ছায়াময় আমার একমাত্র বন্ধু । তার মুখে অনেক দাড়ি । সে অনেক গল্প জানে । বটগাছের নীচে তাহার বাড়ি । সূর্য উঠিলে, গাছের নীচে ছায়া পড়িলে সে আসে এবং আমার সঙ্গে খেলা করে । হাওয়া উঠিলে আমরা লুকোচুরি --- সিতু এই অব্দি রচনা লিখে জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে দেখল । এখন দুপুরবেলা । মা আর দিদি ওঘরে ঘুমোচ্ছে । আকাশটা কি নীল ! দলা দলা মেঘ ভাসছে । ঠিক হাওয়াই মেঠাইয়ের মত । তবে গোলাপী নয়, সাদা । এতক্ষণে ছায়াময় নিশ্চয় বটতলায় এসে বসে থাকবে । সিতু তাড়াতাড়ি খাতা কলম ফেলে বারান্দা থেকে এক লাফে নিচে নেমে দৌড় লাগাল । খুলে থাকা খাতার পাতায় অর্ধেক গড়া "প্রিয় বন্ধু" রচনাকে নিয়ে দক্ষিণী হাওয়া খেলা করতে লাগল ।
ঝিকের টুকরো পায়ে ফুটছে । দরজার পাশে লক্ষ্মী দাঁড়িয়ে ছিল । মেহেন্দির বেড়া চিবোচ্ছে । ওকে দেখে মাথা বাড়ল । গলায় সুড়সুড়ি খাবে । লক্ষ্মীকে একটা ডজ করে পাশ কাটিয়ে সিতু আবার দৌড়ুল । উইথাউট দ্য বল প্লে । গেমস্যার শিখিয়েছে ।
মা নিশ্চয় টের পায়নি । পেলে চিত্কার করে ডাকত । না শুনলে সন্ধেবেলা বাবাকে বলে মার খাওয়াত । নিজে মারবে না । ভাল হয়েছে । ঘুম ভাঙতে ভাঙতে সেই বিকেল । সিতু ততক্ষণে ফিরে আসবে ।
রাস্তা ডিঙিয়ে মাঠ । বর্ষায় বিল হয়ে যায় । নৌকা চলে । এখন ঠা ঠা শুকনো । ছায়াটা পায়ের নিচে এই এতটুকু হয়ে ছুটছে-- ছুটছে-- মাঠের ওপারে বাসরাস্তা । এখান থেকে লাল একটা সরু সূতোর মত দেখায় । গরমে তিরতির করে কাঁপছে । ওই অব্দি যেতে হবে তবে সিতুর বটগাছ আসবে । গাছ নয় তো, রাজপ্রাসাদ । থামের মত সব ঝুরি নেমেছে । ওখানে দুপুরবেলা সিতু সিরাজদৌল্লা খেলে । ছায়াময় শুয়ে শুয়ে দেখে ।
"ছায়াময় । ও ছায়াময় । আছো ?"
সিতু হাঁপাতে হাঁপাতে ডাকছিল । ঘেমো গেঞ্জিটা খুলে একটা ঝুরির গায়ে লটকে দিয়েছে । হাওয়া খেয়ে শুকোক । গাছতলাতে বেশ ঠান্ডা । খালি গায়ে আরাম লাগে । পাতার ফাঁকে ফাঁকে লাঠি লাঠি বোদ ঢুকে আসছে । হাওয়ায় বটবাড়ির ছাদ নড়ে, আর অমনি নিচের মাটিতে আলো ছায়ার ছবিগুলোও নড়েচড়ে অন্যরকম হয়ে যায় । দিদির ক্যালিডোস্কোপের মত । ওরই মধ্যে কোথাও ছায়াময় লুকিয়ে আছে । দেখ কান্ড ! রোজ এই খেলা । সিতুকে অন্তত: আধঘন্টা ছায়াবাড়ি ঘুরে ঘুরে খুঁজতে হবে । তোষামোদ করতে হবে । তবে সামনে আসবে ।
"ও ছায়াময় । নাও আর খুঁজবোই না । এই আমি বসলাম ।"
সিতু রাগ করে, ঝুরির পর ঝুরি পেরিয়ে গাছবাড়ির একেবারে মাঝখানে এসে একটা উঁচুমত শেকড়ে হেলান দিয়ে বসল । মুখখানা ভার । কথা বলছে না । আসুক না আজ একবার ।
ওর চারদিকে এলোমেলো আলোয় ছায়ায় কত যে ছবি তৈরী হচ্ছে । তার মধ্যে একটাও ছায়াময়--- আরে--- এই ঝরে সিতু দেখতে পেল । ওই তো । কখন যেন ঠিক এসে বসে আছে । আলো আর ছায়ায় মিলে ঠিক এত্তো বড়ো একটা দাড়িগোঁফওয়ালা মুখ-- মাটির ওপর ছড়িয়ে । হাসছে মিটিমিটি । সিতু একবার চেয়ে দেখেই মুখ ঘুরিয়ে নিল ।
"এ--ই সিতু ।"
"যাও । তোমার সঙ্গে আড়ি ।"
ওমনি টুক করে একটা বটফল এসে লাগল মাথায় । ছায়াময়ই মেরেছে । নইলে কে আর আসবে এই দুপুরে সিতুকে ঢিল মারতে ।
"দাঁড়া তো !"
একটা ঢিল কুড়িয়ে নিয়ে ছুঁড়ে মারতে যাবে সিতু, অমনি ফুরফুরে হাওয়া বয়ে গেল বটবাড়ির ছাত শনশনিয়ে । সিতু দেখল, ছায়াময় সামনে নেই ।
"টু-----কি"---
অনেকটা দূরে ছায়াময়ের আলোছায়া মুখটা ভাসছে মাটির ওপর-- "ছোঁয়া ছুঁয়ি খেলবে ?"
সিতু চু--উ--উ--উ-- করে দম দিয়ে ছুটল শেকড় পেরিয়ে । ছায়াময় আবার ডুব দিল-- এবারে ভেসে উঠল একেবারে গাছটার গোড়ার কাছে ---
সিতুকে থার্ড পিরিয়ডের স্ময় ছোটকা স্কুল থেকে বাড়ি নিয়ে এল । হেডমাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে বারান্দায় দেখা । ছোটকা ওঁকে আস্তে আস্তে কি যেন বলে, তারপর সিতুকে সাইকেলের রডে বসিয়ে বাড়ি নিয়ে চলল । বলল, ওর পনেরোদিন ইস্কুল ছুটি ।
উঠোনে ভীষণ রোদের মধ্যে বাবা শুয়ে ছিল । ঠাম্মা কাঁঅদছে । মা কাঁদছে । বাবা কিন্তু কিচ্ছু বলছে না । চুপচাপ শুয়ে আছে ।
একেই বুঝি মরে যাওয়া বলে ! কিন্তু কই ? ভূত কোথায় ? এ তো চুপচাপ শুয়ে আছে ! দেখে মনে হবে, ঘুমোচ্ছে । এক্ষুণি পাশ ফিরে, চোখ খুলে সিতুকে ঘামাচি মারতে ডাকবে । সিতু বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল । সবাই এত কাঁদছে কেন ? বাবা তো কাউকে মারে নি !
খানিক পরে সবাই মিলে বাবাকে কাঁধে তুলে বের হল । সিতুকেও সাথে নিয়ে গেল । নদীর ধারে নিয়ে গিয়ে বাবাকে শুইয়ে একগোছা পাটকাঠিতে আগুন দিয়ে ওর হাতে দিয়ে বলল, "বাবার মুখে ছোঁয়া ।"
পটপট ক'রে জ্বলতে জ্বলতে হঠাৎ বাবাকে ঘিরে ধু ধু করে আগুন জ্বলে উঠল । বাবার চুল পুড়ে যাচ্ছে.... সিতু ধরতে যাচ্ছিল, সবাই মিলে ওকে আটকে রাখল । বলল, ধোঁয়ায় চড়ে বাবা স্বর্গে যাচ্ছে ।
"আচ্ছা ছায়াময়, আগুনে পুড়ে মানুষ কোথায় যায় ?"
"বাতাসের দেশে ।"
"তুমি তাদের দেখতে পাও ?"
"হ্যাঁ, দেখতে পাই । কথা বলি ।"
"আমার বাবাকে দেখেছো ?"
"হ্যাঁ । তুমি এবারে ফাস্ট হয়েছো বলে খুব খুশি ।"
"সত্যি ?"
"হ্যাঁ গো । আমায় বলল তো !"
"ছায়াময় । আমার রেজাল্টটা দেখবে ? দেখে নিয়ে বাবাকে নম্বরগুলো বলে দিয়ো ।"
বটগাছের পাতার ফাঁক ফোঁকর দিয়ে রৌদ্রশলা এসে বিদ্ধ করে মাটির বুক । আলোছায়ায় মাখামাখি গাছতলা । আর তারই মধ্যে, সেই আলোয় ছায়ায় মায়ায় গড়া একটি মুখের আদল ভেসে থাকে । তার পাশে উবু হয়ে বসে শিশুটি তার নম্বরের কাগজ মেলে ধরে তার ছায়াময়ের মুখের সামনে । --- এবং স্বর্গ নেমে আসে বটতলার নিটোল নির্জনে ।
বিকেলে মাঠ থেকে ফিরে সিতু দেখল সেজকাকা এসেছে । বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিল । সিতু প্রণাম করে ঘরে গিয়ে ঢুকে দেখে মা একটা ছোট বাক্সে ওর জামা কাপড় গুছোচ্ছে ।
"মা । মামাবাড়ি যাবো বুঝি ?"
মা জবাব দিল না ।
"কিন্তু মা, এখনও তো গ্রীষ্মের ছুটি পড়তে অনেক দেরি !"
"সিতু, তুই আজকের রাতের বাসে তোর সেজকাকার সঙ্গে দুর্গাপুর যাচ্ছিস ।"
"কেন ?"
"ওখানে থেকে পড়বি তুই । শহরের ইস্কুলে---"
"আমি যাবো না । আমি কিছুতেই...."
"সিতু, শোন..."
কিন্তু যেতে হল । রাত আটটায় বাস । ছটার সময় খেয়ে দেয়ে, কপালে দইয়ের টিপ পরে রওয়ানা হল সিতু । কাকার হাতে ওর বাক্স । ফুটবলটাকে সিতু বগলদাবা করে নিয়ে চলেছে । মা, দিদি কেঁদেছে । ছোটকাকা মুখ ঘুরিয়ে থেকেছে । সিতু কাঁদে নি । মুখও ঘোরায় নি । শুকনো চোখে বের হয়ে এসেছে । ওর খালি মনে হচ্ছিল, ওকে তাড়িয়ে দিচ্ছে । কী লজ্জা ! লজ্জায় ও কারো দিকে তাকায় নি ।
--"সেজকা, দূর্গাপুরে পৌঁছোব কখন ?"
"ভোর ছটায় ।"
"সারারাত বাস চলবে বুঝি ?"
"হ্যাঁ । সারারাত ।"
-- সারারাত ! আজ পূর্ণিমা । থালার মত চাঁদটা সরে পূব দিকে উঠেছে । ওই চাঁদটা ভেসে ভেসে পুব থেকে পশ্চিমে চলে যাবে, বাস থামবে না । গোঁ গোঁ করে শুধু চলতেই থাকবে, চলতেই থাকবে--- তারপর রাত কেটে ভোর হলে, তবে দূর্গাপুর আসবে । ওখানে মা বাঙলায় কথা বলে তো ! কে জানে !"
"সেজ কাকা, তোমাদের বাড়ির কাছে বটগাছ আছে ?"
"কেন বল তো ?"
"বল না, আছে ?"
না । নেই । একি তোদের গ্রাম পেয়েছিস ?"
---"বটগাছ নেই ? তাহলে ছায়াময়--- দুপুর বেলা যে কোন বটতলায় গেলেই ওকে দেখতে পাবে এই ভরসাতেই তো--- সিতুর গলার কাছে একটা কান্নার দলা আটকে আসছিল । চোখ জ্বালা করছে । সবকিছু কেমন ঝাপসা ।
বটতলার পাশেই বাসস্ট্যান্ড । বাঁশের খুঁটির ওপর ঢেউটিনের চাল । ওরা তার নিচে এসে দাঁড়াল । এখনও মিনিট পনেরো দেরি আছে । বটের কষের মত জ্যোত্স্না ঝরছে । চারদিক আলোয় আলো । কাকা আর একজন বুড়ো মানুষ দূর্গাপুরে জিনিসপত্রের দরদাম নিয়ে গল্প করছিল । সিতুর হাত ছেড়ে দিয়েছে ।
হাওয়া দিচ্ছিল । বটপাতার ঝর ঝর শব্দ শুনে পেছন দিকে চেয়ে দেখল সিতু । ঘন ক্ষীরের দলার মত চাঁদের আলোর এলোমেলো টুকরো ছড়িয়ে আছে বটতলার অন্ধকার জুড়ে । আর তার মধ্যে--- আরে--- এ তো ছায়াময় !! নিশ্চয় খবর পেয়ে দেখা করতে এসেছে ! সিতু এদিক ওদিক তাকিয়ে হঠাৎ বলটা ছুঁড়ে দিল গাছতলায় । তারপর বলল, "কাকা, বলটা বটতলায় গড়িয়ে গেছে । নিয়ে আসি ?"
"যাও তবে সাপখোপ দেখে ।"
কাকা আবার মুখ ফিরিয়ে গল্প করছে । সিতু একছুটে রাস্তা ডিঙিয়ে ওর রাজপ্রাসাদে এসে ঢুকল ।
এখানটা সবকিছু কেমন চুপচাপ । ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখে একটা পাখি তার বাসায় খড়খড় করে শব্দ করে উঠল, তারপর আবার সব নি:ঝুম । ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে ।
বলটা পরে ছিল ছায়াময়ের ঠিক পাশে ।
"ছায়াময় ।"
"বলো ।"
"আমাকে দূর্গাপুরে নিয়ে যাচ্ছে ।"
"আমি জানি তো ।"
আর আসবো না ।"
ছায়াময় মিষ্টি হাসল--- "ভালো থেকো কিন্তু ।"
এইবারে সিতু দেখতে পেল । মাকে ছেড়ে আসবার সময় টের পায়নি । এইবারে টের পেল----
-- যেন অন্ধকার অনন্তের বুকে অচেনা কার হাত ধরে সে তার চেনা উপকূল ছেড়ে চলেছে---চলেছে--- তার মা, তার ছায়াময়, সব আস্তে আস্তে ছোট হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে যেন । আর সে নিজে---
-- একটা ঠান্ডা একাকিত্ব তার মনটাকে পাকে পাকে জড়িয়ে বজ্র পেষনে যেন নিঙড়ে নিচ্ছিল, আর সেই পেষণের নির্যাস এবারে দুটো কিশোর চোখ বেয়ে বার হয়ে এসে লবণাক্ত করে দিল ছায়াময়ের মুখ, যা কিনা আসলে সেই আলোছায়ার বুননে ঢাকা বটতলার মাটি, যাতে মিশে আছে সিতু নামে বালকের পিতৃপুরুষের দেহভস্ম ।
দূরে একটা গুরু গুরু শব্দ হচ্ছিল । ত্রক্রমে তা আরও জোরালো হয়ে উঠল । হঠাৎ দিগন্ত থেকে ধেয়ে এল জোড়া বিদ্যুতের ফলা । হেডলাইটের তীব্র ইলেকট্রিক ধমকে বটতলার অন্ধকার নিমেষে উধাও । বল হাতে উঠে দাঁড়াল সিতু, সিতাংশু স্যান্যাল ।
এমনি ভাবেই, চোখের জলে পিতৃপুরুষের, এবং তার সুপ্রিয় বর্তমান--- তার মা, প্রাসাদ ও ছায়াময়--- সেই সকলের তর্পন সেরে বালক এক সন্ধ্যায় শহরের পথে রওয়ানা হয়েছিল ।
আর ফিরে আসেনি ।