• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩১ | অক্টোবর ২০০৩ | গল্প
    Share
  • আশ্রয় : হারিস মাহমুদ

    দরজাটা আমি সকাল থেকে খোলা রাখি । ভোরের সূর্য ওঠোন ছোঁবার আগে দাঁড়কাক ডাকে । নারকেল গাছের ডালে বসে ভূতোম পেঁচা ডানা ঝাপটায় । গোয়ালে লাল গাইটার ওলানে দুধের চাপে বেদনা নামে । সে ছটফট করে, কাঠের মেঝেয় খুট খুট শব্দ হয় । গাইটি গলা চিরে ডাকে । কাকে ডাকে সে, শুধু সে-ই জানে, আর আমি জানি । কিন্তু গাইটি যাকে ডাকে, সে আসে না আজ সকালে । আমি তবু আশায় আশায় দরজাটা খোলা রাখি । এই বাড়ি আমার নয়, এই ঘর আমার নয়, এই গাছপালা, এই লাল গাই, কেউ আমার নয় । তবু বুকের ভিতর অবিরাম কাঠঠোকরার মতো ঠুকরে ঠুকরে কেউ বলে, যার জন্য এই গাইটি অপেক্ষায় আছে সে আমার অত্যন্ত আপন, সে আর কারো নয়, সে কেবলই আমার । একান্ত আমার ।

    আমি দেখি রোদ হলুদ মোরগছানার মতো ওঠোনে লুটোপুটি খেয়ে চাল কুমড়ো কাঁঠাল গাছ শিমের মাচা পেরিয়ে বিস্তৃত হয়েছে হাওড়ের দিকে । কিন্তু মেয়েটি আসে না । লাল গাইটি অনেক ডাকে । জেগে ওঠা পৃথিবীর কোলাহলে তার ডাক আর খুব প্রকট মনে হয় না, তবু আমি তার কান্না শুনতে পাই । তার ওলানে বেদনা আমার হৃদপিণ্ডটাকে আঁকড়ে ধরে । কিন্তু মেয়েটি আসে না । আমার সারা রাত্রির অপেক্ষা ব্যর্থ হয়ে যায় । এখন আমার বুকের লাল কষ্টকে কে দোহন করবে ? আমি জানি না, কেউ জানে না ।

    রাখাল লাল গাইটিকে গোয়ালে রেখে বাকি গরু নিয়ে হাওড়ে চলে যায় । বাড়ির পাশে সরু ছায়ামজা পথ । সেই পথে নদী, নদীর পার ধরে দক্ষিণের পাহাড় অবধি বিশাল হাওড় । লাল গাইটির কান্না শোনা যায় না । শুধু আমি পুকুর ঘাটে বসে তার কান্না শুনতে থাকি ।

    গতকাল এই সময় সে পুকুর ঘাটে এসেছিল গাই দোহনের পর । সেই প্রথম আমি তার চোখে চোখ রেখেছিলাম । তার চোখের ভিতর গহন এক শান্তিময় পৃথিবী জেগে ছিল, আর সেই পৃথিবীতে আমি স্বপ্নময় ঘরবাড়ি দেখেছিলাম । তখন আশে পাশে কেউ ছিল না ।
    আমি বললাম, `তোমার নাম কি ?'
    সে খুব লাজুক কন্ঠে বললো, `রুবিনা ।'

    তার হাতে ছিল সবুজ আর নীল কাচের চুড়ি । পরনে ছিল গাঢ় সবুজ সূতির শাড়ি । পায়ে কোন জুতো ছিল না । কাটা চাঁদের মতো পায়ে সে হেঁটে চলে গেল বাড়ির ভিতর । আমার হৃদয়ে মেঘবরণ এক ছায়া ফেলে সে চলে গেল । সে কি জানলো আমার কি হলো ? আমার জ্বর উঠলো, চোখ থেকে ঘুম উধাও হলো । সারা রাত আমি ঘুমোতে পারলাম না । অপেক্ষা করতে থাকলাম কখন সকাল হবে, আর সে আসবে, গাই দোহন করবে, আর পুকুরঘাটে আসবে । গাই দোহনের সময় আমি দেখবো তাকে । সে ব্লাউজের গোলাপী আলোয় গাইটির ওলানে হাত রাখবে । মাটির পাতিল চেপে ধরবে দুই হাঁটুর মাঝখানে । আর ওলান থেকে দুধ নেমে আসবে বৃষ্টির মতো । সে কি জানে এক জোড়া চোখ কী অধীর বিস্ময় আর আকুলতা নিয়ে দেখতে চায় তাকে ? সে আজ আসে না । পুকুর ঘাটে সে আসে না । কোন্‌ পালঙ্কে, কোন্‌ শীতলপাটির ওপর ?

    সারাটা সকাল কান্নার পর গাইটি থামে । তুলাবিবি এসে দুধ দোহন করে । তুলাবিবিকে আমি চিনি । সে ঘরকন্নার কাজ করে । আমি কাছে গিয়ে দেখি গাইটির চোখ দু'টি কী এক প্রশান্তিতে বুজে আসছে ।
    আমি বলি, `গাইটি আজ খুব ডেকেছিল ।'

    তুলাবিবি এক নজর আমার দিকে তাকিয়ে আবার দুধ দোহন করতে থাকে । কোন কথা বলে না । আমিও আর জিজ্ঞেস করি না, কেন রুবিনা এলো না আজ । তুলাবিবি কাজ শেষ করে চলে যায় । আমি গোসল করতে পুকুরে নামি । পাথরের ঘাট, তার ফাঁকে ফাঁকে জলে ডোবা ঘাস । ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে গাঢ় খয়েরী রঙের জোঁক টহল দেয় । আমার ভয় হয় । যে কোন রক্তচোষা প্রাণীকে আমার ভীষণ ভয় হয় । জোঁকের ভয়ে আমি ইচ্ছেমতো গোসল করতে পারি না । পাখির মতো নিমেষে গোসল সেরে ঘরে চলে যাই ।

    এই বাড়িতে আমি মাসের বেশি কাটিয়ে দিই । শহরে যুদ্ধ চলছে । যেন সারা দুনিয়ায় যুদ্ধ চলছে । কেবল এই নিঝুম গ্রামটিতে কোন গুলির আওয়াজ নেই । সৈন্যদের টহল নেই । যুদ্ধ নিয়ে ভাবতে আমার ইচ্ছে হয় না । এই গ্রামের ভিতর শান্তি জেগে আছে তরুণীর হাতে মাখা মেহেদীর মতো । আমি শহরে ভয়ানক সন্ত্রাসের বীভত্স চেহারা দেখে পালিয়ে এসেছি । আর এই গ্রামে এসে আমি শান্তির দেখা পেয়েছি । এখানে জেগে আছে নদীর মতো শান্তি, ছায়া সুনিবিড় গাছপালার শান্তি, রুবিনার চোখেমুখেদেহে জেগে আছে অপার শান্তি । এই শান্তি বুকে নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই আমি ।

    এই বাড়ির কর্তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয় নৌকোয়, যে নৌকা আমাকে শহর থেকে গ্রামে নিয়ে এসেছিল । আমার তখন গন্তব্য জানা ছিল না । শুধু জানা ছিল আমাকে পালাতে হবে । শহরে কত শত লাশের মাঝে আমি পিতামাতাকে হারিয়ে ফেলি । তখন নিজের প্রাণ বাঁচাতে আমি আরো অনেক মানুষের সঙ্গে শহর থেকে পালাতে থাকি । আর পালাতে গিয়ে আমি শহরের বাইরে একটি নৌকায় চড়ে বসি । আমি কাঁদতে থাকি, বিতাড়িত শিশুর মতো আমি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যেতে থাকি কান্নায় । তেইশ বছরের যুবক এভাবে কাঁদে না, কিন্তু আমি কাঁদতে থাকি । আমার রক্তে আগুন জ্বলে উঠা উচিত ছিল, শত্রুর ওপর আমার ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত ছিল, অথচ আমি ওসব কিছুই করিনি । আমি ডুকরে ডুকরে মেয়েমানুষের মতো কাঁদছিলাম । তখন কে যেন আমার পিঠে হাত রেখেছিলেন । তিনি ছিলেন এই বাড়ির কর্তা বদর উদ্দীন । তিনিও শহর থেকে পালাচ্ছিলেন সেই নৌকোয় । আমার জন্য দু:খবোধ হলো তাঁর । তিনি বললেন, `কেঁদো না, তুমি আমার বাড়িতে থাকবে । সব ঠিক হয়ে যাবে ।' সেই দিন থেকে আমি তাঁর আশ্রয়ে আছি । কত বৃষ্টি হলো, কত রোদ উঠলো । আমার কষ্ট কমতে লাগলো । আমি আর কাঁদি না । কিন্তু আজ আমার কান্না পেলো রুবিনাকে দেখতে না পেয়ে ।

    আমি একটি বই খুলে জানালার পাশে বসি । দুপুরের খাবারের পর আমার বই পড়ে পড়ে ঝিমোতে ভালো লাগে । বদর উদ্দীন ঘরে ঢুকেন । তাঁকে খুব চিন্তিত মনে হয় । আমি বলি, `কিছু বলবেন ?'
    তিনি আমার বিছানার পাশে বসেন ।
    `কি আর বলবো, বাবা ? তুমি আমার মেয়েকে দেখেছো ? ওর খুব অসুখ ।'

    আমি জানি না কে তাঁর মেয়ে । তিনি তাঁর পরিবারের সবাইকে আমার সঙ্গে পরিচয় করে দেননি । আমি বাইরের ঘরে থাকি, রাখাল ছেলেকে চিনি, তুলাবিবিকে দেখেছি, আর রুবিনা তাঁর মেয়ে কিনা আমি জানি না । কিন্তু আমার জানতে ইচ্ছে হলো রুবিনা কি তাঁর মেয়ে । কেন যেন ইচ্ছেটাকে দমন করে জিজ্ঞেস করি, `কি অসুখ হয়েছে ? ডাক্তার দেখানো যায় না ?'

    তিনি মাথার টুপি খুলে ডান হাতের আঙ্গুলে মাথা চুলকোন । মাথার অর্ধেকটায় চুল নেই । বাকিটাতে সাদা-কালো চুল । মুখে চাপা দাড়ি । তার চোখ দু'টি খুব চিন্তিত, খুবই কাতর ।
    `এ ডাক্তার দেখানোর অসুখ নয় । বড় বিপদ আমাদের । তুমি দোয়া করো আমাদের জন্য ।'

    তার কথা আমাকে খুব পীড়িত করে । তিনি বেরিয়ে যান ভিতর বাড়ির দিকে । প্রচণ্ড রোদে জ্বলছে পৃথিবী । অথচ কোথাও আগুন ধরছে না । ওঠোনে শিমের মাচা । দক্ষিণ কোণে মস্ত বড় আমগাছ । আমগাছের ডালে বুলবুলি পাখির ডাক । ওদিকে পুকুর । পুকুরের নীরব নিস্পন্দ পানির ওপরে নীল ফড়িঙের ওড়াওড়ি । পুকুরের পশ্চিম পাশে ক্ষেতের মাঠ । ক্ষেতের ওপারে নদী । নদীর ওপারে হাওড । আর বিশাল দিগন্ত । সব যেন ঠিক আছে, সুনসান আছে । শুধু আমার বুকের ভিতর কী যেন গলে যেতে থাকে প্রচণ্ড উত্তাপে ।

    রুবিনা কি তাঁর মেয়ে ? কি অসুখ তাঁর মেয়ের ? আমি পুকুর পারে পেয়ারা গাছের ছায়ায় বসে আকাশের দিকে তাকাই । আকাশের গভীর শূন্যতায় বৃত্তাকারে ওড়ে এক চিল । তার দিকে তাকিয়ে আমার নিজেকে খুব ছোট মনে হয় । আমি যেন এই মুহূর্তে এক অন্ধকার গর্তের মধ্যে বন্দী হয়ে আছি

    আমার ইচ্ছে হয় কোথাও যাই । হাটে যাওয়া যায় । ওখানে একটি ফার্মেসী আছে । ফার্মেসীর মালিক রকিব ভাই । তিনি যুদ্ধের খবর রাখেন । সন্ধের পর হাইস্কুলের হেডমাস্টারও এসে বসেন । যুদ্ধের আর রাজনীতির বিষয়ে আলাপ হয় । রাশিয়া আর ভারতের সঙ্গে মার্কিন বিবাদের উত্স নিয়ে তর্ক হয় । আমি চুপচাপ বসে থাকি । কোন মন্তব্য করি না ।
    আমি হাঁটতে হাঁটতে ফার্মেসীতে যাই । চেয়ারে পা তুলে সিগারেট টানছেন রকিব ভাই । আমাকে দেখে খুশি হন ।
    `কেমন আছো, ভাই ? বসো, এখানে বসো ।'

    তাঁর পাশের চেয়ারটা এগিয়ে দেন আমাকে । আমি বসতে বসতে দেখি খেয়ানৌকাটি ওপারে যাচ্ছে । কোন যাত্রী নেই । মাঝির মাথায় ছাতা । নিঝুম হয়ে আছে গোটা গ্রাম । দশ-বারো বছরের একটি ছেলে এসে ছয় টাকার নোবালজিন নিয়ে যায় ফার্মেসী থেকে ।
    `যুদ্ধের নতুন খবর শুনেছো ? মুক্তিযোদ্ধারা শেরপুরের ব্রীজটা উড়িয়ে দিয়েছে ।'

    আমি রকিব ভাইয়ের দিকে কোন অভিব্যক্তি না দেখিয়ে তাকিয়ে থাকি । আমি যুদ্ধের খবর রাখি না । আমার বোধহয় খবর রাখা উচিত । আমি মাঝে মাঝে অনুভব করি যে, আমার যুদ্ধে যাওয়া উচিত ছিল । ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে এসে আমার উচিত ছিল শত্রুর ওপর আক্রমণ করা । আমি জানি না কেন যুদ্ধে যাইনি আমি । প্রাণের ভয়ে ? মৃত্যুর ভয়ে ? অথচ আমি তো এখন অনুভব করি রুবিনার জন্য প্রাণ দিতে আমি দ্বিধা করবো না । তবু আমি বাবা ও মায়ের লাশের মতো অসহায় এই প্রশ্নের কাছে । আমি রুবিনাকে নিয়ে ভাবি । আমি মগ্ন হয়ে যাই নদীর দিকে তাকিয়ে । রুবিনার কি হয়েছে ? কবে আবার দেখতে পাবো ওকে ? রকিব ভাই আমার কাঁধে হাত দিয়ে বলেন, `কি ভাবো তুমি ?'
    আমি লজ্জা পেয়ে যাই । তাকিয়ে দেখি হেডমাস্টার সাহেবও বসে আছেন এক পাশে ।

    সবার দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলি না । হেডমাস্টার সাহেব জিজ্ঞেস করেন, `রফিক আর এসেছিল নাকি ?' আমি রফিককে চিনি না তাই বোকার মতো তাকিয়ে থাকি তাঁর দিকে ।

    ` তুমি বোধ হয় চেনো না তাকে । বদর উদ্দীন বলেন নাই তোমাকে । সে ওর ভাগ্নে, মুক্তিযুদ্ধে গেছে । ওঁর বাড়িতে থাকতো । মাঝে মধ্যে সে আসে ।'

    আমার বুকের ভিতর আরেকটা দরজা খুলে যায় । একজন মুক্তিযোদ্ধা যে বাড়িতে ছিল সে বাড়িতে আমি আছি । এ এক আশ্চর্য অনুভূতি । আমার বুকের ভিতর একটি পাখি গান গাইতে থাকে, আরেকটি পাখি কেন যেন ঠোকর মারতে থাকে ।

    সন্ধে নামে । ঘাট থেকে একের পর এক নৌকা চলে যায় । মানুষজন চলে যায় । আর শূন্যতা জুড়ে নেয় হাটের বুকখানা । ঘরে ফিরে এসে অনেক রাত অবধি আমার ঘুম আসে না । বারান্দায় বসে থাকি । মেঘে ঢাকা চাঁদের ফিকে জ্যোত্স্নায় পৃথিবীকে ভুতুড়ে দেখায় । মাঝে মাঝে মর্টারের ক্ষীণ শব্দ ভেসে আসে । ভিতর বাড়িতে হঠাৎ কান্নার রোল শোনা যায় । আমার বুকের ভিতর আঘাত পড়ে । রুবিনার কিছু হয় নাই তো ? বদর উদ্দীনের সাথে একজন লোক আসে । লোকটি পুকুর পার ধরে নদীর দিকে চলে যায় । আমি তার চেহারা ভালো দেখতে পাই না । বদর উদ্দীন আসেন আমার দিকে ।
    `কি বাবা, এখনো জেগে আছো ?'
    খুব চিন্তিত দেখায় তাকে । এই আধো অন্ধকারেও তাঁর কপালে ভাঁজ দেখা যায় ।
    `কি হয়েছে ? কান্নার শব্দ শুনলাম ।'
    আমরা ঘরে ঢুকে তিনি চেয়ারে বসেন ।
    `শোন বাবা, তোমাকে আগে বলি নাই । আমার ভাগ্নে রফিক মুক্তিযুদ্ধে গেছিল । সে আর নাই । কয়দিন আগে শহিদ হয়েছে ।'
    আমার খুব ভয় লাগে । তাঁকে কি সান্ত্বনা দেবো বুঝতে পারি না ।
    `আপনার মেয়ে কেমন আছেন ?'
    আমি বিছানায় বসি । তাঁর চোখে পানি ছলছল করে ।
    `রুবিনা খুব কাঁদছে । রফিকের সঙ্গে ওর বিয়ের কথা ছিল ।'

    একটি দীর্ঘশ্বাস থমথমে করে দেয় সারাটা ঘর । একজন মুক্তিযোদ্ধার জন্য কাঁদছে রুবিনা । আর রুবিনার জন্য নদীর মতো কাঁদছে আমার হৃদয় । বাইরে অন্ধকার । পাখির ডানার শব্দ আর শেয়ালের ডাক শোনা যায় । কুকুর চিত্কার করে । বদর উদ্দীন নীরবে বসে থাকেন । চোখ বন্ধ করে অনেকক্ষণ কি যেন ভাবেন । আমি শক্ত হয়ে বসে থাকি ।
    `তুমি আমাদের ছেড়ে কখনো চলে যেও না, বাবা ।'

    আমি চমকে উঠি । তাঁর কথাগুলি বাষ্পায়িত । আমি স্বভাবত কিছু বলতে পারি না । তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি । বুকের ভিতর আমার নদী ফুলে উঠে । তিনি দাঁড়িয়ে গেলে আমিও দাঁড়িয়ে যাই । আচমকা তিনি আমার হাত দু'টি জাপটে ধরে তাঁর বুকে তুলে নেন ।
    `তুমি আমার মেয়েটিকে বিয়ে করবে, বাবা ? রুবিনাকে বাঁচাবে ?'

    সীমান্ত থেকে মর্টারের শব্দ আসছে । ভিতর বাড়িতে কেউ যেন এখনো কাঁদছে । আমি কি বলবো তড়িৎ ভাবতে পারি না । রুবিনাকে বাঁচাবার জন্য আমি যে-কোন ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত । তবু খুঁটিয়ে ভাববার সামর্থ্য যেন আমার নেই । আমি বদর উদ্দীনের হাত ধরে বলে ফেলি, `হ্যাঁ, আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি আছি ।'

    বদর উদ্দীন আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন । আমি অনুভব করি তাঁর বুকে অনেক উত্তাপ, অনেক শক্তি জেগে উঠেছে । আমার খুব ভালো লাগে ।

    আমাদের বিয়ে ঠিক হয়ে যায় । বিয়ের আগের দিন খুব বৃষ্টি হয় । সাথে ঝড়ো হাওয়া বইতে থাকে । পুকুর পারে অনেক কলা গাছ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে । কদম গাছের কয়েকটি ডাল ভেঙ্গে পুকুরে পড়ে যায় । সেদিন সন্ধ্যায় রুবিনা আসে আমার ঘরে । সে এসে হ্যারিকেনটা জ্বালিয়ে দেয় । আর হ্যারিকেনের মৌন আলোয় তার মুখটা ভেসে উঠে সন্ধ্যামালতীর মতো । তার চোখ দু'টি আর নাচে না প্রজাপতির মতো, বৃষ্টিশেষের দীঘির মতো কেবল টলমল করে ।

    আমি জানি না কি বলে তাকে অভিবাদন করবো । একজন নিহত মুক্তিযোদ্ধার প্রিয়তমা সে, তাকে কি বলে ডাকবো আমি জানি না । আমি তাকে চেয়ার এগিয়ে দিই ।
    `বসো ।'

    সে চেয়ারে বসে সম্রাজ্ঞীর মতো মাথা তুলে তাকায় আমার দিকে । রফিক যদি আজ বেঁচে থাকতো, আর যুদ্ধশেষে দেশে ফিরে দাঁড়াতো রুবিনার সামনে, কী সুন্দর দেখাতো দু'জনকে । আমার শরীর শিউরে উঠে । আমি রুবিনার হাত ধরে হাঁটু গেড়ে বসে যাই তার সামনে ।
    `তুমি কি আমাকে ভালোবাসো, রুবিনা ? আমি কি তোমার যোগ্য ?'

    রুবিনা কিছু বলে না । তার চোখ টলমল করে । পানি চিকচিক করে তার চোখের ভিতর । আমি শাড়ির আঁচলে তার চোখ মুছে দিই । আমি জানি না সে কেন কাঁদছে । রফিককে মনে পড়ছে তার ? রফিকের কোন চিহ্ন আমি দেখি না কোথাও । রুবিনা নিশ্চয় দেখে । কিন্তু একদিন রফিকের চিহ্ন কোথাও থাকবে না, কোন দেয়ালে কোন মানবদেহে কোথাও না । হৃদয়ের গায়ে যে দাগ আছে সেও ক্ষয়ে ক্ষয়ে সময়ের ঝাপটায় মুছে যাবে । রুবিনা আমার দিকে তাকায় ।

    `রফিক ভাইকে আমি কোনদিন ভুলতে পারবো না । তবে আপনাকে আমি চিরকাল ভালোবাসবো । আপনি আমার একান্ত আশ্রয় । আপনার আশ্রয় না পেলে আমি নদীতে ডুবে মরে যাবো ।'

    আমি রুবিনাকে বুকে জড়িয়ে ধরি । একটি অবোধ কপোতের মতো সে মিশে থাকে আমার বুকের ভিতর । আমি জানি না কেন সে আমাকে এতো বড়ো করে দেখে । কী এমন আশ্রয় আমি তার জন্য ? আমার তো কিছু নেই । পলাতক একজন মানুষ আমি, আশ্রয় পেয়ে বেঁচে আছি তাদের ঘরে । ঝড়ের হাওয়ায় দুলতে থাকে পেয়ারা গাছের ডাল, আমার হৃদয় এখন ঐভাবে দুলতে থাকে । আমার বুকে রুবিনা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে আবার ।
    `বলুন, আপনি কখনও যুদ্ধে যাবেন না ।'
    আমি তার মুখ তুলে অপলক চেয়ে থাকি তার চোখের ভিতর ।
    `না, আমি তোমাকে ছেড়ে কখনও যুদ্ধে যাবো না ।'

    রুবিনা চলে গেলে আমি দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ি । টিনের চালে নিঝুম বৃষ্টি হয় । আমি সারারাত শিশুর মতো ঘুমোই । সকালে উঠে দেখি রাঙ্গামাটির নির্জলা বালুকার মতো লাল হয়ে আছে দিন । রাখাল ছেলেটি এসে বলে, `নদী দিয়ে লাশ ভেসে যাচ্ছে, যাবেন নাকি দেখতে ?' আমার ইচ্ছে ছিল রুবিনাকে একটিবার দেখি । কিন্তু কি মনে করে আমি দৌড় দিই নদীর দিকে । নৌকায় করে নদীর মাঝখানে গিয়ে দেখি তিনটি লাশ ভেসে যাচ্ছে । সুন্দর ফর্শা স্বাস্থ্যবান তিনটি লাশ । কেউ বলে এগুলি হানাদার বাহিনীর লাশ । মুক্তিযোদ্ধার হাতে নিহত হয়ে ভেসে যাচ্ছে নিয়তির টানে । একটি লাশের শরীর ছিল সম্পূর্ণ নগ্ন । কার একটি কুকুর নৌকা থেকে লাফ দিয়ে চড়ে উঠে লাশের উপর । কুকুরটি খেতে থাকে লাশটির মাংশ । আমার খুব খারাপ লাগে । খুব বমি ভাব হয় । তবে বমি হয় না ।

    কয়েকদিন পর খুব অনাড়ম্বর পরিবেশে আমাদের বিয়ে হয়ে যায় । টুপটাপ বৃষ্টির মধ্যে আমি ও রুবিনা কবুল করি পরস্পরকে । রাতে বৃষ্টি থেমে গেলে হাওড়ের ঘোলা পানির ওপর প্রকাণ্ড এক চাঁদ উঠে । কিন্তু আমার বিছানায় যে চাঁদ বসে আছে, সে আকাশের ওই চাঁদের চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর । এই অনিন্দ্যসুন্দর রাতেও মর্টারের শব্দ ভেসে আসে । শেষ রাতের দিকে রুবিনার তলপেটে খুব ব্যাথা হয় । কষ্টে সে শুয়ে থাকতে পারে না । আমি বুঝতে পারি না কেন এই ব্যাথা হয় । আমি কি করতে পারি তার ব্যথা লাঘব করার জন্য ? মেয়েমানুষের শরীর আমার কাছে সম্পূর্ণ এক অচেনা জগৎ । আমার উদ্বেগ দেখে রুবিনা কষ্টের মধ্যেও হেসে ওঠে । কিন্তু তার চোখ থেকে বড় দু'ফোটা পানি উপচে পড়ে গালের ওপর । তবু কোন মিনতি ছাড়াই সে আমার বুকে মুখ লুকিয়ে শুয়ে পড়ে । আমরা দু'জন ঘুমিয়ে যাই ।

    যুদ্ধ চলতে থাকে । মাসের পর মাস যুদ্ধ চলে । কেউ বলে পাকিস্তানীরা আর পারছে না । পিছু হটতে শুরু করেছে । নদী দিয়ে আরো লাশ ভেসে গেছে । আমি আর লাশ দেখতে যাইনি । একদিন খবর আসে পাকিস্তানী সৈন্যরা পাশের একটি গ্রামে এসে আগুন ধরিয়েছে । মানুষজনকে বিনা কারণে মারধোর করেছে । কলেজে পড়ে একটি যুবককে হত্যা করেছে । আমরা ভয় পেয়ে যাই এই খবর শুনে । মাঝেমাঝে রাতে কাক ডাকে । মসজিদের পাশের ঝাউগাছে রাতে পাখিরা তুমুল চিত্কার করে । আমি জানি না কেন এ রকম হয় ।

    রুবিনা গর্ভবতী । ওর শরীরটা এখন চোখে পড়ার মতো । একটি মানবশিশু ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে ওর ভিতরে । রুবিনাকে এখন খুব উদাস দেখায় । সে আগের মতো বেশি কিছু বলে না । ওর মাকেও উদ্বিগ্ন মনে হয় । আমি খুব ভাবি না । কেবল সন্তানের আগমনের অপেক্ষায় থাকি । রুবিনা খুব ক্লান্ত থাকে । সে ঘুমিয়ে গেলে আমি তার পাশে শুয়ে পেটে হাত বুলিয়ে দিই । কখনও টের পাই তার পেটের ভিতর শিশুটি নড়ছে । বেশি নড়লে রুবিনার ঘুম ভেঙ্গে যায় । বোধ হয় শিশুটির হাত-পায়ের খোঁচায় ওর কষ্ট হয় । আমি রুবিনার গালে ও কপালে চুমু খাই । ও আবার ঘুমিয়ে যায় । আমিও ঘুমিয়ে যাই ।

    খুব ভোরবেলা একদিন দরজায় কড়া নাড়েন রুবিনার বাবা । দরজা খুলে দিলে তিনি তটস্ত হয়ে ঘরে ঢোকেন । খুব উদ্বিগ্ন দেখায় তাঁকে । রুবিনা ঘুমিয়ে আছে তখনো । আমার দিকে কয়েক মুহূর্ত অপলক তাকিয়ে থাকেন ।

    `খবর পেয়েছি সৈন্যরা যে-কোন দিন আসতে পারে । ওরা আসলে খুব খারাপ হবে । বুঝতে পারছি না কি করবো ।' তাঁর কন্ঠস্বরে ভীতি দানা বেঁধে আছে ।

    আমিও আঁতকে উঠি । আবার পালাতে হবে ? শহর থেকে পালিয়ে এসেছি গ্রামে । এখন কোথায় যাবো ? আমি আর পালাতে চাই না । রুবিনাকে নিয়ে আমি এখানে অনন্তকাল থাকতে চাই ।

    `চিন্তা করবেন না । আমরা এখানেই থাকবো । কিচ্ছু হবে না আমাদের ।' এই নিশ্চিত সাহস কোথা থেকে আসে আমার বুকের ভিতর আমি নিজেই এই সময় বুঝতে পারি না ।

    ওঠোনের এক পাশে গোয়ালঘর । তার দক্ষিণে খালি একটু জায়গা । কিছু লাকড়ি আর খড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে । আম গাছের ছায়া পড়ে এখানে । এই জায়গায় আমি আর রাখাল ছেলেটি সারারাত মাটি খুঁড়ে বড় একটি বাংকার তৈরি করি । দৈর্ঘ্যে প্রস্থে অনেক বড় । জন তিনেকের জায়গা হবে । আমি একটি পানি ভর্তি বালতি আর কয়েকটি মোমবাতি রাখি বাংকারের ভিতর । শীতলপাটি কেটে বিছিয়ে দিই মেঝেয় । আর ওপরটা আগের মতো ঢেকে রাখি লাকড়ি আর খড় দিয়ে । মনেই হয় না এখানে কোন বাংকার আছে ।

    রুবিনার দিন ঘনিয়ে আসছে । নয় মাস হয়নি তবু ওকে বেশ মলিন আর ভারি দেখায় । চোখ দু'টি খুব কাতর মনে হয় । ওর মায়ের খুব চিন্তা হয় ওকে নিয়ে । রাত্রিবেলা প্রায়ই তিনি ওর পাশে থাকেন ।

    সকালবেলা কেউ এসে বলে হাটে এসে পাকিস্তানী সৈন্যরা তুলকালাম কাণ্ড বাঁধিয়েছে । সবাইকে জিজ্ঞেস করছে, রফিক কোথায় ? কয়েকটি দোকানে আগুন ধরিয়েছে । রকিব ভাইকে খুব পিটিয়েছে । লোকজন গ্রাম ছেড়ে পালাতে শুরু করেছে । আমি রুবিনাকে বাংকারের নিচে শুইয়ে রাখি । রাখাল গরু নিয়ে হাওড়ে চলে যায় । তুলাবিবি, আমার শাশুড়ী আর আমি বাংকারে আশ্রয় নিই । আমরা বাংকারে ঢুকে গেলে বদর উদ্দীন ওপরটা আগের মতো লাকড়ি আর খড় দিয়ে ঢেকে দেন । তারপর তিনি মসজিদে নামাজ পড়তে চলে যান । হাওড়ে গিয়ে রাখাল বারবার গ্রামের দিকে তাকিয়ে থাকে । গরুগুলিও ঘাস খাওয়া ফেলে ধোঁয়াচ্ছন্ন গ্রামের দিকে তাকিয়ে থাকে ।
    সৈন্যরা মসজিদ থেকে বদর উদ্দীনকে ধরে বাড়িতে নিয়ে আসে । ওরা বারবার তাঁকে জিজ্ঞেস করে, `রফিক কোথায় ?'
    তিনি বারবার বলেন `ও নেই । ও চলে গেছে । কোথায় গেছে আমি জানি না ।'

    ওরা বদর উদ্দীনকে বিশ্বাস করে না । অবশেষে আকাশে গর্জন ওঠে, মনে হয় আকাশ ফেটে গেছে । রুবিনা ভয়ে কাঁপতে থাকে । ওর তলপেটে ব্যথা ওঠে, পানি নামতে শুরু করে । বুকের মধ্যে কান্না চেপে বলে, `আম্মা, আমার খুব ব্যথা করে ।'

    আমি অদূরে বসে কাঁপতে থাকি । তুলাবিবি ওর পেটে হাত বুলিয়ে দেয় । মুখে পানির ছিটা দেয় । মোমবাতির আধো আলোয় রুবিনাকে খুব কাতর দেখায় । ব্যাথায় ওর শরীর কেঁপে কেঁপে ওঠে ।

    ধোঁয়ার গন্ধ এসে নাকে লাগে । ওপরে আগুন জ্বলছে, আগুনের শাঁ শাঁ শব্দ ছাড়া আর কোন আওয়াজ নেই কোথাও । আমি রুবিনার কাছে আসি । ওর কানে মুখ নামিয়ে বলি, `তুমি ভয় পেও না ।'
    নি:শব্দ চিত্কারে ওর শরীর মোচড় দিয়ে ওঠে । যেন ও শরীরের সর্বস্ব ঠেলে বাইরে আনতে চাচ্ছে ।

    একটি অচেনা অদ্ভুত কান্নার আওয়াজে আমি চমকে উঠি । তাকিয়ে দেখি আম্মার হাতে আধো আলোয় জলমগ্ন নক্ষত্রের মতো দপ্‌ দপ্‌ করছে আমার আর রুবিনার সন্তান । এখন বাইরে আর কোন শব্দ নেই । কোথাও কোন শাঁ শাঁ আগুন নেই । রাখাল এসে ডাক দিলে আমরা বেরিয়ে আসি । আম্মার কোলে শিশুটি চিত্কার করে । যেন গোটা পৃথিবীকে জানিয়ে দিতে চায় যে সে এসেছে । কিন্তু বদর উদ্দীনের লাশ দেখা মাত্র আম্মা হাহাকার করে ওঠেন । তার কান্নায় যেন আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নেমে আসে । রুবিনাকে ঘরে নিয়ে আমি বিছানায় শুইয়ে দিই । পাড়া প্রতিবেশী এসে ভিড় করে বাইরে । সন্ধ্যা নামে । বদর উদ্দীনকে আমরা দাফন করে ফিরতে রাত ঘন হয়ে আসে । আমার খুব কান্না পায় তাকে যখন কবরে নামিয়ে রাখি । তাকে আর কোন দিন দেখতে পাবো না । আমি তার মুখের ওপর কাফনে একটি চুমু দিই । যেন আমি শুনতে পাই তিনি আমাকে বলছেন, `আমাদের ছেড়ে তুমি কোন দিন চলে যেও না, বাবা ।'

    ঘরে ফিরে দেখি রুবিনা ঘুমিয়ে গেছে । আর তার পাশে আম্মা তার নাতিকে কোলে নিয়ে গুনগুন করে দুরুদ পড়ছেন ।


  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)