• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩১ | অক্টোবর ২০০৩ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • ৫ পার্ল রোড : মীনাক্ষী দত্ত

    আবু সয়ীদ আইয়ুব ছিলেন অতি সুদর্শন । অল্প বয়সে তাঁর টিবি হয়েছিলো এবং সারা জীবন অসুস্থতা তাঁকে তাড়া করেছে । কিন্তু তাঁর চেহারায় রোগের ম্লানিমা ছিলো না বরং অসুস্থতা তাঁকে দিয়েছিলো এক রোমান্টিক `অরা' । টিকোলো নাক, লম্বা ঢেউ-তোলা চুল, উজ্জ্বল ত্বক যেন কমলালেবুর সঙ্গে দুধ মেশানো । গায়ে সর্বদাই একটি রঙিন চাদর, পাঞ্জাবিও রঙিন । সে-সময়ে পুরুষদের রঙিন পাঞ্জাবি পরার চল ছিলো না, আইয়ুবই একমাত্র নানা রঙের পাঞ্জাবি পরতেন । আমাদের বাড়ি এসে কখনো কিছু খেতেন না, তাঁর বাড়িতে গেলেও খেতে দিতেন না কিছু, জলও না । খুব সম্ভব তাঁর অতীতের যক্ষ্মা রোগের কারণে, হয়তো ভাবতেন লোকেরা ভয় পাবে, কিংবা হয়তো কখনো কোনো খারাপ অভিজ্ঞতা হয়েছিলো তাঁর ।

    আমি যখন দর্শন নিয়ে বিএ ক্লাশে ভর্তি হবো কিনা ভাবছি তখন আইয়ুব খুব উত্সাহ দিয়েছিলেন । বলেছিলেন, আমার কাছে এসো, আমি তোমাকে সাহায্য করবো, তোমার যে-সব বই দরকার হবে প্রায় সবই আমার কাছে পাবে । উনি থাকতেন পার্ক সার্কাসে, ৫ পার্ল রোড । বাড়িটি ছিলো তাঁর বড়ো ভাই ড: গণির । ড: গণিও খুব সুশ্রী ছিলেন, কিন্তু অন্যরকম, খুব শক্তপোক্ত পুরুষালি চেহারা । তিনি ছিলেন কমিউনিস্ট বিধায়ক ও ডাক্তার । তিনি বিনা পয়সায় বস্তিবাসীদের চিকিত্সা করতেন । শুনেছি তিনি নাকি খোলা ফিটনে করে বেরুতেন । গরীব মানুষেরা তাঁর গাড়ির পেছনে এসে দেখিয়ে যেতো । আমি অবশ্য সেটা দেখিনি । আইয়ুবও প্রথমে বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন, পদার্থবিজ্ঞান । পরে তিনি দর্শনে আসেন ।

    কলেজ শুরু হওয়ার আগে একদিন আইয়ুব সাহেবের বাড়ি গেলাম নরেশদার (নরেশ গুহ) সঙ্গে । পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকে দেখলাম আইয়ুব ও একটি তরুণী মুখোমুখি । মেয়েটির পরনের খদ্দরের সাদা শাড়িতে ফিতে পাড়, সাদা ব্লাউজ কনুই অবধি, মুখে কোনোরকম প্রসাধনের চিহ্ন নেই, গায়ে নেই কোনো গয়না । আমি পরেছি টুকটুকে লাল শিফনের শাড়ি, আর আমাদের অল্পবয়সে সব মেয়ের গায়েই বেশ গয়না থাকতো, হাতে বালা, গলায় হার, কানে মাকড়ি এসব তো বাধ্যতামূলক । তাই ঐ ভূষণহীনাকে দেখে একটু আত্মসচেতন হয়ে পড়লাম । পরে গৌরী জানিয়েছিলো একই প্রতিক্রিয়া তারও হয়েছিলো আমাকে দেখে । এদিকে নরেশদার মুখ তাকে দেখে আনন্দে ঝলমল করে উঠলো । আমার সঙ্গে মেয়েটির পরিচয় করিয়ে দিয়ে নরেশদা বললেন, `গৌরী দত্ত' ।

    নামটা জানতাম, কারণ তার কিছুদিন আগে শান্তিনিকেতনে সাহিত্যমেলা হয়ে গেছে, যার উদ্যোক্তা ছিলেন গৌরী দত্ত ও নিমাই চট্টোপাধ্যায় । ২১শে ফেব্রুয়ারির দিনটি মনে রেখে ঐ কিন্তু প্রথম উত্সব যদিও উদ্যোক্তারা রাজনৈতিক কারণে সেটা স্পষ্ট করেননি কারণ পূর্ববঙ্গ তখনো শৃঙ্খলিত পূর্বপাকিস্তান । সেই হিসেবে ঐ সাহিত্যমেলাটি ঐতিহাসিক । এই সাহিত্যমেলায় মা বাবা গিয়েছিলেন, নরেশ গুহ, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, তরুণ শঙ্খ ঘোষ ও পূর্বপাকিস্তান থেকে এসেছিলেন শামসুর রাহমান । সভাপতিত্ব করেছিলেন অন্নদাশংকর রায় । নরেশদা ফিরে এসে ফাল্গুন ১৩৫৯ নামে একটি কবিতা লেখেন যাতে এরকম একটি লাইন আছে :

    কেমন, বলিনি ? দ্যাখো, বসন্ত ফোটায় গাছে ফুল ।
    (ধন্যবাদ গৌরী দত্ত, শ্রীনিমাই চট্টোপাধ্যায় ।)
    তিপ্পান্ন সালেও আজো ফাল্গুন কী-রঙ্গ দেখায় ...
    আইয়ুব সাহেব যে মেয়েটির প্রতি খুবই মনোযোগী, বেশ অতিরিক্তই, সেটা বুঝতে পারছিলাম - মনে হচ্ছিলো তাঁর যেন হঠাৎ বয়স কমে গেছে ; কিন্তু আইয়ুব ও গৌরী যে পরস্পরের প্রতি আসক্ত হতে পারেন তা মাথায় আসেনি । বরং নরেশদাকেই মনে হচ্ছিলো গৌরীর প্রতি একটু অধিক মনোযোগী । দুটি অসমবয়স্ক মুগ্ধ পুরুষের সামনে বসে আছে একটু আত্মসচেতন হয়ে আভরণহীনা তরুণী, ছবিটি সুন্দর । আমার বেশ মজারই লেগেছিলো সেদিন । তাই কিছুদিন পরে যখন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এক সন্ধ্যায় এসে বললেন যে তিনি আকস্মিকভাবে আইয়ুবের বাড়ি গিয়ে দেখেন যে আইয়ুবের বিয়ে হচ্ছে, পাত্রী একটি অল্পবয়সী তরুণী, তার নাম গৌরী, তখন মা-বাবার সঙ্গে আমিও দারুণ অবাক হয়েছিলাম । তাঁর স্বভাবিসদ্ধ ইংরিজিতে ঘরে ঢুকেই সুধীন্দ্র বলেছিলেন, `Ayyub got married today' |

    বিয়েতে পরিবারের বাইরের কেউ উপস্থিত ছিলেন না, ড: গণি ছিলেন সাক্ষী । সালটা হয় ১৯৫৫-র শেষদিক অথবা ১৯৫৬-এর শুরু । আইয়ুব সাহেবের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি তখন, গৌরীর বড়োজোর পঁচিশ । গৌরীর বিয়ের পর নিমাই ইংলণ্ডে চলে যায়, পঁচিশ বছর আর দেশে ফেরে না । কাকতাল না বিশেষ কোনো কারণ আছে তা জানি না ।

    এক সকালে আইয়ুব এলেন আমাদের বাড়িতে সদ্যপরিণীতা স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে । গৌরীর বাবা ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত খ্যাতনামা অধ্যাপক, তাঁর লেখা বই কলেজে আমাদের পাঠ্য ছিলো । তিনি ছিলেন কট্টর গান্ধীবাদী এবং পরিবারের ব্যাপারে গন্ধীর মতোই স্বৈরাচারী । আইয়ুব যখন শান্তিনিকেতনে পড়াতে যান ১৯৫০ সালে নিজাম অধ্যাপক হয়ে তখন গৌরীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় । এই পদটি নিজামের আর্থিক সৌজন্যে প্রতিষ্ঠিত, ইসলামিক সংস্কৃতি পড়ানোর জন্য । আইয়ুব ছিলেন দ্বিতীয় অধ্যাপক, প্রথম কে এসেছিলেন তাঁর নাম ভুলে গেছি । পূর্বপল্লীর নিজামভবনে আইয়ুব থাকতেন । দর্শনের ছাত্রী গৌরী আইয়ুবকে প্রায় উপাসনা করতে শুরু করলো । আইয়ুবের জন্ম বিহারী মুসলমান পরিবারে, বয়সে দ্বিগুণ, তার উপরে অসুস্থ । গৌরীর বাবার ব্যাপারটা মোটেই পছন্দ হলো না । বিপদ হয়তো তিনি নিজেই ডেকে আনলেন গৌরীকে বাধা দেবার চেষ্টা করে । ৫২-সালে ছুটিতে গিয়ে আইয়ুব আর ফিরলেন না, খুব সম্ভব ফিরতে পারলেন না, অনেকেরই ধারণা ধীরেনবাবুই তার জন্য দায়ি । আমি যখন আইয়ুবের ঘরে গৌরীকে দেখেছিলাম তখন সে শান্তিনিকেতন থেকে চলে এসেছে বাবার বিরুদ্ধাচারণ করে । বাবা অতোটা বাড়াবাড়ি না করলে গৌরী আইয়ুবকে বিয়ে করতো কিনা তা নিয়ে সংশয় হয় ।

    বাবাকে অমান্য করার অপরাধে গৌরীর দার্শনিক, পণ্ডিত পিতা তাকে পরিত্যাগ করলেন, সারা জীবন তার মুখ দেখলেন না । স্ত্রী ও অন্যান্য ছেলেমেয়ের প্রতি কঠোর নির্দেশ দিলেন যোগাযোগ ছিন্ন করার । গৌরীর যখন ছেলে হলো তখনো তাঁর নাতিকে দেখার ইচ্ছে হলো না, যদিও গৌরী খবর দিয়েছিলো, হয়তো তার সুদূর আশা ছিলো ক্ষমা পাবার ।

    পার্ল রোডের বাড়িতে আইয়ুব সাহেবের একটি মাত্র ঘর, বই-এ ঠাসা এবং প্রতি সন্ধ্যায় বন্ধু-সমাগম । একতলায় গৌরী একটা ঘর পেলো নিজের জন্য ।

    তাদের বিয়ের পর এক সন্ধ্যায় আইয়ুবের কাছে গেছি, একটু পরেই ট্রে-তে করে এলো চায়ের সরঞ্জাম, সঙ্গে নানান খাদ্যদ্রব্য । আমি তো বেশ অবাক, খুশিও । তাকিয়ে দেখলাম ঘরের দেয়ালে নতুন রঙ, জানালায় সুন্দর পর্দা, ঘর নিপুণভাবে গোছানো । গৌরী এসে চা ছেঁকে দিলো, কাবাবের সঙ্গে পেঁয়াজের স্যালাড তুলে দিলো, আর একটা নাও, আর একটা নাও বললো, তারপর `আমার ঘরে চলো' বলে নিচের ঘরে নিয়ে গেলো । মাঝারি সাইজের ঘর, পাশে এক চিলতে রান্নাঘর । জানালার তাকে আচারের বোয়ম রাখা রোদ পোহাবার জন্য । রঙিন চাদর ও কুশনে সজ্জিত বিছানা, খাবার টেবিল দেয়াল ঘেঁষে । দেয়ালে আইয়ুবের ছবি, বোধহয় বিয়ের পরে তোলা, মুখ একটু নিচু করে সে হাসছে, আইয়ুব তার দিকে তাকিয়ে আছেন । আইয়ুবের ঘরে গৌরীর একটি ছবি ছিলো মনিপুরি নাচের পোশাকে তোলা শান্তিনিকেতনে । ভোজবাজির মতো আইয়ুবের জীবনের ছাঁচ গেছে বদলে । গৌরী অত্যন্ত শ্রীমতী, যেমন স্নিগ্ধ তার চেহারা, তেমন স্নিগ্ধ তার স্বভাব আর তেমনই তার সংসার রচনা । এরপর ৫ পার্ল রোড আর শুধু বই ধার নিতে বা দর্শনের তত্ত্ব বুঝতে যাবার জায়গা রইলো না, সে বাড়ির প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠলো গৌরীর আতিথ্যপ্লাবিত ওঁদের দুজনের সংসার ।

    একদিন ওদের বাড়ি থেকে ফিরছি, এগিয়ে দিতে এসে সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে গৌরী বললো, `আজ আমি রং সাইড অফ থার্টি-তে চলে গেলাম' । আইয়ুব সাহেবের স্ত্রী হিসেবে আমি তাকে গৌরীদি এবং আপনি বলতাম । সেদিন বললাম, `আজ থেকে আর গৌরীদি ডাকবো না এবং তোমাকে তুমি' । সেই থেকে সে আমার কাছে শুধুই গৌরী । মা তাকে মেয়ের মতো স্নেহ করতেন, বাবা কিন্তু তাকে `আপনি' সম্বোধন করতেন । গৌরী খুবই আপত্তি জানাতো, কিন্তু বাবার শর্ত ছিলো গৌরীরও আইয়ুবকে `তুমি' বলতে হবে । পুরোনো অভ্যাসবশে গৌরী বিয়ের পরও আইয়ুবকে `আপনি' বলতো, তার জিভে কিছুতেই `তুমি' আসতো না । শিক্ষককে বিয়ে করলে হয়তো ভক্তি-ভাবটা প্রবল হয়, আমার শাশুড়িও শ্বশুরমশাইকে `আপনি' বলেছেন - তিনি একসময় প্রাইভেট টিউটর ছিলেন ।

    গৌরীর বিয়ের একবছরের মধ্যেই তার ছেলের জন্ম হয়, ওঁদের একমাত্র সন্তান । ডাক্তার গৌরী বা আইয়ুবের কথা না শুনে একটা তারিখ দেন এবং সে তারিখে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান । আইয়ুব কাতরভাবে বলেছিলেন যে ওঁকে বললাম ঐ সময়ে আমাদের বিয়েও হয়নি, উনি কান দিলেন না । গৌরীকে বেশ কয়েকদিন বাড়তি হাসপাতালে থাকতে হয়েছিলো । তারপর `কোল আলো করা' ছেলে নিয়ে সে বাড়ি ফিরলো ।



    সম্পর্কিত `প্র-নাতি' কুষাণ-এর সঙ্গে গর্বিত গৌরী আইয়ুব
    (মার্চ, ১৯৯১; ঢাকা)


    সত্যিই, পূষণের মতো সুন্দর শিশু আমি দেখিনি । আইয়ুব ও গৌরীর সমস্ত সৌন্দর্যটুকু নিয়ে সে জন্মেছিলো । আইয়ুব তার নাম রাখলেন পূষণ আঞ্জুম । কিন্তু গৌরী আইয়ুব নামটি জুড়ে দিলো । ছেলেকে নিয়ে বেশ কিছুদিন গৌরীকে একতলায় থাকতে হয়েছিলো । দিনের মধ্যে না জানি কতোবার তাকে সিঁড়ি ভাঙতে হতো । আইয়ুবকে নিচের ঘরে ক্কচিৎ দেখেছি । সেই ঘরে গৌরী প্রায়ই আমাদের খাওয়াতো । আমিষ নিরামিষ, কতো রান্নাই যে সে জানতো । গোমাংসের শামিকাবাব, নার্গিস কোপ্তা, কাঁচকলার কোপ্তা - এসব আমাদের মধ্যে বিখ্যাত ছিলো । সে বলতো কাউকে নিমন্ত্রণ করলে রাতে তার ঘুমের ব্যাঘাত করতো মেনু'র পরিকল্পনা ।

    একবার আমরা একটা বেশ বড়ো দল নিমন্ত্রিত হয়েছি, আইয়ুবের ঘরে আড্ডা হচ্ছে, এমন সময় অম্লান দত্তের প্রবেশ । অম্লানকে যাঁরা চেনেন তাঁরা জানেন যে তাঁর মুখ দিয়ে একবার `না' বেরুলেই হলো, সেটাকে কেউ `হ্যাঁ' করাতে পারবে না অথবা `হ্যাঁ'কে `না' । সেদিন গৌরী অম্লানকে বহু অনুনয় করলো খেয়ে যাবার জন্য, অম্লান কিছুতেই রাজি হলেন না । খাবার ব্যবস্থা নিচে গৌরীর ঘরে । অম্লান যখন চলে যাবার জন্য সিঁড়ি দিয়ে নামছেন তখন আমি আর আমার বোন রুমি দুজনে তাঁর দুই বাহুলগ্ন হয়ে ঝুলে পড়লাম এবং ঐভাবে তাঁকে প্রায় তুলে নিয়ে গৌরীর ঘরে ঢুকিয়ে দিলাম । অম্লান খুব একটা বাধা দিলেন না, তাইতে আমরা নিশ্চিন্ত হয়ে তাঁকে ছেড়ে দিলাম ও গৌরী দ্রুত প্লেটে তাঁর জন্য খাবার সাজাতে লাগলো । কিন্তু আমরা তখনো অম্লানকে চিনিনি । গৌরীর ত্বরিত্গতিতে সাজানো খাবারের প্লেট উপেক্ষা করে আমরা কিছু বোঝার আগেই তিনি বেরিয়ে গেলেন তিন তিনজন জলজ্যান্ত তরুণীকে বোকা বানিয়ে ।

    ভাগ্যক্রমে দোতলায় আইয়ুবের পাশের ঘরটি ফাঁকা হলো । পাশাপাশি দুটো ঘর নিয়ে সম্পূর্ণ একটি ফ্ল্যাট হলো অবশেষে । নতুন ঘরটি বেশি ভালো, সঙ্গে একটি বারান্দাও আছে ; গৌরী আইয়ুবকে সে ঘরটি দিয়ে নিজে আইয়ুবের পুরোনো ঘরটি নিলো । বারান্দায় ফুল গাছের টব বসালো । পূষণকে এমনভাবে রাখতো যাতে আইয়ুবের কোনোরকম ব্যাঘাত না ঘটে । সে প্রথমে পড়াতো যোধপুর গার্লস হাই স্কুলে, তারপর, বোধহয় অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরে এসে যোগ দিলো শ্রীশিক্ষায়তন কলেজে । যতোদিন পেরেছে সে চাকরি করেছে, বাতে পঙ্গু হয়ে যাবার পরও বাড়ি থেকে টানা রিক্সা করে বহুকষ্টে যাতায়াত করতো ।



    (মাঝের সারিতে, বাঁ-দিক থেকে) গৌরী আইয়ুব, জাহানারা ইমাম,
    ও ড: সুলতানা জামান (মার্চ, ১৯৯১; ঢাকা)


    তার আতিথেয়তা ছিলো অনবদ্য, স্ত্রী হিসেবে সে অতুলনীয়া - বাবা বলতেন একমাত্র মহাভারতের সাবিত্রীই তার মতো বুদ্ধিমতী, বিদূষী, লাবণ্যময়ী ও পতিপ্রাণা । সত্যবানের মতোই আইয়ুবের জন্য গৌরী দীর্ঘজীবন উপহার নিয়ে এসেছিলো । কিন্তু চাকরি, সংসারচালনা, সন্তানপালন, অসুস্থ স্বামীর ক্লান্তিহীন সেবা করেই সে তৃপ্ত হয়নি, নানান সমাজসেবামূলক কাজেও সে জড়িয়ে ফেলেছে নিজেকে । বস্তিতে বস্তিতে ঘুরে মেয়েদের জন্মনিয়ন্ত্রণ শেখানো, নিরক্ষরদের সাহায্য করা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রচেষ্টা, এছাড়াও ছিলো `খেলাঘর' অনাথ আশ্রমের কাজ । তার সঙ্গে দুবার আমি গিয়েছিলাম মধ্যমগ্রামে `খেলাঘরে' । মৈত্রেয়ী দেবী ঐ প্রতিষ্ঠানটি শুরু করেছিলেন ।

    পঞ্চাশের ও ষাটের দশককে বলা চলে ঠাণ্ডা যুদ্ধের তুঙ্গ সময় । রাশিয়া ও আমেরিকা লিপ্ত অস্ত্রদৌড়ে, অন্যদিকে পৃথিবীর সর্বত্র বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে চলছে বিশ্বাসের, ভাবনার লড়াই । কলকাতায় তথাকথিত প্রগতিশীলেরা ট্রামবাস পোড়াচ্ছেন ও মাঠে ঘাটে করছেন আন্দোলন । এই লালবন্যা ঠেকাতে বুদ্ধিজীবীরা দ্বিধাগ্রস্থ পায়ে নেমে এসেছেন দক্ষিণ কলকাতার রাজা বসন্ত রায় রোডের কংগ্রেস ফর কালচারাল ফ্রিডমের সৌখিন বৈঠকে । শোভাযাত্রা নয়, পোস্টার নয়, বোমাবন্দুক তো দুরের কথা - তাঁদের অস্ত্র হচ্ছে অতি সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ, শাণিত বক্রোক্তি, ফরাসি ও জার্মান চিন্তাবিদ ও কবিদের রচনা থেকে উদ্ধৃতি । তখন বম্বেতে এক অধিবেশন হয় যাতে যোগ দেবার জন্য বাবাকে প্রায় মেছোবাজারের ভাষায় আক্রমণ করেছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায় পরিচয় পত্রিকায় । (সুধীন্দ্রনাথ দত্ত প্রতিষ্ঠিত এই পত্রিকাটি তখন পরিণত হয়েছে কম্যুনিস্ট পার্টির মুখপত্রে) । তখন বম্বে থেকে প্রকাশিত হতো Quest পত্রিকা, যাতে লেখার জন্য সে-যুগের বিচারে দেওয়া হতো আকর্ষণীয় পারিতোষিক । স্থির হলো এবার থেকে ঐ পত্রিকা কলকাতা থেকে বেরুবে, সম্পাদক আবু সয়ীদ আইয়ুব ও অম্লান দত্ত । সহকারী সম্পাদক হিসেবে সম্পাদকদ্বয় নির্বাচন করলেন কেম্ব্রিজের স্নাতক শান্তিনিকেতন আগত যাদপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যের শিক্ষক ডেভিড ম্যাক্কাচ্চন-কে । ছুটিতে ডেভিড যখন ইংলণ্ডে গেলো তখন জ্যোতির উপর সে দায়িত্ব দেওয়া হলো । পত্রিকার দপ্তর আইয়ুবের ঘরে, কাজেই সে সময়ে খুব বেশি যাওয়া হতো ঐ বাড়িতে । তখন আমাদের আড্ডা ২০২ রাসবিহারী এভিনিউ থেকে মাঝে মাঝে স্থানান্তরিত হতে লাগলো ৫ পার্ল রোডে, কখনো ৬ রাসেল স্ট্রীটে সুধীন্দ্র-রাজেশ্বরীর দক্ষিণের বারান্দায়, মাঝে মাঝে জ্যোতি ও আমার ৭ কর্নফিল্ড রোডের ছোট্ট ফ্ল্যাটে । বিয়ের পর আইয়ুব কোথাও যেতেন না গৌরীকে ছাড়া, যেমন সুধীন্দ্র-রাজেশ্বরী ছিলেন অচ্ছেদ্য জুটি । সুধীন্দ্র ও আইয়ুব দুজনেই পুরুষের সৌন্দর্যের প্রতীক । আপাত সাহেবিআনা সত্ত্বেও সুধীন্দ্রনাথ বজায় রেখেছিলেন অট্টহাসি ও জোর গলায় কথা বলা যেমনটি অভিনেতা অমর দত্ত'র ভাইপোকেই সাজে । অন্যদিকে আইয়ুব কথা বলতেন অতি নিচু স্বরে, হাসতেন মুখ টিপে এবং তাকাতেন বাঁকাভাবে চিবুক ঈষৎ তুলে মুখটা কাৎ করে । গৌরী মাখন-নরম রাজেশ্বরী গর্জাস, গ্ল্যামারাস । দুজনেই শন্তিনিকেতনের ছাত্রী, স্বামীর সঙ্গে বয়সে ব্যবধান বিস্তর । সুধীন্দ্র ছিলেন স্বাস্থ্যের প্রতীক, দীর্ঘ দেহটি সোজা রেখে দাঁডাতেন, বেশিরভাগ সাদা প্যান্ট-সার্ট পরতেন, চালাতেন ছোট একটি ফিয়াট । আইয়ুব চির-অসুস্থ, ঠাণ্ডার ভয়ে জানালাটা কতো ডিগ্রি ফাঁক হবে তা নিয়ে গৌরীকে রইতে হতো ত্রস্ত ।

    Quest পত্রিকার বৈঠকে নীরস কচকচি হতো না । বিশুদ্ধ আদর্শের কারণে, শিল্পীর স্বাধীনতা রক্ষার্থে সকলে জড়ো হয়েছিলেন কংগ্রেস ফর কালচারাল ফ্রিডমের ছাতার তলায় । আইয়ুব তো কখনোই নিজের চেয়ারটি ছেড়ে উঠতেন না, তাঁর ইন্ফ্রাস্ট্রাক্চার জুগিয়ে যেতো গৌরী । যেমন ইলেকট্রিকের বাতির তারগুলো আমরা দেখতে পাই না, তেমন ছিলো তার অদৃশ্য হাত ।

    ঠিক হলো কলকাতায় একটা বিশেষ অধিবেশন হবে তাতে দেশবিদেশ থেকে বুদ্ধিজীবীরা আসবেন । প্রধান বক্তা আর্থার কোয়েসলার । The God That Failed বইয়ে তাঁর লেখা সবাই পড়েছেন । তাছাড়া এই গোষ্ঠীর তিনি পাণ্ডা । এই গোষ্ঠীরই পত্রিকা ছিলো Encounter যার সম্পাদক ছিলেন স্টিফেন স্পেণ্ডার ও আর্ভিং ক্রিস্টল (প্রসঙ্গত আর্ভিং ক্রিস্টলের ছেলে বিলি ক্রিস্টল এখন মার্কিনি প্রেসিডেন্ট বুশের পরামর্শদাতা ) । আইয়ুব জ্যোতির উপর ভার দিলেন ঐ অধিবেশন নিয়ে লেখবার ; জ্যোতি কোয়েসলারকে এমন বিদ্রুপ করে লিখলো যে আইয়ুব পড়লেন বিপদে । এই কোয়েসলারের হাত দিয়েই আসে Quest পত্রিকার খরচ । অন্যদিকে রয়েছে তাঁর মতামত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস । জ্যোতিকে এক দীর্ঘ চিঠি লিখেছিলেন তিনি যার প্রথম লাইনটি আমার মনে আছে, `Your piece is more than excellent but ...' কংগ্রেস ফর কালচারাল ফ্রিডম যে সি,আই,এ-র তা এই সাধু বুদ্ধিজীবীর কল্পনাতেও আসেনি, যখন জানতে পারলেন তখন সম্পাদকদ্বয় পদত্যাগ করলেন ।

    আমার মেয়ে তিতির পূষণের চেয়ে দু'বছরের ছোটো । নরেশদার মেয়ে মণি (সুচরিতা) আর পূষণ সমান । তিতিরের জন্মের আগে গৌরী প্রথাগতভাবে আমার `সাধ' দিয়েছিলো । ঝকঝকে কাঁসার থালার চারদিকে ছোটো ছোটো বাটিতে খাবার সাজানো, চাঁদকে ঘিরে তারা । ঘন কমলারঙের একটি সুন্দর টাঙাইল শাড়ি সে দিয়েছিলো আমাকে সেই উপলক্ষে । নিজে সে কিন্তু চিরকালই সাদা বা খুব হালকা রঙের শাড়ি পরতো, শীতকালে উড়িষ্যার তসর পরতে দেখেছি । আইয়ুবের জানালার ফাঁক দিয়ে রাস্তার ওপারে দোতলা বাডির রান্নাঘরে একটি শাঁখা-পরা কর্মব্যস্ত হাত দেখা যেতো । আইয়ুবের খুব ভালো লাগতো । সেই থেকে গৌরীর হাত দুখানিও শঙ্খশোভিত হয়েছিলো ।

    তিতিরের জন্মের পর গৌরী একটি লাল টুকটুকে সুটকেস ভরে নিয়ে এসেছিলো তার নিজের হাতে সেলাই করা বাচ্চার বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড় ও বাচ্চার গায়ে দেবার কাঁথা । হালকা নীল চাদরের চারপাশে সাদা লেসের ঝালর । সে নীল রঙ বোধহয় করেছিলো ছেলে হবে ভেবে । সবাই বলতো ছেলে হবে । মা নাম ঠিক করে রেখেছিলো তাতার । বাচ্চাকে পেটে নিয়ে আমি অতিশয় দৌড়ঝাঁপ করেছি, তাই মা বলতেন তোর পেটে একটা দস্যু এসেছে, তাতার দস্যু । যেই দেখলেন মেয়ে তন্মুহূর্তে বদলে নাম রাখলেন তিতির ।

    অস্ট্রেলিয়া যাবার আগে পর্যন্তই ছিলো আইয়ুব দম্পতির সুস্থ স্বাভাবিক জীবন । অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরে দুজনেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন । আইয়ুবকে চিরদিনই অসুস্থ দেখেছি, গৌরীর বাতটাই খুব অসুবিধের কারণ হলো । চলাফেরায় খুবই কষ্ট হতে শুরু করলো তার । তাই নিয়ে চাকরি, ছেলেকে দেখা, স্বামীর সেবা ও সমাজসেবা সবই মসৃণভাবে চালাতো সে, মুখে কখনোই কোনো বিরক্তি বা অভিযোগ দেখিনি । তার বাড়ি গেলে কাবাবেরও ঘাটতি পড়েনি ।

    আমরা যখন শিকাগোতে ছিলাম তখন আলাপ হয়েছিলো মার্সি এলিয়াডার সঙ্গে এডওয়ার্ড ডিমকের বাড়ির পার্টিতে । তিনি আমাদের তাঁর লা নুই বেঙ্গলি বইটি উপহার দিয়েছিলেন যার উত্সর্গপত্রে রোমান হরফে লেখা ছিলো : `মৈত্রেয়ীকে : তোমার কি মনে আছে ? যদি মনে থাকে তবে তুমি কি ক্ষমা করিয়াছো ?' (হয়তো একদম সঠিক হলো না) । আমরা খুবই কৌতুহলী হয়ে বললাম, `আমরা এক মৈত্রেয়ীকে চিনি কলকাতায় ...' জানলাম এলিয়াডার মৈত্রেয়ী আমাদেরই মৈত্রেয়ী দেবী । ফিরে এসে জ্যোতি গৌরীর কাছে এই গল্প করেছিলো । একদিন গৌরী এসে বললো, মৈত্রেয়ী দেবী জ্যোতিকে `খেলাঘর' দেখাতে নিয়ে যেতে চান একদিন (আগেই উল্লেখ করেছি, খেলাঘর অনাথ আশ্রমের) । আসলে মৈত্রেয়ী দেবী জ্যোতির মুখ থেকে শুনতে চেয়েছিলেন এলিয়াডার বিষয়ে । জ্যোতি ফিরে এসে বলেছিলো উনি কেঁদেছিলেন সেদিন । `ন হন্যতে' যখন লিখলেন তখন `গৌরী'র জায়গায় `পার্বতী' নাম ব্যবহার করলেন আর জ্যোতির উল্লেখ করেছেন `জ' বলে ।

    একদিকে যেমন কোমল স্বভাব, মধুর ও মৃদুভাষিণী গৌরী তেমনি তার চরিত্রের দৃঢ়তা - রবীন্দ্রনাথ থেকে চুরি করে বলা যায়, কড়ি ও কোমল । সে যেমন তার প্রবল প্রতাপশালী বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে আইয়ুবকে বিয়ে করেছিলো, তেমনি জরুরি অবস্থার সময় আইয়ুবের বিরুদ্ধে গিয়ে গৌরদা ও জ্যোতিকে সহায়তা করেছিলো । প্রথম থেকেই ঠিক হয়েছিলো গৌরদা বাড়িতে বসে পুলিশের দরজায় টোকার প্রতীক্ষা করবেন কারণ হার্ট-অ্যাটাকের পর ছোটাছুটি করা বোধহয় ঠিক হবে না, আর জ্যোতি পলাতক থেকে পত্রিকা বার করে চলবে । এবারে জ্যোতি-আকুল-শম্ভুর (`কলকাতা' রাজনীতি সংখ্যার প্রকাশক ও লেখক) চলবে কী করে ? গৌরদার বন্ধু ও সহ-র্যাডিকাল হিউম্যানিস্ট শান্তিব্রত সেন বললেন, তিনি সব খরচ দেবেন । প্রতিমাসে শান্তিদা গৌরীর কাছে টাকা রেখে যেতেন, জ্যোতি কোনোভাবে গিয়ে নিয়ে আসতো । ধরে নেওয়া হয়েছিলো যে শান্তিদার বাড়ির উপর পুলিশের নজর পড়বে, কিন্তু গৌরীকে কেউ সন্দেহ করবে না ।



    পূষণ ও চম্পাকলি'র বিবাহ-উত্সবে তোলা ছবি, সেই একই ঘরে । উপরে মাঝখানে গৌরী আইয়ুব, মৈত্রেয়ী দেবী বাঁ-দিকে, নীচে গৌরকিশোর ঘোষ (১৯৮১)


    তা কিন্তু হলো না । একদিন মধ্যমগ্রাম যাওয়ার পথে গৌরী আর মৈত্রেয়ী দেবী লক্ষ করলেন পেছন পেছন একটি গাড়ি আসছে । ওরা ফিরে গৌরীর বাড়ি চলে এলেন । বোঝা গেলো পুলিশ গৌরীর দিকে নজর রাখছে । আইয়ুব পারকিনসন রোগে আক্রান্ত, খুবই ভয় পাচ্ছেন - গৌরী জেলে গেলে কী হবে ! তারই মধ্যে কীভাবে যে টাকার হাতবদল হতো ! ঝড়ের বেগে হাজির হতো পাতালবাসী জ্যোতি ; তখন যতো আস্তেই কথা বলুক আইয়ুব ঠিক টের পেয়ে যেতেন । কিন্তু তারই মধ্যে গৌরী জ্যোতিকে না খাইয়ে ছাড়তো না । গৌরদা তখন জেলে । কেউ যোগাযোগ করে না পুলিশের নজরে পড়ার আশঙ্কায় । গৌরী আর তার বন্ধু আরতি সেন দুজনে গৌরদার সঙ্গে দেখা করে এলো । পরে গৌরদার `আমাকে বলতে দাও' বইটি যখন বেরুলো, তিনি উত্সর্গ করলেন গৌরী আর আরতিকে - `আমার দুই সাহসিকা বন্ধু' - বলে ।

    আইয়ুব সাহেবের মৃত্যুর পর গৌরীর মা চলে এসেছিলেন তার কাছে । গৌরীর ভরসা ছিলো `পুনদেও' যে আইয়ুবের দেখাশুনো করতো । যে জামাতাকে জীবত্কালে গ্রহণ করেননি, তার মৃত্যুর পর তারই ঘরে বাস করছেন ভদ্রমহিলা এবং তাঁর সেবাপরায়ণা কন্যা কোনো অভিমান মনে না রেখে তাঁর সেবা করছে । বাড়িতে গোমাংস নিষিদ্ধ হয়ে গেছে দেখে একটু বিমর্ষ বোধ করেছিলাম আমি । আমার মনে হয়েছিলো আইয়ুবের বাড়ির আদবকায়দা তাঁর পছন্দমতোই রাখা উচিত । গৌরীকে বলেওছিলাম সেকথা । মৃদু হেসে সে জবাব দিয়েছিলো, `এই বয়সে মাকে আর কষ্ট দিয়ে কী হবে !'

    গত ন'বছর আমি কলকাতার বাইরে । যখন কলকাতা যেতাম, প্রতিবার গৌরীর সঙ্গে দেখা করা হয়ে উঠতো না । শেষবার দেখা হয়েছিলো তার মৃত্যুর কিছুদিন আগে, তখন সে একেবারেই শয্যাশায়ী । আমার সঙ্গে ছিলো সোমনাথ মেহ্তা (বাবার `মহাভারতের কথা'র হিন্দি অনুবাদক) । শেষের দিকে গৌরী কারু সঙ্গে দেখা করতে চাইতো না । আমি ফোন করে পুনদেওকে বিশেষভাবে অনুরোধ করে চলে গিয়েছিলাম । বিছানা থেকে তখন ওঠার ক্ষমতা নেই আর তার । তার চোখের দৃষ্টি দেখে বুঝে নিয়ে পুনদেও কফি নিয়ে এলো, আর গৌরীর নাতনি `অহনা'র জন্য লেখা বইটি । ঐ ঘরে আমাদের কতো না আনন্দের স্মৃতি । কলকাতা ছাড়ার আগে এক সন্ধ্যায় গৌরীর এই ঘরেই এসেছিলাম তার কিশোরী পরিচারিকা `মনা'র আইবুড়ো ভাতে । শাড়ি, রুপোর গয়না, বাসনকোসন কতো কী দিয়ে যে গৌরী তার বাক্স সাজিয়েছে । কিছু সে নিজে কিনেছে, কিছু তার বন্ধুরা উপহার দিয়েছে । মেয়েটি নতুন তাঁতের শাড়ি পরে জড়োসড়ো হয়ে এলো, লজ্জা ও আনন্দের আলোছায়া তার মুখে খেলা করতে লাগলো । গৌরীকে প্রথম ওখানেই, ওই ঘরেই দেখেছিলাম, তখন সেটা আইয়ুবের ঘর ছিলো । আইয়ুবের সামনে বসে ঐরকমই আনন্দের আভায় উজ্জ্বল তার মুখ । ঐ ঘরেই কমলারঙের টাঙাইল পরে বসে আমি গৌরীর দেওয়া `সাধ' খেয়েছি, পাশে সবাই পূষণকে বসালো যাতে ঐরকম চাঁদের মতো সন্তান হয় । পৃথিবীতে জানি কোনো কিছুর কোনো ব্যাখ্যা নেই, তবু গৌরীর শারীরিক যন্ত্রণা ও অকালমৃত্যুর মতো অর্থহীন আর কিছু ভেবে পাই না । নাকি সব মৃত্যুই তাই ? এক অর্থহীন, আপীলহীন চরম দণ্ডে সব প্রাণীই দণ্ডিত ?




    ছবিগুলি পূষণ আইয়ুব ও লুবনা মরিয়ম-এর সৌজন্যে ।


  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • কীভাবে লেখা পাঠাবেন তা জানতে এখানে ক্লিক করুন | "পরবাস"-এ প্রকাশিত রচনার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট রচনাকারের/রচনাকারদের। "পরবাস"-এ বেরোনো কোনো লেখার মধ্যে দিয়ে যে মত প্রকাশ করা হয়েছে তা লেখকের/লেখকদের নিজস্ব। তজ্জনিত কোন ক্ষয়ক্ষতির জন্য "পরবাস"-এর প্রকাশক ও সম্পাদকরা দায়ী নন। | Email: parabaas@parabaas.com | Sign up for Parabaas updates | © 1997-2022 Parabaas Inc. All rights reserved. | About Us