ইতিহাসের অবসান ঘোষণার পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ায় সত্য-প্রগতি ভাবাদর্শের মৃত্যু নিয়ে গত দু'দশকে যথেষ্ট ছদ্ম-গম্ভীর শোকপ্রস্তাব লেখা হয়েছে । প্রবলভাবে ভাসমান সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে কোথাও কোনও কিছুর পারম্পর্য নেই, প্রাসঙ্গিকতাও নেই । অতএব মৃত্যু ঘটে গেছে উপন্যাসের, কাহিনির, আখ্যানের, বয়ানের । দেরিতে হলেও আধুনিকোত্তর নির্মাণবায়নের বার্তা পৌঁছে গেছে প্রতিষ্ঠান-পুষ্ট বাংলা সাহিত্যের `সরকারি' মহলে । পচনের উত্সব দিনদিন সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছে তাই । এই সর্বব্যাপ্ত আঁধি, পণ্যায়নের কুহক ও কাণ্ডজ্ঞানশূন্য আত্মবিস্মৃতির মাদকের মুখোমুখি হয়ে নবারুণ ভট্টাচার্য যেন পাল্টা আঁধি-কুহক-বাচনিক মাদক দিয়ে নতুন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে চেয়েছেন । `কাঙাল মালসাট' এর প্রতিবেদন তাই হয়ে উঠেছে প্রত্যাঘাতের প্রতিনন্দন ও প্রতিসন্দর্ভ । নইলে সন্দর্ভ ও নন্দনের নামে প্রচলিত নিশিছদ্র মিথ্যা ও বিকারের প্রতি রঙ্গ-ব্যঙ্গ-কার্নিভালের এমন ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষিপ্ত হতে পারত না । নবারুণ বিচিত্র উত্স-জাত অন্তর্বয়নের সূক্ষ্ম ও অরৈখিক সমাবেশকে ব্যবহার করেছেন বিধ্বংসী বিস্ফোরকের মতো । এপ্রসঙ্গে পশ্চিমের বিখ্যাত আখ্যান ভাবুক জে. হিলিস মিলেরের মন্তব্য মনে পড়ে : 'ঝী ঞচ্ং ত্ঠঞংশছশষ্ গধশূ ঠয গঠঞচ্ঠত্র ঠঞযংত্ংঈ ধৃংত্র, চ্ংঞংশধভংত্রংধণ্ণয, ছ রুঠছত্ধভণ্ণং ধী বধত্রীত্ঠবঞঠত্রভ টধঠবংয, ঠঞ ঠয ছত্যধ যংংত্র ছয ধৃংত্র ঞধ ধঞচ্ংশ ঞংন্ঞয, ংঋংশস্ংছঢত্ং ঞধ ঞচ্ংস্, ংঋংশস্ংছঞংরু ঢষ্ ঞচ্ংস্. ংই ত্ঠঞংশছশষ্ ঞংন্ঞ ঠয ত্রধঞ ছ ঞচ্ঠত্রভ ঠত্র ঠঞযংত্ংঈ, ধশভছত্রঠবছত্ত্ষ্ ণ্ণত্রঠীঠংরু, ঢণ্ণঞ ছ শংত্ছঞঠধত্র ঞধ ধঞচ্ংশ ঞংন্ঞয গচ্ঠবচ্ ছশং শংত্ছঞঠধত্রয ঠত্র ঞচ্ংঠশ ঞণ্ণশত্র. মচ্ং যঞণ্ণরুষ্ ধী ত্ঠঞংশছঞণ্ণশং ঠয ঞচ্ংশংংঈধশং ঞচ্ং যঞণ্ণরুষ্ ধী ঠত্রঞংশঞংন্ঞণ্ণছত্ঠঞষ্.' (১৯৮০:৫২৩)
এই যে পাঠকৃতির নিজেরই ভেতরে সব দিক খুলে যাওয়া, নানাধরনের সংঘর্ষময় স্বরের সমাবেশ এবং অন্তহীন অন্তর্বয়নের গ্রন্থনা : এসমস্ত কত তির্যক ও শ্লেষার্দ্র হতে পারে তা `কাঙাল মালসাট' অভিনব ভাবে দেখিয়েছে । কী বলব এই রচনাকে, উপন্যাস-পাঠের প্রচলিত ধাঁচ দিয়ে তো ঠিক করতে পারি না । বরং, ভাবতে ইচ্ছে করে, কমলকুমার মজুমদার যেমন ভাষাকে আক্রমণ করেই ভাষাকে সৃষ্টিশীল উদ্যমের জন্যে বাঁচিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন, তেমনই অভ্যাসে-মিথ্যায়-প্রসাধনে জীর্ণ বাস্তবকে আক্রমণ করে নবারুণ সৃজনী বাস্তবকে পুনর্জীবিত করতে চেয়েছেন । যা-কিছু ঘটেছে বয়ানে, সমস্তই পরিকল্পনা মাফিক । কাহিনির বিন্যাসে জড়িয়ে পড়তে পড়তে `কাঙাল মালসাট' হয়ে উঠেছে এক অনবদ্য গোলমেলে অভিজ্ঞতা -- এরকম জানানো হয়েছে যদিও আসলে পাঠকৃতিকে অনুক্ষণ শাসন করেছে প্রতিপাঠকৃতি । আর, পদে পদে কাহিনির বিন্যাসকে মনে হয় নির্মোক, যা মূলত প্রতিন্যাসের প্রকাশকে আড়াল করতে চেয়েছে । নবারুণের কাছে বাস্তব মিথ্যায় আক্রান্ত বলেই তাকে প্রতি-আক্রমণ করা ছাড়া অন্য উপায় নেই । তাছাড়া প্রতিষ্ঠানিক সরকারি প্রতিবেদনের স্থায়ী অবলম্বনকে সিংহাসন-চ্যুত করার জন্যে বেসরকারি বয়ানকে যতটা সম্ভব শাণিত করতে চান নবারুণ । তাঁর বাচন অনুযায়ী `ইতিহাস সম্বন্ধে ট্র্যাজিকমিক বোধ জাগ্রত করার জন্য'-ই (পৃ ৮৫) মূলত কার্নিভালের শ্লেষকে তীক্ষণ ও উতরোল করে তোলা হয়েছে । অতএব ভাষার মধ্যে সর্বত্র মিশে গেছে খিস্তি, আদিরসাশ্রিত অশিষ্ট বাক্ভঙ্গি, অপভাষা । কখনও কখনও মনে হয় বুঝি বা বাতেইলের (
পরিচিত পৃথিবীকে অপরিচিতীকৃত হতে দেখি বারবার । এটা স্পষ্টত নবারুণের রণকৌশল কেননা পাঠকৃতি তাঁর কাছে যুদ্ধক্ষেত্র যেখানে সমকালীন পরিসরের ত্রক্রনোটোপ থেকে বিচ্ছুরিত হয় সামাজিক স্থিতাবস্থা ও রাজনৈতিক প্রতাপের প্রতি তীব্র ব্যঙ্গ । কাহিনির প্রতিন্যাসে যতটুকু পারম্পর্যের আভাস দেওয়া সম্ভব, নবারুণ দিয়েছেন । কিন্তু তাঁর অভিনিবেশ অন্তর্বয়নের অন্তহীন গ্রন্থনায় । বাস্তব যখন প্রহসনে পরিণত, কার্নিভালের প্রচ্ছন্ন ও প্রকাশ্য হাসি ছাড়া অন্য কোনোভাবে তার মোকাবিলা করার কথা ভাবেননি নবারুণ । অসংখ্য দৃষ্টান্ত থেকে আপাতত এই একটি বেছে নিচ্ছি :
`হলদিয়া পেট্রোকেমিকেল কেন লাটে উঠছে তা বুঝতে হলে এই ঘটনাটিকে ধরেই এগোতে হবে । এখানেই রয়েছে ভাইট্যাল ক্লু । এর বেশি বলা বারণ আছে । কারণ আলিমুদ্দিনে খবরটা গেলেই গেঁতো গবরমেন্ট নড়েচড়ে বসতে পারে । সে হ্যাপা সামলানো `কাঙাল মালসাট'এর ধকে কুলোবে না । অবশ্য এতক্ষণে নিশ্চয়ই রটে গেছে যে আমরা আনন্দবাজার বা সি. পি. এম. অথবা তৃণমূল কিংবা ঘাড়ভাঙা কংগ্রেস কোনো মালকেই খচাতে চাই না । কিন্তু নিজে নিজে, আপন গরজে কেউ যদি খচিয়ান হয়ে ওঠে আমাদের কিছুই করার নেই ।' (পৃ ৮৫) তাহলে কি নিজস্ব ধরনে উপন্যাসের মৃত্যু ঘোষণা করছেন নবারুণ ? আসলে, অবসান হয়ে গেছে তো উদ্দেশ্যেরও । অতএব আপাত-অসংলগ্ন অনুষঙ্গপুঞ্জের বিন্যাসে প্রাতিষ্ঠানিক ঔপন্যাসিকতাকে কখনও ব্যঙ্গবিদ্ধ করে, কখনও ট্র্যাজিকমিক বোধের বিস্তারে কখনও বা বিস্ফোরণে দীর্ণ করে সোচ্চার প্রত্যাখ্যানই তো আমাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন ।
এই প্রত্যাখ্যান এতদূর অবধি গেছে যে স্বয়ং লেখক নিজেকেই `টেক্সচ্যুয়্যাল প্লে'-র সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছেন । বিনির্মাণ পন্থায় এ তাঁর নিজস্ব সংযোজন । এমনও ভাবতে পারি, নবারুণ কৌশলে তাঁর লেখকসত্তাকে নিজের থেকে স্বতন্ত্র করে নিয়েছেন যাতে তাঁর পাঠকৃতিও কার্নিভালের আবহে সম্পৃক্ত হয়ে যায় । দশম পরিচ্ছেদের প্রথম অনুচ্ছেদটি এই নিরিখে বিশেষভাবে লক্ষণীয় :
`দশ ও দেশের মুখোজ্জ্বল করার অভিসন্ধি নিয়েই `কাঙাল মালসাট' শুরু হয়েছিল কিন্তু গত অধ্যায় বা কিস্তিটা ছাপার সময় ভূতের খপ্পর কাকে বলে তা বোধগম্য হল । গোটা ব্যাপারটার মধ্যে মানুষের কোনো হাত নেই । প্রথম প্রুফ যেই এল তখনই নজরে পড়ল যে শেষে যেখানে (চলবে) বলা থাকে সেখানে বেরিয়েছে (চলবে না) । সংশোধনের পরেও সেই আশাভঙ্গকারী `না' । কম্পিউটারের মাউস বা ক্যাট কেউই বাঁদরামি করছে না, তারা শুদ্ধ, ভাইরাসমুক্ত এবং যে পত্রিকায় এক এক পক্কড় করে ধরাশয়ী হচ্ছে সেখানেও কুচোকাচা কেউ ঢ্যামনামি করেনি । (চলবে না)-এর চেয়ে বরং ঢলবে না, টলবে না হলেও মুখরক্ষে হত কিন্তু (চলবে না) অবশ্যই অপমানজনক । লেখকের মধ্যে তখন খুবই প্রাকৃতিক ভাবের মতো যে উপলব্ধি পাওনা হল তা হল এ নিশ্চয়ই সম্পাদকের হারামিপনা । হয়তো তা প্রমাণিতও হত । এই নিয়ে বাদানুবাদের সময় সম্পাদক বরং শেষমেশ অপারগ হয়েই লেখকের দিকে পাণ্ডুলিপির জেরক্স ছুঁড়ে দিয়ে বলল - এটা কি আমার বাপের হাতের লেখা ? লেখকের নিজেরই লেখা । অবিকল সেই হস্তাক্ষরে, নির্ভুল বানানে লেখা - (চলবে না)। সম্পাদকের কবুলতি হল চলুক বা না চলুক -- কিছুতেই তার এক গাছাও ছেঁড়া যায় না । একই মত লেখকেরও । একই রকম গোঁ সব শালারই । রহস্য সায়ার মতোই রহস্যময়ী । আসল কারণ কেউই জানে না । প্রেতলোক অনেক সময়ই অটোমেটিক রাইটিং বা ওই জাতীয় কোনো ছলের আশ্রয় নিয়ে অপরিবর্তনীয় ভবিষ্যতের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে । কিন্তু মানুষের ধাতে ভূতের নির্দেশ মানার কোনো সদিচ্ছা নেই । অবধারিত নিয়তি এভাবেই নির্জন জলার কাছে, আলেয়ার হাপসু গ্যাসালো আলোর নিকটস্থ নীরবে অপেক্ষারত, দক্ষ ঠ্যাঙাড়ের সান্নিধ্যে ভ্রাম্যমাণ পথিকবরকে নিয়ে যায় । ...' (পৃ ৮৪)
এ প্রসঙ্গে বাখতিনের (
এই প্রতিসন্দর্ভের প্রারম্ভিক কয়েকটি বাক্য স্পষ্ট সংকেত দেয় যে বাংলা আখ্যানকে আমূল বিনির্মাণ করার জন্যেই রচিত হচ্ছে `কাঙাল মালসাট' : `কাতার দিয়ে কাটামুণ্ডু আদিগঙ্গার পাড়ে গড়াগড়ি যাচ্ছে । অর্থাৎ রাতে ভয়াবহ কিছু ঘটেছে । বস্তাকরে মুণ্ডুগুলো ডাঁই করে রেখে সটকেছে ? ধড়গুলোর তা হলে কী হলো ? কুপিয়ে কাটা না পোঁচ দিয়ে দিয়ে মুণ্ডুগুলো কি ব্যাটা ছেলের না ফিমেল এরকমই ছিল একটি ভাষ্য । অপরটি হলো সাইক্লোন জনিত ঘোলাটে আকাশের তলায় খলবলিয়ে মাথার খুলি নাচছে । আগে অনেকগুলি নাচছিল । কিন্তু যেই পুলিশ এলো অমনি বাকিগুলো ভ্যানিশ হয়ে মাত্র তিনটে রইল । আর পুলিশ যখন ভাবছে পা বাড়াবে কি বাড়াবে না, নতুন কোনো কেচ্ছায় জড়িয়ে পড়ার মন্দভালো সাত পাঁচ ঠিক সেই সময় ঐ তিনটে খুলিও মুচকি হেসে উদ্বেল জোয়ারে লোপাট হয়ে গেলো ।' (পৃ: ৭)
এইটুকু পড়ে পাঠক খানিকটা ভ্যাবাচাকা খেতেই পারেন । কিন্তু একটু পরেই তাঁর মনে হবে যে এই সব আপাতঅর্থহীন বাক্বিন্যাসে প্রথমেই নিরাকৃত হয়ে গেছে বাস্তব । আর, বাচনের পরিসরের দখল নিয়েছে কিমিতিবাদী প্রতিন্যাস । একটু পরেই নবারুণ জানিয়েছেন ঘটনাটি ঘটেছিল ২৮ অক্টোবর ১৯৯৯ -- শুধু তারিখটা মনে রাখতে হবে । আগে থেকে সব জেনে যারা ঘটনা এলে সেই পরিচিত হাসিটি হাসে তাদের গেঁড়ে-মদনা না বলার কোনো কারণ আছে কি?' (তদেব) এই যে সুনির্দ্দিষ্ট তারিখ বলে দেওয়া হলো, এও কিন্তু লেখকের রণকৌশলের অঙ্গ । অবিশ্বাস্য ও অনির্দ্দেশ্যকে তিনি বিশ্বাস্য বা নির্দিষ্ট করতে চান না ; শুধু করার ভানটুকু করে পাঠককে সযত্নরচিত আলোআধাঁরির দিকে নিয়ে যেতে চান । অপশব্দ ব্যবহারের সূত্রপাত করে তিনি ভাষার তথাকথিত আভিজাত্যকেও প্রত্যাহ্বান জানিয়েছেন ।
ত্রক্রমশ আমাদের সামনে উন্মোচিত হয় ন্যায়-পরম্পরা বহির্ভূত উল্লম্ফন- ঘটনাবিহীন ঘটনার এবং পারম্পর্য-বিহীন কথা-পরম্পরার । তাই কালীপ্রসন্ন কাব্য বিশারদ ও সত্যেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রসঙ্গ অনায়াসে জুড়ে যায় খুলি-ডান্সের অনুষ্ঠান-কথায় । এবং, ঠিক এর পরে উথ্থাপিত হয় রবিবাসরীয় আনন্দবাজারে যাদুকর আনন্দের বিজ্ঞাপন-প্রসঙ্গ ।
॥ তিন ॥
আনন্দবাজার পত্রিকার বিশাল সব হোর্ডিং-এ লেখা থাকে : `আনন্দবাজার পড়তে হয়, নইলে পিছিয়ে পড়তে হয় ।' একে একটু চিমটি কেটে লিখেছেন নবারুণ ; `এইটুকু বুদ্ধি আমাদের হয়েছে যে পিছিয়ে পড়ার চাইতে পা পিছলে আছাড় খেয়ে পড়াও ভাল ।' (পৃ ৮) `কাঙাল মালসাট'-এ কথার সঙ্গে হরফেরও বড়ো ভূমিকা রয়েছে । তাই যাদুকর আনন্দের বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছে মোটা হরফে এবং ভাষাতেও রয়েছে সূক্ষ্ম মোচড় । পাঠক লক্ষ করেন, চকিত ইশারায় স্বয়ং কথাকার আমাদের ধরিয়ে দিয়েছেন ম্যাজিক রিয়্যালিজম বা ঐন্দ্রজালিক বাস্তবতাবাদের সূত্র : `ভোজবাজির চেয়েও রহস্যমণ্ডিত এই কাকতালীয় কাণ্ড । ... ম্যাজিকের কি এই তবে শুরু ?' (তদেব) কিন্তু কার্নিভালের মেজাজে ব্যঙ্গের হুল ফুটিয়ে সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদকে উত্যক্ত ও হাস্যকর প্রতিপন্ন করা যে তার প্রকৃত অভিপ্রায়, তা সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট হয়ে যায় : `এর পরেই সন্দিগ্ধ মনে যে ফ্যাকড়া ত্রক্রমেই আস্তানা গাড়ে তা হল নামের এই মিল অর্থাৎ যাদুকর আনন্দ ও আনন্দবাজার পত্রিকা -- আনন্দের ভেতরে আনন্দ -- একি নিছকই ভবেশ্বরের খেলা না পিশাচসিদ্ধ হেঁয়ালি না ঘোমটাপরা ওই ছায়ার মায়াময় হাতছানি তবে আমাদের মনের এই ফ্যাকড়াকে কেউ যেন আনন্দবাজার পত্রিকার মতো সুমহান প্রতিষ্ঠানের পেছনে কাঠি করার অপচেষ্টা বলে না ভাবেন । দুইহাতে সংবাদ ও সাহিত্যের মন্দিরা যে প্রতিষ্ঠান নিয়তই বাজিয়ে চলেছে তার পোঙায় লাগতে যাওয়া মোটেই ফলপ্রসূ হতে পারে না । উল্টে হুলো হয়ে যেতে পারে ।' (তদেব) উপন্যাসের অবসান সূচিত করার জন্যেই কি এরকম প্রতিবাচন ব্যবহৃত হলো ? অথবা, কথাটা একটুখানি ঘুরিয়ে দিয়ে লিখব, অবসান যাতে সূচিত হয় সেইজন্যেই প্রতিভাষার এই আমোদ ! কোনো কাহিনি নেই লেখকের কেননা কাহিনিকে ধরে রাখার মতো বাস্তবও নেই কোথাও । চারদিকে যখন প্রকট স্টিফেন কনোর কথিত
সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতিটি ক্ষেত্রে যখন আধিপত্যবাদের বিদূষণ ও ক্ষয়ের সংক্রমণ চূড়ান্ত, রাষ্ট্র-পৌর সমাজ-রাজনৈতিক ব্যবস্থা-বৌদ্ধিক সমাজ নিজেদের অন্ত:সারশূণ্যতা ও ইতরতায় আত্মঘাতী -- `কাঙাল মালসাট' পক্ষপাতহীন কার্নিভাল দিয়ে সর্বব্যাপ্ত নগ্নতাকে উদ্ঘাটিত করেছে । অনেকদিন আগে গিয়র্গ লুকাচ জেম্স্ জয়েসের `ইউলিসিস'-এ যা লক্ষ করেছিলেন, তা যেন হুবহু প্রযোজ্য নবারুণের প্রতিসন্দর্ভ সম্পর্কেও :
ফলে নির্দ্বিধায় প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে যেতে পারেন নবারুণ । ভাষাতেও মিশিয়ে দিতে পারেন খিস্তি-খেউড় ও নিচুতলার অপভাষা, তত্সম ও দেশি শব্দ, ইংরেজি ও হিন্দি, হুল্লোড়ে পদ্য ও ছম-ইতিহাসের আধা-খ্যাঁচড়া বিন্যাস । আর, আগাগোড়া বজায় রাখেন শ্লেষ ও কৌতুকের, প্যারডি ও স্যাটায়ারের বিচিত্র ভঙ্গি । যেমন, দুই হাতে সংবাদ ও সাহিত্যের মন্দিরা বাজানো প্রতিষ্ঠানকে বিরক্ত করলে কীভাবে হুলো হয়ে যেতে পারে, তার দৃষ্টান্ত এরকম : `এই হুলো কী বস্তু তার একটি টিপিকাল কেস হলো মি: বি. কে. দাস এর জীবন । ঘটনাটি আনন্দবাজার পত্রিকার সঙ্গে কোনোমতেই জড়িত নয় ।' (পৃ ৮) এই বাক্ভঙ্গি, বলা ভালো বাক্চাতুর্য, যেন
দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরা যায় এই অংশটুকু : `এখান থেকে লেনিনীয় নির্দেশে এক পা আগে-র পরে যদি দুই পা পিছোনো যায় তাহলে সেই আনন্দবাজার প্রসঙ্গ পাওয়া যাবে । আমাদের সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত এমনই হওয়া বরং শ্রেয় যে আনন্দবাজার পত্রিকা ও ম্যাজিসিয়ান মি: আনন্দ আলাদা, দুই এরই কক্ষপথ ভিন্ন, ডি এন এ ইত্যাদি দুরূহ ছকে গঙ্গা গঙ্গা ফাঁক অতএব একটিকে খপ করে ধরে ক্লোন করলে অন্যটি হবে না । ... তবে একথা না বলা বোধহয় অন্যায় হবে যে আনন্দবাজার না থাকলে মুষ্টিমেয় যে কয়জন বাঙালি লেখক মালদার হয়ে উঠেছেন তাঁদেরও এতটা ফুলে ফেঁপে ওঠা সাধ্যে কুলাতো না । হাতে হ্যারিকেন হয়ে যেত । বাঙালিদের মধ্যে কিন্তু হ্যারিকেন হাতে লেখকের ঘাটতি নেই । সাধারণ রঙ্গালয়ের গোড়ার দিকে যে মাদী ও মদ্দারা থিয়েটারে ভিড়ত তাদের সম্বন্ধে রসরাজ অমৃতলাল বসু যা লিখেছিলেন তা হ্যারিকেন হাতে লেখকদের ক্ষেত্রেও খেটে যাচ্ছে,
নিজ পরিবার মাঝে বিরক্তিকারণ ।
এমন প্রতিসন্দর্ভ আপাত-ভাবে স্বত:স্ফূর্ত, প্রায় স্বয়ংক্রিয় লিখন-কৌশলের ফসল, বলে মনে হলেও আসলে কিন্তু সুপরিকল্পিত । নইলে এ ধরনের উল্লেখ অন্তর্বয়ন হিসেবে পাঠকৃতিতে বারবার ব্যবহৃত হয় না ; গদ্যের রৈখিকতায়
কথাকার স্বজাতিকে রেয়াত করেননি : `তার (বাঙালির) জিনগত অভ্যাসই হল আলুথালু হয়ে হাঁউমাঁউ করা পরক্ষণেই পাল্টি খেয়ে দাঁত ক্যালানো । এই প্যাটার্ন অ-বাঙালী অর্থাৎ নাগা, রুশ, জার্মান বা হাবসি ইত্যাদির মধ্যে দেখা যায় না ।' (পৃ ১০) কিংবা `আজ কলকাতায় যখন বইমেলা হয় তখন আনন্দ পাবলিশার্স-এর সামনে বাঙালি যেভাবে দীর্ঘ লাইন লাগায় তা দেখলে মনে হয় আহা ! এমন একটি নয়নাভিরাম দৃশ্য যদি রবীন্দ্রনাথ দেখতেন তাহলে তাঁর কি সাতিশয় আনন্দই না হত !' (পৃ ১১) বয়ানে সামান্য এগিয়ে (যদিও কার্যত এতে এগোনো-পিছোনো বলে কিছু নেই), দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের শুরুতে পাচ্ছি : `একটা হাঙ্গাম ভালো করিয়া থামিতে না থামিতে আবার একটা হাঙ্গাম আরম্ভ হইত । বাংলার এ এক মহান ঐতিহ্য । ১৯৯৯-এর শেষ দিকটায় সেই একই কেলো । ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া ও চলচ্চিত্র উত্সবের রণবাদ্য শেষ হতে না হতে বাস চাপা ও বাস জ্বালানোর দামামা বেজে উঠল । ফাঁকফোঁকরে কিছু কিডন্যাপ, কবিতা উত্সব, মার্ডার আর তহবিল তছরুপের টুকটাক প্রোগ্রাম । এইসব থিতোতে না থিতোতে বিশ্ববঙ্গ সম্মেলনের বিউগল ও ব্যাগপাইপ । বাজারে কানাঘুষো নতুন ইংরেজি বছর অবিরাম কেক-ভক্ষণ প্রতিযোগিতা দিয়ে শুরু হলেও আচমকা নাকি অন্যদিকে মোড় নেবে ।' (পৃ ১৩) প্রতিটি ক্ষেত্রে ভাষার বিন্যাসেই স্পষ্ট যে কোনও ধরনের গাল-গল্প বা বিবরণের চমক ঈপ্সিত নয় । চারপাশের পৃথিবী সম্পর্কে পক্ষপাতহীন ভাবে তির্যক দৃষ্টির বিচ্ছুরণ ঘটানোই কথাকারের অন্বিষ্ট । যেহেতু সার্বিক কার্নিভালের আবহ ছাড়া এই প্রক্রিয়ায় নতুন মাত্রা যোগ করা যায় না, `কাঙাল মালসাট' জুড়ে চূড়ান্ত অরৈখিকতার প্রাধান্য । এইজন্যে বোক্তার -- ফ্যাতাড়ুদের অভাবনীয় উপস্থাপন । মানুষে-ভূতে-পাখিতে মিশে এমন ধুন্ধুমার যে যুক্তি ও যৌক্তিকতা বহুদূরে নির্বাসিত ।
আখ্যান-বিহীন এই আখ্যানের প্রচ্ছদ লিপিতে ঠিকই জানানো হয়েছে : `এ এমনই জগৎ যেখানে চারপাশের সবকিছু, সমস্তই অচেনা, অথচ ভীষণ পরিচিত ।' ঘটনা-পরম্পরা যেহেতু অবান্তর হয়ে গেছে, কী কী ঘটলেও ঘটতে পারে, সেইসব সম্ভাব্য অসম্ভবের গ্রন্থনায় গড়ে উঠেছে এই প্রতিসন্দর্ভ । একথা আমাদের মানতে অসুবিধা হয় না : `বাংলা সাহিত্যে ফ্যাতাড়ুদের আবির্ভাব এক মহা চমকপ্রদ ঘটনা । ইতিপূর্বে সুমহান সুপ্রাচীন এই সাহিত্যের ধারায় হেসে খেলে, নেচে গেয়ে অবলীলায় যেসব পাহাড়-প্রমাণ চরিত্ররা তাদের অস্তিত্ব সগৌরবে ঘোষণা করেছেন তাদের সঙ্গে ফ্যাতাড়ুদের আবির্ভাব গৌরবের নাকি ভয়ের, আমাদের নাকি ডুকরে কেঁদে ওঠার এ-বিষয়ে কোনও স্থির সিদ্ধান্তে আমরা এখনও উপনীত হতে পারিনি । কবিবর পুরন্দরের সঙ্গে ডি. এস. এবং মদনের ত্রিমাত্রিক সম্পর্কের যে আঁচে পাঠককুল এতদিন ঝলসাচ্ছিলেন এই উপন্যাসে তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চোক্তার ভদি, বেচামনি, বড়িলাল, বেগম জনসন, কমরেড আচার্য এবং অন্যান্যদের সঙ্গে এক বৃহৎ দণ্ডবায়স ।' দণ্ডবায়স অর্থাৎ দাঁড়কাকও এই বিচিত্র বয়ানে বিচিত্রতর ভূমিকা নিয়েছে !
এদের নামকরণ সম্পর্কে একটু আগে যেমন লিখেছি, সেই অনুযায়ী সেই পৃথিবীর এইসব বাসিন্দাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনুপুঙ্খগুলিতেও অধিবাস্তবের একাধিপত্য । সুরের প্রাথমিক বিস্তারের পরে যেমন কথার আভাস পাওয়া যায় ধ্রুপদী সঙ্গীতে, তেমনি শৃঙ্খলাবিহীন শৃঙ্খলার ইঙ্গিত দেওয়ার পরেই উদ্ভট পরিস্থিতিতে চোক্তার ভদির মুখোমুখি হই আমরা । তেমনি নলেন এবং বেচামনি । ভাবা যায়, কোনও বাংলা উপন্যাসের নায়িকার সঙ্গে যখন প্রথম পরিচিত হচ্ছি আমরা, তখন সে পাইখানায় রয়েছে ? অদ্ভুতুড়ে কার্যকলাপকে বিশ্বাস্য করে তোলার ভঙ্গি হিসেবে সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ বলে দেওয়া হচ্ছে : `২৪ অক্টোবর, রবিবার, সকালে এমনটি-ই হয়েছিল ।' (পৃ ১২) যাদুকর আনন্দর পূর্ব-কথিত বিজ্ঞাপন যেন নিগূঢ় নির্দেশনামা । এরপরই আসে শীতের কবিতার হাস্যকর স্যাম্পল এবং পুরোনো বাংলা রহস্য-উপন্যাসের ধরণে কিছু প্রশ্নের উপস্থাপনা । ত্রক্রমশ বড়িলাল এসে যায় বয়ানে এবং হাস্যকর উপস্থাপনার সূত্রেই তাকে অনুসরণ করে পাঠক কেওড়াতলা শ্মশানে পৌঁছে যান ।
তবে কার্নিভাল বিশেষ ভাবে প্রকট হয় তিনজন ফ্যাতাড়ুর সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের মুহূর্তে : `ঘাটের ইধারে বসার রোয়াক । বাঁ দিকটাতে তিনজন বসেছিল একজন ঢ্যাঙা, একজন বেঁটে-মোটা, আর তিন নম্বরকে দেখলেই বোঝা যায় পাজামাখ্যাঁচা । ---- এই ফাঁকে বলে নেওয়া যাক্ যে, বাঁদিকের তিনজন হলো ফ্যাতাড়ু যারা গোপন একটি মন্ত্রের বলে উড়তে পারে এবং নানাধরনের অনুষ্ঠান বা সুখের সংসারে ব্যাগড়া দিয়ে থাকে । -- ঢ্যাঙা মালটা হলো মদন । ওর ফলস্ দাঁত পকেটে থাকে । বেঁটে-কালো-মোটাটা হলো ডি. এস । ঐ নামে একটি হুইস্কি আছে ডিরেক্টর স্পেশাল । -- তিননম্বর স্যাম্পেলটা হলো কবি পুরন্দর ভাট । এরা মোটের ওপরে আমোদ গেঁড়ে' (পৃ ১৭) এবং এরপরেই চূড়ান্ত হাস্যকর একটি কবিতার স্যাম্পেলে কৌতুকই প্রাধান্য পায় । স্বভাবত এদের বাক্-ব্যবহারে কিংবা উপস্থাপনায় অপভাষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে । এদের অনুসরণ করে আমরা পৌঁছে যাই ভদি ও বেচামনির কার্নিভালে ।
তবে নবারুণ রৈখিকতা পছন্দ করেন না বলে আমোদের নতুন পর্যায়ে পৌঁছানোর আগে গম্ভীর কথার অবতারণা করেছেন তৃতীয় পরিচ্ছেদের সূচনায় :
`গিরিন্দ্রশেখর স্বপ্নের জগৎ থেকে সুষুপ্তির জগতে নির্বাসিত । যেমন নির্বাসিত দক্ষিণারঞ্জন, ধনগোপাল, হেমেন্দ্রকুমার, সুনির্মল, খগেন্দ্রনাথ, সুখলতা ও খ্যাত-অখ্যাত শত শত সাহিত্যিক যারা শিশুদের জন্য লিখতেন । এখন সাহিত্যিক শিশুদের যুগ । ছোটরা কেবলই ফেলুদা বা টিনটিন পড়ে । বাপ-মা গুলোও অগা । ছোটবেলা থেকে হাই প্রোটিন, ব্রেনোলিয়া, সুলভ ব্রয়লার, কেলগ ইত্যাদি গিলে অকালেই কেঁদো কেঁদো হয়ে ওঠে । তারপরই দেখা যায় হয় কম্পিউটার শিখছে বা লুচ্চামি । বিগ বং-এর বাচ্চারা হাঁদা-ভোঁদা, নন্টে-ফন্টে, বাঁটুল দি গ্রেট এমন কী চেঙা-বেঙা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অনবহিত । ছোটবেলা থেকেই এত স্বার্থপর ও খচ্চর অন্য কোনো দেশের শিশুরা হয় না ।' (পৃ ২০) সন্দেহ নেই যে এমন নিরপেক্ষ ও নিষ্ঠুর আয়না সচরাচর মেলে না । `কাঙাল মালসাট' কে তখন মনে হয় চলমান জীবনের অন্তহীন অসঙ্গতির বিরুদ্ধে আপসহীন যুদ্ধের ঘোষণা ।
বয়ানের নানাস্তরে এই যুদ্ধের নানা ধরণের অভিব্যক্তি দেখেছি যদিও কার্নিভালের স্বভাব অনুযায়ী সমস্তই ছদ্মযুদ্ধ ও উত্তাল হাসির প্রস্রবণ । চাক্তির খেলা প্রসঙ্গে ঐন্দ্রজালিক বাস্তবতার কৃত্-কৌশল বিপুলভাবে ব্যবহৃত হয়েছে যা একই সঙ্গে কিমিতিবাদী প্রবণতারও চরম উদ্ভট প্রমাণ । নবারুণ জানেন, বিভ্রান্ত পাঠকের মনে কয়েকটি অপরিচিত শব্দের তাত্পর্য সম্পর্কে প্রশ্ন জাগবেই । অতএব ডি. এস, মদন, ও পুরন্দরকে ভদি বুঝিয়ে দেয় : `চাক্তির খেলা যখন শুরু হয় তখন চোক্তারের সঙ্গে ফ্যাতাড়ুর এক পার্টি হয়ে যায় । উকিল, ডাক্তার, মোক্তার, পেশকার ঐ সবের যেমন ফ্যাতাড়ু মেলেনা তেমন চোক্তারও মেলেনা । আমরা ঠিক বলিয়ে কইয়েদের দলে পড়ি না ।' (পৃ ২২) যাতে এই প্রশ্নোত্তর পর্বটি প্রতিসন্দর্ভের মেজাজ ও ধরনের পক্ষে বেমানান না হয়, পুরন্দরের বিচিত্র পদ্য ব্যবহৃত হয়
- ভাবতে হবে । জানমারানি পদ্য তো, ঝপ্ করে কিছু বলব না । তবে, মনে হচ্ছে, পুরন্দর এর মানেটা বুঝে লেখে নি । পেয়ে গেছে, ছেড়ে দিয়েছে ।' (পৃ ২৩)
অনবদ্য এই মধ্যান্তরের পরে, যেন পাঠকের প্রতি করুণাবশত, এই সংলাপ লেখা হয়েছে :
- খোলসা হল না ।
পুরোনো ধরনে বলা যায়, কোনো-যে-মানে নেই এটাই মানে । কিংবা, র্যাঁবোর মতো `এদের অর্থ হলো ঠিক তা-ই যা লেখা হয়েছে !' হ্যামলেটের ঘরানায়ও বলতে পারি,
ফ্যাতাড়ুদের সঙ্গে চোক্তার ভদির এধরনের বিচিত্র সংলাপের মধ্য দিয়ে সমকালীন অপজীবনের নানাদিক উলঙ্গ হয়ে পড়ে । আর, তখনই প্রতিসন্দর্ভে নতুন মাত্রা দিতে হাজির হয় `একটি সুবৃহত্, প্রাচীন ও প্রতীত দাঁড় কাক' যে নির্ভেজাল মনুষ্যকন্ঠে কথা বলে । একে ঠিক ঐন্দ্রজালিক বাস্তবের উপাদান বলতে পারি না কেননা পরবর্তী পরিচ্ছেদ গুলিতে উন্মোচিত প্রতিবাস্তবের সূত্রধার হিসেবে এর নিরন্তর আনাগোনায় কার্নিভালের প্রত্যাঘাত বড় হয়ে উঠবে । উড়ন্ত চাকি সাইরেনের মতো শব্দ করে তেড়ে বেরিয়ে ঘোলাটে আকাশে উধাও হয়ে গেল কেন, তাও একটু একটু করে স্পষ্ট হবে ।
পাঠক হিসেবে আমাদের কাজ হলো এই আগাপাশতলা এলোমেলো ও বিশৃঙ্খল বয়ানের প্রতিন্যাস থেকে অজস্র গলিখুঁজির মধ্য দিয়ে ঠিক পথ বের করে এগিয়ে যাওয়া । অবশ্য প্রচলিত অর্থে ঠিক পথ বলে কিছু হয় কী না, `কাঙাল মালসাট' পড়ার পরে এই ধন্দ থেকেই যায় । নবারুণ যেন জানাতে চেয়েছেন `বোঝো লোক যে-জানে সন্ধান'। একমাত্র নাছোড়বান্দা পাঠকই লক্ষ করবেন `অনাদ্যন্ত চ্যাংড়ামি'র মধ্যে কোথায় কোথায় লুকিয়ে রয়েছে ভুলভুলাইয়ায় ঢোকার সংকেত । দিবসের শেষে পাঠককে কুমীরে নিক বা না নিক, এইসব মনিমুক্তো তাঁকে লক্ষ করতেই হবে : `লেখকের মর্জি, তার খোলতাই, প্যাঁচ লড়াবার ধান্দা, বিশেষত আওকাৎ যদি ঠিক থাকে তাহলে কলাকা ডিমকা থেকে এক ডাইভে হেথা নয়, হেথা নয় হয়ে যেতেই পারে । আধুনিক অখ্যান খুবই অনেকান্তবাদী । ঐ হা হা হাসি, এই হু হু হাওয়া । এরকমই এখন চলবে । থেকে থেকে লেখকের নাক ডাকবে কারণ সে লেখার স্বপ্নে বিভোর । পাঠক কিন্তু সজাগ ।' (পৃ ২৮)
আরও বেশ খানিকটা পরে পাচ্ছি : `আধুনিক নভেলের একটি লভেলটি হলো নানা তথ্যের একটি ঘাপলা তৈরি করা যার মধ্যে অধিকাংশই হলো ফালতু গ্যাঁজা । অনেকসময় আবার তথ্যের বদলে এমনই একটি দার্শনিক দার্শনিক ভাব করে নন-স্টপ গ্যাঁজানো চলতে থাকে যে এই ভাটানোকে মহামূল্যবান মনে করে অনেকেই বোমকে যায় । `কাঙাল মালসাট' দু'নৌকোতেই ঠ্যাং নাচাবে ।' (পৃ ১৫৩-১৫৪)
এও ঠিক যে `পণ্ডিত বা বিদগ্ধ বলে কিছুই নেই । আছে বিভিন্ন মাপের বোকা ও তারও বেশি বেশি কিছু ।' এদের জন্যেই এই প্রতিসন্দর্ভ পরিকল্পিত । `পর্বে পর্বে চোক্তার ও ফ্যাতাড়ুদের মধ্যমণি বানিয়ে' চতুর্থ পরিচ্ছদ থেকেই লাগাতার যেসব অসম্ভব ঘটনার বিকট বোম্বাচাক বিবৃত হলো কিংবা বলা যাক বিবরণে অন্তর্ঘাত করা হলো -- সম্মোহিত ভাবে তাদের অনুসরণ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই পাঠকের । যেতে যেতে পথ বদলে যাবে বারবার ; এমন কোনো প্রসঙ্গ নেই যা উথ্থাপিত হবে না । কোন্টা অবান্তর আর কোন্টা প্রয়োজনীয় -- এদের মধ্যে তফাত করা যাবে না । `কাঙাল মালসাট' নামক ডুবোজাহাজ কখনও খেই হারিয়ে অধিবাস্তবের অথৈ জলে ও কুয়াশায় ঘুরপাক খাবে, কখনও বা হাউইয়ের মতো উত্ক্ষিপ্ত হবে মহাশূন্যে । `ইতিহাস হল এক ঝকমারি প্রহেলিকা' (পৃ ৪৬), একথা মেনে নিয়ে যুগপৎ পৌর সমাজ ও রাজনৈতিক সমাজের আগপাশতলা বিদীর্ণ হয়ে যাওয়া লক্ষ করব আমরা । কার্নিভাল উত্তাল নিশ্চয় ; কিন্তু তাতে প্রশ্রয়ের হাসি নেই কোথাও । আখ্যানহীনতা যে এমন অন্তহীন লেবিরিন্থের কৃষ্ণগহ্বর হয়ে উঠতে পারে, তা কি জানা ছিল আমাদের ? `বৃদ্ধ দণ্ডবায়স উড়িয়া গেল' -- এই অন্তিম বাক্যে প্রতিশ্রুতি নেই কোনো, নেই আরও কিছুর ইশারাও । বিপুল না-এর মধ্যে যার শুরু, অতলান্ত না-এর মধ্যে তার সমাপ্তিবিহীন সমাপ্তি । এধরনের প্রতিসন্দর্ভ বাঙালি পাঠকের অভিজ্ঞতায় ছিল না । `নানা টাইপের আধাখ্যাঁচড়া ঝটর-পটর সম্বলিত এই বোম্বাচাকটি বিরক্তি সহযোগে বাতিল' (পৃ ১৯৫) করা এত সহজ নয় । এবং `সম্পূর্ণ রসাস্বাদন খতম হইল'- এমন সিদ্ধান্ত-ই বা নিই কী করে ! বরং সিদ্ধান্তহীনতা কবুল করেই `কাঙাল মালসাট' কে হতবুদ্ধি পাঠকদের পক্ষ থেকে সেলাম জানাই ॥
(পরবাস, মে, ২০০৫)
॥ দুই ॥
কীবলব একে, আগাগোড়া ঠাট্টা, মস্করা আর ফিচলেমি যা শিষ্ট অশিষ্টের জলবিভাজন রেখা মানে না । না বর্ণনা না ঘটনা না বয়ানের গন্তব্য কোনো কিছুর প্রতি দায়বদ্ধতা আছে তার, এমন তো মনে হয় না । যখন সরকারি বয়ানের পরম্পরা ভূলুন্ঠিত, শিল্পের কৃত্কৌশল নিয়ে এমন ঠাট্টা করা যেতেই পারে এবং অনায়াসে নিজেকেও তার অন্তর্ভুক্ত করা চলে । মানুষ ও না-মানুষের পরিসর মিশে যায় পরস্পরের সঙ্গে, মিশে যায়ও না আবার । ত্রক্রনোটোপের রৈখিক বিন্যাস ভেঙে চৌচির হয়ে যায় । যা ঘটছে বলে মনে হয় তা আসলে ঘটে না ; সম্ভাবনার মুক্তি-বিধায়ক দিগন্ত প্রকট হয়ে পড়ে অন্তর্ঘাতের লাগাতার বিস্ফোরক উপস্থাপনার সূত্র । কার্নিভালের চূড়ান্ত নমুনা দেখতে পাই আমরা `কাঙাল মালসাট' এর প্রতিটি পৃষ্ঠায় । দৃশ্যমান পৃথিবীর প্রতিটি অনুষঙ্গকে কার্যত অবান্তর প্রমাণ করে দিয়ে চূড়ান্ত বৈপরীত্য ও নৈরাজ্যের বিশৃঙ্খলা প্রকট হয়নি শুধু, ভাষার প্রচলিত ব্যবহার ও মান্য আকল্পকেও প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে । এই প্রক্রিয়াটি আসলে প্রাতিষ্ঠানিক চিন্তা-প্রকরণ ও অভ্যাসের প্রতি আখ্যানকারের তুমুল ধিক্কার । যেন তিনি বোঝাতে চান, অচলায়তনের দুর্গ থেকে কয়েকটি পাথর খসিয়ে দেওয়াই যথেষ্ট নয় । সম্পূর্ণ কাঠামোকেই ধ্বংস করে দিতে চান নবারুণ । এই জন্যে তিনি ভাষাসংস্কার ও ঔপন্যাসিকতার মধ্যে উপস্থিত প্রতাপের সদর দপ্তরে কামান দেগেছেন । ফলে বয়ানের বিন্যাস থেকে সামাজিক ও অসামাজিক ভাবনা কিংবা বাক্ব্যবহার সম্পর্কিত প্রচলিত জলবিভাজনরেখা মুছে গেছে । তেমনই বাস্তব আর অসম্ভাব্যতার ভেতরেও । একে প্রকল্প বা ফ্যান্টাসি বলব সরাসরি, তারও উপায় নেই কেননা অন্তর্বয়নের সূত্রে বাচনের কোষে-কোষে মিশে গেছে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে তীক্ষণ স্নেহের বারুদ ।
কুটুম্ব সমাজে লজ্জা নিন্দার ভাজন ॥
দেশের দশের পাশে শ্লেষ ব্যঙ্গ হাসি ।
সরে গেছে বাল্যসখা তাচ্ছিল্য প্রকাশি ॥         (পৃ ১০-১১)
॥ চার ॥
॥ পাঁচ ॥
`- আঁজ্ঞে, চোক্তার তাহলে ঠিক কী ?
- একথার কোনো মানে নেই । ফ্যাতাড়ু কী ? তেমনই চোক্তার কী চোক্তার হল চোক্তার । তবে এটুকু বলতে পারি হুজ্জত লাগাতে চোক্তারের কোনো জুড়ি নেই । তবে ঠিক টাইম না হলে কিচ্ছুটি হবার উপায় নেই ।
- হবে কী করে । আজকে তো সিরিয়ালের পয়লা এপিসোড । তিনশো পেরিয়ে গেল, `জন্মভূমি'-তে ঠিক কী হচ্চে লোকে শালা বুঝতে পারছে না । আর এক নম্বরেই তোরা এত বড় কাণ্ডটা সাইজ করবি সে কী করে হয় ? আর আমিই বা গাণ্ডুর মতো অত বড় ঘোমটা দিতে যাব কেন যাতে পোঁদ বেরিয়ে পড়ে!' (তদেব)