রাস্তায় একটা বাজার পড়ে, সেটা ছাড়িয়েই একপাশে একটা বড় ডাস্টবিন । কর্পোরেশনের ময়লার লরি এসে ঐ ডাস্টবিনের জঞ্জাল তুলে নিয়ে যায় । লরির আসার কথা শেষরাতে, কিম্বা খুব ভোরে । মাঝে মাঝে দেরিও হয় । সকাল নটার সময় বিরাট চেহারার লরি দাঁড়িয়ে থাকে রাস্তার পাশে, আর লরির মজদুররা বেলচা দিয়ে জমে থাকা ময়লার স্তূপ লরিতে তোলে । তখন পুরোদস্তুর অফিসটাইম । লরি রাস্তার অনেকটা জায়গা জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকে বলে তার সামনে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে বাস, মিনিবাস, গাড়ি, ট্যাক্সি । উল্টোদিক থেকে আসা গাড়ির স্রোত একটু কমলে তবেই ঐ দাঁড়িয়ে থাকা লরিকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়া যাবে । দু একটা দু:সাহসী অটোরিক্সা এদিক ওদিকের ফাঁক দিয়ে গলে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করে - তাতে করে ট্রাফিক জ্যামটা আর একটু বাড়ে । অফিসযাত্রীরা তাদের অফিসে পৌঁছতে দেরি হয়ে যাবে, তা ভাবতে ভাবতে আর গরমে ঘামে - তারই ফাঁকে দেখতে পায় ঐ লরির ড্রাইভার তার গাড়ির বনেটের পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে নির্বিকার মুখে বিড়ির ধোঁয়া ছাড়ছে ।
ডাস্টবিনের পরেই রাস্তাটা থেকে আর একটা ছোটো রাস্তা বেরিয়ে এঁকে বেঁকে ভেতরে চলে গেছে । একটু ভেতরে ঢুকেই রাস্তাটা সরু হয়ে গেছে - গাড়ি ঢোকে না । একটা সাইকেল রিক্সা হয়তো কোনোরকমে যেতে পারে । এ রাস্তায় পিচও বেশিদূর নেই । এই পঞ্চাশ গজ খানেক ভেতরে ঢুকেই ইঁট বসানো মাটির রাস্তা । জায়গায় জায়গায় ইঁট উঠে গিয়ে গভীর গর্ত । সাবধান হয়ে না হাঁটলে ঐ গর্তে পড়ে পা মচকে যেতে পারে, বেশি বেকায়দায় পড়লে ভাঙতেও পারে । রাস্তার দু ধারে খোলা নর্দমা, তাতে কালো থকথকে নোংরা জলের স্রোত । নর্দমার ঠিক পাশের থেকেই বাড়িগুলো উঠেছে । ছোটো ছোটো একতলা বাড়ি - বেশিরভাগই দরমার দেয়াল, টালির চাল । কয়েকটা ইঁটের বাড়িও আছে । সেগুলোর চেহারা সবই মোটামুটি একরকম । পলেস্তারা খসে গিয়ে ইঁটগুলো দেয়ালের জায়গায় জায়গায় বিশ্রীভাবে বেরিয়ে আছে । জানালার কাঠের পাল্লা, দরজার কাঠ সব রঙ ওঠা, জলে ভিজে ভঙ্গুর চেহারা । মনে হয় হাতের একটা চাপ দিলেই মড়মড়িয়ে ভেঙ্গে পড়বে ।
আজ সকালেও বাসের রাস্তাটায় ট্রাফিক জ্যাম । তবে কারণটা আলাদা । আজ কর্পোরেশনের লরি দাঁড়িয়ে নেই । গলির মুখটায় পুলিশের জীপ দাঁড়িয়ে আছে । একটা ঢাউস চেহারার লরিও দাঁড়ানো । তার উইণ্ডস্ক্রীনের ওপর স্টিকার লাগানো - অন পোলিস ডিউটি । বেশ কিছু গাড়িও রয়েছে - বেশিরভাগ খবরের কাগজ বা টেলিভিশনের লোকদের । গলির ভেতর খানিকটা ঢুকে একটা হাড় বার করা ইঁটের বাড়ির সামনে লোকে লোকে ঠাসবোঝাই । পাড়ার লোক, পুলিশের উর্দি পরা লোক, মিডিয়ার লোক - কে নেই সেখানে । বাড়িটার ঠিক পাশেই একটা টিউবওয়েল, এই ভিড় ঠেলে সেখানে যাওয়া যাচ্ছে না । পাড়ার মেয়েরা নিজেদের বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে কি হচ্ছে তা দেখার চেষ্টা করছে । কোনো কোনো বাড়ির দরজা বন্ধ - কিন্তু তার জানালা খোলা । তাতে দু তিনজন কৌতূহলী মহিলার মুখ ভিড় করে আছে । মিডিয়ার পক্ষ থেকে যারা এসেছে তাদের কারোর কাঁধে ক্যামেরা, কারোর বা হাতে মাইক । চটপটে চেহারার একটি সাংবাদিক যুবতী তার এক সহকর্মীর কাঁধে এক হাতের ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । মেয়েটির পরনে টপ আর জীনস - এমনিতে সুদর্শনা, আপাতত মুখটা ব্যাথায় একটু বিকৃত । বেচারির উঁচু হিলের জুতো পরা পা একটু আগেই একটা ইটের গর্তে পড়ে গিয়েছিল ।
কয়েকজন পুলিশ অফিসার বেরিয়ে এলেন ঐ বাড়ির থেকে । পেছনে দুজন উর্দি-পরা ডোম, তারা একটা স্ট্রেচার বয়ে নিয়ে এসেছে - তাতে একটা মানুষের শরীর শোয়ানো, পা থেকে মাথা পর্যন্ত সাদা কাপড় মুড়ি দেওয়া । পুলিশের লোকজন রূঢ়ভাবে ভিড় সরিয়ে দিতে লাগল আর ডোম দুজন স্ট্রেচার নিয়ে সোজা গিয়ে তুলল ঐ পুলিশের লরিতে । স্ট্রেচারের পেছনে যাচ্ছিলেন রোগা বেঁটে গালভাঙা টাক পড়া একজন বুড়ো লোক, পরনে ধূতি আর পাঞ্জাবি - পাঞ্জাবির ফাঁক দিয়ে গলার কন্ঠির মালা দেখা যাচ্ছে । মিডিয়ার লোকজন ভিডিও ক্যামেরায় সব ছবি তুলে নিচ্ছিল, সাংবাদিকরা ঐ বৃদ্ধের মুখের সামনে মাইক বাড়িয়ে ধরে বলছিল, বলুন, আমাদের সব বলুন - কখন আপনার ছেলেকে ঐ অবস্থায় দেখলেন -
বৃদ্ধ ফ্যালফ্যাল করে তাদের দিকে তাকাতে তাকাতে হাঁটছিলেন । কিন্তু কোনো কথা বলতে পারলেন না । গিয়ে উঠলেন ঐ পুলিশের লরিতে । তার সঙ্গে উঠল পাড়ারই কিছু লোক । একটি অল্প বয়স্ক যুবক রুক্ষভাবে সাংবাদিকদের বলল, আর কিছু জিজ্ঞেস করে বাবাকে বিরক্ত করবেন না ।
যুবকটির গলার আওয়াজ পেয়ে লরির ভেতর থেকে পাড়ার একজন লোক তাকে ডেকে বলল, সান্টু, আয় আয়, তাড়াতাড়ি উঠে পড় । দেরি হয়ে গেলে ডাক্তার বেরিয়ে যেতে পারে । তাহলে আজ আর কাটাছেঁড়া হবে না । বাড়ি ফেরৎ পেতে পেতে সেই কালকে । তাই শুনে যুবকটি তাড়াতাড়ি লরিতে উঠে পড়ল । স্টার্ট দিয়ে লরি বেরিয়ে গেল - সেই সঙ্গে পুলিশের জীপ । ভিড় কমতে লাগল এবার । ঐ সাংবাদিক যুবতীটিও নেংচে নেংচে গলির মোড় পর্যন্ত এসে ওদের গাড়িতে উঠে পড়ল । উঠবার আগে খালি একবার বলল, ওহ গড্, কি ব্যাথা করছে পায়ের পাতাটা ।
খুব তাড়াতাড়িই খালি হয়ে গেল জায়গাটা । যেসব মহিলারা ভিড়ের জন্যে টিউবওয়েলের কাছে যেতে পারছিলেন না তারা এবার হাতে বালতি নিয়ে টিউবওয়েলের চারপাশে ভিড় করলেন । আগে জল নেওয়া নিয়ে দু জনের ভেতর ছোটোখাট ঝগড়াও হয়ে গেল একটা ।
পেছনের একটা পোড়ো জমিতে কয়েকটা বাচ্চা ছেলে কাঁচের মার্বেল দিয়ে গুলি খেলছিল । একটা ছেলে আর একজনকে বলল, এই জগা, তুই তো ভেতরে ঢুকেছিলি । মালটাকে দেখেছিস ?
জগা বলল, হ্যাঁ দেখেছি । সিলিং ফ্যানের থেকে চাদরের ফাঁস দিয়ে ঝুলছিল ।
অন্য ছেলেগুলো ওকে ঘিরে ধরল । বলল - দেখা, দেখা, কি ভাবে ঝুলছিল ।
জগা বলল, এইভাবে । বলে ঘাড় কাৎ করে চোখ পাকিয়ে জিভ বার করে দিল, একটা হাত গলায় রেখে বোঝাল গলায় ফাঁস বাঁধা দিল ।
হি হি করে হেসে উঠল ছেলেগুলো । তারপর ওরা গুলি খেলতে লাগল । খেলবার সময় একজন জগার মাথায় একটা থাবড়া বসিয়ে দিলে জগা শুকনো চোখে পরিত্রাহি চেঁচাতে লাগল, মা-আ-আ, দ্যাখো না - আমায় মারছে - আমায় মারছে -
কোনোরকমে বাসের দরজায় এসে সিঁড়িতে দাঁড়াল মানব । এর পরের স্টপেজটাতেই ও নামবে । বাসটা কিন্তু সেখানে থামল না । খালি গতিটা একটু কমে এল ।
দরজায় দাঁড়ানো বাসের কণ্ডাক্টার মানবকে তাড়া লাগায় - নামুন, নামুন, নেমে যান এবার ।
বাসটা তো চলছে । মানব অসহায় ভাবে কণ্ডাক্টারের দিকে তাকায় । বলে, ভাই, বাসটাকে একটু দাঁড় করান । আমার একটা পা কমজোরী আছে ।
কণ্ডাক্টার ওর পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখল । তারপর বাস থামাবার জন্যে দরজার গায়ে দুমদুম করে মেরে চেঁচিয়ে ড্রাইভারকে বলল - আস্তে, একদম আস্তে । ল্যাংড়া নামবে - ল্যাংড়া ।
এবার বাসটা থামল, কিন্তু রাস্তার একেবারে মাঝখানে । দরজার প্রায় গা-ঘেঁষে বাসের বাঁদিক দিয়ে হুশ হুশ করে গাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে । অসহিষ্ণু কণ্ডাক্টার প্রায় ঠেলেই মানবকে নামিয়ে দিল । তারপর আবার দরজার গায়ে দুমদুম করে পিটিয়ে বলল, চলো - চলো ।
বাসটা মানবের পেছনের দিক দিয়ে বেরিয়ে গেল - ঠিক সেই সময়েই ওর সামনে দিয়ে চলে গেল একটা মিনি বাস । এগ্জস্ট পাইপ থেকে বেরোন ঘন কালো ধোঁয়া ওর নাকমুখ ভরিয়ে দিল । ঐ এক জায়গায় সিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে রইল মানব । ওর দুপাশ দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে । কোনোটার ড্রাইভার ছ-ইঞ্চি এপাশ ওপাশ দিয়ে চালালেই ও চাপা পড়বে । তারপর দূরের সিগন্যাল লাল হয়ে গেল । গাড়ির স্রোত থামল । তখন ও ধীরে ধীরে হেঁটে গিয়ে সামনের ফুটপাথে উঠল । ওর বাঁ-পাটা হাঁটুর নিচে থেকে সরু । লম্বাও ডান পায়ের চাইতে কম । ও তাড়াতাড়ি হাঁটতে পারে না - দৌড়নো তো দূরের কথা ।
এখান থেকে ওর অফিস বেশি দূরে নয় । ও যেভাবে হাঁটে তাতে পনের মিনিট লাগে । প্রতিবন্ধির কোটাতে চাকরি পেয়েছিল । নইলে হয়তো এখনও বেকার থাকতে হতো । ও অফিসের দিকে হাঁটে আর বিড়বিড় করে মুখে আওড়ায় - ল্যাংড়া নামবে, ল্যাংড়া ।
ছোটোবেলায় মানব খোঁড়া ছিল না । তখন ও পাড়ার ছোটো ছেলেদের সঙ্গে ছুটে বেড়াত - বাড়ির পেছনের পোড়ো জমিটায় ডাণ্ডাগুলি খেলত । ওর বাবার মুদী দোকানটাও চলছিল ভালোই । দিনগুলো খুব একটা খারাপ ছিল না তখন ।
সমস্যাটা শুরু হোল - তখন ওর বছর দশেক বয়েস । বাঁ পাটায় কিরকম জোর পায় না । বেশি ছুটোছুটি দৌড়দৌড়ি করলে ব্যাথা করে । যত দিন যায়, ব্যাথা বাড়ে - পায়ের জোর কমে । যখন ওর বছর বারো বয়েস তখন পা বেশ সরু হয়ে গিয়েছে, একটুখানি খুঁড়িয়ে চলা শুরু হয়েছে । ওর বাপের তখন ব্যবসা ভালো চলছে না । তবুও পাড়ার ডাক্তার দেখানো হোল, সে ডাক্তার বললেন হাড়ের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে । বাঘা বাঘা সব অস্থিবিশারদ - তাদের চেম্বারে আলাদা করে দেখাতে গেলে খালি ভিজিট খরচাই দুশো টাকা । মানবকে হাসপাতালে দেখাতে নিয়ে গেল ওর বাবা । সরকারি হাসপাতাল - রোগীর ভিড় দেখে মনে হয় একটা মেলা বসেছে । নাম লিখিয়ে টিকিট করিয়ে ওরা অনেকক্ষণ হলঘরটার মেঝেতে বসে রইল - কারণ বসবার কাঠের বেঞ্চিগুলো সব ভরতি । ডাক্তার এলেন অনেক দেরি করে । কিন্তু এসেই খুব দ্রুত রোগীদের পরীক্ষা করা শেষ করতে লাগলেন - এক একজন রোগীপিছু দু'মিনিট তিন মিনিট - খুব জোর পাঁচ মিনিট । মানবের পায়ের হাড় খুব জোরে একবার টিপে দিলেন ডাক্তার । তারপর ওর টিকিটের কাগজে কি সব লিখে দিয়ে বললেন, অনেক দেরি হয়ে গেছে । একটা অপারেশন করিয়ে দেখতে পারেন - তবে বিশেষ কিছু হবে বলে মনে হয় না ।
বাপের হাত ধরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাড়ি ফিরে এল মানব । আর কোনো ডাক্তারের কাছে যাওয়া হয়নি । শেষ পর্যন্ত বাঁ পাটা ডান পা'টার থেকে চার ইঞ্চি ছোটো হয়ে গেল । নেংচে হাঁটাটাও মানব মোটামুটি রপ্ত করে নিল ।
ওদের অফিস চারতলার ওপর । লিফটের সামনে লম্বা লাইন । সেই লাইনের পেছনে দাঁড়িয়ে পড়ল মানব । লিফটের পাশেই সিঁড়ি । অনেকে তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাচ্ছে, কেউ কেউ আবার দু-তিনটে সিঁড়ি টপকে টপকে উঠছে । আগে আগে ওদের দেখে অনেক সময় মানবের হিংসে হোত । এখন আর হয় না । চোখে সয়ে গেছে ।
বিল্ডিংটার পুরো একটা তলা জুড়ে ওদের অফিস । প্রকাণ্ড একটা হল ঘর । সেখানে নানা রকম পার্টিশন করে পদস্থ কর্তাব্যক্তিদের জন্যে চকচকে পালিশ করা কাঠের খুপরি টুপরি করে অফিসে সাজান হয়েছে । লিফট থেকে বেরিয়ে হলে ঢোকবার প্রকাণ্ড কাঁচের দরজা । ঠিক ঢুকবার মুখেই মানবের দেখা হয়ে গেল একটি চটুলাক্ষী পৃথুলাঙ্গী যুবতীর সঙ্গে । মন্দিরা রায় । মানবেরই সহকর্মিনী । বিয়ের আগে মন্দিরা সেন ছিল । বড়ো ব্যাগটা কাঁধের ওপর দিয়ে পিঠের ওপর ফেলে ধরে রেখেছে । ওর হাঁটার তালে তালে ওই ব্যাগটাও ডাইনে বাঁয়ে অল্প অল্প দুলছে । বাঁ হাতে নিজের ছেলের ডান হাত ধরে রেখেছে । বছর তিনেকের ফুটফুটে নাদুস নুদুস একটা ছেলে । মাঝে মাঝে মন্দিরা অফিসে নিয়ে আসে । যেদিন আনে সেদিন বিশেষ কোনো কাজ করে না । লাঞ্চের পরেই অফিস থেকে চুপচাপ কেটে পড়ে ।
মানব মুখ নিচু করল । তারপর কোনোমতে ওর পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল নিজের টেবিলের দিকে ।
ছ-বছর আগে মানব এই চাকরিতে ঢুকেছে । মন্দিরাও একই সঙ্গে ঢুকেছিল । আড়ে আড়ে মন্দিরাকে তাকিয়ে দেখত মানব - কথা বলতে সাহস পেত না । তাকানোটা খুবই স্বাভাবিক । মন্দিরা ফর্সা, সুশ্রী, মোটাসোটা - যাকে বলে স্বাস্থ্যবতী । এই অফিসে কিছু ঘাগী, পুরোনো কর্মচারী ছিল । ব্যাপারটা তাদের চোখে পড়ে । মানবের পেছনে লাগল ওরা । মানবকে বলা হল মন্দিরা ওকে ভালোবাসে । কয়েকদিন মানসিক উত্তেজনার মধ্যে কাটিয়ে মানব কথাটা বিশ্বাস করে ফেলল । ওকে আরও কিছুদিন এভাবে খেলানো হল । মন্দিরা যে ব্যাপারটা একেবারে জানত না তা নয় । কিন্তু মজার ভাগটা ও-ও নিচ্ছিল । একটা ছেলে, হলই বা খোঁড়া, ওর জন্যে নাচছে - ব্যাপারটা মন্দ কী ? তারপর ওই ঘাগীদের হাত দিয়ে মানবের কাছে একটা চিঠি এল । বলা হল সেটা মন্দিরার প্রেমপত্র । ওরা মানবকে দিয়ে মন্দিরাকে একটা চিঠি লেখাল । তারপরই বোমাটা ফাটল । সারা অফিসে রটে গেল ল্যাংড়া মানব মন্দিরাকে প্রেম নিবেদন করে চিঠি দিয়েছে ।
অফিসে কথা বলা প্রায় বন্ধ করে দিল মানব । তারপর মন্দিরার বিয়ে হয়েছে, ছেলে হয়েছে, মন্দিরা মুটিয়ে গেছে । সোজা কথায় অনেক বছর কেটে গেছে । কিন্তু এখনও মন্দিরার মুখোমুখি হয়ে গেলে মানব মাথা নিচু করে ফেলে । কান দুটো ঝাঁ ঝাঁ করে - রগের পাশে দপ দপ করতে থাকে ।
নিজের টেবিলে এসে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল মানব । মন্দিরার ছবিটা চোখের সামনে থেকে মুছে না গেলে কাজ শুরু করা যাবে না । তারপর সকালের চা এল টেবিলে । খালি কাপে চা - তলায় কোনো প্লেট নেই । কাপের তলায় চা লেগে থাকে - তাতে করে টেবিলের কাঠের ওপর কাপের নিচের চায়ের গোল গোল দাগ পড়েছে । চা শেষ করে হাতে একটা চিঠি তুলে নিয়ে মানব গেল ওদের সেকশন ইনচার্জের কাছে । চিঠিটার ওপর আজই কাজ করার দরকার - কিন্তু কয়েকটা ব্যাপার ইনচার্জের কাছে জানার আছে । ইনচার্জ ভদ্রলোক প্রৌঢ়ত্ব পার করেছেন, মাথাভরা টাক, কাগজেকলমে বয়েস কমিয়ে রাখার জন্যে এখনো রিটায়ারমেন্টটা হয়নি । নিজের টেবিলে বসে দেশলাই কাঠির ডগা ভেঙে নিজের দাঁত খোঁচাচ্ছেন ভদ্রলোক । বুড়ো বয়সে দাঁত ফাঁক হয়ে গেছে বলে পানের টুকরো দাঁতের ফাঁকে আটকে যায় । মুখ বিকৃত করে একপাশের দাঁত আর মাড়ি বার করে রেখেছেন - দাঁত আর মাড়ি দুইই পানের রসের ছোপে লালচে । মানব চিঠি হাতে নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ফিরে এল নিজের জায়গায় ।
ছুটি হওয়ার কয়েক মিনিট আগেই মানব অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ে । যেহেতু ও প্রতিবন্ধী, এ ব্যাপারটা নিয়ে কেউ বিশেষ মাথা ঘামায় না । মানবের নিজেরও একটা গরজ থাকে তাড়াতাড়ি বেরোনর জন্যে । ছুটি হলে ওর সহকর্মীরা হনহন করে হেঁটে বেরিয়ে যায় - দৌড়ে গিয়ে হাত দেখিয়ে বাস থামিয়ে তাতে উঠে পড়ে । অনেকে আবার নিজস্ব দু-চাকার গাড়ি চালিয়ে আসে । মাথায় হেলমেট চাপিয়ে এক লাথি মেরে স্কুটার বা মোটরবাইক স্টার্ট করে - তারপর ভোঁ করে ওর পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যায় । ওরা কেউই মানবের দিকে তাকিয়ে দেখে না । ওরা জানে যে মানব খোঁড়া - তাড়াতাড়ি হাঁটার ক্ষমতা ওর নেই । মানবও জানে সে-কথা । তবুও ও চেষ্টা করে যাতে অফিসের লোকদের চোখে পড়তে না হয় - যতক্ষণে ওরা অফিস থেকে বেরোবে ততক্ষণে ও যাতে যথেষ্ট দূরে চলে যেতে পারে ।
ফেরার সময় মানব ট্রামে আসে । তার কারণ হচ্ছে ট্রাম অপেক্ষাকৃত খালি থাকে । এই যানটাও মানবের মতো - বিশেষ জোরে চলার ক্ষমতা নেই । সময় লাগে অনেক । ময়দানের ভেতর দিয়ে আলিপুর ঘুরে আসে । যাদের তাড়া থাকে তারা ট্রামে চলাফেরা করে না । মানবের তাড়া নেই । ও শান্তভাবে বসে থাকে - যতক্ষণ না ওর বাড়ির কাছের স্টপেজটা আসে ।
মানবদের বাড়িতে বাড়িতে ইঁটের সরু রাস্তার লাগোয়া দুটো ছোট্ট ছোট্ট ঘর - ঘর দুটোর পেছনে একচিলতে বারান্দা । ওরা সবাই বাড়িতে ঢোকে এই বারান্দা দিয়েই । বারান্দার এক কোনে তোলা উনুনে রান্না হয় । আর এক কোনে টিন দিয়ে একটু জায়গা ঘিরে দেওয়া হয়েছে । এ জায়গাটা স্নানের জন্যে ব্যবহার হয় । স্নানঘরটা শ্যাওলা ধরে পেছল । তার কারণ বাড়ির লোকেরা মূত্রত্যাগটাও এখানেই করে । বড় কাজটার জন্যে বাড়ির বাইরে যেতে হয় । জায়গাটা কাছেই - প্রায় পঞ্চাশ ঘর বাসিন্দার জন্যে পাশাপাশি তৈরি করা ব্যবস্থা । ওদের স্নানের জায়গায় কোনো জলের কল নেই । রান্না খাওয়া, স্নান সবই তোলা জলে । এই জল আনতে হয় রাস্তার ওপরে টিউবওয়েল থেকে - কাজটা করে ওর বোন আর তারপরের ভাই ।
বাড়ি ফিরে মানব বারান্দায় জুতো খুলে স্নানের জায়গায় গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে নিল । তারপর ওর ঘরে ঢুকল । এ-ঘরটা বাড়ির ছেলেদের শোয়ার জন্যে । ঘরের দুপাশে দুটো সরু সরু তক্তপোশ - একটা মানবের আর একটা ওর বাবার শোয়ার জন্যে । মেঝেতে মাঝখানের জায়গাটুকুতে ওর ভাই শোয় । পাশের ঘরটা ছোটো । একটা তক্তপোশ রয়েছে । সেখানে মানবের মা শোয় - মেঝেতে ওর বোন । ।
ঘরে সিলিং ফ্যান ছাড়াও মানবের বিছানার মাথার দিকে ঘরের এককোনে একটা নড়বড়ে টুলের ওপর একটা টেবিলফ্যান রয়েছে । বাড়ির রোজগেরে ছেলের জন্যে এই আরামটুকুর ব্যবস্থা । ফ্যানটা ধূলোয় ভর্তি - যখন ঘোরে তখন এই ধূলো ঘরময় ছড়ায় । মাঝে মাঝে কোনো কারণে টুলটা নড়ে উঠলে ফ্যানের জালিতে ব্লেড লেগে ঘটাঘট আওয়াজ হয় । মানব ঘরে ঢুকে প্রথমেই ফ্যানটা চালিয়ে দিল - তারপর খালি গায়ে লুঙ্গি পরে বিছানায় বসল । বর্ষা আসবে আসবে করে আসছে না - অসহ্য গুমোট চলছে । মানবের ঘরে একটাই জানালা - তা দিয়ে খালি মশা ঢোকে ঘরে - হাওয়া আসে না । ওর বাপ এখন বাড়ি নেই । বুড়ো অনেক রাত পর্যন্ত দোকানে থাকে - তারপর ঝাঁপ বন্ধ করে বাড়ি আসে । ভাই কোনোদিনই এসময় বাড়ি থাকে না । পাশের ঘর থেকে মায়ের কাশির আওয়াজ শুনতে পায় মানব । মহিলা বছর খানেক আগে স্নানের ঘরের শ্যাওলায় পা পিছলে পড়ে কোমর ভেঙ্গেছিল । এখন বিশেষ হাঁটাচলা করতে পারে না । কুঁজো হয়ে লাঠিতে ভর দিয়ে গিয়ে প্রাত:কৃত্যটুকু করে আসে ; ওর বোন ধরে ধরে নিয়ে যায় । স্নানটাও ওর বোনই করিয়ে দেয় । বুকেও বোধহয় কিছু দোষ হয়েছে । মাঝেমাঝেই কাশে - হাঁপানিও হয়েছে । কিছুদিন আগে পর্যন্তও মানব অফিস থেকে ফিরে ও-ঘরে ঢুকত - মাকে জিজ্ঞেস করত, মা, কেমন আছ ? আজকাল আর বিশেষ যায় না । কি হবে গিয়ে ? নতুন কিছু তো আর দেখবে না ।
ওর বোন ঘরে ঢুকল । একহাতে একবাটি তেলমাখা মুড়ি, আর এক হাতে এককাপ চা । অফিস থেকে ফেরার পর মানবের জলখাবার । ওর বোনের নাম শুভ্রা, যদিও মেয়েটির গায়ের রঙ বেশ কালো । বছর বাইশ তেইশ বয়েস । বছর দুই আগে পাড়ার একটা ছেলের সঙ্গে প্রেম করে তার সঙ্গে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিল । মাস খানেক পরে ফিরে আসে - পেটে বাচ্চা । ছেলেটা তখন উঠতি মাস্তান - স্মাগলিং টাগলিং করে, সঙ্গে পিস্তল নিয়ে ঘোরে । ওকে শুভ্রাকে বিয়ে করতে বলতে কারোর সাহস হয়নি । রাস্তার ল্যাম্পপোস্টে অনেক বিঞ্জাপন সাঁটা থাকে । অভিঞ্জা মহিলা শ্রীমতী অমুক - নামের পাশে কয়েকটা হরফ । তারপর লেখা - সাকশন মেথডে পাঁচমিনিটে আরোগ্য । সেরকম একটা জায়গায় নিয়ে গিয়ে শুভ্রার বাচ্চা নষ্ট করা হয়েছিল ।
শুভ্রা নিচু হয়ে মেঝেয় মুড়ির বাটি আর চায়ের কাপ রাখে । ওর শাড়ির আঁচল সরে গিয়ে বুকের বেশ খানিকটা অংশ দেখা যায় । চোরা চাউনিতে মানব তা দেখে । মেঝের দিকে চোখ রেখেও শুভ্রা বোঝে দাদার নজর ওর শরীরে কোনো জায়গায় পড়েছে । দাদাকে একটু সহানুভূতির চোখে দেখে শুভ্রা । আহা, খোঁড়া দাদাটা বিয়ে-থা তো আর করতে পারবে না । একটু যদি ওর দিকে তাকিয়ে দেখে তাহলে দোষ কি ?
একটু দেরি করেই সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ায় শুভ্রা । ধীরে সুস্থে শাড়ির আঁচলে শরীর ঢাকে । মানব ততক্ষণে মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়েছে । শুভ্রা মনে মনে হাসে । বোকা দাদাটা জানে না যে ওর বোন সব বোঝে । মুখে বলে, দাদা খেয়ে নে । চা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে । তারপর ওর বাবার বিছানার ওপর বসে । মানবের খাওয়া শেষ হলে বাটি আর চায়ের কাপ নিয়ে যাবে ।
মানব মেঝেয় বসে বাটি থেকে মুড়ি নিয়ে চিবোয়, চায়ে চুমুক দেয় । চা খুব গরম, মনে হয় জিভ পুড়ে যাবে । কাপ নামিয়ে রেখে বোনের দিকে তাকিয়ে মানব হাসে । বলে, চা খুব গরম রে । একটু ঠাণ্ডা হোক, তারপর খাব ।
শুভ্রা তক্তপোশের ওপর বসে পা দোলায় । বলে, তোর তো গরম লাগবেই । সারাদিন অফিসের ঠাণ্ডা হলঘরে বসে থাকিস ।
তারপর পা দোলানো থামিয়ে শুভ্রা বলে, জানিস দাদা, স্বপ্না বাপের বাড়ি এসেছে ।
মানব মুড়ির বাটির থেকে মুখ তোলে । উত্সুক চোখে বোনের দিকে তাকায় । শুভ্রা মানবকে পাড়ার নানারকম খবর-টবর শোনায় । ও কোনো প্রশ্ন করে না । জানে বোন নিজের থেকেই আরও কথা বলবে ।
শুভ্রা বেশ খুশি হওয়া গলায় বলে, শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে । ওর বর বোধহয় আবার বিয়ে করবে । দুটো বাচ্চার হাত ধরে এসে উঠেছে বাপের বাড়ি । আসার সঙ্গে সঙ্গে লাঠালাঠি লেগে গেছে দাদা আর বৌদির সঙ্গে । ঐ একটা তো মোটে ঘর । থাকবে কোথায় ? আর দাদা কি ওকে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবে নাকি ? ওর বাপ মা চুপ করে আছে । কিছু বলছে না ।
স্বপ্না মানবদের পাড়ারই মেয়ে । ছোটোবেলায় মানব খেলাধূলো করেছে ওর সঙ্গে । তারপর ওরা বড় হতে লাগল, মানবের পা খোঁড়া হোল আর স্বপ্নার বিয়ে হয়ে গেল দূরে কোথাও একটা । ওর বাবার একটা ছোট্ট হার্ডওয়ারের দোকান আছে । এখন সেটা দেখে ওর দাদা । বিশেষ চলে না । এ পাড়ার আর পাঁচটা পরিবারের মতোই দিন আনা দিন খাওয়া অবস্থা । মানব বোঝে ও নিজেও ওর বোনের মতোই একটু খুশি হয়ে উঠেছে । যদিও স্বপ্না কষ্টে পড়লে ওর নিজের কিছু ভালো হওয়ার সম্ভাবনা নেই । কথাটা চালিয়ে যাবার জন্যে মানব বলল, আইন কিন্তু স্বপ্নার পক্ষে । কি একটা মারাত্মক ধারা আছে চারশো পঁচিশ না চারশো নিরানব্বই - স্বপ্না যদি নালিশ করে পুলিস ওর শ্বশুরবাড়ির সবাইকে হাজতে ভরে দেবে ।
শুভ্রা অবজ্ঞায় ঠোঁট উল্টে দেয় । বলে তুইও যেমন । ওরা নাকি যাবে থানা পুলিস করতে । ওরা নিজেদের মধ্যেই খেয়োখেয়ি করবে ।
মানব উত্তর দেয় না । মুড়ি চিবোয় । শুভ্রা তক্তপোশের ওপর থেকে ওর দিকে ঝুঁকে পড়ে । গলা একটু নামিয়ে জিজ্ঞেস করে, দাদা তোদের অফিসের সেই মন্দিরার খবর কি রে ?
মানবের কান লাল হয়ে ওঠে । শুভ্রা জানে । একেবারে প্রথমে, যখন অফিসে খেলাটা চলছিল, তখন মানব বোনকে গল্প করেছিল । শুভ্রা এখনও মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করে ওই মহিলার কথা । কেমন সেই মহিলা যার প্রেমে ওর দাদা একসময় মজে গিয়েছিল ! মানব কথা বলে না । হাত উল্টে একটা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি করে । পাশের ঘর থেকে মায়ের ডাক ভেসে আসে, শুভা রে-এ-এ, কোথায় গেলি ?
শুভ্রা মুখ বাঁকিয়ে দাঁড়িয়ে ওঠে । বলে, ঐ যে, বুড়ি ডাকছে । বোধহয় বাথরুম যাবে ।
মানবের মুড়ি আর চা শেষ হয়ে গিয়েছিল, খালি কাপ আর বাটি তুলে নিয়ে শুভ্রা বেরিয়ে যায় ।
মানব তক্তপোশের ওপর হাতের ভর দিয়ে মেঝে থেকে উঠে ওর নিজের বিছানায় বসে - একটা সিগারেট ধরায় । এই সময়টুকু ওর নিজস্ব - অফিস থেকে ফিরে চা খাওয়া শেষ করার থেকে রাতের খাবারের ডাক পড়া পর্যন্ত । শুভ্রা ঘরের কাজে ব্যস্ত থাকে, বাবা থাকে দোকানে, ভাইটা কোনোদিনই এসময় বাড়ি থাকে না । ঘরের ভেতর ওর সিগারেটের ধোঁয়া তাল পাকায়, আর তার সঙ্গেই নিজের বঞ্চনার রাশ ছেড়ে দেয় মানব । ওর খোঁড়া পা ভালো হয়ে যায় - কখনো হাসপাতালে গিয়ে অপারেশন করিয়ে, কখনো বাড়িতে একজন সাধু আসেন - ওকে স্পর্শ করে ভালো করে তোলেন তিনি । ও অফিসে প্রমোশন পায় - যারা ওর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে ও তাদের বরখাস্ত করে । কিন্তু ও মন্দিরাকে মাপ করে দেয় - আহা মেয়েটা সুখি হোক ।
বাইরের বারান্দায় একটা গোলমাল শুনতে পেল মানব । বেশ কয়েকটি পুরুষের উত্তেজিত চড়া গলা । তার মধ্যে ওর ছোটো ভাই - সানুর গলার আওয়াজও পাওয়া যাচ্ছে । শুভ্রাও চেঁচিয়ে কি সব বলছে । মানব বাইরে বেরিয়ে এল । সানু আর তার কয়েকজন বন্ধু । সানুকে দেখলেই বোঝা যায় ও কারোর সঙ্গে মারামারি করে এসেছে । মাথার চুল এলোমেলো, শরীর ঘামে ভিজে গিয়েছে, গায়ের শার্টটা বিচ্ছিরি ভাবে ছিঁড়েছে, ঠোঁটের কষে রক্ত, বাঁ চোখের নিচে ঘুষি লেগে কালশিটে পড়েছে । ওর বন্ধুদের টুকরো টুকরো কথার থেকে মানব ব্যাপারটা আন্দাজ করে নিল । পাড়ার আর একটি ছেলের সঙ্গে হাতাহাতি করেছে সানু । উপলক্ষ পাড়ারই একটি মেয়ে - বর্ণা । মানব মেয়েটাকে চেনে । চেহারায় একটু চটক আছে, কথায় কথায় খিলখিল করে হেসে ঢলে পড়ার ভান করে । এ মহল্লার অনেক যুবাবয়েসী ছেলেকেই অল্পবিস্তর অনুগ্রহের চোখে দেখে থাকে এই মেয়েটি । শোনা যাচ্ছে এখন নাকি টিভি সিরিয়ালেও অভিনয় করার অফার পাচ্ছে ।
শুভ্রা নিজের শাড়ির আঁচল জলে ভিজিয়ে ভাইয়ের ঠোঁটে চেপে চেপে রক্ত মোছায় । সানুর অনুপস্থিত প্রতিপক্ষের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে গাল পাড়ে - শাপশাপান্ত করে । তারপর ভাইকে নিয়ে পড়ে । আর পাঁচটা মেয়ের থেকে কি এমন আলাদা ঐ মেয়েটা ? সানুর কি দরকার ছিল তার জন্যে লড়াই ঝগড়া করতে যাবার ? এদিকে তো সানু বেকার - এক পয়সা রোজগার করার তো মুরোদ নেই ।
সানু চুপ করে দাঁড়িয়ে দিদির সেবা নেয় - মুখে কিছু বলে না । দিদির কথা সত্যিও ; এখানকার অন্যান্য ছেলেদের মতোই বেকার । পাড়ার একটা ক্লাবে গিয়ে পড়ে থাকে । ওই ক্লাব চালায় স্থানীয় একজন মস্তান - তার চামচাবাজি করে । বিভিন্ন পুজোর সময় পাড়ার সকলের থেকে - বিশেষ করে দোকানগুলোর থেকে জোর জবরদস্তি করে চাঁদা আদায় করে । ঐ মস্তান কিছু করে টাকা সানুর মতো ছেলেদের হাত খরচা হিসেবে দিয়ে থাকে । শোনা যাচ্ছে আগামী ভোটে ঐ মাস্তানবাবুর জনপ্রতিনিধিত্বের জন্যে একটা পার্টির টিকিট পাবার সম্ভাবনা আছে ।
শুভ্রার শাড়ির আঁচল মুখ থেকে সরলে পর সানু ওর বন্ধুদের বলে, শালার পেটে আমি একফুট গজ ঢুকিয়ে দেব - দেখিস তোরা । মানবের কানে কথাটা যেতে ওর রাগ চড়ল । এগিয়ে গিয়ে সানুর কলার চেপে ধরে ওর যে গালটা অক্ষত সেটায় একটা চড় বসাল । চেঁচিয়ে ধমক দিল, চুপ কর্ । ওসব গুণ্ডামি আবার করবি তো ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বার করে দেব ।
ঝটকা মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল সানু । ওর দু-চোখে হিংস্র রাগ আর ঘৃণা । ও দাদার ওপর চেঁচায়, তুই চুপ কর শালা । চাকরি তো পেয়েছিস ল্যাংড়া হয়ে - নইলে আমার মতো হয়েই তো থাকতে হোত তোকে ।
শুভ্রা চেঁচিয়ে ভাইকে ধমক দিল - এই সানু - দাদার সঙ্গে ও-ভাবে কথা বলবি না । মানব একবার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখল । তারপর ঘরে ঢুকে গেল ।
রাতে মানবের ঘুম ভেঙে যায় । ওদের বিছানায় প্রচুর ছারপোকা, তারা এখন সক্রিয় । ঘাড়ে, পিঠে, হাতে, গায়ে চুলকুনি এবং জ্বলুনি টের পাচ্ছিল মানব । বালিশের নিচে হাত চালিয়ে কয়েকটা ছারপোকা আঙুলে টিপে মারল ; বিশ্রী একটা গন্ধে মশারির ভেতরটা ভরে যায় - আঙুলের ডগায় মৃত ছারপোকার শরীর থেকে বেরোন ওর নিজেরই রক্তের চটচটে স্পর্শ অনুভব করে । ও মশারি ফাঁক করে তক্তপোশ থেকে নামে । ও পাশের তক্তপোশে বাবার বিছানা - মাঝখানের সরু জায়গাটুকুতে মেঝেয় বিছানা পেতে সানু ঘুমোচ্ছে - ওর মশারির দড়ি ঘরের এপাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত বাঁধা । খুব সাবধানে মানব পা ফেলে - সানুর বুকে বা গলায় পা না পড়ে যায় । ঘরের খোলা জানালাটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় । গুমোট একই রকম চলছে, একটুও হাওয়া নেই । ঘরের দেওয়ালে একটা টিকটিকি একটা পূর্ণবয়স্ক আরশোলাকে কামড়ে ধরেছে - আরশোলাটা ঝাপটা মেরে মেরে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করছে । কাল সকালে উঠে আবার অফিস, নোটশীট, ফাইল, বড়বাবু, মানব ঘাম মুছে নিল । তারপর মশারির একটা পাশ সাবধানে তুলে নিজের বিছানায় ঢুকল । শুয়ে পড়ার পর কানের কাছে বোঁ বোঁ করে একটা গুঞ্জন শুনতে পায় । বুঝতে পারে - মশারির ফাঁক দিয়ে কয়েকটা মশা ভেতরে ঢুকে গেছে ।
কণ্ডাক্টার পেছন দিকের একটা সীটে বসে পড়েছে, হাত পা ছড়িয়ে আরাম করছে । ড্রাইভারও নিজের কেবিনের দরজা খুলে বেরিয়ে এসে ওর কাছে বসে পড়ে বিড়ি ধরিয়েছে । বোঝাই যাচ্ছে এ গাড়ি এখন বেশ কয়েক ঘন্টা চলবে না । বাকি যাত্রীদের সঙ্গে মানবও নেমে পড়ল । এই মাঝরাস্তায় ও কোনো ভিড় বাসে উঠতে পারবে না । প্রায় কিলোমিটার খানেক হাঁটলে সামনের বড় মোড়টা পড়বে - সেখান থেকে যদি কিছু যানবাহন পাওয়া যায় ।
রাস্তাটা পার হয়ে অন্য দিকের ফুটপাথ ধরে মানব হাঁটছিল । এ দিকটায় একটু অন্ধকার - লোকজন কম । মানবের পক্ষে হাঁটার সুবিধে । বৃষ্টির ফোঁটাগুলোর এক আধটা ওর মাথায় গায়ে পড়ছে । ওর সঙ্গে ছাতা নেই, বৃষ্টি জোরে এলে ও একেবারে ভিজে যাবে । এখনও পুরোদস্তুর বর্ষাকাল আসেনি । সঙ্গে একটা ফোল্ডিং ছাতা রাখার কথা ওর মাথায় আসেনি ।
মানব অনুভব করল ওর পাশে পাশে কেউ হাঁটছে । মুখ ঘুরিয়ে সেদিকে তাকাল । একটি মেয়ে । যুবতী । আবছা অন্ধকারে মুখ ভালো দেখা যাচ্ছে না । ওর দিকে মুখ ঘোরাতে ও সামনের কাছে সরে এল । ওর হাত দিয়ে মানবের এক হাত চেপে ধরল । মানবের হৃত্স্পন্দন জোরালো হয়, কপালের দুপাশের রগ দপদপ করে, তলপেট ভারি হয়ে শিরশির করতে থাকে । ভাবল হাতটা ছাড়িয়ে নেবে । পারল না । মেয়েটির শরীর থেকে আসা একটা জোরালো গন্ধ ওর ইচ্ছাশক্তিকে কিরকম অবশ করে দিচ্ছে । ও শুনতে পেল মেয়েটি ওকে বলছে, আমার ঘর একেবারে কাছে, চল, সেখানে যাই । মানব বুঝল ওর গলা শুকিয়ে গেছে । একবার খালি ঢোঁক গিলে নিল ।
কতক্ষণ মেয়েটির সঙ্গে হেঁটেছে মানবের খেয়াল নেই । হয়তো মাত্র কয়েকমিনিট - হয়তো বা একঘন্টা । সরু একটা অন্ধকার গলিতে পাশাপাশি কতগুলো ইঁটের ঘর - সেগুলোর টালির চাল । ঘরগুলোর দরজার সামনে মুখে রং মাখা মেয়েরা বসে আছে - কয়েকজন রাস্তায় হেঁটে বেড়াচ্ছে । একটা দরজার সামনে মেয়েটা মানবকে দাঁড় করাল । দরজা বন্ধ । তালা লাগানো, হাতের ব্যাগ থেকে চাবি বার করে দরজা খুলে মানবকে নিয়ে মেয়েটি ভেতরে ঢুকল । মানব পেছন থেকে মেয়েলি হাসি শুনতে পেল - সেই সঙ্গে টিটকিরি - ই:, মাগি একেবারে রাস্তা থেকে বাবু ধরে এনেছে ।
ভেতরটা অন্ধকার । মেয়েটি একটা কেরোসিনের কুপি জ্বালল । তারপর ঘরের দরজায় হুড়কো লাগিয়ে দিয়ে মানবকে বলল, বিছানায় এসে বসো না ।
কুপির মৃদু আলোয় মানব এবার চারপাশ দেখে, আসবাব কিছু প্রায় নেই বললেই চলে । একপাশে একটা মাদুরের ওপর একটা তোষক, তার ওপর একটা আধময়লা চাদর পাতা রয়েছে । অন্যদিকে একটা মাঝারি সাইজের টিনের ট্রাঙ্ক - বোধহয় তাতে মেয়েটির জামাকাপড় থাকে । তার পাশে জলের কুঁজো, কেরোসিনের স্টোভ, দুটো জল রাখার আধভরা বালতি আর কিছু বাসনপত্র । ঘরে বিদ্যুতের কোনো ব্যবস্থা নেই । একপাশের দেয়ালে একটা ছোটো জানালার সাইজের খোপ - দেয়ালে লাগানো একটা টিনের ঝাঁপ দিয়ে সেটা বন্ধ করা যায় । মানব জুতো দরজার সামনে খুলে রেখে বিছানায় গিয়ে বসল । মেয়েটি ওর পাশে ।
মানব মেয়েটিকে দেখছিল । রং বিশেষ মাখেনি মেয়েটা । অপুষ্টিতে ভোগা চেহারা, চোখদুটোতে একটা করুণ চাউনি । নাকটা অল্প ভোঁতা, আর ঠোঁট দুটো একটু পুরু - তাতে করে মুখটায় একটা জান্তব আকর্ষণীয়তা এনে দিয়েছে । মানবের প্রাথমিক ভয়ের ভাবটা কেটে গিয়ে এখন ও বেশ স্বচ্ছন্দ বোধ করছিল । ও মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কি ?
মেয়েটি মানবের ডান হাতটা তুলে নিয়ে ওর তর্জনিতে একটা ছোটো কামড় দিল । তারপর বলল, রীতা ।
মানবের সাহস বাড়ছিল । ও বলল, ওটা তো এ লাইনে আসার পরের নাম । আগের নাম কি ছিল ?
মেয়েটা হেসে ভ্রুভঙ্গি করে । বলে, আগের নাম যাই থাক - এখন আমি রীতা । বলেই কুপিটা তুলে নিয়ে এক ফুঁয়ে নিভিয়ে দিল ।
বৃষ্টি এখন একটু জোরেই শুরু হয়েছে - টালির চালের ওপর শব্দ করে ফোঁটাগুলো পড়ছে । বৃষ্টি আটকানোর জন্যে রীতা টিনের ঝাঁপটা দিয়ে দেয়ালের খোপটা বন্ধ করেছে - ঘরের ভেতর নিশ্ছিদ্র অন্ধকার । আর বিছানায় মানব আর একটি নারী । ভালো লাগছে মানবের - খুব ভালো লাগছে । মেয়েটির স্পর্শের সুখানুভূতি এখন ওর সর্বাঙ্গে - মুখে, ঠোঁটে, বুকে, পিঠে । কোমল এবং উষ্ণ সেই স্পর্শ । মেয়েটির শরীরের ঘ্রাণ নেয় মানব - ও টের পায় ওর সারা শরীরে রক্ত মাতাল হয়ে উঠেছে - ও এখন পুরোপুরি সক্ষম একজন পুরুষ । আর যে মেয়েটা ওর সারা গায়ে লেপটে আছে তাকে ও এখন ঠোঁট দিয়ে মোলায়েম ভাবে স্পর্শ করতে পারে, দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে ফেলতে পারে, ওর পৌরুষ দিয়ে আঘাত করতে পারে । মানব হারিয়ে যায় মেয়েটির মধ্যে, তারপরে হাঁপায় ।
তোষকের তলায় হাত চালিয়ে দিয়ে রীতা একটা আধময়লা গামছা বার করে আনল । সেটা দিয়ে মানবের সারা গায়ের ঘাম মুছিয়ে দিল । বলল, বড্ড ঘেমে গেছ গো । তারপর উঠে কুপিটা জ্বালে, নিজের গায়ে শাড়ি জড়ায় ।
মানবও ওঠে, জামা পরে । তারপর রীতাকে একটা একশ টাকার নোট দেয় । রীতা ঠোঁট ফুলিয়ে আব্দার করল, আর পঞ্চাশটা টাকা দাও না । গতমাসের ঘরভাড়া পুরো দিতে পারিনি - এ মাসের মধ্যে সব দিয়ে দিতে হবে ।
মানব আরও পঞ্চাশ টাকা দিল ওকে । রীতা টাকাটা পেয়ে ওর গালে চুমু খায় । বলে, তুমি ভারি ভালো বাবু । আবার আসবে তো আমার কাছে ! মানব দু-হাতে ওর মুখটা ধরে । তারপর ওর পুরু ঠোঁটে চুমু খায় । বলে, আসব ।
গত কয়েকমাস হল মানবের শরীরটা বড় খারাপ চলছে । চট করে ঠাণ্ডা লেগে যায় - অল্প অল্প জ্বর হয়, কাশিও হয় । হজমেরও গোলমাল হচ্ছে কিছুদিন যাবৎ । স্নান করে চুল আঁচড়াবার সময় একগাদা করে চুল উঠে চিরুনিতে লেগে থাকে । একটু রোগাও বোধহয় হয়েছে - প্যান্টগুলো কোমরে একটু ঢিলে হচ্ছে, বেল্টটা আরও টাইট করে বাঁধতে হচ্ছে ।
প্রায় ছ-মাস রীতার কাছে যাতায়াত করেছিল মানব । তারপর হঠাৎ একদিন রীতা কোথায় উধাও হয়ে গেল । অফিস থেকে ফেরবার সময় ঢুকেছিল ঐ গলিতে । রীতার ঘরের সামনে এসে দেখল দরজা হাট করে খোলা - দরজার চৌকাঠে বসে আছে ঘোর কালো বিপুলকায়া, বিকটদশনা, মুখে খড়ি মাখা একটি মাঝবয়েসী মেয়েমানুষ । মানব হাবার মতো জিজ্ঞেস করে ফেলেছিল । রীতা এখানে থাকে না ?
পান খাওয়া লাল ছোপ ধরা দাঁত বার করে মেয়েমানুষটা হেসেছিল, বলেছিল, রীতা নেই তো আমি আছি । এসো না আমার ঘরে । কোলে বসিয়ে দোলাব - দেখবে খুব ভালো লাগবে ।
ও পাড়ার একটা দালাল গোছের লোক ওখান দিয়ে যাচ্ছিল । মানব প্রায় ছ-মাস ধরে ওখানে গেছে - মোটামুটি মুখটা চেনা ছিল । ফিসফিস করে বলে গেল, রীতা উধাও হয়ে গেছে - ওর খোঁজ আর করবেন না । ইচ্ছে হলে ওদের কারোর ঘরে যান ।
মানব ফিরে এসেছিল । আর যায়নি ওদিকে । খালি মাঝে মাঝে ভেবেছে - কি হোল মেয়েটার ? ওকে গুম করে ফেলল নাকি বিক্রি করে দিল ?
তারপরও প্রায় বছর খানেক কেটে গেছে । গত শীতটার থেকেই ওর শরীরটা ভালো যাচ্ছে না ।
মানবদের অফিসের ডাক্তারবাবুটি ভালো । অফিস ডিসপেন্সারিতেও রোগীকে ভালো করেই দেখেন । মানব গেল ওঁকে দেখাতে । উনি মানবকে অনেকক্ষণ ধরে বিভিন্ন ভাবে পরীক্ষা করলেন । তারপর রক্ত পরীক্ষার একটা লম্বা ফিরিস্তি লিখে দিলেন । অনেক ধরনের পরীক্ষা করতে হবে ।
যেখানে হোক - হাত উল্টে দিয়ে বললেন ডাক্তারবাবু, রক্ত পরীক্ষাটা ভালো করে করলেই হোল ।
মানবদের বাড়ির কাছেই বাসরাস্তার ওপর একটা প্যাথোলজিক্যাল ক্লিনিক খুলেছে । সকালবেলা মানব সেখানে গেল । খালিপেটে রক্ত দিতে হবে । ওখানে গিয়ে দেখা হয়ে গেল শেখরের সঙ্গে । ওদেরই পাড়ার ছেলে । সানুর সঙ্গে একসঙ্গে স্কুলে পড়ত । ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়ে সানু পড়া ছেড়ে দিল । শেখর উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে এ লাইনে একটা ট্রেনিং নিয়েছে । ও এখন এখানে অ্যাসিস্ট্যান্টের কাজ করে । রক্তটা ওই নিল । কাউন্টারে টাকা নিল একটি অল্পবয়েসী মেয়ে - নিয়ে রসিদ লিখে দিল । সবকটা পরীক্ষার রিপোর্ট পেতে দিন সাতেক লাগবে ।
বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে ওর বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসেছিল মানব । ওর দৃষ্টি সোজা ওর সামনে দরজার ওপরে ঘরের দেয়ালে নিবদ্ধ । একটা বড় গোছের স্ত্রী মাকড়সা সেখানে জাল বুনেছে - একটা বড়ো সড়ো পোকা আটকে আছে সেই জালে । মাকড়সাটা জালের অন্যদিকে - পোকাটাকে ধরবার কোনো চেষ্টা করছে না সেটা । পোকাটা তো আর পালাতে পারবে না - যখন ইচ্ছে সেটার কাছে গিয়ে ধীরে সুস্থে ওটাকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেলেই হবে ।
এই ঘরটার সঙ্গে মানবের অস্তিত্ব এখন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে গেছে । মানব এখানে বাস করছে বহুদিন । সূর্যের দৈনন্দিনের পরিক্রমা হিসেব করলে হয়তো মাত্র দু-এক মাস । কিন্তু মানব এখন বেশিরভাগ সময় বাস করে ওর স্মৃতির মধ্যে । রীতার সেই ঘর - তার মাটিতে পাতা বিছানা । সেখানে কখনো ওর সময় কাটে মেয়েটির আলিঙ্গনের মধ্যে - কখনো বা ওরা বিছানায় পাশাপাশি বসে গল্প করে । মানব ওকে শোনায় নিজের খোঁড়া হওয়ার ইতিহাস - ওর অফিস আর সহকর্মীদের কথা । খুব যত্নে এড়িয়ে যায় মন্দিরার প্রসঙ্গ । রীতাও বলে নিজের কথা । গ্রামের গৃহস্থবাড়ির একটি ছোটো মেয়ে - বাড়ির গরুর যত্ন করত - ছোটো ভাইবোনদের দেখাশোনা করত । তারপর সে কিশোরী হোল - বাবা মা বিয়ে দিল - কিশোরীটি ভিনগ্রামে শ্বশুর ঘর করতে গেল । তারপরের ঘটনার কথা জিজ্ঞেস করলে রীতা খালি হাসে - মানবকে বিছানায় শুইয়ে ফেলার চেষ্টা করে । রীতার ঘর থেকে বেরিয়ে মানব ওদের বাড়ির পেছনের পোড়ো জমির খেলার মাঠে পৌঁছে যায় - বালক মানব সমবয়স্ক অন্যান্য ছেলেদের সঙ্গে ছুটোছুটি করে ডাণ্ডাগুলি খেলে । নিজের অজান্তে মানব বোঝাবার চেষ্টা করে কোথায় ওর জীবনের সবচেয়ে আনন্দের সময় কেটেছে - ওই ডাণ্ডাগুলি খেলার মাঠে না কালিঘাটের একটা এঁদো গলির ভেতর ছোট্ট একটা টালির চালের ঘরে ।
কিন্তু তখন ওর বুক এবং কন্ঠনালি নিংড়ে একটা ভয়ঙ্কর কাশি ওঠে । সেটা যখন কমে তখন আবার মানব তার এই ঘরে ফিরে এসেছে । ও দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে মাকড়সাটা তার পুরোনো জায়গা থেকে একটু সরেছে । তাগড়া চেহারা মাকড়সাটার - পাগুলো লম্বা আর বলিষ্ঠ । এখনও কিন্তু ওটা পোকাটার থেকে দূরে - মনে হয় ওর শিকার সম্পর্কে নির্বিকার । আবার ওর চেতনা ভেসে চলে যায় এ-ঘরের বাইরে । ও এখন ওই প্যাথোলজিক্যাল ক্লিনিকে - ওর রক্ত পরীক্ষার রিপোর্টগুলো নেবার জন্যে কাউন্টারের সামনে দাঁড়ানো । কাউন্টারের মেয়েটি এক একটা রিপোর্টের ওপর ছাপানো নাম আর ত্রক্রমাঙ্ক নম্বর মিলিয়ে মানবের জন্যে আলাদা করে রাখছিল । একটা রিপোর্ট দেখতে একটু বেশি সময় নিল মেয়েটি । একবার মুখ তুলে মানবের দিকে তাকাল । তারপর রিপোর্টগুলো ভাঁজ করে একটা লম্বাটে খামের ভেতর ঢুকিয়ে দিল । মানব খামটা নেবার জন্যে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল । ওর হাতে না দিয়ে কাউন্টারের ওপর দিয়ে খামটা ঠেলে ওর দিকে এগিয়ে দিল মেয়েটি । মানব খামটা তুলে নিল - মনে মনে একটু চটল মেয়েটির ওপর । সামান্য ভদ্রতাটুকুও ভালো করে শেখেনি মেয়েটা ।
অফিসের ডিসপেন্সারিতে ডাক্তারবাবুর সামনে দাঁড়িয়েছিল মানব । ডাক্তারবাবুর রাইটিং টেবিলটা বড় সাইজের - বসার গদিমোড়া রিভলভিং চেয়ারটা তোয়ালে দিয়ে ঢাকা । সেই চেয়ারে ডাক্তার বসা - আর টেবিলের এপাশে মানব । ডাক্তার রক্ত পরীক্ষার রিপোর্টগুলো দেখে নিয়েছেন - তার প্রেসক্রিপশনের প্যাডে একগাদা ওষুধ লিখে দিয়েছেন । আমার অসুখটা কি - ডাক্তারবাবু ? ডাক্তার তাঁর মোটা লেন্সের চশমার ভেতর দিয়ে মানবের দিকে সোজাসুজি তাকালেন - তারপর একটা রিপোর্ট বার করে মানবের দিকে এগিয়ে দিলেন ।
মানব ছাপানো রিপোর্টটা একবার পড়ল । আবার পড়ল - শুনতে পেল ডাক্তার বলছেন, হাসপাতালেও ভর্তি হতে পারেন । লিখে দিয়েছি সেকথা ।
মানবের ঘরের দরজাটা খুলে গেল । শুভ্রা বাইরের থেকে এক হাত দিয়ে ঠেলে দরজা খুলেছে । ওর অন্য হাতে একটা বড় জাগ - জলে ভর্তি । ঘরের ভেতর ঢুকল না শুভ্রা । মানবের ঘরের ভেতর মানবকে ছেড়ে দিলে মনুষ্যেতর প্রাণী ছাড়া কেউই ঢোকে না । সেজন্যে ঘরটা ঝাড়পোঁছও করা হয় না । ঘরের দরজা খুলে যেতে মানব বুঝতে পারল যে সন্ধে হয়েছে তার কারণ বাইরে জ্বলে থাকা ইলেকট্রিক বাতির আবছা আলো ওর ঘরের দেয়ালে একটা বড় ত্রিভুজাকৃতির ছোপ ফেলেছে । শুভ্রা প্রথমে হাত বাড়িয়ে ঘরের ভেতরের দেয়ালে লাগোয়া সুইচ টিপে আলো জ্বালল । কম পাওয়ারের বাতির আলোয় ঘরের মলিন চেহারাটা স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠল । বাঁ হাতের দুটো আঙুলে আলতো করে কুঁজোর ওপরের গেলাসটা তুলে নিল শুভ্রা । তারপর এ জাগের পুরো জলটা কুঁজোয় ঢেলে দিয়ে আবার কুঁজোটা ঐ একই ভাবে ঢেকে দিল । দরজার অন্য পাশে ঘরের ভেতর দিকে একটা এঁটো এলুমিনিয়ামের থালা রয়েছে - তাতে পড়ে আছে হাতরুটির একটা ছোটো টুকরো আর কয়েককুচি আলুভাজা - মানবকে সকালে যা খাবার দেওয়া হয়েছিল তার অবশিষ্টাংশ । শুভ্রা একবার সেদিকে তাকিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল । মানব জানে ও এখন কি কি করবে । খুব শীগগিরই ও ফিরে আসবে । ওর একহাতে ধরা থাকবে কয়েকটা হাতরুটি - অন্য হাতে একটা হাতায় করে কিছু আলুভাজা - হয়তো বা একদলা গুড় । দরজার চৌকাঠের বাইরে উবু হয়ে বসবে শুভ্রা । তারপর আলতো করে হাতরুটিগুলো ছুঁড়ে দেবে মাটিতে রাখা ঐ থালায় - ঐ হাতার থেকে ঢেলে দেবে আলুভাজা - হয়তো বা গুড় । রোজ অভ্যেস করে করে শুভ্রার টিপ একেবারে পাকা হয়ে গিয়েছে - একটুখানি খাবারও প্লেটের বাইরে পড়ে না । প্রথম প্রথম দু-এক সময় অল্প কিছু খাবার প্লেটের বাইরে পড়ে যেত । তখন ঝামেলা - ওসব তুলে বাইরে ফেলবে কে ? তবে ঘরে পিঁপড়ে আর আরশোলা রয়েছে প্রচুর - রাত্রিবেলা ওরা সব সাফ করে দিত । এখনও দেয় - মানবের প্লেটে যদি কিছু খাবার পড়ে থাকে তা চেটেপুটে খেয়ে দেয় ।
এই খাবার দেবার সময়টায় মাঝে মাঝে মানবের সঙ্গে তার বোনের কথাবার্তা হয় । দাদা - তুই ওষুধ খাস না কেন ? টাকা নেই রে বোন । আশি টাকা করে এক একটা ট্যাবলেট, দিনে আটটা করে খেতে হবে । হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি হতে তো পারিস ? গিয়েছিলাম একটা হাসপাতালে - সেখানে বেড খালি নেই, ভর্তি হবে না । কবে খালি হবে ? বলা যাচ্ছে না - মাঝে মাঝে খোঁজ নিতে হবে ।
রাত বাড়ে । পাড়াটা একেবারে নি:ঝুম হয়ে গিয়েছে । এবার মানব বেরোয় - প্রাকৃতিক কাজকর্ম সারে । প্রথম কিছুদিন দিনের বেলা বেরিয়েছিল । তখন নজর করেছে ওকে দেখে লোকজনের চকিত চাউনি - কারো বা রাগ । ওর থেকে দূরে সরে যায় তারা, চোখে চোখ পড়লে দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে নেয় । ছোটো ছেলেমেয়েদেরও উচিত কর্তব্য শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে । মানবকে দেখলেই ওরা দু-হাতে চোখ ঢেকে ফেলে - তারপর দৌড়ে দূরে সরে যায় । একদিন মানব বেগমোচন করে ফিরে আসছিল । পেছন থেকে কোনো একজন ত্রক্রুদ্ধ পুরুষের গলার স্বর শুনতে পেল - শুয়ারের বাচ্চা, পুরো জায়গাটা রোগে ভরিয়ে দিয়ে চলে গেল ।
দিনের বেলা বাইরে বেরোন বন্ধ করে দিল মানব । প্রথম কয়েকদিন একটু কষ্ট হয়েছিল । তারপর অভ্যেস হয়ে গিয়েছে । বারান্দার বাইরে মাটিতে এক বালতি জল রয়েছে । এটা মানবের জন্যে । মানব সেই জলে মুখ ধোয় - হাত দিয়ে মাথায় জল দেয় । ও এখন স্নান করে না - তার কারণ স্নানের ঘেরা জায়গাটা ব্যবহার করা ওর জন্যে এখন মানা হয়ে গিয়েছে । মাথায় মুখে জল দিতে গিয়ে ওর মনে হয় ওর চুল দাড়ি বড় হয়েছে - চুলে বোধহয় একটু জটও পড়ছে । আবার নিজের ঘরে ঢোকে মানব । তোষকের তলায় হাত ঢুকিয়ে একটা কাঁচি বার করে আনে, ফিরে আসে বাড়ির বাইরের জমিতে । ঐ কাঁচি দিয়ে চুল আর দাড়ি গোঁফ যত ছোটো করে সম্ভব কাটে । ওর অসুখ ধরা পড়ার পর একদিন ওদের পাড়ার চুল কাটার দোকানে গিয়েছিল মানব । দোকান চালায় মহাদেব ঠাকুর । বিহারের লোক । চুল কেটে হাতে একটু পয়সা হলেই দেশে গিয়ে জমি কেনে । তখন ও রোগা বেঁটে একটা জামাইয়ের জিম্মায় দোকান রেখে যায় । আগে আগে চুল কাটবার সময় ওর সঙ্গে খোসগল্প করত মানব । ওর দেশের হালচাল - চাষে কত জমি আছে - কি কি ফসল ওঠে - তার দর - এই সব । মহাদেব মানবকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠল - ঢুকবেন না, ঢুকবেন না দোকানে - চলে যান - যান এখান থেকে । দোকানে তখন পাড়ার দুটি যুবক ছিল । একজন একটা খবরের কাগজ পড়ছিল - আরেকজনের গোঁফে আর গালে সাবান লাগিয়ে মহাদেবের জামাই ক্ষুর চালাচ্ছিল । ওরাও গর্জন করে উঠল - ভাগ্, ভাগ্ শালা ল্যাংড়া এখান থেকে ।
মানব ওর খোঁড়া পা যতটা সম্ভব দ্রুত চালিয়ে ফিরে এল । তারপর শুভ্রা ওকে খাবার দিতে এলে একটা কাঁচি চেয়ে নিল । সস্তার কাঁচি - মানবের জট পড়া চুল কাটতে গিয়ে এটার ধার দ্রুত কমে আসছে ।
মানব আন্দাজ করে কি ভাবে খবরটা ছড়িয়েছে । ঐ ক্লিনিকের অ্যাসিস্ট্যান্ট বিকাশ - সানুর বন্ধু, ওর থেকে জেনেছে সানু - হয়তো বা মহল্লার আরও কিছু লোক । যা মানব জানে না তা হোল খবরটা পাবার পরেই সানু ওর বাবাকে ডেকে নিয়েছিল দোকান থেকে - বাড়িতে একটা বৈঠক বসিয়েছিল । মানবের রোগটা মারাত্মক ছোঁয়াচে, নি:শ্বাসের থেকে ছড়ায়, হাতে হাতে ঠেকলে সংক্রমণ হতে পারে - এমনকি চোখে চোখে তাকানোও বিপজ্জনক । এমন লোককে বাড়িতে রাখা যেতে পারে না । কিন্তু তাতে আপত্তি করল শুভ্রা - ওর দাদা ওদের সঙ্গেই থাকবে - মারা গেলে ওদের সঙ্গে থেকেই মারা যাবে । মানবের মা খালি কাঁদলেন, বাবা মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলেন আর মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন । শেষ পর্যন্ত সানু রফা করল - মানব ওর ঘরে একা থাকবে, ওর সব কিছু আলাদা করে দেওয়া হবে - আর ঘর থেকে যতটা সম্ভব বেরোবে না । ওদের নিজেদের শোয়ার ব্যবস্থাও পাল্টানো হোল - পাশের ঘরে মায়ের সঙ্গে তক্তপোশে শুভ্রা আর মেঝেতে সানু আর ওর বাবা ।
নিজের বিছানায় শুয়ে ঝিমোচ্ছিল মানব । এখন গরমকাল - ঘরের ভেতর গুমোট - ও অল্প অল্প ঘামছিল । এঘরের টেবিল ফ্যানটা মানবকে আলাদা করে দেওয়ার সময়তেই সরিয়ে নেওয়া হয়েছে । কার্বন ক্ষয় হয়ে গেছে বলে সিলিং ফ্যানটা ও আজকাল আর ঘোরে না । তবে মানব জানে এই তন্দ্রার ভাবটা বেশিক্ষন থাকবে না । কাশি আসবে, তখন বুক ধরে বিছানায় উঠে বসতে হবে ।
ওদের বাড়ির দরজায় দুম দুম করে কয়েকটা আওয়াজ হোল । জানালা দিয়ে উঁকি মারল মানব । দরজার বাইরে রাস্তার ওপর জন দশেক যুবাবয়স্ক ছেলে - সবাই এ মহল্লাতেই থাকে । সানুর ক্লাবের ছেলেও কয়েকজন আছে । মানবকে দেখতে পেয়েই ওরা চেঁচিয়ে উঠল, ঐ যে হারামির বাচ্চাটা । - বেরিয়ে আয় শালা শুয়ারের বাচ্চা, আজ তোকে খুন করে এখানে পুঁতব ।
চট করে জানালার পাল্লা বন্ধ করল মানব । একটা ঢিল এসে পড়ল বন্ধ জানালার ওপর । আর একটা - আরও একটা । সেই সঙ্গে চিত্কার - হারামির ব্যাটা, রাণ্ডিবাজি করে নিজে মরতে বসেছে, সেই সঙ্গে বাকি সবাইকেও মারবে - এই সানু, বার কর তোর দাদাকে, ওকে আমরা দেখে নেব - শালা ল্যাংড়া, হাঁটতে পারে না, মাগীবাড়ি যাবার সখ - শালা, যখন বেরোবি পেছনে বাঁশ ভরে দেব ।
কিছুক্ষণ ধরে এরকম চলল, তারপর সব চুপচাপ । মানবের ঘরের দরজার বাইরে ওর ভাই, বোন আর বাবা এসে দাঁড়িয়ে আছে - পাশের ঘর থেকে ওর মার হাঁ হাঁ করে কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে ।
মানব সন্তর্পণে জানালা খুলে দেখল, ছেলেগুলো নেই - চলে গেছে । রাস্তার ওপাশের বাড়িগুলোর জানালা খোলা, তাতে কৌতূহলী পুরুষ আর মহিলাদের মুখ । মানবের চোখে চোখ পড়তেই ঠাস ঠাস করে তাদের জানালার পাল্লাগুলো বন্ধ হয়ে গেল ।
মানব জানালা বন্ধ করে ঘরের দরজার দিকে তাকাল । ওর বাবার চোখের চশমার কাঁচ খুব মোটা, এমনিতেই চোখ বড় বড় দেখায় । এখন চোখদুটো আরও বড় দেখাচ্ছে - হতভম্ব হওয়ার মতো ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন । শুভ্রার মুখ ভয়ে শুকনো, গাল বেয়ে চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে । সানু চিত্কার করে উঠল, তোর জন্যে আমাদের এত অশান্তি । তুই চলে যা এ বাড়ি থেকে - আমাদের শান্তি দে ।
শুভ্রা ভাইকে বলল, এই, চুপ কর । তারপর মানবকে বলল, কি হবে দাদা ? ওরা যে শাসিয়ে গেল ।
মানব কিন্তু শান্ত । ঠাণ্ডা গলায় বলল, বাবাকে আর সানুকে নিয়ে ওঘরে যা । তোরা শুয়ে পড়্, আমাকে একটু ভাবতে দে ।
ওরা চলে গেলে মানব নিজের ঘরের দরজা ভেতর থেকে হুড়কো লাগিয়ে বন্ধ করল । তারপর এসে নিজের বিছানায় বসল । রাতটা এখন আশ্চর্যরকম শান্ত এবং স্তব্ধ । মানবের কাশি আসে - সেই কাশি থামলে ও একটু দম নেয় । ও একবার ওপরে সিলিং ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে দেখল । তার পর ওর নজর পড়ল ওর বিছানায় পাতা তেলচিটে ময়লা চাদরটার ওপর । একটা ইঁদুর ঘরের মেঝেতে ছুটে যায় । একটা আরশোলা ফরর্ করে উড়ে গিয়ে ঘরের ছাদে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে - তারপর ধীরে সুস্থে হেঁটে মানবের চৌকির তলায় ঢুকে যায় । ধীরে - অতি ধীরে মানব বিছানা থেকে চাদরটা তুলে নিল । ও জানে ওকে এখন কি করতে হবে ।