তবে কিনা, কাল এল ঘোর কলি, লোকমধ্যে কানাগলি । তাই দেবীরূপকে মানবী লাগে বটে । শুধু মানবীর লোহিনী মুখমণ্ডলের পরিপার্শ্বে এক মহিমময় মহামহিম মহি-মহিমা জ্যোর্তিবলয় দৃষ্ট হয় ।
কিন্তু, হে মানবকুল, কলিকালের হে অপুণ্যাত্মা পাপাচারী, তোমরা সকল মানবীতে এহ জ্যোতি: দৃষ্ট হইবা না । তোমরা তাঁহারই মধ্যে জ্যোতি: পাইবে যাঁহাকে আমি এই যুগেও সতীত্বের শক্তি দিব । স্বামীর অনুগতা হইবে যে, স্বামীগুণে গুণী, স্বামীসুখে সুখী ও স্বামীদাক্ষিণ্যে ধনলাভ করিয়া যে মুখে চিক্কণ তৃপ্তির পিচ্ছিল আলোক ধারণ করিবে ।
ঈশান কোণ পর্যবেক্ষণ করিলে বৃষ্টি-বাদলায় বিদ্যুল্লিখিত, ঈশ্বরপ্রেরিত এরূপ কিছু বাণী যে অদ্যাবধি চোখে পড়ে না এমন নয় । কিন্তু সতী-সাধ্বী, স্বামীগৌরবে গৌরবান্বিতা নারীর বাহুল্য হেতু বহু মাতৃরূপিণীর মাথার চারপাশে - না, ঠিক চারপাশে নয়, সরস্বতীর চালির মতো মাথার পেছনে চাঁদের বলয়ের ন্যায় জ্যোতি:কিরণ নজরে পড়ে । অতএব বিষ্ণু রায়চৌধুরীর স্ত্রী বিজয়লক্ষ্মী রায়চৌধুরীর লোহিনী মুখমণ্ডলের পরিপার্শ্বে এক অনিবার্য জ্যোর্তিমণ্ডল -- যা এই সাদামাটা ভুবনকে কিছু-বা উজ্জ্বলতর রাখে । এমনকী রাত্রিকালে বিদ্যুত্-সংযোগ বিচ্ছিন্ন হইলেও সেই জ্যোতি:বিভা আলোকিত করে যোজনদূরত্ব ।
এমন হতে পারে আজও কোনও মহিয়সী মহিলার ক্ষেত্রেই, যাঁদের নিজস্ব মহত্ত্ব প্রমাণের জন্য বিষ্ণু রায়চৌধুরী তুল্য প্রতিভাবান, প্রতিষ্ঠিত, সর্বজনমান্য, শক্তিমান, প্রভাবশালী, ধীমত্, প্রগুণ পতিদেব বাগানো ও তাঁর অনুরক্ত হয়ে থাকা ছাড়া অন্য কিছুই করার থাকে না । আর সমাজে আজও তা দেখায় ভাল । সুতরাং বিজয়লক্ষ্মীর জ্যোতির্মণ্ডল সম্পর্কে আর কারও কোনও প্রশ্ন থাকে না । তার মহিমা সম্পর্কেও থাকে না কোনও সন্দেহ । মনোবিজয়ের তরে কেহ দেয় প্রাণ, কেহ দেহ ।
দেহ দেয় অর্থে এ-কথা ভুলেও ভাবার দরকার নেই যে শ্রীমতী বিজয়লক্ষ্মীর সকাশে কেউ শরীর-সংসর্গ প্রস্তাব করে বসে । পৃথিবীতে যা কিছু সম্ভব নয় তার মধ্যে এই প্রস্তাব । দেহ যদি কেউ দেয় তো বিজয়লক্ষ্মীর পায়ে । পদতলে । `তোমার সন্তানেরে রক্ষা করো মা' - বলে সটান প্রণিপাত ।
তবে বিজয়লক্ষ্মী শিক্ষিতা, আধুনিকা একটি মেয়ে । ইদানীং তিনি মাতৃস্বরূপা, যৌবনজলতরঙ্গ রোধিবার লাগি নিয়মিত পার্লারে যান, তুলে ফেলেন চিবুক ও উপরোষ্ঠের সংলগ্ন অবাঙ্ছিত চুল । তাঁর কেশদামের শ্বেতস্বভাব মেহেন্দি রঙে চাপা পড়ে অগ্নিভ সমুজ্জ্বল । মুখে গালে হাতে পায়ে শেহনাজের নানান উদ্ভিজ প্রলেপ । এবং এই প্রলিম্পনে তাঁকে দেখায় শক্তিমতী, যৌবনা, আত্মবিশ্বাসী । কিন্তু বিজয়লক্ষ্মী প্রণাম মোটে পছন্দ করেন না । শিক্ষিতা, আধুনিকা একটি মেয়ে -- প্রণাম পছন্দ করেন না । বরং পছন্দ করেন -- আপনি এখনও কী সুন্দর ! বিজয়লক্ষ্মীদি, বউদি, ম্যাডাম ! কী সুন্দর ধরে রেখেছেন শরীর ! আপনার বয়স, ওমা, বোঝাই যায় না কিছু । ... অথবা, কেদারা ছেড়ে পদতলে বসল কোনও যুবক । হালকা মশকরার ছলে । কিন্তু ছলনার আড়ালে আনুগত্য দেখাল !
তাঁর এই মনোভাব ভক্তজনবিদিত । আর এরা প্রত্যেকেই প্রকৃতপক্ষে বিষ্ণু রায়চৌধুরীর ভক্ত । পতির ভক্ত, সতীর ভক্ত । তাই বিষ্ণুভক্ত, লক্ষ্মীভক্ত । সরল হিসেব, সোজা অঙ্ক । বিষ্ণু আর লক্ষ্মী । লক্ষ্মী আর বিষ্ণু । অধরা কিন্তু এ ধরা ধারণ করে আছেন মুখে মৃদু হাসি সমেত পদ্মফুলে বসে । লোকে তাই, স্বার্থবশে, মহানন্দে, যুগলেরে তোষে ।
তোষণ বটে মানবেরই ধর্ম । ভক্ত নেতারে তোষে, নেতা ভক্তেরে । মাঝখানে স্বার্থের সাঁকো । নেতার স্বার্থ সে জনবল পায়, ভক্তের স্বার্থ পায় মনোবল । বলা বাহুল্য বিজয়লক্ষ্মী আপন বলে, স্বামীবলে, কোনও ছল না করেই ভক্তেরে দেন বল । এবং ভক্ত তাঁর দ্বারে কিছু পারিতোষিক হিসাবে স্বীয় পত্নীর তৈয়ার সুগন্ধী সুস্বাদু ভটিত্র আনয়ন করে এবং আপন অসুবিধা ব্যক্ত করে । এ মতো সে বলে -- হেঁ হেঁ, আমার বউ রান্না করেছে । কেমন ম্যাডাম ? কেমন ?
এই ভক্তের পত্নীর রান্নার স্বাদ আগেও মিলেছে । অতএব বিজয়লক্ষ্মী খুশিকে পরিমিতিতে বেঁধে, মৃদু হেসে, দেবীসুলভা বলেন -- তোমার বউ তো ভাল রাঁধে ? না ? এর আগেরবার কী যেন পাঠাল ? কী যেন ?
- পলান্ন ম্যাডাম ।
মনে রেখেছে সে । পলান্ন এনেছিল । এ সবই প্রস্তাবের পাঁয়তারা । এখন বিজয়লক্ষ্মী বললেন -- হ্যাঁ ! পলান্ন ! কী আনন্দ করে খেয়েছিলাম আমরা ? বিষ্ণু ? মনে আছে তোমার ?
বিষ্ণু রায়চৌধুরী পাশেই উপবিষ্ট । গভীর মনোযোগে একটি বই পড়ছিলেন । সম্প্রতি প্রকাশিত একটি ইংরাজি গূঢ় পুস্তক । ভাবে ভারী । বিষয়ে গভীর । এমন বই পাঠকালে যে-কোনও গুরুত্বপূর্ণ মানুষের মুখই নির্বিকার দেখায় । এমনকী পলান্ন বা ভটিত্র বিষয়ও তাতে কিছু নতুন রেখাপাত করে না । কিন্তু এখানে বিষয়ের অন্তরালে আছে অন্যতর বিষয় । রন্ধনের অন্তরালে রাঁধুনি । সুগন্ধের আড়ালে ভক্তের স্ত্রী । যদিও সেই হলদে পলান্নের সুগন্ধী বৃহৎ মাংসখণ্ডগুলি সুপ্রীতিকর, অতি সুস্বাদু তরুণী বসন্তেরই ন্যায় । আর এই ভটিত্র, কালচে, নরম, সরস, জিহ্বার সঙ্গে তার নিকট সম্পর্ক ! বিষ্ণু তা জানেন ।
বহু গুণান্বিত পুরুষ হিসেবে মহান ও গুরুত্বপূর্ণ শ্রী বিষ্ণু মদ্যপানে প্রীত ও তৃপ্ত । দোষ যদি বলে কেউ তো দোষ -- না হলে নয় । এ ছাড়া বিষয়ে নারী থাকলে বিষ্ণু রায়চৌধুরী কিছু আলোড়িত । পুরুষজাতির পক্ষে এ এক মস্ত বিপর্যয় বটে । নারী অন্তরে চাঞ্চল্যের সঞ্চারক । আর, এ চাঞ্চল্য চোখ গাল ঠোঁট অধিকার করে বসে । অপরপক্ষে নারীর হৃদয় বিষয়ে বহু তথ্য আজও অজ্ঞাত । একজন পঁয়তাল্লিশোর্ধ্ব পুরুষ, এক বিংশতি তরুণীকে দেখলে চোখে যে-ভাব প্রকাশ করে তাকে অনায়াসে কামভাব চিহ্নিত করা যায় । কিন্তু কোনও ভারতীয় নারী, চল্লিশোর্ধ্বা, কোনও বিংশতি তরুণের দিকে দৃকপাত করলে যে-ভাব প্রকাশ পায়, তাকে বলে মাতৃস্নেহ । নিষ্কাম স্নেহে সিক্ত । এ-বিচারে নারীকে মহান চিহ্নিত করে সমাজ । যে-নারীর কামবোধ যত তাড়াতাড়ি চলে যায়, এ-সমাজ তাকে নির্দেশ করে ততই অতিরিক্ত শ্রদ্ধেয়া এবং বাড়তি দেবী ।
তবে হ্যাঁ । মধ্যবয়সিনী ও তদোর্ধ্বাদের প্রথম রিপুর অস্তিত্ব নিন্দনীয় হলেও, পুরুষের যে-কোনও বয়সের চোখ সমাজে গৃহীত । মিনসেগুলো চিতেয় উঠলেও চরিত্র শোধরায় না -- এমন প্রবচন দিতেন সেকালে মাসি-পিসিরা ।
অতএব হাড় থেকে মাংস আলগা হয়, ত্বকে কুঞ্চন বাড়ে । টান টান গালের ওপর একের পর এক আঁকা হয়ে যায় বলিরেখা, কিন্তু পছন্দের নারী সম্পর্কে বিষ্ণু রায়চৌধুরীর উত্তাপ কমে না ।
সমাজে যাঁদের প্রতিপত্তি অনেক, তাঁরা ধামার নীচে লীলে করেন । সে রামপাখির ভটিত্র ভোজনই হোক -- বা অন্যকিছু । কিন্তু লীলার উন্মাদনা অনেক সময় বেবাক ধামা উল্টে সব আঢাকা করে দেয় । সেই ঈশ্বরের আমল থেকে এমনটি হয়ে আসছে । মুখে যে যতই নিন্দে করুক, পরস্ত্রী ভজনার মজাই আলাদা । প্রতিপত্তিশালীরা মঞ্চে স্ত্রীকে দক্ষিণ পার্শ্বে রাখেন ঠিকই, কিন্তু মঞ্চ থেকে নামলেই তাঁরা জনগণের । নারীগণের । বিষ্ণু রায়চৌধুরীও পদাধিকারবলে এমন যে জনসমাবেশে পছন্দের নারীর পিঠে হাত দিয়ে কাছে টেনে নেন অবলীলাস্নেহে । হ্যাঁ, অবলীলায় । কিন্তু তার মধ্যে লীলা দেখে না কেউ । তবে, তখন, কোনও কোনও নারীকে কাতর লাগে । ওই কাছে টানায় কারও গলন শুরু হয়, কারও জ্বলন । কেউ, অন্তরালে আত্মসমর্পণের ইশারা দিয়ে যায় । কেউ সমর্পণের জন্য সবেগ তাড়িত হয়, মনে মনে কোনও মনোবাঙ্ছা পরিকল্পনা করে ।
পুরুষদের সমর্পণ কিছুটা আলাদা । তারা হাত কচলে কেবলই বলে, আপনি কত ভাল, আপনি কত মহান, আপনি কত ইয়ে ... । করুণার ঝুলি তাতে কিছু উপুড় হয় বটে । কিন্তু হয় না যাদের, তারা গিয়ে ধরনা দেয় বিষ্ণু রায়চৌধুরীর স্ত্রী মাননীয়া দেবী শ্রীলা শ্রীযুক্তা বিজয়লক্ষ্মী রায়চৌধুরীর কাছে । সূক্ষ্মভাবে দেখলে সন্তানস্নেহ নয়, আধুনিকা বিজয়লক্ষ্মীর কাছে মেলে ভ্রাতৃস্নেহ । সেই স্নেহকে প্রশংসা, পারিতোষিক ও আনুগত্য দ্বারা নিজের দিকে সেচন করিয়ে যে-যার অভিলাষ ব্যক্ত করে । দেবী তুষ্ট হলে, স্বয়ং পদাধিকার বলে কারওকে আদেশ বা অনুরোধ করেন । ছোট-খাটো ব্যাপার হলে মিটিয়ে নিতে পারেন আপনিই । কিন্তু ধরা যাক, কারও চাকরি চাই -- এ-হেন গভীর এবং দুর্লভ এবং কঠিন বিষয়ের ক্ষেত্রে বিজয়লক্ষ্মী স্বামীর শরণাপন্ন হন । আর বিষ্ণু, কখনও স্ত্রীর ইচ্ছে প্রত্যাখ্যান করেন না । যে-কোনও নারীর ক্ষেত্রেই ঈর্ষণীয় মর্যাদা তিনি স্ত্রীকে দিয়ে থাকেন । জনসমাবেশে পছন্দের নারীর কাঁধে হাত রাখা বা স্নেহবশে গাল প্রলুন্ঠিত করা ছাড়া অন্যগুলি তিনি স্ত্রীর অনুপস্থিতিতে বা চোখের আড়ালেই সারেন ।
সতী-সাধ্বী স্ত্রীগণ স্বামীর এতটুকু মনোবিকার হলে ধরে ফেলতে পারেন । তাহলে, সতীনারী স্ত্রী বিজয়লক্ষ্মী কি বিষ্ণুর এই চাঞ্চল্য টের পান ? লোকে আড়ালে আলোচনা করে বটে । তারা সব এলেবেলে । দিন কাটে জলে-তেলে ।
-- হ্যাঁ হ্যাঁ, সব বোঝেন । ন্যাকা সেজে থাকেন ।
-- না না, উনি অন্যরকম । ওসব ওঁর মনেও আসে না ।
-- আহা ! কত বড় মানুষ ! কত বড় মানুষের বউ ! কী মর্যাদা !
-- হ্যাঁ । দেবী যেন ! কী চমত্কার ব্যবহার ! মাথার পেছনে জ্যোতিশ্চক্রটি দেখেছ কি ? কী উজ্জ্বল ! লোডশেডিং-এও জ্বলজ্বল করে । উনি কী না পারেন !
-- উনি চাইলে সব পারেন । বিষ্ণুবাবু ওঁর কথায় ওঠেন আর বসেন । অমন স্ত্রী !
-- হ্যাঁ, তবে আমি বিষ্ণুবাবুর দোষ দেখি না । মেয়েরা বিষ্ণুবাবুর জন্য কীরকম করে, না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না । কী হ্যাংলামো, কী অসভ্যতা, ছি: ।
-- তা তো ঠিকই । পুরুষের মাথা ঘুরিয়ে দেয় তো মেয়েরাই । ওরা হামলে পড়লে পুরুষের সংযম থাকে ?
-- তবে উনি যাই করুন স্ত্রীকে মর্যাদা দেন সর্বত্র ।
হ্যাঁ, বিজয়লক্ষ্মী সর্বত্র এই মর্যাদা পেয়ে থাকেন, তিনি বিষ্ণুর মাননীয়া স্ত্রী । এই যেমন এখন । ভক্ত ইন্দ্র, যে কিনা তার স্ত্রী শুচিস্মিতার রান্না করা ভটিত্র এনেছে, এবং শুচির প্রসঙ্গ উঠতেই শ্রীবিষ্ণু চঞ্চল । তা শুধু পূর্বেকার পলান্নের স্বাদ স্মরণ করেই নয় । শুচির নিজস্ব স্বাদের কথা ভেবেও । বিষ্ণু, বেশ ক'বার, বিশেষ মুহূর্তে, বিনা বাধায় শুচিকে গ্রহণ করে তৃপ্ত হয়েছেন । বিজয়লক্ষ্মী তা জানেন না । তাঁকে না জানাবার সমস্ত ব্যবস্থাই বিপুল মর্যাদার সঙ্গে বিষ্ণু সম্পন্ন করেছেন । সমাজ এ বিষয়ে কী বলে ?
সে আর কী বলবে ? সমাজের তো আর হাত পা নাক চোখ মুখগহ্বর নেই ! এ কলিকালের সমাজে কেলি করে স্ত্রীর কাছে পুরোপুরি গোপন করতে পারাটাই স্ত্রীকে প্রকৃত মর্যাদা প্রদান । সংযমের কোনও প্রয়োজন নেই । সংযত থাকে বোকারা । এ ভবে কত-না আনন্দের পসরা । রসে, গন্ধে, স্বাদে পূর্ণ । লুটে লে ! লুটে লে ! যত পারিস লুটে লে ! দু'দিনের জীবন - নইলে শুকিয়ে আমসি হয়ে যাবে । মরে শান্তি পাবিনি ।
প্রত্যেক সতী স্ত্রী-ই অবশ্য স্বামীর এই গোপনাচরণ বিষয়ে অজ্ঞ । কারণ স্বামীই অন্ন দেয়, সম্মান দেয়, পৃথিবীতে জায়গা করে দেয় । তিনিই ভরণ, তিনিই পোষণ, তিনিই লালন, তিনিই সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য-বিহারের স্বর্গ-বন্ধন । অতএব, দেখো না, বোলো না, শুনো না -- আপন মর্যাদা বাড়বে বই কমবে কই ! বরং মস্তকের চারপাশে অয়ি জ্যোতি:কুণ্ডল উজ্জ্বলতর হবে । স্মিত চকচকে মুখমণ্ডলে, উন্নতির লিপি লেখা প্রশস্ত কপালে গর্ব, সাফল্য, আনন্দ ও প্রাপ্ত ভক্তির লোভনীয় প্রতিফলন হতে থাকবে । দুয়ারে চপ্পলের ভিড় । টেলিফোন অবিরাম । জগত্সংসারের যতেক ঝক্কি সামলানো ! শ্রীবিষ্ণুর পাশে যেন শ্রীলক্ষ্মী ! আহা ! শ্রীমতী বিজয়লক্ষ্মীর জীবন ধন্য হল ।
বিজয়লক্ষ্মীর মুখমণ্ডলের চতুষ্পার্শ্বস্থ জ্যোতির্বলয় তেজে ও দীপ্তিতে মুখর হল । সে-কারণ পৃথিবীও হল উজ্জ্বল । তিনি মৃদু হাস্যে মুখ ভরিয়ে গালের ভার এক হাত থেকে অন্য হাতে নিয়ে নীরব রইলেন । ইন্দ্র বলে চলল -- তো বলে কী জানেন ? তোর কী ? তুই যে সেদিন কানের লতিতে করবী ঝুলিয়ে যাচ্ছিলি, তার জন্য কি শিবেশদার পরামর্শ নিয়েছিলি ? আমি শিবেশদাকে জানি । ব্যস্ !
খ্যাতি ও প্রতিপত্তির সঙ্গে এসবও সামলাতে হয় বটে । আর কোনও সমান্তরাল শক্তির অভ্যুথ্থানের সম্ভাবনা । তজ্জনিত উদ্বেগ ! বিজয়লক্ষ্মী নিষ্পাপ মানুষ । শক্তির দৌড়ে তিনি সামিল হওয়ার কথা ভাবতেও পারেন না । তবে সতী-সাধ্বী স্ত্রীর যা কর্তব্য, সেটুকু উনি করবেন । এই সংবাদ সুসময়ে স্বামীর কর্ণে পরিবেশন করবেন । ভক্ত ইন্দ্রও জানে তা । বোঝে । সুতরাং বিজয়লক্ষ্মীকে কিছুক্ষণ নীরব থাকতে দিয়ে সে বলল -- একটা কথা ছিল ম্যাডাম । আপনাকে ছাড়া আর কাকে বলব । বিশে পাল আমাকে ডজ করে এগিয়ে গেল বলে । মাইরি, এই সুযোগটা ধরতে না পারলে আগামী দশ বছরে আমার আর উন্নতি হবে না । আমার আর শুচির ভবিষ্যৎ আপনার ওপরই নির্ভর করছে ম্যাডাম ।
তার করতলদ্বয় পরস্পরের সঙ্গে অকারণ জড়ামড়ি করে পরস্পরকে স্বেদসিক্ত করে । বিজয়লক্ষ্মী প্রশ্রয় মেশানো ধমকের স্বরে বলেন -- ছি: ! ও আবার কী ভাষা !
ইন্দ্র এক মুহূর্ত থমকায় । কোনটা ভুল হল ? `মাইরি' বলাটা ? কোনও ঝুঁকি নিল না সে । `মাপ করে দিন ম্যাডাম, মাপ করে দিন' -- বলতে বলতে কেদারা ছেড়ে ভূমি আশ্রয় করল । দেবী বিজয়লক্ষ্মী স্মিত হাসি রেখে কপট ক্রোধে বললেন -- আগে বলিসনি কেন ? সমস্যা যখন সমাধান করা অসম্ভব হয়ে উঠবে, তখন তোরা ছুটে আসবি ?
বিনত ইন্দ্র বিগলিতপ্রায় । বলল -- আপনি চাইলে অসম্ভব কিছু নেই ম্যাডাম । আর বুঝতে পারিনি । সত্যি বুঝতে পারিনি । বিশেটা যে তলে তলে এতদূর এগিয়ে গেছে ! তা ছাড়া, মনে হয়, এতে শিবেশদার হাতও থাকতে পারে !
বিজয়লক্ষ্মীর সরল ঠোঁট দুটি প্রশ্ন উচ্চারণ করে । ধীর এবং নিস্পৃহ সেই উচ্চারণের স্বর । কিন্তু একটু কান পাতলে শোনা যাবে, বাহিরে তখন বাজছিল গুরু গুরু । ঘন মেঘে আকাশ ঢেকে ফেলছিল । কোনও এক দুর্যোগ সম্ভাবনা রচিত হচ্ছিল ঈশানে । ইন্দ্র মনে মনে এ দুর্যোগ আবাহনই করছিল হয়তো-বা । তাই উড়ো হাওয়া বইয়েছিল । কোথাও কোথাও উড়ো হাওয়ার শক্তি অনেক, সে দেখেছে । চাল নেই, চুলো নেই, মূল নেই, শেকড় নেই, দমকা এসে মুহূর্তে প্রলয় লাগিয়ে দিতে পারে । তবে এ হাওয়া আয়োজন করে হয়ে ওঠা সমুদ্রোথ্থিত বায়ুর মতো শক্তিমান নয় । এ কখনও সফল । কখনও নয় । ইন্দ্রও কখনও সফল । কখনও নয় । সে এমন আলপটকা বলে ঠিক বুঝতে পারল না ভুল বলল, না ঠিক । অতএব বিজয়লক্ষ্মীর সুশান্ত প্রশ্নের জবাবে সে বলল -- না, মানে আমি সঠিক জানি না । হতেও পারে আর কী !
হাওয়া বয়ে গেল । মহাপ্রলয় ঘটল না । সামান্য বারিপাতে ভূমি ভিজল কি ভিজল না, মেঘের দল কালো থেকে ফিকে হতে হতে ছাইরঙা হল, তারপর মিলিয়ে গেল দূরে । এবং বিশে পাল নয়, শ্রীবিষ্ণুর হস্তক্ষেপে পদোন্নতি ঘটল ইন্দ্রর ।
বিষ্ণু রায়চৌধুরী এখনও পৌঁছননি কারণ অন্য একটি প্রমোদসভা করে তাঁকে আসতে হবে । তাঁর উপস্থিতি যে-সভাকে উল্লসিত করে, বিজয়লক্ষ্মীর জ্যোতি:মণ্ডল সেই সভাকে করে আলোকময় । অতএব ইন্দ্রের প্রমোদসভা এখন আলোকোজ্জ্বল থাকলেও তাতে প্রাণের অভাব চোখে পড়ছিল । কিন্তু সন্ধে গড়িয়ে রাত্রির দিকে ঢলে পড়লে শ্রীবিষ্ণু রায়চৌধুরী কয়েকজন পারিষদবর্গ সমভিব্যাহারে প্রবেশ করলেন । সুসজ্জিত, আলোকতৃপ্ত ঘর হর্ষে উত্তাল হল ।
ইন্দ্র কাছাকাছিই ছিল । দ্রুত এসে শ্রীবিষ্ণুকে আসন গ্রহণ করানোর ভূমিকা নিল সে । পারিষদবর্গও আশেপাশেই বসলেন । ইন্দ্র বসল শ্রীবিষ্ণুর পাশেই । তার দন্ত স্ফুটিত । ভাবে নম্রতা । করতলে প্রবল ঘষাঘষি । সভা বেশ কিছুক্ষণ ধরে গড়িয়েছে বলে অতিথিরা যে-যার মতো বৃত্ত রচনা করে স্থিত । শুচিস্মিতাকে আর ততখানি ছুটোছুটি করতে হচ্ছিল না । বিষ্ণুর আগমনবার্তা পেয়ে সে দ্রুত আসছিল । এবং বিষ্ণুরও চোখ তার দিকেই । তাঁকে দেখায় যেন-বা কিছু রক্তিম । পূর্ববর্তী সভা হতে কিছু পান করেছেন । এখন, ইন্দ্রের সাফল্যসভায়, তাঁর হাতে আনন্দ পানীয় ! শুচিস্মিতাকে দেখামাত্র -- অয়ি শুচিস্মিতে -- বলে হাঁক পাড়লেন তিনি । শুচিস্মিতা মধুর হেসে বসে পড়ল ইন্দ্র এবং শ্রীবিষ্ণুর মাঝখানে একফালি জায়গায় । বিষ্ণুর মুক্ত থাবা সরাসরি নেমে এল শুচিস্মিতার জঙ্ঘায় । কোল জুড়ে খেলে বেড়াতে লাগল । বিজয়লক্ষ্মী ধারে-কাছে নেই । ইন্দ্র অনেকখানি ঔদাসীন্যে পাশের পারিষদকে বলল -- অনেককিছু ধারণ করেছেন দেখছি ! মানেন জ্যোতিষ-টোতিষ ?
সে লোক বলল -- ওই আর কী । সত্যি কাজ হয় কিনা জানি না । পরেছি । বউ বলল ।
-- হ্যাঁ । কাজ হয় কারও কারও । ভাল জায়গা থেকে পাথর কিনলে ...
জ্যোতিষ বিষয়ে আরও কিছু বাক্যালাপ হওয়ার পর ইন্দ্র একসময় সে-জায়গা ত্যাগ করল । অতিথিরা, যারা এসেছিল আগে-আগেই, বিদায় নিতে থাকল । বিষ্ণু শুচিস্মিতার কাঁধে হাত রেখে পান করলেন আরও -- আরও । এবং ভোজনের আয়োজনের কাছে পৌঁছে তাঁর, পলান্ন বা রামপাখির ঝলসানো অঙ্গ বা রেওয়াজি মাংসের ভটিনের চেয়ে অনেক উপাদেয় ভোজ্য মনে হল শুচিস্মিতাকে ।
সহসা নিবে গেল আলো । বিদ্যুত্বিচ্ছিন্নতা । এমনকী দেবী বিজয়লক্ষ্মীর জ্যোতির্বলয়ও জাজ্বল্যমান রইল না । প্রমোদসভা থেকে শুরু করে সমগ্র বিশ্বচরাচর ডুবল অন্ধকারে । বিজয়লক্ষ্মী অন্ধকারে নিমজ্জিত হলেন । প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি জোরে, প্রায় আর্ত নাদে বললেন -- ওকে ভাল করে ধর শুচি । বড্ড বেশি খেয়েছে আজ । পড়ে যাবে ।
বিদ্যুৎ এল ।
আলো জ্বলল পৃথিবীতে ।
শুধু দেবী বিজয়লক্ষ্মী রায়চৌধুরীর মস্তক পরিপার্শ্বে জ্যোতির্বলয় রয়ে গেল নিরালোক । শূন্য । ফাঁকা ।