শব্দ হলো মাছের টোপ, মাছ হলো গান । শব্দেরও আগে আছে নি:শব্দ । লালনের গানে আছে না - যখন নি:শব্দ শব্দরে খাবে ...। ইমান আলী ফকির এখন পাশে নাই, আছে অন্ধকার, অন্ধকারের ভিতর ঘুম শরীর আর নি:শ্বাসের শব্দ, মাংসের ভাঁজ, ঘামের গন্ধ, প্রাণশূন্য কাম । কাম জেগে ওঠে, অথবা অভ্যাস - শরীরের অভ্যাস । বাহাই ফকিরের কন্যা জুলেখার শরীরে কাম খেলে না, অভ্যাসের কাছে শরীর পেতে দেয় । আলালও চাকর, অভ্যাসের চাকর । কিন্তু শব্দ ! শব্দের পিছে ছুটে চলার পথ কি ছোট হয়ে গেল ! নাকি সেই তাগাদা নাই ! কে জানে ! তবুও ইমান আলী ফকির আলালের স্মৃতি মন দৃষ্টি ঘিরে বসে রয়েছে । ইমান আলী তার মুর্শিদ নয়, তবুও মুর্শিদের অধিকার নিয়ে আলালের চেতন অচেতনে খবরদারি করে যায় । করবে না কেন, শব্দ খোঁজা শব্দের অর্থ বুঝে নিতে সে নিজেই তো মাথা কুটেছে । বাউল ফকিরী গানের শব্দ-মর্ম-তত্ত্ব বুঝতেই তো ইমান আলী ফকিরসহ আরো কত ফকিরের প্রশ্রয় পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে পথে নামা । পথের প্রথম সিঁড়ি শব্দ, শেষ সিঁড়িও শব্দ ! এতোদিন পর আলালের মনে হয় নি:শব্দই নিয়তি । এই নিয়তির ঘরে পৌঁছতে দরকার শব্দের সিঁড়ি ভাঙ্গা । ফকিরী গান সংগ্রহ এবং গানের মানে বুঝতে এসেই আলাল মণ্ডলের শব্দযাত্রী হওয়া । শব্দতো শুধু নয়, শব্দের বস্তুত্ত্ব বুঝতে হবে, কথাটা হলো না, শব্দের বস্তুত্ত্ব দেহে অনুভব করতে হবে । তবেই শব্দ নাগালে আসবে । বরফ, আগুন, পানি ইত্যাদি শব্দ লিখে ফেলা যায়, মুখে উচ্চারণ করতে বাধছে না, তাতে কী হলো, বরফ লিখলে কি ঠাণ্ডা হিমের অনুভব হচ্ছে ? আগুন লিখলেই কাগজটা পুড়ে যাচ্ছে না বা পানি লিখবার পরই তার আর্দ্রতা প্রবহমানতা টের পাওয়া যাচ্ছে ? ইমান আলী ফকির যেমন বলেছিল, `গানের পেছনে ছুটছো এখন, এরপর সেই গানের ভাবের নিরাকরণ করতে চাইবে তো ? আমি বলি কি জানো, তুমি আগে শব্দের পেছনে ছোটো । তারপর গান খোঁজো ।' তাইতো ! আলাল মুহূর্তে মজে যায়, শব্দ কি ? ভাবের ওপর চড়ানো একটা নাম, সেই নামও আপেক্ষিক । ভাবের যে বস্তুসার সেটাই মোক্ষম । ইমান আলীর কথা, `বস্তুকে জানো তা হলেই শব্দের খোসা খুলে শাঁস বেরিয়ে যাবে ।' আহা, এইতো আলাল মণ্ডল খোঁজ করছে । না হলে আর বাউল ফকির সঙ্গ কেন ? আলাল মণ্ডল অন্ধকারের ভিতর চোখের তারা ফুটিয়ে ইমান আলী ফকিরকে হৃদয় ও বোধের শিরায় ঢুকিয়ে নেয় শেষ পর্যন্ত সেই নি:শব্দই সার । সৃষ্টির পয়লা দিনে ছিলো নি:শব্দ, আখেরি দিনেও থাকবে নি:শব্দ । মাঝখানে এই কদিন আমরা তৈরি করছি শোরগোল-শব্দ । ফকিরদের কথা বোঝা ভার, তা বুঝলেও ভার তো লাঘব হয় না । সেই ভার ও ভাবের খোঁজেই সে শব্দযাত্রী । এই যাত্রাপথের তরিকামতে ধরতে হয় মুর্শিদ, গুরু । গুরুই নিরাকার স্রষ্টার সাক্ষাৎ প্রতীক । অন্তত সেই প্রতীকের সুলুক সন্ধান দিবে । আলাল মণ্ডল এমন অনেককেই মুর্শিদ বানিয়েছে, বাহাউদ্দিন বা বাহাই ফকির, ইমান আলী ফকির এমন কি পশ্চিমবঙ্গের কোন এক গোরডাঙ্গা গ্রামের আধপাগলা নিজামীও তার মুর্শিদ বা ভাবমুর্শিদ । ভাবমুর্শিদ আবার কী ! ফকিরী সাধনায় কেউ ভাব ভণিতা মেনে নিবে না ঠিক, কিন্তু আলালের মনে সমস্যা তৈরি হয় না । একলব্যের মতো তার সাধনা । শব্দের ভিতর কত কুহক বিভ্রান্তি ছলনা সত্য ঘাপটি মেরে আছে - পরোক্ষে হলেও যে ধরিয়ে দেয় সেই হতে পারে গুরু, অন্তত আলালের হতে পারে । শব্দের প্রেমে মজেই তো এতদূর, এইভাবে যাত্রী হওয়া,
অমৃতের সুধা রসে না ফুটির চাল
শব্দভাবে জব্দ হবো আর কতকাল
কতকাল মাটি হবে যৌবনের
শব্দের বীর্য ঘেঁটে বুঝ অর্থ মৌবনের ।
ফকিরী ঢংগে এসব কাঁচা বয়সে লেখা । এই পথের জন্য হয়তো বয়সটা কাঁচাই ছিল । সাহিত্যে এম. এ পর্যন্ত পড়া আলাল ছন্দ মাত্রা বুঝে একরকম, ছোট বড় কাগজে কবিতা লিখে পরিচিতিও জুটিয়েছিল, কিন্তু মনের খোরাক সে খরিদ করতে পারেনি ।
মাছ অন্ন মুখে রোচে ভাই
নারী যোনি কামনা মিটায়
মনের আহার সুখের শানাই
কোথায় বাজেরে কোথায় কাঁদায় ।
খুঁজে দেখ খুঁজে নেও গোপন ভারার
খোসা ভেঙে জিবে তোলো আনন্দ পসার ।
আলাল মণ্ডল সেই মোকামে এখনো পৌঁছল না, খোসা খসিয়ে আমূল সফিনা হয়ে পড়ল না অনেক কিছুই রহস্যঘেরা বাতেনি জগতের যে সাধনা সে তো আনন্দেরই পথ । সেই আনন্দ আর অহংকারের গোমরে যুগ যুগ ধরে ফকিরী শব্দে বাক্যে আলো আঁধারির চাদর বোনা । চাদরের হিসাব করা সূতার ফাঁসে পানি নিংড়ে পড়ে মাছের আস্তরূপ ঝলসে উঠবে চাঁদের জোছনায় । মাছবস্তুর রূপ ও স্বরূপ জোছনা পানি আর চাদরের গুণ ধরিয়ে দিবে মুর্শিদ, কর মুর্শিদের ভজনা । বাতেনি সাধনার রসে কষে আলাল মণ্ডল নিজেকে মিলিয়ে দিয়েও কুল পায় না,
আমার মগজ যোনি শ্রবণ শরীর
উদলা কইরা দিলাম সাঁইরে
সাঁইজি আমার, লিঙ্গ পশে অচিন দেহের
ঢেউ ভাঙে ঢেউ খেলে জোছনা শরীরে
সুখের খেলায় জ্বালায় পোড়ায়
পুইরে পুইরে কয়লাআগুন ফর্সা হয়
আগুনকয়লা ফের নিভে, হায়
ভবের জোছনা কেমন শরীর কাঁপায়
সাঁই বলে ভজনা করিস গুরুলিঙ্গ
বাতেনি সুখের মধুসঙ্গ ।
বাতেনি সুখ না কৌতূহল ! ফকিরদের কৌতূহল নাই, কৌতূহল অতিক্রম করে দেহ ও বোধে সব ধারণ করে নেয় । দেহবাদী দেহতাত্ত্বিক বলেও ফকিরদের পরিচয় আছে । গানের শরীরে ভাবের প্রকাশ ঘটে শরীর অঙ্গ ভর করে । গুরুলিঙ্গ হলো মুর্শিদের কথা, মগজযোনি হলো শিষ্যের কান, বোধ । বাহাই ফকির আলালের গান শুনে পিঠে হাত রেখে বলেছিল, ভদ্রলোকের ছাওয়াল দেহ ফকির বইনা গেছে, সব মুর্শিদের মর্জি । আলাল অন্ধকারের মধ্যে নি:শব্দে হাসে, নিজের অলস একটা হাত বাহাই ফকিরের কন্যা জুলেখার ওপর ফেলে আবার সরিয়ে নেয় । আলালের ভাল লাগে না । ফকিরের বাতেনি সাধনার বড় বিষয় মোহাম্মাদের সাথে আল্লাহর কথোপকথন, আর কোরআন । কোরআনের তিরিশ পারা যা সকলেই জানে, ছাপার কালিতে কটি কপি, হাজার বছর ধরে লোকে সেই সব জানে । এই `ছাপি' না তিরিশ পারা ছাড়া আরো ষাট পারা বাতেনি রয়ে গেছে । সেই গুপ্ত অধ্যায়ের সাধনায় ফকিরদের হেয়ালিপনা নাই, তারা সিনায় সিনায় বাতেনি কিতাবের মর্মকথা লেনদেন করে । ফকিরদের নব্বই পারার হিসাব এমন, কোরআনের জাহির হওয়া তিরিশ পারা নিয়ে মোল্লা মৌলবীগণ আচার, আচরণে ব্যস্ত । ফকিরদের জন্য দশ পারা, এই দশ পারা নিয়ে তারা মুর্শিদের মুরিদ হয়ে কাজ কারবার করে, বাকি পঞ্চাশ পারার মধ্যে বিশ আছে আরশে, বিশ আছে `কুরমে', আর দশ আছে কবরস্থানে । ফকিরদের মত হলো, এই নব্বই পারা কোরআনে নব্বই হাজার কথা আছে, তার তিরিশ হাজার জাহির আর ষাট হাজার বাতেনি । আলাল মণ্ডল অন্ধকারের ভিতর শরীর কাঁপিয়ে শ্বাস ফেলে ফকিরী গানের দুটি লাইন মনে করে, খাতায় হয়তো পুরা গানটিই লেখা আছে ।
`মারফতি বিচার করে বসিয়ে শরীয়তের কোলে
ষাট হাজার গোপনের কথা নিষেধ করছে রসুলে ।'
বাতেনি ষাট হাজার পারা রসুলের কথাতেই গোপন রয়েছে । ফকিররা তা জেনেছে পরস্পরের সিনায় সিনায় । কী জানে বাহাই ফকির বা ইমান আলী ? কতটুকু নিজে জেনেছে আলাল তা বুঝতে পারে না, ঝাপসা কথার হেয়ালি ছাড়া কী ! শব্দের মজা ! শব্দ আবিষ্কারের ভিতর অধরা ধরার আনন্দ আছে, অভিনব কায়দায় ভাব প্রকাশের ফকিরীপথ আনন্দদায়ক বৈকি ! আলাল এই মজাতেই মজে আছে । মাথা গরম করে দেয়ার মতো অনেক কথাই ফকিররা বলে, সেই বলার মধ্যে যুক্তি ও সুরের বৈচিত্র্য আছে । মেয়ারাজে আল্লার সাথে রসুলের যে কথা হয়েছিল সেই কথার তিরিশ হাজার প্রকাশ হয় তিরিশ পারায় । কিন্তু ফকিররা খোদ মেয়ারাজে আল্লার সাথে রসুলের দর্শন নিয়ে প্রশ্ন তোলে, যদি আল্লা নিরাকার হয় তবে আদম সন্তান রসুল কি করে নিরাকারের সাথে মিলেন ! বাউল ফকিরদের গুরু স্বয়ং লালন ফকির প্রশ্ন তোলে,
`মেয়ারাজের কথা শুধাব কারে
আদমতল আর নিরূপ খোদা
নিরাকারে মিলে কি করে ?'
তো শব্দ ভাব যার চেতনা দখল করে থাকে সেই আলাল মণ্ডল কেন
পথে বের হবে না ! শব্দযাত্রী আলালের লক্ষ্য শব্দ, বস্তুর আধার, আরো
হয়তো কিছু, হয়তো জুলেখাও । জুলেখা মানে শরীর, বয়স, বয়সের
দাবি-দাওয়া, অথবা জুলেখা বাহানা মাত্র, বাহাই ফকিরকে পাওয়াই তার লক্ষ্য
। হতে পারে । সেজন্য জুলেখাকে ব্যবহার করার দরকার ছিল ? আলাল
হয়তো করেওনি । অন্তত সচেতনভাবে করেনি । কিন্তু এখন, আজকাল
রাতের এমন ঘুমহীন প্রহরে সে ক্লান্তিবোধ করে, ধরা অধরার স্বাদ
অর্থাৎ অর্থ-অনর্থের সাথে বোঝাপড়ার এই কালে জুলেখা বড়ো অতিরিক্ত
। ঘুম-তন্দ্রা-ঝাপসা অন্ধকারের ভিতর জুলেখা পড়ে আছে, ব্লাউজ ছাড়া
শরীরের ওপর হয়তো শাড়িও নাই, নেতানো বুকদুটি ভারি ও ঠাণ্ডা ;
আলাল মণ্ডলের শরীর ঘিনঘিন করে, ধরেও দেখতে ইচ্ছা করে না ।
জুলেখা ফকিরের মেয়ে, ঠোঁটের নিচে চিকন হাসির ছায়া লেপ্টে
থাকে আলালের । জুলেখা তা দেখতে পায় না, আলালও এই হাসি বিষয়ে
সচেতন নয় । গাঢ় রাতের নি:শব্দ জোছনার স্বাদ নাই, তবুও মাথার
কাছের জানালা দিয়ে এক টুকরা জোছনা বিছানার চাটাইয়ে এসে পড়ে
থাকে নোম্যানস্ ল্যাণ্ডের মতো । এই জোছনার ভিতর আলাল তার শরীর
বা হাত বা কিছুই ফেলে না, জুলেখাও না । মেঘ অথবা সময় যখন
জোছনা রেখার পরিবর্তন ঘটায় তখন জুলেখা ভারি নি:শ্বাস ফেলে ।
আলাল ডাকে, এই ডাকের আগে সে কখনোই বুঝতে পারেনি সে
জুলেখাকে ডেকে উঠবে । ডাকা না ডাকার পুরা এখতিয়ার আলালের ।
আলাল যেদিন বাড়ি থাকে, বিছানায় শোয়, সেদিন জুলেখার ঘুম অঘুম
নিরপেক্ষ চেতনা আলালের ডাকে সাড়া দিবার অভ্যাসে তৈরি । আলাল
আবার ডাকে,
বউ !
বউ উত্তর করে না ।
বউরে ।
বউ জোছনা সরে যাওয়ায় নোম্যান্স ল্যাণ্ডের সীমা পার হয়ে এগিয়ে এসে
একইরকমভাবে শুয়ে থাকে । আলাল হাত বাড়িয়ে জুলেখার স্তনের ওপর
রাখে, করতল জুলেখার ঠাণ্ডা শরীর টের পায়, যদিও জুলেখা নিজ থেকে
শোওয়ার ভঙ্গি পাল্টায় না, এই সবের দায় দায়িত্ব আলালের । আলাল
বললে, বলা মতো অথবা আলাল নিজেই সুবিধা মতো শরীরের অবস্থান ঠিক
করে নিবে ।
বউ !
বউ এখনো নিশ্চুপ ।
বউ আমার শরীরের
ওপর উঠে শোও ।
জুলেখা উঠে শোয় । আলালের হাত তাকে আকড়ে ধরে না । বরং বুকের ওপর চাপ পড়ায় জুলেখাকে কাত করে শুইয়ে দেয় । জুলেখা আরো একটা ভারি নি:শ্বাস ফেলে । উঠানের অন্যপ্রান্তের ছাপড়া থেকে বাহাই ফকির কাশে । আলাল মণ্ডলের বুকে আটকে থাকা বাতাসও শরীর কাঁপিয়ে বের হয়ে আসে । একটা গান বুকের ভিতর খচখচ করে ওঠে, জিবে শব্দ আসে না, কোনো এক গভীরে শব্দগুলি গুঞ্জন তোলে,
আলো আধারির রাতবেলা
আল্লা রসুল কাবা কালা
দিশা বিদিশার ঝুট ঝামেলায়
একলা আলাল কেমনে মিলায়
যোনির ভিতর লিঙ্গ ঠেলে
সুখ দু:খ কি যে মিলে
একলা আলাল যত জানে
অন্য কারো বিষম হইবে ।
গোপন কথার অন্ধঘরে
চান সূর্য কোন অধিকারে
টোকা মেরে চোখ দিবে
আলাল তাহার কারণ জানতে চায় ।
এই কারণ জেনে আলালের কী হবে, কী হয়েছে আলাল তোর !
আলালের ঠোঁট বিড়বিড় করে । গোপন কথার ফাঁসে শরীর চেতনা
সেধিয়ে এখন আলাল আর তেমন মশগুল থাকতে পারে না,
দ্রুত ভাব কেটে
কথার খেই হারিয়ে ফেলে । বাহাই ফকির আলালের মন বুঝতে পারে
কি না বোঝা যায় না, বলে - (মুর্শিদের) বীর্যের অনাচার করতে নাই
...। আলাল তার শরীর শ্রবণযোনি পেতেই রাখে, তবুও লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে কী
করা যায় ! ধ্যান ও সাধনা কখনো শুকনা বরইর মতো টুপ করে খসে
পড়ে নি:শব্দে । আলাল সেই শুকনা বরই জিবে তুলে টক মিষ্টি স্বাদে
আপ্লুত হতে চায় না । অথবা চাওয়া না চাওয়া নিজের কাছেই রহস্যের
মতো । জুলেখার চোখের পানি আলালের আঙুলে লাগে । দশ আঙুল দিয়ে
আলাল জুলেখার ঠাণ্ডা ভিজা অভিমানে ভরা মুখটি চেপে ধরে দুই চোখের
পাতায় চুমু দেয় । জুলেখাও তখন আলালকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানির
ধারা বিগলিত হতে দেয় । চাঁদের ওপর মেঘের দখলদারি পুরা হওয়ায়
অন্ধকার বেশ জোরাল, গরমও পড়েছে, আলাল জুলেখার শরীরের ঘাম চটচট
করছে । গরমের কারণেই হবে, আলাল দরজা খুলে উঠানে আসে ।
জুলেখাও শাড়ি গুছিয়ে নিয়ে আলালের পাশে এসে দাঁড়ায়,
পাটি
বিছাই দিব ? বসবা ?
আলাল উত্তর দেয় না । জুলেখা দরজার পাশ থেকে মোড়ানো পাটি
এনে পেতে দেয় । আলাল বসে । জুলেখাও আলালের গায়ে ঠেস দিয়ে বসে
বলে,
একটা গান ধরবা ?
ফকির বাবার ঘুম ভাঙবে ।
উনি
জাইগাই আছে ।
আলালের মনে এখন গান বা সুর আসছে না, কবিতার ঘন্টা বাজছে, সেই কবিতা হয়তো জুলেখাকে স্পর্শ করবে না, কিন্তু সে কি করতে পারে !
জলবাষ্প জমে জমে
মেঘ হলো জোছনার ঘরে
চাঁদ ডোবে আলো নিভে
অচেনা চেতনা বোধে আসে
ভাবনা আকাশ অর্থ বোধে
কেমন কেমন করে ।
জলের কণায় মেঘ হলে
মেঘ কেন জোছনা লুকায়
জলের ভিতর চাঁদ দেখা যায়
সূর্য হাসে সকাল দুপুর
সেই জলে আবার আধার নামে
আলাল ফকির সেই কারণ জানতে চায় ।
মাইনে খুব সোজা, পানি যখন ম্যাঘ হয় তখন আর পানি থাহে না,
এইডা বোঝো না ! জুলেখার শান্ত আঁশহীন পরিষ্কার কথা শুনে আলাল
চমকে যায়, বুদ্ধি ও ভাবের কথা সে কখনো জুলেখার কাছ থেকে
শোনেনি । আলাল তার মুখ উঁচু করে ধরে,
তুই বুঝোস, পানি আর
ম্যাঘের ফারাক ?
জুলেখা আলালের হাত সরিয়ে দেয় ।
আমি বাহাই ফকিরের মাইয়া । দলীল উদ্দীন ফকিরের নাতি, তোমার বাপ দাদা কি ফকির জাতের মানুষ ছিলো ?
আলাল মণ্ডলের বংশে কেউ ফকির ছিল না, ফকিরের সাথে কেউ ওঠাবসাও করেনি । আলাল নিজেই রক্তের যোগাযোগহীন পথে নেমে হয়তো রক্তের স্বাদ পেয়েছিলো । সেই কবে থেকেই এই পথে, এম এ ভর্তির পর অনির্দিষ্টকালের বন্ধ, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলও ছাড়তে হয়েছিল, সেই সময় নোটবুক ছোট একটা টেপরেকর্ডার নিয়ে আলাল মণ্ডল আবার বের হয়ে পড়েছিল, বের হয়ে সে নিজের গ্রামেই আসে । খুলনা বরিশাল মহাসড়ক ধরে হাঁটতে হাঁটতে নির্মীয়মাণ বেইলি ব্রিজের পাশে ধুলার পলি জমে ঝাপসা একটা ছাপড়ার সামনের বেঞ্চে বসে । ছাপড়ার বেড়া বেয়ে চালে উঠে এসেছে কদু গাছের লতা, সাদা ফুল সবুজ পাতা ধুলায় ধূসর, তবুও কদু গাছের ডগা আকাশের দিকে হা করে চেয়ে আছে । ছাপড়ার ভিতরে কাচের বয়ামে কয়েক রকম বিস্কুট, মাটির মালশায় নুন ডাল সোডা, পিছনের র্যাকে বিড়ি সিগারেট, পাশে চটের বস্তার ভিতর পলিথিনের ব্যাগে মুড়ি, কেটলিতে চা ফুটছে, কেটলির লালচে এলমোনিয়ামে কোন ধুলা নাই, সরু একটা সসপেনে দুধ, দুধের ওপর পুরু সর । হাফপ্যান্ট পরা খালি গায়ের একটা ছেলে এই চা, মুদি করছে । তেলে লেপ্টানো চুল, গায়েও প্রচুর তেল চকচক করছে । আলাল একসঙ্গে দুই কাপ চা চেয়ে দোকানের ভিতর আরো খুটিয়ে দেখে । একজন মধ্যবয়সী লোক ছাপড়ার ভিতর ছায়ায় মিশে চোখ বন্ধ করে বসে আছে । তারও গা উদাম, সাদা লুঙ্গি, হাজিদের রুমালের মতো একটা কাপড় কাঁধে ফেলা, আলাল লক্ষ করে দেখে, লোকটা বিড়বিড় করে কী যেন বলছে । আলাল চায়ের কাপে চুমুক দিতে ভুলে যায়, লোকটার চওড়া কপাল, বড় চিবুক, থুতনিতে সরু এক গোছা কাঁচাপাকা দাড়ি, পিছন দিকে আঁচডানো চুলের মাঝখানে সিঁথি । আলাল আস্তে করে বলে, তোর আব্বা ? ছেলেটি উত্তর দেয় না । উনি তোর আব্বা ? ছেলেটি দুইদিকে মাথা দুলিয়ে না জানায় । আলালের কাছে কেমন চেনা চেনা লাগছে । ইমান আলী ফকিরের চেহারার সাথে মিল তো আছেই, আরো কতজনের সাথেই মিল ঘটছে । কোথাও পরিচয় হয়েছিল ! বাউল ফকিরের কপি করা চেহারা । আলাল ভিতরে ভিতরে চঞ্চল হয়ে ওঠে, ঝঁংউকে পড়ে জানতে চায়, তোর কিছু হয় ? ছেলেটি এবার গোল পিতলের চামুচ দিয়ে দুধের সর এক পাশে সরিয়ে দুধ তুলে আবার ছাড়ে । গরম ধোঁয়ার সাথে ঘন দুধের গন্ধ ভেসে আসে । সেই গন্ধই হয়তো নাক দিয়ে টিনে ছেলেটি বলে, চিনেন না, উনি গান করে, বাহাই ফকির । আলাল হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে ঠাস করে বসে, সেই বসার ঝাঁকিতে বেঞ্চে চা পড়লেও তাকিয়ে দেখে না । ছেলেটি গামছা এগিয়ে দেয় । আলালের সেদিকে খেয়াল নাই, সে পা ভাঁজ করে দোকানের চৌকি বা মাচায় পিছন ঠেকিয়ে বসে দুই হাত এগিয়ে বাহাই ফকিরের পা ছোঁয় । ঠাণ্ডা খসখসে পা, এক মুহূর্ত হাত রেখেও দেয় । বাহাই ফকির চোখ খুলে আবার বন্ধ করে রাখে । আলাল মণ্ডল অপেক্ষায় থাকে । ফকিরী সাধনা বা লোকধর্মের বাতেনি ঘরানার কতগুলি কায়দা আছে । অথবা মার্গসঙ্গীতের মতো বন্দিশ, কেতা জানা না থাকলে গুরু ধরা দিবেন না । আলাল মণ্ডলের সেসব প্রায় জানা, তেমন সহবতো সে আয়ত্ত করেছে । আসল বস্তু হাসিল করার পথঘাট বুঝতে বেশি বাকি নাই । বাহাই ফকির চোখ বন্ধ করে রাখে । চা-স্টলের ছেলেটি আলালকে দেখে নিজেই বেঞ্চের চা পরিষ্কার করে বলে, চা জুরাই গেল । চা জুরাই যাক আর ফুরাই যাক, আলাল মণ্ডল আসল লোককে পেয়ে গেছে, এর খোঁজেই তো আসা । অবাক ব্যাপার, শব্দতত্ত্বের নরেন স্যার যেমন যেমন বলেছিল তার একচুলও এদিক ওদিক নাই । এ জন্যই খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছিল । আলাল মণ্ডল মনকে শক্ত করে চোখ বন্ধ বাহাই ফকিরের উদ্দেশ্যে বলে, বাবা, বেশরা (বেশরীয়ত) ইনসান আলিফ না লেইখা কেমনে আল্লাহ ধ্বনি কলপে আনবে । বাহাই ফকির চোখ খোলে না । আলাল মণ্ডল তার মনোযোগ দখল করবেই, বলে, বেশরা ফকির গাছের গোড়া চিনে না, ডালে ডালে ঘুইরা বেড়ায় ...। আলাল মণ্ডলের সতর্ক উত্সুখ চোখ বাহাই ফকিরের ওপর । বাহাই ফকির তেমনি সব অগ্রাহ্য করে চোখের পাতা দৃষ্টির ওপর ফেলে রাখে । সাহস সঞ্চয় করার সঙ্গে জেদও আলাল মণ্ডলকে পেয়ে বসেছে, বাহাই ফকিরের মুখ সে খোলবেই । বলে, আচ্ছা বাবা শরীয়ত বাদ দিয়া কেমনে মারফতে পৌঁছতে চান ? শরীর ছাড়া রুহু নিয়া আহত হওয়ার চাপ । মুখে কথা নাই, দোকান থেকে নেমে রাস্তায় এসে দাঁড়ায় । আলাল চায়ের দাম দ্রুত মিটিয়ে ফকিরের পিছে অপেক্ষা করে । ফকির একবার দেখে হাঁটতে শুরু করে দেয় । আলাল মণ্ডল পিছন থেকে এগিয়ে তার পাশে পাশে হাঁটে । বাহাই ফকির চুলের ওপর হাত বুলিয়ে দাড়িতে হাত রেখে বলে, দুখের কথা কি জান বাবা, বুইঝা না বুঝার ভণিতা করা । আলাল মণ্ডল কোন কথা বলে না । দূর থেকে একটা ট্রাক হর্ন বাজিয়ে আসছিল, আলাল বাহাই ফকির পাশে সরে ট্রাকটিকে যেতে দেয় । ট্রাক ইচ্ছামতো ফাল্গুনের শুকনা ধুলা উড়িয়ে ছোটে । ফকির বলে, দুলা উরলে চোহে মুহে হাত দেও ক্যা ? দেও দুলা লাইগ্যা যাতে চোখ কানা না হৈয়া যায়, মুহের ভিতর বালি কিচকিচ করবে । হেই রহম, আগেই বর্ণমালা শিখা না থাকলে নিজের বাপের নাম লেখবার নামবা না । বর্ণপরিচয় না থাকলে শব্দ কোথায় পাবা ? অক্ষর শব্দ মিলা লাইন, পরথম স্তর, তারপর আসে জ্ঞানবুদ্ধির কথা । শরীয়ত না বুইঝা মারেফতের চুলও ছুঁইতে পারবা না । ফকিররা বেশরা না, শরীয়ত পাশ । আলাল মনে মনে খুশি, সে ঠিক পথেই আছে, কোনো কথা না বলে একটা গান ধরে, সুর ছাড়াই শব্দগুলো তালে তালে বলে ফকিরকে শোনায়,
ভূমি যদি হয় শরীয়ত
বীজ দানা হয় মারেফত
গাছ ভাই শরীয়ত হলে
মারেফত মিলে ফুলে ফলে
মারেফত পথ হইলো কেমন
যদি শরীয়ত না শিখল বামন
আগে শিখ আলিফ লায়লা
পরে বল লা ইলাহা ইল্লালাহ
বাহাই ফকির আলাল মণ্ডলের গা ঘেষে হাঁটতে হাঁটতে হাত ধরে বলে, বাবা এই মুহে আমার বাড়ি । আলাল বাহাই ফকিরের হাত ধরে খুলনা বরিশাল মহাসড়কের ঢাল বেয়ে নামে । দুই পাশে পাটনাই গমের চারাক্ষেত । সরু আইল ধরে এগিয়ে এলে ডোবার মতো একটা পুকুর । পুকুরে হয়তো পানির বদলে কচুরিপানাই বসত করে নিয়েছে । ডোবার পার ঘেষে উচু জমিতে একটা আমগাছ । গাছের পুরা ছায়া পড়েছে ডোবা বা পুকুরে । আমগাছের পরেই একচালা ছাপড়ার ওপর শেষ দুপুরের রোদ, ছোট উঠানের দক্ষিণে চালার নিচে রান্নাবান্নার আয়োজন চলছে । আলাল এবং বাহাই ফকির উঠানে এসে দাঁড়ালে রান্নার আয়োজনকারী ফকিরের বউ ঠোঁট ছড়িয়ে হেসে পাশের টুলটি এগিয়ে দেয়, বসেন । এমন সহজ স্বাভাবিক অভ্যর্থনা দেখে মনে হতে পারে আলাল মণ্ডল নামের কেউ এই পড়ন্ত দুপুরে এসে হাজির হওয়ার কথা ছিল । বাহাই ফকির আলালকে বসতে অনুরোধ করে ঘরের চাল থেকে হুক্কা নিয়ে আসে । বাহাই ফকিরের বউ কোন কথা না বলে হুক্কা থেকে কলকি খুলে চিটা মাখানো তামাক ঠেসে, একটা বড়ি কলকির ওপর বসিয়ে পাটখড়ির আগুন দিয়ে আগুনের সংযোগ শেষ করে ফকিরের হাতে ধরা হুক্কার মাথায় বসিয়ে দেয় । ফকির দুই তিন বার টান দিয়ে আবার ছেড়ে গড়গড়ি ঠিক করে ঠোঁট ছড়িয়ে নি:শব্দে হাসে । আলাল মুগ্ধ চোখে হুক্কা পর্ব দেখা শেষ হতে হতেই বিস্মিত হয়, পনের ষোল বছরের একটা মেয়ে একপ্যাচে শাড়িপরা, ফকিরের গা ঘেষে বসে । আগন্তুক সম্পর্কে কোনো কৌতূহল তারও নাই । বাহাই ফকির বলে, আমার ছোটো মাইয়া জুলেখা, ভারি ন্যাওটা । ফকিরের সংসার ও বাত্সল্য দেখে আলাল অবাক হয় না, ফকিররা সংসার বিমুখ নয়, সংসার সন্তান রিপু মিলে প্রতিদিনের আটপৌড়ে মানুষদের সাথে তাদের অমিল শুধু বোধ বুদ্ধিতে, তরিকায় । বাহাই ফকির আলালের দিকে তাকিয়ে অর্থময় হাসি হাসে । এই হাসির অর্থ আলাল এখন বোঝে, ফকিরদের লেনদেন হয় সিনায় সিনায়, ফকিরী সাধনার অনেক পথ ঘাট আকার ইঙ্গিতই তার চেনা । আলাল বাহাই ফকিরের হাসির উত্তর দেয়,
সাঁইরে আমার মানব প্রেমিক
সাধনা তাহার আল্লাহ
সাধন পথের মুর্শিদ নাবিক
দাড়ি দ্বারে নাই জেল্লা
বাহাই ফকির মিট মিট হেসে তার বাবা দলীল উদ্দীন ফকিরের একটা গান মনে করে, গানের কথাগুলি গলার এসে ভিড় করে, কিন্তু ঠোঁট জিব কেন যেন বিগলিত হয়ে ওঠে না । মেয়ের তেলমাখা চুলের ওপর অনাবশ্যক হাত ডলে । আলাল মণ্ডল বরং বলে, সংসার সন্তান কাম ইচ্ছা সবার মধ্যেই তার হাজিরা আছে ; এই সব হেলাফেলা করলে সাধনার লক্ষ্যবস্তুরই ক্ষতি হওয়ার কথা,
হিল্লি দিল্লি চিল্লা গেলি
হজ মক্কা সব পেলি
পয়সা কড়ির শ্রাদ্ধ হলো
খোদার দেখন কোথায় মিলল ?
ঘরের ভিতর মাটির সানকি
গায়ে গায়ে মেয়ে মাগী
বিছনা চাদর হোগলা চাটাই
খোদার আদর সিনায় সিনায় ।
বুঝতে বিফল হলে যদি
মুর্শিদ তোমার হবে বাদী ।
গান শেষ করেই আলাল মণ্ডল বাহাই ফকিরের পা ছোঁয় । বাবা আপনিই আমার মুর্শিদ, আমারে ফিরাবেন না । জুলেখা তখন শব্দ করে হেসে ওঠে । বাহাই ফকির জুলেখাকে বলে, যাও মা, মেজবানের খাবার তৈয়ার হইছেনি দেহ । জুলেখা উঠে গেলে বাহাই ফকির আলাল মণ্ডলের নাম ঠিকানা ইত্যাদি বিত্তান্ত জেনে বলে, ফকিরী ধর্ম বইলা কিছু নাই বাবা । আমাগো তরিকার নাম ফকিরী । শরীয়তের আল্লা রসুল আমাগোও আল্লা রসুল । তবে, লোক দেখাইনা নিয়ম আকীদায় ফকিররা ভরসা পায় না । আবার বাবা, যা চোহে দেহি না তা দেহেও ধারণ করতে পারি না । মোল্লাগো আল্লা নিরাকার, সেই নিরাকারের সব আদেশ আবার ছাপিনা হইয়া গেল । আমরা সেই নিরূপের রূপ ঠাহর করি মুর্শিদের ভিতর । মুর্শিদই আমার কাণ্ডারি । আমি তার মুরিদ হইয়া কেমনে তোমার মুর্শিদ হই গো বাবা ! তাছাড়া বাতেনি তরিকার কত গুমর আমারই দেহ মনে জানা হয় নাই । রাইত দিন তার ভজনা কইরাও কুল পাবার লাগি নাই । আলাল মণ্ডল মনে মনে বলে, বাবা বাহাই ফকির, সাঁইজী আমার, তুমি নিয়মের মুর্শিদ না হইলেও মুর্শিদ । অনেক বাতেনি তত্ত্বের কিনারার হদিস তুমি দিবার পারবা । মনে মনে এসব বললেও আলাল ঢিপ করে বাহাই ফকিরের পা ছুঁয়ে নেয় । তখন জুলেখা আসে, পিছে তার মা, মাথার ঘোমটা টেনে বলে, বাবা তাইলে আসেন, গরীবের সাথে মুহে কিছু দেন, আমরা খুশি হবো । আলাল মণ্ডলের চোখে তখন পানি চলে আসে - এই সরল, নি:স্ব, প্রেমে ভরা মানুষগুলির ওপর কত নির্যাতন, ফতোয়া যুগ যুগ ধরে ঘটেছে । কাফের মোনাফেক অসভ্য ফকিরদের পুড়িয়ে মেরে ফেলার ফতোয়াও মোল্লারা দিয়েছে । আলালের মনে পড়ে, রংপুরের মৌলানা রেজাউদ্দীন আহমদের `বাউল ধ্বংস ফতোয়া' গ্রন্থে `এই বাউল বা ন্যাড়া মত মোছলমান হইতে দূরীভূত করার জন্য' পাড়া মহল্লায় মসজিদে মসজিদে কমিটি করে দায়িত্ব পালনের জন্য আহবান জানানো হয়েছিল । `বাউল ধ্বংস ফতোয়া' প্রকাশের কিছু বছর পর মওলানা আফছারৌদ্দীনের নেতৃত্বে কুষ্টিয়ার ছেউরিয়ার আখরায় সমবেত লালন পন্থী বাউল ফকিরদের চুলের ঝুটি কেটে অপদস্ত করা হয়েছিল । অন্যদিকে কাজী আব্দুল ওদুদের মতো মুক্তবুদ্ধির মানুষ বাউল ফকির তথা মারফত সাধনার সাধকদের ওপর নিপীড়নের প্রতিবাদ করেছেন । তিনি মারফতপন্থীর ভিতরে দেখেছিলেন `জীবন্ত ধর্ম, সৃষ্টির বেদনা, পরিবেষ্টনের বুকে সে এক উদ্ভব; আর মওঅলানা শুধু অনুকারক, অনাস্বাদিত পুঁথির ভাণ্ডারি - সম্পর্কশূন্য ছন্দোহীন তার জীবন ।' ছন্দোহীন তো বটেই । ফকিররা শব্দ ও ভাবের গিঁঠেগিঁঠে ছন্দ তাল লয়ের অশ্রুতপূর্ব ধ্বনি সঞ্চার করে মানুষের সরল বিশ্বাসে শুধু নয়, তার মগজ মেধাতেও সাড়া দেয় । আলাল মণ্ডলের ইচ্ছা হয় বাহাই ফকিরের মত জানতে, কেন মোল্লারা ফকিরদের ধ্বংস করতে চায়, অন্য অন্য ধর্মের লোকদের ধ্বংস করার ফতোয়া তো মোল্লারা দিয়ে বেড়াচ্ছে না ! আলালের জিজ্ঞাসা করা হয় না, সে যদিও তার মতো করে উত্তর জানে । আলাল সেই উত্তরই গানের সুরে গেয়ে উঠতে চায়, তখন খেয়াল হয়, ফকির বাবা এক লাইনও সুর তোলে নাই । নিজেই শুধু বেসুরা গলায় গেয়ে গেয়ে উঠছে । বাবা কি পছন্দ করছে না, না যোগ্য মনে করছে না, হতে পারে ফকিরী গানের গুমর বুঝবার মতো তাকে লায়েক মনে করছে না বলেই শুধু নি:শব্দে হেসে এড়িয়ে যাচ্ছে । আলাল একটা গানের জন্য মুখ তুলে অনুরোধ করতে যাবে, তখন জুলেখা বলে, এক লহমাও তো খান নাই ? জুলেখার মা বলে ফকিরগো চিন্তায় ধরছে, তল পাইবেন না, ইডু খান বাবা, আলাল লজ্জা পেয়ে খেয়ে নেয় । জুলেখা গামছা এগিয়ে দেয় । বাহাই ফকির গলায় আধা সুর জড়িয়ে বলে,
আন্ন দানা প্রাণ সোনা
সব তরিকার আগে
প্রেম তত্ত্ব হাতে গোনা
জীবন থাকলে লাগে
ঘষা অন্ধকার আর জমাট নীরবতার মধ্যে হঠাৎ বাহাই ফকিরের সেই
পদটি মনের মধ্যে গুন গুন করে ওঠে, জুলেখার তত্ত্ব বোঝার গুণ দেখেও
বুক কাঁপিয়ে বড় শ্বাস ফেলে - প্রেমতত্ত্ব হাতে গোনা/জীবন থাকলে
লাগে । কাম প্রেমের সঙ্গে সঙ্গে বোধ বুদ্ধিরও নিরন্তর যোগাযোগ যদি
দেহের খাঁচায় প্রাণ পাখিটি থাকে । আকাশের পেটে পিঠে আরো মেঘ
জটিল হয়ে ওঠে, চাঁদ, চাঁদের আশেপাশে ছিটা ফোঁটা তারা ইত্যাদিও
মেঘের কব্জায় । বেতাল রাতের অন্ধকার প্রায় ফাঁস লাগার মতো ।
আলাল জুলেখা পাটি তুলে ঘরে উঠে আসে । এর মধ্যে কেমন একটা
বাতাসও বইতে শুরু করেছে । ঘরে ঢুকে আলাল জুলেখাকে জড়িয়ে
কপালে চুমু খেয়ে ছেড়ে দেয়, বাকি রাতটুকু সে ঘুমাতে চায় ।
জুলেখার ঘুম আসে না, একবার কথা বলতে পারায় সহজ হয়ে আরো
কথায় ফুলে ফেপে উঠছে - এই সুযোগে, আলালকে সে অনেক কথা
শোনাতে চায়, বলতে হবেই । আলাল অন্যদিকে ফিরে শোয় । জুলেখা
বলে,
তোমার একটা গান শোনাবা ?
আলাল উত্তর দেয় না ।
দাদাজানের গান মনে আছে, তার একখান শোনাও ।
জুলেখা ব্লাউজ ছাড়া শরীর থেকে শাড়ি সরিয়ে আলালকে জড়িয়ে ধরে উষ্ণতা দেয়, শুধু শরীরের নয় মনেরও । আলালের খারাপ লাগে না । দাদাজানের গানের বদলে তার শরীর মন জেগে ওঠে । আলাল ঘুরে জুলেখাকে ধরে । জুলেখা আলালের আচরণের অর্থ বোঝে । বলে, না এখন না, আগে একটা গান শোনাও । আলাল বলে, আচ্ছা ।
`শরীরে মাটির গন্ধ মেখে,
শরীরে জলের গন্ধ মেখে,
উত্সাহে আলোর দিকে চেয়ে
চাষার মতন প্রাণ পেয়ে
কে আর রহিবে জেগে পৃথিবীর পরে ?
স্বপ্ন নয়, শান্তি নয়, কোন্ এক বোধ কাজ করে
মাথার ভিতরে !'
জীবনানন্দের বোধ কবিতার কয়েক লাইন জুলেখার মগজে কোনো
বোধ সঞ্চার করে না । বলে,
এইডা দাদাজানের গান না ।
গানতো !
না । ফকিরী গান গাও ।
ঘুমাও, আমার ভারি
ঘুম পাইছে ।
জুলেখা জোরালোভাবে আলালকে জড়িয়ে ধরে, আলালও । জীবন থাকলে প্রেম কাম থাকবেই । আলাল তো জীবনশূন্য নয় । জুলেখার গরম শরীর আলালের ইন্দ্রিয়বোধে সুখ বিছায় । আহা,
দেহতীর্থ, তীর্থই শরীর
সকল তীর্থের সেরা তীর্থ
ইচ্ছুক নারীর
দেহতীর্থ ভ্রমণ শেষে ক্লান্ত আলাল ভাবে এবার ঘুম জমবে । না, ঘুম
চোখের পাতায় জমে থাকলেও মগজে সঠিক সঙ্কেত পাঠাতে পারছে না, ঘুম
তার হয় না, বরং সে নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে, ঘুম অথবা অঘুম নিয়ে
আলাল চিন্তিত নয়, জুলেখার ঘামে ভিজা ঠাণ্ডা শরীর সে আর ছুঁয়েও
দেখে না । বরং সেই অবসাদ, অর্থহীনতার বোধ তাকে আবার পেয়ে বসে ।
তখন জুলেখা তার ভারি হাত পা আলালের ওপর ফেলে বলে,
আমাগো
বাচ্চাকাচ্চা অয় না ক্যান ?
আলাল চুপ থাকে ।
ক্যান অয় না
গো ?
জুলেখা বড় করে শ্বাস ফেলে বলে,
নিজাম ভাইর কথা
মনে আছে না ?
নিজাম ভাই কেডা ?
ওই যে পাগলা নিজামী
ফকির ।
কেন তোমার মনে অইলো ?
জুলেখা দীর্ঘশ্বাস
ফেলে,
না এমনি । মানুষটার মধ্যে ত্যাজ ছিল ।
বাউল ফকির সংঘের এক সম্মেলনে আধপাগলা মানউল্লা ওরফে নিজামী ফকিরের সাথে দেখা হয়েছিল ওপারের গোরাডাঙ্গা গ্রামে । প্রবেশিকা পর্যন্ত পড়া মানউল্লা গাঁজার মাত্রাদোষে আধপাগলা হয়ে গেলেও তার মধ্যে এক নতুন চেতনা তৈরি হয়েছিল বৈকি । আলাল মণ্ডল তখন বহু গান কবিতা নিজামী ফকিরের কাছ থেকে টুকে নিয়েছিল । তথাকথিত শিক্ষারহিত ফকিরদের তুলনায় নিজামীর কথার ঢং আলাদা, `আল্লার কাজ-কারবার সারাদিন ধরে চোখ মেলে দেখি আর তাজ্জব বনে যাই । রাতে কিছু দেখা যায় না । দেখুন আল্লার হেকমত । তখন গরু আর গোলাপ সবই আঁধার । ঠিক তখনই রুহু, মানে আত্মার আলো জ্বলে ওঠে । আল্লা রাতস্মরণীয় । হা হা আল্লা রাত স্মরণীয় । প্রাত:কালে মানুষের থাকে জঠরের চিন্তা, বিষয় চিন্তা ।' তারপর নিজামী ফকির একটা খেজমতের গান শোনায় ।
`আমার এই পেটের চিন্তে
এমন আর চিন্তে কিছু নাই ।
চাউল ফুরাল ডাউল ফুরাল
সদাই গিন্নি বলেন তাই ॥
যখন আমি নামাজ পড়ি
তখন চিন্তা উঠে ভারী
কীসে চলবে দিনগুজারী
সেজদা দিয়ে ভাবি তাই ॥
আমার পেটের জ্বালা জপমালা
আমি তসবী মালায় জপি তাই ।'
হা হা, আল্লা আল্লা । সম্মেলনের পরেও আলাল নিজামীর সঙ্গ ছাড়েনি । জুলেখার সাথে নিজামীর পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল, আমার বউ জুলেখা বাহাই ফকিরের মাইয়া । বাহাই ফকির নাম শুনেই যেনো বড় আদপের একটা শরিয়তী সালাম দেয় জুলেখাকে । জুলেখা মাথার ঘোমটা আরো টেনে দেয় । নিজামীর লেখা একটা কবিতা এমন,
`চিন্তায় রয়ে গেছে আমার মুক্তির পথআরো একটা কবিতায় আছে,
যতই চিন্তা করি আমি নি:শব্দ থাকি
প্রকৃতির নি:শব্দ সাধনায় ধর্ম কি ?'
`আমার ঘুম এসে যায় যখন চিন্তা
করার যুক্তি থাকে না । যুক্তি নিয়ে বেঁচে
থাকাটাই ঠিক জীবনের জ্ঞান শক্তি ।'
সব কথার শেষেই সে জিকিরের মতো বলে উঠত হা হা আল্লা আল্লা ।
এই নিজামীর কথা হঠাৎ কেন জুলেখার মনে এল ? বাচ্চা-কাচ্চা না
হওয়ার চিন্তার সাথে একই পঙ্ক্তিতে নিজামীর কথা মনে আসার কারণ
আলাল জানে না । `বোধ' কবিতার ভাব বুঝতে না পেরেই কি নিজামীর
কথা মনে হয়েছে ? নিজামীর কথার অর্থও তখন জুলেখা বোঝে নাই ।
নিজামী যখন ভগ্নি তুমি সুখে থেকো বলে মাথায় হাত রেখেছিল, জুলেখা
তখন ভয়ে আলালের পিছনে সরে দাঁড়িয়ে শার্ট খামচে ধরে রেখেছিল ।
জুলেখা কি আলালকেও ভয় পাচ্ছে এখন ? জুলেখা আলালকে শক্ত করে
জড়িয়ে ধরে রাখে । আলালের ভালো লাগে না, প্রায় ধাক্কা দিয়ে
সরিয়ে দেয়, এখন ঘুমাও । জুলেখা ঘুমায় না, তার চোখের ভিতর জ্বালা
করে গলার ভিতর পানি ধরে রেখে বলে,
আমারে তুমি ঘিন্না কর,
কুত্তার মতো ছেই ছেই কইরা খেদাও ক্যান
আলাল অন্যদিকে পাশ
ফিরে ।
আমারে বিয়া করছিলা ক্যান ?
আলাল শোওয়ার ভঙ্গি
পাল্টায় না ।
আব্বাজানের মন পাবার জন্য এই কাম করছিলা, এখন
বুঝি সব শ্যাস হইয়া গেছে ?
আলাল চিৎ হয়ে শোয় ।
জুলেখা ।
জুলেখা ফুপিয়ে কাঁদে ।
তোমার সমস্যা কি জানো, যহন
আমি কথা কই তুমি বুঝ না, আর যহন তুমি কথা কও তহন বুঝবার
পার না, আমি শুনবার চাই কি না ।
তোমার কতা বুঝবার কী
ঠেহা পরছে ?
বুঝবার ক্ষমতা থাকলে তো ।
আলালের গলায় ক্রোধ । বড় বড় শ্বাস ফেলে ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করে
নেয় । জুলেখা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদার পর্ব শেষ করে বলে,
মাসের পর মাস আমারে ফেলাইয়া ঘুইরা বেড়াও, আমি মানুষ না ?
নাকি বাজারের মাইয়া মানুষ, মাঝেমধ্যে আইসা সুইয়া যাও, মনের
কোন কতা নাই ?
আলাল অন্ধকারের ভিতর চিকন করে হাসে,
তোমারও মনের কথা আছে, আহা কও শুনি ?
জুলেখা চোখে
মুখে পানি আর অন্ধকার মিশিয়ে বিজবিজ করে বলে,
আমি তোমার যুগ্যি না অইলে যুগ্যি মাইয়াগো নিহা কইরা নিবার পার না, এহেনে আস ক্যান ?
আলাল তার নিজের বিছানায় শুয়ে কখনোই নিজের কথা, সাধন ও
সাধকের কথা ভাবতে পারেনি । জুলেখা, শরীর, অভিযোগ ইত্যাদি সামাল
দিতে দিতে কত দরকারি রাত পার হয়ে গেছে । আলাল জুলেখাকে কাছে
টেনে নেয়, তখন কেমন করে ঘরের খুব পাশ থেকেই একটা কুকুর
কেঁদে ওঠে, কুকুরের কান্নার ভিতর বাহাই ফকির কাশতে কাশতে
দমবন্ধ করে ফেলে । খুলনা বরিশাল মহাসড়কের ওপর দিয়ে বিকট
আওয়াজ করে ট্রাক চলে যায় । প্রায় শেষরাতের বিষাদগ্রস্ত অন্ধকার
কাঁপিয়ে হঠাৎ করে সব বিশ্রী শব্দ বেজে উঠলে আলাল জুলেখাকে
কিছু না বলে চুপ থাকে, তারপর কুকুরের কান্না আর বাহাই
ফকিরের কাশির বিরতিতে বলে,
কওগো ফকিরের নাতি ফকিরের
মাইয়া `যখন নি:শব্দ শব্দরে খাবে' কথার অর্থটা কি ?
জুলেখা হাতের উল্টাপিঠ দিয়ে চোখ মোছে, বুক শরীর কাঁপিয়ে
বড় শ্বাস ফেলে । আলাল উঠে মাথার নিচের শক্ত বালিশটা তুলে নেয়,
তখন আবার কুকুরটা সুর করে কাঁদতে শুরু করে, বুইড়া ফকিরের
কাশিও বুঝি কুত্তার কান্নাকাটির সাথে বান্ধা । আলাল তবুও হাতের
বালিশটা মুখের ওপর শরীরের শক্তি দিয়ে চেপে ধরে বলে,
ফকিরের
নাতি কও `যখন নি:শব্দ শব্দরে খাবে' কথাডার মাইনে কী, কও ?
বিছানার ওপর জুলেখার হাত পা ছুড়াছুড়ির শব্দ ও কুকুরের
কান্নার সাথে মিলিয়ে যেয়ে এক সময় হয়তো থামে, কিন্তু আলাল মণ্ডল
তবুও মুখের ওপর থেকে বালিশ সরায় না ।