ওকে একবার দেখে নিয়ে হাতের ঘড়ি দেখল । ঠিক তিনটে । মেয়েটা এবাড়ির চার-পাঁচটা ফ্ল্যাটে কাজ করে । তিনটে নাগাদ বেরিয়ে বাড়ি যায় । ও কোথায় থাকে প্রবীর জানে । আর কোন রাস্তা ধরে ও ঘরে ফিরবে সেটাও ।
সে প্রায় মাসখানেক আগেকার কথা । প্রবীর সন্ধেবেলায় রেণুমাসির ডেরায় একটা কাঠের বেঞ্চে বসেছিল । বেঞ্চটা লম্বা একটা বারান্দায় রাখা রয়েছে । বারান্দার একধারে সার দিয়ে গোটা পাঁচেক খুপরি খুপরি ঘর । আর একেবারে এক কোণে কল-পায়খানা । সেখান থেকে মাঝে মাঝে দমকা দুর্গন্ধ আসছে । ঘরগুলোর বাইরের দেয়ালের চূনকাম এখন নোংরা, কালচে - মাঝে মাঝে পানের পিকের ছোপ লেগে রয়েছে । প্রবীরের পাশে আরও একটা লোক বসে আছে । প্রবীরের সামনে চাঁপার ঘর - তার দরজা এখন বন্ধ । অন্য ঘরগুলোর দরজাও তাই । প্রবীর আর তার পাশে বসা সঙ্গী - দুজনেই চাঁপার খদ্দের । প্রবীর চাঁপার ঘরের রঙ চটা দরজার দিকে তাকিয়ে ভাবছিল । আজ শনিবার - সেটা খেয়াল হয়নি । শনি রবিবার, আর ছুটির দিনে এ জায়গায় খুব ভিড় হয় । প্রবীর যখন এল তখন চাঁপা সবে এক মক্কেলকে ঘরে ঢুকিয়েছে । তারপর লাইনে আছে প্রবীরের পাশের লোকটা । তারও পরে প্রবীরের পালা । ঘরগুলোর ভেতরে হাসি, চিত্কারের আওয়াজ ! চাঁপার ঘরে হিন্দি ফিল্মি গানের ক্যাসেট চলছে - চাঁপা বোধহয় এখন বাবুকে নাচ দেখাচ্ছে । নাচ ফাচ কিছু না হলেই চাঁপা ঘন্টায় কম করে পাঁচশো নেয় - আর নাচ দেখালে মিটার বাড়ে । মনে হয় ভেতরের লোকটা মালদার পার্টি । প্রবীর মনে মনে চাঁপার ঘরের ভেতরটা ভেবে নেয় । মেয়েটার গায়ে জামা কাপড় কিছু নেই - ধেই ধেই করে নাচছে আর আধাবয়েসী বাবু ওকে দুচোখ দিয়ে গিলছে । প্রবীরের শরীরটা গরম গরম লাগে । ও হাতের ঘড়ি দেখে । প্রায় সাতটা । সাড়ে আটটা-নটার আগে চাঁপার ঘরে ঢোকা যাবে না । মেয়েটার ঘরের দরজার ঠিক ওপরে একটা ময়লা ভূষি-পড়া চল্লিশ পাওয়ারের বাতি নিতান্ত অনিচ্ছায় টিম টিম করে জ্বলছে ।
বারান্দায় ভারি পায়ের শব্দ । প্রবীর ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল । রেণু আসছে । প্রবীরকে দেখে মুখে একগাল হাসি মেখে ওর দিকেই এগিয়ে আসছে । রেণুবালা প্রকাণ্ড মোটা, লম্বা কালো রঙের বাজখাঁই চেহারার মেয়েমানুষ । ও এই পাঁচটা ঘরের মালিক । বাড়িটার এই বারান্দা ঘুরে আর একটা লম্বা বারান্দা - সেদিকে ও ওর কয়েকটা ঘর আছে । প্রত্যেকটা ঘরে ও একটা করে মেয়ে পোষে । চাঁপা, মিনতি - আরও কে কে সব । প্রবীর প্রথম দিন এসে চাঁপার ঘরে গিয়েছিল । তারপরের থেকে ওর ঘরেই যায় । একজনের কাছে যাওয়ার কিছু সুবিধে আছে । চাঁপা ওর জন্যে রেটটা কম করে দেয় - পাঁচশোর বদলে তিনশো । মেজাজ খুশ থাকলে কখনো কখনো দুশো । তা নাহলে এখানে মাঝে মাঝেই আসবার মুরোদ হোত না প্রবীরের । কিন্তু রেট ঠিক এক ঘন্টার জন্যে । পাঁচ মিনিট বেশি হয়ে গেলেও আরও তিনশো টাকা । আরে বাবা এসব কাজ কি আর ঘড়ি ধরে হয় ? কিন্তু চাঁপা কিছুতেই ছাড়ে না - ঠিক আদায় করে নেয় ।
রেণু এসে প্রবীরের পাশে বসল । প্রকাণ্ড মুখ, ভাঁটার মতো গোল দুই চোখ, মোটা মোটা দুই হাতে থলথল করছে চর্বি । নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে প্রবীরের মুখ মুছিয়ে দেয় রেণু । প্রবীরকে ও একটু ভাল চোখে দেখে । মাসের মধ্যে দু-তিনবার তো এখানে আসে প্রবীর । একটু বোস্ - রেণু বলল । আজ চাঁপির দরজায় লম্বা লাইন আছে । তারপর প্রবীরের কানের কাছে মুখ এগিয়ে নিয়ে এল - ওর মুখে পচা মাছ, জর্দা পান আর বাংলা মদের মেশানো গন্ধ - আস্তে আস্তে বলল, ততক্ষণ একটু মাল খাবি নাকি ?
খটাস করে চাঁপার ঘরের দরজার ছিটকিনি খুলল । ঘর থেকে বেরোল একটা ধুমসো কালো ঠোঁট মোটা মারে.ংআয়াড়ী, দামি সাফারি স্যুট পরা । কোনদিকে না তাকিয়ে বারান্দায় জুতোর আওয়াজ তুলে হেঁটে চলে গেল । ওর পেছনেই বেরোল চাঁপা - নেশা করেছে খুব - চোখদুটো লালচে আর ছোট হয়ে আছে । প্রবীরকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এসে ওর গাল টিপে দিল । বলল, কখন এলি ? দেখিনি তো ? যাক্, আর একটু বোস, তারপরেই তোকে নিয়ে বিছানায় উঠব ।
প্রবীরের পাশে বসা লোকটা ততক্ষণে দাঁড়িয়ে উঠেছে - ঘরে ঢুকবে বলে । একটু দাঁড়াও গো চাঁদমানিক - চাঁপা মুচকি হেসে ওকে বলল । তলপেট ভারি হয়ে গেছে, একটু জল ছেড়ে আসি । বলে চলে গেল বারান্দার কোণের কলঘরের দিকে । রেণু হাসে । বলে, মেয়েটা খুব জোর ছেনাল । ততক্ষনে চাঁপা কলঘরে ঢুকে গেছে - বেরিয়েও এল খুব তাড়াতাড়ি - ও দরজা খুলে বেরোবার সময় ওখান থেকে ভেসে এল এক ঝাপ্টা পূতিগন্ধ - ফিরে এসে চাঁপা লোকটার হাত ধরল । বলল, এস, ঘরে এস । আজ কিন্তু হাজার টাকা লাগবে - হ্যাঁ । প্রবীরেরে সামনে আবার বন্ধ হয়ে গেল চাঁপার ঘরের দরজা ।
রেণুর চাকর মদের বোতল আর গেলাস রেখে গেল । ছোকরা ছেলে - বয়েস এখনও কুড়িতে পৌঁছয়নি । আর ক-বছর পরেই রাস্তায় বেরিয়ে চাঁপাদের জন্যে খদ্দের ধরে আনবে । প্রবীর রেণুকে বলল, মাসি, আজ মদের দাম আমি দেব ।
খুশি হয়ে হাসল রেণু । হাসলে ওর সব কটা দাঁত বেরিয়ে পড়ে - দুই ঠোঁটের কোন প্রায় কান পর্যন্ত পৌঁছে যায় । প্রবীরের গালে ঠোঁট চেপে ধরে চুক করে আওয়াজ করে বলল, লক্ষ্মী ছেলে, সোনা ছেলে । তারপর গেলাসের পর গেলাস মাল খেয়ে টং হয়ে গেল ।
তখনই রেণু বলেছিল প্রবীরকে । কচি বয়েসের মেয়ে চাই । এই চোদ্দ, পনেরো, ষোল বছরের মধ্যে । এক এক জনের জন্যে বিশ হাজার করে টাকা দেবে নগদ । প্রবীর আন্দাজ করে নেয় তাদের নিয়ে কি করে রেণু । দু-এক জনকে নিজে রাখবে । বেশির ভাগই চড়া দামে বেচে দেবে দালালদের কাছে । মেয়েগুলো পাচার হয়ে যাবে দেশের বিভিন্ন জায়গায় - দেশের বাইরে । সেখানে আরও বেশি দামে বিক্রি হবে ওরা ।
তারপর একটা মতলব খেলে গেছে প্রবীরের মাথায় । ওদের ফ্ল্যাটবাড়িতে যে অল্পবয়েসী মেয়েটা কাজ করে তার সব খবর নিয়েছে । ওর নাম মেনকা । মা, ভাই বোন কেউ নেই । বুড়ো একটা বাপ আছে - বাতে প্রায় পঙ্গু । ওর রোজগারে বাপটা খায়, ঘরভাড়া দেয় । ওর ঘর খুব বেশি দূরে নয় - হেঁটে আধঘন্টা । দূরত্ব আরও কম করার জন্যে মেয়েটা পাশের যে বাড়িটা উঠছে তার ভেতর দিয়ে যাতায়াত করে । রাস্তা দিয়ে ঘুরে যায় না । ঐ বাড়িটার পেছন দিকে ডাঁই হয়ে পড়ে আছে ইঁট, পাথরের কুচি, বালি এসব । সেদিকে এখন কোন লোকের যাতায়াত নেই । মেয়েটা তার ভেতর দিয়েই যায় - পেছনের রাস্তাটায় গিয়ে পড়ে । এভাবে মিনিট পাঁচেকের হাঁটা রাস্তা কমায় ।
টিফিন কেরিয়ার ধুয়ে ফিরে এসে বেচু আবার সেটা যত্ন করে ওর থলেতে ভরে রাখছিল । প্রবীর বলল - ঐ যে মেয়েটা বেরিয়ে গেল, ও প্রেম করে । জানিস নাকি ?
বেচু মুখ তুলে প্রবীরের দিকে তাকাল । বলল, কোথায় ? কার সঙ্গে ?
কথাটা একেবারে মিথ্যে নয় । ঐ ছেলেটার সঙ্গে মেনকার চোখে চোখে ইশারা ইঙ্গিত, হাসাহাসি চলত । প্রবীর বেশ কয়েকবার দেখেছে । একদিন মাথার পেছনে দু হাত দিয়ে ছেলেটা নাচের মত অঙ্গভঙ্গি করছিল । মেনকা হাসতে হাসতে ওর পাশ দিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছিল । প্রবীরের চোখে পড়েছিল ঘটনাটা ।
বেচুর চোখ চকচক করে উঠল । হ্যাঁ হ্যাঁ দেখেছি তো । কিন্তু এখন তো ঐ মিস্তিরিরা এখানে নেই ।
তাতে কি হয়েছে । কাছাকাছি কত ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরি হচ্ছে - কোথাও না কোথাও কাজ করছে ওরা । ওই দুটোর মধ্যে আশনাই চলছে ঠিকই ।
প্রবীরের বেচুকে এ কথা বলার কারণ আছে । মেয়েটা উধাও হয়ে গেলে একটা সোরগোল উঠবেই । তখন দোষ চাপাতে হবে ঐ ছেলেটার ঘাড়ে । বলতে হবে ঐ ছেলেটাই মেনকাকে হাপিস করে দিয়েছে । ওই ছেলেটা আর মেনকার মধ্যে ভাবসাব আছে এটা যত বেশি লোক জানবে ততই ভাল । আসছে সোমবার কাজটা করা হবে বলে ঠিক হয়েছে । যতদিন বেচুর দুপুরে ডিউটি ততদিন কাজটা করা যাবে না । কারণ বেচু দেরি করে আসে । যেদিন কাজ হবে সেদিন দুটোর মধ্যে প্রবীরের ছুটি হতেই হবে । সোমবার থেকে দুপুরে ডিউটি রামেশ্বর প্রসাদের । ও কখনো দেরি করে না । একটার মধ্যে এসে যায় । রামেশ্বরের বয়েস হয়েছে । বিহারে ওর কিছু জমিজমা আছে, তাতে ফসল-টসল হয় । কলকাতায় থেকে দারোয়ানি করে নগদ টাকার জন্যে । দেশে ওর সাবেক বৌ আছে - ছেলে, ছেলের বৌ, নাতি, নাতনি, সব আছে । এখানে ও একটা মেয়েমানুষ রাখা আছে - সেই মেয়েমানুষের পেটের একটা ছেলেও আছে । সে-ছেলে এখন লায়েক হয়েছে - কলকাতার রাস্তায় ট্যাক্সি চালায় । কয়েকটা ছোটখাট দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে - তাতে করে মাঝে মাঝে হাজতে থেকেছে । রামেশ্বর অন্য লোকের কেচ্ছা করতে খুব ভালবাসে । ঐ দোতলার ফ্ল্যাটের সুন্দরীর অনেক কাহিনী প্রবীরকে শোনায় । মেনকার সঙ্গে ওই রাজমিস্ত্রী ছেলেটার হাসিঠাট্টার কথাও বলেছে - বিশেষ করে যখন ওই মিস্তিরির দল পাশের বাড়িটায় কাজ করছিল । মেনকা গায়ের হয়ে গেলে রামেশ্বরকে দিয়ে চারপাশে রটাতে হবে যে মেয়েটা ঐ ছেলেটার সঙ্গে ষড় করে পালিয়েছে । প্রবীরও একই কথা বলবে দোতলার ফ্ল্যাটের সুন্দরীকে । সুন্দরী বলবে তার বন্ধু পুলিশ সাহেবকে । আর পুলিশ ছেলেটাকে পিটিয়ে ওকে দিয়ে লিখিয়ে নেবে যে ও মেনকাকে হাওয়া করে দিয়েছে ।
প্রবীর কথা বলেছে চীনা আর নান্টুর সঙ্গে । চীনা এখানকার উঠতি গুণ্ডা । বেশ কয়েকটা পুলিশ কেস ঝুলে আছে ওর নামে । জামিনে খালাস রয়েছে । গুণ্ডামি, তোলা আদায় - সবই করে বেড়াচ্ছে । নান্টু একটা ছোট ট্রাক চালায় । জাপানি ইঞ্জিন - গাড়িটা খুব জোরে ছুটতে পারে । ওর ট্রাকে তরি তরকারি বাজারে যায় । রাতদুপুরে চোরা চালানের মাল বাংলাদেশের সীমানায় দিয়ে আসে, ওখান থেকে মাল নিয়েও আসে । আবার ডাকাতের দলও ওর গাড়ি ভাড়া নেয় - এক সঙ্গে কয়েকটা গ্রাম লুঠে নিয়ে জোরে ট্রাক চালিয়ে উধাও হয়ে যায় ।
নান্টুর ঘরে বসে মাল খাচ্ছিল ওরা । দুটো ছোট ছোট ঘর - বাইরেরটার মেঝেয় মাদুর বিছোন । মাদুরের ওপর ওরা তিনজন বসা । ওদের সামনে গেলাস - দুটো মদের বোতল । একটার অর্ধেকটা এখন ভর্তি - বাকিটা এখনও পুরো রয়েছে । একটা থালার ওপর মদের চাট - চানাচুর, ভাজা ছোলা, কুচোন পেঁয়াজ আর লঙ্কা - ঘন করে মেশানো । মদের দাম দিয়েছে প্রবীর । চাটের খরচাটা নান্টুর ।
ঘরে ঢুকল গোলাপী - নান্টুর রাখা মেয়েছেলে । চীনার গেলাসের দিকে তাকিয়ে বলল, কি গো - গেলাস যে প্রায় খালি । বলে চীনার গেলাসে বোতল থেকে মদ ঢেলে দিয়ে জল মিশিয়ে দিল । আর একমুঠো চাট হাতে নিয়ে চীনার মুখের সামনে হাত রেখে বলল, খাও ।
চীনা গোলাপীর হাত ধরে । ওর হাতে মুখ লাগিয়ে চাট খায় । গোলাপী হি হি করে হাসে । ছেনালির হাসি । নান্টু না দেখার ভান করে । ও জানে চীনার সঙ্গে গোলাপী রং ঢং করে । কিন্তু এ নিয়ে কিছু বলে না । গোলাপী তো আর ওর বিয়ে করা বৌ নয় । কিছুদিন পরে গোলাপী পুরনো হয়ে গেলে পরে ওকে বার করে দিয়ে অন্য একটা মেয়েকে নিয়ে আসবে নান্টু । তখন গোলাপী গিয়ে আর কারোর ঘরে উঠবে । তবে হ্যাঁ - মাঝে মাঝে পুরো মাতাল হয়ে বাড়ি ফেরে নান্টু । তখন চীনার সঙ্গে গোলাপীর ফষ্টি নষ্টির কথা মনে পড়লে ওর ইজ্জতে লাগে । দুমদাম পেটায় মেয়েছেলেটাকে । মার খেয়ে গোলাপী কয়েকটা দিন ঠিক থাকে । তারপর আবার যে কে সেই ।
মদ খেতে খেতে কথা হোল । ওরা চলে আসবে আড়াইটে নাগাদ । নান্টু ওর ট্রাক নিয়ে আসবে । ট্রাকে থাকবে কিছু সিমেন্টের ব্যাগ, পাথরকুচির বস্তা, এইসব । ট্রাকে দুটো ভূয়ো নম্বর প্লেট লাগিয়ে আনবে । গাড়ির গায়েও আসল নম্বরটা লেখা আছে । ওটার ওপর দিয়ে একটা কাপড় ঝুলিয়ে দিয়ে ঢেকে দিলেই হবে । দুপুরবেলা ঐদিকটা একেবারে ফাঁকা থাকে । কেউ যদি ট্রাকটা দেখতেও পায় ভাববে ঐ বাড়ি তৈরি করার জন্যে মাল এসেছে । প্রবীর আর চীনা ওখানে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকবে । মেনকা যেই ওখানে আসবে ওমনি পেছন থেকে ওর মুখ চেপে ধরে ওর মুখ, চোখ আর হাত বেঁধে ফেলবে । তারপর ট্রাকে তুলে ভেতর দিকে ওকে শুইয়ে চাদর চাপা দিয়ে দেওয়া হবে । সামনের দিকে সাজানো সিমেন্টের বস্তা, পাথরকুচি, বালির বোরা- এসব ওকে আড়াল করে রাখবে । মেয়েটাকে চেপে ধরে বসে থাকবে প্রবীর আর চীনা - যাতে নড়াচড়া না করতে পারে । নান্টু হৈ হৈ করে ট্রাক ছুটিয়ে নিয়ে উঠবে একেবারে রেণুবালার ঠেকে । তারপর মাল খালাস করার দায়িত্ব রেণুর ।
মেয়েটা অবশ্য বিকেলেও একবার আসে । এই সাড়ে চারটে নাগাদ । ফেরৎ যখন যায় তখন রাত আটটা বেজে যায় । কিন্তু তখন ঐ বাড়িটার ভেতর দিয়ে সর্টকাট পথটা ঘুরঘুট্টে অন্ধকার থাকে বলে সেখানে ঢোকে না, গাড়ির রাস্তা দিয়ে ঘুরে যায় । কাজেই কাজটার জন্যে খাঁ খাঁ দুপুরবেলাটাই ভাল ।
চীনা গেলাসে একটা লম্বা চুমুক দিল । বলল, তোরা যাই বলিস ট্রাকে তোলার আগে আমি একবার মেয়েটাকে চেখে দেখব । মাইরি ঐ বয়েসের মেয়ের সঙ্গে কখনো শুইনি । একটা চান্স যখন পাওয়া যাচ্ছে, সেটাকে ছেড়ে দেওয়া বোকামি হবে ।
নান্টু মাদুরে গড়িয়ে পড়েছিল । ওর বেশ নেশা হয়ে গেছে । সড়াক করে জিভের জল টেনে বলল, ঠিক কথা, আমিও ছাড়ব না । কচ্চি মেয়ে - তার সোয়াদই আলাদা । ভাবছি গোলাপীকে বিদেয় করে দেব - ওরকম বয়েসের একটা মেয়ে ঘরে নিয়ে আসব । কিন্তু গোলাপীটা তাহলে কোথায় যাবে ? এই শালা চীনা - তুই গোলাপীকে রাখবি ?
চীনা নান্টুর পাছায় একটা হাল্কা লাথি মারল । বলল, চোপ্ শালা ।
প্রবীর কিন্তু মাথা নাড়ে । তা হবে না । জখম হওয়া মেয়ে রেণু নেবে না । ওখানে গিয়ে মাল ডেলিভারি না হলে কেলেঙ্কারি হবে । আর রেণুর ডেরায় গিয়ে ওর সঙ্গে ঝামেলা করা যাবে না । ওখানকার দালাল আর গুণ্ডারা পেঁদিয়ে লাশ করে দেবে তাহলে ।
নান্টু ফোঁস করে একটা নি:শ্বাস ফেলল । বলল, প্রবীর শালা হিজড়ে । ওটাকে দিয়ে কিছু হবে না ।
চীনা ওপরে নিচে মাথা নাড়ে । ও নান্টুর সঙ্গে একমত ।
একটাই খালি ফ্যাকড়া রয়েছে প্ল্যানের ভেতর । যদি সেদিন রামেশ্বর কামাই করে । তাহলে প্রবীর তো ডিউটি ছাড়তে পারবে না । সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন উঠবে প্রবীর ডিউটি ছেড়ে কোথায় গিয়েছিল - কেন গিয়েছিল । সেরকম কিছু হলে কি করা যাবে তাও ঠিক করে ওরা । বেলা দুটো পর্যন্ত বুড়োটা যদি ডিউটিতে না আসে তাহলে প্রবীর নান্টুর মোবাইলে ফোন করে দেবে - অপারেশন ক্যানসেল । রেণুকেও ফোন করে দিতে হবে - মাল আজ যাচ্ছে না ।
অনেক রাতে প্রবীরের ঘুম ভেঙ্গে যায় । ও শুয়েছে পাম্পের ঘরটার বাইরের সিমেন্ট বাঁধানো চাতালে । এখন গরমকাল । একটা মাদুর আর একটা তেলচিটে পাতলা বালিশ - তাতেই শুয়েছে ও । গরমকাল হলেও বিন বিন করছে মশা । সব রাস্তায় বড় বড় সাইনবোর্ড টাঙিয়ে কর্পোরেশন লিখে রেখেছে - ম্যালেরিয়ার মশা রাতে কামড়ায় । ম্যালেরিয়া আটকাতে মশারি টাঙিয়ে ঘুমোন । প্রবীরের পরনে খালি একটা হাফপ্যান্ট, খালি গা । মশাগুলো ওর পা দুটো বেশি করে আক্রমণ করছে - একটা জোরে হুল ফোটাতে প্রবীর পায়ে একটা চটাস করে চাপড় মারল । অস্ফুটে বলল, ওফ্ শালা ।
ও চিত হয়ে শুয়ে মাথার ওপরের ছাদ দেখতে পায় । ছাদটা নিচু - ও চাতালটার ওপর দাঁড়ালে ছাদ প্রায় মাথায় ঠেকে যায় । একতলার পুরো জায়গাটা গাড়ি রাখার জন্যে - সব ফ্ল্যাটগুলো রয়েছে তার ওপরে । পাশ ফিরলে এক টুকরো আকাশ দেখা যায় । এখন চাঁদ দেখা যাচ্ছে - এক ঝলক মোলায়েম জোছ্না প্রবীরের চোখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে । ওর গলা শুকনো লাগে, কিন্তু ও জল খাবার জন্যে ওঠে না । পকেটে রয়েছে বিড়ির বাণ্ডিল আর দেশলাই - চিৎ হয়ে শুয়েই একটা বিড়ি ধরিয়ে ফেলে । ধোঁয়া ছাড়তে থাকে আর বিড়ির মুখের লাল আগুনটুকু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে । আকাশে চাঁদ থেমে নেই । কোনাকুনি তরতর করে ওপরে উঠে যাচ্ছে, জোছনার টুকরোটাও পিছলে পিছলে সরে যাচ্ছে ওর কালো রঙের গায়ের এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় । সিমেন্ট বাঁধানো চাতালটা বেশ গরম - দিনের বেলা রোদ খেয়েছে - একটা তাপ উঠছে প্রবীরের মাদুরের ভেতর দিয়ে । বাপ মারা যাবার পর কাজ পেয়েছিল একটা সস্তা ভাত খাবার হোটেলে । সেখানে রাতে শুতো রান্নাঘরে - নিভিয়ে দেওয়া উনুনের পাশে । উনুনের তাপে সারা রান্নাঘর গরম হয়ে থাকত । কিন্তু প্রবীর নি:সাড়ে ঘুমোত সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর । জেগে থাকত আরশোলা আর ইঁদুরের দল - ওরা গায়ের ওপর উঠলে শরীরের সে জায়গাটা চুলকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ত আবার । দিনের বেলা রান্নার ওস্তাদকে জোগাড় দিত । খদ্দেরদের জন্যে থালায় সাজিয়ে নিয়ে আসত ভাত, রুটি, ডাল, সব্জী - লঙ্কার ঝালে লাল ডিমের কারি । বাসন মাজত উনুনের পোড়া ছাই দিয়ে - একসঙ্গে অনেক ছাইমাখা বাসন বড় এক গামলায় রাখা জলে ডুবিয়ে ধুয়ে ফেলত । প্রবীর এখন জেগে থাকে - পূর্ণযুবক, জোয়ান বয়েসের প্রবীর । রাতের ডিউটি বুড়ো রামুর - ওর লাঠির ঠকঠকানির মাঝে মাঝে জোরে আওয়াজ করা গলা খাঁকারির আওয়াজ শুনতে থাকে প্রবীর । তিনদিন আগে চাঁপার ঘরে গিয়েছিল । মেয়েটার মেজাজ খাট্টা ছিল, ভাল জমেনি সেদিন । বেচুর কথা ভাবে প্রবীর । শালা এখন মায়ের হাতের রান্না খেয়ে খাটে শুয়ে ঘুমোচ্ছে । ওর মা আবার ওর বিয়ের চেষ্টা করছে । বিয়ে হয়ে গেলে ঐ খাটে ওর পাশে বৌটাও শোবে - একটা বেশ নরমসরম কচি মেয়েছেলে । বেশ আছে শালা । চাঁদটা অনেক ওপরে উঠে গিয়েছে, তার আলোও সরে গিয়েছে অনেক দূরে - প্রবীর অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গিয়েছে । ওর চোখ বুজে আসে - ও আবার ঘুমিয়ে পড়ে । ঠিক ভোরে ওর ঘুম ভেঙে যাবে - সকালের ডিউটি ওর ।
সোমবার বেলা একটা থেকেই ছটফট করছিল প্রবীর । রামেশ্বর আসছে না কেন ? না এলে সব ভেস্তে যাবে । শেষ পর্যন্ত এল - তখন প্রায় দুটো বাজে । একটা হাঁফ ছাড়ল প্রবীর । অন্যান্য দিনের থেকে দেরি করেছে ঠিকই, কিন্তু কিছু বলার নেই । ওর ডিউটি বেলা দুটোয় শুরু । বুড়ো ভ্যাজর ভ্যাজর করে । ওর ছেলের গাড়ি চালানোর লাইসেন্স পুলিশ কেড়ে নিয়েছে । ফাইন দিয়ে তবে ছাড়াতে হবে । পুলিশ বড়ই অত্যাচার করে ট্যাক্সিওয়ালাদের ওপর - এসব দু:খ করে বলছিল । কথাগুলো প্রবীরের কানে যাচ্ছিল, কিন্তু ও তাতে মন দিচ্ছিল না । রামু বুড়ো ওর বাঙালি জরুর পেটের ছেলেকে ভালবাসে । প্রায়ই এই ছেলের কথা বলে - ছেলের মার কথাও বলে । দেশে থাকা বৌ ছেলেদের কথা ওর মুখে বিশেষ শোনা যায় না । অবশ্য দেশে যায় মাঝে মাঝে । ফসল কাটার সময় । প্রায় মাসখানেক কাটিয়ে ফিরে আসে ।
একটা গোলমালের আওয়াজ কান খাড়া করে প্রবীর । আওয়াজ আসছে পেছন দিকটার থেকে । মেয়েমানুষের গলা । একটা নয় । বেশ কয়েকজন মেয়ে একসঙ্গে চেঁচিয়ে কি সব বলছে । রামেশ্বর ছুটল ঐ দিকে । পেছনে প্রবীর - সদর গেট ছেড়ে রেখেই । ব্যাপারটা দেখার দরকার ।
ঘটনার নায়ক একটি শিশু । একটা ছেলে - বছর পাঁচেক বয়েস । ফুটফুটে রং, মোটাসোটা চেহারা । এই বাড়িরই একটা ফ্ল্যাটের বাসিন্দা এক দম্পতি - তাদের ছেলে । নাম বাবুন । অসম্ভব ছটফটে আর দুষ্টু । সে এখন একটা কার্নিশে চড়ে বসে আছে । মাটি থেকে প্রায় পনেরো ফুট উঁচু কার্নিশ - তার পাশে একটা মই ঠেকানো । মই-এর এক পাশ বিল্ডিং এর গায়ে ঠেকানো রয়েছে । ঐ ফ্ল্যাটের কাজের মেয়েটা - যে বাচ্চাটাকে দেখাশোনা করে - নিচে দাঁড়িয়ে হাঁউমাউ করে চেঁচাচ্ছে । ওর কাছাকাছি আরও তিন চার জন ওরই বয়েসী কাজের মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে - তারও উত্তেজিতভাবে চেঁচামেচি করছে । প্রবীর ব্যাপারটা আঁচ করে নিল । এ-বাড়িটায় টুকটাক কাজ এখনও চলছে । মিস্ত্রীরা বোধহয় কোনও সময় কিছু কাজ করেছিল, তারপর মইটা ওখানে রেখেই চলে গিয়েছে । বাচ্চাটার মা বোধহয় এখন ঘুম লাগিয়েছে । কাজের মেয়েটা বাচ্চাটাকে নিয়ে নিচে নেমে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করছিল । আর সেই সুযোগে বাচ্চাটা মই বেয়ে ওপরে উঠে গেছে । মইটা রাখা রয়েছে খুব ঢালু ভাবে । ওটা বেয়ে ওপরে ওঠা একটা বাচ্চার পক্ষে শক্ত হলেও অসম্ভব নয় । প্রবীর আর রামেশ্বরকে দেখেই মেয়েগুলো চিত্কার করে ওদের দুজনকে বলতে লাগল বাচ্চাটাকে নামিয়ে আনার জন্যে । শিশু নায়কটি ওদের অবস্থা দেখে ওপরে দাঁড়িয়ে খিলখিল করে হাসছে, দু-এক পা এদিক ওদিক হাঁটছে, আর নিচে দাঁড়ানো মেয়েগুলো ভয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে উঠছে । তিন ফুট বাই দু ফুটের কার্নিশ - একটু এদিক ওদিক হলেই বাচ্চাটা ওপর থেকে পড়ে যাবে ।
প্রবীর রামেশ্বরকে বলল, রামুদা, তুমি দৌড়ে গিয়ে ওর মাকে এখানে ডেকে নিয়ে এসো । আর মেয়েগুলোকে বলল, তোরা কার্নিশের ঠিক নিচে দাঁড়া - পড়লে ধরে ফেলবি । আমি ওপরে উঠছি ।
রামেশ্বর হাবার মতো দাঁড়িয়েছিল । ওকে এক তাড়া দিল প্রবীর - জলদি যাও, উসকি মাকো বুলাও । এবার রামেশ্বর ছুটল সিঁড়ির দিকে ।
প্রবীর মইয়ে এক পা উঠল । বাচ্চাটাকে ডেকে বলল, বাবুন, তুমি নড়ো না । আমি তোমাকে নামিয়ে আনছি । বলতে বলতে আরও দু ধাপ উঠল প্রবীর ।
উঠবে না, উঠবে না - বাচ্চাটার সোচ্চার প্রতিবাদ । আমি স্পাইডার-ম্যান । আমি দেয়াল বেয়ে নামব ।
সর্বনাশ করেছে । আমরা একটা খেলা খেলছি - প্রবীর বলল । তুমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকো । নড়লেই তুমি আউট ।
এখন প্রবীর মইয়ের মাঝামাঝি ।
বাবুন, দাঁড়াও, দাঁড়াও । এই দেখো, সার্কাসের বাঘ সিংহরা কি ভাবে মই বেয়ে ওঠে । এই, এইভাবে - বলতে বলতে আরও দু ধাপ ।
শব্দ করে হেসে উঠল বাচ্চাটা । নির্ভেজাল খুশির হাসি । হাততালি দিয়ে বলল, বাঘ সিংহ না, হনুমান - তুমি হনুমান ।
বড় হয়ে ঘোর হারামি হবে এই ছেলে । প্রবীর একবার মনে মনে দূরত্বটা আন্দাজ করে নিল । বাচ্চাটা এখন ও বোঝেনি যে ও প্রায় প্রবীরের হাতের নাগালের মধ্যে । এই শেষ মুহূর্তে লাফিয়ে না পড়ে - আরও একধাপ - নিজের মাথাটা নিচু করে রেখেই প্রবীর খপ করে হাত বাড়িয়ে ক্ষুদেটার একটা হাত ধরে ফেলল । সঙ্গে সঙ্গে প্রবল চিত্কার - শিশুটির প্রতিবাদের কান্না - ওর হাতের ওপর নিজের হাতের মুঠো আরও শক্ত করল প্রবীর ।
বাচ্চাটাকে নামিয়ে আনার পর বীরের সম্বর্ধনা । কাজের মেয়েরা একসঙ্গে কলকল করছে - ভাগ্যিস প্রবীরদা ছিল - প্রবীরদা না থাকলে যে কি হোত - ওপর থেকে পড়লে ছেলেটা বোধহয় আর বাঁচত না । রামু বুড়ো বলল, কামাল কিয়া প্রবীরনে । বাচ্চার আয়া মেয়েটি চুপ করে আছে । ওর মুখ শুকনো - এ ঘটনার পর চাকরি যাবার ভয় আছে । বাচ্চার মা প্রবীরকে বাবা বাছা বলতে বলতে নিজের ফ্ল্যাটে নিয়ে গেলেন । সোফায় বসিয়ে খেতে দিলেন ডবল ডিমের ওমলেট আর রাতে খাবার জন্যে তৈরি করা পুডিং । প্রবীরের সব খোঁজখবর নিলেন । ছোটবেলায় মা-বাবা মারা গেছে, ভাইবোনও কেউ নেই শুনে দু:খ প্রকাশ করলেন । বাচ্চার বাবা আগেই টেলিফোনে খবর পেয়েছিলেন । এবার তিনিও অফিস থেকে এসে পৌঁছে গেলেন । প্রবীরের উপস্থিত বুদ্ধি আর তত্পরতার প্রচুর প্রশংসা করে ওকে দিলেন একখানা একশো টাকার নোট । খচ্চর কোথাকার - প্রবীর ভাবল । ওর ছেলের জান বাঁচিয়ে দিলাম আর দিল মোটে একশো টাকা । তারপর প্রবীর দেখল বাচ্চার মা-বাবা দুজনেই হাবেভাবে বলছেন যে এবার প্রবীর উঠে পড়লেই ভাল হয় । অতএব প্রবীর নিচে নামল ।
নেমে এসে শুনতে পেল রামেশ্বরের ডাক । এ প্রবীরউয়া, তেরে লিয়ে ফোন হ্যায় । পহলে ভি একবার আয়া থা ।
প্রবীর ফোনের ঘরে গিয়ে রিসিভার কানে লাগাল । হ্যালো, প্রবীর বলছি । সঙ্গে সঙ্গে শুনল - শালা হারামির বাচ্চা -- । চীনার গলা ।
একেবারে পাথর হয়ে গেল প্রবীর । এই ঝামেলাটায় সব কিছু ভুলে গিয়েছিল । হাতের ঘড়ির দিকে একবার তাকাল । প্রায় সাড়ে চারটে বাজে । ওদিকে ফোনে সমানে গালাগাল চলছে - বল্ শুয়ারের বাচ্চা, আমাদের ভোগা দিলি কেন ? মা, বোন, বাপ, প্রবীরের চোদ্দপুরুষ উদ্ধার করে বলল, শালা, এবার তোর জান নিয়ে নেব আমি । তারপর লাইন কেটে গেল ।
আর তখন প্রবীরের চোখে পড়ল মেনকা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছে । সন্ধেবেলার কাজ করতে এসেছে ।