জানলাম যিনি এসেছিলেন তাঁর নাম এডওয়ার্ড ডিমক । আমেরিকান, কলকাতায় এসেছেন বৈষ্ণব কবিতা নিয়ে কাজ করবেন বলে । কিন্তু তার আগে আমার খেয়াল হয়েছে যে আমার মুখের চন্দন শুকিয়ে বীভত্স দেখাচ্ছে, ঐ সুন্দর যুবক আমাকে দেখে কী ভাবলো ? আমি ভেঙে পড়লাম একেবারে । বাবা জানালেন তার পরের দিন মা-বাবার ওঁর বাড়িতে নিমন্ত্রণ, সেটাই মনে করিয়ে দিতে এসেছিলেন ।
পরদিন মা-বাবা বেরুবার আগে কতোবার যে বললাম, গিয়েই বলবে আমার মুখে চন্দন মাখা ছিলো । রাতে আর ঘুমোতে পারি না, ওঁদের ফেরবার অপেক্ষায় জেগে রয়েছি । বাড়িতে ঢোকামাত্র বললাম, `বাবা বলেছিলে ?' `কী ?' `কী আবার !' বাবার অন্যমনস্কতায় আমি বিরক্ত । বাবা জানালেন, বলেছিলেন এবং ড: ডিমক জানিয়েছেন উনি আগেই বুঝেছিলেন যে আমি মুখে চন্দনের `মাস্ক' লাগিয়েছি । যেহেতু বৈষ্ণবজীবনে চন্দনের বিশেষ স্থান সেহেতু সেটা তাঁর বেশ নতুন ও ভালো লেগেছে ।
এডওয়ার্ড ডিমককে প্রথম দেখার সেই মুগ্ধতা আমার সারাজীবন ছিলো ।
এডওয়ার্ড হার্ভার্ডের ডিভিনিটি বিভাগ থেকে পাশ করা পাদ্রী । যদি পাদ্রী পেশাই সে রাখতো তাহলে আদর্শ হতো কারণ একটা আধ্যাত্মিক ভাব তার মধ্যে ছিলো যেটা সকলকে আকর্ষণ করতো । কিন্তু তার আগ্রহ ছিলো ভাষাতত্ত্বে । ফুলব্রাইট নিয়ে সে ভারতে আসে । সে যত্ন নিয়ে শিখেছে সংস্কৃত ও পারসিয়ান । এমনিতেই তার আগ্রহ ছিলো থিওলজিতে, বৈষ্ণব ধর্ম ও তন্ত্র নিয়ে কাজ করতে করতে শিখলো বাংলা । হার্ভার্ডের ছাত্র শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ-এশিয় বিভাগের প্রধান অধ্যাপক এডওয়ার্ড ডিমকের একাডেমিক-সুলভ গাম্ভীর্য বা ভারিক্কিভাব ছিলো না । বাংলার শ্রেষ্ঠ একাডেমিকদের সকলের সঙ্গেই ছিলো তার বন্ধুতা -- সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, প্রবোধচন্দ্র সেন, সুকুমার সেন, প্রতুল গুপ্ত । আবার সে-সময়ের প্রধান লেখক ও চিত্রকররাও তার ঘনিষ্ঠ, বিশেষ করে যামিনী রায় । দিনের পর দিন সে যামিনী রায়ের বাড়ি গিয়ে চুপচাপ বসে তার কাজ করা দেখেছে, কিনেছেও অনেক ছবি । তার সবশুদ্ধ একুশটা যামিনী রায় আছে, নানান পিরিয়ডের, যার মধ্যে দুর্লভ ল্যাণ্ডস্কেপ ও ইমপ্রেশনিস্টদের কপিও রয়েছে ।
এডওয়ার্ড ডিমকের প্রথম বই ঝত্র নংছশবচ্ ধী ণঠরুরুংত্র ংঔধধত্র মচ্ং ত্ংঐছবং ধী ঞচ্ং ণঠরুরুংত্র ংঔধধত্র: শ্শধঞঠব ংঔষ্যঞঠবঠযস্ ঠত্র ঞচ্ং ফ্ছঠযত্রছটছ-নছচ্ছএঠষ্ছ ঙণ্ণত্ঞ ধী জংত্রভছৎ (বধছণ্ণঞচ্ধশ: ঘংত্ররুষ্ ঈধত্রঠভংশ)?? (বৈষ্ণব সাহিত্যে `গুপ্ত চন্দ্র' বলতে যা বোঝায়) । দ্বিতীয় বই বিদ্যাসুন্দর কাব্যের গদ্যানুবাদ -- মচ্ঠংংঈ ধী ত্ধটং । এছাড়া একগুচ্ছ বৈষ্ণব কবিতা মার্কিনি মহিলাকবি ডেনিস লেভারটভ-এর অনুবাদ করেছেন ঝত্র শৈছঠযং ধী ষশঠযচ্ত্রছ বইতে । তার সারাজীবনের কাজ হচ্ছে চৈতন্যচরিতামৃতের অনুবাদ, হার্ভাড ওরিয়েন্টাল সিরিজ থেকে বেরিয়েছে । এছাড়া আছে ভারতবাসের অভিজ্ঞতা লেখা স্মৃতিকথা ংঔশ. ঈঠস্ধবূ শ্ন্ংঋত্ধশংয ঞচ্ং ংঔষ্যঞংশঠংয ধী ঞচ্ং শ্ছযঞ - ঁধণ্ণশত্রংষ্য ঠত্র ঝত্ররুঠছ যার কিয়দংশের বাংলা অনুবাদ আমি করেছিলাম `দেশ' পত্রিকার জন্য ।
১৯৬২ সালে তার সঙ্গে জ্যোতির বন্ধুতার শুরু যখন সে কলকাতায় এসেছে আমেরিকান সেন্টার ফর ইণ্ডিয়ান স্টাডিজ প্রতিষ্ঠা করার জন্য । কর্নফিল্ড রোড আর সুইনহো স্ট্রীটের কোনায় তিনতলার বাড়ির দোতলায় অফিস ও তিনতলার পুরোটা নিয়ে থাকার ব্যবস্থা । তিনতলার দক্ষিণের বারান্দায় প্রতি সন্ধ্যায় আড্ডা জমতো । আমি যেহেতু বাবার বন্ধু বলে জানতাম তাকে সেহেতু নাম ধরে ডাকতে অস্বস্তি হতো আমার । বললাম, তোমাকে এডওয়ার্ডদা বলবো । সেটা তার পছন্দ হলো না -- `দাদা' আবার কী ? তার মধ্য-নাম ক্যামেরন -- লোরেন ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রা ক্যাম বলে ডাকেন, তাই ঠিক হলো আমিও ক্যাম বলে ডাকবো । সেই থেকে আমাদের বন্ধুদের কাছেও সে ক্যাম, এবং ছেলেমেয়ের কাছে ক্যাম-কাকা ।
বলতে বাধ্য হচ্ছি, আদর্শ বন্ধু হলেও লোরেনের কাছে আদর্শ স্বামী বলতে যা বোঝায়, তা ছিলো না ক্যাম । ধূমপান, সুরাপান, পর-রমণী প্রীতি -- এসব একটু বেশি মাত্রাতেই ছিলো । ভারতে এলে তার প্রিয় পানীয় হতো রাম ও চারমিনার সিগারেট ; আমেরিকায় বার্বান ও ক্যামেল । চারমিনার ও ক্যামেল খেলে বলা যায় ক্যানসার অনিবার্য । জীবনের শেষ কুড়ি বছর ক্যামের কেটেছে ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করে ।
কলকাতায় ক্যামের ছিলো একটি জিপ-গাড়ি, ড্রাইভার রামকৃষ্ণ । দশমীর দিন বাঙালিরা সিদ্ধি খায়, রামকৃষ্ণ ক্যামকে জানালো । লেনিকে সঙ্গে নিয়ে (ড: লিওনার্ড গর্ডন, ক্যামের ছাত্র, জশধঞচ্ংশয ভিছঠত্রযঞ ঞচ্ং ওছএ বইয়ের লেখক, সুভাষচন্দ্র বসুর উপর কাজ করেছেন) ক্যাম গেলো রামকৃষ্ণর নেতৃত্বে বড়বাজারে সিদ্ধিপান করতে । সিদ্ধির নেশা জমতে একটু সময় লাগে । নেশাটা আসে ঢেউ-এর মতো, আসে, পড়ে যায় । ক্যাম আর লেনি যখন দুজনেই আচ্ছন্ন অবস্থায় ও লোরেন ভয় পেয়ে ডাক্তার ডাকতে উদ্যত তখন জ্যোতি গিয়ে উপস্থিত । লোরেনকে ভরসা দিয়ে ওদের তেঁতুল জল টল খাইয়ে কিছুটা সুস্থ করলো সে । লেনির সঙ্গে জ্যোতির সেই প্রথম দেখা । লেনির নেশাচ্ছন্ন চোখে জ্যোতিকে দৈত্যাকৃতি মনে হয়েছিলো, পরে তাকে দেখে সে আর চিনতে পারে না ।
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয় বিভাগে ক্যামকে ঘিরে গড়ে উঠেছিলো এক বঙ্গপ্রেমিক দল -- ক্লিন্টন বি. সিলি, লিওনার্ড গর্ডন, জন মরিয়ার্টি, রিকি মিলার, ইনগ্রিড আল, রালফ নিকলাস, ইভা ফ্রিডল্যাণ্ডার, আকশ অ্যাস্টর, রন ইন্ডেন, লিনা ফ্রুজেটি -- এরা সবাই ভারত ও বাংলাদেশকে ভালোবাসতে শিখেছে তার কাছে, কলকাতায় এসে কাজ করেছে, বাংলা শিখেছে । ক্যামের আমলে শিকাগোর বাংলা-বিভাগ জমজমাট ছিলো, বেশ কিছু আমেরিকান ছাত্রছাত্রী বাংলার ক্লাশ নিতো । জ্যোতিকে ক্যামই নিয়ে গিয়েছিলো শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরিজিতে ভারতীয় সাহিত্য পড়াতে । বাংলা শেখানোর নিজস্ব ধারা ছিলো ক্যামের । প্রথম সেমেস্টারে হরফ শেখানো হতো না, শুধু বাংলা কথোপকথন । দ্বিতীয় সেমেস্টারে হরফ ও লেখাপড়া । বাংলা শেখানোর জন্য একটি বইও সে তৈরি করেছিলো নিজের মতো করে, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্বের অধ্যাপক (তখন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র) সোমদেব ভট্টাচার্যর সঙ্গে । আমি ইংরিজিভাষীদের বাংলা শেখাই -- ওই বইটিই ব্যবহার করেছি চিরকাল, এখনো করি । যদিও শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান বাংলার অধ্যাপক, ক্লিন্টন বি. সিলি আর একটি বাংলা শেখার বই তৈরি করেছেন সম্প্রতি । উইলিয়াম রাদিচিরও একটি বই আছে ।
ক্যাম ও লোরেনের পাঁচ ছেলেমেয়ে, দুই মেয়ে ও তিন ছেলে ; সবাই কাছাকাছি । ছোটোবেলায় তারা বড়োই দুর্দান্ত ছিলো, সারাক্ষণ ঝগড়াঝাঁটি, তোলপাড় করে বাড়ি অস্থির করতো । ভাগ্যিস তখন আমেরিকায় বাচ্চাদের গায়ে হাত তুললে ৯১১ ডেকে তারা পুলিস আনতে পারতো না, নয়তো লোরেনের বিপদ হতো, কারণ তাকে দেখেছি মাঝেমাঝেই ওদের পেটাতে । ক্যাম শান্ত ও মৃদুভাষী, তার গলার স্বর এতই নিচু যে পাশের লোক ছাড়া শুনতে পায় না, তর্ক সে করতো না, মতানৈক্য হলে চুপ করে থাকা দেখেই আমরা বুঝে নিতাম ; কখনো তার মুখে বিরক্তি দেখেছি বলে মনে হয় পড়ে না, একেবারেই বস্টন-ব্রাহ্মণ, আর কী সুন্দর যে তার হাসি, চোখের দুপাশের চামড়া হাসলে সামান্য কুঁচকে যেতো, খুব ভালো দেখাতো ; আর লোরেন সর্বদাই নিজের মত প্রকাশে সতেজ, মতামত খুব স্পষ্ট, সহজে রেগে যায় ও রাগ প্রকাশে দ্বিধা করে না । ক্যামের ভক্তরা বেশ সমঝেই চলতো লোরেনকে । ক্যাম আর লোরেনের, অনেক বিপরীত-স্বভাব দম্পতিরই যেমন হয়, ঝগড়া হতো মাঝে মাঝে, তাতে লোরেন সরব হলেও ক্যামও খুব পিছিয়ে থাকতো মনে হয় না -- অন্তত ঝগড়ার কারণটা ক্যামই ঘটাতো । একবার দেখি ক্যামের দুই আঙুল জুড়ে ব্যাণ্ডেজ করা । `কী হয়েছে ?' উত্তরে লোরেন হেসে খুন ; বলে ঝগড়া হচ্ছিলো তাদের, ক্যাম রেগে গিয়ে দেয়ালে মেরেছে ধাঁইসে এক ঘুষি । কী করে বেচারি ! বউকে তো আর মারতে পারে না । তারপর উ: আ: কারণ আঙুল গেছে ভেঙে । লোরেনকেই ষাট ষাট করে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হলো ।
ক্যামের কলকাতার ফ্ল্যাটে অনেকবারই থেকেছি আমরা । আড্ডা ভাঙতে রাত একটা-দুটো হয়ে যেতো, ক্যাম-লোরেন বলতো, থেকে যাও । কলকাতাতে কেন, তার শিকাগোর বাড়িংআতে কতোবার থেকেছি দুই বাচ্চা নিয়ে । কখনো কোনো আড়ষ্টতা বা অস্বস্তি বোধ করিনি । আমরা যখন শিকাগোতে গেলাম -- এয়ারপোর্টে ক্যাম লোরেন দাঁড়িয়ে অন্তত একডজন ছাত্র-শিষ্য নিয়ে । প্লেন থেকে নামার পর থেকে সব কিছু করেছে ক্যাম ও লোরেন । মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করা, ডাক্তার ঠিক করা, আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া (তখন আমি সন্তানসম্ভবা) । লেনি বাড়ি ঠিক করে রেখেছিলো, সাউথ কেনউড-এ, তারই নিচের তলার ফ্ল্যাটে । শিকাগো বাসকালীন আমাদের যেসব অতিথি এসেছেন সকলকেই ক্যাম আপ্যায়িত করেছে । তাঁদের সম্মানে ভোজ ও নাচের পার্টি হয়েছে তার বাড়িতে । সারাদিন কাজ করে রাতদুপুর পর্যন্ত নাচা-টা কোনো ব্যাপার নয় একটা বয়সে । আমরা বহু রাত করে বাড়ি ফিরতাম কি ফিরতাম না । শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয় বিভাগ থেকে অনেক ভারতীয়কে ডেকে আনা হতো । একবার এলেন আলি আকবর, সঙ্গে তার ছেলে আশিস ও তবলাবাদক মহাপুরুষ মিশ্র । এছাড়া ছিলেন আলি আকবরের এক সঙ্গিনী, এক শ্বেতাঙ্গিনী তরুণী । আলি আকবরকে নেমন্তন্ন করে আমি বিব্রত, উনি গোমাংস খান না কারণ ওঁর বাবা কালীর দর্শন পেয়েছিলেন আর শূকরমাংস খান না ধর্মমতে মুসলমান বলে । তার উপর মহাপুরুষ জানালেন তিনি নিরামিষাশী । তাই ক্যামের বাড়িতে পার্টির আগে লোরেনকে সাবধান করে দিলাম । লোরেন বেচারি ভারতীয় রান্নায় পারদর্শী নয়, মুর্গির ঝোলভাত প্ল্যান করলো আর মহাপুরুষের জন্য একটা ডাল ও নিরামিষ । তাদের খাবার টেবিলে সব সাজানো রয়েছে ; অতিথিদের মধ্যে একজন নিরামিষের দিকে যেই হাত বাড়িয়েছেন, লোরেন হেঁকে উঠলো -- এই খবরদার । ওটা মহাপুরুষের । অতিথিটি অপ্রস্তুতের একশেষ, মহাপুরুষও । ক্যামের মুখচোখ লাল হয়ে গেছে, কিন্তু অতোজনের মাঝে সে তো কিছুই বলবেই না । পরে কী করেছিলো জানি না, তবে কলকাতার একটা ঘটনা জানি । তাদের নেপালি পাচক কাঞ্চাকে যতোই বলা হতো রান্নায় ঝাল না দিতে সে শুনতো না, একটু ঝাল সে দেবেই । বাচ্চারা খেতে পারতো না । বলে বলে ক্লান্ত হয়ে লোরেন একদিন রেগে গিয়ে কাঞ্চার দিকে রান্নাকরা খাবার ছুড়ে ফেললো, খাবার ছিটকে কাঞ্চার নাকে মুখে লাগলো । ক্যাম সঙ্গে সঙ্গে খাবার টেবিল থেকে উঠে গিয়ে সোফায় বসলো ; তখন লেনি (গর্ডন) ছিলো সেখানে, তাকে বললো, রামকৃষ্ণকে (ড্রাইভার) ডাকো, গাড়ি বার করতে বলো, আমি সোনাগাছি যাবো । ঝ গছত্রঞ ছ গধস্ছত্র ঞধ ঞঠবূত্ং স্ষ্ ংঈংংঞ. সত্যিই গাড়ি নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলো সে, যদিও সোনাগাছি যায়নি কারণ গল্পটা লেনির মুখে শোনা, লেনি বলেছে ।
আর একবার, ক্যামসহ আমরা কয়েকজন (যাদের নাম মনে পড়ছে : আমরা ছাড়া, দীপক-সুপ্রিয়া, সুনন্দ [দত্তরায়, সাংবাদিক], ডেভিড ম্যাক্কাচ্চন ও ক্রিস্টেন ডি লিণ্ডে [ব্রিটিশ কাউন্সিলের পরিচালক]) একটা ফিটন ভাড়া করে সারা কলকাতা ঘুরেছিলাম বহু রাত অবধি । ক্রিস দারুণ মজার ছেলে, নিজের নাম বদলে করেছিলো কেষ্ট (প্রথমদিন আমাদের সঙ্গে আলাপ করতে এসে বাংলায় বলেছিলো, `নমস্কার, আমার নাম কেষ্ট') । মাথায় লাল গামছা বেঁধে গাড়ির কোচওয়ানকে সরিয়ে দিয়ে ক্রিসই ফিটন চালিয়েছিলো, আর দীপকের উপর হুকুম হয়েছিলো গলা ছেড়ে গান গাওয়ার । ঘোড়ার গাড়ি ফেরৎ দিয়ে ব্রিটিশ কাউন্সিল থেকে নিজের গাড়ি বের করে ক্রিস আমাদের নিয়ে চললো বাড়িতে বাড়িতে নামাতে । ক্যাম বললো, `সবাই আমার বাড়ি চলো আগে ; ভোর তো হলো প্রায়, চা খেয়ে বাড়ি যাবে ।' আমরা তার তিনতলার ফ্ল্যাটে উঠে ঘন্টা দিয়েছি কি দিইনি লোরেন বেরিয়ে এসে ঘচ্ংশং গংশং ষ্ধণ্ণ? বলে এক হ্যাঁচকা টান দিয়ে ক্যামকে ঢুকিয়ে নিয়ে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিলো আমাদের মুখের উপর । আমরা গুটি গুটি যে যার বাড়ি চলে গেলাম ।
সেদিন সন্ধ্যায় লোরেন আর ক্যাম এলো আমাদের বাড়িতে । ফর ওয়ান্স লোরেন সেজেছে সুন্দর করে, পারফিউম ও লিপস্টিক ব্যবহার করেছে, আর ক্যাম তো সর্বদাই সুসজ্জিত । প্রতি সন্ধ্যায় সে ধোপভাঙা একটি সুন্দর রঙের সার্ট ও মানানসই পাত্লুন পরতো । সেই সন্ধ্যায় আমাদের বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন সমর সেন (কবি) ও তাঁর বড়ো ভাই অমল সেন । এঁরা দুজনেই বামপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাসী । আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে অমলবাবু কিছু বলছিলেন, হঠাৎ দেখি লোরেন খাটের উপর উঠে দাঁড়িয়ে হাত পা নেড়ে কী সব বলছে আর অমলবাবুও ঘাবড়াবার পাত্র নন, যা বলছিলেন বলেই চলেছেন । তাঁদের মধ্যে প্রায় হাতাহাতি হবার উপক্রম । ক্যাম সম্পূর্ণ উদাসীন । ক্যাম আর লোরেনের ব্যক্তিত্ব সম্পূর্ণ আলাদা, একজন কোনো কিছুতেই উত্তেজিত হয় না আর আরেকজন উত্তেজিত হবার জন্য সদা প্রস্তুত । লোরেন যতোই খোলামেলা, উগ্র ও স্পষ্টভাষী, ক্যাম তেমনই সুদূর ও বিধুর, হয়তো কিছুটা রহস্যে ঘেরা -- তাই হয়তো মেয়েরা তার প্রতি ধাবিত হতো ।
শুধুমাত্র ভারতীয় সাহিত্য ও চিত্রকলা নয়, ভারতীয় সঙ্গীত ও চলচ্চিত্রেও ছিলো ক্যামের আগ্রহ । রবীন্দ্রসঙ্গীত তার প্রিয় । লণ্ডনে এক সন্ধ্যায় রাজেশ্বরী দত্তের গলায় `তবু মনে রেখো' গানটি শুনে সে মুগ্ধ হয়েছিলো । তারপর বার বার ঐ গানটি সে শুনতো ।
সত্যজিৎ রায়ের সব ছবি সে দেখেছে বলা বাহুল্য, বম্বের ছবি নিয়েও কৌতূহল ছিলো । জ্যোতি তখন স্টেটসম্যান পত্রিকার চিত্রসমালোচক । তার সঙ্গে ক্যাম নাইটশোতে দু'একটা মারদাঙ্গা ছবিও দেখেছে । শাবানা আজমির প্রথম ছবি অঙ্কুর (১৯৭৩) দেখতে গিয়েছিলাম আমরা একসঙ্গে, যতোদূর মনে পড়ছে মেট্রো-তে । ক্যামের সহাস্য মন্তব্য - ঘংত্ত্, চ্ং ঠয ত্রধ নছঞষ্ছএঠঞ ওছষ্.
১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থার সময় জ্যোতি যখন `পলাতক আসামী' তখন ক্যাম এসেছিলো কলকাতায় কিন্তু আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি । সেই একই সময় লেনিও এসেছিলো, আমাদের আরেক বন্ধু ফ্রেড ডেভিস (রবীন্দ্রনাথের প্রথম কবিতার বই `পুষ্পাঞ্জলি'র অনুবাদক) এসেছিলো -- ওরা এসেই আমার সঙ্গে দেখা করেছে । ফ্রেড তো জ্যোতির সঙ্গেও দেখা করতে গেছে । লেনি বললো, আমেরিকান ইনস্টিটুট অব ইণ্ডিয়ান স্টাডিজ-এর আমাদের যে বন্ধুটি কাজ করেন তিনি বলেছেন এখন মীনাক্ষীর সঙ্গে দেখা করতে না যাওয়াই ভালো, কারণ পুলিশ বাড়ির দিকে নজর রেখে বসে আছে । বিদেশী হিসেবে তারা ঝামেলায় পড়ে যেতে পারে, জ্যোতিরও অসুবিধে হতে পারে । লেনি তার কথা শোনেনি, কিন্তু ক্যাম শুনলো ও আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলো না । ক্যামের আগমন উপলক্ষ্যে যে পার্টি হলো তাতেও আমাকে নেমন্তন্ন করা হলো না । একবার আমেরিকান ইনস্টিটুটের পার্টিতে গিয়ে দেখেছিলাম ক্যাম দাঁড়িয়ে আছে, সেটা ছিলো তার `সারপ্রাইজ ভিজিট', আমি খুব রেগে গেলাম আমাদের না জানানোর জন্য, বললাম, আমি এক্ষুনি চলে যাচ্ছি । ক্যাম অনেক করে ক্ষমা চাইলো, বললো, আর কখনো হবে না, এবারে হঠাতি এসে পড়েছি । আর এখন সে একটা ফোন পর্যন্ত করলো না ! আমি অবশ্য ততোদিনে এধরনের ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, কিন্তু ক্যামের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক তো আলাদা, সে কারফিউর মধ্যেও আমাদের দেখতে গেছে । খুব মনোকষ্ট হলো ।
ক্যাম আবার যখন এলো, দুবছর পরে তখন জরুরি অবস্থা উঠে গেছে, জীবন আবার ফিরে এসেছে স্বাভাবিক ছন্দে । তখন দেখি ফোন করে জানানো হচ্ছে এডওয়ার্ড ডিমকের আগমন বার্তা । আমরা সর্বদাই ক্যামকে স্বাগত জানাতে হাজির থেকেছি, এয়ারপোর্টে গেছি, কিন্তু এবারে কিছুই করলাম না । সন্ধ্যায় দরজায় ঘন্টা শুনে খুলে দেখি ক্যাম, সঙ্গে ছিলেন নরেশদা (কবি নরেশ গুহ) ও চিনুদি (অর্চনা গুহ, নরেশ গুহর স্ত্রী) । আর অবিশ্বাস্য -- সে জ্যোতিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলো । কোনো মার্কিনি পুরুষ অন্যের সামনে কাঁদবে এটা ভাবাই যায় না । তাছাড়া এমনিতে ক্যামের আবেগের প্রকাশ সংযত । চোখের জলের হার স্বীকার করতেই হয়, আমাদের সম্পর্ক আবার সহজ হয়ে গেলো । ঐ সময়ে অনেকেই তো আমাদের এড়িয়ে চলেছেন, সেটাই স্বাভাবিক কারণ অকারণে পুলিশের ঝামেলায় কে চায় জড়িয়ে পড়তে, কিন্তু কেউ কোনোদিন তা নিয়ে এভাবে দু:খপ্রকাশ করেনি ।
জীবনপ্রেমিক এডওয়ার্ড ডিমককে ঘিরে হতো আলোচনা, বিতর্ক, আড্ডা, নাচ গান । কতো না ছাত্রী যে লোরেনের সৌভাগ্যে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে । আবার কেউ কেউ সুযোগ পেয়েছে তার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যের । একবার সাগরময় ঘোষ এসেছেন আমেরিকায় । আমরা তখন আইওয়ার রাইটার্স ওয়ার্কশপে । দীপক, সুপ্রিয়া `আরবানা'য় । সবাই মিলে সাগরময়কে নিয়ে গিয়েছি নিউ ইয়র্কে । কাকতাল এমনই, যে আমরা যে হোটেলে উঠেছি, ক্যামও সেখানে । খাবার ঘরে দেখা, ক্যামের সঙ্গে তার এক ছাত্রী । সাগরময়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়া হলো । ক্যাম তত্ক্ষণাৎ তাকে শিকাগোর নিমন্ত্রণ জানালো । তারপর আমরা যে যার ঘরে ঢুকলাম । এর কিছুদিন বাদে আমরা সাগরময়কে নিয়ে শিকাগো গেছি, ক্যামের বাড়িতে বিশাল ভোজসভা । তার নিচের হলঘরে আসবাব দেয়ালে ঠেলে নাচের আয়োজন । লোরেন ব্যস্ত হয়ে ঘোরাঘুরি করছে । সাগরময় বারবার বলছেন `ঘচ্ংশং ঠয ংঔশয. ঈঠস্ধবূ' ; তাঁকে চিমটি-টিমটি কেটে থামাই । লোরেন কিন্তু ঠিকই শুনেছে -- আমাকে বললো, `ণং ংঋশধঢছঢত্ষ্ ঞচ্ঠত্রূয ঝ ছস্ ঞচ্ং স্ছঠরু, ংঔশয. ঈঠস্ধবূ ঠয যধস্ংগচ্ংশং ণ্ণৃযঞছঠশয ংঋণ্ণঞঞঠত্রভ ধত্র ত্ঠৃযঞঠবূ.'
নারী, সুরা, সুখাদ্য, সুন্দর পোশাক, গাড়ি -- সবকিছু নিয়েই এই পণ্ডিত ও প্রেমিকের জীবন । সবে বাজারে বেরুনো (১৯৬৭) `মাস্তাং' গাড়ি কিনলো সে, ইস্পাত-ছাই রঙা । সে যে কী খুশি ও গর্বিত । বললো, `চলো লম্বা ড্রাইভে যাই ।' অনেক পথ চলে পথের শেষে এক এক গাছগাছালির দোকান -- এতো বড়ো যে ভেতরে ঢুকলে মনে হয় বনে এসে পড়েছি । আমি উপহার পেলাম একটা কমলালেবুর বনসাই । ঐটুকু গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে আলোর মতো ফুটে আছে কমলা । শিকাগোর ছোট্ট ফ্ল্যাটের জানালার তাকে রেখেছিলাম রোদের জন্য, বদলে সেই গাছই যেন আলো জ্বেলে রেখেছিলো আমাদের বসবার ঘরে । কলকাতায় একবার ক্যামকে বলেছিলাম, `তোমার বই আমি কিনতে রাজী নই, তুমি উপহার দেবে আমাকে ।' দেশে ফিরেই সে বই পাঠিয়ে দিয়েছিলো, দারুণ খুশি হয়েছিলাম ।
কলকাতাকে, কলকাতার মানুষকে, বাংলাভাষাকে ভালোবেসেছিলো ক্যাম, বাঙালিরাও তার ভালোবাসার প্রতিদান দিয়েছে । বিশ্বভারতী তাকে দিয়েছে `দেশিকোত্তম' উপাধির সম্মান, তার ংঔশ. ঈঠস্ধবূ শ্ন্ংঋত্ধশংয ঞচ্ং ংঔষ্যঞংশঠংয ধী ঞচ্ং শ্ছযঞ বইটির জন্য সে পেয়েছে `আনন্দ পুরস্কার' । `দেশ' পত্রিকার জন্য ঐ বইটির কিছু অংশ আমি অনুবাদ করেছিলাম । `দেশ'-এ লেখা ছাপার ব্যাপারে তার খুবই আগ্রহ ছিলো, ফোনে কথা হলে বলতো, `লেখাটা বেরুলো ?' আমি `দেশ'-এর তত্কালীন সম্পাদক অমিতাভ চৌধুরীকে তাগাদা দিতাম, `আবার তার ক্যানসার মাথা চাড়া দিয়েছে, তার মৃত্যুর আগে যেন লেখাটা ছাপা হয় ।' সম্পাদক জানালেন, তাঁর দপ্তর থেকে লেখার প্যাকেটটি হারিয়ে গেছে । আমি আবার কপি পাঠালাম । ভাগ্যিস ! সে চলে যাবার আগে, মাত্রই কিছুদিন আগে, দেশ-এর লেখা বেরুলো ও আনন্দ পুরস্কারও সে পেলো । তার খুব ইচ্ছে ছিলো সেই উপলক্ষ্যে কলকাতা যাবার, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ডাক্তার অনুমতি দিলেন না । আনন্দবাজার থেকে তাঁকে জানানো হলো তাঁর কোনো প্রতিনিধিকে পাঠানো জন্য । ক্যাম বললো, `তবে তুমিই যাও, জ্যোতি' । কিন্তু `দেশ' সম্পাদক বললেন, `না, একজন আমেরিকান হলে ভালো হয় ।' তখন ক্যামের প্রকাশকের দপ্তর থেকে আন্টোনিয়া ফুসকো নামে একটি মেয়ে গেলো ক্যামের পুরস্কার গ্রহণ করতে । আনন্দ পুরস্কার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন পেয়েছেন -- ক্যামের ছাত্র ক্লিন্টন বি. সিলি পেয়েছেন জীবনানন্দ দাশের জীবনী ( ংই ধৈংঞ ংঋংইছশঞ ) লেখার জন্য । ক্যামের নেতৃত্বে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালেয়র দক্ষিণপূর্ব এশিয়া বিভাগ হয়ে উঠেছিলো পশ্চিমে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি গবেষণার প্রধান ক্ষেত্র ।
শেষ দিনগুলিতে কেপ কড-এর সাগরতীরে বসে সে বলতো, `বানপ্রস্থ' নিয়েছি, এখন কলকাতায় যাই মনে মনে, অনেক দ্রুত চলে যেতে পারি । পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তার ছাত্র, বন্ধু ও অনুরাগীরা গেছেন উপসাগরবর্তী তার সেই আশ্রমে । স্বপ্নের মতো সেই বাড়ি, সাগরতীরের বালুকাময় বনচ্ছায়ায়, মাটির রাস্তায় একটা গাছের গায়ে কাঠের টুকরোর উপর লেখা ঈঝৌচঙষ । প্রতিটি ঘরে বই আর বই, আর সারা বাড়ি জুড়ে যামিনী রায় । বাড়ি থেকে নেমেই নিজস্ব বালুকাবেলা, জলের মধ্যে খুঁটিতে বাঁধা নৌকা দুলছে । রামগিরি কি সরযূনদীর মতোই, অতি পবিত্র সেই স্থান । চোখে ছবি ভাসছে, নীল জলে ফাঁকা নৌকাটি দুলছে ..... দুলছে ।
১৯৬৩ সালে একবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিলো কলকাতায় । আমরা তখন থাকতাম ব্রড স্ট্রীটে, পার্কসার্কাস থেকে খুব কাছে এবং বাড়ির পেছনের জমির দেয়ালের ওপারেই মুসলমান বস্তি । শহরে যেখানে যেখানে মুসলমানদের ঘনবসতি সেখানেই কারফিউ জারি হয়েছে, আমরা পড়ে গেছি কারফিউ এলাকায় । রাস্তায় নেমেছে মিলিটারি, তাদের প্রহরায় ভোরবেলা দুঘন্টার জন্য কারফিউ তোলা হয় । নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজকর্ম দোকানবাজার করার জন্য । জ্যোতি সাংবাদিক, তার গাড়িতে কারফিউ পাস কারণ রিপোর্ট করতে নানা জায়গায় যেতে হবে । তার সুযোগ নিয়ে জ্যোতি পার্কসার্কাসের পার্লরোডে আবু সয়ীদ আইয়ুব ও গৌরীকে দেখে এসেছিলো এবং তাঁদের আশু প্রয়োজনীয় কিছু জিনিশপত্র কিনে দিয়ে এসেছিলো । কিন্তু শহরের ঐ অবস্থায় অন্য কোথাও যাওয়ার কথা মনে হয়নি । আমার মা-বাবা-ভাই-বোন সবাই তখন আমেরিকায় । থমথমে আবহাওয়া । এরই মধ্যে হঠাৎ এক সকালে তার জিপ নিজে চালিয়ে ক্যাম এসে উপস্থিত । আমরা তো আঁত্কে উঠেছি তাকে দেখে, আরো আতঙ্কিত কারণ পেছন পেছন এলো পুলিশ -- শাদা চামড়ার এই লোকটির সঙ্গে আপনাদের কী সম্পর্ক ? কারফিউর মধ্যে গাড়ি চালিয়ে তিনি এখানে এসেছেন কেন ? (এর আগে অ্যালেন গীনসবার্গ ও পিটার অরলভস্কি আমাদের বাড়ি আসতো বলে কোনো প্রতিবেশী পুলিশে রিপোর্ট করেছিলেন জ্যোতির নামে ।) পুলিশ বাহিনীকে কোনো পাত্তাই না দিয়ে ক্যাম বললো, `তোমাদের ফোন নষ্ট নাকি ? কিছুতেই লাইন না পেয়ে এই ঝুঁকি নিতে বাধ্য হলাম । তোমাদের চিন্তায় রাতের ঘুম নষ্ট হচ্ছে । এখানে পড়ে থাকতে হবে না, আমার ওখানে থাকবে যতোদিন না ঝামেলা কমে ।' সেটা ছিলো আমার শ্বশুরবাড়ি, সদস্যসংখ্যা ষোলো । জ্যোতি সন্তর্পণে নিজের কারফিউ পাসটি ক্যামের পকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে তাকে আশ্বস্ত করলো যে পরের দিন তার কাছে চলে যাবে । পুলিশকে ক্যামের বিষয় বোঝানো হলো, তবু পরে জানলাম, পুলিশের গাড়ি তাকে অনুসরণ করেছে তার বাড়ি পর্যন্ত । পরে আমরা আমাদের ঘনিষ্ঠ পুলিশ বন্ধুদের (যথা, রথীন ভট্টাচার্য) ফোন করে জানিয়ে দিলাম যাতে ভুল বোঝাবুঝি না হয় । পরের দিন ক্যামের বাড়ি গেলাম, খিচুড়ি রাঁধা হলো । জ্যোতির প্রেস লাগানো গাড়িতে ক্যাম শহরের অবস্থা দেখতে বেরুলো । আমাদের পরিচিত মুসলমান বন্ধুদের কাছেও যাওয়া হয়েছিলো তাদের কিছু লাগবে কিনা জানতে ।
ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে করে ক্লান্ত হয়ে ক্যাম অবসর নিয়ে শিক্ষকতা ছেড়ে চলে গেলো নিউ ইংলণ্ডে, তার শৈশবের বাসভূমি কেপ কড-এ । সেখানে তার পৈত্রিক বাড়ি, একটি সুন্দর কাঠের দোতলা, আছে নিজস্ব সাগরবেলা, প্রিয় কুকুর নিকি ও প্রিয় অবসরবিনোদন -- নৌকা বাওয়া । এর আগে ক্যাম একটা ভাঙা জাহাজ কিনেছিলো, বাংলায় যাকে ভড় বলে । ঠিক করেছিলো অবসর জীবন কাটাবে জাহাজে ভেসে ভেসে দেশ থেকে দেশান্তরে, দ্বীপ থেকে দ্বীপে গিয়ে । জ্যোতি তখন তার `মণিমেখলা' নৌকা নিয়ে এক অভিযান সেরে এসেছে । ক্যাম তাকে রিক্রুট করলো, আমি বললাম, `আমাকেও নাও, আমি হবো শেফ' । সে ঠিক করেছিলো বম্বে থেকে জাহাজ সারাবে । কিন্তু ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধে সে পরাজিত হলো, ডাক্তার-হাসপাতালের কাছাকাছি তাকে থাকতে হয় । তাকে শেষ দেখেছি সমুদ্রের ধারে তার বাড়ির চাতালে আরাম কেদারায় বসে রাম-এর গেলাশ হাতে । দোতলা কাঠের বাড়িটি রাস্তা থেকে অনেকটা ভেতরে ঢুকে, বড়ো বড়ো গাছের আড়ালে, সমুদ্রর একদম উপরে । তাদের বসার ঘরটি সম্পূর্ণ কাচের যাতে সমুদ্র দেখা যায় । ক্যামের পায়ের কাছে তার বৃদ্ধ কুকুর নিকি । শারীরিক কষ্ট তার মুখের হাসিকে ম্লান করতে পারেনি । রোগের কোনো ম্লানিমা ছিলো না তাকে ঘিরে, শুধু গলার শব্দ গিয়েছিলো বদলে ।
এডওয়ার্ড ডিমক-এর ফটোটি তাঁর ংঔশ. ঈঠস্ধবূ শ্ন্ংঋত্ধশংয ঞচ্ং ংঔষ্যঞংশঠংয ধী ঞচ্ং শ্ছযঞ বইটির কভার জ্যাকেট থেকে নেওয়া হয়েছে ।
এইটির সঙ্গে মীনাক্ষী দত্তর আরো অনেক লেখা একত্রিত করে ২০০৪-বইমেলায় প্রকাশিত হচ্ছে `অ্যালবাম থেকে কয়েকজন' । প্রয়োজন হলে `পরবাস'-এর সঙ্গে যোগাযোগ করুন ।