
 
 
 
	 
				 `কষ্ট বলতে এখনও অনেকদিন বাঁচতে চায় । কাদি খুব যত্ন করে । 
                  তবু মনে খুব সন্দেহ হয়েছে এখন ।'  
 `কীরকম ?'  
 `ভাবে, 
                  তাকে মেরে ফেলবার ষড়যন্ত্র চলছে ।'  
 `ওটা মায়া । ওটা টান । 
                  তোমার সঙ্গে কথা বলে ?'  
 `আমি পাইনা ।'  
 `দেন ?'  
 `যদি 
                  আমার হাত চেপে ধরে একবার !'  
 `তাহলে কী হবে ?' 
                   
 `ছাড়তে পারব না । দমবন্ধ হয়ে আমি মরে যাব । জানো তেঁতুলগাছ, 
                  তোমাকে যেদিন কাটা হল, ঠাকুরমা কষ্ট পেয়েছিল খুব ।'  
 `কেন 
                  ?' 
                   
 `জানি না । তবে মনে পড়ে ঠাকুরমা আমাকে মজা করেই হয়তো 
                  বলত, মরে গিয়ে তোমার ডালে পেত্নী হয়ে থাকবে !'  
 `তাই ?' 
                   
 `হ্যাঁ । কিছুকাল আগেও যখন হাঁটতে পারতো, যে- ঢিবিতে তুমি 
                  ছিলে, সেই ফাঁকা জায়গাটায় দুপুরবেলায় গিয়ে একা-একা দাঁড়াতো 
                  ।'  
 `মানুষটা ভাল ।' 
                   
 `তেঁতুলগাছ, তুমি এখন যে গ্রামে, সেখানে অনেক পাখি আসে ?' 
                   
 `অনেক । ওখানকার মানুষ পাখি মারে না ।' 
                   
 `তুমি চলে যাবার পর আমাদের বাড়িতে আর তেমন একটা পাখির 
                  থাকে না । কীরকম সবকিছু ফাঁকা হয়ে গেছে । ছাড়া ছাড়া হয়ে 
                  গেছে । কেউ কারও সঙ্গে বিশেষ কথাই বলে না ।'  
 `আজ হঠাৎ 
                  এখানে এলে কেন ?' 
                   
 `রাতে তোমাকে স্বপ্নে দেখেছি । মাকে লুকিয়ে নুন এনে আমি 
                  আর পাশের বাড়ির কালু চুপিচুপি কাঁচা তেঁতুল খেতাম গাছে ব'সে 
                  । একদিন পাশ থেকে একটা বড় দাঁড়াশ ঝুল্ খেতে লাগল ডাল ধ'রে । 
                  ভয়ে আমরা কাঠ । তারপর সাপটা নেমে চলে গেল মাঠের দিকে । সেইসবই 
                  মনে পড়ল । সকালে উঠে শুনি ঠাকুরমার অবস্থা খারাপ । বাবা-মা- 
                  কাকি ঘিরে আছে । ঠাকুরমা গোঙাচ্ছে । আমি পালিয়ে এসেছি । 
                  জায়গাটা এখন ঝোঁপ । তুমি নেই । তোমার নতুন গ্রামটা কোথায় গো 
                  ?'  
 `খুঁজে নিও । বলতে মানা ।'  
 `মানা ? কার ?'  
 `জাদু 
                  । জাদু বোঝো ?'  
 `না ।'  
 `একদিন বুঝবে ।'  
 `কবে ?' 
                   
 `একদিন ।'  
 `কবে বল না ?'  
 `একদিন ... একদিন ... 
                  এ-ক-দি-ন ...' 
                   
বড় ছেলের হাঁকডাক । বয়স ষাট । চুল পেকেছে অনেক । বাজারে পান-বিড়ির দোকান । দোকান খুলতে হবে । সব কিছুতেই একটু কর্মকর্তা টাইপের ভাব । এখনও । এই মাত্র মায়ের কাছ থেকে উঠে এসেছে । তার বউ গেছে পাশের বাড়ি । গঙ্গাজল দরকার । দু-দশ ফোঁটা পেলেই যথেষ্ট । কলের জল মিশিয়ে বুড়ির মুখে বিন্দু বিন্দু দেওয়া হবে ।
 উঠোনে আশপাশের বাড়ির মহিলাদের জটলা । সেদিকে ফিরে 
                  বড়ছেলে আবার হাঁকে - `পিন্টুটা গেল কোথায় ? অকম্মা ছেলেটাকে 
                  ঠিক সময়ে পাওয়াও যায় না ।'  
 কেউ একজন বলল -`টিউশনিতে যায়নি 
                  তো ?'  
 `কীসের টিউশনি ? ঠাকুরমা যার মরতে বসেছে !' 
                   
বড়ছেলে দাঁত খিঁচোয় । পান চিবুতে চিবুতে এক মাসিমা সামনে এসে দাঁড়ায় । `কীরখম ডেখ্লে সোঠীশ ?'
বড়ছেলে সতীশ দু'হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে উঠল - `মা গো ! তোমার শেষ ইচ্ছেটা পূর্ণ হল না ... বাংলাদেশের ভিটেতে একবার যেতে চেয়েছিলে ...'
বলতে বলতেই সে ঘড়ি দ্যাখে । বুঝ্দারের মতো রায় দেয় -`যা মনে হল, বিকেলের মধ্যেই যতীনকে খবর দেওয়া দরকার । ... পিন্টুটা যে কোথায় গেল !'
যতীন ছোটভাই । কলকাতায় কেরানীর চাকরি করে । মেসে থাকে । ছেলে-মেয়ে-বউ এখানেই । শনিবার রাতে ফেরে । সোমবারে যায় । আজ বৃহস্পতিবার । কোনওভাবেই যতীনের আসার কথা নয় । এজন্যেই পিন্টুকে খোঁজা হচ্ছে ।
 ন'টা বাজে । সতীশের দেরী হয়ে যাচ্ছে । বারোটা অবধি অন্তত: 
                  দোকানটা খুলে রাখতে চায় সে । অতএব সাইকেল বেরোয় । প্যাডেলে পা 
                  দিয়েই হঠাৎ কী মনে হয় তার । বাবার ছবিটা । বাবা মারা গেছে ৩০-৩২ 
                  বছর আগে । তার পরপরই পিন্টু হয় । বাবার ডেডবডি ছুঁয়ে সকলের 
                  একটা ছবি বাঁধানো হয়েছিল । শেষে সেটা ঠিক কোনও ছবি নয়, 
                  মুছে-যাওয়া একটা স্মৃতির মতন দেওয়ালে ঝুলত । ছবিতে সতীশের বড়দি 
                  ছিল । বড়দিও চলে গেছে বছর দশ । ওদের বাচ্চাকাচ্চা ছিল না । দিদির 
                  মৃত্যুর পর জামাইবাবু কোথায় উধাও । তো সেই ছবিটা কিছুদিন আগে 
                  দেওয়াল থেকে পড়ে ভেঙে চুরমার । কারও কিছু মনেও হয় নি । শুধু 
                  বুড়ির খিটিমিটিতে আবার বাঁধাতে দেওয়া । আনা হয় নি । কিন্তু আজ 
                  যে আনতে হবে । ভালো কথা মনে পড়েছে বড়ছেলের । নিজের 
                  দায়িত্বজ্ঞানে খুশি হয় সে । হৃষ্টমনে আবার সাইকেলে চেপেছে সতীশ, 
                  তক্ষুনি কোথ্থেকে পিন্টু ।  
 `বাবা, দোকানে যাচ্ছ ?'  
 `হ্যাঁ 
                  । কোথায় ছিলিস্ এতক্ষণ ? এরকম একটা অবস্থায় ...'  
 `কী করব 
                  আমি ?'  
 `ওটা কোনও কথা হল ? মা তোর নাম ধরে ডাকছিল ।' 
                   
 `ওই ভয়েই তো পালালাম ।' 
                   
 `বোকার মতো কথা বোলো না । শোনো, ক্লাবের বন্ধুদের খবর 
                  দাও । ওরা তৈরী থাকুক । আর বুথ থেকে একটা ফোন করো 
                  কাকুর অফিসে ।'  
 `ফোন নম্বর কত ?'  
 `তুমি জানো না ?' 
                   
 `আমি জানব কেন ?'  
 `নিজের কাকুর ফোন নম্বর জানো না 
                  ?'  
 `কাকুর সঙ্গে তো আমার কথাই হয় না ।' 
                   
`তবু জানা উচিত ছিল তোমার । কাকিকে জিজ্ঞাসা করো । আমি যাচ্ছি । একবেলা অন্তত: দোকানটা খুলি । দেরী হয়ে যাচ্ছে । আর ভাল কথা, তোমার এক বন্ধুকে আমার দোকানে পাঠাও খানিক পরে । তোমার দাদুর ছবিটা নিয়ে আসবে । ওটা মা-র মুখোমুখি দেওয়ালে লাগিয়ে দিও । একটু দায়িত্ব নিতে শেখো । বয়স তো ...'
বাকি কথা উচ্চারণ না ক'রে সতীশ পিছন ফিরে মেয়েদের ভিড়ের উদ্দেশ্যে আর এক রকম গলায় জেগে ওঠে - `আপনারা পাঁচজন আছেন, একটু আর্শীবাদ করবেন । মা আমার যেন শান্তিতে যেতে পারেন ।'
সাইকেল এগোয় । প্রথমে শোকগ্রস্ত, ধীরে । একটু বাদে মোড় ঘুরতেই দ্রুত, দ্রুততর, তাড়া আছে ।
 `মুখে ফোঁটা ফোঁটা গঙ্গাজল দেওয়া হচ্ছে .. নতুন-বাঁধানো 
                  ঠাকুরদার চাবি টাঙানো হয়েছে সামনের দেওয়ালে । বের করা হয়েছে 
                  গীতা । কাকুর ছেলেমেয়ে দুটো মাথার কাছে বসে আছে । কেউ কেউ 
                  হরির নাম শোনাচ্ছে ।'  
 `তুমি তো কাছে যাচ্ছো না । ওইসব 
                  তোমার পছন্দ ?' 
                   
 `একদম না । একটা লোককে যেন খালি মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে - 
                  মরে যাচ্ছো ... আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তুমি মরে যাচ্ছো ... । এসব 
                  অসহ্য, তেঁতুলগাছ !'  
 `বারণ করো ।'  
 `আমার কথা কেউ 
                  শুনবে না ।'  
 `কেন ?' 
                   
 `আমি তো রোজ সকালে অফিসে যাই না । আমার সম্মান নেই । 
                  সবাই বিরক্ত হবে । বাড়িতে যেন পুজো পুজো ভাব !'  
 `তোমার 
                  বাবা কোথায় ?'  
 `দোকানে ।'  
 `এযাঁ ?' 
                   
 `ওই তো ! জাদু ! তুমি তখন আমাকে জাদুর কথা বললে না ? 
                  আমিও তোমাকে ফেরত দিলাম । সংসার তো করলে না, তেঁতুলগাছ !' 
                   
 `বাব্বা ! পাকা হয়েছো তো ?' 
                   
`বাবার কাছ থেকে শেখা কথাটা । রোজ বিশবার শুনি । ... কিন্তু ওদিকে শঙ্খ বাজছে কেন ? আমি আসছি ...'
পুকুরপাড়ে দুটো লম্বা নারকেল গাছ । কোন্ একটার মাথায় বসে যেন কাক ডাকছে - `কা-কা ।' আজ আর কেউ হুস্ হুস্ ক'রে কাকটাকে তাড়াচ্ছে না । আজ যেন এ'বাড়ি কাকের ডেকে ওঠা স্বাভাবিক কিছু জানান দেওয়া । বারান্দার ঘরে চোখ বুঁজে পড়ে আছে শতবর্ষ ছুঁতে যাওয়া এক বুড়ি । ছেঁড়া কাঁথায় মোড়া মানবকঙ্কাল । অল্প হাঁ হয়ে থাকা ঠোঁটে জল দিচ্ছে কেউ । বুড়ি গিলছে না । এলানো ঠোঁট বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল । বিপিনের মা সুর করে হরিনাম গাইছে । ধূপকাঠি জ্বলছে । পাছা গলছে বুড়ির । বদগন্ধ যতটা ঢাকা যায় । ছোটছেলে এখনও আসেনি । ধূপের খরচ তাই বড়ছেলেরই । মাঝে মাঝে তার চোখ ভিজে আসছে । ভাঙা স্বরে `মা ... মা ...' ডাক । ভিড়ের পেছনে পিন্টু দাঁড়িয়ে । কিছুক্ষণ আগে বড়ো রকমের খাবি খেয়ে মুহূর্তের জন্য চোখ খুলেই বন্ধ করেছিল বুড়ি । বেজে উঠেছিল শাঁখ । সবাই ভেবেছিল, এবার শেষ । কিন্তু একটু পরেই আবার বুড়ি গুঙিয়ে ওঠে । তখন পালা করে সবাই খেয়ে আসে ।
ত্রক্রমে রোদ পড়ছে । কার্তিকের শেষ । বাতাসে শীত-শীত ভাব । বেলা আগের তুলনায় ছোট । ক্লাবের ছেলেরা মাঝে মাঝেই খবর নিয়ে যাচ্ছে । দলনেতা গামছা নিয়েই ঘুরছে । সে আওয়াজ দিল - `ঠাম্মা, বেশি রাত কোরো না । নাতিদের নিউমোনিয়া হয়ে যাবে ঠান্ডায় ।'
 বিপিনের মা গান থামিয়ে বুড়ির কানের কাছে মুখ নিয়ে যায় । `ও 
                  দিদি, তুমিও একটু ঠাকুরের নাম নাও । যাতে বেশিক্ষণ কষ্ট না পেতে 
                  হয় । শুনছো ?'  
 বুড়ি গোঙায় । 
                   
 বড়ছেলে পকেট থেকে একবার দোকানের চাবি বের করছে । হাতে 
                  নিয়ে নাচাচ্ছে । আবার ভরে নিচ্ছে পকেটে । সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না 
                  । অস্থিরভাবে ডাকল - `মা গো ...।' কী যেন বলতে গিয়ে আর বলল না 
                  ।  
 বুড়ির গলায় অদ্ভুত শব্দ দলা পাকায় । 
                   
হরিনাম আবার চালু হয় । পিন্টু পেছন থেকে চোখ মোছে । মনে মনে বলে -`খুব কষ্ট হচ্ছে, ঠাকুমা ?' বলতে বলতে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে । ঘরের ধূপের ধোঁয়ায় সে পাচ্ছিল ঠাকুরমার কুলের আচারের গন্ধ । ছোটবেলার সেই রোদ্দুর কবে যেন গিলে ফেলেছে ঘরের অন্ধকার ।
 উঠোনে পা দিয়েই দ্যাখে, কাকু । উদ্ভ্রান্ত চেহারা । হাতে নতুন 
                  পলিপ্যাক । ওটা পিন্টুর হাতে দিয়েই `মা কোথায় রে, আমার মা ...' 
                  বলে হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে গেল ঘরের ভেতর । ভিড় 
                  ব্যস্ত হয়ে উঠল । সবাই ছোটছেলেকে সামলাচ্ছে । কাকি ছুটে এল । 
                  ওদের ছেলেমেয়েদুটোও কেঁদে উঠল গলা ছেড়ে । ভিড় বলল, `কেঁদো 
                  না, যতীন । সবাইকেই তো একদিন যেতে হবে ।'  
 একজন বলল, 
                  `তোমার অপেক্ষাতেই বুড়ি আছে ।'  
 আর একজন হাত রাখল পিঠে - 
                  `তোমাকে তো খুঁজছে মাঝেমাঝেই ...'। 
                   
বড়ছেলে সতীশ একথায় কিছুটা ক্ষুণ্ণ । সে প্রসঙ্গ পালটায় - `আসতে অসুবিধা হয় নি তো তোর ?'
 বুড়ি গুঙিয়ে ওঠে আবার । হঠাৎ চুপ হয়ে যায় সবাই । তারপরই প্রবল 
                  হরিনাম । উত্সবের মুখরতা বাড়িটাকে জমিয়ে দেয় ।  
 একটু ধাতস্থ 
                  হয়ে নিয়ে ছোটছেলে যতীন পিন্টুকে ডাকল - `এদিকে আয় ।' 
                   
 পিন্টু গেল । যতীন বলল - `ওটা দে ।' 
                   
প্যাকেটটা কাকুর হাতে দিল পিন্টু । বেরোলো একটা সাদা থান । মগ্ন যতীন হঠাৎ দাদাকে বলল - `এক কাজ করলে হয় না, দাদা ? শেষ সময়টা মা-কে তুলসীতলায় নিয়ে চলো ।'
ভিড় লাফিয়ে ওঠে । বুড়িকে সাদা থানে মুড়িয়ে তুলসীতলায় নিয়ে যায় । পিন্টুর ভেতরটা দুম্ ক'রে ফাঁকা । সন্ধে ঘন হয় । অন্ধকারে গা মিশিয়ে দেয় সে ।
`বসবো, তেঁতুলগাছ ! ওরা ঠাকুরমাকে জোর করে মরতে বলছে । আমাকে তোমার গ্রামে নিয়ে চলো ।'
 `পাগল ছেলে ! শোনো, পিন্টু, কেঁদো না । ওখানে যাও । তোমার 
                  ওখানে দরকার ।'  
 `আমি কী করবো ওখানে ?'  
 `জেনে রাখবে 
                  । মানুষের মন কতো বিচিত্র হয় ।'  
 `তেঁতুলগাছ, আমার অনেক 
                  কথা আছে । তুমি শুনবে না ?'  
 `বলো ।' 
                   
ধূপ-ধুনো-প্রদীপ-হরিনাম । আয়োজনে কোনও ত্রুটি নেই । বুড়ির গোঙানির শব্দও আর আলাদা করে শোনা যাচ্ছে না । রাত বাড়ছে । বাড়ছে অস্বস্তি । অপরাধী মুখ নিয়ে দুই ছেলে প্রতিবেশীদের দিকে তাকাচ্ছে । দুই বউ মাঝেমাঝেই চা দিয়ে খুশি রাখছে তাদের ।
দূরে কোথাও কুকুর ডাকছে । আকাশে এক কামড় খাওয়া চাঁদ । বুড়ি কিছু দেখছে না । শুনছে না । তবু আয়োজন চমত্কার ।
 বড় ছেলে এইসময় দেওয়াল থেকে ছবিটা খুলে নিয়ে এসে চেষ্টা করল - 
                  `মা, এই যে বাবার ছবি ... দ্যাখো দ্যাখো তোমার বুকে রাখলাম ... 
                  বাবা তোমাকে ডাকছে ... তুমি শুনতে পাচ্ছো ? ... বাবা তোমাকে 
                  নিয়ে যেতে এসেছে ... শুনতে পাচ্ছো ? ... শু-ন-তে-পা-চ্ছো ? ...' 
                   
 গলা ত্রক্রমশ মরিয়া হয়ে ওঠে । 
                   
প্রতিবেশীদের কাছে আর সম্মান থাকছে না । পাড়ার ছেলেদের কাঁধের গামছা পর্যন্ত অস্থির । এই মুহূর্তে দুই ছেলের অসম্মান আর বিমূঢ়তার শ্রেষ্ঠ রূপান্তর হতে পারে কান্না । তারা গলা ছেড়ে কাঁদতে থাকে অতএব । বউরা । প্রতিবেশীরা ।
তবু সব আয়োজনের গালে আশ্চর্য অথচ বিপন্ন এক থাপ্পড়ের মতো বেঁচে থাকে বুড়ি । মরে না । আর প্রায় একশো বছরের পুরোনো পাঁচ আঙুলের দাগ যাদের গালে সবচেয়ে গভীরভাবে বসেছে, সেই দুইভাই, বড়ো আর ছোটো, রাতভর উন্মত্তের মতো চিত্কার করে চলে - `মা ... তুমি মরো ... এবার মরো ... এবার অন্তত: মরো ...'
`কে জানে তেঁতুলগাছ, বুঝি না, কে সময়, কে জাদু, শুধু এক্ষুনি চাই ঠাকুরমা মরে যাক এই যন্ত্রণা শেষ হোক ... তেঁতুলগাছ, কথা দাও, ঠাকুরমা চলে গেলে এই গ্রামে আর আমি থাকব না, কথা দাও আমাকে নিয়ে যাবে ... জানো আমি একবার ... সঙ্গে ঠাকুরমাও ... আর দুপুর ... আর গল্পশোনা রাতের বিছানা ... সোনার কাঠি ... রুপোর কাঠি ... কখন যে শেষ ... এই রাত ... উ: ...'   
 আকুল পিন্টুর আরও কিছু অক্ষর আমি দেখলাম বুনো ঝোপে মিশে 
                  গেল । মিশে যেতেই সেখানে নামল আশ্চর্য কুয়াশা । যেখানে 
                  তেঁতুলগাছটা ছিল, এখন নেই, সেই অস্তিত্ব আর অস্তিত্বহীনতায় দুলতে 
                  থাকা জায়গাটায় একটা কিছু খেলা হচ্ছে । কুয়াশা আমাকে দেখতে 
                  দিচ্ছে না । ঠিক আছে, কুয়াশা । অন্তত: বলো, এটা কি একটা 
                  ভোরবেলা ?