• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩৫ | মে ২০০৫ | রম্যরচনা
    Share
  • আমরা সবাই ব্যতিক্রম : মীজান রহমান

    আপনার দেশ কোথায় ?
    বাংলাদেশ ।
    মানে, আপনার জন্মস্থান কোথায় ?
    সেটাও বাংলাদেশ ।
    আহা, সেদেশের কথা বলছি না আমি । আপনার বাপদাদার দেশ কোথায় ?
    আমার বাপদাদার দেশ ছিল পাকিস্তান । তার আগে ছিল ভারতবর্ষ ।
    দূর সাহেব, আপনি কিছুই বোঝেন না । আমি জানতে চাচ্ছি আপনার গ্রামের বাড়ি কোথায় ।
    তাই বলুন, গ্রামের বাড়ি । তা গ্রাম বলতে হবে, না, থানা জেলা হলেই চলবে ।
    থানাই যথেষ্ট ।
    রায়পুরা থানা ।
    তাহলে আপনি নিশ্চয়ই রায়পুরা সমিতির সদস্য ?
    সে আবার কি জিনিস ?
    সেকি, আপনারা এখনো সমিতি করেননি ? বাংলাদেশের এমন কোন থানা নেই যার সমিতি নেই ।
    বাংলাদেশ, না, এখানে ?
    আপনি দেখি আজব মানুষ সাহেব । এতদিন বিদেশে আছেন, সমিতির খবর রাখেন না ।
    আমার অন্য কাজ আছে ।
    সমিতি কি কাজ নয় ?
    আমার জন্যে নয় ।
    কেন, সমিতি করলে কি আপনার ইজ্জত যাবে ?
    আমার ইজ্জত বড় নয়, দেশের ইজ্জতের চেয়ে ।
    আপনি কি বলতে চান সমিতি করলে দেশের ইজ্জত থাকে না ?
    আপনিই বলুন ।
    আপনার কথার ইঙ্গিত সুবিধের মনে হচ্ছে না সাহেব । নাকটা একটু খাড়া মনে হয় ।
    গোস্তাকি মাপ করুন । খারাপ অর্থে বলিনি ।
    ঠিক আছে, মাপ করলাম । এ সপ্তাহের ঠিকানা দেখেছেন ?
    কার ঠিকানা ?
    না সাহেব, আপনার সঙ্গে কথা বলে আরাম নেই । `ঠিকানা' একটি পত্রিকার নাম, তাও জানেন না ?
    ও হ্যাঁ, দেখেছি । ভাল পত্রিকা ।
    পত্রিকার বালমন্দ জানি না, সার্কুলেশন কত জানেন ? শুনলে মাথা ঘুরে যাবে । ভেতরে বিজ্ঞাপনের পাতাগুলি দেখেছেন ?
    না, দেখিনি ।
    তাহলে কিছুই দেখেননি । দেখবেন বড় করে ছাপা হয়েছে আমাদের ছবি ।
    কেন ?
    ইলেকশনে জিতেছি বলে । বাসায় গিয়ে খুললে দেখবেন ১০৮-তম পৃষ্ঠায় ১০ জন নির্বাচিত পুরুষের ছবি । তার মধ্যে এই অধমেরও আছে একখানা । কোষাধ্যক্ষের পদ । আমি চাইনি কোন পদাদি, ওরা জোরজবরদস্তি করাতে রাজি হলাম ।
    কোন্‌ সমিতির ইলেকশন এটা ?
    বৃহত্তর ল্যাংমারা সমিতি ।
    ক্ষুদ্রতর ল্যাংমারা সমিতি আছে নাকি কোনও ?
    ঠাট্টা করবেন না সাহেব, এটা ঠাট্টার বিষয় নয় ।
    ঠাট্টা নয়, কৌতূহল মাত্র । তা মাত্র দশজনের ছবি কেন ?

    একজন সভাপতি । চারজন সহসভাপতি । একজন সাধারণ সম্পাদক, একজন সহসাধারণ সম্পাদক । একজন কোষাধ্যক্ষ । একজন সাংস্কৃতিক সম্পাদক, একজন ত্রক্রীড়াসম্পাদক ।
    সবই একজন করে, শুধু সহসভাপতিই চারজন । কারণ জিজ্ঞেস করতে সাহস পাচ্ছেন না ভদ্রলোক । সম্ভাব্য সংলাপটি মনে মনে কল্পনা করেই হাসলেন খানিক ।

    চারজনের মাঝে দুজন সভাপতির দু'পা টিপবে, দুজন টিপবে তার হাত ।
    কেন ? হাত-পা কি জখম হয়েছে ?
    কিঞ্চিৎ ।
    কিভাবে ?
    প্রতিপক্ষকে হারাতে গিয়ে ।
    প্রতিপক্ষকে হারাতে হাত-পা লাগে নাকি ? ভোটে হয় না ?
    সবসময় হয় না, মাঝে মাঝে হাত-পা লাগে ।




    আজকাল লোকে আমাকে নানাবিধ `আলোচনাসভায়' ডাকে । বাঙালি খুব আলোচনাপ্রিয় জাতি । আমি লেখালেখি করি বলে তাদের ধারণা হয়ে গেছে যে আমি আলোচনাপটু । আসলে আমি তা নই । আমি বক্তৃতা করতে দাঁড়ালে মানুষের ঘুম পায় । সেহিসেবে আমার বক্তৃতা বেশ উপকারীই বলা চলে । আজকাল জীবনটা এমন হয়ে গেছে যে কড়া ওষুধ না খেলে সহজে ঘুম আসতে চায় না । পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের এ বাতিকটা আছে কিনা জানি না, কিন্তু বাংলাদেশের বাঙালিরা খুব বক্তৃতাভক্ত । উপলক্ষ্য যাই হোক তারা যখন তখন যাকে তাকে ডাকবে `কিছু বক্তব্য রাখা'র জন্য । বেচারার হয়ত কিছুই বলার নেই, তবু তাকে বলতে হবে । সেটা বাচ্চার জন্মদিনেই হোক আর পিতামহের মৃত্যুদিবসেই হোক, একটু গণ্যমান্য হয়েছেন তো সেরেছে, কিছু না বলে আপনার নিস্তার নেই । আনুষ্ঠানিক আলোচনাপর্ব থাকলে তো কথাই নেই । মঞ্চে বড় বড় করে টেবিল সাজানো হবে । তাতে সারি বেঁধে বসানো হবে মহান ব্যক্তিদের -- সভাপতি, প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি, প্রধান বক্তা, সম্পাদক, সহসম্পাদক । টেবিলে প্লাস্টিকনির্মিত পানির বোতল (পুরাকালে থাকত কলের পানি ও কাচের গ্লাস), ফুলের তোড়া বা (খরচ কমানোর তাগিদে) কোনার দোকান থেকে সেল-এ কেনা বাসি গোলাপ । একসময় শুরু হয় বক্তৃতাপর্ব । প্রথম কিস্তির বক্তৃতা পেশ করেন অন্যান্য বক্তারা যাঁরা মঞ্চে বসার মত `গণ্যমান্যতা' এখনো অর্জন করেননি । তাঁদের অনেকেই প্রাক্তন ছাত্রনেতা, দেশের ক্যাম্পাসে গরম গরম বক্তৃতা দিয়ে অভ্যস্ত, তাই প্রবাসে বক্তৃতার সুযোগ পেলে তাঁরা তার পূর্ণ সদ্ব্যবহারে মোটেই কার্পণ্য করেন না । একবার কোন এক অনুষ্ঠানে আমার পূর্ববর্তী বক্তা ছিলেন জনৈক মুক্তিযোদ্ধা । এমনই অগ্নিবর্ষী বক্তৃতা করলেন তিনি যে স্পীকারগুলোর ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা । তারপর যখন আমি দাঁড়ালাম কিছু বলার জন্যে, হলের ভেতরে ফায়ার অ্যালার্ম বেজে উঠল । সম্ভবত ভদ্রলোকের অগ্নিবর্ষণের ফলে ধোঁয়া উঠতে শুরু করেছিল কোথাও । সে দৃশ্য ভোলার নয় । তাই মঞ্চে বসে ছাত্রনেতাদের জ্বালাময়ী কন্ঠ শুনলে আমি একটু সংকিত হয়ে উঠি । মজার ব্যাপার যে এই বক্তৃতাগুলি বেশি জনপ্রিয় হয় -- মুহুর্মূহু করতালি তাঁরাই পায় বেশি । এ.ংএদর বক্তৃতা শোনার পর আমার মত নিরীহ বক্তাদের শীতল বক্তব্য শোনার কোন আগ্রহই থাকে না শ্রোতাদের । পেছনের সারি থেকে অনেকেই পানবিড়ির বিরতির জন্যে হল থেকে বেরিয়ে যায় ।

    এক ভদ্রলোক মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলছিলেন : বাংলাভাষা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষা । আহা, কথাটা যদি সত্য হত ! ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম : আপনি ক'টা ভাষা জানেন ? কথার সুরটা সম্ভবত পছন্দ হয়নি ওঁর । কপাল কুঁচকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন আমাকে : কেন ? বললাম : এমনি । শ্রেষ্ঠ ভাষা বললেন কিনা তাই । অনেকগুলো ভাষা জানলে তবেই তো বলা যায়, কোন্টা শ্রেষ্ঠ । বিরক্তি চাপবার ব্যর্থ চেষ্টা করে বললেন " অনেকগুলো ভাষা জানবার দরকার হয় না । বাঙালি মাত্রই জানে সেকথা । অনতিপ্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতটা এই যে আমি ভাল বাঙালি নই, যদি আদৌ বাঙালি হয়ে থাকি ।

    `শ্রেষ্ঠ' শব্দটার সঙ্গে আমাদের একটা আত্মার যোগ আছে । খুব ভাল লাগে ব্যবহার করতে । আরেক ভদ্রলোক কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলেন : আপনি নিশ্চয়ই জানেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি কে ।
    না জানি না, তবে শুনেছি ।
    সে আবার কেমন কথা । শুনেছেন অথচ জানেন না !
    কারণ শোনাটা কানের কাজ, জানাটা জ্ঞানের । আমার কান আছে, কিন্তু জ্ঞান হাজার বছরের ইতিহাস জানে না ।
    মনে হচ্ছে আপনি জরিপের ফলাফলটার সঙ্গে একমত নন !
    যারা জরিপের প্রশ্নে সাড়া দিয়েছেন তাদের মত জ্ঞানী আমি নই । সুতরাং একমত বা দ্বিমতের প্রশ্ন দাঁড়ায় না । আমার ব্যক্তিগত বিচারে গত হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হলেন আমার মা ।
    আপনার যা কথার নমুনা ! বলে ভদ্রলোক হনহন করে হেঁটে চলে গেলেন ।


    সম্প্রতি আমার একটা বই বেরিয়েছে । বইটার নাম বলছি না পাছে পাঠক সন্দেহ করে বসেন যে লেখার নাম করে আমি বিজ্ঞাপন ছাপাচ্ছি । আমার বই লোকে কেনে না । আমার বই তিনচার বছর গুদামে থাকার পর পোকাদের উপাদেয় খাদ্যে পরিণত হয় । আমার মত নো-নেইম লেখকদের বই খেয়ে খেয়ে বাংলাদেশের পোকাজাতি স্বাস্থ্যবান হয়ে উঠেছে । আমি বইমেলায় যাই না, প্রকাশনা উত্সব করি না, প্রমোশন সদরে গিয়ে মুগ্ধ পাঠকদের সদ্যক্রীত পুস্তকে নামসই করি না । আসলে বই লেখার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণই আমার নেই । আমি হলাম যাকে বলে সিনিয়ার সিটিজেন । সামান্য পেনশন থেকে যা কিছু পাই তাই দিয়ে কোনরকমে দিনযাপন করি । নিজের পয়সায় বই ছাপানোর মুরোদ আমার নেই । দুর্ভাগ্যবশত আমার অনুজতুল্য প্রকাশক লুত্ফুর রহমান চৌধুরী তার কষ্টার্জিত টাকাগুলো জলাঞ্জলি দেওয়ার জন্য বদ্ধপরিকর (ওটা নিশ্চয়ই কোনও অসুস্থ বাতিক তার), তাই বছরে দু'বছরে একটি দু'টি বই ছাপে আমার । অনেকটা তার প্রতি করুণাবশতই আমি টরন্টো এবং মন্ট্রিয়লের দুটি বইবিক্রেতার সাথে যোগাযোগ রেখেছি যাতে দয়া করে তারা আমার বইগুলোর স্থান করে দেয় তাদের তাকে । অন্যান্য শহরে যোগাযোগ করতে সাহস পাই না পাছে জিজ্ঞেস করে বসে : আপনি কে মশাই ? দেশ কোথায় ? টরন্টোর ভদ্রলোকটি খুব অমায়িক । সেদিন বললেন : আপনার ক'টা বই তো এখনো পড়ে আছে । অর্থাৎ বিক্রি হচ্ছে না, সুতরাং নতুন বই পাঠিয়ে লাভ কি । আমাকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে ভদ্রলোক এ'ও বললেন যে শুধু আমার বই নয়, কারুর বইই কেনে না লোকে । তাহলে কষ্ট করে দোকান খুললেন কেন । স্বাভাবিক প্রশ্ন । জবাব না দিয়ে একটু হাসলেন । বুঝলাম, আরেক পাগল বইয়ের দোকান খুলেছে টরন্টোতে । বাংলাদেশী প্রবাসীদের বাজারে যে বইয়ের ব্যবসা ভাল চলবে না সেটা বোধ হয় লোকটা বুঝতে পারেননি । এখানে হালাল মাংসের ব্যবসা চলবে । হিন্দী ছবি, ফোন কার্ড, দেশী মাছ, হিজাব, আলখেল্লা, আর আমিনী-সাঈদীর মত বড় বড় আলেখ উলামার ওয়াজ-তফসিরের সিডি-ক্যাসেট, এগুলোর জন্যে ক্রেতার অভাব হবে না । ক্রেতার অভাব হবে শিল্পীর আঁকা ছবির, বাংলা চলচ্চিত্রের, বাংলা গ্রন্থের, বিশেষ করে প্রবাসী লেখকদের রচিত গ্রন্থ । বই পড়ার অভ্যাসটা বাংলাদেশের ভেতরে কিছু কিছু গড়ে উঠলেও প্রবাসে তার আভাস খুব একটা দেখছি না । সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের বাড়িতে গেলে আসবাবপত্র বেশ দেখা যায়, বড় স্ক্রীনের টেলিভিশনতো অবশ্যই, ভিসিআর ডিভিডি না হলে তো আধুনিক জীবন অসম্ভব, ডিজিটাল ক্যামেরা, গোটা দুয়েক সেলফোন, ঢাকা কোলকাতার প্রোগ্রাম দেখার জন্য ব্যবস্থাও থাকতে হবে, টিনেজ ছেলেমেয়ে থাকলে কম্পিউটার না কিনে উপায় নেই, আর হ্যাঁ, প্রচুর হাঁড়ি পাতিল বাসনপত্র, এগুলো হল নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস । যা অনুপস্থিত তা হল বইপত্র । হ্যাঁ, হুমায়ুন আহমেদের কয়েকটা নভেল হয়ত আছে, আরবি-ফারসি-বাংলায় মেশানো গুটিকয়েক দীনিয়াত শেখার বই থাকা অস্বাভাবিক নয়, রন্ধনপ্রণালীর বই থাকলেও থাকতে পারে, ইংরেজি বই একেবারেই না, কবিতার বইয়ের প্রশ্নই ওঠে না । তাহলে বলুন এখানে বইয়ের দোকান চলবে কেন ।

    হাঁড়িপাতিলের কথা বলতে মনে পড়ল । এক ছাত্রনেতা সেদিন `সংক্ষিপ্ত বক্তব্য' রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আধঘন্টা যাবত তাঁর বাকপটুতার নিদর্শন রেখে গেলেন অবিশ্রাম ধারায় । প্রবাসের প্রাক্তন ছাত্রনেতাদের একটা বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয় -- তাঁরা দেশের আপামর জনসাধারণের দুরবস্থা নিয়ে অত্যন্ত চিন্তিত । সুযোগ পেলেই তাঁরা আবেগাপ্লুত, কম্পিত কন্ঠে উল্লেখ করেন : "দেশের লাখো লাখো জনতা অনাহারে অর্ধাহারে প্রতিদিন ধুঁকে ধুঁকে মরছে ....।" আসলে অনাহারে খুব বেশি লোক মরছে আজকাল, তেমন দাবি বিরোধীদলের নেতানেত্রীরাও করছেন না । অর্ধাহারে হয়ত ভুগছে কিছু মানুষ, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষদের ভোজবিলাসের যে নমুনা আমি প্রত্যক্ষ করে এলাম এবার তাতে মনে হয় অর্ধাহার ব্যাপারটি অন্তত স্বাস্থ্যের পক্ষে খুব ক্ষতিকর নয় । দেশের মধ্যবিত্ত সমাজে আজকাল অধিকাংশ মানুষ খেয়েই মরে, না খেয়ে নয় । এত বিশাল পরিমাণ খাদ্য যে তারা কেমন করে হজম করে জানি না । একটু বিত্তশীল পরিবারে গিয়ে দেখুন, সকাল ছ'টা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত পাকঘরে বিরতি বলে কিছু নেই । এরা সারাক্ষণই খাচ্ছে, এদের বাড়িতে সারাক্ষণই অতিথি আসছে, চাকরবাকরদের একমুহূর্ত বিশ্রাম নেই, ঘন্টায় ঘন্টায় নাস্তা দিচ্ছে চা দিচ্ছে খানা লাগাচ্ছে । এরা খাওয়ার পর ঘুমায়, ঘুমানোর পর আবার খায়, আড্ডা দেয়, ফোনে কথা বলে, টিভিতে খেলা দেখে বা নাটক দেখে, তারপর আরেকদফা `খানা লাগায়' । একজন প্রাপ্তবয়স্ক বাঙালি গড়ে দৈনিক কয়শ' গ্র্যাম চর্বি খায়, কয় আউন্স চিনি খায়, আর কত মণ কারবো সেবন করে তার পূর্ণ জরিপ কখনো হয়েছে কিনা জানি না, কিন্তু দেশে আজকাল হৃদরোগ, বহুমূত্র আর পাকস্থলীগত ব্যাধির মাত্রা যে অবিশ্বাস্য হারে বেড়ে গেছে তাতেই বোঝা যায় `খেয়ে খেয়ে মরা' কথাটার অর্থ কি । সুতরাং নেতাসাহেবদের অবগতির জন্যে বলতে হয় : "লাখো লাখো মানুষ অনাহারে মরছে না, মরছে অত্যাহারে ।" এবং মজার ব্যাপার যে প্রবাসেও তাদের এই জীবনধারায় বিন্দুমাত্র ছেদ ঘটেনি । বরং দ্বিগুণ উত্সাহের সঙ্গে পালন করতে পারছেন, কারণ তুলনামূলকভাবে একই জিনিস তারা অনেক সস্তায় কিনতে পারছেন এখানে । ফলে আজকাল বাংলাদেশী কোন পরিবারকে নিমন্ত্রণ করতে চাইলে দুতিনমাস আগে থেকে যোগাযোগ করতে হয়, কারণ তার আগের প্রতিটি উইকেণ্ডই তারা বুক্ড্‌, অর্থাৎ শুক্র, শনি, রবি তিনদিনই দাওয়াত -- হয় নিজের বাড়িতে নয় অন্যের । নয়তবা বিয়ের নিমন্ত্রণ, নাহয়, জন্মদিনের, নাহয় অন্নপ্রাশনের, আকিকার, বেবি শাওয়ারের, ব্রাইডেল শাওয়ারের, মিলাদের, ঈদের, পূজার (পার্বণের কি শেষ আছে ?) । এতসবের পর একটা মানুষের কি ধৈর্য থাকে না গায়ের শক্তি থাকে বইয়ের পাতা উল্টানোর ? তার ওপর উইকেণ্ডে রাত দু'টো তিনটে পর্যন্ত জাগতে হয় দোকান থেকে ভাড়া-করা নতুন হিন্দী ছবি দেখার জন্য । দূর দূর জায়গা থেকে আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধব আসে ছুটি কাটাতে, তাদের আপ্যায়ন করতে হয়, সাথে বসে গল্প করতে হয় । বই পড়ব কখন, বলুন তো ?

    সপ্তদশ শতাব্দীর বিখ্যাত ফরাসী বুদ্ধিজীবী রশফুকো সেকালের ফরাসীচরিত্রের ওপর কটাক্ষ করতে গিয়ে বলেছিলেন যে প্রতিবেশীর বিপদ দেখলে শত্রু ও মিত্র উভয়ই সমানভাবে পুলকিত হয় । কথাটা বর্তমান যুগের ফরাসী জাতির বেলায় প্রযোজ্য কিনা জানি না, তবে প্রায় প্রতিটি বাঙালিই মনে করেন যে এটা বাঙালিচরিত্রের সঙ্গে নিখুঁতভাবে মিলে যায় । এক বাঙালির দু:খ আরেক বাঙালিকে কিভাবে সুখ দেয়, তার বহু বিবরণ আমি বহুজনের মুখে শুনেছি (যদিও প্রতিটি বক্তাই নিজেকে তার ব্যতিক্রম বলে মনে করেন) । আসলে আমরা যাকে `আড্ডা' বলে অভিহিত করি এবং বাঙালি ঐতিহ্যের একটি গৌরবময় অংশ বলে ভাবতে দ্বিধাবোধ করি না তার মূল বিষয় হল পরচর্চা । পুরুষরা করে চায়ের দোকানে বা কমনরুমে, আর মেয়েরা করে কুয়োর ধারে, পুকুরপারে বা টেলিফোনে । আর পরচর্চা বলতে সচরাচর যেটা বোঝায় সেটা কারো প্রশংসা বা স্তুতিবাদ নয়, বোঝায় সহজ সরল পরনিন্দা । শত্রুমিত্র কিছু আসে যায় না । পরচর্চা/পরনিন্দা হল মুড়িমুড়কির মত -- সামনে থাকলে লোভ সামলানো যায় না । সেদিন এক বাংলাদেশী ভদ্রলোক হঠাৎ করে দেশে চলে গেলেন । আমি যতদূর জানি তাঁর দেশে যাওয়ার কারণ একান্ত ব্যক্তিগত, ব্যবসা-সংক্রান্ত ব্যাপারে । তার পরদিনই গুজবের কারখানা থেকে আনকোরা সংবাদ বেরিয়ে এল : ক্যানাডা সরকার তাকে সপরিবারে বহিষ্কার করে দিয়েছেন অভিবাসজনিত নানাবিধ অবৈধ কাজ করা অপরাধে । ঠিক সেদিনই তার স্ত্রী ও ছেলেদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা হল আমার, ঠিক অকই শহ্রে যেখান থেকে গুজবটির উত্পত্তি । আরেকটি গুজব শুনুন । আঠারো বছরের একটি মুসলমান মেয়ে বন্ধুর বাসায় দু'ঘন্টার জন্যে যাবে বলে বেরিয়ে রাতে ফেরেনি । কারণ, সন্ধ্যা থেকে তুমুল তুষারপাত, রাস্তায় গাড়ি চালানো বিপজ্জনক । ফোন করে বাবা-মাকে সে জানিয়ে দিয়েছিল যে বন্ধুর বাড়িতেই রাত কাটাবে । বন্ধুটি তারই সমবয়সী এক ইরানীয়ান মেয়ে, ভীষণ ভাল পরিবার তাদের । কিন্তু ভাল পরিবার আর তুষারঝড় কোন কৈফিয়তি যথেষ্ট নয় বাঙালি রসনার জন্যে । খবর ছড়িয়ে গেল যে মেয়েটি পালিয়ে গেছে এক বিদেশী যুবকের সঙ্গে (ভাল কথা, ক্যানাডার বাংলাদেশীরা নিজেদের `বিদেশী' মনে করে না, মনে করে ক্যানাডিয়ানরাই বিদেশী) । যত মিথ্যা গুজবই হোক তার একটা বিশ্রী স্বভাব যে একবার জিভের জল পেলে আঠার মত লেগে থাকে । ওই মেয়েটি শেষ পর্যন্ত শহর ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছিল । নইলে তার জীবন অতিষ্ঠ করে ফেলত লোকে ।

    আসলে কি জানেন, আমি নিজেও তো বাঙালি । সুতরাং এতক্ষণ যে এত কথা বললাম বাঙালি সম্বন্ধে, তা'ও ঠিক একই কারণে । বাঙালি বলেই । আমার মনের কোনও গোপন কোণে এমন একটা ধারণা বাসা বেঁধেছে যে আমি যাই বলি না কেন বাঙালি নিয়ে, আমি অন্যদের চেয়ে আলাদা বলেই বলি । অর্থাৎ আমি বাঙালি হলেও ব্যতিক্রম বাঙালি । এই আরেকটা বৈশিষ্ট্য আমাদের । আমরা সবাই ব্যতিক্রম বাঙালি । কোনও অনুষ্ঠান বা নিমন্ত্রণে যত দেরি করেই যাই না কেন, যাওয়ার পর বাঙালির সময়জ্ঞান নিয়ে হাসিঠাট্টা করতে আমার মোটেও বাধবে না । অথচ ঘটনা এই যে কোথাও যথাসময়ে উপস্থিত হওয়াটা স্বাভাবিক বাঙালির জন্যে মহাবিস্ময়ের ব্যাপার -- ভাববে, লোকটার মাথায় গণ্ডগোল নেই তো ! দেরি করাটা শুধু ঐতিহ্য নয় আমাদের, মহান সংস্কৃতিরই একটা অংশবিশেষ । সেদিন এক অনুষ্ঠানে যেতে হয়েছিল যা শুরু হওয়ার কথা ছিল বিকেল পাঁচটায় । আয়োজকদের একজন আমাকে গাড়ি করে নিয়ে গেলেন ছ'টায় । গিয়ে দেখি আমরাই প্রথম । ঠাট্টা করে বললাম, সাতটার আগে শুরু হলে আমার হার্ট ফেল করবে । সৌভাগ্যবশত হার্টের কিছু হয়নি, কারণ অনুষ্ঠান শুরু হল যখন ঘড়িতে বাজে সাতটা দশ । এবং এতে কারো মুখে কোনরকম বিরক্তি বা অসন্তোষ ভাব দেখা গেল না । যা স্বত:সিদ্ধ তাই স্বাভাবিক !

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments