• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩১ | অক্টোবর ২০০৩ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • ৫ পার্ল রোড : মীনাক্ষী দত্ত



    একটি বইয়ের খবর শ্রী লিওনার্ড গর্ডন কৃত "ব্রাদার্স এগেনসট দি রাজ - এ বাইওগ্রফি অফ ইণ্ডিয়ন ন্যাশনলিস্টস শরৎ এণ্ড সুভাষ চন্দ্র বোস" বইখানার খবর আমাকে দিয়েছিলেন সিলভর স্প্রিঙ্গ নিবাসী আমার অগ্রজপ্রতিম শ্রী জগদীশ শর্মা । বইখানা পাড়ার লাইব্রেরিতে স্বভাবতই পেলাম না । তবে ওনারাই আবার খোঁজ করে রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের পুস্তকাগার থেকে আনিয়ে দিলেন । পাতা উল্টে প্রথমেই লক্ষ করলাম যে নেতাজী সুভাষ সম্বন্ধে বহু প্রয়োজনীয় কথা আমার জানা নেই । বই দীর্ঘ - দু-সপ্তাহের কর্ম নয় । আমাজনে অর্ডার দিলাম - নিউ ইয়র্ক য়ুংউনিভার্সিটি প্রেসের প্রকাশনা : হয়তো সেই কারণেই পেতে দেরি হতে লাগল । ইতোমধ্যে সমীর ভট্টাচার্য বইটার ভারতীয় সংস্করণ আনিয়ে দিলেন দেশের রূপা কোম্পানি থেকে ।

    লেখক ন্যু ইয়র্কের ব্রুকলিন কলেজের অধ্যাপক । কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিন এশিয়া গবেষণা কেন্দ্রের অধ্যক্ষ । বইটা লিখতে ওনার বহুদিন লেগেছিল, সে পরিচয় তিনি নিজে যদি বা ভুমিকাতে নাও দিতেন, কত লোকের সঙ্গে কথা বলতে হয়েছে, কত দেশে যেতে হয়েছে, সেই তালিকাটুকু পড়লেই আন্দাজ হবে । এ-বই জোড়াতালি দিয়ে লেখা নয় । গভীর শ্রদ্ধা নিয়ে লেখা । এ বাবদ বসু-পরিবারের সঙ্গে লেখকের ঘনিষ্ঠতা ঘটেছে । সেই নিয়ে দেশের যাঁরা সি.আই.এ. বিশারদ (এবং বসুপরিবারের কিছু পরশ্রীকাতর জ্ঞাতি) তাঁরা ওনাদের নামে কুত্সাও কিছু রটিয়েছেন, সে কাহিনীও পড়তে হোল কিছু এই বইতেই ।

    কিন্তু এহ বাহ্য । বইটি আমার যত্পরোনাস্তি ভালো লেগেছে বলে এত অবান্তর কথা এসে গেল । হয়তো আরো আসবে - এটা শুধু বইএর কথা নয় - কিছুটা আমারও কথা হয়তো ।

    বর্তমান যুগের বাঙালিরা নেতাজী সুভাষ সম্বন্ধে কতটুকু জানেন সে-খবর আমার জানা নেই । আমার নিজের জ্ঞান সীমিত । দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ভারতবর্ষের লোক আজাদ হিন্দ বাহিনীর কথা প্রথম ভালো করে জানতে পারে (যুদ্ধের সময়ে কিছু আজাদ হিন্দ কৃত বেতারবার্তা কেউ কেউ শুনেছিলেন নিশ্চয়, কিন্তু তাঁরা আমার পরিচিত ছিলেন না) । তখনকার উত্তেজনা ও গৌরববোধের কথাটাই মনে গাঁথা আছে (এই কাহিনীর রাজনৈতিক ফলের কথা এ-প্রবন্ধের শেষে আসবে - হয়তো একালের লোকেরাও জানেন : তবে এ কাহিনী লোকে জানুক, এটা বহু শক্তিশালী লোকের ইচ্ছা নয়) । এছাড়া এর আগে হরিপুরায যখন নেতাজীকে সর্বভারত কংগ্রেসের সভাপতি হিসাবে সম্বর্ধনা করা হোল এবং পরের বছর ত্রিপুরি কংগ্রেসে যখন নির্বাচিত সভাপতি হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে নানা কলে ফেলে সভাপতিত্ব থেকে পদত্যাগ করতে প্রায় বাধ্য করা হোল, সেই সময়ে আমার দাদার উত্তেজনার কথা আমার মনে আছে (আমার বয়স তখন দশ-এগারো বছর) । কবে তিনি নাকি প্রেসিড়েন্সি কলেজের কোনো ইংরেজ অধ্যাপককে চটিপেটা করেছিলেন, সে গুজবও কানে গেছিল (গর্ডন সাহেব ও-ঘটনাটা নিয়ে গবেষণা করেছেন এ-বইয়ে - কতটা গুজব ও কতটা সত্য সে মীমাংসা হয়নি - পরে সে-কথায় আসব) । নেতাজীর জীবন নিয়ে দুটি ভিডিও টেপও পাওয়া যায় । একটা "দি রেবেল অ্যাণ্ড দি রাজ" (কার তৈরি আর মনে নেই - বসুপরিবার এতে প্রচূর সাহায্য করেছিলেন, এটুকু জানা আছে) ও বি. বি. সি'র তৈরি "দি লীপিং টাইগার" । এ-দুটিতেও ওনার যুদ্ধকালীন কাজ ও আজাদ হিন্দ সরকার (আর্জী হুকুমৎ এ আজাদ হিন্দ) ও বাহিনীর কথাই বেশি । ওগুলো কী করে কোথায় পাওয়া যায় আমার জানা নেই - ক্লীভল্যাংআণ্ডের বন্ধু শ্রী মিহির দত্ত আমাকে কপি করে দিয়েছিলেন ।

    পীযূষ বসুর বাংলা সিনেমা, "সুভাষচন্দ্র" অধুনাকালে দেখেছি । চলচ্চিত্র হিসাবে তার উত্কর্ষ সম্বন্ধে মন্তব্য করার জায়গা এটা নয় । তবে এতে এমন কিছু নেই যা গর্ডন সাহেবের বইয়ের সঙ্গে মেলে না । তবে এমন অনেক কথা আছে যা গর্ডন সাহেবের বইয়ে নেই । সেগুলো হয়তো সুভাষচন্দ্রের আত্মজীবনী থেকে পাওয়া । সে আত্মজীবনী থেকে গর্ডন সাহেব অবশ্যই সব কিছু তোলেননি । দুএক জায়গায় (যেমন সুভাষের কলেজে ভর্তি হওয়ার ব্যাপারে আশুংউতোষ মুখোপাধ্যায়ের প্রভাব) চলচ্চিত্রে অত্যুক্তি হয়তো একটু আছে, কিন্তু সে ধর্তব্য নয় । সিনেমাটি যথার্থ । চলচ্চিত্রটিতে সুভাষচন্দ্রের বাল্যকাল থেকে আরম্ভ করে শেষ হয়েছে ওনার প্রথম গ্রেপ্তারি (১৯২১) পর্যন্ত ।

    কিন্তু এসব সত্ত্বেও ভারতের ও বাংলার রাজনৈতিক আকাশে নেতাজীর এবং শরৎ বাবুর ত্রক্রম-উথ্থান, কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র ও অল্ডরম্যান পদে তাঁঁদের কাজ ও আদর্শবাদের উথ্থান, এ সবই আমার অজানা রয়ে যেত যদি এ-বইখানি আমি না পড়তে পেতাম ।

    এ বই প্রধানত সুভাষচন্দ্র সম্বন্ধে - ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভুমিকায় । সেইসঙ্গে সেই সংগ্রামে শরত্চন্দ্রের দানের কথা আসেই - বসুপরিবারের ধারক ও সুভাষচন্দ্রের পোষক হিসাবে শুধু নয়, সংগ্রামের একজন নেতা হিসাবেও তাঁর দানের পরিচয় লেখক বিস্তৃতভাবে দিয়েছেন ।

    এ-প্রসঙ্গে একটা কথা আমার পক্ষ থেকে বলে নেয়া দরকার । স্বাধীনতা সংগ্রাম যেকালে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে, তখন ভারতের শাসক হিসাবে ইংরেজদের অন্যায়গুলোর কথাই এ আলোচনায় আগে আসবে । কিন্তু এই ইতিহাসে এটাও পদে পদে দেখা যাবে যে ভারতের স্থাথনীয় শাসন এবং সে-সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের ভার ইংরেজরা ভারতীয়দের হাতে যখনই পারে দেবার চেষ্টা করেছে । সেটার সঙ্গে নানা বাধ্য-বাধকতা জড়ান থাকত নি:সন্দেহে (লোকে বলত, "সর্বস্ব তোমার, চাবিকাঠিটি আমার") এবং এই আপাত-স্বাধীনতার পেছনে কতটা মত্লববাজি থাকত, সে বিতর্ক অবশ্যই করা যায় । তবে ভারতের সমাজব্যাবস্থার ইতিহাসে ইংরেজ শাসনকালের একটা মঙ্গলকর ছাপ যে আছে, এটা আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি । এ-প্রবন্ধ সে-সম্বন্ধে নয় - কাজেই ইংরেজ শাসনের খারাপ দিকটাই এখানে চোখে পড়বে । সেটা ভুল কিছু নয়, তবে নিরপেক্ষও নয় ।

    লেখক শুরু করেছেন বসুপরিবারের আদি নিবাস কোদালিয়া গ্রাম ও নেতাজীর পিতামহ হরনাথ বসুকে নিয়ে । বসুপরিবারের সঙ্গে কটক শহরের সম্পর্ক হরনাথ বসুর ছেলে দেবেন্দ্রনাথের মাধ্যমে - দেবেন্দ্রনাথ সরকারি শিক্ষা পরিষদের কর্মি হিসাবে কৃষ্ণনগর কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন, পরে কটকে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন । তাঁর ভাই জানকীনাথ কটকের রাভেনশ কলেজ থেকে পাশ করেন । জানØকীনাথের বিবাহ হয় হাটখোলার দত্ত পরিবারের প্রভাবতী দেবীর সঙ্গে । ইনি শরত্চন্দ্র ও সুভাষচন্দ্র বসুর পিতা ।

    হরনাথ বসুর সব ছেলেরাই (দেবেন্দ্রনাথ, জানকীনাথ, যদুনাথ ও কেদারনাথ) ইংরেজি শিক্ষিত এবং সবাই ইংরেজের অধীনে নানা কাজ করে প্রতিষ্ঠিত হন । ফলে ইংরেজ সরকারের কেন্দ্র কলকাতার সঙ্গে ঐ পরিবারের যোগ তখন থেকেই । জানকীনাথ মেট্রোপলিটন ইনসটিট্যুশন থেকে ওকালতি পাশ করে কটকে ওকালতি শুরু করেন । পরে সরকারি উকিলের পদ পান । কটকের ভারতীয় ও ইংরেজ সমাজে তাঁর প্রতিপত্তি ছিল । ইংরেজি সংস্কৃতির সঙ্গে বাংলার ঘনিষ্ঠতা এই সময়ের থেকেই শুরু । জানকীনাথ "সাহেব মানুষ" ছিলেন । ঘোর সাহেব নয় । কোদালিয়ার দেশের বাড়ির সঙ্গে তাঁর পুরো যোগ ছিল । দেশের লোকের সঙ্গেও ছিল । তখনকার ধনী সমাজের লোকেদের মতো তিনিও দানে ও পরোপকারে মুক্তহস্ত ছিলেন । কিন্তু ওঁদের বাড়ির সাহেবিয়ানা পরবর্তী প্রজন্ম পর্যন্ত চালু ছিল এবং এখনো আছে - কলকাতার উচ্চ-মধ্যবিত্ত লোকের সংস্কৃতির সঙ্গে ওটা এখন ওতপ্রোত হয়ে গেছে বলে আমার ধারণা (আমি নিজে এই সংস্কৃতির মধ্যেই মানুষ) । তখনকার ইংরেজিশিক্ষিত লোকের কাছে এটা স্পষ্ট ছিল যে ভারতের (বিশেষত বাংলার) তখনকার সংস্কারগুলো দেশের ক্ষতি করছে এবং ইংরেজের কাছে তাঁদের অনেক শেখার আছে । জানকীনাথ বাংলার আইনসভার সদস্য হিসাবে মনে করতেন যে ইংরেজি গণতান্ত্রিক প্রথায় দেশ শাসনের পথে ভারতের পদক্ষেপ শুরু হয়েছে । শরত্চন্দ্র বড় হয়ে এই পথেই চলেছিলেন শেষ পর্যন্ত - কিন্তু ইংরেজর পরোপকারিতার ওপর বিশ্বাস ও-পরিবার থেকে সরে গিয়েছিল জানকীনাথের পর থেকেই । হয়তো তার শুরু সুভষচন্দ্রকে দিয়েই ।

    কিন্তু সে-গল্প পরে । বইটার চুম্বক দিতে হলে আবার জানকীনাথে ফিরে যেতে হবে ।

    জানকীনাথের ছেলেমেয়েদের নাম প্রমীলা, সরলা, সতীশচন্দ্র, শরত্চন্দ্র, সুরেশচন্দ্র, সুধীরচন্দ্র, সুনীলচন্দ্র, তারাবালা, সুভাষচন্দ্র, মলিনা, প্রতিভা, কনকলতা, শৈলেশ, সন্তোষ । পরবর্তী একটি সন্তান শিশুকালে মারা যায় । আমাদের গল্পে অবশ্যই এঁদের সকলের স্থান সমান নয় । গর্ডন সাহেব বিদগ্ধতার খাতিরে পুরো তালিকা দিয়েছেন । তাছাড়া মা প্রভাবতী দেবী যে চোদ্দবছর বয়স থেকে সাঁইত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত তেইশ বছরে পনেরটি (গর্ডন সাহেব লিখেছেন চোদ্দ, কিন্তু আমার হিসাবে মিলছে না) সন্তান প্রসব করেছিলেন সেটা ওনার পাশ্চাত্য চোখে বোধহয় খুব বেশি পড়েছিল (অবশ্য পাশ্চাত্য দেশেও একশ বছর আগে এটা খুব বিস্ময়কর ছিল না - আজও মার্কিন ক্যাথলিক সমাজে কোনো বাড়িতে চোদ্দটি ছেলেমেয়ে খুব একটা বিস্ময়কর কথা নয়) ।

    আসল গল্প শরত্চন্দ্র ও সুভাষচন্দ্রকে নিয়ে । অন্যান্য দু-একজন ভাইএর কথা কখনো কখনো এসে পড়তে পারে - এখন তোলা থাক । শরত্চন্দ্র মেধা ও উত্সাহে দাদা সতীশচন্দ্রকে ছাড়িয়ে গেছিলেন খুব অল্প বয়সে । দু ভাইই প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র । দুই ছেলে কলকাতায়, জানকীনাথ নিজে আইন সভার সঙ্গে সম্পর্কিত । বসু পরিবারের ভারকেন্দ্র বিংশ শতকের গোড়া থেকেই কটক থেকে কলকাতায সরে আসতে লাগল । ১৯০৯ সালে সতীশ্চন্দ্র ও শরত্চন্দ্রের বিবাহের অল্প আগে ওঁদের এলগিন রোডের প্রথম বাড়ি তৈরি শেষ হয় ।

    শরত্চন্দ্রের স্ত্রীর নাম বিভাবতী । ১৯১০ সালে শরত্চন্দ্র বি.এল. পাস করেন দাদা সতীশচন্দ্রের এক বছর আগে । শরত্চন্দ্র কটকে ও সতীশচন্দ্র কলকাতায় ওকালতি শুরু করেন । বাবার সঙ্গে এক আদালতে কাজ করার সময় শরত্চন্দ্র ওখানকার ইংরেজ বিচারকদের সুনজরে পড়েন । তাঁরাই জানকীনাথকে বলেন ছেলেকে বিলাত পাঠিয়ে ওকালতি পড়াতে, এমন কথা চলিত আছে । জানকীনাথ বড় ছেলেকে ডিঙিয়ে মেজ ছেলেকে বিলাতে পাঠানোর এটা হয়তা কারণ । ১৯১২-সালে স্ত্রী ও সদ্যোজাত পুত্র অশোককে রেখে শরত্চন্দ্র বিলাত গেলেন । তার এক বছর পরে সুভাষচন্দ্র কটকের রাভেনশ কলেজিয়েট স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় স্থান নিয়ে পাশ করেন । ১৯১৩ সালে অগ্রজদের পদানুসরণ করে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন । ১৯১৪ সালে শরত্চন্দ্র বিলেত থেকে পাশ করে এসে কলকাতাতে ওকালতি শুরু করেন । ওনার জীবনের সঙ্গে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ও সুভাষচন্দ্রের জীবনের নানা সংযোগ গরডন সাহেব এ-বইতে প্রচূর আলোচনা করেছেন - আগেই বলেছি, বইটা ওনার সম্বন্ধেও ।

    সুভাষচন্দ্রের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য তার আগের থেকেই স্পষ্ট হয় । দাদারা বংশের প্রথামতো ইংরেজি শিক্ষার ও ইংরেজরাজের অধীনে কাজ করার দিকেই এগোচ্ছিলেন । কিন্তু বসু পরিবারের ভিত্তিগত শাক্ত ধর্ম ওঁদের মধ্যেও ছিল (শরত্চন্দ্রের গীতানুরাগের কথা পরে আসছে) । কিন্তু সুভাষ অল্প বয়স থেকে ধর্মানুরাগী হয়ে পড়েন ।

    রাভেনশ স্কুলে সুভাষচন্দ্র এসেছিলেন ১৯০৯ সালে - বারো বছর বয়সে । এর আগে সাহেব জানকীনাথের ছেলে পড়েছিলেন কটকের প্রটেস্ট্যান্ট য়োরোপিয়ান স্কুলে । ইংরেজি ভাষা থেকে ইংরেজি মতবাদে তখন তাঁর হাতেখড়ি । এদিকে বাড়ির হাওয়া দু-মিশালি । সকালে খাওয়া হয় মাটিতে, রাত্রে বাবা এলে টেবিলে । মা বাংলা ছাড়া বলেন না । বাড়িতে মহভারত রামায়ণ পড়াও হয় । সুভাষচন্দ্র বাংলা বলতেন, কিন্তু স্কুলের পথ্যের মধ্যে বাংলাও ছিল না, ভারতীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচায়ের কোনো পথও ছিল না । রাভেনশ স্কুলে এসে সব বদলে গেল । শিক্ষক বেণীমাধব দাসের আওতায় সুভাষচন্দ্র দেশের হাওয়া বেশি করে পেলেন । মাকে ভালবাসতেন - নিজের মধ্যে মাতৃধর্ম ছিল - বাড়িতে ফুলগাছের যত্ন নিতেন । বাবা ব্রাহ্মদের কথা বেশি ভাবেন, মা কালীভক্ত । সুভাষ ঝুঁকলেন মায়ের দিকে । রামকৃষ্ণের কথা জানলেন । বিবেকানন্দর মধ্যে ধর্ম আর সেবার সমন্বয় তাঁকে সেই ছোট বয়সেই টানল । দেশের কথা ভাবতে আরম্ভ করলেন । আনন্দমঠ পড়ে উদ্বুদ্ধ হলেন । স্কুলে মাষ্টারমশায়দের কাছে বেদ উপনিষদের খোঁজ পেলেন ।

    বইখানার দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পড়ে আমার ধারণা হয়েছে যে সুভষচন্দ্র যদি নেতাজী না হতেন, তাহলেও আমাদের জাতীয় জীবনের কোথাও না কোথাও তাঁর বৃহৎ দান থাকতো । স্কুলে থাকতেই বাড়িতে লুকিয়ে গ্রামে গিয়ে কলেরা রোগীর সেবা করে এসেছেন । একটা ছুটিতে বাড়ি পালিয়ে উত্তরভারত ঘুরে গুরু খুঁজেছেন (ওরকম গভীর চিন্তাশীল মন যার, তার পক্ষে তথাকথিত গুরু পাওয়া শক্ত - উনি পাননি)। ভারতীয় ও যুরোপীয় দর্শনশাস্ত্র পড়তে আরম্ভ করেছেন ।

    কিন্তু আনন্দমঠ পড়া জ্যান্ত ছেলের সুখে থাকার পথ সরল নয় । প্রেসিডেন্সি কলেজের সাহেব অধ্যাপকরা সবাই যে ভারতের ঐতিহ্যকে চিনতেন বা শ্রদ্ধা করতেন তা তো নয় - ইতিহাসের অধ্যাপক ওটেন সাহেব একদিন ক্লাসে বললেন যে গ্রীকরা যেমন পুরাকালে যে-সব অসভ্য জাতির সংস্পর্শে এসেছিল, তাদের গ্রীক সভ্যতার আলো দিয়েছিল, তেমনি ভারতীয়দের সভ্য করার ভার পড়েছে ইংরেজের ওপর । ছাত্রসমাজে এই নিয়ে যে বিক্ষোভ দেখা দিল, তার অন্যতম হোতা হলেন সুভাষচন্দ্র । তবে কলেজের সিঁড়িতে ওটেন সাহেবকে যাঁরা চটিপেটা করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে সুভাষ ছিলেন কিনা সে সম্বন্ধে সাক্ষাত প্রমাণ কিছু নেই (পরবর্তিকালে ওটেন সাহেব আত্মজীবনীতে নাকি লিখেছেন ব্যাপারটার সম্বন্ধে সব কথা তাঁর মনে নেই, তবে এতবড় একটা লোকের কাছে যদি মার খেয়ে থকতেন, তাহলে নিশ্চয় তিনি ভুলতেন না) । যাই হোক, উচক্কা ছাত্র হিসাবে আগেই নাম কিনে ফেলেছিলেন - এ-ব্যাপারে যাদের কলেজ থেকে ছাড়িয়ে দেয়া হোল, সুভাষ তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন । এটা ১৯১৬ সালের ঘটনা ।

    সুভাষের কাণ্ডকারখানা সম্বন্ধে মেজদার কিছু সহানুভূতি ছিল, বৌদি বিভাবতীর সমর্থন তো ছিলই, মা প্রভাবতীর সঙ্গেও সুভাষ চিরদিন পত্রালাপ করেছেন, নিজের মনের কথা জানিয়েছেন । তাঁরও মত ছিল ছেলে সহজে অন্যায় কিছু করবে না । জনকীনাথকে বোঝাবার ভার মেজো ছেলে (শরত্চন্দ্র) নিয়েছিলেন খুব সম্ভব ।

    সুভাষচন্দ্র কলকাতা ছাড়লেন কিছুদিনের জন্য । কিন্তু কটকেও ওনার চরিত্রের পরিচয় একই রকম রইল । কলেজে ভর্তি হওয়া ছেলেদের বাসস্থান পেতে অসুবিধা হয় দেখে বাবার কাছ থেকে ওনার একটা বাড়ি সেই কাজে ব্যবহার করার অনুমতি পেলেন । তথাকথিত অস্পৃশ্য বর্ণের ছাত্রের কলেজে ভর্তি হওয়া নিয়ে রাভেনশ কলেজের সঙ্গে তর্কে নামলেন এবং জিতলেন । আতুরের সেবার কাজ ঘাড়ে নিলেন । নৃতত্ববিদ নির্মল বসুর সঙ্গে আলাপ এই সময়ে ।

    এই করে দুবছর গেল । শরত্চন্দ্র ও জানকীনাথের ইংরেজ সমাজে প্রতিপত্তি ছিল । তাঁদের ও ভাইস-চ্যান্সেলর স্যার আশুতোষের যুগ্ম চেষ্টায় কলকাতার কলেজ কর্তৃপক্ষেরা শেষ অবধি সুভাষকে স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়বার অনুমতি দিলেন - প্রেসিডেন্সিতে পড়া আর সম্ভব হোল না । তাতে ক্ষতি খুব হোল না । কলেজের দার্শনিক সমিতিতে সুভাষ বস্তুতন্ত্রের সপক্ষে ও বিপক্ষে বক্তৃতা করে দুবারই প্রশংসা পেলেন ।

    এছাড়া আরো একটা কাজে ভিড়লেন যেটা ওনার পরবর্তি জীবনের আভাস দেয় । বিশ্বমহাযুদ্ধের শেষাংএংএশষি সময়ে ইংরেজ সরকার ভারতীয় ছাত্রদের জন্য প্রথম সামরিক শিক্ষার ব্যাবস্থা করেন । সুভাষ এতে যোগ দিলেন এবং সসন্মানে উত্তীর্ণ হলেন । বি. এ. পরীক্ষায় দর্শনশাস্ত্রে প্রথম শ্রেণীতে পাশ করলেন । এম. এ. তে ওনার ইচ্ছা ছিল পরীক্ষামূলক মনস্তত্বে পড়াশুনো করবেন । কিন্তু ওনার বাবা চাইলেন কৃতি ছেলে বিলেত গিয়ে আই. সি. এস.-এর পড়া করে পরীক্ষা দিয়ে আসুক ।

    বাবার সব কথা ঠেলার ইচ্ছা বা সাহস তখনকার দিনের কম ছেলেরই থাকত (সব সময়ে থাকা ভালোও নয়) । সুভাষচন্দ্র বিলেত গেলেন । সেখানেও ইংলণ্ডের ভারতীয় ছাত্রমহলে নেতৃত্বের স্থান নিলেন - ওঁদের নানা সুবিধার জন্য সরকারে দরবার করলেন (নেতৃত্ব ও বিদ্রোহ ওনার স্বভাবের মধ্যে ছিল) । এবং এসব করেও আই. সি. এস পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান নিয়ে পাশ করলেন । এর সঙ্গে সঙ্গে কেম্ব্রিজে ট্রাইপসের পড়া চলতে লাগল ।

    এইবার সুভাষের তৃতীয় বিদ্রোহ । ইংরেজ সরকারের অধীনে সসন্মানে মোটা মাইনের চাকরিতে তাঁর মন কোনোদিনই ছিল না । এবার ওটার মুখোমুখি দাঁড়াতে হোল । সে-সময়ের মানসিক দ্বন্দের পরিচয় ওনার দাদা, মা বন্ধু-বান্ধবদের কাছে লেখা চিঠিতে প্রচূর পাওয়া যায় । শেষ অবধি তিনি লর্ড মন্টেগুকে চিঠি দিয়ে অনুরোধ করলেন যে আই. সি. এস. এর জন্য পরবর্তী শিক্ষার্থীদের তালিকা থেকে ওনার নাম সরিয়ে দিতে ।

    দেশে সেই সময়ে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন কাজে নেমেছেন । সুভাষ তাঁর কাছে উপদেশ চাইলেন । তিনি ওনাকে উত্সাহ দিলেন কেম্ব্রিজের পরীক্ষার পর দেশে ফিরে আসতে ।

    এইখানে সুভাষচন্দ্রের জীবনের প্রথম পরিচ্ছেদের (এবং বইয়ের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের) সব দ্বন্দ্বের শেষ । পুরোপুরি দেশের কাজে নামলেন এখন থেকে । বাড়িতে ফিরে শরত্চন্দ্রের ও বিভাবতী দেবীর বাড়িতে স্থান নিলেন । শরত্চন্দ্র তখনো পর্যন্ত নিজের ব্যাবসাতেই যুক্ত ছিলেন । উন্নতি করেছিলেন । কার্সিয়ংএ বাড়ি তিনি এই সময়েই কেনেন এবং এলগিন রোডের দ্বিতীয় বাড়িও এই সময়ে তৈরি হয় । কিন্তু বাংলার অসহযোগ আন্দোলনে তাঁর সহানুভুতি ছিল । পরিবার প্রতিপালন ছাড়া অর্থ সংগ্রহের কোনো প্রয়োজন তিনি কোনোদিন দেখেননি । তদানীন্তন ধনী লোকেদের মতো পুরো সাহেবিয়ানাও তাঁর কোনোদিন ধাতস্থ হয়নি । পুরাকালের মতোই বাইরে ইংরেজি, বাড়িতে দেশি কায়দাই চলছিল । অর্থাৎ সুভাষচন্দ্রের পথে নামবার রাস্তা ততদিনে জানকীনাথ ও শরত্চন্দ্রের জন্যও তৈরি হয়ে ছিল ।

    সুভাষচন্দ্র বোম্বাইয়ে নেমে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে সর্বপ্রথমে দেখা করেন । ওনার প্রযুক্তির প্রথম ধাপে কীভাবে কাজ শুরু হবে এবং শেষে কাজের শেষ ধাপে কীভাবে ইংরেজ শাসন লুপ্ত হবে সে-সম্বন্ধে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করেন । ওনার সব উত্তর সুভাষের মন:পূত হয়নি । অহিংসা শুধু স্বাধীনতার পথে পাথেয়মাত্র নয়, পথটাই ভবিষ্যতের জন্য মস্ত আরব্ধ, একথা মানতে তাঁর দ্বিধা ছিল । ওনার মধ্যে শাক্ত ও বৈষ্ণব প্রভাব দুইই ছিল, কিন্তু কালীভক্তের বৈষ্ণবতা বোধহয় ঠিক চৈতন্য-মার্কা হতে পারে না । গীতার কৃষ্ণ প্রেমময় যতই হোন - কংসবধ তাঁর হাতেই হয়েছিল । সুভাষচন্দ্র জানতেন যে গায়ের জোর না দেখালে ইংরেজ যাবে না ।

    মহাত্মার সঙ্গে এই মতদ্বৈধ ওনার একার নয় । এটা বোঝাবার জন্য এবং সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের সৌহার্দের মূল দেখাতে গর্ডন সাহেব তৃতীয় পরিচ্ছেদের প্রথমে ভারতের জাগরণের ইতিহাসের চুম্বক দিয়েছেন ।

    স্মরণ রাখতে হবে যে উনবিংশ শতাব্দীর শেষাশেষি যখন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের স্থাপনা হয়, তখন সেটা ইংরেজি শিক্ষিত ভদ্রলোকেদের একটা আলোচনা সভা মাত্র ছিল । ইংরেজ সরকার নিজের থেকে যেটুকু স্বায়ত্ব-শাসন ক্ষমতা দিয়েছে সেটুকু ভাঙিয়ে কতটুকু সুবিধা করে নেয়া যায় বা দেশের লোকের কতটা সুবিধা করা যায়, কল্পনা তার বেশি তখন যায়নি (শ্রী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মশায়ের "প্রথম আলো"তে এই সময়টার আলোচনা আছে - রবীন্দ্রনাথের, "আমায় বোলো না গাহিতে" গানটির সঙ্গে এই ইতিহাসের একটা সম্বন্ধ আছে বলে অধুনা জেনেছি)। মনে থাকতে পারে যে জানকীনাথ নিজে ইংরেজের আইনমণ্ডলিতে ছিলেন এবং কাজ করেছেন । স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা তখনো ওঠেনি । তবে ১৯০৫ সালে ইংরেজ সরকার যখন বাংলা প্রদেশকে দুভাগে ভাঙবার ব্যাবস্থা করলেন, সেই সময়ের জাগরণ ইংরেজের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহের রূপ নেয় (ইংরেজের এই সিদ্ধান্তর মূলে কী ছিল সে আলোচনা পরে করার প্রয়োজন হবে) । বাংলায় সশস্ত্র বিপ্লব সেইসময়ে শুরু এবং দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের নাম তখন থেকেই ভারতের সংগ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে যায় । ঐ সময়ে ইংরেজ সরকার অরবিন্দ ঘোষের (বিপ্লবী বারীণ ঘোষের ভাই, পরবর্তিকালে পণ্ডিচেরির শ্রীঅরবিন্দ) বিরুদ্ধে যে মামলা আনে, সেখানে অরবিন্দের পক্ষে সরকারের বিরুদ্ধে ওকালতি চিত্তরঞ্জন করেন । উকিল হিসাবে সুপ্রতিষ্ঠিত তিনি আগেই ছিলেন । এখন থেকে বিপ্লবীদের প্রতি সহানুভুতি এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ যোগের শুরু ।

    ভারতের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গান্ধীজির প্রবেশ ১৯১৫ সালে । ভারতে গণজাগরণ ও ভারতের স্বাধীনতার কল্পনা কংগ্রেসে সেইসময় থেকে চালু হয় । ১৯২০-সালের মধ্যে গান্ধীজির প্রভাব কংগ্রেসে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় : প্রাদেশিক শাখার সংখ্যা অনেক বাড়ে । তবে এটাও স্বীকার্য যে কংগ্রেসের কাজের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ যেখানে অপরিহার্য, সেকালে এমন কিছু করা গান্ধীজির পক্ষে সম্ভব ছিল না যাতে ধনী লোকেদের তিনি উষ্মাভাজন হন । কাজেই কুলি-মজুরদের নেতৃত্ব থেকে কংগ্রেসকে দূরে থাকতে হয়েছিল । আমাদের গল্পে এর প্রভাব পড়বে কিছু পরে ।

    দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের সহানুভুতি যদিও সশস্ত্র-সংগ্রামের পক্ষে যথেষ্ট ছিল কিন্তু গান্ধীজির গণজাগরণ-প্রচেষ্টায় তিনি সম্পূর্ণরূপে যোগ দেন ; বাংলার কংগ্রেসের নেতৃত্ব তাঁর ওপরে স্বভাবত বর্তায় - বাগ্মিতায়, কর্ম-কুশলতায়, আদর্শবাদে উনি মহাত্মাজির সমকক্ষ ছিলেন) । ওনার এটা দৃঢ় ধারণা ছিল যে স্বাধীনতার সঙ্গে পূর্ণ গণতন্ত্রের সম্বন্ধ অঙ্গাঙ্গী । প্রথম থেকেই তিনি গণজাগরণের পথে গেছিলেন । এবং এটা তিনি দেখতে পান যে বাংলার চাষিদের দলে পেতে হলে তাঁকে অনেকটা মন দিতে হবে বাংলার মুসলমান চাষিদের দিকে, কারণ বাংলার দরিদ্র চাষিদের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি । হিন্দু-মুসলমানের একতা কংগ্রেসের আদর্শের মধ্যে পড়ে - কাজেই এই ব্যাপারে উনি কংগ্রেসের পূর্ণ সমর্থন পান ।

    বাংলার মুসলমানের ইতিহাস সহজ নয় । পূর্ব বাংলার চাষিরা মুসলমান - জমিদারেরা হিন্দু । বাংলার নেতাদের মধ্যে অনেকেই উচ্চবর্ণের হিন্দু । উচ্চশ্রেণীর মুসলমান যাঁরা, তাঁরা নিজেদের বাঙালি না ভেবে আরব-তুর্কীদের উত্তরাধিকারী বলেই মনে করেন । উর্দু যারা বলে না, সে-মুসলমান তাঁদের সমাজে ব্রাত্য । কাজেই এ ব্যাপারে চিত্তরঞ্জনের কাজ কঠিন হতে বাধ্য ছিল । ভারতের ইতিহাসে এর প্রভাব দূরপ্রসারী, একথা আমরা আজ পুরোই উপলব্ধি করতে পারি - কিন্তু আমাদের গল্পের বর্তমানে এটুকু গৌণ রাখা যেতে পারে । পরে কিছুটা জানতে হবে নেতাজীর গল্পের অঙ্গ হিসাবে । শুধু এটুকু বলে রাখা ভালো যে বাংলার মুসলমানের সঙ্গে হিন্দুর একতার এই অভাবটাকে ইংরেজরা নিজেদের কাজে ভালোই লাগাতে পেরেছিলেন (এবং সেটাকে সমদর্শিতার উদাহরণ বলে নিজেদের পিঠ প্রচূর চাপড়েছিলেন - দোষ দেয়া যায় না) । এ-প্রসঙ্গে বাংলা বিভাগ এবং মুসলিম লীগের প্রথম প্রতিষ্ঠার কথা ওঠে ।

    বাংলা-বিভাগের কারণ হিসাবে ইংরেজ সরকার দেখিয়েছিলেন শাসনকার্যের সুবিধা : কিন্তু হিন্দু পশ্চিমবাংলা ও মুসলমান পূর্ববাংলাকে আলাদা করে দেয়ার ইচ্ছা এর পেছনে কিছুটা কাজ করেছিল, এ সন্দেহ করলে বোধহয় অবিচার হবে না । উর্দুভাষী মুসলমানদের হাতে বাঙালি মুসলমানদের নেতৃত্ব চলে গেল যখন ইংরেজ সরকার মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করলেন ।

    এসত্বেও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস হিন্দু-মুসলিম মৈত্রীর ব্যাপারে অগ্রণী হতে পেরেছিল প্রথম বিশ্বমহাযুদ্ধের সময়ে । তুর্কীর সঙ্গে ইংরেজের যুদ্ধ বহু মুসলমানের চোখে ধর্মযুদ্ধের রূপ নিয়েছিল । এই "খিলাফত্‌" আন্দোলনের সংগে ভারতের স্বাধীনতা প্রচেষ্টাকে এক করে কংগ্রেসের সঙ্গে খিলাফৎ নেতাদের চুক্তি বহুদিন স্থায়ী হয়েছিল । বাংলায় চিত্তরঞ্জনও কিছু মুসলমান কৃষক নেতাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করতে পেরেছিলেন । ফজলুল হক এঁদের মধ্যে নাম করা ।

    সুভাষচন্দ্র যখন দেশে ফিরলেন তখন বিশ্বমহাযুদ্ধ শেষ হয়েছে । ইংরেজেরা দেশের স্বাযত্ব-শাসনের অধিকার (যা জানকীনাথের সময়েও অল্পবিস্তর চালু হয়েছিল) বাড়িয়েছেন মন্টেগু সাহেবের শাসনসংস্কারের পরে । কিন্তু সেইসঙ্গে সন্ত্রাসবাদীদের দাবাবার নাম করে ভারতের স্বাধীনতা-কর্মীদের ধরপাকড়ও শুরু হয়েছে নতুন "রাওলট আইনের" আওতায় । এর প্রতিবাদে গান্ধীজির প্ররোচণায় অহিংস অসহযোগ শুরু হয়েছে । এই সুত্রে পাঞ্জাবের কুখ্যাত জলীয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড ও তার প্রতিশোধে সুদীর্ঘ বিশ বছর পরে ইংলণ্ডে জেনেরল ওডায়ারের হত্যার কথা হয়তো অনেকে শুনেছেন - এইসময়ে চিত্তরঞ্জন সুভাষচন্দ্রকে নিজের দলে নিলেন । তাঁর মত কর্মক্ষম ও উত্সাহী লোক পেয়ে দেশবন্ধুরও যেমন লাভ হোল, সুভাষচন্দ্রও একজন যথার্থ গুরু পেলেন । পরবর্তিকালে সুভাষচন্দ্রের মা বলতেন যে দেশবন্ধুর স্ত্রী বাসন্তী দেবীই যেন সুভাষচন্দ্রের মায়ের স্থান নিয়ে নিয়েছেন (সুভাষচন্দ্রের জীবনে মায়ের স্থান মস্ত ছিল, সে নিজের মাই হোন, মা কালীই হোন, দেশমাতৃকাই হোন, গুরুপত্নীই হোন - বহুদিন অবিবাহিত, ব্রহ্মচারী সুভাষচন্দ্রের প্রথম জীবনে মেয়েদের প্রভাব এইভাবেই পড়েছিল) ।

    দেশবন্ধু নবাগত সুভাষচন্দ্রকে বহু কাজের ভার দিলেন । তাঁর প্রতিষ্ঠিত "বাংলার কথা" পত্রিকার সম্পাদনা ভার পেলেন । "বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ"এর অধ্যক্ষর কাজ শুরু করলেন । স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর পরিচালনার ভার পেলেন ।

    ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ সংক্রান্ত অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে বহু ছাত্র ইংরেজের চালানো কলেজে পড়া ছেড়ে দিয়েছিল । ১৯১৯ থেকে যে অসহযোগ আন্দোলনের শুরু হয় মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে,, বাংলার নায়ক হিসাবে চিত্তরঞ্জন তার ভার নিয়েছিলেন । সেকালেও ইংরেজি কলেজ ছেড়ে ছাত্ররা অসহোযোগ আন্দোলনে যোগ দেয় । তাদের শিক্ষার ভার নেয় "ন্যাশনাল কলেজ" । সুভাষচন্দ্র যখন অধ্যক্ষ হলেন, তখন সে উত্তেজনায় ভাঁটা পড়ে এসেছে - ছাত্রসংখ্যা প্রায শূন্যের ঘরে । সুভাষচন্দ্র খালি বেঞ্চের সামনে পড়াতে বসে কলেজের আয়-ব্যায়ের হিসাব করতেন । "বাংলার কথা"র কাজ হোত । এইসঙ্গে স্বাধীনতা-আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত "আত্মশক্তি" ও ইংরেজি "ফরোয়ার্ড" কাগজের সঙ্গেও তিনি সংশ্লিষ্ট হয়ে গেছিলেন । বাংলার সন্ত্রাসবাদি ছেলেরা এই সময়ে চিত্তরঞ্জনের অনুরোধে নিজেদের কাজ বন্ধ রেখে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন । তাঁদের এবং অন্যান্য অসহযোগী ছেলেরা "বেঙ্গল ভলান্টিয়র"এ যারা ছিল, সুভাষ তাদের নেতা হিসাবে বিদেশি জিনিংএংএষর দোকানে হরতাল করতেন, স্কুল কলেজে ছাত্রদের, আদালতে উকিলদের ইংরেজের সঙ্গে সহযোগিতা ছাড়তে অনুরোধ করতেন দল বেঁধে । অক্লান্ত কর্মী হিসাবে ওঁর নাম ছড়িয়ে পড়েছিল কংগ্রেসের লোকেদের মাঝে ।

    ১৯২১-সালে কলকাতায় ইংলণ্ডের যুবরাজের আগমনের সময়ে যে হরতাল হয়, সেই ব্যাপারে জড়িত থাকার অপরাধে চিত্তরঞ্জন ও সুভাষ দুজনেই গ্রেপ্তার হন । ওঁদের আট মাস কারাদণ্ডের আদেশ হোল ।

    ওনাদের কারাবাসের পরের কাহিনী লিখতে হলে ভারতের রাজনৈতিক পরিবেশের কিছু পরিবর্তনের কথা বলতে হবে । ওনাদের জেলযাত্রার আগে থেকেই অসহযোগিতা আন্দোলনে ভাঙন ধরছিল । যে স্বাধীনতার আশ্বাস দিয়ে মহাত্মাজী আন্দোলনের শুরু করেছিলেন, তাঁর নিজের কাছে তার সংজ্ঞা ছিল রাজনৈতিক স্বাধীনতার চেয়ে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার দিকে বেশি ঘেঁষা । চরকা ও তাঁতের ব্যাবহার ঘরে ঘরে এনে ইংরেজি কাপড়ের ব্যাবসায়ের হাত থেকে দেশকে বাঁচান তার বড় উদ্দেশ্য ছিল - রাজনৈতিক স্বাধীনতার সঙ্গে তার সম্পর্কটা তিনি নিজেও বোধহয় পুরো যাচিয়ে দেখেননি । চিত্তরঞ্জন বা নেতাজী প্রমুখ লোকেদের আরব্ধ ছিল সারা দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাবধীনতা । কৃষাণদের দলে নেওয়ার চেষ্টা যে তাঁরা শুরু করেছিলেন, সে কথা আগে বলেছি । জমিদার গোষ্ঠি তাতে খুশি হননি । মহাত্মাজী নিজে মজুরদের জাগরণের দিকে মন দিলে টাকা তোলার অসুবিধা হোত - কাজেই তিনি এব্যাপার থেকে দূরে ছিলেন । তাঁর দলের অনেক লোক রাজনৈতিক স্বাধীনতা বলতে দেশের উচ্চস্তরের লোকেদের স্বাধীনতাই বুঝতেন । কিন্তু মহাযুদ্ধের পরে রাশিয়ার বিদ্রোহের খবর দেশে পৌঁছেছিল । একদল লোক স্বাধীনতার চেযে কৃষাণ-মজুরদের শক্তিবৃদ্ধিটাকেই বড় করে দেখতে আরম্ভ করেছিলেন । বাল্যবন্ধু হেমন্ত সরকারের থেকে সুভাষচন্দ্রের পথ এইসময়ে আলাদা হয়ে গেল । কিন্তু মজদুরদের সংগ্রামে সুভাষচন্দ্র তাঁর গুরু চিত্তরঞ্জনের মতো পুরো জড়িয়ে না পড়লেও তাঁর সহানুভুতি পুরো ছিল । নানা জায়গায় তাঁর নানা বক্তৃতায় তার প্রমাণ পাওয়া যায় ।

    ইংরেজ সরকার এই সময়ে অসহযোগ আন্দোলানের সঙ্গে আপোশ করবার জন্য গান্ধীজিকে বৈঠকে ডাকেন । মহাত্মাজি সে আমন্ত্রণ অগ্রারহ্য করেন । দেশবন্ধু তখন জেলে । এজন্য তিরস্কার করে তিনি মহাত্মাজিকে চিঠি লিখেছিলেন । এমনিতেই ওনার নেতৃত্বে বাংলায় যথেষ্ঠ খাদি উত্পন্ন হয়নি বলে কেন্দ্রীয় কংগ্রেসের সঙ্গে মনোমালিন্য হচ্ছিল, এই ব্যাপারের পরে বিভেদ আরো বেড়ে গেল । মন্টেগু-সংস্কারের ফল হিসাবে প্রাদেশিক আইনসভায় ভারতীয়দের প্রতিপত্তি বাড়ার কথা, কিন্তু গান্ধীজি সেখানেও অসহযোগ করলেন । কংগ্রেসের কিছু নেতা সে-কথা অমান্য করতে চাইলেন । জেল থেকে বেরিয়ে দেশবন্ধু ও সুভাষচন্দ্রও নতুন স্বায়ত্বশাসনে ভাগ নিতে বদ্ধপরিকর হলেন । আইনসভায় যোগদান করবার পক্ষে বাংলা কংগ্রেস রায় দিল, কিন্তু জাতীয় কংগ্রেস বাধা দিল (মহাত্মার কথার বিরুদ্ধে দাঁড়াবার ক্ষমতা জাতীয় কংগ্রেসে বহুদিন জন্মায়নি) । এর প্রতিবাদে দেশবন্ধু কংগ্রেসের সভাপতিত্ব ত্যাগ করলেন, তাঁর পুর্বতন "এক গেলাসের ইয়ার" মোতিলাল নহরূ (পণ্ডিত জবাহরলালের পিতা) সম্পাদকের কাজ ছেড়ে দিলেন । এইখান থেকে বাংলায় স্বরাজপার্টির জন্ম হোল । দেশবন্ধু বাংলা কংগ্রেসের সভাপতি রয়ে গেলেন ।

    প্রাদেশিক আইনসভায় তখন সভ্যসংখ্যা বেড়েছে । দেশবন্ধু বাংলার মুসলমান নেতাদের কথা দিলেন যে ওনার অধীনে যেসব চাকরি থাকবে (ক্রমশপ্রকাশ্য), তাতে মুসলমানেদের সমানুপাতিক সংখ্যা নেবার চেষ্টা করা হবে । হিন্দু ক্ষমতাশালী লোকেরা প্রতিবাদ করলেন, কিন্তু এব্যাপারে দেশবন্ধু গান্ধীজির আশীর্বাদ পেলেন । সুরবর্দি প্রমুখ মুসলমান নেতাদের সাহায্যে স্বরাজপার্টির আইনসভায় ঢোকার পথ পরিষ্কার হোল ।

    আইনসভায় ওঁরা ইংরেজদের আনা নানা আইনের বিরোধিতা করলেন - কখনো জিতলেন, কখনো জিতলেন না । একটা ব্যাপারে সুবিধা পেলেন । ইংরেজরা কলকাতা কর্পোরেশনে ভারতীয়দের প্রভাব বাড়াতে দিতে তৈরিই ছিল, ওঁরা সেটাকে বেশ পোক্ত করে নিলেন । নির্বাচন সম্ভব হোল । নির্বাচনে দেশবন্ধু মেয়রের পদ পেলেন । শরত্চন্দ্র অল্ডারম্যান নির্বাচিত হলেন । রাজনীতির ক্ষেত্রে এই শরত্চন্দ্রের প্রথম সরাসরি পদক্ষেপ ।

    কর্পোরশনের "চীফ এক্সেক্যুটিভ অফিসর" হিসাবে নানা লোকের কথা ভাবার পরে দেশবন্ধু চাইলেন সুভাষচন্দ্রকে । সুভাষ প্রথমে আপত্তি করেছিলেন, "আই সি এসের কাজ ছেড়ে দিলাম কি কর্পোরশনের চাকরির জন্য ?" কিন্তু দেশবন্ধু ওনাকে বোঝালেন যে এ কাজও দেশসেবার অঙ্গ । উনি তাঁর স্বাভাবিক কর্মকুশলতার সঙ্গে কাজে নেমে পড়লেন । কর্মসূচি যা নেয়া হোল, তা বর্তমানকালেও পুরো শেষ হয়ে ওঠেনি - কিন্তু সে যুগে লোকে ওগুলোও কল্পনা করতে পারত না ।

    স্বাধীনতা সংগ্রামে সুভাষচন্দ্র কোনোদিনই সন্ত্রাসবাদের পথ ধরেননি - পথটাকে উনি উচিত বলে দেখেননি - কিন্তু সন্ত্রাসবাদীদের দেশভক্তি ও বীরত্বকে চিরদিনই প্রকাশ্যে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন । ওনার মত এসময়ে ছিল মোটামুটি এইরকম : দেশকে অস্ত্রবলে ছাড়া স্বাধীন করা কঠিন, কিন্তু দেশের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে সেটা সম্ভব নয় - দেশও দুর্বল, গান্ধীজীও বাদ সাধবেন । আর স্বাধীনতা জনগণের জাগরণ ভিন্ন অর্থহীন, কিন্তু সেটাও বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে পুরো হয়নি । কাজেই জনসেবা, জনজাগরণের সঙ্গে সঙ্গে স্বরাজপার্টিতে ও কর্পোরেশনে কাজ করাই তিনি উচিৎ বলে মনে করেছিলেন ।

    ইংরেজ কিন্তু ওনাকে অন্য চোখে দেখেছে সবসময়ে । উনি সন্ত্রাসবাদীদের শ্রদ্ধা করেন । অতীব কর্মঠ লোক - যা করেন অন্ত করে ছাড়েন (সামরিক শিক্ষায় পর্যন্ত) । তাছাড়া জেল থেকে ছাড়া পাওয়া সন্ত্রাসবাদীদের সাহায্য করতে কর্পোরেশনে প্রচূর চাকরিও দেওয়া হচ্ছিল মুসলমানদের ছাড়াও । কাজেই ওটুকু সন্দেহের ওপর ভিত্তি করে ১৯২৪ সালে তারা আবার ওনাকে গ্রেপ্তার করল । ভারতরক্ষা আইনে ব্যক্তিস্বাধীনতার স্থান বিশেষ ছিল না (বর্তমান ভারতীয় ও মার্কিন আইন যাঁরা নিজের চোখে দেখেছেন - এবং যেটা রক্ষা করতে এদেশে সিভিল লিবরটি যুনিঅন খরদৃষ্টি রেখে থাকে - তাঁরা স্বাধীন ও পরাধীন দেশের পার্থক্যটা দেখতে পাবেন । যে-দেশে এই ব্যক্তিস্বাধীনতা নেই, সে-দেশ বিদেশিদের শাসনে না থাকলেও সে-দেশকে আমি অন্তত স্বাধীন বলব না - সেরকম দেশ দুনিয়ায় প্রচূর আছে) । মোট কথা, যাঁরা ওনাকে প্রমাণের অভাববশত খালাশ করার চেষ্টা করলেন, তাঁরা সফল হলেন না । এক বছরের মধ্যে কলকাতা থেকে ওনাকে মান্দালয়ে সরিয়ে ফেলা হোল ।

    কলকাতার জেলে থাকা কালে কর্পোরেশনের কাগজপত্র দেখার কাজ ওনাকে জেলে বসে করবার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু মান্দালয়ে চালান হওয়ার পরে সে কাজ তিনি স্বভাবতই করতে পারেননি ।

    এবারে নেতাজী জেলে রইলেন তিন বছর । বর্মায় থাকার কালে নানা চিঠি ও প্রবন্ধে নিজের চিন্তা ও মত প্রকাশ করেছেন, তাতে তাঁর চিন্তার বিকাশ দেখা যাবে । গর্ডন সাহেব নানা উদ্ধৃতি দিয়ে তার আলোচনা করেছেন । এই সব চিঠি বাড়িতে মেজদা (শরত্চন্দ্র), বৌদি (বিভাবত)ংই, গুরুপত্নী (বাসন্তীদেবী)কে লেখা । এর চর্বিতচর্বণ না করে এই সময়ের গুটি কয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কথা বলে এ পরিচ্ছদে দাঁড়ি টানব ।

    মান্দালয়ের জেলখানা খুব স্বাস্থকর জায়গা ছিল না । দেওয়াল ছাদ কাঠের বেড়া দিয়ে তৈরি । শীতাতপ নিবারণ সেখানে ভালো হোত না । বৃষ্টির ছাঁটও আসত । সুভাষচন্দ্রের স্বাস্য্থ ভাঙতে শুরু করল । প্রথমটা কষ্ট হয়নি খুব । জেলজীবনের বিরক্তি আটাকাতে খেলাধুলোর ব্যাবস্থা করলেন তাঁর স্বভাবসিদ্ধ নেতৃত্বের সঙ্গে । জেলের কর্তৃপক্ষের কাছে দুর্গাপুজা করার অনুমতি পেলেন শুধু নয়, কর্তৃপক্ষ এতে আর্থিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতিও দিলেন । বাঙালির ছেলেরা কদিন মনে প্রাণে বাঙালি হবার আনন্দ পেল । কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিবাদ বাধল - টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিটা তাঁরা রাখলেন না । এর প্রতিবাদে সুভাষচন্দ্র একটা গান্ধী-মার্কা পথ নিলেন : অনশন শুরু করলেন (এই সম্বন্ধে পরবর্তী কালে তিনি গান্ধীর নাম করেননি কেন আমরা জানি না) ।

    জেলখানার কর্তৃপক্ষ খবরটা চেপে যাবার চেষ্টা করেছিলেন প্রথমে । সে চেষ্টা সফল কেন হোল না, গর্ডন সাহেব সেকথা স্পষ্ট করে লেখেননি । কিন্তু খবরটা বেরিয়ে গেল এবং ছড়িয়ে গেল । কাগজে তাঁর স্বাস্থ্য সম্বন্ধে দৈনিক বুলেটিন বেরোতে শুরু করল । সরকার আপোশ করতে বাধ্য হোল । ধর্মকার্যের পোষকতায় মান্দালয়ের প্রতি কয়েদি বছরে ৩০ টাকা বাড়তি ভাতা পেলেন ।

    কর্পোরশনের অল্ডরম্যানের পদে শরত্চন্দ্রের বার বার সেখানকার ইংরেজ সভ্যদের সঙ্গে মতদ্বৈধ হচ্ছিল - শান্তিময় পথে ভারতের মঙ্গল করার সম্বন্ধে ওনার মত হয়ত সেই সময় থেকেই বদলাতে শুরু করল - স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে সেইখানে ওনার পদক্ষেপ । ছোটভাইয়ের মত মতো তিনি স্বাধীনতার প্রয়োজনের দিকে উত্তরোত্তর ঝুঁকতে লাগলেন ।

    ১৯২৫-এ দেশবন্ধুর মৃত্যু হোল - উনি অনেকদিন থেকেই অসুস্থ ছিলেন, তারই ফাঁকে ফাঁকে কাজ করে যাচ্‌ংইছলেন । কিন্তু ওনার তিরোধানের আগে থেকেই ওনার কষ্টে রচিত হিন্দু-মুসলিম ঐক্যে ফাট ধরতে শুরু করেছিল । এবার সেটা দাঙ্গার রূপ যখন ধরল, বাধা দেবার মত ক্ষমতা কারো রইল না । কলকাতার ডেপুটি মেয়র সহীদ সুরাবর্দি এ-দাঙ্গার প্ররোচক ছিলেন বলে অভিযোগ হোল । উনি কর্পোরেশন থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন (১৯৪৭এর "ক্যালকাটা কিলিং" এর কথা যাঁরা জানেন, তাঁরা সুরবর্দির পরিচয় কিছু মনে রেখেছেন হয়ত) । ফজলুল হকের সঙ্গে বিভেদ হয় আরো পরে, অনেক বেশি সঙ্গত কারণে, এখন সেটা গৌণ থাক । কিন্তু এইসময়ে শরত্চন্দ্র গ্রামে গ্রামে গিয়ে শান্তি-স্থাপনের চেষ্টা করলেন । আইনের কাজের সঙ্গে প্রত্যক্ষ দেশের কাজ জুটল ।

    ১৯২৬-এ শরত্চন্দ্র বাংলার আইনসভার জন্য দাঁড়ালেন এবং জেলে থাকা অবস্থাতেই ভাইকেও দাঁড়াতে প্ররোচিত করলেন । দুজনেই নির্বাচনে জিতে আইনসভার সভ্য হলেন ।

    মান্দালয়ের জেলে সুভাষচন্দ্রের অসুস্থতাটা শুরু হয়েছিল বদহজম আর সর্দিজ্বরের রূপে - কিন্তু সেটার বাড়াবাড়ি হতে লাগল, দুর্বলতা বাড়তে লাগল । ওনাকে আর জেলে রাখার বিপদটা সরকার উপলব্ধি করলেন - নরহত্যার (বিশেষ করে শ্রদ্ধেয় দেশনেতার) বদনামটা ওঁরা নেন কী করে । সুভাষকে বলা হোল যে উনি যদি দেশ ছেড়ে সুইটজরল্যাণ্ড গিয়ে স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন, তাহলে ওনাকে ছেড়ে দেওয়া হবে । উনি রাজি হলেন না । সরকার যেসব কার্যকলাপের সন্দেহে তাঁকে ধরেছিল, তা যখন প্রমাণ হয়নি, তখন তিনি বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে দূর দেশে যাবেন কেন ?

    সরকার বলল যে আলমোড়ায যক্ষারোগগ্রস্ত বন্দীদের জন্য যে হাসপাতাল আছে, সেখানে তাঁকে বদলি করা হবে । জাহাজ চড়লেন, কিন্তু কলকাতা পৌঁছবার পরে কেন সরকার মত বদলে তাঁকে সরাসরি ছেড়ে দিল সেটা স্পষ্ট নয় । এটা ১৯২৭ সালের কথা ।

    দেশে ফিরে সুভাষচন্দ্র মেজদার বাড়িতে উঠলেন । তখন ওনার নিজের রোজগার কিছু ছিল না । আদালতে শরত্চন্দ্র ভালো রোজগার করছিলেন; জানকীনাথের প্রতিষ্ঠিত বাড়ি; আটকাল না কোথাও । দুভাই আইনসভায় স্বরাজপার্টির প্রতিভুরূপে কাজ করে গেলেন; সরকারের সঙ্গে নানা ব্যাপারেই দ্বন্দ্ব লাগল । সরকার মন্ত্রী নিয়োগ করলেন নিজের ইচ্ছামতো, তাঁরা বেতন পেতে লাগলেন সরকারি তহবিল থেকে । স্বরাজপার্টির লোক ও তাঁদের প্রতি সহানুভুতিসম্পন্ন দলের লোকেরা প্রতিবাদ করল - গণতন্ত্রমতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে মন্ত্রী নির্বাচনের কথা হওয়া উচিত্‌, না হলে মন্ত্রীরা সরকারের ধামাধরা হতে বাধ্য ; যদিও মন্ত্রীদের মধ্যে বসুপরিবারের কিছু আত্মীয়রাও ছিলেন । ইত্যাকার নানা দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে আইনসভার কাজ চলতে লাগল । সুভাষ শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃত্ব নিলেন নানা জায়গায় । কোথাও জিতলেন, কোথাও মালিকদের সঙ্গে তাঁদের চুক্তি শ্রমিকদের মন:পূত হোল না । তাছাড়া কংগ্রেস কোনোদিনই শ্রমিক আন্দোলনে ভাগ নিতে চায়নি - তাঁদের মত ছিল যে দেশের স্বাধীনতায় দুই পক্ষেরই লাভ, কাজেই এই দুই দলের হাত মিলিয়ে কাজ করা উচিৎ । রাশিয়ার বিদ্রোহের পর দেশে কম্যুনিষ্ট দল তখন শক্তি সংহত করছে । তাদের মত হোল যে শ্রমিক-মালিকের দ্বন্দ্ব চিরন্তন - সেখানে আপোষ চলে না, ("আমাদের দাবি মানতে হবে") ।

    কৃষকদের নানা অধিকার নিয়েও কংগ্রেসে ও আইনসভায় নানা মতানৈক্য দেখা দিল । বাংলায় এ-দ্বন্দ্ব্ব প্রায় হিন্দু-মুসলমানের দ্বন্দ্ব হয়ে দাঁড়ায় । কৃষকদের অধিকারের ব্যাপারে কংগ্রেস যথেষ্ট মন দিচ্ছে না, কৃষকদের নেতা হিসাবে এটা ফজলুল হককে বিরূপ করে তুলল । এটাকে ওনার মুসলমান সাম্প্রাদিকতা বলে মনে করা উচিৎ হবে না - কিন্তু ফলটা প্রায় তাই দাঁড়াল ।

    সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব্বের আরেকটা চেহারা দেখা দিল যখন জওহারলাল নেহরুর নেতৃত্বে ভারতের শাসনবিধির খসড়া তৈরি করার কাজ শুরু হোল । মুসলমানেদের জন্য আইনসভায় ইংরেজি কায়দায় আলাদা আসন থাকবে অথবা সাধারণ নির্বাচনে মুসলমান সংখ্যা-গরিষ্ঠ অঞ্চলে স্বাভাবিকভাবেই মুসলমন সভ্য আসবেন, এখানেও বিরোধিতা হোল ।

    কংগ্রেসের মধ্যেও তখন স্বাধীনতা নিয়ে মতৈক্য আসেনি : জওহরলাল, সুভাষ-প্রমুখ লোকেরা বলছেন পূর্ণ স্বরাজের দাবিতে কাজ হোক, গান্ধীপন্থীরা বলছেন, আস্তে আস্তে অধিকার বাড়ান হোক । এর মধ্যে গান্ধীজী লবন আন্দোলনের কাজ শুরু করলেন । সবাই তার সমর্থনে দেশে অসহযোগ আন্দোলন গড়লেন - বাংলায় তার অন্যথা হোল না । গান্ধী-আরুইন চুক্তিতে তার পরিণতি । সেটা সকলের মনে ধরল না । সন্ত্রাসবাদী যারা দেশবন্ধুর কথায় নিজেদের কাজ স্থগিত রেখেছিল, তারা আবার কাজ শুরু করল । বেশ কিছু ইংরেজ রাজকর্মচারী খুন হলেন । চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুঠ হোল । চট্টগ্রামে কদিনের জন্য সূর্য সেনের অধীনে স্বাধীন সরকার বসল । স্বভাবতই সেটা ক্ষণস্থায়ী হোল । কেউ কেউ পুলিশের সঙ্গে যুদ্ধে প্রাণ দিলেন, কেউ ধরা পড়ে ফাঁসি গেলেন । কিন্তু এই নিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে সুভাষের দলের একটা ভেদ সরকার দেখতে পেল । গান্ধীজীর দল সরাসরি বলল এরা অন্যায় করছে । সুভাষ, শরত্চন্দ্রের মত লোকের বললেন যে সন্ত্রাসবাদের পথ তাঁরা গ্রহণ করবেন না, কারণ অসহযোগের পথ বর্তমানে প্রকৃষ্ট পথ । কিন্তু সন্ত্রাসবাদীদের আত্মত্যাগ, বীরত্ব ও আদর্শবাদকে তাঁরা শ্রদ্ধা করেন । পরের বছর লাহোর ষড়যন্ত্রের অপরাধে যখন ভগত সিংহের ফাঁসি হয় তখন পাঞ্জাবে গিয়ে তিনি বলেছিলেন যে শিখ সম্প্রদায় যদি একশ জন ভগত সিংহের মতো আত্মত্যাগী দেশকে দিতে পারে, তবে ভারতের স্বাধীনতা অনেক এগিয়ে আসবে ।

    খানিকটা এই কারণে, খানিকটা কেন্দ্রীয় কংগ্রেসে গান্ধী ও নেহরু-সুভাষ প্রমুখ যুবক দলের সংঘাতের ছায়া হিসাবে, বাংলার প্রাদেশিক কংগ্রেসেও দলাদলি শুরু হোল । দেশবন্ধুর মৃত্যুর পরে (সুভাষ তখন মান্দালয়ে) যতীন্দ্রমোহন সেন বাংলার নেতৃত্বভার নেন, মহাত্মাজীর তাতে আশির্বাদ ছিল । যতীন্দ্রমোহন আত্মত্যাগী সমাজসেবি ছিলেন, সুভাষচন্দ্রের দলের লোকের অনেক সময়েই তাঁর কাজে সাহায্য করেছেন - তিনি ও সুভাষ একসঙ্গে জেলও খেটেছেন । কিন্তু নেতৃত্বের অধিকার নিয়ে ও দুই দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব থেকেই গিয়েছিল । সেই কারণে কেন্দ্রীয় কংগ্রেসেও সুভাষচন্দ্রের মতামত জোর পাচ্ছিল না ।

    সুভাষ তবুও কংগ্রেসের কাজে অক্লান্ত কর্মী ছিলেন । ১৯২৮-সালের কলকাতা কংগ্রেসের অধিবেশনের সময়ে সুভাষ যে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সৃষ্টি করেছিলেন, তার চেহারাখানা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল । ব্যাপারটা হয়েছিল পুরো জঙ্গি কায়দায় । পোষাক তৈরি করান হয়েছিল বিলেতি জঙ্গি পোষাকের দোকান থেকে । কুচকাওয়াজ পুরো জঙ্গি মতে হোত । এখানে সুভাষচন্দ্রের পূর্ববর্তী জঙ্গি শিক্ষা কাজে লেগেছিল । ব্যাপারটা সবার চোখে ভালো অবশ্যই লাগেনি । ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের স্বরূপ সম্বন্ধে তাঁর ও গান্ধীজীর মতবিরোধটা যেন এখানে চোখে আঙুল দিয়ে দেখান হয়ে গেল (গান্ধিজী স্বয়ং জিনিষটাকে বলেছিলেন "সার্কাস") । ইংরেজরাও লক্ষ করেছিল ব্যাপারটা ।

    ১৯২৯ সালে যতীন্দ্র সেনগুপ্ত, সুভাষ এবং আরো কযেকজনকে রাজদ্রোহিতার অপরাধে গ্রেপ্তার করা হোল । ১৯২৯এ কয়েকমাস সুভাষ জেলে রইলেন । যতীন্দ্রমোহনের শরীর অসুস্থ হচ্ছিল - ছাড়া পাবার পরেও ওনাকে কয়েক মাস চিকিত্সার জন্য অন্যত্র থাকাতে হোল । এই সময়ে শরত্চন্দ্র ঠিক করলেন যে আইনসভার ১৯২৯এর নির্বাচনে তিনি দাঁড়াবেননা । কর্পোরশনের এবং প্রাদেশিক কংগ্রেসের বহু কাজের ভার নিলেন ।

    এরপরে যতীন্দ্রনাথ আর কাজে ফিরতে পারলেননা । বিদেশ থেকে ফেরার পর তিনি বারবার আবার গেপ্তার হলেন । ১৯৩২ সালে রাঁচীর জেলে তাঁর মৃত্যু হয় । সুভাষ জেলে থাকাকালীন কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন - জেল থেকে বেরিয়ে তিনি সেই কাজের ভার নিলেন । এ ছাড়া যুবকদলের নেতা হিসাবে নানা জায়গায় সংগঠনের কাজে ঘুরতে হোল । মেয়েদের দেশের কাজে নামাবার জন্য সচেষ্ট হলেন - নানা জায়গায় মহিলা সমিতি স্থাপিত হোল ।

    ১৯৩১ সালে সরকারী নিয়মের বিরোধে মালদায় কংগ্রেসের কাজে যাওয়ার জন্য সাত দিনের জন্য জেলে যান । ১৯৩১এর স্বাধীনতা দিবসে সরকারী নিষেধ ভেঙ্গে মিছিল বার করতে গিয়ে তিনি গ্রেপ্তার হন অবার । পুলিশের হাতে নির্মম ভাবে মার খান - জেল তো হয়ই ।গান্ধী-আরুয়িন চুক্তির অংশ হিসাবে এর পরে তিনি ছাড়া পান । কিন্তু চুক্তির পরবর্তি বৈঠকে যাওয়া তাঁর হয়নি । পূর্ণ স্বাধীনতার কথা গান্ধীজি তুলতে রাজী হলেননা । তাছাড়া রাজনৈতিক বন্দীদের যারা ছাড়া পেয়েছিল, সন্ত্রাসবাদী বন্দীরা তার অন্তর্ভুক্ত হয়নি ।

    বিলেতের বৈঠক থেকে মহাত্মা প্রায় খালি হাতে ফিরলেন । কংগ্রেস আবার অসহযোগের কথা ভবতে আরম্ভ করল । ১৯৩২এর জানুয়ারী মাসে কংগ্রেসের র্‌Øযকরীকার্যকরী সমিতির সবাই গ্রেপ্তার হলেন । এবার দুই বসু ভাইরাও বাদ গেলেননা । বাংলার সন্ত্রাসবদী দের প্রতি তাঁদের সহানুভুতিকে সরকার কোনোদিনই ভালো চোখে দেখেনি । সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে তাঁদের প্রতক্ষ যোগ প্রমাণ করার দরকার হোলনা । শুধু সন্দেহের ওপর ভর করে লোককে জেলে দেওয়ার ক্ষমতা সরকারের আইনগত ভাবে থাকুক আর না থাকুক, তাদের বাধা দেওয়া সহজ হোলনা ।

    জানকীনাথ তখন অসুস্থ । বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে রোজগেরে ছেলে শরৎ যখন আর কাজ করতে পারলেননা তখন পরিবারের ভার পড়ল বড় ভাই সতীশচন্দ্রের ওপর - একলা সে কাজের ক্ষমতা তাঁর ছিলনা । সম্পত্তি-আদির ওপর যা বাড়তি, দু ভাইয়ের কিছু গুণগ্রাহী ধনী বন্ধু সে ভার বহন করলেন । ম্যুনিখে অশোকচন্দ্রকে চিঠি লিখে জানান হোল যে সে যেন মন দিয়ে পড়াশোনা করে যায় - খরচের ব্যবস্থা হয়ে যাবে ।

    ওনাদের প্রথমে তোলা হোল মধ্যপ্রদেশের ছোট এক কারাগারে । মান্দালয়ের মতোই - ঘরে দরজা-জনালা নেই, শীতাতপ নিবারণ হয়না । সুভাষচন্দ্রের পুরোন অসুখ আবার চাড়া দিল । শরত্চন্দ্রের ডায়াবেটিস ছিল, এই অত্যাচারে সেটার উপসর্গ দেখা দিল । সরকার জব্বল্পুরে দুজনকে এনে ডাক্তার দেখালেন । শরৎ সেখানেই রয়ে গেলেন । সুভাষের শরীরের জন্য আর দায়ীত্ব নেওয়া সরকার উচিৎ বোধ করলনা । বলা হোল উনি যদি দেশ ছেড়ে য়োরোপে গিয়ে থাকতে রাজী হন তো তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হবে । ইংলণ্ডে যাবার অনুমতি দেওয়া হোলনা (ওনার ব্রিটিশ পাসপোর্ট ছিল - বোধহয় ওনাকে আটকতে ওরা পারতনা, কিন্তু উনি ব্যাপারটা এড়িয়ে গেলেন ) । বিদেশে যাবার খরচ সরকার বহন করলনা - ওনাদের নিজে ব্যাবস্থা করতে হোল । দেশ ছাড়বার আগে কলকাতাতেও যেতে দেওয়া হোলনা । বোম্বাইয়ে গিয়ে বৌদি দেখা করে এলেন । ম্যুনিখে ভাইপো অশোক ছিলেন । কাকা উঠলেন ভিয়েনাতে । মাঝে মাঝে অশোকের সঙ্গে দেখা হতে লাগল ।

    শরত্চন্দ্র জব্বল্পুরেই রয়ে গেলেন প্রথমে । সরকারের নানা স্তরে চিঠি দিতে থাকলেন । প্রায় ওকালতির ব্রীফ: ওনার বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো কল্পনা করা যায়, সেগুলোর বিরুদ্ধে তর্ক তুললেন (অভিযোগ কিছু সরকারী ভাবে আনা হয়নি)। প্রথমে কোনো উত্তর পেলেননা । শেষটা উনি বাংলার ছোটলাটেক চিঠি দিলেন । এবার কাজ এইটুকু হোল যে ওনাকে কার্সিয়ংএ নিজের বাড়িতে নজরবন্দী থাকতে অনুমতি দেওয়া হোল ।

    য়োরোপে সুভাষচন্দ্র সেখাননকার বিভিন্ন দেশের ভারতীয় প্রবাসীদের সঙ্গে যোগস্থাপন করলেন । ভারতের সংগ্রামে সাহায্য করবার জন্য উদ্বুদ্ধ করলেন । প্রবাসীদের ওপর যেসব অন্যায় নিষেধাজ্ঞা ছিল (বিশেষ জার্মানীতে), সেগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে তাঁদের সাহায্য করতে লাগলেন । যখন লক্ষ করলেন যে ভারত সম্বন্ধে যোরোপীয়দের জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত, তখন ভারতের সম্বন্ধে প্রচার শুরু করবার ব্যাবস্থা করতে লাগলেন । এ কাজ তাঁর আগেই দেশবন্ধুর পূর্বতন সহকর্মী বিঠলভাই পাটেল (সর্দার বল্লভভাইএর দাদা) শুরু করেছিলেন য়োরোপে (দেশবন্ধুর পরামর্শ এতে ছিল)। তিনি সুভাষকে নিজের পক্ষচ্ছায়ায় নিলেন । সুভাষচন্দ্রের সম্বন্ধে তাঁর স্নেহভাব এইসময়ে দৃঢ় হয় । মৃত্যুকালে তিনি সুভাষচন্দ্রকে কিছু অর্থের উত্তরাধিকারী করে গেছিলেন । বল্লভভাই মামলা করে সেটা বন্ধ করেন ।

    এ ছাড়া ওনার একটা বড় আরব্ধ হোল যে নানা দেশের সরকারের সঙ্গে যোগস্থাপনা করা - যাতে প্রয়োজনে সেখান থেকে সাহায্য পাওয়া যায় । ভিয়েনার নাগরীক সংস্থার কিছু লোক তাঁকে এ ব্যাপারে সাহায্য করলেন । জার্মানীতে কিছু লোকের সঙ্গে হৃদ্যতা হোল । কিন্তু জর্মন সরকার তাঁকে আদৌ অমল দিলনা । হিটলারের ক্ষমতা সেখানে বাড়ছে । ভারতীয়, তথা সারা এশিয়াবাসী ওঁদের চোখে ব্রাত্য । ইংরেজের মত আর্য জাতীর হাতে যখন নীচজাতীয় ভারতীয়রা রয়েছে, তখন তাদের কোনো সংগ্রামকে ভালো চোখে দেখা তখন রীতির মধ্যে পড়েনা । (যুদ্ধের সময়ে উনি হিটলারের কাছে কিছু সাহায্য পেযেছিলেন অবশ্যই, কিন্তু সে অনেক পরের কথা)।

    কিন্তু য়োরোপের অন্যান্য দেশে তাঁর আদর হয়েছিল । মুসোলিনির সঙ্গে উনি দেখা করেছিলেন । (এর ফলে ও অন্যান্য পড়াশুনো করে ফ্যাসিষ্টনীতির সম্বন্ধে তাঁর যা মনোভাব হয়েছিল, সে প্রসঙ্গে একটু পরে আসব)। মুসোলিনি ওনাকে উত্সাহিত করেছিলেন । প্রাগে মাসারিকের মাসারিকের সহকর্মী ডা: বেনেশের সঙ্গেও দেখা হয়েছিল । পোল্যাণ্ড ও বল্কান দেশগুলো ছাড়া উনি তুর্কী পয্যন্ত গেছিলেন (আতাতুলের তুর্কী সম্বন্ধে যে আশা নিয়ে গেছিলেন, সেটা কিন্তু ওনার টেঁকেনি)। অস্ট্র্ত্রিয়ার কিছু লোকের মাধ্যমে ভারত ও মধ্য য়োরোপের সঙ্গে একটা বানিজ্যিক সম্পর্কের পত্তনও তিনি করবার চেষ্টা করেছিলেন ।

    এর মধ্যেও ওনার অন্যান্য চিন্তা বাধা পায়নি । ধর্ম সম্বন্ধে চিন্তা ও ধ্যান ধারণার অভ্যাস ওনার চিরকালই ছিল । কলেজের বন্ধু দিলীপ রায়ের সঙ্গে এ সম্বন্ধে পত্রালাপ অব্যাহত ছিল (দিলীপ রায়কে লেখক হিসাবে যাঁরা না চিনবেন বা পণ্ডিচেরীতে অরবিন্দের সঙ্গে তাঁর ভক্তি-সম্পর্কের কথা যাঁরা নাও জানেন তাঁরা গায়ক হিসাবে তাঁকে বোধহয় চিনবেন - বর্তমান বাংলার চিন্তা এখন কী মুখো তার পুরো খোঁজ আমার নেই) । দেশে থাকতে নানা পুস্তিকা তিনি লিখেছিলেন, য়োরোপ থেকে "মডার্ণ রিভিউ" তিনি সোশিয়ালিষ্ট রীতি ও ফ্যাশিষ্ট রীতির একটা মিলনসাধন করে দেখাতে চেয়েছিলেন যে ভারতে এই যৌথ মতবাদের প্রয়োগ হলে ভালো হবে । ফ্যাশিষ্ট নীতির মধ্যে আদর্শবাদ ও শৃঙ্খলার সামঞ্জস্য ওনাকে প্রীত করেছিল । ওর অত্যাচারগুলোকে উনি কোনো কারণে আমল দেননি । এটা বন্ধু নেহরু ও ভারতের অন্যান্য চিন্তাশীল লোককএ বিচলিত করেছিল ।

    ইংলণ্ডের ভারতীয় ছত্র সংস্থা ওনাকে নিমন্ত্রণ করেছিল । ব্রিটিশ পাসপোর্ট থাকায় ওখানে যাওয়া বোধহয় ইংরেজরা আটকতে পারত না । কিন্তু উনি সে ঝুঁকিটা নিতে চাইলেননা । একটা ভাষনণ পাঠিয়ে দিলেন । সেই ভাষনে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মহত্মাজীর এবং ওনার দৃষ্টিভঙ্গীর পার্থক্য তিনি আলোচনা করেছিলেন ।

    সেই আলোচনা ও ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রামের সম্বন্ধে তাঁর মতামত ভালো করে প্রকাশ করার সুবিধা তাঁর হোল যখন ইংলণ্ডের প্রকাশক লরেন্স উইশর্ট তাঁকে ওই সম্বন্ধে বই লিখতে অনুরোধ করলেন । সেই বই ("দি ইণ্ডিয়ন স্ট্রাগল,১৯২০-১৯৩৪") ভারত সরকার বেআইনী ঘোষণা করায় তদনীন্তন ভারতীয়রা সেটা পড়তে পারেনি, এখন নিশ্চয় পাওয়া যাবে ।

    এই বই লেখবার সময়ে তাঁর একজন সেক্রেটরীর প্রয়োজন হয়েছিল । তাঁর ভবিষ্যত স্ত্রী এমিলি শেংকলের সঙ্গে এখান থেকে তাঁর যোগ । পরে এ কথা আবার উঠবে ।

    বই যখন শেষ হয়ে আসছে সেই সময়ে জানকীনাথের আসন্যমৃত্যুর খবর পেলেন । ইংরেজরা ওনাকে কলকাতা যাবার অনুমতি দিল এই সময়টুকুর জন্য (আগে স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলেছিলম, কাজেই এখানে স্বীকার করতে হবে যে অন্য বিদেশি সরকার হলে এইটুকু বদান্যতা করত কিনা, আমার সন্দেহ আছে )। খুব তাড়াতাড়ি বইয়ের প্রুফ দেখা সেষ করে যখন বোম্বাই পৌঁছুলেন, তখন জানকীনাথের মৃত্য হয়েছেংউ ।

    কার্শিয়ং থেকে শরত্চন্দ্র কলকাতা আসার অনুমতি পেয়েছিলেন । ভাইয়েরা একসঙ্গে পিতৃশ্রাদ্ধ করার পরে ওনারা চেষ্টা করতে লাগলেন যে পরিবারের অসহায়তার ভিত্তিতে শরত্চন্দ্রকে স্বাবধিন ভাবে ওকালতি করার অধিকার দেওয়া হোক । দেশবন্ধুর পূর্বতন সহযোগী নলিনীরঞ্জন সরকার তখন প্রাদেশিক মন্ত্রী । প্রথমে কিছু দোনামনা করে তিনি শরত্চন্দ্রের জন্য গভর্নরকে অনুরোধ করলেন । তাঁকে নি:স্বর্তে মুক্তি দেয়া হোল ।

    সুভাষকে ভারতবর্ষে স্বাধীনভাবে বিচরণ করাতে সরকারের ভয় অনেক বেশি ছিল । ফলে ১৯৩৫ সালের গোড়ায় উনি আবার দেশত্যাগ করলেন । য়োরোপে এসে খবর পেলেন যে তাঁর সদ্য-প্রকাশিত বই প্রচূর প্রশংসা পাচ্ছে । একজন ইংরেজ সমালোচক লিখেছেন, "বোসকে একজন সমাজবিরোধী সন্ত্রাসবাদী জেদী লোক বলেই পরিচয় দেওয়া হয় । কিন্তু এই বইয়ের লেখককে বরঞ্চ চিন্তাশীল, ধীরমতি লোক বলেই দেখলাম । ভারতীয় সংগ্রাম সম্বন্ধে লেখা সব বইয়ের মধ্যে এটাকে প্রথম স্থান দেওয়া যায় । তাঁর মতামত লেখক স্পষ্ট করে বলেছেন ও অত্যন্ত পরিষ্কার করে তার যুক্তি দেখিয়েছেন । এত অল্প বয়সে এ রকম পরিষ্কার চিন্তাশক্তি যার থাকে, সেরকম লোক তার দেশের রাজনৈতিক কাজে অতি মূল্যবান" ।

    এককালে সুভাষের ইচ্ছা ছিল রোমাঁ রোলাঁ ওনার বইয়ের ভূমিকা লিখুন; ব্যাবস্থা করে উঠতে পারেননি । এ ব্যাপারে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ওনার কিছু মনোমালিন্যও হয়েছিল । কিন্তু রোমাঁ রোলাঁ স্বয়ং এই বই সম্বন্ধে ওনাকে পরে লিখেছিলেন, "ভারতীয় সংগ্রামের ইতিহাসের পক্ষে এ বই অমূল্য । ইতিহাস লেখাকের যে সব গুণ থাকা দরকার, তা তোমার আছে । তোমার মত কর্মী লোকের মধ্যে এরকম সমদর্শীতা বড় একটা দেখা যায়না "। ওনাদের দুজনের দেখা হয়েছিল - কথা হয়েছিল দোভাষীর মাধ্যমে ।

    ওনার পেটের অসুখের জন্য চিকিত্সার চেষ্টা উনি বরাবরই করছিলেন । মধ্য য়োরোপের কয়েকটি উষ্ণ প্রস্রবনে তিনি গতবারেই সময় কাটিয়েছিলেন, কিছু উপকারও পেয়েছিলেন, কিন্তু আরও কড়া চিকিত্সার প্রয়োজন আর এড়ান যচ্ছিলনা । এবারে য়োরোপে ফেরার পর ভিএনাতে ওনার "গল ব্লডর"এ অস্ত্রোপচার হোল । সুস্থ হবার পর আবার তিনি পরিক্রমা শুরু করলেন । ডা: বেনেশের সঙ্গে আবার দেখা করলেন প্রাগে । তখন তিনি চেকোস্লোভাকিয়ার প্রেসিডেন্ট (অবশ্য সেটা হিটলরের কের্দানি শুরু হবার আগে - উনি বেশিদিন টেঁকেননি তার পরে ) । হিটলার এশিয়াবাসী ও ভারতীয়দের সম্বন্ধে বিরূপ মন্তব্য করে বক্তৃতা দেন । সুভাষ জর্মনীর ভারতীয় ছাত্র-সংস্থাকে তার প্রতিবাদ করতে উদ্বুদ্ধ করলেন । তারা ভয় পেল । উনি বললেন, "প্রতিবাদ না করলে অন্যায় কিছু কমবেনা । জোর দেখালে বরঞ্চ কিছু সুফল হতে পারে - এখানকার ইতিহাসেই তার নজীর আছে" । জর্মন সরকারের লোকেদের সংগে এবারেও দেখা করতে পারলেন না । স্টালনের সরকারও তাঁকে উত্সাহ দিলনা - হয়ত ইংরেজরা কিছু কলকাঠি নেড়েছিল । কিন্তু বেলজিয়মে উনি বেশ কিছুদিন কাটালেন ও বেলিজয়মের ধনী ভারতীয় নাগরীকদের তাঁর সৌহার্দ হোল । পরে তাঁদের একজনের বোম্বাইয়ের বাড়িতে তিনি বার কতক অতিথি হয়েছিলেন ।

    আয়লর্য়াণ্ড তখন স্বাধীন দেশ ।আয়র্ল্যাণ্ডের ভারতীয়-আইরিশ সংস্থা বিঠলভাই পাটেল স্থাপনা করে গেছিলেন । তাঁরা সুভাষকে নিমন্ত্রন করলেন । ইংলণ্ড হয়ে যাওয়া সহজ হবেনা মনে করে তিনি ফ্রান্স থেকে সোজা কর্কে জাহাজ নিয়ে গেলেন । আয়লর্য়াণ্ডের স্বাধীনতা-সংগ্রাম চিত্তরঞ্জন, সুভাষ, শরৎ প্রমুখ বহু বাঙালি নেতাকে এর আগে উদ্বুদ্ধ করেছিল । ভারতীয়দের আইরিশরা স্বধীনতা-পথে সহযাত্রী বলেই দেখত । কাজেই ওখানে সুভাষচন্দ্রের প্রচূর সমাদর হোল । শ্রমিক নেতা, সরকারের বাইরের নানা রাজনৈতিক নেতাদের স!ণেগ দেখা হোল । প্রেসিডেন্ট দি ভ্যালেরার সঙ্গে দেখা হোল তিনবার ।

    একটা মজার ঘটনা - এখানে মান্দালয় জেলের পূর্বতন কর্তৃপক্ষ কর্ণেল স্মিথের সঙ্গেও তাঁর দেখা হোল । পুরোন দিনের গল্পও হোল কিছু ।

    এরচেয়ে দরকারী কথা, ওনার এই দ্বিতীয় য়োরোপ সফরের সময়ে পণ্ডিত জবাহরলাল স্ত্রীর চিকিত্সার জন্য য়োরোপে ছিলেন (এর অতি অল্পকালের মধ্যে শ্রীমতী কমল্ল নেহরুর মৃত্যু হয়) । সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে বারকয়েক তাঁর দেখা হয় । ওঁদের মধ্যে হৃদ্যতা গভীরতর হয় । এর আগেও দেশে বহু ব্যাপারে ওনারা এক পক্ষে থেকে কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে তর্ক করেছেন । কিন্তু নেতাজী তাঁর বইয়ে পণ্ডিতজীর স্মল্লোচনা করে বলেছিলেন যে তিনি নাকি বারবার কাজের সময়ে মহাত্মাজীর চাপে মত বদলান - এটা ভালো নয় । এ নিয়ে দুজনের মধ্যে যদি মনোমালিন্য হয়েও থাকে, এই সময়ে সেটার কিছু উওঅশম বোধহয় হয়েছিল । পরেও এর প্রমাণ পাওয়া যাবে ।

    সুভাষচন্দ্রের কিছুদিন থেকেই মনে হচ্ছিল যে দেশের বাইরে থাকলে হাজার চেষ্টা করেও দেশের কাজ বেশি হয়না । ডি ভ্যালেরা এ কথা সমর্থন করলেন । কাজেই সুভাষ ঠিক করলেন যে নিশেধাজ্ঞা অমান্য করেই তিনি ভারতে ফিরবেন । ভিয়েনার ব্রিটিশ কন্সাল এ ব্যাপারে তাঁকে সাবধান করে চিঠিও দিলেন । শুনলেননা । ১৯৩৬ এ বোম্বাইয়ে জাহাজ থেকে নামলেন ও অবিলম্বে গ্রেপ্তার হলেন ।

    দু বছরের বেশি তাঁকে বন্দী থাকতে হয়নি । কিন্তু সে কথা বলার আগে একটু খবর দিয়ে নিই ওনার দুবছর বিদেশবাসের স্ময়ে শরত্চন্দ্র কী করলেন ও দেশে কী হোল ।

    শরত্চন্দ্র ১৯৩৫ সালে ছাড়া পাবার পরে আবার ওকালতিতে ফিরে গেলেন । পূর্বতন বন্ধুরা সাদর অভ্যর্থনা করলেন । পুরোন পশার ফিরতে খুব দেরী হোলনা । সংসার আবার স্বচ্ছল হোল । মেয়ের বিয়ের ব্যাবস্থা হোল । বাড়ির দিকটা সামলে গেল ।

    নতুন ভারত শাসন আইনে নির্বাচনের তোড়জোড় চলল । ওই বিধানে সরকার ঠিক করলেন যে মুসলমান ও অস্পৃশ্য জতীদের স্বার্থরক্ষার জন্য আইনসভায় কিছু আসন তাঁদের জন্য আলাদা থাকবে । কংগ্রেসের এ ব্যাপারে আপত্তি ছিল - দেশ সম্পূর্ণ জাতী-নিরপেক্ষ হবে এটাই ছিল আদর্শ । কাজেই এই ব্যাপারে সরকারের সঙ্গে সহযোগীতা করা উচিৎ হবে কিনা, সে সম্বন্ধে দ্বন্দ্ব দেখা দিল খানিকটা । পুরোন স্বরাজ পার্টীর সঙ্গে সহানুভূতি যঁদের ছিল তাঁরা বললেন যে অন্য সব ব্যাপারে যখন অসহযোগীতা অপাতত: বন্ধ আছে তখন আইন সভায় ঢুকে সেখান থেকে কিছু প্রগতিশীল কাজ করার চেষ্টা করা উচিত্‌, পরে যদি সরকার পক্ষা বাধা দেয়, তলহন ভেতর থেকেই আইনসভাকে বানচাল করা যাবে । বিধান রায় এ ব্যাপারে নেতৃত্ব নিলেন । শরত্চন্দ্র প্রাদেশিক কংগ্রেসের সভাপতি হিসাবে নির্বাচনের ব্যাবস্থাপনার ভার নিলেন । পুরোন হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্ব আবার স্পষ্ট হোল । ফজলুল হক কৃষক প্রজা পার্টীর নেতা হিসাবে আগেই বর্ণ-হিন্দুদের কাছে ঘা খেয়েছিলেন । কাজেই তিনি অবাঙালি মুসলিম লীগের সঙ্গেই মোটামুটি হাত মেলালেন । শরত্চন্দ্র নানা আলোচনার চেষ্টা করলেন, ফল খুব একটা হোলনা ।

    কম্যুনিষ্টরা কংগ্রেসকে কোনোদিন ভালো চোখে দেখেনি । কংগ্রেসের মধ্যেও অনেকে ছিলেন যাঁরা সমাজতন্ত্রের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন ছিলেন, কিন্তু কম্যুনিষ্টদের রাশিয়া-ভজনাকে ভালো চোখে দেখতেননা (তখন "কমরেড স্টালিনের" যুগ, "দলিতদের নেতা" হিসাবে তিনি তখন নিজের স্বেচ্ছাতন্ত্রকে বেশ গুছিয়ে নিয়েছেন, ট্রটস্কি মেক্সিকোয় নির্বাসিত - অথবা ততদিনে খুন হয়ে গেছেন, ঠিক মনে পড়ছেনা । "চীনের চেয়ারম্যান" তখনো "আমাদের চেয়ারম্যান" হবার মতো শক্তি সংগ্রহ করতে পারেননি) । কিন্তু কংগ্রেসে থাকলেও মহাত্মাজীর ধনী-তোষননীতি তাঁদের মন:পূত ছিলনা । তাঁরা "কংগ্রেস সোশ্যালিষ্ট পার্টির" সৃষ্টি করলেন । এঁদের মধ্যে বিশিষ্ট ছিলেন জয়প্রকাশ নারায়ণ, মিনু মসানী, অশোক মেহতা, কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায়, অচ্যুত পটবর্ধন, রামমনোহর লোহিয়া । এ সময়ে ওঁরা সবাই নাসিক জেলে ।

    এত কথা উঠল দুটো কারণে । সুভাষচব্দ্রের অনুপস্থিতিতে দেশের হাওয়া কতটা বদলেছিল, তার একটা মোটামুটী চুম্বক দেয়া ও সেক্ষেত্রে শরত্চন্দ্রের দানের কথা বলা ছাড়া এমন কিছু নাম পঠকের কাছে তুলে ধরা, যাঁরা আমার কৈশোর ও যুবাবস্থায় আমার নমস্য ছিলেন । বর্তমান কালে এঁদের কথা লোকে কতটা মনে রেখেছে, আমি জানিনা ।

    সুভাষের কথায় ফেরা যাক । ওনাকে বন্দী রাখার বিরুদ্ধে একটা জনমত গড়ছিল । পণ্ডিতজী একদিনের জন্য "সুভাষ ডে" ঘোষনা করলেন । কেন্দ্রীয় পরিষদে ওনার কারাবাসের সম্বন্ধে বিতর্ক উঠল । সরকার বলল, উনি বিপজ্জনক লোক ।

    সুভাষকে প্রথমে বোম্বাইয়ের জেলে রাখা হয়েছিল, পরে পুনার কাছে ইয়রবদায় বদলী করা হয় । কিন্তু ওনার শরীরের জন্যও খানিকটা ও জনমতের জন্যও খানিকটা, ওনাকে এরপরে কার্সিয়ংএ শরত্চন্দ্রের বাড়িতে নজরবন্দী রাখা হয় । এখানে প্রথমটা উনি ভালো ছিলেন । এই সময়ে শ্রীমতী শেংকলের সঙ্গে তাঁর নিয়মিত পত্রালাপ হোত । দুজনেই পরস্পরের মঙ্গলার্থী ছিলেন - কথা হোত সেই নিয়েই । রাজনৈতিক কথা কইবার থাকলেও উপায় ছিলনা - চিঠিপত্র কড়া "সেন্সর" করা হোত ।

    কিন্তু কোনো কারণে ওখানেও ওনার স্বাস্থ টিঁকলনা (আমার ধারনা ওনার শরীর কোনোদিনই ভালো ছিলনা - কাজে ব্যস্ত থাকলে উনি সেটাকে ভুলে থাকতেন অনেকটা) । বাংলার গভর্ণর কেন্দ্রীয় সরকারকে জানালেন যে দেশের এবং ওনার বর্তমান অবস্থায় ওনাকে ছেড়ে দিলেও ওনার পক্ষে কোনো ক্ষতিকর কাজ করা সহজ হবেনা । শেষ অবধি ১৯৩৭ সালে উনি নি:স্বর্তে মুক্তি পেলেন ।

    পেলেই যে পূর্ণ উদ্যমে কাজে নামতে পারলেন তা নয় - শরীর করতে দিলনা । কলকাতায় একদিন "সুভাষ ডে" পালন করা হল । স্বয়ং কবিগুরু অভিনন্দন পাঠালেন । ফুলের মালায় টেবিল ভরে গেল । ওনার বহুদিনের ইচ্ছা ছিল যে স্বাধীনতা-সংগ্রামীদের স্মৃতীতে একটা স্থায়ী প্রতিষ্ঠান তৈরি হোক, এই সময়কার উত্সাহে মহাজাতি সদনের গোড়াপত্তন হোল । কর্পোরশনে এবং প্রাদেশিক কংগ্রেসে ওনার নেতৃত্ব বাঁধাই ছিল, কিন্তু তার ভার নেবার আগে আরো কিছুদিন বিশ্রাম নেবার জন্য তিনি মাস পাঁচ ডালহাউসিতে গিয়ে রইলেন । ইংলণ্ডের ছাত্রজীবন কালে লণ্ডনের এক পাঞ্জাবী ডাক্তার পরিবারের সঙ্গে ওনাদের হৃদ্যতা হয়েছিল, ডালহাউসিতে তাঁদের বাড়িতে রইলেন । পড়াশোনা চলতে লাগল । পুরোন বন্ধু দিলীপ রায়ের সঙ্গে পত্রালাপে আধ্যাত্মিক মতামতের আদানপ্রদান হতে লাগল । ইতিমধ্যে কলকাতায় মেজদা শরত্চন্দ্রের ওকালতি ও বাংলার আইনসভায় কংগ্রেসের প্রধান মুখপাত্র হিসাবে চিরাচরিত কাজ চলতে লাগল । এই দুটো জিনিষেরই প্রচূর আলোচনা গর্ডন সাহেবের বইয়ে পাওয়া যাবে । সুভাষচন্দ্রের ব্যাপারে কিছু কিছুর বিস্তার পরে করব ।বর্তমানে শরত্চন্দ্রের সম্বন্ধে এইটুকু বলি যে ওনার দেশসেবাটা চিরকালই সংগঠন, আইন ও বিতর্ক দিয়ে তৈরি হয়েছিল । সে সময়কার আইনসভায় সরকার পক্ষের সঙ্গে যে বাকযুদ্ধ হোত তা এখনকার আইনসভাগুলোর থেকে পৃথক কিছু নয় । বাজেট নিয়ে যে বিতর্ক হোত, সে আজও চলছে । সরকার চাইছে পুলিশ, সরকারী কর্মচারীদের বেতন, আইন-শৃঙখলা রক্ষাটাই আসল, বিপক্ষ দল বলছে শিক্ষা, গনসেবা এগুলোর বেলা এত গাফিলতি কেন? অবশ্য বিতণ্ডার ভাষাটা মর্কিনের থেকে বেশি ইংরেজি হাউস অফ কমন্সের গা ঘেঁষা ।

    কেন্দ্রিয় কংগ্রেসে জবাহরলাল পরপর দু বছর সভাপতি ছিলেন । গান্ধীজি বুঝতে পেরেছিলেন যে ওনার থেকে বাম-ঘেঁষা লোকেদের প্রধান্য উনি রোধ করতে পারবেননা । জবাহরলালকে উনি অনেকটা বশে রাখতে পারতেন, সে দিক থেকে ওনার পরে কাকে সভাপতি করা হবে, সেটা চিন্তার কথা ছিল - সুভাষ জবাহরলালের বন্ধূ , সে হিসাবে পরোক্ষে হয়তো কিছুটা প্রভাব রাখা যাবে, কিন্তু পুরো বিশ্বাস করতে পারছিলেননা । তবু পরের কংগ্রেসে ওনাকেই সভাপতি করতেমনস্থ করলেন (কমিটির ভোট তখনো হয়নি - তবে ওয়ার্কিং কমিটি ওনাকে অমান্য বেশি করতনা) । মহাত্মা সুভাষকে বললেন যে ওনার স্বাস্থটাকে হয়তো আরো একটু ভালো করা যাবে, যদি তিনি অল্প কিছুদিন আবার য়োরোপে গিয়ে থাকেন ।

    এবার উনি প্রধান ঘাঁটি করলেন সুইটজরলয়াণ্ড ও অস্ট্রিয়ার সীমার কাছে অস্ট্রিয়ার বদগাস্টীনে - ওখানের উষ্ণ প্রস্রবনে ওনার স্বাস্থ পুনরুদ্ধার হবার ভরসা ছিল (এর আগে জর্মানীতে থাকার কালেও উনি কতগুলি "স্পা"তে সময় কাটিয়েছিলেন)। একটা আত্মজীবনী লেখার ইচ্ছ তাঁর ছিলই । সে কাজে সাহায্য করার জন্য উনি শ্রীমতী শেংক্লকে বদগস্টীনে আসতে অনুরোধ করলেন ।

    ওনার আত্মজীবনী "ইণ্ডিয়ান পিলগ্রিম"এ ওনার জীবন দর্শন ও এবারকার সফরের সময়ে ওনার রাজনৈতিক বিবর্তনের কিছু চুম্বক গর্ডন সাহেব দিয়েছেন; হয়তো এখানে তার কিছু চুম্বক দেওয়া যায (পরে হয়তো আর সময় হবেনা) । আরেকটা ব্যাপারের আলোচনারও সময় বোধহয় এসেছে, সেটা হোল এমিলি শেংকলের সম্বন্ধে নেতাজীর বিবাহের কথা । গর্ডন সাহেব ও দুটোকে এক সুতোয় বাঁধবার একটু চেষ্টা করেছেন, আমার মত মেলেনি, বোধহয় সে কথাও এসে পড়বে ।

    এমিলি শেংকল গর্ডন সাহেবকে বলেছিলেন যে বাডগেস্টীনে ১৯৩৭ সালের ডিসেম্বর মাসে গোপনে ওঁদের বিবাহ হয় । তাঁর কথা ছাড়া এ ব্যাপারে কোনো প্রমাণ নেই । যুদ্ধোত্তর য়োরোপে যুদ্ধপূর্ব সরকারী কাগজপত্র পাওয়া কঠীন । সুভাষচন্দ্রের আত্মীয়া শ্রীমতি কৃষ্ণা বসু ১৯৭২ সালে "ইলস্ট্রেটেড উইকলি" তে লিখেছেন যে ওঁদের বিবাহ ১৯৪১ সাল নাগাদ যুদ্ধের সময়ে জার্মানীতে গোপনে হিন্দু মতে হয় । অন্যন্য জীবনীকার বলেছেন ১৯৪২ । তারিখটা বড় কথা নয় । যুদ্ধের সময়ে ওঁরা স্বামি-স্ত্রী হিসাবে বাস করতেন এ কথা ঠিক । ওনাদের মেয়ে অনীতার জন্ম ১৯৪২ সালে । নেতাজীর মৃত্যুর পরে শরত্চন্দ্রর হাতে ওনার চিঠি এসেছিল, তাতে তিনি এমিলিকে নিজের স্ত্রী বলে পরিচয় দিয়েছেন ও কন্যা অনীতার কথা জানিয়েছেন । পরবর্তিকালে শরত্চন্দ্র সপরিবারে ভিয়েনাতে ওনাদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন । ১৯৪৮ সালে ওনাদের গ্রুপ ছবি গর্ডন সাহেবের বইয়ে আছে । আমি নিজে বারকত ভিয়েনাতে গ্রীষ্ম কাটিয়েছি - একবার ওনাদের খোঁজবার চেষ্টাও করেছিলাম । শেংকল নাম তখন জানতাম না । এমিলি বেঁচে আছেন কিনা আমি জানিনা । অনীতার বিবাহিত নাম যদি থাকে (তাঁর বয়স এখন ষাটের ওপর) সেটা বসু বা শেংকল কোনটাই নয় । কলকাতায় বসু পরিবারের কাছ থেকে ছাড়া বা হয়তো গর্ডন সাহেবের কাছে ছাড়া ওঁদের বর্তমানের কথা জানা কঠিন ।

    বাডগেস্টীনে ফিরে যাই । "ইণ্ডিয়ন পিলগ্রিম"এ ওনার জীবন দর্শনের বিস্তারিত বিবরণ সুভাষ দিযেছেন । তার সঙ্গে তাঁর "ইণ্ডিয়ান স্স্ট্রগল"এ লেখা রাজনৈতিক মতামতের সম্পর্ক দেখিযে উনি আরো লিখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তা আর করা হয়ে ওঠেনি । "ইণ্ডিয়ান পিলগ্রিম" ১৯৪৮ সালে কলকাতায় প্রকাশিত হয়েছিল । ঐ বইয়ের সবচেযে বড় মূল্য হোল তাঁর আত্মবিশ্লেষণে তাঁর জীবনদর্শণের ত্রক্রমবিবর্তনের ইতিহাস ।

    বাড়ির ছোট ছেলের আত্মবিশ্বাস সচরাচর কম হয় - দাদা-দিদিদের ক্ষমতার ওপরেই বিশ্বাসটা বেশি থাকে । কিন্তু সুভাষের বিপ্লবী মন সেষটা থেকে বেরোতে চাইছিল গোড়া থেকেই । ওনার ছেলে বেলার জনসেবা, তাঁর বাড়ি থেকে পালিয়ে গুরু খোঁজা, সবই শক্তি-সংগ্রহের চেষ্টা । কিন্তু ওঁর মনে ধর্ম-জিজ্ঞাসাও প্রথম থেকে ছিল । বিবেকানন্দর কাছ থেকে শিখলেন ধর্মক্ষেত্রে সেবার স্বার্থকতা । সাধকদের অনুকরণে কামিনী-কাঞ্চন-ত্যাগ তার সঙ্গে জড়িয়ে গেছিল । জনসেবার ক্ষেত্রে বিদেশি শাসন যে প্রতিবন্ধক, সেটা তিনি বুঝেছিলেন - ওনার বিদ্রোহী মনটা সেখান থেকে স্বরাজ- আন্দোলনে স্বভাবত:ই সরে গেছিল । কিন্তু আরো বড় বয়সে, নানা সময়ে যখন কর্ম থেকে বিরত হতে হোল তখন তিনি বিস্তর পড়াশোনা ও চিন্তা করারও সময় পেয়েছিলেন তখন থেকে ওনার কাছে ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি সব এক সুতোয় বাঁধা হয়ে গিয়েছিল । ঈশ্বরের সঙ্গে বিশ্বপ্রেমের সম্পর্ক তিনি উপলব্ধি করেছিলেন । নিজেকে কর্মযোগী হিসাবে দেখতে পেয়ে তিনে এটাও বুঝতে শুরু করেছিলেন যে ওনার প্রথম বয়সের ব্রহ্মচর্য্যের চেষ্টা (যেটা ওনাকে ছেলেবেলায় প্রচূর কষ্ট দিয়েছে) জ্ঞানযোগীর যতটা আরব্ধ, ওনার নয় ।

    আমার আন্দাজ এই যে শ্রীমতী শেংকলের নিকট সংসর্গে আসার ফলে উনি তাঁকে নিজের উত্তরসাধিকা পেয়েছিলেন । সেখান থেকেই বোধহয় তাঁর যৌন জীবনের পরিবর্তনের শুরু । কিন্তু এখানে গর্ডন সাহেব ওটাকে ওনার বিশ্বপ্রেমের সঙ্গে এক করেছেন । আমার ধারণা যে বৈষ্ণবদের মধ্যে "প্রেম" শব্দটা যেখানে বিশ্বপ্রেম বা ঈশ্বরপ্রেম অর্থে ব্যাবহার হয়, সেটা গর্ডন সাহেব তলিয়ে দেখেননি অথবা জানতেননা । প্রেম শব্দটার ইংরেজি প্রতিশব্দ "লভ" ধরে উনি শ্রীমতী শেংকলের সঙ্গে সুভাষের প্রেম-সম্পর্কটা সুভাষের ধর্মভাবের অংশ হিসাবে ধরেছেন (খনিকটা তান্ত্রিকদের মতো) । খুব একটা এসে যায়না অবশ্য - নিজের জীবনে দেখেছি ও দুটো প্রেমের মধ্যে জট ছাড়াবার খুব একটা প্রয়োজন নেই ।

    ওনার রাজনৈতিক মতের কিছু পরবর্তি বিবর্তন ওনার বইয়ে দেখান হয়েছিল কিনা জানিনা, কিন্তু ওনার এইবরকার য়োরোপ সফরের সময়ে সেটা কিছু বক্তৃতায় স্পষ্ট হয়েছিল । ওনার ছাত্রজীবনের পরে এই প্রথমবার তিনি ইংলণ্ড যান । ইংলণ্ড-প্রবাসী ভারতীয়রা এই সময়ে ওনাকে আমন্ত্রণ করেন আগের বারের মতই । ব্রিটিশ পাসপোর্ট-ধারী লোকের ইংলণ্ড-যাত্রায বাধা দেবার ক্ষমতা ইংরেজ সরকারের ছিলনা - ওরা শুধু ওনাকে এ ব্যাপারে হুমকি দিত । এবার উনি সেটা মানলেননা । ইংলণ্ডে প্রচূর সম্বর্ধনা পেলেন । ভারতীয় সংস্থাগুলোর সঙ্গে তো বটেই, নানা রাজনৈতিক দলের প্রতিভূদের সঙ্গে ছাড়া ভারতের পূর্বতন রাজপ্রতিনিধিদের সঙ্গেও দেখা হোল ।

    ওখানেই কোনো একটা সভায় ওনাকে ফ্যাসিষ্টবাদ সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হয় । মুসোলিনির সম্বন্ধে ওনার পূর্ববর্তি শ্রদ্ধাভাব আগেও কেউ ভালো চোখে দেখেনি । উনি তখন ফয়াসিষ্টদের মধ্যে দেশপ্রেম ও নিয়মানুবর্তিতাটাই বড় করে দেখেছিলেন - সেই নিয়ম চালু করতে যে অত্যাচারটা হয়েছিল, সেটাকে তিনি আমল দেননি । কিন্তু এর মধ্যে ইটালি ও জার্মানীর রাজনৈতিক চেহারাটা যা দেখা যাচ্ছিল, সেটা সুভাষকে মত পরিবর্তনে বাধ্য করে । এট উনি সেই সভায় স্পষ্ট স্বীকার করেছিলেন ।

    য়োরোপ ছেড়ে দেশে ফেরবার সময় হয়েছে এবার । উনি এবার বিদেশে থাকার সময়েই কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় কমিটি ওনাকে পরবর্তি সর্ব-ভারতীয় কংগ্রেস অধিবেশনের সভাপতি মনোনীত করে । স্বাস্থ অনেক ভালো হয়েছিল (শুধু বডেগস্টীনের হাওয়া নয়, শ্রীমতী শেংকলের সাহচর্য বোধহয় তার জন্য দায়ী ) । উনি দেশে ফিরে এলেন ।

    এবং দেশে ফিরেই কাজে ডুবে গেলেন । এক মাসের মধ্যে হরিপুরায় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতিত্ব করতে গেলেন - বাংলার প্রাদেশিক কংগ্রেসের সভ্য হিসেবে শরত্চন্দ্র স্বভাবত:ই গেলেন । ট্রেনে গেলেন হিন্দি-উর্দূ শিখতে শিখতে ।

    কংগ্রেসের অধিবেশনে যা ধুম হয়, সে প্রায় দিল্লী দরবারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে । দর্মার বেড়ায় ঘেরা প্রায় দু বর্গ মাইল জুড়ে সহর তৈরি হয়েছিল এবার । স্বেচ্ছাকর্মী ইঞ্জিনিয়রদের সাহায্যে সেখানে জল, বিদ্যুত্‌, কিছুরই অভাব ছিলনা । একজন "নেটিভ স্টেট"এর রাজার দহার দেওয়া একান্ন বলদে টানা রথে সুভাষকে অধিবেশনে নিয়ে যাওয়া হোল ।

    তাঁর ভাসনে সুভাষ আবার পূর্ণ স্বরাজের দাবির কথা বললেন । বললেন ভারতের "কনিসটট্যুশন" ভারতকেই তৈরি করতে হবে । ভারতের অর্থনৈতিক কাঠামো সমাজৈনতিক না হলে দরিদ্র জনসধারণের মঙ্গল হওয়া কঠিন । ইংরেজের সঙ্গে "ফেডরেশন" সম্ভব হোত, যদি ইংলণ্ড সমাজতান্ত্রিক দেশ হোত ।

    কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী দল অবশ্যই এতে খুশী হোলনা । সর্দার বল্লভভাই পটেল (যাঁর দাদা বিঠলভাইয়ের দেওয়া টাকা সুভাষচন্দ্র কোনোদিন পাননি) যে বক্তৃতা দিলেন স্বয়ং মহাত্মা বললেন তাঁকে একটু নরম হতে । বামপন্থীদের খুশী করতেই সুভাষকে যখন সভপতি করা হয়েছে, তখন তাদের কিছুটা আস্কারা নাঅ দিলে ক্ষতি হেব, এট মহাত্মাজী জানতেন । ওনার ভরসা ছিল যে জবাহরলালকে উইনি যেমন মিষ্টি কথায় বসে রাখতে পেরেছেন, এখনেও তর পুনরাবৃত্তি হতে পারবে । মহাত্মার প্রতি সুভাষও শ্রদ্ধা রাখতেন - মতদৈধ্ব যতই হোক - উনি অহিংস পথে নিজেও চলেছিলেন ।

    কিন্তু "ওয়র্কিং কমিটি" তৈরি করার সময়ে বামপন্থীদের খুব সুবিধা হোলনা । কম্যুনিষ্টদের সঙ্গে কংগ্রেস সোষ্যলিস্টদের খিটিমিটিতে বামপন্থীরা দুর্বল ছিল - দক্ষিণপন্থিরা মহত্মার নেতৃত্বে সংহত ।

    কাজ চলতেই লাগল । সুভাষচন্দ্রের চিরদিনই ইচ্ছা ছিল যে একটা অর্থনৈতিক পরিকল্পনার কাজ শুরু করার সময় হয়েছে । জবাহরলালের নেতৃত্বে সে পরিকল্পনার কাজ আরম্ভ হোল (স্বাধীন ভারতের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাগুলোর ভিত্তি এইখানে) । প্রাদেশিক যে সব সরকারগুলো কংগ্রেসের অধীনে ছিল (বাংলার কথা পরে আসছে), তাদের মধ্যে দলাদলীর সালিশী মহাত্মাজীর দল যেভাবে করতে চাইলেন, সুভাষ একমত হলেন ।

    দ্বন্দ্ব আরেকটা বাধল আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে । সুভাষচন্দ্র যদিও ফ্যাসিষ্টদের সম্বন্ধে তাঁর মত বদলেছিলেন, কিন্তু তাঁর মনে এ কথাটাও ছিল যে ইংরেজের বিরুদ্ধতা করতে হলে ইংরেজের শত্রুদের সাহায্য কাম্য হতে পারে । ইটালী, জার্মানী, জাপান ভালো কাজই করুক বা মন্দ কাজই করুক, তারা ইংরেজের শত্রু বলে তারা আমাদের বন্ধু । কংগ্রেসের মধ্যে মহাত্মাজী যে ন্যায়বোধের প্রচার করেছিলেন, সেখানে এ মত গ্রাহ্য হতে পারেনা । কংগ্রেসের পক্ষ থেকে চীনাদের সাহায্য করবার জন্য একটা ডাক্তরী "মিশন" আগেই গিয়েছিল (চীন-জাপানের যুদ্ধ তখন শুরু হয়ে গেছে - এই মিশনের কাজ সম্বন্ধে রাশিযা থেকে "ডাকটর কোটনিসকী অমর কহানী" নামের হিন্দি সিনেমা আমরা ছেলেবেলায় দেখেছিলাম) । নেতাজীর তাতে আপত্তি ছিলনা, কিন্তু জাপানকে শত্রু ভাবা তিনি ভুল বলে ভাবতেন । বিপ্লবী রাসবিহারী বসু এর অনেক আগে দেশ থেকে পালিয়ে জাপানে বাস করছিলেন এবং সেখানকার ভারতীয়দের সঙ্ঘবদ্ধ করছিলেন । এঁনার সঙ্গে নেতাজীর পত্রালাপ ছিল । তিনি জাপানের "এশিয়া-সঙ্ঘের" পরিকল্পনাতে বিশ্বাস করতেন । নেতাজীর এই মতের প্রভাব পরবর্তীকালে অনেক পড়েছিল, কিন্তু যখনকার কথা বলছি, তখন তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গী ওনার সংগে কংগ্রেসের একটা শক্তিশালী অংশের বিরোধই গড়ে তুলছিল । ইংরেজদেরও খুশী করেনি অবশ্যই ।

    কংগ্রেসের সঙ্গে দ্বন্দের আরও কারণ তৈরি হতে লাগল পুরো ১৯৩৭ সাল ধরে । সর্বভারতীয় কংগ্রেসে তিনি যা করছিলেন, সে ছাড়া বাংলা প্রাদেশিক কংগ্রেসের সভাপতিত্ত্ব তাঁর ছিলই । এই সময়ে কলকাতা কর্পোরেশনেও ওঁকে অল্ডরম্যান করা হোল । কর্পোরেশনে প্রচূর দুর্নীতি ধুকেছিল - সুভাষ আগে থেকেই সে সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন । এখন ভরসা করা গেল উনি এ সম্বন্ধে কিছু করতে পারবেন ।

    এখানে যে সংঘাতগুলো বাধল, সেগুলো আগে থেকেই ধূমায়িত হচ্ছিল । বাংলার আইন সভায় শরত্চন্দ্র প্রমুখ নেতারা কংগ্রেসের কথা ঠেলে ঢুকেছিলেন । কিন্তু ইংরেজের নতুন সাম্প্রদায়িক বিভাগনীতির ফলে মন্ত্রীসভায় তখন ফজলুল হকের মন্ত্রীত্বে সরকার গড়েছিল । হক তখন মুসলিম লীগে যোগ দিয়েছেন । বোধহয় লীগের কথটার কিছু আলোচনা এখন দরকার ।

    মুসলিম লীগে তখন মুহম্মদ জিন্নাহ (পাকীস্তানের "কায়দ-এ-আজম") একছত্র । শুধু মুসলমানেদের স্বার্থ সংরক্ষণ তাঁর উদ্দেশ্য নয়, তাঁর আবদার যে ভারতের মুসলমানেদের প্রতিভূ হিসাবে লীগ ছাড়া আর কেওকে মানা চলবেনা । কংগ্রেস ভারতের প্রতি জনের প্রতিনিধি একথা তাঁর কাছে গ্রাহ্য নয় । কংগ্রেসের সঙ্গে কোনো বৈঠক হলে সেখানে কংগ্রেস পক্ষে কোনো মুসলমান বসতে পাবেনা । (কায়দ-এ-আজম উর্দু বলতে পারেননা, মৌলানা আজাদ ইস্লাম দর্শনে বিদগ্ধ - তাতে কী হোল, জিন্নাহ সাহেব প্রকৃত মুসলমান, মৌলানা হিন্দুদের সংস্রবে হিন্দু হয়ে গেছেন) । সুভাষচন্দ্র কংগ্রেসের সভাপতি হবার পর জিন্নাহ সাহেবের সঙ্গে পত্রালাপের চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কংগ্রেস মুসলমানদের রাখলে জিন্নাহ সাহেব তার সঙ্গে কোনো রকম চুক্তিতে রাজী নন । হিন্দু মহাসভার এতে আপত্তি ছিলনা, কিন্তু কংগ্রেসের ছিল । কাজেই ও পত্রলাপে কোনো কাজ হোলনা ।

    অথচ বাংলার আইন সভায় তার ব্যতিক্রম হোল । শরত্চন্দ্র এবং তাঁর দলের লোকেরা হক মন্ত্রীসভাকে এমন কোনো আইন করতে দিলেননা যাতে হিন্দু ও মুসলমানেদের আলাদা করে দেখা হয় । কর্পোরেশনে কজন মুসলমান সভ্য থাকবেন, সেটা নিয়ে উভয পক্ষের চুক্তি হতে পারে, আইন করলে চলবেনা । এদিকে হিন্দু মহাসভা আবদার করছেন যে মুস্লমানেদের কোনো বিশেষ স্থান দিয়ে চুক্তি করার তাঁরা ঘোর বিরোধিতা করবেন । শরত্চন্দ্র দেশের লোকেদের কাছে গিয়ে বলছেন যে




    ছবিগুলি পূষণ আইয়ুব ও লুবনা মরিয়ম-এর সৌজন্যে ।


  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)