তবে কি নাছোড়বান্দা ফাল্গুন, কমরেড ?
বসন্ত বিজ্ঞপ্তি আঁটে ঘূর্নিফল গাছে ;
পর্দায় সর্দার হাওয়া কসরৎ দেখায় ।
আকাশে অসংখ্য টর্চ ; মেঘেরা ফেরার -
গোলদীঘির গর্তে চাঁদ ধরা পড়ে গেছে ।
বসন্ত সত্যিই আসবে ? কী দরকার এসে ?
বছর-বছর দেখা দিয়েছে সে ক্যাম্বেলের ভিড়ে ॥
কোথাও কোনোরকম উদ্দেশ্যহীনতা নেই । হিসেবের খাতা খুলে রাখা হয়েছে সামনেই । এমন কোনো যোগফল নেই যা ম্লান করে দিতে পারে বিয়োগফলকে । চাঁদ ধরা পড়ছে গর্তে, আর বসন্ত ধরা পড়ছে ক্যাম্বেলে । একেবারে নিরাবেগ, সর্তক আপাদমস্তক । কিংবা যদি দেখি `কাব্যজিজ্ঞাসা' যা দৃষ্টি পর্বে বিভক্ত, সেখানেও হিসেবের উপায় নেই নয়ছয় হওয়ার । সেখানেও খুঁজলে এমন কিছু পাওয়া যাবে না যা পরিকল্পনার দিক থেকে প্রতিহার্য । চতুর্থ পর্বে তো সেই `সজাগ দৃঢ় সঙ্কল্প'-র চতুর্থী ।
জাগুন জাগুন       পাড়ায় আগুন
       বাড়ে হু হু
মগজে প্রভূত        দম্ভ, তবু তো
       আহা উহু ।
মনের মহল        দিচ্ছে টহল
       মিঠে কুহু
এখনো জাগুন        পাড়ায় আগুন
       বাড়ে হু হু ।
এই জেগে ওঠার ডাক তাঁর `সকলের গান' - এর অতি পরিচিত যে প্রথম ছত্র (`কমরেড, আজ নবযুগ আনবে না ?'), তার থেকেও প্রত্যক্ষ, তার থেকেও অমোঘ মনে হতে থাকে । আর নিজের গান যে সকলের গান থেকে আলাদা কিছু নয়, এটাও পরিষ্কার হয়ে যায় নির্ঘাত ।
আর্চিবল্ড ম্যাকলিশের `মিউজিক অ্যাণ্ড ড্রাম' এমন একটি কবিতা যাতে ব্যষ্টি এবং সমষ্টির রূপরেখা আঁকা হয়েছে খুব পরিষ্কার করে । একেবারে প্রথম স্তবকেই হাতের মুঠোয় চলে আসে কোন শিবির কেমন করে দাঁড়িয়ে আছে তার একটা আলেখ্য ।
' গচ্ংত্র স্ংত্র ঞণ্ণশত্র স্ধঢ / ঈশণ্ণস্য ঞচ্শধঢ; / গচ্ংত্র স্ধঢ ঞণ্ণশত্রয স্ংত্র / ংঔণ্ণযঠব ছভছঠত্র.' ড্রাম বাজতে থাকে তখনই যখন ব্যষ্টি পর্যবসিত হয় সমষ্টিতে । তখন অনেক অবান্তর হয়ে যায় সঙ্গীত । সঙ্গীতের প্রাসঙ্গিকতা তখনই আবার ফিরে আসে যখন জনতার ভূমিকা থেকে ব্যক্তির ভূমিকায় ফিরে আসতে হয় মানুষকে । কবিতাটি যত এগিয়েছে তত আমরা বুঝতে শিখেছি, যখন অধ্যাত্ম সরে যায়, তখন বেজে উঠতে থাকে দামামা । আবার যখন অধ্যাত্মের প্রত্যাবর্তন ঘটে তখন শুরু হয়ে যায় সঙ্গীত । এইভাবেই দেখব যে, রাষ্ট্র দামামাকেই তুলে ধরে, আর প্রজার হাতে থাকে বাজনার সেই গভীরতা এবং একাকিত্ব । আমরা যারা ছবি আঁকি, কবিতা লিখি, রচনা করি কথাসাহিত্য, বা কোনো উন্মোচনের কাছে গিয়ে দাঁড়াতে চাই, তাদের কাছে ড্রাম এবং মিউজিকের এই সমস্যা একটা বড়ো সমস্যা হয়ে ওঠে চিরকাল । একতা এবং একাকিত্বের এই দাম্পত্যভার কাঁধের ওপর এমনভাবে চেপে বসে যে মাঝে মাঝে মনে হয়, কে কতটা নিজের মতো করে এই ভার লাঘব করতে পারেন সেই উপায়টাই যেন একটা বড়ো উপকরণ হয়ে ওঠে এগিয়ে যাওয়ার পথে । সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখলেন `দীক্ষিতের গান' । একেবারে শুরুর তিনটি ছত্র - `পালাবার পথে ধুলো-ওড়ানোর দঙ্গলে, ভাই / আমিও ছিলাম একজন ; আজ প্রাণপণে তাই / ভীরুতার মুখে লাথি মেরে লাল ঝাণ্ডা ওঠাই ।' লক্ষ রাখতে হবে, কবিতাটি শেষও হয়েছে এই তিনটি ছত্র দিয়ে । ছন্দের সংগঠনের মধ্যে কোনো শৈথিল্য নেই । বক্তব্য এতটাই দানা বেঁধেছে যে মুখস্থ করে ফেলতে ইচ্ছে করে অবসাদের মুহূর্তে । `বিপদ-তাড়ানো আওয়াজে আজকে হাঁকো হৈ হৈ / ফাঁসিতে দিয়েছি জীবন, সরতে পিছপাও নই / গৃহকলহকে দূরে ঠেলে এসো একজোট হই ।' এই যে আহবান এর কোথাও কোনো দুর্বলতা নেই । ডাকা হচ্ছে গলা খুলে । বোঝাও যায় যে, এই ডাকের মধ্যে সেই যাদু আছে যা সোজা করে দিতে পারে মেরুদণ্ড । মাথা উঁচু করে একজোট হতে পারে তারা যারা ভয়ে ভয়ে টুকরো হয়ে আছে এতদিন । শুধু একজোট হওয়া নয়, পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটার ইচ্ছেটাও প্রবল হয়ে উঠতে থাকে । তার একটা বড়ো কারণ কবিতা বেজে উঠেছে । শোনা যাচ্ছে ড্রামের স্পন্দন । সুভাষ তাঁর একজন প্রিয় কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত সম্পর্কে শতবর্ষে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে লিখেছিলেন (মাঘ ১৩৯৪, আনন্দবাজার পত্রিকা) - `উনিশ শো দশ থেকে বাইশের মধ্যেই যতীন্দ্রনাথের কবিতা পরিণত আকার নেয় । দেশ আর দুনিয়ায় তখন ছিল একটা তোলপাড়ের সময় । তাঁর ব্যক্তিত্বে আর কবিত্বে এই সময়কালের ছাপ যেভাবেই হোক পড়েছিল । বিনা সাক্ষ্যপ্রমাণেও তা বলা যায় । শুধু মানবাধিকার নয়, মানুষের সমানাধিকারের লড়াইও তখন থেকেই ত্রক্রমশ পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়ে ।' যতীন্দ্রনাথের `মরুশিখা' বেরোয় ১৩৩৪-এ । তার মানে সেটা ১৯২৭ । এই কাব্যগ্রন্থেরই একটি কবিতা `দেশোদ্ধার'। এর অঙ্গে অঙ্গে সেই সময়চেতনার `সাক্ষ্যপ্রমাণ '।
ওরে ওঠ্ ওঠ্ জেগে,-
তরুণ অরুণ আলোক জানা ও অজানা ব্যথায় লেগে !
সকলে স্কন্ধে তুলে নিয়ে হল,
পাঁচনে খেদায়ে বলদের দল,
প্রভাতের মাঠে কলকোলাহলে দল বেঁধে চল্ বেগে ।
সুভাষের `কাব্যজিজ্ঞাসা'-য় যে ঘুম ভাঙানোর ডাক আমাদের কানে এসেছে শেষপর্যন্ত কিংবা `গৃহকলহকে দূরে ঠেলে এসো একজোট হই' যে ডাকের ভাষা, তার সঙ্গে `দেশোদ্ধার'-এর ডাকের এই আত্মীয়তা যে খুঁজে পেতে কষ্ট হয় না তার একটা প্রধান কারণ, পায়ের তাল মেলানোর জন্য এগিয়ে এসেছে পা । বহু আগেই যে কাঠি পড়ে গেছে সেই ড্রামে ।
`সুকান্ত সমগ্র'-তে পাওয়া যায় `চির একুশের কবি' এই নামে একটি লেখা সুভাষের । `মাত্র একুশ বছর সুকান্ত পৃথিবীতে বেঁচে ছিল' - এ কথা যিনি শুরুতেই লিখছেন তাঁর শুরুটা যে `পদাতিক' দিয়ে সেটাও তো বেরিয়েছিল তাঁর প্রায় একুশ বছর বয়সে । এটুকু মনে রেখে আমরা চলে যাই সুভাষের বক্তব্যের একটা বিশেষ অংশে । `সুকান্ত মুখে যাই বলুক, আসলে সে শুধু পার্টির কর্মীদের জন্যেই লেখেনি । যে নতুন শক্তি সমাজে সেদিন মাথা তুলেছিল, সুকান্ত তার বুকে সাহস, চোখে অন্তর্দৃষ্টি আর কন্ঠে ভাষা যুগিয়েছিল । এ কথাও ঠিক নয়, কাউকে খুশি করার জন্যে সুকান্ত লিখেছিল । তাগিদটা বাইরে থেকে আসেনি, এসেছিল তার নিজের ভেতর থেকে । পাঠকের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আসলে নিজেকেই সে কবিতায় ঢেলে দিয়েছিল । কিভাবে সে কবিতায় কথা বলেছিল সেটাও দেখতে হবে । সুকান্তর আগে আর কেউ ওকথা ওভাবে বলেনি ব'লেই পাঠকেরা কান খাড়া ক'রে তার কথা শুনেছেন । বলবার উদ্দেশ্যটা যাঁদের মনের মতন ছিল না, বলবার গুণে তাঁরাও না শুনে পারেন নি ।' এই যে উদ্ধৃতি এর নিবিষ্ট পাঠক হলে আমরা কিন্তু সুভাষের কবিতা নিয়ে কথা বলবার উপকরণ পেতে থাকি নির্ঘাত । নতুন শক্তিতে যে প্রতিমা গড়া হয়ে গেছে, পটুয়াদের পাড়া থেকে তাকে তুলে এনে মণ্ডপে স্থাপিত করার পর প্রাণপ্রতিষ্ঠার কাজটা সুভাষ করেছিলেন মনের আনন্দে । অন্তরের তাগিদ না থাকলে এই মনের আনন্দ কিন্তু আসে না । অন্তরের তাগিদ থেকেই শেষে বেরিয়ে এসেছিল সেই কবিতা যার নাম `সুন্দর' । দমকা হাওয়ায় যার আঁচল ওড়ে, শেষ বিকেলের রোদ যার ঘামকে মুক্তোয় পরিণত করে, যে `আকাশ উদ্ভাসিত ক'রে' হেসে উঠতে পারে একসময়, সে কিন্তু সুন্দরের মুহূর্তকে তখনো উপহার দিতে পারছে না । সেই মুহূর্ত আসবে আর কখন তাহলে ? এই প্রশ্নের প্রকৃত উত্তর মূর্ত হয়ে ওঠে সেই `সুন্দর'-এর শেষে এসে ।
যখন ভোঁ বাজতেই
মাথায় চটের ফেঁসো জড়ানো এক সমুদ্র
একটি ক'রে ইস্তাহারের জন্যে
উত্তোলিত বাহুর তরঙ্গে তোমাকে ঢেকে দিল
যখন তোমাকে আর দেখা গেল না -
তখনই
আশ্চর্য সুন্দর দেখাল তোমাকে ॥
এখানে প্রতিমার প্রাণপ্রতিষ্ঠায় একেবারে অন্যরকমের পুজো এসে হাজির হয়েছে মণ্ডপে । যে মানুষের মাঝে এসে দাঁড়িয়েছে তার কোনো মুদ্রাই আলাদা করে সেই সম্পূর্ণতার জন্ম দিতে পারছে না । `উত্তোলিত বাহু'-র মাধ্যমে জনতার একটিই মুদ্রা যখন একাই একশো হয়ে ওঠে, তখন অন্নপূর্ণার দেবারতি শুরু হয়ে যায় । মুখমণ্ডল মুছে যায় বলে মুখ হয়ে ওঠে `আশ্চর্য সুন্দর' । এখানে রূপই শেষপর্যন্ত অরূপের মাধ্যমে মূর্ত হয়ে উঠেছে । যাঁরা এই ব্যাখ্যায় তত সন্তুষ্ট হতে পারবেন না, যাঁদের মনে হবে উদ্দেশ্যর চাপে হারিয়ে যেতে বসেছে বিধেয়, তাঁরাও কিন্তু একটা কথা অস্বীকার করতে পারবেন না কখনো । কান খাড়া করে তাঁদের শুনতে হয়েছে সুন্দরের সেই পদশব্দ । তার একটাই কারণ । উদ্দেশ্য যতই প্রণোদনের সৃষ্টি করুক, যতই প্ররোচণার ভূমিকা থাক, বলবার গুণে শুনতে হয়, শ্রোতা হতে হয় সেই কবিতার ।
সুভাষের একটি কবিতা `খাঁচা-ছাড়া' স্বল্পায়তন হয়েও একাধিক দিক থেকে বিজয়ী । শুধু বলবার গুণ নয়, এর মধ্যে আছে ধরবার গুণ । প্রায় সত্যের মর্যাদা পেতে চলেছে এমন একটা ধারাকে হাতেনাতে ধরে ফেলা । আগে একবার দেখে নেওয়া যাক তার পুরো অবয়ব
লেখকের দল ।
একদিকে জল
একদিকে দানা ।
বসিয়ে খাঁচায়
ওরা লেখা চায় ।
খাঁচা ভেঙে তাই
মেলছি ডানা ॥
ডানা মেলার কথা বললেও শেষপর্যন্ত কে কতটা ডানা মেলতে পারেন সেই আকাশে যা নীল হয়ে আকাশে ছড়িয়ে আছে এক অবিমিশ্র জীবনানন্দ হয়ে, সেই প্রশ্ন থেকেই যায় কাঁটার মতো । তাই সে কথা আনছি না । বলতে চাইছি এই কথাটাই যে, শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠান থেকেই প্রাতিষ্ঠানিকতার জন্ম হয় না, মতবাদও জন্ম দেয় এক ধরনের প্রাতিষ্ঠানিকতার । সেটাও কিন্তু একজন প্রকৃত কবিকে বদ্ধ করে ফেলে পিঞ্জরে । এই কবিতাটি তার পাঠককে এমন এক ভাবনার দিকেও চালিত করতে পারে অজান্তে । তখন আমাদের মনে হতে পারে, যে-সুভাষ কবিতাজীবনের শুরু থেকেই দীক্ষামন্ত্র লাভ করেছিলেন, দীক্ষিত হওয়ার জন্য যাঁকে এলোমেলোভাবে গুরু খুঁজতে হয়নি দিনের পর দিন, তিনি তাঁর বীজমন্ত্র লুকিয়ে রাখতে পারেননি সবসময় । যখনই সেই বীজমন্ত্র প্রকাশ হয়ে পড়েছে তখনই সাধকের নতুন নতুন শক্তিমত্তার প্রকাশ সত্ত্বেও কোথায় যেন লাঘব ঘটেছে দীপান্বিতার । মাদলে নতুন নতুন বোল এসেছে, কিন্তু সুর কেটে গেছে বাঁশির । কিন্তু যখনই তিনি দীক্ষামন্ত্র লুকিয়ে রাখতে পেরেছেন তখনই আমরা পেয়েছি কবিতার সেই হয়ে ওঠা, বা কবিতার সেই হয়ে না ওঠার মহতী বিফলতা ।
আমি যত দূরেই যাই
       আমার সঙ্গে যায়
ঢেউয়ের মালা-গাঁথা
এক নদীর নাম -
আমি যত দূরেই যাই ।
আমার চোখের পাতায় লেগে থাকে
নিকোনো উঠোনে
সারি সারি
       লক্ষ্মীর পা
আমি যত দূরেই যাই ॥
প্রথম স্তবকে মরা নদী নয়, `ঢেউয়ের মালা-গাঁথা' এক নদী । তার মানে জঙ্গমতার পরাকাষ্ঠা । দ্বিতীয় স্তবকের লক্ষ্মীর পা হাঁটছে না । স্থির হয়ে আছে মাটির বুকে । তার মানে পরাকাষ্ঠা স্থাবরতার । স্থাবর এবং জঙ্গম দুটোকে নিয়েই চলেছেন কবি । যে নদীর কথা বলেছেন তার মধ্যে দেখে নেওয়া যায় জনতার ঢেউ । অর্থাৎ সেই সমষ্টির জয়যাত্রা । যে উঠোনের কথা বলেছেন সেখানে ব্যক্তির নি:শব্দ আলপনা থইথই করে । যত দূরেই যান না কেন ব্যষ্টি এবং সমষ্টি চলেছে পাশাপাশি । কোনোটাকেই বাদ দিচ্ছেন না, তুচ্ছ করছেন না কোনোটাকেই । ফলে ড্রাম ও মিউজিকের দাম্পত্যের সেই বোঝা জাঁকিয়ে বসতে পারছে না সুভাষের কাঁধে । পায়ে পা মেলানোর মাদলও বাজছে, আবার বাঁশিরও সুর কাটছে না ছড়িয়ে পড়তে গিয়ে । পাঠকেরও স্বস্তি মিলছে বেশ ।
(পরবাস, ডিসেম্বর, ২০০৪)