• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩৪ | ডিসেম্বর ২০০৪ | গল্প
    Share
  • আগন্তুক : সাবর্ণি চক্রবর্তী

    বৃষ্টিটা শুরু হয়েছে ঠিক পূজোর সময় থেকেই । আর ছাড়ছে না । কখনো গুঁড়ি গুঁড়ি পড়ে, কখনো বা একটু বাড়ে । আকাশটা খুব কালো না হলেও বেশ ঘোলা । সেই সঙ্গে চলছে হাওয়া । কখনো জোর, কখনো আবার একটু কমে যাচ্ছে । নতুন নতুন মেঘ এসে জড়ো হচ্ছে আকাশে । লক্ষ্মীপূজো পেরিয়ে গেল - এখনও একই অবস্থা চলছে ।

    এখন সকাল আটটা । সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল দিলীপ । ওর ঘর থেকে বেরিয়ে প্রথমে খানিকটা মাটির কাঁচা রাস্তা । তারপর মোরামের রাস্তা দিয়ে বেশ খানিকটা গেলে ঐ রাস্তা উঁচু হয়ে পিচ বাঁধানো বড় রাস্তায় গিয়ে পড়েছে । বৃষ্টির জলে ভিজে মাটির রাস্তা এখন কাদায় কাদা, খুব পেছল হয়ে আছে । সাইকেল ঠেলে ঠেলে হেঁটে চলল দিলীপ । বৃষ্টি হলে এ-রাস্তায় সাইকেল চালানো যায় না । সে-চেষ্টা করলে সাইকেল সমেত আছাড় খাবার ভয় আছে । প্রায় দশ মিনিট এভাবে সাইকেল ঠেলে এগোল দিলীপ । তারপর মোরামের রাস্তায় পড়ে সাইকেলে উঠল । কিন্তু এখন হাওয়া দিচ্ছে জোরে - উল্টোদিক থেকে । বেশি জোরে যাওয়া যাচ্ছে না । সাইকেলের সামনের হ্যাণ্ডেলে ঝোলানো থলেটার ভেতর একটা কৌটো - তার ভেতর ওর বৌ স্বপ্নার বানিয়ে দেওয়া রুটি তরকারি - দিলীপের রোজকার দুপুরের খাবার । হাওয়ায় থলেটা দুলছে - দিলীপ এক হাতে থলেটার খানিকটা হ্যাণ্ডেলের সঙ্গে চেপে ধরে আছে । তা না-হলে হয়তো উড়ে যাবে । বৃষ্টির ছোট-বড় ফোঁটাগুলো দিলীপের মুখে ঝাপটা মারছে । ওর মনিবের বাড়ি পৌঁছবার আগেই দিলীপ পুরোপুরি ভিজে যাবে । স্বপ্না আজ কাজে বেরোতে মানা করেছিল । কিন্তু বাড়ি বসে থাকলে হবে না । দিলীপের চাকরিটা নতুন আর মালিকটা হারামি । এককথায় তাড়িয়ে দিতে পারে । ওর নতুন লোকের অভাব হবে না । আজকাল প্রচুর কুড়ি-একুশ বছরের বাচ্চা বাচ্চা ছেলে ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে নিচ্ছে । হাজার কি বারোশ টাকা মাস মাইনেতেও ওরা গাড়ি চালাতে তৈরি ।

    দিলীপ ঘর তুলেছে শহর থেকে বেশ একটু দূরে । জমিটা জোগাড় করে দিয়েছিল ওর বন্ধু মানিক - জমির দালালি করে । এখন কমের মধ্যে নিয়ে নে দিলীপ - মানিক বলেছিল । এরপর আর পাবি না । ওই শালা মেট্রো রেল টালিগঞ্জ ছাড়িয়ে এগোবে এখবর বেরোবার পর থেকেই এ-তল্লাটের জমির দাম বাড়ছে চড়চড়িয়ে - তা এ-জায়গাটা শহর থেকে পাঁচ মাইল দূরেই হোক আর মেট্রোরেলের কাজ শুরু হোক চাই না হোক । এক কাঠা জমি সাত হাজার টাকা । তার ওপর দিলীপের ঘর । ইঁটের মেঝে করেছে, দেয়াল অর্ধেক ইঁটের, অর্ধেক দরমার । টিনের চাল, পাশে একটুখানি জায়গা টিন দিয়ে ঘিরে স্নান করার ব্যবস্থা । আর একটা জনতা শৌচালয় । সরকার থেকে দিচ্ছে - চারশো টাকা দাম । চারপাশে ত্রিপলের বেড়া, ওপরেও ত্রিপলের ছাদ । কিন্তু বর্ষাকালে জলের ছাঁট আসে - ছাতা মাথায় দিয়ে বসতে হয় । নিজের এক পয়সাও ছিল না । স্থানীয় মুদি দোকানের মালিক গোপাল সাহা । ওর দোকান খুব চলে । তেজারতির কারবারও করে । ধার দিয়েছে শতকরা পাঁচ টাকা সুদ মাস হিসেবে । এখন খালি সুদের টাকা শোধ দিয়ে যাচ্ছে দিলীপ - আসলে হাত পড়েনি । গাড়ি চালিয়ে দিলীপ মাসে পায় তিন হাজার - স্বপ্নাও হাজার খানেক রোজগার করে । বড় রাস্তার ওপারে থাকেন সোমা দত্ত - নারীসমিতি চালান । অনেক মেয়েকে সেলাইয়ের কাজ দেন - তারা মহিলাদের কাপড়জামা সেলাই করে দেয় । বিক্রীর ভার সোমা দত্তর । স্বপ্নাও সেভাবেই কাজ পায় । দিলীপ বেরিয়ে গেলেই ওর সেলাই কল চলতে শুরু করে । তবে ওর আর একটু সাবধান হওয়ার দরকার । ওদের বাচ্চাটার বয়েস পাঁচ - মেয়ে, নাম মিনু । গতবছর ওর আঙুলের ওপর দিয়ে সেলাই কলের ছুঁচ চলে গিয়েছিল । রক্তারক্তি কাণ্ড - হাসপাতাল, ডাক্তার - সে এক বিচ্ছিরি ব্যাপার । আর কিছুদিন গেলে মিনুকে স্কুলে ভর্তি করতে হবে । তাতেও কিছু খরচা আছে । একটা প্রাইমারি স্কুল আছে - এখান থেকে প্রায় দু-মাইলটাক দূর । দিলীপ নাহয় সকালে ওর সাইকেলে মেয়েকে পৌঁছে দিয়ে আসতে পারবে - ফেরার সময় স্বপ্নাকে গিয়ে নিয়ে আসতে হবে মেয়েকে । মনিবের কাছে দশ হাজার টাকা ধার চেয়েছিল দিলীপ । মাসে মাসে মাইনের থেকে টাকা কেটে নিতে বলেছিল । খচ্চরটা দেয়নি । ও টাকাটা পেলে গোপাল সাহাকে এতগুলো টাকা মাসে মাসে সুদ গুনে দিতে হোত না ।

    দিলীপের মনিবের নাম বি কে সেন - রাশভারি চেহারার বয়স্ক লোক । একটা ফ্ল্যাট কিনেছেন একটা বড় অ্যাপার্টমেন্ট হাউসে । দিলীপের বাড়ি থেকে সাইকেলে প্রায় আধ-ঘন্টা লাগে । আজ পৌঁছতে একটু বেশি সময় লাগল - যখন পৌঁছল তখন চুপচুপে ভিজে । বিল্ডিং এর গেটে দাঁড়িয়ে আছে তপন । এ-বাড়ির চৌকিদার - দিলীপেরই বয়েসী । আপাদমস্তক বর্ষাতি দিয়ে মোড়া । দিলীপের অবস্থা দেখে হি হি করে হাসছে । দিলীপ এক খিঁচুনি দিল - দাঁত বন্ধ কর উল্লুক । এ ব্যাটারা আছে ভাল । এক জায়গায় বসে ডিউটি করে । দিলীপের মতো গাড়ি ঠেঙিয়ে ঘুরতে হয় না ।

    বিল্ডিং এর হাতায় ঢুকে প্রথমে রোজকার জায়গায় সাইকেল রাখল দিলীপ । তারপর গেল চৌকিদারদের বাথরুমে । সেখানে চৌকিদারদের একটা গামছা রয়েছে, তাই দিয়ে গা-মাথা মুছে শার্টপ্যান্টের জল নিংড়ে আবার পরল । তবুও জামাগুলো ভালই ভিজে । সেনসাহেবকে নিয়ে যখন গাড়ি ছাড়ল তখন প্রায় নটা । একটা আধা সরকারি সংস্থায় উঁচু পদে কাজ করেন ভদ্রলোক । বাড়ি থেকে সাহেবের অফিসে যেতে প্রায় একঘন্টা লেগে যায় । আজ গাড়িটা চালাতে কষ্ট হচ্ছে । বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট ভেজা, তার ওপর ওয়াইপারটা মাঝে মাঝেই আটকে যাচ্ছে । ব্যস্‌, তখন উইণ্ডস্ক্রীন ঝাপসা, আন্দাজে গাড়ি চালাও । হবে নাই বা কেন ? বারো বছরের পুরনো ঝরঝরে গাড়ি - এটা ওটা ঝামেলা লেগেই আছে । পেছনে বসা মূর্খটাকে বেশ কয়েকবার ওয়াইপারের কথা বলেছে দিলীপ । ব্যাটা পাত্তাই দেয়নি । একটা নতুন গাড়িও কিনবে না শালা । রাস্তার একপাশে খানিকটা জায়গায় জমা জল । দিলীপের গাড়ির চাকা তার ওপর দিয়ে গড়ায় - সেই নোংরা জল ছিটে উঠে পাশ দিয়ে ভিজিয়ে দেয় । চেঁচিয়ে গালাগাল দিচ্ছে লোকটা - গাড়ির গতি বাড়িয়ে লোকটাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেল দিলীপ ।

    ফেরবার সময় অফিস থেকে বেরোতে বেরোতে সেই সন্ধে - রোজই যেরকম হয় । সারাদিন মুষলধারায় বৃষ্টি পড়েছে । রাস্তার কোনও কোনও জায়গায় একেবারে হাঁটুজল । দিলীপ সতর্ক হয় । একটু অসাবধান হলেই সায়লেন্সার পাইপে জল ঢুকে গাড়ি আটকে যাবে । তখন একহাতে স্টিয়ারিং ধরে অন্য হাতে গাড়ি ঠেলতে হবে দিলীপকেই । প্রায় দু ঘন্টা লেগে গেল ফেরার পথ পার হতে । সেনসাহেবের বাড়ির ভেতর গাড়ি ঢুকিয়ে দিয়ে দিলীপ একটা হাঁফ ছাড়ল । আজকের মত ঝামেলা চুকল ।

    কিন্তু সাইকেল চালিয়ে নিজের বাড়ির দিকে যেতে যেতেই দিলীপ বুঝল ঝামেলা চোকেনি । বিকেলের দিকে বৃষ্টিটা একটু ধরেছিল । এখন আবার অল্প অল্প শুরু হয়েছে - হাওয়ার জোরও বেড়েছে । পিচরাস্তার দুপাশের জমিতে জল উঠে এসেছে । মোরামের রাস্তার দুপাশেও জল - আর একটু বাড়লেই জল রাস্তার ওপর উঠে আসবে । তার মানে চারপাশের নিচু জমিগুলোতে জল দাঁড়িয়ে গেছে । এবার ওর দুর্ভাবনা হতে লাগল । ওর নিজের ঘরটাও নিচু জমিতে । ঘর তুলবার সময় ও অবশ্য মাটি ফেলে মেঝে অনেকটা উঁচু করেছিল । তবুও বেশি জল দাঁড়ালে ওর ঘরে জল ঢুকে যেতে পারে । এর মধ্যেই রাস্তার দুপাশে লোক বসে যেতে শুরু করেছে । পুরো পরিবার - বাড়ির পুরুষরা, বৌ, বাচ্চা, বুড়োবুড়ি । সঙ্গে পোঁটলা, টিনের ছোট বাক্স । কারোর মাথায় ছাতা - কেউ বা বসে বসে ভিজছে । হয় ওদের ঘর পড়ে গেছে, নয়তো এত জল ঢুকেছে যে থাকা সম্ভব নয় । কিছু কিছু পরিবার বাসনকোসন, হাঁড়ি-কলসীও সঙ্গে নিয়ে এসেছে । ফাঁকা ঘরে রেখে দিয়ে এলে চোরে সব সাফ করে দিয়ে যাবে । ওর পেছন থেকে একটা বিকট আওয়াজ ওর কাছে এগিয়ে আসছে । চমকে ব্রেক টিপে রাস্তার ওপর সাইকেল থামিয়ে দিল দিলীপ । এখন ওর পেছন থেকে এসে দুপাশ দিয়ে পাঁচ-ছটা কুকুর দৌড়ে যাচ্ছে । চার পাঁচটা মিলে একটাকে তাড়া করেছে । যেটাকে তাড়াচ্ছে সেটা একবার করে দাঁড়িয়ে পড়ে হিংস্রভাবে দাঁত বার করে বাকিগুলোকে ভয় দেখাবার চেষ্টা করছে - আবার পেছন ফিরে দৌড় মারছে । ওদের ডাকের খ্যা খ্যা শব্দ, ভয় দেখাবার গর্র্‌ আওয়াজ - ওরা দিলীপকে ছাড়িয়ে অনেকটা এগিয়ে চলে গেল । ওদের ঝামেলায় ভয় পেয়ে একটা বুড়ি রাস্তার পাশে জলের ভেতর গিয়ে পড়েছিল । একটা লোক হাত ধরে বুড়িটাকে টেনে তুলছে - বোধহয় ওর ছেলে । সাবধানে সাইকেলের পেডালে চাপ দিয়ে সামনে এগোল দিলীপ ।

    মাটির রাস্তাটা জলে ডুবে গেছে । খুব সাবধানে পা টিপে টিপে সাইকেল ঠেলে চলল দিলীপ । একটু এপাশ ওপাশ হলে সাইকেল নিয়ে একেবারে বুকজলে পড়ে যাবে । ওদের পাড়াটার কাছে এসে চোখে পড়ল - সারা জায়গাটা অন্ধকার । হয় লোডশেডিং নয়তো বিদ্যুতের তার ছিঁড়েছে । দিলীপের ঘরে একটা বিদ্যুৎ বাতি জ্বলে । পাশে থাকে বলরাম দাস । ওর বাড়ি থেকে তার টেনে নিয়েছে । সেজন্যে মাসে একশো টাকা করে বলরামকে দেয় । বিদ্যুতের আলো না হলে স্বপ্নার সেলাইয়ের কাজ করতে অসুবিধে হয় । অনেকে পরামর্শ দিয়েছিল রাস্তার তারের থেকে বাড়িতে একটা তার টেনে নিতে । তাহলে বাতি জ্বালতে এক পয়সাও খরচা লাগত না । কত লোকই তো করছে । দিলীপের সাহস হয়নি । ধরা পড়লে পাঁচ বছরের জেল । তার চাইতে বলরাম মাসে একশ টাকা করে নিক ।

    দিলীপ সাইকেল ঠেলে নিজের ঘরের দাওয়ায় উঠল । একটা কেরোসিনের কুপি জ্বেলেছে স্বপ্না । ঘরের দরজা খোলা । দিলীপ সাইকেল দাওয়ায় রেখে কুপির যেটুকু আলো বাইরে আসছে তাতে হাতড়ে হাতড়ে সাইকেলে চেন আর তালা লাগাল । ওর পায়ের পাতার ওপর দিয়ে জল বইছে । নোংরা, কাদাগোলা জল । ঘরের ভেতরেও তাই । স্বপ্না মেয়েকে নিয়ে জবুথবু ভাবে চৌকির ওপর বসে আছে, বিছানাটা মাথার দিকে গোটানো ।

    এই ঝড় বৃষ্টির রাত - দরজা বন্ধ করোনি কেন ?- দিলীপ একটু বিরক্তভাবে স্বপ্নাকে জিগ্যেস করল ।

    দরজা লাগানো যাচ্ছে না - স্বপ্না বলল । একটা কব্জা ভেঙে গিয়েছে ।

    দিলীপ কাছে গিয়ে পরীক্ষা করে । তাই বটে । টিনের দরজাটা বেঁকে ঝুলে আছে - একটা কব্জা এমনভাবে ভেঙেছে যে ওটাকে ঘুরিয়ে বন্ধ করা যাচ্ছে না ।

    দিলীপ জলে পা ফেলে ছপ ছপ করতে করতে চৌকির কাছে ফেরৎ আসে । বিছানার ভেতর থেকে টর্চটাকে টেনে বার করে । এটা রাত্রে ওদের শিয়রের কাছেই থাকে । বোতাম টিপে টর্চটা জ্বালল দিলীপ । আলোর জোর কম । ব্যাটারি বদলানো দরকার । আলো কখন গেল ? - দিলীপ জিগ্যেস করল ।

    সে অনেকক্ষণ - স্বপ্না বলল । সেই সঙ্গে মিনু বলে উঠল, জানো বাবা, তার ছিঁড়ে গেছে । বলরাম কাকা বলে গেল ।

    দিলীপ হেসে মিনুর গাল টিপে দেয় । ভারি চালাক চতুর হয়েছে মেয়েটা । ঠিক করে লেখাপড়া করাতে পারলে মেয়েটা একটা কিছু হবে - ডাক্তার, উকিল, কম করে সেনসাহেবের মত একটা চাকরি করবে । তারপরেই বিরক্ত বোধ করে । কাল সকালের আগে তার মেরামত হবে না - তার মানে সারা রাত কারেন্ট পাওয়া যাবে না ।

    টর্চের কমজোরি আলোতেই ঘরের জিনিষপত্র একে একে দেখে নেয় দিলীপ । চৌকিটা কাঠের, পায়াগুলো ইঁটের ওপর বসানো আছে । এখনও জল ইঁট ছাড়িয়ে ওপরে ওঠেনি - উঠলে পায়া ভিজবে আর কাঠ পচবে । তার মানে গেল জিনিষটা । এপাশে ইঁটের ওপর ওপরে করে রাখা তিনটে ট্রাঙ্ক । এগুলোর ভেতর স্বপ্নার সেলাইয়ের কাপড়, তৈরি জামা, এসব থাকে । সবচেয়ে ওপরের ট্রাঙ্কটার ওপর ঘোমটা দেওয়া কলাবৌ এর মত ঢাকনা পরানো সেলাই মেশিনটা রাখা রয়েছে । দিলীপের রোগা বৌটা রোজ ওই ভারি মেশিন নামিয়ে কাজ করে, আবার কাজ শেষ হলে ওপরে তুলে রাখে । আহা, কত কষ্ট হয় বৌটার । ওদের নিজেদের বাসনপত্র - হাঁড়ি, কড়াই, ডেকচি এগুলো সব ডাঁই করে খাটের নিচে রাখা রয়েছে । থাক্‌ শালারা ওখানে । জলে ডুবে থাকলে ওরা কিছু ক্ষয়ে যাবে না । জল সরে গেলে ধুয়ে নিলেই হবে । আর একদিকে মেঝেয় ইঁটের ওপর রাখা রান্নার কেরোসিনের স্টোভ আর পাশে প্ল্যাস্টিকের পাঁচ লিটারের পাত্রে কেরোসিন তেল । জল যদি আরও উঠতে থাকে তাহলে রান্নাখাওয়া বরবাদ হবে - স্টোভ আর তেলের পাত্রটা ওখান থেকে সরানো দরকার । এপাশে জানালার কাছে আরও তিনটে ট্রাঙ্ক একটার ওপর আর একটা রাখা, ওগুলোতে ওদের কাপড়জামা থাকে । ঐ ট্রাঙ্কগুলো রাখা যাবে না । কেরোসিন তেল চুঁইয়ে ভেতরে ঢুকলে জামা কাপড় সব নষ্ট হবে - এসব ভাবতে ভাবতে ওই ট্রাঙ্কগুলোর ওপর টর্চের আলো ফেলল দিলীপ । সেই আলোয় যা দেখল তাতে ওর হাত পা ঠাণ্ডা মেরে গেল । স্বপ্নাও দেখতে পেয়েছে । আঁক করে একটা আওয়াজ করে মুখে হাত চাপা দিল দিলীপের বৌ ।

    ট্রাঙ্কের ওপর কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে আছেন একজন অতিথি - কালো চকচকে শরীরটা, গোল মাথা, বৃষ্টিটা এখন থেমেছে, কিন্তু ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে । সেই আলোয় আরও পরিষ্কার দেখা গেল । লাল রঙের সরু চেরা জিভটা মুখের মধ্যে ঢুকছে, আর বেরোচ্ছে । ছোট ছোট উজ্জ্বল চোখদুটো আলো পড়ে ঝিকমিক করে উঠল । খাটে বসা মিনু চেঁচিয়ে উঠল, বাবা, দ্যাখো, দ্যাখো সাপ- ওই বাক্সের ওপর ।

    দিলীপ চুপ, স্বপ্নারও মুখে কথা নেই ।

    মিনু ভয় পাওয়া গলায় বলল, বাবা, ওটা আমাদের কামড়াবে ?

    এবার দিলীপ ধমকে উঠল, চুপ করো । ও মোটেই কামড়াবে না ।

    বিদ্যুৎ চমকানো বন্ধ হয়ে গিয়ে ঘরটা এবার প্রায় অন্ধকার । দিলীপ আবার টর্চ ফেলল সাপটার গায়ের ওপর । এবার সাড়া জাগল আগন্তুকটির শরীরে । ট্রাঙ্কগুলোর পেছনে দিলীপের ঘরের চালের খুঁটি । সেটা বেয়ে উঠে গিয়ে দরমার দেয়াল, টিনের চাল আর খুঁটির ত্রিবেণীসঙ্গমে গিয়ে লুকিয়ে পড়ল । এখন টর্চের আলো ফেলেও ওটাকে দেখা যাচ্ছে না ।

    স্বামী-স্ত্রী দুজন দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে । এবার কি কর্তব্য ? স্বপ্নার চোখ ভয়ে বড় বড় হয়ে আছে । ও দিলীপের একটা হাত চেপে ধরে । বলে, কি হবে গো ?

    দিলীপ আস্তে আস্তে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয় । বলে, ভয় পেয়ো না । দেখছি কি করা যায় ।

    ও নিজেও অবশ্য ভয় পেয়েছে । বুক ঢিপঢিপ করছে, গলা মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে । তবু কিছু না কিছু তো করতেই হবে । জল আরও বেড়েছে মনে হচ্ছে, পায়ের পাতা ডুবে যাচ্ছে । ও চালের সব জায়গায় টর্চের আলো ফেলে দেখতে লাগল সাপটা কোথাও লুকিয়ে আছে কিনা । চালের কাছে এক জায়গায় দরমায় একটা ফুটো হয়েছে । আগে চোখে পড়েনি । এই রাস্তাতেই বোধহয় মহারাজ ঢুকেছিলেন । আর তো তাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না ।

    সে কথাই দিলীপ বৌকে বলল । কোথাও চোখে পড়ছে না তো আর । বেরিয়ে গেছে বোধহয় । ওই ফুটোটা দিয়ে । টর্চের আলো ফেলে দেখল দিলীপ ।

    তাহলেও আবার তো ঢুকে আসতে পারে ? স্বপ্নার মুখে ভয়ের ছায়াটা আরও গাঢ় হচ্ছে । মিনু ততক্ষণে তার পুতুল নিয়ে খেলতে শুরু করেছে - ওটাকে থাবড়ে থাবড়ে ঘুম পাড়াচ্ছে । ওর ওই একটাই খেলনা । মাস ছয়েক আগে দিলীপ কিনে দিয়েছিল । এই ছ-মাসে পুতুলের জামা ছিঁড়েছে, চুলও কিছু উঠে গেছে । মিনুটা লক্ষ্মী মেয়ে, নতুন পুতুলের জন্যে আব্দার করে না । ওটা নিয়েই খেলে ।

    জল ভেঙে ঘরের বাইরে গেল দিলীপ । ঘরের দাওয়ায় বাঁশের কঞ্চির বেড়া - মাটি থেকে তিন ফুট পর্যন্ত উঁচু । দাওয়ার মাটি এখন এক হাত জলের নিচে । জলের ভেতর হাত ডুবিয়ে বেড়ার কঞ্চি ধরে টান মারল দিলীপ । জলে ভিজে কঞ্চি নরম হয়ে গেছে - খানিকটা ভেঙে দিলীপের হাতে উঠে এল । প্রায় ফুট তিনেক লম্বা একটা টুকরো, এতেই হবে । কঞ্চি নিয়ে ঘরে ঢুকে এল দিলীপ ।

    কঞ্চি দিয়ে কি হবে ? - স্বপ্না ফিসফিস করে জিগ্যেস করল । ভয়ে ওর গলা শুকিয়ে গিয়েছে, জোরে কথা বলতে পারছে না । তাছাড়া ওদের জোরে কথা বলার আওয়াজে ওদের অতিথি যদি চটে যায় ?

    চালটা খুঁচিয়ে দেখব - দিলীপ বলল । এখনও ভেতরে লুকিয়ে আছে না বেরিয়ে গিয়েছে ।

    না না তার দরকার নেই - স্বপ্না আবার দিলীপের হাত চেপে ধরল । ওসব করলে লতা যদি চটে যান ? তাহলে সর্বনাশ । মেয়েটাকে নিয়ে রাতে তো আমাদের এঘরেই শুতে হবে । তাছাড়া বেরিয়ে গেলেই বা কি ? আবার তো ঢুকে আসতে পারে ?

    দিলীপের রাগ হয়ে গেল । সারাদিনের পরিশ্রম, বৃষ্টিতে ভেজা - গা, মাথা, জামা এখনও ভিজে - কোথায় মৌজ করে চৌকির ওপর বসে চা আর তেলমুড়ি খাবে, তা নয়তো ঘরভর্তি জল, দাঁড়াবার জায়গা নেই, তার ওপর সাপ ঢুকেছে ঘরে । আর বৌটা বলে কিনা চাল খুঁচিয়ে লতাকে রাগানো উচিৎ নয় । সামনেই স্বপ্না, চৌকিতে বসে আছে । হাতের কঞ্চিটা দিয়ে কয়েক ঘা বসিয়ে দিল দিলীপ । তারপর সেটা ঘরের এককোণে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে রাগ রাগ মুখে চৌকির ওপর দুম করে বসে পড়ল । হালকা বাঁশের কঞ্চি, জলের ওপর দিব্যি ভাসছে ।

    মার খেয়ে বৌটা চোখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদে - ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলে । স্বপ্না কি এমন খারাপ কথা বলেছে যে দিলীপ ওকে মারল ? দিলীপ কি চায় ওর বৌ মরে যাক ? তাহলে দিলীপ তাই করুক - মেরে ফেলুক ওকে । তারপর চাইলে আর একটা মেয়েকে বিয়ে করেও ঘরে আনতে পারে । খালি মিনুটার যেন কোন অযত্ন না হয় - সেটা যেন দিলীপ দেখে । মিনু খেলা থামিয়ে চুপ করে বসে আছে - একদৃষ্টিতে মায়ের কান্না দেখছে ।

    স্বপ্নার কান্না শুনে দিলীপের রাগ জল হয়ে গেল । সত্যিই তো - বৌটা কি এমন খারাপ কথা বলেছে ওকে ? রোগা বৌটা সারাদিন পরিশ্রম করে সেলাই করে - পয়সা রোজগার করে ওকে সাহায্য করে । মিনু হবার সময় বড় কষ্ট পেয়েছিল স্বপ্না । হাসপাতালে বিছানা পায়নি - ওকে মাটিতে শুইয়ে রেখেছিল । অবস্থাও তো প্রায় যায় যায় হয়েছিল । মা আর বাচ্চা সেবারে কোনমতে প্রাণে বেঁচে গিয়েছে । দিলীপ বৌকে কাছে টানল, বুকে জড়িয়ে ধরল । স্বপ্নার কান্না থেমে গেল - আদরে বেড়ালের মত দিলীপের বুকে মাথা গুঁজল । কঞ্চির ঘা লেগেছে কয়েকটা হাতে, কয়েকটা পিঠে - দিলীপ সেসব জায়গায় হাত বোলাতে লাগল ।

    মা-বাবার ভাব হয়ে গেছে দেখে মিনু নিশ্চিন্ত হয়ে আবার পুতুল নিয়ে খেলতে শুরু করে । স্বপ্না শাড়ির আঁচল দিয়ে দিলীপের মাথা মুখ মুছিয়ে দেয় । বলে, ভেজা জামা পাল্টে নাও । এই জামা গায়ে শুকোলে অসুখ করে যাবে ।

    সারাদিনই তো ভেজা জামা গায়ে শুকোচ্ছে । দিলীপ ট্রাঙ্ক থেকে শুকনো লুঙ্গি আর গেঞ্জি বার করল । কিন্তু পোষাক পাল্টাতে গিয়ে থেমে গেল । সাপটার কথা মাথায় ঘুরছে । বেশি রাতে যদি আবার ওটা ঢুকে আসে ?

    আজ রাতটা অন্য কারোর বাড়ি গিয়ে থাকলে হয় না ? - দিলীপ বলল । এই ধরো যদি বলরামকে বলি থাকতে দিতে ? কাল চালের ফুটোটার আর ভাঙা দরজাটার একটা কিছু ব্যবস্থা করে নিতে হবে ।

    স্বপ্না রাজি হোল না । বলরামের ঘরেও তো জল ঢুকেছে । কোথায় শুতে দেবে ওরা ? তার চেয়ে নিজেদের ঘরেই থাকব । মাথার ওপর ভগবান আছেন - উনিই বাঁচাবেন আমাদের ।

    স্বপ্নার যুক্তি মানল দিলীপ । আর কথা না বাড়িয়ে পোষাক পাল্টে নিল । ঘরের ভেতর একটা দড়ি আড়াআড়ি করে টাঙানো । বর্ষাকালে ভিজে কাপড় শুকোনর ব্যবস্থা । ভেজা জামাপ্যান্ট নিংড়ে সেই দড়ির ওপর মেলে দিল । তারপর চৌকিতে বসার পর টের পেল অসম্ভব খিদে পেয়েছে ।

    রাতে খাওয়ার কি হবে ?

    স্বপ্না এ-কথার কোন উত্তর দিল না । শাড়ি হাঁটুর কাছাকাছি তুলে কোমরে গুঁজে নিল - শাড়ির নিচের দিকটা ভিজে না যায় । জল ভেঙে গিয়ে ঘরের ওপাশে রাখা একটা ঢাকনা দেওয়া অ্যালুমিনিয়ামের কৌটো তুলে নিয়ে ঢাকনা খুলে দেখল । তারপর বলল, ঘরে চিঁড়ে আছে । তাই ভিজিয়ে দিচ্ছি । এই রাত করে জলের মধ্যে রান্না করা যাবে না । চিঁড়ে খেয়ে সবাই শুয়ে পড়ো ।

    সে ব্যবস্থাই হোল । মিনু চিঁড়ে খাবে না বলে আব্দার ধরেছিল । স্বপ্না ওকে এক চড় বসিয়ে দেয় । তারপর দিলীপ মেয়েকে কোলে নিয়ে কান্না থামায়, আদর করে চিনি দিয়ে মাখা ভেজা চিঁড়ে খাইয়ে দেয় ।

    দিলীপ আর মিনুর খাওয়া হয়ে গেলে স্বপ্না নিজে খেয়ে নিল । বিছানাটা চৌকির ওপর পেতে ফেলল । তারপর শাড়ির আঁচল দিয়ে দুপা ভাল করে মুছে পা চৌকির ওপর তুলে নিল । দিলীপ মেয়েকে কোলে করে বাইরে গিয়েছিল জল সরাতে । মেয়েকে নিয়ে দিলীপ ফিরে এলে মিনুর পাও মুছিয়ে দিল স্বপ্না । তারপর ওকে একপাশে শুইয়ে দিল ।

    কুপিটা জ্বেলে রাখল দিলীপ । কেরোসিন অবশ্য অনেকটা পুড়বে । উপায় নেই - ঘরে একটা আলো রাখতে হবে । রাতে তো ঘুমোন যাবে না । প্রাণীটা আবার ভেতরে ঢুকে আসতে পারে । ঘরে বাচ্চা রয়েছে - সাবধানে থাকতে হবে ।

    কিন্তু শরীর মানতে চায় না । চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসে, আবার জোর করে জেগে ওঠে দিলীপ । বৃষ্টি আর হচ্ছে না । কিন্তু খুব জোর হাওয়া দিচ্ছে - তার গোঁ গোঁ শব্দ । ঘরের দরমার দেয়াল অল্প অল্প দোলে - মচমচ করে আওয়াজ হয় । দেয়ালের ফাঁকফোকর দিয়ে ঠাণ্ডা জোলো হাওয়া ঢুকে এসে দিলীপের গায়ে বেঁধে - সারাদিন ভেজার পর একটু শীত করে । বৃষ্টি যদি আর না হয় তাহলে কাল থেকে জল নামবে । প্রথমে জল সরে যাবে উঁচু জায়গাগুলোর থেকে - তারপর দিলীপদের পাড়ার জল নামবে । কাল ডিউটি কামাই হবে - সাহেব খুব চটে যাবে । চালের দিকে একটা ছোট্ট আওয়াজ - দিলীপ চমকে সেদিকে তাকায় । একটা টিকটিকি একটা পোকা ধরেছে - এই জলে কতরকম পোকামাকড় যে ঘরে আসছে । পোকাটা বেশ বড় । শিকারীর দাঁতের কামড়ের থেকে বেরোবার জন্যে ঝটপট করছে । টিকটিকিটা চালের ফ্রেমের কাঠে পোকাটার মাথা আছড়ে আছড়ে ওটাকে কাবু করার চেষ্টা করছে । দিলীপের চোখ পড়ে স্বপ্নার ওপর । বৌটা ঘুমিয়ে পড়েছে - বোধহয় দিলীপ জেগে আছে দেখে নিজে আর জেগে থাকার চেষ্টা করেনি । একহাত দিয়ে ঘুমন্ত মিনুকে জড়িয়ে ধরে আছে । আহা রোগা বৌটা - কন্ঠার হাড় জেগে উঠেছে - কিন্তু মুখটা গোলগাল, আর শরীরটা নরম । ওর গায়ে হাত রাখে দিলীপ - ঘুমের ভেতরেই স্বপ্না ওর হাতটা নিজের গায়ে চেপে ধরে । কিন্তু তখনই দিলীপ শুনতে পায় একটা অচেনা শব্দ - অনেকটা মৃদু শিষের মত আওয়াজ । দিলীপের হাত সরে যায় স্বপ্নার গায়ের থেকে, চোখ চলে যায় ঘরের চালের দিকে । আছে কি ওপরে কোন ফাঁক ফোকরে ? কোথাও কি দেখা যাচ্ছে ঐ কালো চকচকে শরীরটার আভাস ?

    শরীরের ক্লান্তিতে শেষ পর্যন্ত সাপের ভয় ভুলে ঘুমিয়ে পড়েছিল দিলীপ । ঘুম ভাঙ্গল একটা বিকট আওয়াজে । একটা মানুষের মরণ চিত্কার । সেইসঙ্গে আরও কয়েকজনের জলের ভেতর দিয়ে দৌড়ে চলে যাবার ছপছপ শব্দ । কুপি নিভে গিয়ে ঘরে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার । তেল ফফুরিয়ে গেছে হয় তো । মিনু জেগে উঠে হাঁ হাঁ করে কান্না জুড়েছে । স্বপ্না কথা বলতে পারছে না - খালি বোবার মত মুখে আ-আ করে আওয়াজ করছে, আর দুহাতে দিলীপের একটা হাত খিমচে ধরেছে ।

    দিলীপ মাথার বালিশের নিচে থেকে টর্চ বের করে আলো জ্বালল । ঘরের ভাঙা দরজাটার কাছে একটা লোক জলের মধ্যে লম্বা হয়ে পড়ে আছে । টর্চের এই আলোয় আর বিশেষ কিছু দেখা যাচ্ছে না ।

    প্রথমে বৌ আর মেয়ের মাথায় কয়েকটা আদরের থাবড়া মেরে ওদের একটু শান্ত করল দিলীপ । তারপর টর্চ নিয়ে লোকটার কাছে গিয়ে ওকে ভাল করে দেখল । অল্পবয়েসী একটা জোয়ান ছেলে - নিশ্চয়ই ভিন গাঁয়ের - দিলীপ ওকে কোনদিন দ্যাখেনি । ছোবল খেয়েছে গালে, মুখের ঠিক পাশটায়, একটু একটু রক্ত বেরোচ্ছে জখমের জায়গাটা দিয়ে । অজ্ঞান হয়ে গেছে ছেলেটা । পাশে একটা লোহার ডাণ্ডা পড়ে আছে - বোধহয় ওর হাতে ছিল । চালে টর্চের আলো ফেলল দিলীপ । টর্চের মৃদু, গোল আলোটা চালের এধার থেকে ওধার পর্যন্ত ঘোরাঘুরি করল । অতিথিটিকে এখন কোথাও দেখা যাচ্ছে না । চেঁচামেচি হাঙ্গামা শুনে কাছাকাছি কয়েকটা বাড়িতেও আলো জ্বলে উঠছে এক এক করে - কুপি, লন্ঠন, টর্চ । কিন্তু কেউই বেরোচ্ছে না নিজের বাড়ি থেকে ।

    ব্যাপারটা বুঝে নিল দিলীপ । এরা পেশাদার চোর ডাকাত নয় । এই ঝড়বৃষ্টির সময় অনেক লোকই ঘরে জল ঢুকে যাওয়ায় কোথাও উঁচু জমিতে গিয়ে উঠেছে । তাদের ঘর এখন খালি । এরা এসব খালি ঘরে ঢুকে যা কিছু জিনিষপত্র পাচ্ছে তা হাবিস করছে । ওদের ঘরের দরজা ভাঙ্গা দেখে বোধহয় ভেবেছিল ঘরে কেউ নেই । ঘরের বাইরে উঁকি মেরে টর্চের আলোয় দেখে নিল দিলীপ । সাইকেলটা জায়গামতই আছে । ওটা গেলে কেলেঙ্কারি হতো । সাইকেল ছাড়া তো ওর চলবে না । আর একটা নতুন সাইকেলের দাম আড়াই-তিন হাজার টাকা । ভাগ্যিস চোরগুলো সাইকেলটার দিকে নজর দেয়নি ।

    কিন্তু এবারে লোক না ডাকলেই নয় । প্রথমে কুপিটাতে তেল ভরে ওটা জ্বেলে দিল । তারপর বৌকে আর মেয়েকে সাহস দিল । মেয়েকে নিয়ে একটুখানি বসে থাকুক স্বপ্না । এক্ষুনি চলে আসবে দিলীপ ।

    পড়শীরা কয়েকজন এল । যারা কাছাকাছি থাকে - বলরাম, নারায়ণ মণ্ডল আর শ্রীমন্ত রায় । এই রাতে ওদের যে আসবার খুব একটা ইচ্ছে ছিল তা নয় । কিন্তু বৃষ্টিটা ধরেছে আর চোরের দল পালিয়েছে । তাছাড়া যে ছেলেটা সাপের ছোবল খেয়েছে তাকে দেখার কৌতূহলটাও চেপে রাখা শক্ত । দিলীপের ঘরে ঢুকল না কেউ । দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে টর্চের আলোয় ছেলেটাকে দেখতে লাগল । দিলীপের ঘরের ভেতর সাক্ষাৎ যম লুকিয়ে আছে । কোথায় ওৎ পেতে আছে কে জানে ।

    ছেলেটাকে দেখে এখন পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে ও খুব তাড়াতাড়ি মারা যাবে । জ্ঞান তো নেইই, মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বেরোচ্ছে, হাত পা মাঝে মাঝেই তড়পে তড়পে উঠছে - মাথাতেই বিষ পৌঁছে গেছে কিনা কে জানে । যে কথাটা সকলের মাথায় ঘুরছিল তা শ্রীমন্ত বলেই ফেলল - সকালের আগে তো কিছু করা যাবে না । আর এ-ছেলেটা সকাল পর্যন্ত বাঁচবে কিনা সন্দেহ । তবুও, ভোর হলে পর নিয়ে যেও হেলথ সেন্টারে । এছাড়া থানাতেও তো একটা খবর দিতে হবে ।

    পড়শীরা যে যার বাড়িতে ফিরে গেল । বৃষ্টি থেমেছে - আশা করা যায় এবার জল নামতে শুরু করবে । ভোর হতে এখনও ঘন্টা দুই আড়াই । ততক্ষণ জেগে থাকতে হবে । দিলীপ ছেলেটাকে ডিঙিয়ে ঘরে ঢুকল । টর্চের আলো এখন অত্যন্ত করুণ । অতিথি মহারাজ আর কোন সাড়াশব্দ করছেন না । চৌকির ওপর স্বপ্না হাঁটুতে থুতনি রেখে বসে আছে, পাশে বসা মিনুকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে রেখেছে । পা মুছে চৌকিতে ওঠার আগে দিলীপের চোখে পড়ল - ঘরের এক কোণে কালো রঙের একটা বড়সড় ব্যাঙ - শরীরের অর্ধেকটা জলে ডুবিয়ে বসে আছে । কোনভাবে ঢুকে এসেছে ঘরের ভেতর । থাকুক ব্যাটা ওখানে বসে । কাল সকালে ওটাকে তাড়িয়ে বার করা যাবে । দিলীপ চৌকির ওপর পা তুলে নিল । টর্চ নিবিয়ে দিয়ে বৌকে বলল, মিনুকে ঘুম পাড়িয়ে দাও । আমরা জেগে থাকি । সকাল হলে দেখা যাবে কি করা যায় ।

    দিলীপ জেগে থাকে । পাশে স্বপ্না বসে বসে ঢুলছে । মাঝে মাঝে পুরো জেগে উঠে মেয়ের গায়ে আস্তে আস্তে আদরের থাবড়া মারছে - মেয়ের ঘুম না ভেঙে যায় । কুপির শিখাটা ধ্যানী মহাপুরুষের মত সোজা আর স্থির । ছেলেটা মাঝে মাঝে গোঙাচ্ছে - ঘড়ঘড় আওয়াজ করছে । সেই সঙ্গে শেষ রাতের জোরালো হাওয়ার ত্রক্রুদ্ধ তর্জন । দিলীপ কান পেতে থাকে । সেই রহস্যময় আওয়াজটা কি শোনা যাচ্ছে - সেই মৃদু আর মোলায়েম শিষের শব্দ ?

    ঝামেলা লাগল সকালে । ছেলেটাকে কিভাবে নিয়ে যাওয়া যাবে । শ্রীমন্তর দুটো রিকশা-ভ্যান আছে - ভাড়ায় খাটায় । দিলীপ ছেলেটাকে একটা ভ্যানে চাপিয়ে হেলথ্‌ সেন্টারে নিয়ে যেতে চায় । শ্রীমন্ত গাঁইগুঁই করে । একে তো দিলীপ ওর পড়শী - ওর এই বিপদে ওর থেকে টাকা চাওয়া মুস্কিল । তার ওপর ভ্যানে করে মড়া নিয়ে গেলে ওর ব্যবসার অমঙ্গল হবে । শেষ পর্যন্ত দিলীপ ওর হাতে দুশ টাকা গুঁজে দেওয়ায় রাজি হয়ে গেল । এখনও মাসের দশ তারিখ পেরোয়নি - দিলীপের কাছে এই টাকাটা ছিল । মাসের শেষে ওর হাত একেবারে খালি থাকে - ভাগ্যিস এই ঝামেলাটা তখন হয়নি । ভ্যান যে চালায় সে লোক এখনও আসেনি । এই জলের ভেতর আসবে কিনা সন্দেহ । এলেও হয়তো ভ্যানে চড়িয়ে কোন সাপে কাটা মড়া টানতে রাজি হবে না । দিলীপ নিজেই ভ্যান চালিয়ে ছেলেটাকে নিয়ে চলল হেলথ্‌ সেন্টারে । বলরাম উঠে বসেছে ভ্যানের পাটাতনে - ও দিলীপের সঙ্গে যাবে হাসপাতালে আর থানায় ।

    বৃষ্টিটা একেবারে থেমে গেছে । মেঘ এখন ছেঁড়া ছেঁড়া - তার ফাঁক দিয়ে হাল্কা রোদ আসছে । একটু খুশি হয়ে উঠল দিলীপ । এবার নিশ্চয়ই জল নামতে শুরু করবে । তারপরেই পরিশ্রম অনুভব করল । সাইকেল চালিয়ে অভ্যেস - রিকশা ভ্যান তো আর চালায় না । তার ওপর দুটো বাড়তি মানুষের বোঝা টানতে হচ্ছে ওকে । দিলীপ রিকশার প্যাডেলে চাপ দিতে লাগল - হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে - জোরে জোরে শ্বাস টানতে টানতে ।

    হেলথ্‌ সেন্টারে এখন ডাক্তার, নার্স এসব কেউ নেই । অত সকাল - তার ওপর চারদিকে জল । একটা চৌকিদার গোছের লোক ছিল - বোধহয় এখানেই থাকে । ছেলেটাকে দেখে বলল, এতো মনে হয় মরেই গেছে । তবে সেকথাটাও তো ডাক্তারবাবু এসেই লিখবেন । আপনার নাম ঠিকানা, রোগীর নাম ঠিকানা -এসব লিখে দিন খাতায় ।

    এ আর এক ঝামেলা । নিজের নাম ঠিকানা তো লিখল, কিন্তু ছেলেটার সম্বন্ধে কি লিখবে ? রোগী জীবিত বা মৃত - নাম অজানা - সাকিন অজানা । তা তো আর লেখা যাবে না । ঘটনাটা খুলে বলল দিলীপ । শুনে হাসতে লাগল হেলথ্‌ সেন্টারের লোকটা । বড় মজার ঘটনা । ঠিক আছে । আমাকে যা বললেন খাতায় তাই লিখুন । থানায় যাচ্ছেন তো ? সেখানে গিয়ে রিপোর্ট করুন । আমরাও থানায় খবর পাঠিয়ে দেব । বডিও তো পোস্টমর্টেমে পাঠাতে হবে ।

    থানায় পুলিশ প্রথমে দিলীপের কথা শোনে না । যখন শুনল তখন বিশ্বাস করল না । তারপরে উল্টোচাপ । বাড়িতে সাপ পুষেছিস, ওয়াইল্ড লাইফ অ্যাক্টে পড়ে যাবি । সাত বছরের জেল হবে ।

    তারপর কানে ফিসফিস - টাকা বার কর । পাঁচ হাজার টাকা ।

    এই সেরেছে । অত টাকা কোথায় পাওয়া যাবে ?

    ওরে বাস্টার্ড - তুমি টাকা দেবে না ? তবে থাক শালা ওইখানে বসে । বড়বাবু আসুক - তখন তোকে লক আপে ভরব । আর পিটিয়ে বাপের নাম ভুলিয়ে দেব ।

    দিলীপ বসে রইল - থানার মেঝেতে, এককোণে । বলরামকে ফেরৎ পাঠিয়ে দিয়েছে - গোপাল সাহাকে বলে টাকা জোগাড় করা যায় কিনা তার ব্যবস্থা করতে । পুলিশ যদি গ্রেপ্তার করে হাজতে পুরে দেয় তাহলে তো হয়ে গেল । কতদিনে ছাড়া পাওয়া যাবে কে জানে । চাকরিটা তো চলে যাবে । বৌ-বাচ্চা নিয়ে খাবে কি ? তার ওপর হাজতে ভরে রেখে যদি পেটায় তাহলে তো আরও ভাল । হয়তো হাত পা ভেঙে পড়ে থাকতে হবে । কি ঝামেলায় ফেলে দিল শালা সাপটা । চোরকে কামড়ে দিলীপকে বাঁশ দিয়ে দিয়েছে । গায়ের শার্টটা তুলে মুখের ঘাম মুছে নেয় দিলীপ । বুকের ভেতরটা ধুক পুক করছে - হাত পা ঠাণ্ডা মেরে যাচ্ছে । মাঝে মাঝেই পুলিশগুলো ওর পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় ওর দিকে কটমট করে তাকিয়ে যাচ্ছে । বড়বাবু এলে দিলীপ তার হাতে পায়ে ধরবে । ব্যাপারটা বোঝাবার চেষ্টা করবে ।

    দিলীপকে বিপদ থেকে উদ্ধার করল তার বৌ । বলরামের মুখে খবর শুনে স্বপ্না প্রথমে এক পড়শীর কাছে মেয়েকে জিম্মা করেছে । তারপর সোজা চলে গেছে সোমা দত্তর কাছে । সব শুনে মহিলা গাড়ি নিয়ে চলে এসেছেন থানায় - সঙ্গে স্বপ্না । তাকে দেখেই পুলিশরা উঠে দাঁড়িয়ে আসুন দিদি, বসুন দিদি করতে লাগল । করতেই হবে । একে তো নারীসমিতির নেত্রী, তার ওপর পার্টিতে স্থানীয় সমিতির একটা গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন । খবরের কাগজ, টিভি, এসবে মাঝে মাঝে বিবৃতি দিয়ে থাকেন । খবর পেয়ে থানার বড়বাবু বাড়ি থেকে চলে এলেন । এল চা, সিঙ্গাড়া আর মিষ্টি - দিলীপ, স্বপ্না আর সোমা দত্তর গাড়ির ড্রাইভারের জন্যেও । সোমা দত্ত চা কয়েক চুমুক খেলেন - সিঙ্গাড়া আর মিষ্টি ছুঁলেন না । সব কিছু খুব তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে গেল । পুলিশ দিলীপের বয়ান লিখে নিল । সোমা দত্ত তার গাড়িতে উঠে চলে গেলেন । দিলীপ ফিরল তার ঘরে । রিকশা ভ্যান চালিয়ে - পাটাতনে বসা বৌ স্বপ্না ।

    শ্রীমন্তের বাড়ি গিয়ে ভ্যানটা ফেরৎ দিল দিলীপ । আর তখন খেয়াল হোল কাজ কেন কামাই করেছে সে-খবরটা সেনসাহেবকে দেওয়া হয়নি । ভদ্রলোক আজ নিশ্চয়ই ট্যাক্সি করে অফিস গেছেন । আর একেবারে ফায়ার হয়ে আছেন । শ্রীমন্তর একটা মোবাইল ফোন আছে । সেটা চেয়ে নিয়ে সাহেবের অফিসে ফোন করল দিলীপ ।

    কি হোল ? আজ কাজে এলে না কেন ? - ফোনে একটা চাপা গর্জন ভেসে এল ।

    স্যার, আমার ঘরে জল ঢুকে গেছে । ঘরের দরজাও ভেঙে পড়েছে ।

    বাকিটা আর বলল না দিলীপ । বেশি খবর দিলে আবার কি ঝামেলা হবে কে জানে ?

    সাহেব বললেন, তাই নাকি ?- এবার গলার আওয়াজটা একটু নরম । তা কাল কাজে আসবে তো ?

    হ্যাঁ স্যার । জলটা আজ নেমে যাবে মনে হয় । তাহলে কাল নিশ্চয়ই যাব ।

    মোবাইল ফোন শ্রীমন্তকে ফেরৎ দিয়ে ঘরে ফিরল দিলীপ । স্বপ্না পড়শীর বাড়ি থেকে মেয়েকে নিয়ে এখনও আসেনি । সে-বাড়ির মেয়েরা নিশ্চয়ই সাপ আর চোরের রোমাঞ্চকর গল্প শুনছে স্বপ্নার কাছ থেকে । জলটা বেশ একটু নেমেছে । বাইরে রোদও ঝকঝক করছে । আজ দুপুরের আগেই জল পুরোপুরি সরে যাবে মনে হয় ।

    ঘরে ঢুকেই ব্যাঙটার কথা মনে পড়ল । ওটাকে তাড়াতে হবে । কিন্তু ওটা নেই । দিলীপ চারপাশে তাকিয়ে ওটাকে খুঁজল । কোথাও নেই ।

    কিন্তু তখন শুনতে পেল ব্যাঙের ডাক । ঠিক ডাক নয় - আর্তনাদ । যেন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে ওটা । আওয়াজটা আসছে ঘরের চালের দিক থেকে । ওই ব্যাঙটাই হবে । হয়তো এ-বাড়ির সাপটা ধরেছে ওকে । এখন আস্তে আস্তে গিলছে । যতক্ষণ না মরবে ততক্ষণ ব্যাঙটা ডাক ছাড়তে থাকবে । একটানা ডাকছে না । মাঝে মাঝে থামছে - আবার ডাকছে ।

    স্বপ্না মেয়েকে নিয়ে ফিরল বেশ অনেকক্ষণ পরে । ঘরের বাইরে জলের ওপর ইঁট পেতে দিয়ে তার ওপর একটা প্রদীপ জ্বেলে দিল - পাশে এক ভাঁড় দুধ রাখল । দিলীপ হেসে বলল, তোমার লতা এখন দুধ খাবে বলে মনে হয় না । এখন আমিষ খাবার খাচ্ছেন তিনি ।

    তুমি তামাশা কোর না - স্বপ্নার গলা আর মুখ দুইই গম্ভীর । ওরা ঘরে ঢুকলে কি হোত বল তো ? হয়তো তোমাকে ডাণ্ডা দিয়ে মারত ।

    হয়তো মারত - দিলীপ ভাবল । বৌটারও তো জোয়ান বয়েস, ওকেও কি ছাড়ত ?

    ও নিশ্চয়ই বাস্তুসাপ - স্বপ্না আবার বলল । ও বাড়িতে থাকলে আমাদের ভালই হবে ।

    দিলীপ চুপ করে রইল । ভাল হবে ? কি হবে ? দিলীপের ধার কি শোধ হয়ে যাবে ? ওকি কোন বড় জায়গায় বেশি মাইনের কাজ পাবে ? স্বপ্না সেলাই করে অনেক বেশি রোজগার করবে ? ওদের ঘর পাকা হবে ? হলে কবে হবে ? হুঁ - বৌটার যত বাজে কথা । জলটা পুরোপুরি সরুক - তারপর লোকজন ডেকে ব্যাটাকে ঠেঙিয়ে মারতে হবে । গতরাতে বাইরের লোককে কেটেছে - আজ রাতে হয়তো ওদেরই কাউকে ছুবলে দেবে ।

    স্বপ্না দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই গলায় আঁচল জড়িয়ে প্রদীপের উদ্দেশ্যে প্রণাম করল । জল এখন দ্রুত নামছে । দিলীপের ঘরের মেঝের ইঁট প্রায় জলের ওপর ভেসে উঠেছে ।

    ব্যাঙটার কাতরানি শোনা গেল আবার । স্বপ্না চোখ বড় করে দিলীপের দিকে তাকাল । মিনু বলে উঠল, বাবা, ও কিসের আওয়াজ ? ভয় পেয়েছে বাচ্চাটা ।

    আমাদের সাপটা ব্যাঙ ধরেছে । ব্যাঙটা মরে যাচ্ছে তো, তাই ওরকম ডাকছে ।

    ব্যাঙটার কি খুব ব্যাথা লাগছে বাবা ?

    নিশ্চয়ই লাগছে মা । তা না হলে এরকম ডাকবে কেন ?

    দুপুর পর্যন্ত চলল এই আওয়াজ । মাঝে মাঝে বন্ধ থাকে - আবার হয় । ঘরের মেঝের ইঁট এখন ভিজে, কিন্তু জল নেই । স্বপ্না স্টোভে তেল ভরে খিচুড়ি রান্না করল, সেই সঙ্গে কুচিয়ে কাটা আলুভাজা । বৌটা রাঁধে ভাল । দিলীপ খেতে খেতে বারবার ঘরের দরজাটা আর চালের ফুটোটা দেখছিল । সারাতে ভালই খরচা হবে - অন্তত পাঁচশো টাকা । হাতের সব টাকা বেরিয়ে গেছে শ্রীমন্তর ভ্যান ভাড়া করতে । অথচ এই সারাইটা এক্ষুনি না করালেই নয় । পাঁচ হাজার টাকা চাই শুনে গোপাল সাহা বলরামকে হাঁকিয়ে দিয়েছিল । এখন এ টাকাটা দেবে কি ? এই পাঁচশ টাকা । ব্যাঙটার ডাক অনেকক্ষণ বন্ধ আছে । সাপটার পেটে চলে গেছে বোধহয় ।

    খেয়ে উঠে আঁচানোর জন্যে বাইরে গিয়েছিল দিলীপ । তখন দেখতে পেল । দরজার বাইরে উঠোনে চিৎ হয়ে লম্বালম্বি পড়ে আছে । প্রায় ফুট পাঁচেক লম্বা । রোদ লেগে শরীরের কালো রঙ চিকমিক করছে । গলার কাছটায় উঁচু হয়ে ফুলে রয়েছে । ব্যাঙটা বড় সাইজের ছিল । গিলে উঠতে পারেনি ওটাকে ।

    (পরবাস, ডিসেম্বর, ২০০৪)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments