ডেভিডের জন্ম কাভেন্ট্রিতে, শিক্ষা কেম্ব্রিজে । তার ডিগ্রি ংঔধরুংশত্র ত্ছত্রভণ্ণছভংয
-এ । ফরাসি ও জর্মান । প্যারিস প্রিয় শহর, প্রুস্ত প্রিয় লেখক । সে চাকরি নিয়েছিলো ফ্রান্সে, স্কুলে ইংরিজি পড়ানোর চাকরি, এই আশায় যে প্যারিসে কাজ পেয়ে যাবে । কিন্তু ফ্রান্সের মফ:স্বলের জীবন তার ভালো লাগে না, প্যারিসেও কাজ জোটে না । তাই মাঝে মাঝেই `দুত্তোর' বলে ইংলণ্ডে চলে আসতো । তার পরিবার শ্রমিক শ্রেণীর, বাবার ছিলো সব্জির দোকান । সেখানে কাজ করে দৈনিক এক পাউণ্ড করে পেতো, আবার একটা স্কুলমাস্টারি জুটিয়ে ফ্রান্সে চলে যেতো ।
ত্রক্রমে সে ক্লান্ত হয়ে উঠছে । মনোমতো একটা কাজ চাই তার । এইরকম একটা সময়ে সে তার প্রিয় বন্ধু বি বি সি-র নিমাই চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে গিয়েছিলো উইণ্ডসরে । সেখানে পাবের অলস আড্ডায় নিমাই তাকে বললো, `ভারতবর্ষে চলে যাও ।' ডেভিড বললো, `যাবো, যদি একটা চাকরি জোগাড় করে দাও । আছে নাকি কিছু তোমার হাতে ?' নিমাই গম্ভীরভাবে বললো, আছে বৈকি । দেখবে ? দাও তো দেখি একটা ন্যাপকিন ।' কাগজের ন্যাপকিনে তক্ষুনি তক্ষুনি নিমাই একটা চিঠি লিখলো তার শান্তিনিকেতনের সহপাঠী বন্ধু পুণ্যশ্লোক রায়কে ।
পুণ্যশ্লোক ছিলো অস্তিত্ববাদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা
তখন সত্যেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন বিশ্বভারতীর উপাচার্য । তিনি ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন হাওয়া বওয়াবার চেষ্টা করছিলেন । সেই প্রচেষ্টায় পুণ্য ছিলো তাঁর ডানহাত । নিমাই লিখেছিলো বিশ্বভারতীতে জর্মান পড়াবার কাজটা ডেভিডকে দেবার জন্য । পুণ্য জানালো, এ পদ খালি নেই, সে ডেভিডকে ইংরিজি সাহিত্য পড়ানোর প্রস্তাব দিলো, শুধু তাই নয়, একেবারে নিয়োগপত্র পাঠিয়ে দিলো ।
নিমাই কখন সত্যি কথা বলছে, কখন রসিকতা করছে বোঝা যায় না । ডেভিড খুব সম্ভব আশা করেনি ঐ কাগজের ন্যাপকিনে, ওয়াইন পানরত অবস্থায় লেখা চিঠির এই ফল হবে । সে বেশ নার্ভাস হয়ে পড়লো, সে বলতে লাগলো, `ও বাবা, ইংরিজি সাহিত্য ! সেটা পড়াবার যোগ্যতা আমার নেই ।'
বিশ্বভারতীর ইংরিজি বিভাগের দায়িত্ব নেবার জন্য সত্যেন বসুর প্রথম মনোনীত ছিলেন বুদ্ধদেব বসু । কিন্তু বাবা ঠিক সেই সময়, ১৯৫৬ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ শুরু করার প্রস্তাবে রাজী হয়েছেন, নয়তো সত্যেন বসুর অনুরোধের সম্মান তিনি হয়তো রাখতেন । তখন সত্যেন বসু আমন্ত্রণ জানালেন তাঁর বাল্যবন্ধু লণ্ডনবাসী, ইংরিজিভাষী লেখক সুধীন ঘোষকে ।
সুধীন ঘোষ ছিলেন রাসবিহারী ঘোষের ভ্রাতুষ্পুত্র । তরুণ বয়সে বাবার উপর রাগ করে (তিনি একটি এযাংলো-ইণ্ডিয়ান মেয়ের প্রেমে পড়ে তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন, বাবা সম্মতি দেননি) দেশ ছেড়ে ইংলণ্ডে চলে যান । তাঁর বাবা তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র করেছিলেন । তিনিও আর দেশে ফেরেননি । বেশি বয়সে দেশে ফেরার একটা ইচ্ছে জেগেছিলো, সত্যেন বসু সেটা জানতেন । তাই সত্যেন বসুর প্রস্তাবে সাগ্রহে রাজী হয়েছিলেন ।
ডেভিড তো এদিকে নার্ভাস । পুণ্য নিমাইকে লিখলো, সুধীন ঘোষ আসছেন বিশ্বভারতীতে, ডেভিডকে বলো তাঁর সঙ্গে গিয়ে দেখা করতে । নিমাই আর ডেভিড গেলো সুধীন ঘোষের কাছে । তিনি উত্সাহ দিয়ে বললেন, চলো চলো, ভয়ের কিছু নেই । আমিও তো আসছি ।
নিমাই-এর কাছেই এ-সব গল্প শোনা আমার । সে বলেছে, ডেভিড এরপর থেকে পকেটে পেলিকানের
অতি রঙিন মানুষ ছিলেন সুধীন ঘোষ যা প্রতিফলিত হতো তাঁর পোশাকে । কোনো প্রশ্নের সোজা উত্তর দেওয়া তাঁর ধাতে ছিলো না । হাতের চার আঙুলের আংটি দেখিয়ে বলতেন, বউ-প্রতি একটা । শুনেছি, তাঁর স্ত্রী ছিলেন অসুস্থ, সুইত্সারল্যাণ্ডের স্যানাটোরিয়মবাসিনী । লোককে ভুল বুঝতে দিতেন শুধু নয়, ভুল বোঝানোর ব্যাপারে বেশ উত্সাহীই ছিলেন । মধ্যবিত্ত বাঙালি মানসিকতার প্রতি তাঁর অবজ্ঞা গোপন করতেন না, শান্তিনিকেতনের নানান ব্যাপার নিয়ে, অন্ধ রবীন্দ্র-উপাসনা নিয়ে, তিনি ঠাট্টা-তামাসা করতেন ।
সঠিক ঘটনা কী হয়েছিলো জানি না, শুনেছি এযারিস্টফেনিসের `ফ্রগস' অভিনয় করাচ্ছিলেন সুধীন । কস্টিউমের ভার ছিলো রামকিঙ্কর বেইজ-এর উপর । রামকিঙ্করের পোশাকের কল্পনা সুধীনের পছন্দ হয় না এবং তিনি বিরূপ মন্তব্য করেন । অতি শান্ত স্বভাবের মানুষ রামকিঙ্কর তাতে বিরক্ত হয়ে হাতের স্ক্রিপ্ট ছুঁড়ে ফেলে দেন, এবং সেটা গিয়ে সুধীন ঘোষের গায়ে লাগে । এতে অপমানিত হয়ে সুধীন ঘোষ তাঁর হাঁটবার লাঠি তুলে তাঁকে মারতে উদ্যত হন, যদিও মারেন না শেষপর্যন্ত ! শান্তিনিকেতনের `নেটিভ'রা বহিরাগতদের এমনিতেই পছন্দ করে না, (তাদের ওরা বলে `বটু' অর্থাৎ বোকা টুরিস্ট) তার উপর তাদের কিঙ্করদার অপমান ! এরপর কিছু আশ্রমবাসী ছাত্র (যাঁদের অনেকেই আমাদের পরিচিত) সুধীন ঘোষকে শান্তিনিকেতনের অন্ধকার পথে একলা পেয়ে সাইকেল রিক্সা থেকে টেনে নামিয়ে মারে, তাঁর চশমার কাচ ভেঙে চোখে ঢুকে যায় ।
স্বভাবতই খুব গোলমাল হয় ব্যাপারটা নিয়ে । অন্নদাশঙ্কর রায়-এর পরিবার (পুণ্য অন্নদাশঙ্করের বড়ো ছেলে) এর প্রতিবাদ করে আক্রান্ত হয়েছিলেন । সত্যেন বসু আর ডেভিডের বিরুদ্ধেও দল গড়ে উঠলো এই অশালীন আচরণের প্রতিবাদ করার জন্য । শান্তিনিকেতনের কর্মীমণ্ডলি মিটিঙ ডাকলো । (তখন বিশ্বভারতীতে ইউনিয়ন বলতে কর্মীমণ্ডলিই শুধু ছিলো, এখন অধ্যাপক মণ্ডলিও হয়েছে, অধ্যাপকদের ইউনিয়ন ।) সুভাষচন্দ্র বসু ওটেনকে মেরেছিলেন বলে কিম্বদন্তী আছে । সেই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ছাত্রদের শিক্ষকের গায়ে হাত তোলা সমর্থনযোগ্য নয় তবে কোনো কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে তার ব্যাখ্যা করা যায় । প্রবোধচন্দ্র সেনের মতো সর্বজনশ্রদ্ধেয় লোক সেই মিটিঙে এই উদ্ধৃতি আওড়ালেন । অর্থাৎ মিটিঙে সুধীন ঘোষকেই দোষী সব্যস্ত করা হলো । ডেভিড সঙ্গে সঙ্গে পদত্যাগ করলো পূর্বপশ্চাৎ চিন্তা না করে ।
শান্তিনিকেতনের মতো জায়গায় যে এরকম একটা ব্যাপার হতে পারে তাতে ডেভিড স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলো । সে চেয়েছিলো কাগজে সত্য ঘটনাটা লেখা হোক । সেই উপলক্ষ্যেই তার কলকাতায় আসা এবং আমাদের সঙ্গে পরিচয় । তাকে আমাদের বাড়িতে এক সন্ধ্যায় নিয়ে এসেছিলো অমর্ত্য (সেন) । অমর্ত্য তখন কেম্ব্রিজ থেকে ফিরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে
অর্থনীতির বিভাগীয় প্রধান হিসেবে যোগ দিয়েছে (তার আগে আর অতো অল্প বয়সে কেউ ঐ পদ পাননি, পরেও কেউ পেয়েছেন বলে জানি না) । সে সন্ধ্যায় ডেভিড ছিলো উত্তেজিত ও ব্যাথিত ।
সুধীন ঘোষ, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, ডেভিড ম্যাক্কাচ্চন - তিনজনেই বিশ্বভারতী ছেড়ে চলে যান । পুণ্যশ্লোক বোধহয় যায় শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে । সুধীন মা-বাবার প্রিয় বন্ধু ছিলেন, বাবাকে উনি ডাকতেন `সাহেব' বলে । মার কাছে গল্প শুনেছি লণ্ডনের পাবে মদ্যপানান্তে ঈষৎ বিহ্বল অবস্থায় তিনি মা-কে ডাকতে থাকেন `মা-সাহেব' বলে । সত্যেন বসু ছিলেন আমাদের পরিবারের ঘনিষ্ঠ, মায়ের সত্যেনদা ও আমাদের সত্যেন-মামা । একবার মনে আছে, ইওরোপ যাবেন, তার আগে এসেছেন একদিন, বললেন, `বুঝলে বুদ্ধদেব, ঐ-সব নীলনয়না আর স্বর্ণকেশীদের মাঝে মাঝে না দেখলে মন ভালো লাগে না' । বোদলেয়র তাঁর প্রিয় কবি । আর ডেভিড আমাদের নবলব্ধ বন্ধু । তাই এই ব্যাপারটায় আমরা মানসিক ভাবে জড়িয়ে পড়েছিলাম । বিশেষ করে সত্যেন বসুর অপমানটা আমরা কেউ মানতে পারিনি । বাবার `শোণপাংশু' উপন্যাসে এই ঘটনার ছায়া পড়েছে । জ্যোতি স্টেটসম্যানে একটা তথ্যানুসন্ধানী বড়ো লেখা লিখে শান্তিনিকেতনের `অচলায়তনকামী' লোকেদের চির-বিরাগভাজন হয়েছে । সুধীন ঘোষের ইংলণ্ডের ছাত্ররা তাঁকে লিখলো, `হয়েছে তো দেশে ফেরা ? এবার নিজের আসল দেশে এসো' । তারা তাঁর ফেরার টিকিট কেটে পাঠালো । ইংলণ্ডে ফিরে তাঁর চোখের অপারেশন করা হলো ।
সত্যেন বসু ফিরে এলেন কলকাতায় । তাঁর শান্তিনিকেতনের বাড়ি থেকে মা কৃষ্ণচূড়ার চারা এনে পুঁতেছিলেন আমাদের নাকতলার বাড়িতে । সেই গাছ ডালপালা মেলে বিশাল হয়ে আগুনরঙা ফুল ফুটিয়ে তাঁর ক্ষণিক শান্তিনিকেতন বাসের স্মৃতি হয়ে সারা পাড়া আলো করে রাখলো । এখন অবশ্য সে বাড়ি ভাঙা হয়ে গেছে, সে গাছ কেটে ফেলা হয়েছে ।
ডেভিডকে চাকরির জন্য বিশেষ অপেক্ষা করতে হলো না । তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের জন্য বাবা এমন কাউকে খুঁজছিলেন যিনি ফরাসি জর্মান জানেন । ফাদার ফাঁলকেও বাবা আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন । ডেভিডকেও ডেকে নিলেন । সুধীন্দ্রনাথ দত্তকেও বাবা এনেছিলেন সমস্ত লাল ফিতের বাঁধন অগ্রাহ্য করে । লাল ফিতে কারণ সুধীন্দ্রনাথ ছিলেন বি, এ পাশ - এম, এ নন । তুলনামূলক সাহিত্যর ইওরোপীয় শাখার পাঠ্যসূচী তৈরি করতে ডেভিডের সাহায্য নিয়েছিলেন বাবা । ডেভিডের যেদিন যাদবপুরে চাকরি হলো সেদিনটি মনে আছে আমার । মা তাকে নিমন্ত্রণ করে খাইয়েছিলেন । শান্তিনিকেতনের গেস্ট হাউসের খাবারে অভ্যস্ত ডেভিড আমাদের গনেশের (পাচক) রান্না খেয়ে কী যে খুশি ! ডেভিডের থাকার ব্যবস্থা করা হলো গোলপার্কের রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটুট অব কালচারে । যাতায়াতের সুবিধের জন্য, এবং শান্তিনিকেতনের অভ্যাসে, সে চালাতো সাইকেল । ছিপছিপে, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা পরা সুদর্শন এই ইংরেজ যুবাকে কলকাতার যানজটের মধ্যে সাইকেল চালিয়ে যেতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেলো লোকে । ডেভিড ছাড়া আরো দুজন শ্বেতাঙ্গ সাইকেল আরোহী ছিলেন তখন - ফাদার ফালোঁ ও ফাদার আতোয়াঁ । এঁরা দুজনেই তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন ।
এদিকে রামকৃষ্ণ মিশনের মহারাজের সঙ্গে ডেভিডের বনে না । ওখানে নানারকম নিয়মকানুন - নির্দিষ্ট সময়ে ফিরতে হবে, দেরি হলে খাতায় কৈফিয়ৎ লিখে দিতে হবে, ঘরে কোনো মেয়ে আসতে পারবে না - ডেভিড তাতে বিরক্ত । ত্রক্রমে তত্কালীন প্রধান মহারাজের সঙ্গে ডেভিডের বিবাদ সারা কলকাতার জানা হয়ে গেলো । র্যাডিকাল হিউম্যানিস্ট পত্রিকায় ডেভিড একটা লেখা লিখলো যা পড়ে মহারাজ ক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন ও ডেভিডকে ঘর ছেড়ে দেবার নোটিস দিলেন । ওর সঙ্গে আর একটি ইটালিয়ান ছেলেও ছিলো - নাম মনে নেই । আমরা সবাই ডেভিডের জন্য ঘর খুঁজতে লাগলাম । মহারাজদের সঙ্গে ডেভিডের বিবাদের জের টেনে লিওনার্ড গর্ডন, আমাদের লেনি, তাঁদের ভয়ানক উত্পাত করেছিলো । ডেভিডের পরে সে কলকাতায় এসে রামকৃষ্ণ মিশনে ওঠে । রোজ দেরি করে ফিরতো আর খাতায় কারণ হিশেবে লিখতো `ডেভিড ম্যাক্কাচ্চনের সঙ্গে আড্ডা' অথবা `ডেভিডের বক্তৃতা' অথবা `ডেভিডের বিয়ের ভোজ' । অবশেষে মহারাজরা একদিন তাকে দেকে বললেন, ঢের হয়েছে, এবার থামো, নয়তো তোমাকেও চলে যেতে হবে ।
ডেভিড প্রথমে গেলো ফরওয়ার্ড ব্লকের এম, পি ফুলরেণু গুহর বাড়িতে, কিন্তু সেখানেও অসুবিধে হলো । এরপর ও ঘর পেলো নন্দী স্ট্রীটে পুরোনো ধাঁচের একটি বাড়িতে - অতি সুন্দর বাড়িটি । পেয়িঙ গেস্ট, চমত্কার সেকেলে আসবাবে ঘর সাজানো, সংলগ্ন বাথরুম ও বসবার ঘর, সম্পূর্ণ আলাদা একটি অংশ । খাওয়া দাওয়া অতি চমত্কার (ডেভিডের নিমন্ত্রণে সে বাডির রান্না খাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে)। বাড়িটি ছিল/আছে যাঁর তিনি আমার মায়ের নেমসেক - প্রতিভা বসু ।
তুলনামূলক সাহিত্যের প্রথম বছরের ছাত্র ছিলো চারজন, ছাত্রী একটি । অমিয় দেব, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, মানবেন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, তরুণ মিত্র ও নবনীতা দেব । এরা সবাই সাহিত্য পাগল, কেউ কেউ লেখক হবার স্বপ্ন দেখে । পরে তরুণ ছাড়া অন্য চারজন এই বিভাগেই অধ্যাপনা করেছে । ডেভিড তার নতুন সহকর্মীদের সান্নিধ্যে বাংলা সাহিত্যে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলো । আমরা তখন থাকতাম কর্নফিল্ড রোডে একটি নবনির্মিত ছ-তলা বাড়ির ছ-তলার ফ্ল্যাটে । কলেজ ফেরৎ সাইকেল চালিয়ে ডেভিড চলে আসতো মাঝে মাঝে । চা পানান্তে আমি তাকে বাংলা পড়াতাম । আমার মেয়ের কাছে সে ছিলো `সাহেব কাকা' । তার পড়বার জন্য প্রথম উপন্যাস হিসেবে আমরা বেছেছিলাম মানিক বন্দোপাধ্যায়ের `পুতুলনাচের ইতিকথা' । সেটা আমারই অনভিজ্ঞতা, কারণ ঐ উপন্যাসটি যতোই ভালো হোক না কেন, প্রথমপাঠের উপযোগী নয় । তবু বাংলা সাহিত্যে নতুন কী ঘটছে সে বিষয়ে ডেভিড ওয়াকিবহাল হয়ে উঠলো । নিমাইয়ের জন্য সে যে-সব উপহার নিয়ে যেতো ছুটিতে দেশে যাবার সময়, তার মধ্যে ছিলো দীপক মজুমদারের নাটকের বই `বেদানা ও অমলের কুকুর', জ্যোতির্ময় দত্তর কবিতার বই `জলের পুরাণ', কৃত্তিবাস পত্রিকার একটি সংখ্যা যার প্রচ্ছদে ছিলো এযালেন গীনসবার্গের তোলা ছবি । পত্রিকাটির উপর ডেভিড লিখে দিয়েছিলো `জংলি নাম্বার'।
খুবই বিশিষ্ট মহিলা, বোধহয় ও-বাড়িতে একাই থাকতেন অনুগত পরিচারকবাহিনী নিয়ে । একতলায় ছিলো বাচ্চাদের ইস্কুল, বেটার স্কুল । বাচ্চারা সারা সকাল
ডেভিডই মেদিনীপুরের পটুয়াগ্রাম আবিষ্কার করে । তাদের কলকাতায় নিয়ে আসে, সাহায্য করে নানানভাবে । তাদের পট সে নিজে তো কিনতোই, আমাদেরও কিনতে প্ররোচিত করতো । ডেভিডের মৃত্যুতে তারা পিতৃহারা হয়েছিলো । শুনেছি ওদিকে কোনো গ্রামের নাম তারা দিয়েছে `ডেভিড গ্রাম' । সাঁওতালদের জন্য সাঁওতালি ভাষায় একটা পত্রিকা বার করতে সাহায্য করেছিলো সে, তার মেদিনীপুরবাসী বন্ধু তারাপদ সাঁতরাকে সম্পাদক করে ।
একবার জ্যোতির একটা পদোন্নতি হওয়ায় হঠাৎ একটু মাইনে বাড়লো । মাইনে বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের টানাটানিও বাড়লো কারণ দুম করে আমরা কিনে ফেললাম একটা গাড়ি । ছোট্ট গাড়ি, স্ট্যাণ্ডার্ড ৮, অতি প্রাচীন । কিন্তু সেটাই জ্যোতির গর্ব ও নয়নের মণি । রোজ নিজের হাতে তার অন্দর-বাহির তকতকে করে সাফ করে, দুদিনের ছুটি পেলেই আমরা গাড়ি নিয়ে করি নিরুদ্দেশ যাত্রা । অন্ধকার ভোরে বেরিয়ে জিটি রোডে সকাল, দুপুরে গাছের ছায়া খুঁজে পাঞ্জাবি ধাবার রুটি তড়কা, সন্ধ্যা নামলে ফরেস্টবাংলোর খোঁজ । বিদ্যুথীন রাতে চৌকিদারের রান্না গরমভাত আর মুরগির ঝোল । এইসব অভিযানে ডেভিড প্রায়ই হতো আমাদের সঙ্গী ।
আমরা
ংইংইশ্ঝ -এর বই দেখে গন্তব্য স্থির করতাম । একবার ঠিক হলো তারাপীঠ, আরামবাগ হয়ে বাঁকুড়া বিহারের প্রান্তে রানীবাঁধে যাবো সেখানে পাহাড় আছে, নদী আছে, জঙ্গল আছে । ংইংইশ্ঝ -এর সংবাদ অনুযায়ী আরামবাগের পর যে নদী পড়ে (কাঁসাই কি দামোদর মনে পড়ছে না) তার উপর সেতু নির্মাণ হয়েছে, সোজা পথে গাড়ি চালিয়ে চলে যাওয়া যাবে ঘুরপথে যেতে হবে না । তখন বম্বে রোড কোথায়, সে তো দূর কল্পনা । সোজা রাস্তা খুলে গেছে এ সংবাদে জ্যোতি লাফিয়ে উঠলো ।আরামবাগ পৌঁছতেই তো অর্ধেক দিন পার হয়ে গেলো । পড়ন্ত আলোয় এবারে শুরু আমাদের
গঠত্রু গংযঞ যাত্রা । যে-পথে ল্যাণ্ডরোভার যেতে পারে না সে-পথে ঝকঝক করতে করতে চললো স্ট্যাণ্ডার্ড ৮ । নদীতে পৌঁছে দেখা গেলো কোথায় ব্রিজ - সামান্য জল - আর প্রচুর বালি, খাড়াই পাড় । জ্যোতির কাছে সেটাই হলো উত্সাহের কারণ, ডেভিড আর আমার সদুপদেশ কানে না তুলে সে গাড়ি নিয়ে নদীতে নেমে পড়লো । ওপারের খাড়াইয়ে হেডলাইটের আলোয় শুধু দেখা যাচ্ছে ঢিপি আর পাথর । উপরে পৌঁছে তার কাজ সমাপ্ত করে হেডলাইট শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করলো । ঘুটঘুটে অন্ধকার । আর কাণ্ড ! হঠাৎ শুরু হলো ঝড় ও বৃষ্টি একদম বিনা নোটিসে । আলো নেই, ওয়াইপার কাজ করে না, সামনে কিছু দেখা যাচ্ছে না । ডেভিড বার করলো তার বিলিতি টর্চ যা আগুনের মতো জ্বলে । কখনো জানালার কাচ নামিয়ে হাত বাড়িয়ে, কখনো বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি থেকে নেমে সে টর্চের আলোয় পথ দেখাতে লাগলো `স্টপ স্টপ', `কেয়ারফুল, কেয়ারফুল' `ডোন্ট ডোন্ট' বলতে বলতে । রক্ষে যে কোথাও আর কোনো যানবাহন নেই, জনপ্রাণী দূরের কথা, শুধু একটা শেয়ালের দেখা পাওয়া গিয়েছিলো । নিশুতি হয়ে এলো রাত, কোন দিকে যাচ্ছি জানি না । বেরিয়েছিলাম এক ভোরে, পরদিন ভোরে ঘন্টায় গড়ে ৭/৮ মাইল চালিয়ে যেখানে পৌঁছলাম তার দূরত্ব হয়তো কলকাতা থেকে ১৪০ মাইল । তবু অবশেষে পৌঁছেছিলাম রানীবাঁধ, বেলা এগারোটা নাগাদ । তখন রানীবাঁধের কথা কেউ জানতো না এখন অবশ্য পরিচিত স্থান ।আমরা তখন ছিলাম নিখাদ রোমান্টিক । ঐভাবে পথ চলেও সাড়ে তিনজন বেশ ফূর্তিতে আছি । আমাদের শিশুকন্যাটি এ-সব অনিয়মে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলো । রানীবাঁধের সুপ্রাচীন বাংলোতে পৌঁছে ডেভিড খোঁজ করলো মন্দিরের আর জ্যোতি গেলো কাছের পল্লীগুলিতে হানা দিয়ে মারাঠা বর্গীর মতো খাদ্যসংগ্রহে, আমি চৌকিদারের রান্নাঘরে উনুনে লকড়ি গুঁজে রান্নার ব্যবস্থা ও কন্যার পরিচর্যার ।
ফেরার পথে ঘুরপথ । হঠাৎ গাড়ি আর চলে না । খুটুর-খাটুর করে জ্যোতি বললো, `বোধহয় ব্যাটারি ডাউন । একটু ঠেলে দিলেই চলবে' । ডেভিড বেচারি নামলো গাড়ি ঠেলতে । গ্রাম থেকে দল বেঁধে ছেলেবুড়ো বাচ্চা-কোলে-বউ ছুটে ছুটে এলো সাহেব গাড়ি ঠেলছে তাই দেখতে । ডেভিডের পেছন পেছন আসে কিন্তু কেউ হাত লাগায় না । ডেভিডের করুণ অবস্থা । শেষকালে তারা সিদ্ধান্ত নিলো, না এটা আসল সাহেব নয়, ফিরিঙ্গি সাহেব । আসল সাহেব কোনোদিন গাড়ি ঠেলবে না । এইসময় জ্যোতি ভাগ্যিস লক্ষ করলো যে গাড়ির চাবিই ঘোরানো নেই (আমার মেয়ে প্রায়ই এই অপকর্মটি করতো, গাড়ির চাবি টুক করে ঘুরিয়ে বন্ধ করে দিতো) সে চাবি ঘোরাতেই গাড়ি স্টার্ট নিলো । ডেভিড ছুটতে ছুটতে, হাঁপাতে হাঁপাতে এসে গাড়িতে বসে ঘাম মুছলো । আমরা ওকে অবশ্য বলতে সাহস পেলাম না আসল ঘটনা ।
সিংভূমের জঙ্গলে আমরা বারবার গেছি, এর মধ্যে দুবার ডেভিড গেছে আমাদের সঙ্গে । আমাদের মতো তারও পছন্দ ছিলো প্রচলিত ট্যুরিস্ট স্পটের বদলে অচেনা অজানা নির্জন বন-পাহাড় নদী । বম্বেমেলের যাত্রীরা বহুবার পার হয়ে গেছেন, কিন্তু গোয়েলকেরার ছোট্ট স্টেশন খেয়াল করেননি কারণ ঐ স্টেশন আসে রাতে, পাহাড়-জঙ্গলের মধ্য দিয়ে স্বপ্নের মতো পার হয়ে যায় বম্বে মেল । যদি কেউ লক্ষ করে থাকেন তবে তাঁর মনে থাকবে যে একটা সুড়ঙ্গ পার হতে হয় (বম্বে আসার আগে পশ্চিমঘাট পর্বতমালায় অনেক সুড়ঙ্গ আছে, কিন্তু পূর্বভারতে বোধহয় এই একটাই), এই সুড়ঙ্গের একদিকে গোয়েলকেরা একদিকে পসইতা । গোয়েলকেরায় যেতে হতো সম্বলপুর প্যাসেঞ্জারে, যে-পথ বম্বে মেল পার হয় তিনঘন্টায় সে-পথ যেতে ট্রেনে উঠতে হয় রাত নটায় এবং সকাল নটায় আসে শালবনের মধ্যে লাল টালির ছোট্ট স্টেশন, গোয়েলকেরা । কাঁকড়-ঢালা পথ এঁকেবেঁকে উঠে গেছে টিলার উপর যেখানে শাল ও মহুয়ার বীথির মধ্যে অতি প্রাচীন ইংরেজদের করা কলোনিয়াল বাংলোর দেড়-মানুষ সমান উঁচু ভিৎ । দুটো সুইট, বিশাল বাথরুমে স্নানের জায়গায় কাঠের জাফরি কাটা পাটাতন । ছাদে জলের ট্যাংক কুয়ো থেকে জল তুলে ভরে দিতো চৌকিদারের লোক । গোয়েলকেরা থেকে পাটুঙ, কারো নদীর ধারে খেজুরিয়া । সিংভূমের জঙ্গলে গিয়ে ডেভিড মন্দির ভুলে গেলো । রোজ ভোরে উঠে ডেভিড আর জ্যোতি জঙ্গলের ভেতর হাঁটতে যেতো - ওরা তর্ক করতে করতে যেতো আর তর্ক করতে করতে ফিরতো । ফিরে এসে বাংলোর বাগানে বেতের চেয়ারে প্রাতরাশ খেতে খেতে আবার তর্ক । তখন কেম্ব্রিজের ডাউডন কলেজ থেকে বেরুতো
নবশণ্ণঞঠত্রষ্ পত্রিকা ; ডেভিডের খুব প্রিয় পত্রিকা । এফ. আর, লীভিস সম্পাদক । কেম্ব্রিজের এই অধ্যাপক ছিলেন ডেভিডের গুরু । অতএব জ্যোতিকে লীভিসের বিরুদ্ধে বলতেই হবে । বেলা হতে হতে রেঞ্জার চলে আসতেন জিপ নিয়ে, তাঁর সঙ্গে বেরুতাম আমরা । পথে থেমে পাহাড়ি ঝর্নায় জ্যোতি ও তার অন্যান্য সঙ্গী বা ডেভিড স্নান করতো । গভীর রাতে ফরেস্ট অফিসারের জীপে যাওয়া হতো ঘন জঙ্গলে যেখানে জোনাকির মতো অন্ধকারে জ্বলে বনবাসী প্রাণীর চোখ । ফরেস্ট অফিসারের স্ত্রী ডেভিডকে চায়ের বদলে বেলপানা খাইয়ে মুগ্ধ করে দিয়েছিলেন । এক গ্লাস শেষ করে ঈষৎ লজ্জিতভাবে সে দ্বিতীয় গ্লাশের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলো । সেই অবধি বেলপানা তার প্রিয় পানীয় । তাকে কখনো মদ্যপান করতে দেখিনি । সিগারেটের নেশাও ছিলো না । নারী-আসক্তি একেবারেই নয়, যদিও মেয়েরা তার প্রতি যথেষ্ট আকৃষ্ট হতো । সে ছিলো একেবারে গল্পকথার সাধুপুরুষ, কিন্তু অতি জীবন্ত, রসিক ও চমত্কার সঙ্গ । ইংলণ্ড থেকে সে নিয়ে আসতো এক সুটকেস সাদা চকলেট । বনে জঙ্গলে তাই ছিলো তার খাদ্য ।
ডেভিডের বন্ধুসংখ্যা ছিলো অগণিত এবং বাংলা সংস্কৃতির নানান ক্ষেত্রে তাঁদের বিচরণ । যেমন বুদ্ধদেব বসুর তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে শিক্ষকতা করেছে তেমন সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কাজ করেছে, আবু সৈয়দ আইয়ুব ও অম্লান দত্তর সঙ্গে ক্ষণ্ণংযঞ পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক ছিলো সে, পি. লালের সে ঘনিষ্ঠ বন্ধু । যদিও রুংইছস্ পত্রিকার বাংলা সাহিত্য সংখ্যায় ডেভিড
ঝত্ররুধ-ত্রিভত্ঠবছত্র সাহিত্য বিষয়ে (??) বিরুদ্ধ মন্তব্য করেছিলো । ঐ সংখ্যায় প্রধান প্রবন্ধটি ডেভিডেরই ছিলো । সে ছিলো সত্যজিতের অন্ধ অনুরাগী । তাঁর ছবির কোনো সমালোচনাই সে সহ্য করতে পারতো না । একবার সত্যজিতের কোনো একটি ছবি, যতোদূর মনে পড়ে কাপুরুষ, আমার ভালো লাগেনি । সে কথা ডেভিডকে বলতে সে রেগে উঠলো । আমিও বিরক্ত হয়ে বললাম, সেন্সর নাকি ? সত্যজিতের ছবি খারাপ বলা নিষিদ্ধ ? ডেভিডের অভ্যেস ছিলো ইংরিজি বাক্যের মধ্যে দু একটা বাংলা শব্দ ব্যবহার করার । সে বললো, "মচ্ছঞ'য ছত্ত্. ঝী ষ্ধণ্ণ যছষ্ ছত্রষ্ স্ধশং ঝ গধণ্ণত্রু ঞচ্ঠত্রূ ষ্ধণ্ণ ছশং বাজে ছত্ররু ষ্ধণ্ণ গধণ্ণত্রু ঞচ্ঠত্রূ ঝ ছস্ বাজে ঘং ঢংঞঞংশ ঞছত্ংঊ ছঢধণ্ণঞ যধস্ংঞচ্ঠত্রভ ংত্যং."
সত্যজিৎ ভক্তি যে বাড়াবাড়ি নয় সেটা বোঝাতেই বোধহয় সে একদিন বললো `একটা অন্য ছবি দেখাও তো আমাকে । অন্য কোনো পরিচালকের বাংলা ছবি ।' ভেবে চিন্তে তাকে নিয়ে গেলাম তপন সিংহের হাটেবাজারে দেখতে আমাদের পাড়ার `আলেয়া' সিনেমায় । তারকাখচিত ছবি হাটেবাজারে, সে ছবিতে অশোককুমার, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, বৈজয়ন্তীমালা, এঁরা সব অভিনয় করেছেন । বৈজয়ন্তীমালা আমার প্রিয় অভিনেত্রী । ডেভিডকে বললাম, `দেখবে কী দারুণ সুন্দর এই ছবির নায়িকা' । ছবি চলছে, ডেভিড বলে, `কই তোমার সেই সুন্দরী নায়িকা ?' আমি বললাম, `একি, এতক্ষণ দেখলে কী ? ঐ যে বৈজয়ন্তীমালা নাচলেন ?' সে বললো, `এই তোমার সুন্দরী ? এতো মোটা ! একে ব্লু ফক্সের ওয়েট্রেস হলে মানাতো' । তখন পার্ক স্ট্রীটে নতুন খুলেছে ব্লু ফক্স বার, আমরা দু'একদিন গেছি ।
এরপর সুচিত্রা সেনের একটা ছবি দেখিয়েছিলাম সুন্দরী নায়িকা দেখাবার জন্য, ছবিটা বোধহয় শরত্চন্দ্রের `বিপ্রদাস', উত্তমকুমার, পাহাড়ী সান্যাল ছিলেন, পরিচালকের নাম মনে নেই । সুচিত্রা সেনও ডেভিডের মনোহরণ করতে সক্ষম হননি ।
বৈজয়ন্তীমালা, সুচিত্রা সেনকে সুন্দরী মনে না হলেও এক কিশোরী অভিনেত্রী ডেভিডকে
মুগ্ধ করেছিলো । তার নাম যূঁই ব্যানার্জি । তরুণ মজুমদারের `বালিকা বধূ' ছবিতে নায়কের বোনের রূপে যূঁই পর্দায় প্রথম এক ঝলক আসতেই ডেভিড, `বা: কী সুন্দর !' বাংলায় বলে একেবারে সিট থেকে দাঁড়িয়ে উঠলো ।
ডেভিডের মৃত্যুর সময় জ্যোতি ছিলো সাগর মেলায় । জ্যোতি আর ওর সর্বকর্মের সঙ্গী আকুল রাতে হোগলার ছাউনিতে ফিরে রান্নার জোগাড় করতে করতে ট্রানজিসটার শুনছে, হঠাৎ ডেভিড ম্যাক্কাচ্চিন নামটি শুনে উত্কর্ণ হলো । তারা ভেবেছিলো, ডেভিড কোনো পুরস্কার পেয়েছে । সে রাত্রে আর রান্না করা হলো না তাদের । ওরা দুজন ছাউনি থেকে বেরিয়ে গেলো সাগরতীরে যেখানে লোকে মৃত আত্মীয়দের আত্মার মুক্তিকামনায় প্রদীপ জ্বেলে সাগরের জলে ভাসাচ্ছে । ওরাও দুজনে দুটি প্রদীপ জ্বেলে জলে ভাসিয়ে দিলো অনন্তের উদ্দেশ্যে । তারপর তারা প্রথম যে বাস গেলো তা নিয়ে ফিরে এলো কলকাতা । তখন আমি ছেলেমেয়েকে নিয়ে ছিলাম নাকতলায় মা বাবার কাছে । ভোরবেলা জ্যোতি এসে পৌঁছলো, আমরা সকলে শোকাহত । বাবা জ্যোতিকে বললেন "ংই চ্ধশশঠঢত্ং ঞচ্ঠত্রভ চ্ছয চ্ছৃংঋংত্রংরু." বলেই বুঝলেন জ্যোতি জানে, তার মুখে তার ছাপ ।
হাসপাতাল থেকে ফিরে অমিয় (দেব) বলেছিলো, `জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আসন্ন মৃত্যুর কথা জানবার পর কী ভেবেছিলো ডেভিড ? কেমন লেগেছিলো তার ?' বলতে বলতে অমিয়র চোখ জলে ভরে গিয়েছিলো । কী ভেবেছিলো ডেভিড ? কী অন্যায়, কী অন্যায় - মনে কি হয়েছিলো তার ? ৪২-বছর বয়সে, সামনে খ্যাতি ও পরিপূর্ণ জীবনের সমস্ত সম্ভাবনা নিয়ে চলে যাওয়াটা কোনোমতেই গ্রহণ করা যায় না । কোনো মেয়ের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা দেখিনি; অনেক মেয়েই উদগ্রীব ছিলো তার জন্য । আমরাও একে ওকে তার সঙ্গে ভাব করাবার চেষ্টা করতাম । ডেভিড বলতো, `এমন মেয়ে চাই যে
সূক্ষ্ম রুচির মানুষ ছিলো ডেভিড, কোনো কিছু পরুষ কি স্থূল তার মনোমতো হতো না । একবার এসে দেখে যে আমরা সাজগোজ করে চলেছি কোনো এক কনসুলেটের ককটেল পার্টিতে । সে একেবারে স্তম্ভিত - সময়ের এই অযথা অপব্যায়ে জ্যোতি তুমি রাজি হচ্ছো কী করে ? তার বিস্মিত প্রশ্ন । জ্যোতির তুলনায় আমি অনেক বেশি প্রথাগত পথ ও নিয়মকানুন ভালোবাসি । তাই সে সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলো যে এসব পার্টিতে যাওয়াটাওয়া আমার জন্য এবং আমার নাম দিলো
তার অবিচুয়ারি লিখেছিলেন সত্যজিৎ রায় স্টেটসম্যান পত্রিকায় । ডেভিডের লেখা নোট, রেকর্ড ঘেঁটে জর্জ মিশেল যে বইটি সম্পাদনা করেছেন তার নাম
শুনে অবাক হয়েছিলাম যে নাস্তিক ডেভিড মৃত্যুর আগে জানিয়েছিলো, সে এযাংলিকান এবং তার শেষকৃত্য যেন সেই বিশ্বাস অনুযায়ী করা হয় । ভবানীপুরে আছে এযাংলিকান চার্চের সেমেটারি । সেখানেই ডেভিডকে সমাধিস্থ করা হয় । তার কবরের হেডস্টোন তার অনুরাগীরা চাঁদা তুলে বানিয়েছে । কবরের মাথায় গৌরী (আইয়ুব) পুঁতেছিলো একটি কাঠালি চাঁপার চারা এই আশায় যে সেই গাছ বড়ো হয়ে ফুল ঝরাবে ডেভিডের কবরে । আমার এই লেখার পাতাগুলিও তার স্মৃতিতে নৈবেদ্য ।
ছবিগুলি ডেভিড ম্যাক্কাচ্চনের
`দ্য ব্রিক টেম্পল্স্ অফ বেঙ্গল'
বই থেকে নেওয়া ।