• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩০ | মে ২০০৩ | ছোটদের পরবাস | গল্প
    Share
  • দুটি উপকথা : মল্লিকা ধর

    সে বহুদিন আগের কথা । এক দেশে এক গরিব চাষি থাকতো । তার থাকার মধ্যে ছিল শুধু এক মেয়ে । ছোট্টো একটি কুটিরে তারা বাপমেয়েতে থাকতো ।

    তাদের চাষ করবার মতো ছোট্টো জমিটুকুও যখন হাতছাড়া হয়ে গেল তখন মেয়ে তার বাবাকে বললো, "বাবা তুমি রাজার কাছে যাও । তিনি শুনেছি গরিবকে সাহায্য করে থাকেন । তাঁকে গিয়ে আমাদের অবস্থার কথা জানাও । হয়তো তিনি প্রসন্ন হলে আমরা ফসল ফলাবার মতো একটু জমি পাবো । তাতে চাষ করে বেঁচে থাকার মতো আয়টুকু করতে পারবো ।"

    চাষির কাছে তার মেয়ের এই পরামার্শ মন্দ বলে মনে হলো না । সত্যি রাজার দয়ালু বলে সুনাম ছিল । সে যেতে রাজি হলো কিন্তু বললো মেয়েকেও তার সঙ্গে যেতে হবে ।

    শুভদিনে চাষি আর তার মেয়েতে মিলে তো রওনা হলো রাজপ্রাসাদের উদ্দেশ্যে । অনেক মাইল পথ হেঁটে ক্লান্ত হয়ে দুজনে পৌঁছলো রাজার বাড়ি ।

    রাজা তখন রাজসভাতেই ছিলেন । তিনি মন দিয়ে চাষির কথা শুনলেন । তাদের দারিদ্র্যের কথা শুনে মন গলে গেল তরুণ রাজার । বিশেষ করে চাষির মেয়েটির এতই লক্ষ্মীমন্ত সুন্দর চেহারা যে তার ছেঁড়া কাপড় আর অনাহারের কথা শুনে রাজা খুব বিচলিত হয়ে পড়লেন ।

    খুব তাড়াতাড়িই তিনি তাদের জন্য ওই অঞ্চলের সেরা জমিটি মঞ্জুর করে দিলেন । চাষি আর তার মেয়ে তো রাজাকে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে আর কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বাড়ি চলে এলো । তারপরে দিন যায় । চাষি আর তার মেয়ে এখন সেই জমিতে চাষবাস করে খেয়েপরে সুখেই আছে ।

    একদিন চাষি তার ওই জমিতে লাঙল দিতে গিয়ে হঠাৎ পেয়ে গেল একটা সোনার শিল । শুধু শিলই, নোড়া নেই । সে তো হন্তদন্ত হয়ে বাড়িতে চলে এলো শিলটা নিয়ে । মেয়েকে বললো কি হয়েছে । এরপরে বললো সে মনস্থ করেছে রাজাকে এই সোনার শিল দিয়ে আসবে সে । কারণ এই জমি রাজার দেওয়া ।

    চাষির মেয়েটি ছিল দারুণ বুদ্ধিমতী । সে বললো "বাবা তুমি যদি রাজাকে এটা নিয়ে দাও, রাজা বলবেন নোড়াটা কোথায় গেল ?" চাষি মোটেই সে কথা শুনলো না, বললো যে রাজা সোনার শিল পেয়েই খুশি হবেন, নোড়ার কথা কখনই জিজ্ঞেস করবেন না ।

    সোনার শিল গামছায় ভালো করে মুড়ে তো চাষি চললো রাজার বাড়ির দিকে । রাজদরবারে এসে রাজাকে সোনার শিল দিলো আর খুলে বললো কি-করে সে এটা পেয়েছে । রাজা কিন্তু বললেন, "নোড়াটা কোথায় গেল ? ব্যাটা চোর, নোড়া সরিয়ে রেখে শুধু শিল দিতে এসেছ আমায় ? আমি কি ঘাসে মুখ দিয়ে চলি ? তোর মতো চোরকে কি-করে সোজা করতে হয় আমার খুব ভালই জানা আছে । এই কে কোথায় আছিস, একে ধরে নিয়ে কারাগারে রাখ বন্দী করে । যতক্ষণ না নোড়া আমার হাতে আসে মোটেই একে ছাড়বি না । আমি দেশের রাজা, আমার সঙ্গে বদমাইশি ? এবার বোঝো, কত ধানে কত চাল ।"

    কোতোয়াল এসে তো চাষিকে বেঁধে নিয়ে গেল কারাগারে । চাষি এতই হতভম্ব হয়ে গেছিল যে তার মুখ দিয়ে একটি শব্দও আর বেরোলো না ।

    পরের দিন সকালে কারারক্ষী এসে রাজাকে জানালো যে চাষি সারারাত ধরে এতই বিলাপ করেছে আর বলেছে "ইশ যদি আমি মেয়ের কথা শুনতাম !", যে কারারক্ষীর একটুও ঘুম হয়নি, মাথা ধরে গেছে ।

    রাজা খুব কৌতূহলী হয়ে উঠলেন । তার চাষির মেয়েকে খুব ভালই মনে ছিল । মেয়েটি সুন্দরী ছিল সত্যিই, কিন্তু সে এতই বুদ্ধিমতী ?

    রাজা বললেন চাষিকে মুক্ত করে তার কাছে নিয়ে আসতে । সে এলে তাকে জিজ্ঞেস করলেন যে তার মেয়ে তাকে কি বলেছিল । চাষি কাঁদতে কাঁদতে বললো যে মেয়ে তাকে আগেই বলেছিল যে রাজাকে শিল নিয়ে দিলে রাজা বলবেন নোড়াটা কোথায় গেল ।

    রাজা বললেন, "বটে ? মেয়ে তোমার এত চালাক ? ঠিক আছে তোমাকে ছেড়ে দিলাম । কিন্তু কাল তোমার মেয়েকে এখানে আসতে হবে হেঁটেও নয় বা দৌড়েও নয়, কোনো গাড়িতে চড়েও নয় বা কারুর পিঠে চড়েও নয় । তাকে এখানে আসতে হবে কাপড় পরেও নয়, কাপড় না-পরেও নয় । যদি সে তা না পারে তাহলে তোমাদের দুজনকেই শূলে চড়াবো ।"

    শুনে তো চাষির চক্ষুস্থির । সে তো কাঁদতে কাঁদতে আর চোখ মুছতে মুছতে বাড়ি দিকে চললো । নিজের মুক্তির আনন্দ তার সম্পূর্ণ মাটি হয়ে গেছিল কালকের বিপদের কথা ভেবে ।

    সে বাড়ি পৌঁছে তো একেবারে ভেঙে পড়লো । মেয়ে তাঁকে জলবাতাসা দিল, হাওয়া করলো । তারপরে সে একটু সামলে উঠলে তাকে জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে । সে অনেক কষ্টে সব বললো । বলা শেষ হলে সে একেবারে কেঁদে ফেললো, বললো "আমি মরি ক্ষতি নেই, আমারই বোকামির জন্য তোকে মরতে হবে এই অল্পবয়সে এইটাই আমার আফশোস ।"

    চাষির মেয়ে হেসে বললো, "তুমি এত ভাবছো কেন বাবা ? ভগবান সহায় থাকলে আমরা ঠিক তরে যাবো এই বিপদ থেকে । নাও এখন নেয়ে এসে দুটো মুখে দাও দেখি । কালরাতেও তো কিছু খাওয়া হয় নি নিশ্চয় । ইশ, মুখ শুকিয়ে গেছে । তাড়াতাড়ি যাও, পুকুরে দুটো ডুব দিয়ে এসো । আমার রান্নাবান্না সব তৈরি, শুধু চানটা করে এসো । এই নাও তোমার গামছা, দেরি কোরো না, খাবারদাবার সব জুড়িয়ে জল হয়ে যাবে ।"

    চাষি তার মেয়ের এই ভরসা-ভরা কথা শুনে আর তার হাসি দেখে কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে স্নান করতে চলে গেল ।

    পরের দিন রাজা দেখলেন, বিশাল দুই ষাঁড় একটা বোঝা টেনে নিয়ে আসছে । আরো কাছে এলে দেখা গেল বোঝাটা আর কিছুই নয়, চাকা-লাগানো এক কাঠের চৌকো পাতের উপরে মাছধরার জালে খুব ভালোভাবে জড়ানো সেই চাষির মেয়ে । চাষির মেয়ে কাপড়ের বদলে পরেছে মাঝধরার জাল - সে জাল এতবার পেঁচিয়েছে যে তা কাপড়ের চেয়েও ভালো ভাবে তাকে ঢেকেছে । সে হেঁটেও আসেনি, দৌড়েও না, কারুর পিঠে চড়েও না, গাড়িতে চড়েও না । সে কাপড় পরেনি, আবার সে অনাবৃতাও নয় ।

    রাজা চমত্কৃত হয়ে গেলেন । এই অত্যন্ত বুদ্ধিমতী মেয়েটিকে রানী না করতে পারলে তাঁর জীবন বৃথা মনে হলো ।

    যা ভাবা সেই কাজ । তক্ষুণি জরুরি তলব পেয়ে চলে এলেন রাজপুরোহিত । তিনি সেইদিনই শুভক্ষণে রাজার সঙ্গে সেই কৃষককন্যার বিবাহ দিলেন ।

    গোটা রাজ্যের লোক নিমন্ত্রণ খেয়ে ধন্য ধন্য করতে লাগলো ।



    (আয়ার্ল্যাণ্ডের একটি রূপকথার ছায়াবলম্বনে)



    জাল আবিষ্কারের কাহিনী




    সে অনেককাল আগের কথা । তখন লোকেরা মাছ ধরতো ছিপ দিয়ে । তারা জাল বানাতে জানতো না । তাই তারা খুব অল্প মাছই ধরতে পারতো । অনেক সময় তারা মাছের অভাবে উপোস থাকতো তবু কি করা যায় বুঝতে পারতো না ।

    সমুদ্রের তীরে জেলেদের গ্রামে কাহুকুরা বলে এক খুব বুদ্ধিমান ছেলে থাকতো । সে একদিন সমুদ্রের তীর বরাবর হাঁটতে হাঁটতে একজায়গায় এসে দেখলো প্রচুর মাছ ডাঁই করা রয়েছে । এতো মাছ ! অথচ মাত্র কয়েকটা মানুষের পায়ের ছাপ তার আশেপাশে ! সে অবাক হলো প্রথমে, তারপরে স্থির করলো যে নিশ্চয় এ জলদেবদের কীর্তি । কিন্তু এটা করলো কি করে ওরা ?

    কাহুকুরা লুকিয়ে রইলো কাছে । সারাদিন গেল বিনা ঘটনায়, রাত হয়ে এলো । রাত বেশ গভীর হলে সে শুনতে পেলো জলদেবরা জলের ভিতর থেকে গান গাইছে - "হেঁইয়ো হো, হেঁইয়ো হো/ জাল টানো জাল টানো/ জলের ফসল ঝটপটায়/এই হেথায়, ওই হোথায়/ টানো জাল, ধরো মাছ ।"

    কাহুকুরা তো লুকিয়ে শুনছে কিন্তু বুঝতে পারছে না জাল মানে কি । সে আগে কখনো জাল দেখেনি ।

    সে দেখছে চাঁদের আলোয় জলদেবদের ফর্সা দেহ ঝকঝক করছে । তাদের ডিঙি নৌকো থেকে ওরা কি যেন বিশাল জিনিস ছুঁড়ে ফেলছে জলে, দড়ি ধরে থাকছে, তারপরে টানছে আর গান গাইছে ।

    সমুদ্রের তীরে এসে নামলো ওরা । জাল টেনে নিয়ে আসছে । ভিতরে অজস্র মাছ ছটফট করছে ।

    এখন কাহুকুরা ছিল মোটামুটি ফর্সা গোছের । সে কায়দা করে ওদের দলে মিশে গিয়ে জাল টানতে আরম্ভ করলো । সেও ওদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গান গাইছিল । রুপোলি মাছগুলি চাঁদের আলোয় ঝকঝক করছিল আর কাহুকুরার মন আনন্দে নাচছিল । চাঁদের আলোয় ওকে দেখে জলদেবরা কিছু সন্দেহ করেনি । তারা ওকে তাদেরই একজন বলে মনে করেছিল ।

    রাত শেষ হয়ে আসতেই জলদেবরা ব্যস্ত হয়ে উঠলো । সূর্য ওঠার আগেই ওদের ফিরে যেতে হবে জলের গভীরে । কারণ সূর্যতাপ ওদের ফর্সা গায়ের উপরে পড়লে ওরা বাঁচবে না ।

    ওদের দলনেতা চেঁচিয়ে বললেন "তাড়াতাড়ি যে যার মাছ ভাগাভাগি করে নাও । আমাদের ফিরে যেতে হবে ।"

    সবাই মাছ ধরা বন্ধ করে বসলো মাছ ভাগ করতে । কাহুকুরা ইচ্ছে করে ওদের অনেক দেরি করিয়ে দিল ।

    যখন মাছ ভাগ শেষ হলো তখন পুব আকাশে ঊষার আলো দেখা দিল । সে আলো কাহুকুরার গায়ে পড়তেই জলদেবরা দেখতে পেল সে জলদেব নয়, সে মানুষ । ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেল ওরা । অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে জাল, মাছ সবকিছু ফেলে রেখেই ওরা দৌড় দিলো জলের দিকে ।

    কাহুকুরা মনের আনন্দে জাল নিয়ে ফিরে এলো জেলেপাড়ায় । এরপর থেকে ওরা জাল দিয়ে মাছ ধরা শুরু করলো । আর ওদের কোনোদিন মাছের অভাব হলো না ।



    (এটা মাওরি উপকথা)





    আইরিশ উপকথাটি ওয়েক্সফোর্ড কাউন্টি থেকে প্যাট্রিক কেনেডি সংগ্রহ করেছিলেন, ও সেটি নীল ফিলিপ-এর "দ্য ইলাসট্রেটেড ফেয়ারি টেল্স্‌" বইতে সংকলিত । একই গল্পের প্রায় ৬৮০-টি বিভিন্ন রূপ আছে ! গ্রিম-ভাইদের রূপকথাতেও গল্পটি আছে ।

    মাওরি উপকথাটি প্রথম প্রকাশিত হয় স্যর জর্জ গ্রে'র "পলিনেশিয়ান মাইথোলজি" বইতে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৫৫ সালে । গ্রে-সাহেব ছিলেন তখন নিউজিল্যাণ্ড-এর গভর্নর । তিনি গল্পটি শুনেছিলেন মাওরি যোদ্ধা
    Te Wherowhero 'র কাছে ।

    অলঙ্করণ : কালকূট-এর এক যে ছিলেন রাজা বইয়ের প্রচ্ছদ (শিল্পী : সুনীল শীল) থেকে ।


  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments