হিমেনেথ, ও-ই, চলেছেন । পাশে পাশে প্লাতেরো । মুগের-এর আন্দালুসিয়ার পথ থেকে পথে । প্লাতেরো কে ? এক গাধা । অন্য অর্থে, প্লাতেরো, যেন, কবির দ্বৈত-দ্বিতীয় সত্তা । চলেছেন । দুজনে । এক বর্ণময় ভ্রমণ । ভ্রমণকাহিনী । আমরা বলবো এই ভ্রমণ আমাদের । আমাদের-ও ! যেতে যেতে দুটি উড্ডীন প্রজাপতির দিকে আঙুল তুলে হিমেনেথ প্লাতেরোকে বললেন, ওদের উড়ে দেখার মধ্যেই আমাদের আনন্দ । ওড়ার মধ্যে সৌন্দর্যসৃষ্টি, তজ্জনিত আনন্দ । সৌন্দর্য, হিমেনেথ বললেন, চেষ্টা করেও লুকিয়ে রাখা যায় না । যেতে যেতে উড়েঘুরে সৌন্দর্যসৃষ্টি, আর তা থেকে আনন্দ উগরে নেওয়া, এই-ই ভ্রমণ আমাদের । আমাদের-ও । মনে হয় । এই জীবন । এক জীবনে । যে যখন পাশে আসে, পাশে পাশে থাকে, প্লাতেরো, সে । যখন আসে না কেউ, থাকে না, একা কেউ, নিজেকে দুভাগ ক'রে সে এক, অন্যটি প্লাতেরো । এই দ্বৈতালাপ যেতে যেতে । যেতে যেতে যেতে । এই জীবন । এক জীবন । দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে যেতে যেতে ছবি আঁকা, ছবি নেওয়া, ছবি হওয়া । ও-ই চলেছেন, হিমেনেথ, প্লাতেরো । সব বিন্দুতে চোখ রাখতে রাখতে, সবকিছু থেকে উঠে আসা সবকটি ঘন্টায় হাত রাখতে রাখতে । শব্দ আর নি:শব্দের ফাঁকে ফাঁকে অন্তর থেকে উত্সারিত লিলিফুলগুলো রাখতে রাখতে । যেতে যেতে টের পাওয়া শব্দ আর নি:শব্দের মাঝখান দিয়ে গেছে এক পথ, আনন্দের খোঁজে । ভ্রমণ । ভ্রমণকাহিনী । আমাদের । আমরা । প্লাতেরোর পাশে যেতে যেতে হিমেনেথ দেখছেন দুটো যে প্রজাপতি উড়ছে, একটি সে, ওই প্রজাপতি, অন্যটি ছায়া, তার । দুই প্রজাপতির সাদা একটি, অন্যটি কালো । একটিকে আলো বলা যাক, অন্যটি আঁধার । একটিকে সুখ বলা হলে, অন্যটি দু:খ । একটি যে-কেউ, নিজে, অন্যটি পাশে-কেউ । যে যখন পাশে । দুই নিয়ে যাওয়া, ওড়া । ওড়া, সৌন্দর্যসৃষ্টি, তজ্জনিত আনন্দ । বিষাদ-ও । তজ্জনিত । পাশে যাকে নেওয়া, পাওয়া, সে যেমন বদলায়, সেরকমই বিষাদ, আনন্দ, আলো, অন্ধকার, দু:খ, সুখ, যেরকম । চলেছেন, হিমেনেথ, দীর্ঘস্থায়ী দু:খের শলাকাবিদ্ধ ছোট ছোট ছিনিয়ে আনা সুখগুলি টের পেতে পেতে । অন্ধকার পেরিয়ে আলো খুঁজতে খুঁজতে । পাশে সে, যে যখন পাশে, তাকে নিয়ে যাওয়া, যেতে যেতে যেতে ঘন হওয়া, সঙ্গ পাওয়া, সঙ্গে পাওয়া, সঙ্গে নিয়ে চলা । যাওয়া না থামালে, না থামলে, বিষাদ নিঙড়ে পাওয়া আনন্দকে । আনন্দ, লুকিয়ে থাকে, সৌন্দর্য যেমন, যে যায়, ওড়ে, ওড়াউড়ি করে, তাকে ধরা দেয় । যেতে যেতে পাওয়া । যাওয়া, তাই । একটি ভ্রমণ । ভ্রমণকাহিনী । আমরা । এই জীবন । এক জীবন । ও-ই, দুজনে, চলেছেন । ছোট ছোট ঘটনা, দৃশ্য, পাখির উড়ালি, আকাশের সুদূর অলৌকিক চাউনি, রোদ্দুরের লিলিফুল, ভোর, মেলা, মিনার, প্রাসাদ, নদী, কচ্ছপ, ঝঞ্ঝা, উড়ন্ত হাঁস, মেষপালক, যক্ষাক্রান্ত মেয়ে, কাঠের ঘোড়া, ভয়, শীত শরত্, উল্লাস, খন্ড চাঁদ, শাদা প্রজাপতির মতো ফেলে আসা পথের-স্মৃতিসুখ, মনে করতে করতে, সবকিছু পেরতে পেরতে যাওয়া সব পথের আনাচেকানাচের সমাধিবেদি ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাওয়া । পথে বন্ধু, রুটিমদ, বসন্তের সকাল । পথে আরোহণ, পদাঘাত, বুলফাইট, এসব আছেই । এসবও । আচমকা আতশবাজি, প্রোজ্জ্বলতা, কাছের আলোয় দূর দেখে নেওয়া, এ-ও আছে । তারপর যাওয়া, যেতে যেতে যাওয়া, তারপর-ও । তারপর থামা । কোথাও । কোথাও । থেমেছেন হিমেনেথ, ও-ই, প্লাতেরোর পাশে । দূরে এক আলো । তার আলো দুজনের কাছে এসে লাগে । মনে হচ্ছে আলোয় পৌঁছেছি, আলো, প্লাতেরোকে বলছেন হিমেনেথ । আমরা ছায়াকে বলবো । যে যার ছায়াকে । শেষমেস পাশে যাকে পাবো, থেকে যাবে যে, তাকে । বলবো ভ্রমণ এই, বলবো ভ্রমণ ও-ই, প্লাতেরো হিমেনেথ, যাওয়া, যতদূর । থামা নেই, যতক্ষণ যাওয়া । তারপর আলো । আলোয় পৌঁছনো । আলো হয় সত্তব । আলো । আলো । তখন । তখন । অনেক দূরের আলো কাছে এসে লাগে ।
(পরবাস, ডিসেম্বর, ২০০৪)