• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩১ | অক্টোবর ২০০৩ | প্রবন্ধ
    Share
  • টানেলে একাকী শামসুর রাহমান : সালাহউদ্দীন আইয়ুব




            টানেলের ভেতর হঠাৎ
    কখনো চিত্কার শুনে আতঙ্কে শরীর শজারুর
    কাঁটা হয় আর চোখ ফেটে যায় আনারের মতো । চতুর্দিকে
    দৃষ্টি ছোটে, ঘুরি দুটি হাত প্রসারিত করে, অথচ আমার
    নিজস্ব অস্পষ্ট ছায়া ছাড়া কাউকে পাই না খুঁজে
            কোথাও এখন ।


                    ( টানেলে একাকী ; শামসুর রাহমান)

    এক.

    পুরনো ঢাকা কিংবা শ্যামলিতে নয়, কবিতার সঙ্গেই একটানা এক প্রি-মরডিয়াল টানেলের ভেতর সংসার করে গেছেন কবি শামসুর রাহমান । তাঁর একটা কবিতার বই-ই আছে কবিতার সঙ্গে গেরস্থালি নামে, টানেলে একাকী তার মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে স্মরণীয় ও চৌকষ কবিতা ।

    কবিতাটি প্রথম পড়ি ফজল শাহাবুদ্দীনের কবিকন্ঠ কাগজে । সে-সময় কবিতার কাগজ হিসেবে কবিকন্ঠ একটা মডেলই ছিল । ঢাকা পৌঁছুতে আমার তখনো আস্ত দু'টো বছর বাকি । তবে কেবলি বই, সাহিত্যপত্রিকা ও দৈনিকের সাহিত্যপৃষ্ঠা আমাদের সাহিত্যচর্চার একমাত্র নির্ভর ছিল ব'লে, যে-কোনো ভালো রচনা আমরা একটা পবিত্রতার বোধ নিয়ে পড়তাম । উত্তরকালে দিলদরিয়া আনওয়ার ভাইয়ের মাধ্যমে বগুড়া, ঠাকুরগাঁও ও উত্তরবঙ্গের কিছু উজ্জ্বল তরুণের সঙ্গে পরিচয়ের পর তাদের মধ্যেও সাহিত্যব্যাপারে অনুরূপ ঘোর ও বিহ্বলতা দেখে নিজের উন্মেষকালীন অভিজ্ঞতাকে ব্যতিক্রম ভাবতে পারিনি । মনে পড়ে, টানেলে একাকী পাঠ করে বেশ স্পন্দিত হই । বহুদিন পর আজ বিদেশে বসে আবার সেই কবিকন্ঠেই কবিতাটি পড়ছি কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুকূল্যে, আমার কাছে এ এক স্মরণীয় মুহূর্ত ।

    এমন নয় যে তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতার সংগ্রহ আমার কাছে নেই কিংবা কবিতাটি এর আগে অন্তত চার-পাঁচ বার পড়িনি । কিন্তু প্রকাশক্ষেত্রের তারতম্য কোনো কোনো আবেদন ও উপভোগে মস্ত তফাত ঘটাতে পারে । একথা সত্য যে, সাহিত্যকাগজে প্রথম প্রকাশ এবং উত্তরকালের গ্রন্থভুক্তিতে কবিতাটির অন্তর্গত বার্তায় কোনো পরিবর্তন ঘটেনি । কিন্তু কনটেকস্টের কথা বিস্মৃত হলে বা এবিষয়ে কিছুই জানা না থাকলে টানেলে একাকী র অর্থোদ্ধারে অর্থসংকোচনের আশংকা আছে । আমরা অগ্রাহ্য করতে পারি না যে গ্রন্থভুক্ত টানেলে একাকী র শামসুর রাহমানকে অনেক বেশি একা, নি:সঙ্গ ও সহযাত্রীহীন মনে হয় । কাজেই একটা বিশেষ ধরনের একাকিত্ব দুই পাঠে অবিকৃত কবিতাটির প্রধান ভর হলেও, কবিকন্ঠের কবিতাটিতে অভিন্ন প্রপঞ্চের যে পরিপ্রেক্ষিত ও নির্ণয়যোগ্য অভিঘাত, গ্রন্থভুক্ত টানেলে একাকী র দু'পাশের শাদা দুই মার্জিনে তার কিছুই যে লিপিবদ্ধ নেই, তথ্য হিসেবে এটুকু খেয়ালে রাখা লাভজনক ।

    সব কবিতা নয়, কিন্তু কোনো কোনো, কবির বিচারে উত্কৃষ্ট, কবিতা যখন কাগজ থেকে বইতে ঠাঁই নেয় সে অনেকটা ভাড়া বাসা থেকে নিজ বাড়ির স্থায়ী নিবাসে ওঠার মতো ঘটনা । তবে টানেলে একাকী বাড়িবদলের মতো কোনো সমস্যা বাধায়নি । আমি একথা বলতে চাই না যে প্রকাশমাধ্যমের পরিবর্তন কবিতাটি বুঝবার ক্ষেত্রে বিরাট কোনো সমস্যা, আমার লক্ষ্য কনটেকস্টের পরিবর্তন বিষয়ে পাঠককে সজাগ করা । উত্কৃষ্ট কবিতা তো বটেই, মোটের ওপর যে-কোনো কবিতা একটা কোনো কনটেকস্টে তৈরি হয় । তবে কনটেকস্ট ব্যাপারটাকে সরল মনে করার কোনো কারণ নেই । পাঠক হিসেবে যাকে আমরা একটা লেখা বা কবিতার কনটেকস্ট ব'লে নির্দেশ করি, রচয়িতার কাছে তা যথেষ্ট উদ্ভট কিংবা অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে । বাংলাসাহিত্যের ইতিহাসকারদের অ্যাগ্রেগেট লেবেলের বর্ণনা ও ম্যাক্রো পদ্ধতির মীমাংসাগুলোকে আমাদের কবিরা যে উপহাস্য মনে করেন, তার কারণও এই ।

    যদি ধরে নিই পাঠ অভিজ্ঞতার দিক থেকে কবিকন্ঠে প্রকাশিত ও গ্রন্থভুক্ত কবিতাটির কনটেকস্ট এক নয়, তাহলে মানতে হবে কনটেকস্টের পরিবর্তন কবিতার অর্থবদলে খানিকটা হলেও ভূমিকা রাখতে সক্ষম । আর কবিতাটির আলোচনায় এসব কথা যদি এসেই পড়ে, তাহলে স্বীকার করা ভাল যে একটি কবিতা পড়তে গিয়ে আমরা শুধু ওই কবিতাটিই নয়, তার বাইরেও অনেক কিছু পাঠ করি । যেমন, এ লেখার শুরুতে উদ্ধৃত চরণগুলোর একটিতে যখন পড়ি `নিজস্ব অস্পষ্ট ছায়া ছাড়া কাউকে পাইনা খুঁজে / কোথাও এখন', কনটেকস্টের কথা মনে রাখলে একটু ভাবিত ও কিছুটা কৌতূহলী আমাদের হতেই হয় । আমরা ভুলতে পারি না যে কবিতাটি কবিকন্ঠেই প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল, এবং তার চেয়েও বড় কথা হলো এটি এমন একটি সময়ে লেখা যখন আমাদের সাহিত্যে রাজনীতি প্রবেশ করেনি, মিডিয়া ছিল সীমিত, এবং আমাদের প্রধান লেখকেরা শিবিরে শিবিরে ভাগ হননি । সেজন্যে কেবলি সাহিত্যে অঙ্গীকারাবদ্ধ, বিশুদ্ধ, অবিভক্ত ও অনূকুল সহযাত্রীবেষ্টিত ও-রকম একটা সময়ে শামসুর রাহমান যখন বলেন নিজের অস্পষ্ট ছায়া ছাড়া আর কাউকে খুঁজে পান না তিনি, তখন বুঝতেই হবে কবি হিসেবে নিজের সময়টাকে তিনি যেভাবে পাঠ করেছেন, তার সঙ্গে আমাদের সেই অভিন্ন সময়-অনুধাবনের নিশ্চিত এক তফাত আছে । অমার্জনীয় সরলীকরণের ঝুঁকি নিয়েই বলি : সহযাত্রীবেষ্টিত হয়েও সহযাত্রীহীন -- এ যদি এ-কবিতার একটা মানে হয় ( কবিকন্ঠের কনটেকস্টের কথা মনে রেখে), তাহলে কবিতাটি যে উত্তরকালের বাস্তব ও আসন্ন ভবিষ্যৎ অবলোকনের মতো অব্যর্থ দৃষ্টিশক্তির অধিকারী ছিল, তা স্বীকার্য । অন্যদিকে কনটেকস্টের আলো ফেলে আমরা যে কবিতাটিকে অনেকভাবে পাঠ করতে পারছি, তা টানেলে একাকী র কালজয়ী কাব্যগুণের দলিল । উত্কৃষ্ট কবিতার শুদ্ধতম সত্তায় বিশ্বাস অবিচলিত রেখেও, এভাবে কখনো অদ্ভুত কখনো জটিল কিন্তু প্রবলভাবে মানবসম্মত প্রক্রিয়ায়, কোনো কোনো কবিতা পাঠকের হস্তক্ষেপে পুনর্জন্ম লাভ করে । রোঁলা বার্ত একেই হয়ত পাঠকের স্পর্শে টেকস্টের প্রাণপ্রাপ্তি ব'লে নির্দেশ করেছেন । এ হলো রচয়িতার উদ্দেশ্যের সঙ্গে প্রায় নি:সম্পর্কিত সাহিত্যপাঠের একটা প্রক্রিয়া ।


    দুই.

    এ কবিতার টানেল কি শিল্পী শামসুর রাহমানের স্টুডিও ? না কি এর পরিসর স্টুডিওর চেয়েও বড় ? না কি টানেল তাঁর সমগ্র কবিজীবনেরই উত্প্রেক্ষা ? কবি বলছেন একটি টানেলেই তিনি কাটিয়ে দিয়েছেন `হিমযুগ এবং প্রস্তরযুগ, তাম্রযুগ, / লৌহযুগ খুব একা একা', এবং টানেলবাসী এ-কবির নিকটে শুধু নয়, `দূরেও ঘন কুয়াশায় কারো / অস্তিত্ব ফোটে না' । সময় এখানে স্তব্ধ, ইতিহাস নিশ্চল । সময় শুধু স্তব্ধই নয়, মামুলি, গৌণ ; অপ্রাসঙ্গিকও । সময় ও ইতিহাসের গতিরোধ করে ফেলে কবিতাটি, সেজন্যে সারা কবিতা জুড়ে এই দুই প্রপঞ্চের ব্যবহার ও অনুধাবন স্বাভাবিক থাকে না । সময় ও ইতিহাসের পরপারে অবস্থিত বলেই `টানেলের ভেতরে হঠাৎ কখনো চিত্কার শুনে আতঙ্কে শরীর শজারুর কাঁটা হয় আর চোখ ফেটে যায় আনারের মতো' । এমনকি দিন ও রাত্তিরের তফাত অনুধাবনের জন্যে দরকার হয় অতিরিক্ত প্রয়াসের :

            কতকাল আমি সূর্যোদয়
    দেখিনি, শুনিনি কোনো দোয়েলের শিস । কালেভদ্রে
    যেন কোনো বাজিকর টানেলের দেয়ালে ফোটায়
    আলোর গোলাপ, ঝিল্লীস্বর শুনে টের পাই রাত ।


    যেমন আগে বলেছি, শামসুর রাহমানের এই টানেল তাঁর কবিজীবনেরই সংহত উত্প্রেক্ষা । অন্ধকার ও সংকীর্ণ এই টানেলে কবি কি স্বেচ্ছানির্বাসিত ? নিশ্চয়ই । তবে, লক্ষ করার বিষয়, টানেলের ভেতর ভারি হয়ে থাকা নিস্তব্ধতা তো বটেই, শ্বাসকষ্টের কথাও কবির জবানিতেই আমরা জানতে পারি, কিন্তু কোনো বেদনা, দু:খ বা গ্লানির সাক্ষ্য কবিতাটিতে নেই । তার কারণ কবির লক্ষ্য এখানে ব্যক্তিগত জীবনের বর্ণনা নয়, বরং কবি হিসেবে বাস্তব জীবনের ভেতরেই যে খোয়াবি সুড়ঙ্গ তিনি তৈরি করেছেন, টানেলে একাকী তারই কূটাভাসপূর্ণ, ইঙ্গিতময়, ও সম্ভবপররকম আচ্ছাদিত এক আখ্যান ।

    না, টানেলে স্বেচ্ছান্তরীণ হবার জন্যে কবির কোনো দু:খ নেই, কেননা ওই কালো, দীর্ঘ, অন্ধকার, নি:সঙ্গ, ও দিন-রাত্তিরের ভেদাভেদ লুপ্তকারী ব্যক্তিগত সুড়ঙ্গের ভেতর বসবাসের জন্যেই তো তাঁর জীবন উত্সর্গিত । বহুদিনের শ্রম, ধ্যান, ও সাধনার অর্জন এই সুড়ঙ্গের তিনিই সম্রাট, যার মধ্যে অন্য কারো উপস্থিতি, হস্তক্ষেপ কিংবা সাহচর্য অবাঙ্ছিত । `পিকাসোর ত্রিমুখী রমণীর উল্লসিত যোনি', রমণীয় স্তন, ও অভিজাত নাভিমূলের আবেদনও সেখানে নিস্প্রভ, নগণ্য ।

    তবে যদি এ-কবিতার মর্মে, আরো খানিকটা ভেতরে, প্রবেশ করতে চাই তাহলে এর বিনয়ের আব্রু খুলে ফেলার সাহস থাকা দরকার । অবশ্য স্বপ্নস্পৃষ্ট চরণ, সুচয়িত শব্দের অভিঘাত, ও অবিরলভাবে প্রতীকী ভাষণ, ও সংকেতময় তির্যক বিবৃতির মাঝখানে আমরা অকস্মাৎ এক উচ্চারণের মুখোমুখি হই যা একদিকে কবিতার সঙ্গে তাঁর আকৈশোর সংগ্রাম ও সংঘাতের সৎ স্বীকারোক্তি, অন্যদিকে সেই লড়াইয়ে কৃতকাম হবার বিস্ফোরক ঘোষণা :

    অসম্ভবে হয়েছি সওয়ার
    আকৈশোর ; অতিকায়, মত্স্যপৃষ্ঠে করেছি ভ্রমণ
    সমুদ্দরে বহুকাল, জলপরীদের দিব্যলালিম স্তনাগ্র ছুঁয়ে-ছেনে
    গেছে বেলা পাতালের জলজপ্রাসাদ আর খসিয়ে নিজের
    বুকের পাঁজর থেকে হাড় বানিয়েছি দেবতারও
            ঈর্ষণীয় বাঁশি ।

    স্তবকের শুরুতে পাই কাব্যসাধনার স্বীকারোক্তি, মাঝে বিরামহীন কাব্যিক সংগ্রামের উল্লেখ, আর শেষে সিদ্ধকাম ও চরিতার্থ কবির নি:সংশয় ঘোষণা । এই স্তবক পাঠ করে আমরা জেগে উঠি বটে, কিন্তু কবির এ-উচ্চারণকে মোটেও অপ্রত্যাশিত, পরিপ্রেক্ষিতচ্যুত, বা কবিতাটির মূল ভাস্কর্যের সঙ্গে অন্বয়রিক্ত মনে হয় না । এর ঠিক আগের দু-টি স্তবকে তিনি সমকালীন কবিতার মূল অন্ত:সারশূন্যতা (`কান্তিমান লাইনো টাইপগুলি করেছে নির্মাণ / অদ্ভুত জগৎ এক') ও তার অপচিত উদ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন । প্রতিভা ও সৃষ্টিশীলতার সঙ্গে সংশ্রবহীন সমকালের, ও যে-কোনো কালের, খামোখা সাহিত্যচর্চার উত্পাতে কবি এমনই বিক্ষুব্ধ যে তিনি বাংলাকবিতায় নিজের অবস্থানের কথা বেশ বলিষ্ঠভাবে ঘোষণা না করে পারেননি । আমরা বলতে পারি : বিশৃঙ্খল বর্হিবাস্তব, চতুর সময়, ও অ-সাহিত্যিক উন্মাদনায় মুখর একটা শোচনীয় কিন্তু স্থায়ীভাবে অস্বাস্থ্যকর নান্দনিক পরিবেশের বিপরীতে শামসুর রাহমানের টানেল আধুনিকতাবাদী বাংলা কবিতার অভ্যন্তরীণ শক্তি ও তার সম্ভবপর সর্বোত্কৃষ্ট পরিণতির প্রতীক ।



    তিন.

    একজন প্রধান কবি যখন নতুন কবিতা রচনা করেন, তার পেছনে একটা অঘোষিত প্রত্যয় থাকে । তা হল, সৃষ্টির বিরল, তুমুল, প্রাণিত মুহূর্তে পূর্বেকার সমস্ত সৃষ্টিকে অস্বীকার করা । শিল্পেতিহাসে যেকোনো নতুন সৃষ্টি একেকটা ব্যাপক অস্বীকার ও প্রত্যাখানের বিস্ফোরণোন্মুখ ও বিপজ্জনক দলিল । বিস্তৃত আলোচনার সুযোগ নেই, তবে এবিষয়ে সবচেয়ে উদ্দীপক (ও বেশ বিতর্কিত) আলোচনা পাই হ্যারল্ড ব্লুমের সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে প্রকাশিত দি অ্যাংজাইটি অফ ইনফ্লুয়েন্স (১৯৭৩) বইটিতে । উত্তর-আধুনিক ধারার সমালোচনার সঙ্গে নি:সম্পর্কিত হয়েও ইয়েল ও নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হ্যারল্ড ব্লুম একজন প্রতাপশালী সমালোচক । !-- [ব্লুম বিষয়ে এরকম একটা কিংবদন্তী প্রচলিত যে, ইংরেজিতে কথা বলা শেখার আগেই তাঁর ইংরেজি পড়া শেষ হয়ে গিয়েছিল । ইংরেজি সাহিত্যের বেশিরভাগ কবিতা তাঁর মুখস্থ ব'লে (এটি অবশ্য কিংবদন্তী নয়) কবিতা বিষয়ে বই লিখতে গিয়ে ব্লুম প্রয়োজনীয় সব উদ্ধৃতি স্মৃতি থেকেই উদ্ধার করেন; মূল গ্রন্থ ঘাঁটাঘাটির দরকার হয় না ।

    বর্ষীয়ান ইহুদী মনস্বী]--

    তাহলে দাঁড়াচ্ছে এই যে, যে-কোনো শক্তিশালী নতুন কবিতাই প্রাক্তন কোনো মহৎ কবিতার পুনর্লিখন, ব্লুমের ভাষায় `সচেতন ভুল পাঠ' । মুশকিল এই যে, যে কবি বা কবিতা ওই কবির সবচেয়ে প্রিয়, সাহিত্যের যে ঐতিহ্যে অবগাহন ছাড়া তাঁর প্রতিভার উন্মীলন ঘটতো না, সেই কবি, কবিতা, বা ব্যাপক অর্থে সাহিত্যঐতিহ্যকে সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করা ছাড়া শক্তিমান কবির কোনো বিকল্প নেই । অস্বীকার ও প্রত্যাখানের এই ব্যাপক, বিকল্পহীন, অনুপ্রাণিত কিন্তু উদ্বেগপূর্ণ, প্রয়াসকেই হ্যারল্ড ব্লুম শক্তিমান কবির `প্রজেক্ট অফ সেলফ ক্রিয়েশন' বলতে চান । তবে আমাদের মনে রাখা দরকার যে শক্তিমান কবির ব্যাপক প্রত্যাখানের প্রয়াস স্বভাবতই ভিন্ন । প্রাক্তন ও প্রিয় কবিকে শক্তিমান কবি কখনোই সরাসরি অস্বীকার করেন না । কিন্তু কখনো অন্যের ধরনে পাঠও করেন না । তিনি তাঁকে "ভুলভাবে" পাঠ করেন । ভুলপাঠের প্রক্রিয়ায় একদিকে আত্মসৃষ্টি ও অমরতার দরজা ত্রক্রমশ উন্মোচিত হয়, অন্যদিকে ঘটে ঐতিহ্যের পুনর্বোধন (ব্লুমের ভাষায় `র্যাডিকাল রি-ভিশন অফ ট্রাডিশন')। তাঁর তাত্পর্যপূর্ণ বক্তব্য এই যে, প্রাক্তন সৃষ্টির সচেতন ভুল পাঠ ও সংশ্লিষ্ট ঐতিহ্যের প্রবল প্রত্যাখান ছাড়া শক্তিমান কবির স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব নির্ণয়যোগ্য হয় না ।

    আমার ধারণা, শামসুর রাহমানের টানেলে একাকী র একটা অর্থ ব্লুমের ভাষ্য-অবলম্বনে নির্দেশ করা সম্ভব । ব্লুমের দৃষ্টিকোণ থেকে পাঠ করলে আমরা দেখবো যে, টানেলে একাকী প্রধানত কবির আত্মনির্মাণ প্রকল্পের উন্মোচক । দ্বিতীয়ত, কবিতাটিতে সমকালীন কবিতার উল্লেখ ও তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ থাকলেও, এর কোনোটিই শামসুর রাহমানের প্রতিপক্ষ নয় । কবির একমাত্র প্রতিপক্ষ তাঁরাই যাঁদের হুমায়ুন আজাদ বলেন `তিরিশের আদিম দেবতা', এবং যাদের `অতিকায় মত্স্যপৃষ্ঠে' বহুকাল ভ্রমণের কথা কবি নিজেই উল্লেখ করেছেন । কবির সেই দীর্ঘ, কঠিন, নিবিড়ভাবে প্রীতিকর কিন্তু প্রবলভাবে সংঘাতপূর্ণ, ভ্রমণ পরিণামে চরিতার্থ । আধুনিকতাবাদী বাংলা কবিতার একজন প্রধান কবি হিসেবে বৃত হয়েছেন কবি শামসুর রাহমান । বলা বাহুল্য, কবির দীর্ঘ, প্রলম্বিত ভ্রমণ সম্পন্ন হয় বহি:পৃথিবীতে নয়, বরং সেই `দীর্ঘ কালো টানেলের ভেতর', যেখানে তিনি পার করে দেন সকল ঐতিহাসিক ও প্রাগৈতিহাসিক যুগ; যেখানে সময় স্তব্ধ, ইতিহাস নিশ্চল, সমকাল অপ্রাসঙ্গিক; তারই ভেতর, `গৌরবের হেমবর্ণ চূড়া থেকে' দূরবর্তী অবস্থানে অঙ্গীকারাবদ্ধ এ কবি পাঁজরের হাড় খসিয়ে ত্রক্রমাগত বানিয়ে চলেন আধুনিক বাংলা কাব্যে তাঁর প্রিয়তম ও একমাত্র প্রতিপক্ষ "দেবতারও ঈর্ষণীয় বাঁশি" ।


  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)