অপরিচিত গলার স্বরে সুবচনীর আগমন-বার্তা শুনে রঙ্গিনী দরজার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে দেখল লোকটার কাঁধে একটা বাঁক, বাঁকের একদিকে শিকেয় ঝুলছে একটি ছোট্ট ঠাকুরঘর, অন্যদিকে একটা ধামা । প্রথমে হাঁক দিয়ে শাঁখে ফঁংউ দিল সে, তারপর ঘরের দিকে চেয়ে চেয়ে যেন কার অপেক্ষা করতে লাগল ।
ঠিক এমনি ছোট্ট ঠাকুরঘর কাঁধে নিয়ে অন্য লোকও আসে । কেউ গায় শিবের গীত, কেউ-বা শীতলার, কেউ কেউ আবার শনি সত্যনারায়ণের গুনগান করেও ঘুরে বেড়ায় বাড়ি বাড়ি । এদের সবাই এমনি দাঁড়িয়ে থাকে এসে, যতক্ষণ না উঠোনের একটুকু জায়গা গোবরজলের ছিটা দিয়ে শুদ্ধ করে দেওয়া হয় । রঙ্গিনী তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে জলে গোবর গুলে নিয়ে আসতে গেল । কাঁধে ভার নিয়েই লোকটা গান ধরল
ওগো, সুবচনী মা
মাগো তোমার মহিমা জানি না ॥
সুবচনী মাগো তোমায় যে-বা করে হেলা
কেড়ে নাও তার কোলের ছেলে ঠিক দুক্কুর বেলা ॥
রঙ্গিনী ছুটে এসে একটুকু জায়গা গোবর জলে নিকিয়ে দিল । ছোট্ট ঘরটি সমেত মাটিতে নেমে বসলেন এবার সুবচনী ঠাকরুণ । আবার সে গাইতে লাগল,
সুবচনী মাগো তুমি যার বাড়ি যাও
ধান দুর্বো তেল সিন্দুর পান চুয়া পাও ॥
ঘরে চাল বাড়ন্ত, কিন্তু ঠাকুরের ভোগে কিছু না দিলে কেমন করে হবে, যদি ঠাকুর অভিশাপ দেন, - ভয় হয় রঙ্গিনীর মনে । আবার ভাবে লোকটা যে বলল কেড়ে নাও তার কোলের ছেলে, কিন্তু ছেলে যার মোটেই হয়নি, তার আর কি কেড়ে নিবে ? তবু রঙ্গিনী চালের ভাঁড়ার খুঁজে পেতে একমুঠি এনে রাখে ঠাকুরের সামনে । ছোট্ট মণ্ডপের ভিতর তাকিয়ে দেখে দেবী সুবচনীকে, কালো তার গায়ের রঙ - একটি ছেলে কোলে নিয়ে বসে দিব্যি আছেন । রঙ্গিনী ঠাকুরকে ভক্তি ভরে প্রণাম করে প্রার্থনা জানায় - আমাকেও একটি ছেলে দিও মা কোলে ।
সুবচনীর বাহকটি ঠাকুরের আসন থেকে একটি ফুল তুলে নিয়ে দিল রঙ্গিনীর হাতে । বলল, এটি তোমার ছেলের মাথায় ছুঁইয়ে দিও, ছেলের কোনোদিন অমঙ্গল হবে না ।
রঙ্গিনী মনে মনে হাসল, কিন্তু বলতে পারল না মুখ ফুটে যে তার ছেলেপিলে একটিও নেই ।
রাজা নয় নাগিনা, রানী নয় রঙ্গিনী, তবু রাজারানীর গল্পের মতোই তাদেরও ছেলে না হওয়ার কাহিনী । দুবেলা দুমুঠো ভাত কোনোরকমে জুটলেও মানুষমাত্রেই কোলে তাদের ছেলেমেয়ে চায় । ছেলেমেয়ে না থাকায় তাদের ছোটো ঘরখানাও ফাঁকা ফাঁকা ঠেকে । একটি ছেলে পাবার জন্য যে যা বলে নাগিনা ও রঙ্গিনী তাই করে চলে । বাদ দেয় না একাদশীর উপোস, পূর্ণিমা অমাবস্যার নিশিপাসন, সিদ্ধেশ্বরী মঙ্গলচণ্ডীর ব্রত, ষষ্ঠী ঠাকরুণের পূজো - আরও কত কি । গরীব নাগিনা সারাদিন ছেঁড়া জুতো মেরামত করে যা পায় তার বেশিরভাগই চলে যায় ছেলে-পাওয়ার আশায় ছোটোখাটো যাগযজ্ঞের খরচ মেটাতে ।
যখন প্রায় নিরাশ হবার অবস্থা, পুজো-আর্চা সব বন্ধ করে দেবার সম্ভাবনা যখন মনে উঁকি দিচ্ছে - এমন সময় একদিন হঠাৎ দেবতার দয়া হল । অনেকের ভবিষ্যদ্বাণী নিষ্ফল করে দিয়ে সত্যি সত্যি একটি ছেলে এলো রঙ্গিনীর কোলে । যেমনটি সে দেখেছিল সেদিন সুবচনী ঠাকুরুণের কাছে - ঠিক তেমনি সুন্দর ফুটফুটে । ছোটো ঘরের চেহারা গেল বদলে । কতকাল পরে এক পোড়ো তুলসীতলায় কে এসে যেন হঠাৎ প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়ে গেল ।
সুবচনীর আশীর্বাদী সেই ফুলটি খুঁজে খুঁজে হয়রাণ হল রঙ্গিনী, কিন্তু কিছুতেই পেলো না । কতকাল পরে ছেলে পেলো কোলে ছেলেটি যাতে সুস্থ সুন্দর থাকে তার জন্য সারাদিন রঙ্গিনী বসে বসে ভাবে । বাইরে সব সময় কান রাখে সেই লোকটা আবার আসে কিনা সুবচনী ঠাকরুণকে নিয়ে । কিন্তু না, সে আর এল না ।
মনের আশঙ্কা বদ্ধমূল করবার জন্যই যেন রঙ্গিনীর নবজাত শিশুটার স্বাস্থ্য দিন দিন খারাপ হতে লাগল । রঙ্গিনী ভয় পেয়ে তার স্বামীকে শুধাল, "ওগো তুমি কি সুবচনীকে হেলা করেছিলে ?"
"তখন-তো আমাদের ছেলেই হয়নি - তো হেলা করব কেন ?"
"তবে কেন ছেলেটা এরকম টিং টিং করছে ?"
"পীতাম্বর কবিরাজকে শুধিয়েছিলাম তুমি বলবার আগেই ।"
"কি কাগেন তিনি ?"
"বললেন, কালমেঘের রস খাওয়াতে ।"
"তুমি আজই আমাকে কালমেঘ এনে দাও ।"
কি আর করে নাগিনা । কালমেঘের সন্ধানে ছুটল । কবিরাজ মশায়ের বাড়িতে আছে । চাইলে নিশ্চয় পাওয়া যাবে ।
একটু দ্বিধা নিয়েই গেল কবিরাজের বাড়ির দিকে । একটা বিরাট জঙ্গলে গ্রাস করে আছে সেই বাড়িটা । লোকে বলে এই জঙ্গলের একটা গাছও অকেজো নয় । এটার ছাল, এটার মূল, সেটার পাতা, কোনো কোনোটার আবার ফুল ফলও লাগে কবিরাজী ওষুধে । নাম করা কবিরাজ পীতাম্বর ঠাকুর । নিজে চিকিত্সা করেন নিজের তৈরি ঔষধে - এক পয়সার ঔষধ কিনে আনেন না বাইরে থেকে । এই-যে যুদ্ধ লেগেছে দেশে-বিদেশে, কুইনাইন অমিল হয়ে গেছে - চোরাবাজারে বিক্রি হচ্ছে দশগুণ বেশি দামে, কবিরাজমশায়ের তাতে কিছু অসুবিধে নেই । ছাতিম ছাল আর কি কি সব জঙ্গলি গাছ-গাছড়া দিয়ে তিনি এমন পাঁচন তৈরি করে দেন, যাতে কুইনাইনের আগেই ম্যালেরিয়া ছাড়ে । তা না-হলে কি আর বাড়িতে তাঁর দশবারোজন ছাত্র বিনা পয়সায় থাকতে পেতো ? সারাদিন কবিরাজ মশায়ের ফাইফরমাশ খাটে আর শুকিয়ে নেওয়া লতাপাতা ছাল মূল হামানদিস্তায় ফেলে চূর্ণ করে অনেক দূর থেকেই শব্দ শোনা যায় - ঠুং- ঠুং- ঠুং-ঠুং ঠুং ঠুং - ঠুং ঠুং ঠুং .....
ঔষধের জঙ্গলের পাশ দিয়েই কবিরাজের বাড়িতে ঢুকবার পথ । অনবরত লোক যাওয়া-আসা করছে । থেকে থেকে শব্দ উঠছে ঠুং ঠুং ঠুং - ঠুং ঠুং ঠুং - ঠুং ঠুং ঠুং । এই শব্দটা যেন সবাইকে বলেছে - আসুন, আসুন ।
কবিরাজের বাড়িতে ঢুকেই বুকটা ঢিপ ঢিপ করতে লাগল নাগিনার । সামনেই ডিসপেনসারিতে কবিরাজ মশায় বসেছেন ফরাসের উপর তাকিয়া ঠেসান দিয়ে । গড়গড়ার নল হাতে রেখেই কথা বলছেন রোগী বা রোগীর আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে । চারিদিকে ঘিরে আছে নানা বয়সের নানা জাতের নানা চেহারার লোক । সবারই মুখের ভাবে একটা উদ্বেগ - যেন কবিরাজ মশায় একটা কথা বললেই, একটু ওষুধ দিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে ।
একজন একজন করে রোগ বিবরণ বলছে, কবিরাজ মশায় একনিবিষ্ট হয়ে শুনছেন, আর ওষুধ বলে বলে দিচ্ছেন । তাঁর ছাত্রদের একজন ওষুধের শিশি দিচ্ছে এগিয়ে - আর একজন পুরিয়া পাকাচ্ছে । চারদিকে ঘরের দেয়াল ঘেঁসা সাজানো সব কাঠের আলমারি ভরা ওষুধ - বটিকা, ভস্ম, আসব, অরিস্ট - ছোট বড় সরু মোটা নানারকমের কাজের শিশি ও চীনামাটির বোয়াম ।
নাগিনা ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে সব দেখছে । কবিরাজমশায় কারও কাছে পয়সা চাইছে না - তবু সবাই যার যার ইচ্ছামতন দিয়ে চলছে দুটাকা, চারটাকা, দশটাকা, কুড়িটাকা - সবই প্রায় নূতন নূতন কাগজের বড় বড় নোট । কবিরাজ মশায়ের সামনে যেন হরির লুট পড়েছে টাকার । নাগিনার মনে উঠে - এখানে তো কেউই দু'টাকার কম দেয় না, আর যত ছ্যাঁচড়ামো শুধু নাগিনাকে দেবার বেলাতে - মুচির কাছে যত ছ্যাঁদা পয়সা নিয়ে সবাই হাজির হয় । এখানে সবাই হাত কচলায় আর কাঁচুমাচু করে - আর ওর কাছে দাঁড়িয়ে সবাই চোখ রাঙায় আর ধমকায় । যদি নাগিনাও কবিরাজীটা শিখে ফেলতে পারতো ।
হঠাৎ ওর অন্যমনস্ক ভাব ভেঙে দিয়ে কবিরাজ মশায় প্রশ্ন করেন, "কি চাইরে নাগিনা ?"
চমকে উঠেই নাগিনা থতমত খেয়ে বলে, "আজ্ঞে, হুজুর, আপনি যে বলেছিলেন কালমেঘের কথা ।"
"ও, বুঝেছি, তোর ছেলেটার জন্য - আচ্ছা আমি বলে দিই- এই একটু অপেক্ষা কর ।"
কবিরাজ মশায় একটি ছাত্রকে ডেকে বলে দিলেন । ছাত্রটি এসে নাগিনাকে সঙ্গে করে জঙ্গলে নিয়ে গেল । কালমেঘের গাছ দেখিয়ে দিয়ে বলল, "নিয়ে যাও যে-কটা ইচ্ছে ।"
নাগিনা তো কালমেঘের কয়েকটা পাতা পাবার আশাই করেছিল । এখন পেল সে গোটা জঙ্গলটাই হাতের কাছে । একটা দুটো, একশো, দুশো নয় - হাজার হাজার কালমেঘের গাছ । এর থেকে একটা একটা করে পাতা না তুলে দুচারটে গাছ নিয়ে গেলে কারও কিছুই ক্ষতি হবে না । তবু একবার জিজ্ঞেস করে নিতে হয় । কিন্তু পিছনে তাকিয়ে দেখে ছাত্রটি উধাও । সামনে একটূ দূরে একটা খেঁকশিয়াল ছুটে পালিয়ে গেল । একা মানুষের লোকালয়েও ভয়, জঙ্গলে তো কথাই নেই । নাগিনা আর দেরি না করে দুচারটা গাছ টেনে তুলে ছুটে বেরিয়ে এল জঙ্গল থেকে ।
পথে যেতে যেতেই ঠিক করে নিল - বাড়িতে গিয়ে গাছ কটা ঘরের পিছনে বসিয়ে দেবে একটু মাটি খুঁড়ে । দুদিন জল দিলেই গাছগুলো আর মরবার ফাঁক পাবে না । তাহলে রোজ রোজ ছুটতে হবে না কবিরাজের বাড়ি ।
কালমেঘ দেখে রঙ্গিনী কি খুশি । কিন্তু রস বের করে নিয়ে যখন ছেলের মুখে দিল, তখন ছেলের সে কি প্রচণ্ড চিত্কার । কাছাকাছি লোকজন থাকলে সবাই এসে ভেঙে পড়তো নাগিনার ঘরে ।
তবুতো গেলাতে হবে এই তিতো রস । কিন্তু রস ঝিনুকে করে ছেলের মুখের কাছে নিলেই সে যেন বুঝতে পারে, এমনি চিত্কার শুরু করে যে আধঘন্টা পর্যন্ত আর থামে না ।
কিন্তু কৌশল করে রঙ্গিনী ঠিক কালমেঘ খাইয়ে চলে তার অঙ্কের যষ্টিটিকে । একটি একটি করে দুশ্চিন্তার মুহূর্ত পার হয়ে একদিন যেন হঠাতি দেখতে পায় যে তার সেই কোলের মধ্যে জড়িয়ে রাখা রোগা টিং টিং শিশুটি উঠোনে নেমে হেঁটে ছুটে বেড়াচ্ছে ।
জন্মকালের অনেক কিছুই শিশু ভুলে গেছে, কিন্তু ভোলে না কালমেঘকে । এখনও যখনই পেটের পীড়া দেখা দেয় আর মা যখনই কালমেঘ তুলে আনে ছেলে ঠিক বুঝতে পারে । সারাদিন মায়ের আঁচলের আড়ালে আড়ালে ঘোরে, কিন্তু কালমেঘ দেখতে পেলেই মাকে ছেড়ে পালিয়ে যায় ।
সেদিনও ছেলেটা পালিয়েছে । কিন্তু গেল কোথায়, রঙ্গিনী তার সারা আশমানের এক চান্দকে দেখতে না পেলে অস্থির হয়ে ওঠে । চিত্কার করে ডাকতে শুরু করে - মুনিয়ারে ও মুনিয়া, মুনিয়া .... । সাড়া না পেয়ে বিলাপ করে কাঁদতেই আরম্ভ করে ।
উঠোনে এক টুকরা রোদে পোষা বিড়ালটা চোখ বুজে মুখ মুছছে থাবাটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে । পাশেই কুকুরটা ঘুমোচ্ছে । এই মিনি আর এই ভোলার সঙ্গে মুনিয়ার কেন যে ভাব নেই এই কথাটা ভেবে ভেবে আকুল হয়ে ওঠে রঙ্গিনী । মুনিয়া যদি ভোলার কানে ধরে, ভোলা হয়ত একবার ঘ্যাঁক করে ওঠে, তাতে মুনিয়া ভয় পায় কেন মিনির লেজে মুনিয়া যদি লেগে থাকে মিনিতো ফ্যাঁচ করবেই তাই বলে মিনি কখনও মুনিয়াকে আঁচড়ে দিতে পারে ! তবু মুনিয়া এমন পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায় - শুধু কি কালমেঘের ভয়ে । তা নাহলে মিনি ভোলা যেখানে মুনিয়া সেখানেও নেই কেন ? কোথাও খুঁজে আজ মুনিয়াকে পাওয়া যাচ্ছে না ।
শীতকাল । গাঁয়ে অনেকে এসময় জুতো পায়ে দেয় । নূতন জুতো নয় । ফতেগাজির মেলা থেকে গত বছর যা এনেছিল তাই মেরামত করিয়ে নেয় নাগিনাকে দিয়ে । হাটে বসে নাগিনা সব জুতো মেরামতি শেষ করতে পারে না । জোড়াতালির কাজে সময়ও যায় বড় বেশি । তাইতো হাটের শেষে বাড়িতে নিয়ে আনতে হয় কয়েক জোড়া । সেরেসুরে ফিরিয়ে দেবে আগামী হাটে । মজুরির পয়সা কিছু পেয়ে যায় হাতে হাতে । কিছু থেকে যায় বাকি । সে ধার অনেকেই শেষ করতে চায় না ।
কেউ কেউ এসে হাজির হয় আগামী হাটের আগেই নাগিনার বাড়িতে । কাছে বসে থেকে কাজ শেষ করিয়ে না নিলে তারা সোয়াস্তি পায় না ।
আজ কেউ আসেনি । তবু হাতে অনেক কাজ । কোনোটায় তালি, কোনোটায় ধার ঘেঁষে একটুকু সেলাই । পুরনো চামড়া কোথাও ফেটেছে, কোথাও দুমড়েছে, কোথাও-বা পিচবোর্ডের সঙ্গে সঙ্গে ভেঙেই গেছে - সযত্নে পড়ে নষ্ট হয়েছে । নাগিনা ছুঁচে সুতো পরিয়ে টানে, চামড়া কেটে বেরিয়ে আসে সুতো । মনটা ওর বিরূপ হয়ে ওঠে । এ-সব জোড়াতালির চাইতে নূতন জুতো বানানোর কাজে তবু আরাম আছে । কিন্তু কে এই পাড়া গাঁয়ে তৈরি করাবে, তাতে যে পয়সা বেশি লাগে । আর মুলধনও বেশি চাই নাগিনার । পাকা চামড়া আনাতে হয় কলকাতা থেকে । অত টাকা পাবে কোথায় নাগিনা ?
কাজ করতে করতে মন যে কত দেশ ঘুরে বেড়ায় । তবু তো কাজ হয় - সেকথা ভেবে বড় বিস্ময় লাগে নাগিনার । বার বার ছাঁচতলার দিকে তাকায় - বেলা যেন ঘোড়ার মতো দৌড়োয় এই শীতের দিন পড়লে ।
দুজোড়ায় তালি লাগানো শেষ হল সবে । এর মধ্যে হঠাৎ রঙ্গিনীর চিত্কারে আকাশ ফাটছে । নাগিনা কাঁপছে । দাঁতে দাঁত ঘষছে আর শিং থেকে চিকনি লাগাচ্ছে ছুঁচের আগায় । বাঁ হাতটা জুতোর ভিতরে । ডান হাতে দুআঙুলের চাপে ছুঁচটা ঢোকে বেরিয়ে আসে । ছেঁড়া জুতো জোড়া লেগে যায় ।
রঙ্গিনীর কান্নায় নাগিনার হাত কেঁপে কেঁপে ওঠে । অভ্যাসের হাত । কাজ এগিয়ে চলে । তবু নাগিনা তাড়াহুড়ো করে - দেখতে হবে ছেলেটা কোথায় গেল ।
আর একটা ফোঁড় বাকি । হঠাৎ মুখ কুঁচকে উঠল নাগিনার । ছুঁচ ঢুকে গেল আঙুলে । গায়ের জোরেই টেনে বের করতে হল । রক্ত পড়ছিল দরদর করে । বাঁহাতের তর্জনীটা চেপে ধরল ডান হাতের দুআঙুলে । উঠে পড়ল কাজ শেষ না হতেই ।
গাঁদাপাতার গাছ আছে গোয়াল ঘরের পাশে । ওদিকে এগিয়ে গেল চটপট ।
গাছে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল অবাক হয়ে । ফোঁস ফোঁস একটা শব্দ । সাপ নাকি ? ডানে বাঁয়ে সামনে পিছনে তাকাতে লাগলো একটা ভীত চকিত দৃষ্টি দিয়ে । কাছে আর নেই - যাকে বলবে ব্যাপারটা অনুসন্ধান করতে ।
হঠাৎ দৃষ্টি গেল গোয়ালঘরের বেড়ার ফাঁক দিয়ে ভিতরে । আদরের গাই পুনির কিরকম একটা ছটফটানি চলছে । বাঁধনদড়ি ছিঁড়ে ফেলতে চাইছে একেবারে । কেবলই মাথাটা নাড়ছে আর নাকে ফোঁস ফোঁস শব্দ তুলছে ।
ভিতরে ঢুকল সে । ফুটফুটে একটি ছোট্ট বাছুর পুনির পাশে । পুনি জিভে নাগাল পাচ্ছে না তার নবজাত সন্তানের । বাছুরটা দুহাতে আগলে নিয়ে বসে আছে মুনিয়া ।
পুনির গলার বাঁধনটা খুলে দিল এবার নাগিনা । মা ছা-এর গা চাটতে লাগলো খসখসে জিভ দিয়ে ।
নাগিনা ছুটেই বেরল । ঘরে খুঁজে পেল না । বাড়ির নিচুতে খালের পার থেকে তুলে নিয়ে এল রঙ্গিনীকে । মুখের কথায় সে উঠে আসছিল না । মুনিয়া মুনিয়া বলে কাঁদতে কাঁদতে অদ্ভুত এক চেহারা করেছে মুনিয়ার মা । শাড়ির আঁচল ধরে তাকে টেনে তুলতে হল শেষ পর্যন্ত । তারপর একরকম ঠেলে ঠেলে নিয়ে এল গোয়ালঘরের দরজা পর্যন্ত - আর আঙুল দিয়ে ইশারা করে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল ঠিক সেইখানটাতে যেখানে পুনির বাচ্চা আর মুনিয়া দুটিতে জটাপটি করছে ।
মুনিয়া দেখল রঙ্গিনী আঁচলে চোখ মুখ মুছে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল । এবার আঁচল কোমরে জড়িয়ে নিয়ে ঢুকে পড়ল গোয়ালের ভিতরে । নুতন বাছুরটাকে ধরল নরম হাতে ।
মুনিয়া কাঁদতে লাগল । বাছুর বুঝি এবার ওর হাতছাড়া হয়ে যায় ।
বাছুরের মুখে আঙুল দিয়ে দেখল রঙ্গিনী - আরেকটু দেরি হলেই মাড়ি শক্ত হয়ে যেত । মাড়ি শক্ত হলে আর দুধ টানতে পারবে না । শিগগির ওকে মায়ের বাটে লাগিয়ে দিতে হবে ।
একটা শুকনো খড় বাছুরের মুখে পুরে খড়ের দুটো দিক এক জায়গায় করে বেঁধে দিল লাগামের মতো । এবার বাছুর মুখ নাড়ছে । মুখের জড়তা দূর হলে তবে-ত দুধ টানবে চুক চুক করে । এসব ব্যাপার - ছোটোখাটো টুকটাকি যারা না জানে তাদেরই গয়লা ডাকতে হয় ক্ষণে ক্ষণে ।
মুনিয়ার হাত নিশপিশ করছিল । ফাঁকে ফাঁকে থেকে থেকে সে বাছুরটাকে জাপটে জাপটে ধরছে । মুনিয়ার মা বার বার ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে দিচ্ছে ।
মুনিয়ার তাতে রাগ হচ্ছে । মুনিয়া কাঁদতে শুরু করছে । মা বলল, কেঁদো না সোনা । এ বাছুর তোমারই । তুমি এখন নিশ্চিন্তমনে সারাদিন এর সঙ্গে খেলা করতে পারবে । আর কেউ নেবে না একে । এ যে তোমার বোন ।
মুনিয়া খুশি হয়ে বলল, - আমার কেন মা বলতে বলতে আবার এগিয়ে গেল বাছুরটার কাছে । আদরে ঠোঁট দুটোতে কত রকমের শব্দই যে তুলল । চুম কুড়ি খেয়ে খেয়ে বাছুরকে জড়িয়ে ধরে বলল -
বোনি আমার বোনি
এতদিন কেন আসোনি
বাছুরকে ওর মায়ের বাঁটে ধরিয়ে দিয়ে তবে রঙ্গিনী নিশ্চিন্ত । বকনা বাছুর হয়েছে তাই রক্ষে । এঁড়ে হলে এত সহজে বাঁট ধরানো যেত না । এঁড়ে বাছুর বড় দেমাকি হয় । কথায় বলে -
এঁড়ে আসে তেড়ে
মাথার শিং দুটো নেড়ে নেড়ে ।
বাছুর জিভ দিয়ে চুকচুক করে দুধ টানছে - আর কিছুক্ষণ পর পর মুখ দিয়ে এক একটা গুঁতো মারছে বাঁটে । রঙ্গিনী বলছে মুনিয়াকে - বুঝলে, এরকম করে দুধ নামাচ্ছে ।
মুনিয়া অবাক হয়ে বাছুরের কাণ্ড দেখে আর মায়ের দিকে তাকায় । হঠাৎ কখনও মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে । বুকে মুখ গুঁজে চুপি চুপি মায়ের আঁচল সরাতে থাকে ।
মা মুনিয়ার গালে মিষ্টি চড় দিয়ে বলে, ছি মুনিয়া, তুমি এখন বড় হয়েছে । ও তোমার কাণ্ড দেখলে হাসবে যে ।
কে হাসবে মা
মঙ্গলচণ্ডী ।
মঙ্গলচণ্ডী কে মা ?
তোমার বোন - এই যে নুতন বাছুর ।
কেন ওর এমন নাম রাখলে মা
এ যে মঙ্গলবার দিন জন্মেছে ।
মুনিয়া মঙ্গলচণ্ডিকে মুংলি বলে ডাকতে লাগল ।
রঙ্গিনী ছেলের দিকে তাকিয়ে দেখে ভোলাটা ওর পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়ছে । বলে তাই হেসে হেসে মুনিয়াকে, কি হবে মুংলিকে দিয়ে মালাটা দে না ভোলার গলায়, দ্যাখ না, ভোলা মালা পাবার জন্য কেমন আহ্লাদে লেজ নাড়ছে । তোকে ভোলা কত ভালোবাসে, আর তুই ওকে দুচোখে দেখতে পারিসনে ।
মুনিয়া মায়ের কথায় তেড়েমেড়ে ওঠে । পা ছুঁড়তে থাকে ভোলা কুকুরটার দিকে । কাঁচুমাচু হয়ে ভোলা সটান শুয়ে পড়ে মাটিতে । মুনিয়া মালাটা দিয়েই ওকে মারতে শুরু করে ।
মা বলে, বোকা ছেলে, মালাটা না ছিঁড়ে যাবে ।
মুংলি এসে হঠাৎ মুনিয়ার উপর হোঁচট খেয়ে পড়ল । মুনিয়া ধরতে চাইল মুংলিকে, পারল না । কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, দেখলে মা, মুংলি কেমন আমায় গুঁতো মেরে গেল ।
মা বলল, তুই বুঝতে পারিসনি । এতো মুংলি তোকে আদর জানালো ।
মুংলিকে ধরতে মুনিয়া আবার ছুটল মরিয়া হয়ে । মুংলি ছোটে - তো মুনিয়াও ছোটে । মুংলি একটু দাঁড়িয়ে মুখ নাডে .- যেন মুনিয়াকে কি সব ঠাট্টা করে । মুনিয়া রেগেমেগে ধরতে চায় হাত বাড়িয়ে । মুংলি আবার ছুটে ।
মুংলি বাড়ির সীমানা ছাড়িয়ে হঠাৎ পড়ল গিয়ে খালের জলে । পড়লো-তো পড়লই, আর উঠে আসছে না । মুনিয়া এমন জোরে চিত্কার করল যে নাগিনা ও রঙ্গিনী পাগলের মতো ঘর থেকে বেরল ।
খালে পাঁক জমেছে । তাতে কচুরিপানা গিজগিজ করছে । মুংলি পাঁকে সেঁধিয়ে যাচ্ছিল । মুনিয়া লাফিয়ে পড়ল জলে কাদায়, মুংলির পিছনে মুনিয়াও যায় আরকি ! ভাগ্যিস নাগিনা ছিল কাছে, তাই যে করে হোক দুটোকেই সে তুলে আনলো ।
রঙ্গিনী দুহাতে ধরলো দুটোকে । মুনিয়ার গা মাথা মুছিয়ে দিয়েই মুংলির কানে বার বার ফঁংউ দিতে লাগলো, জল কানে ঢুকলে বাছুর বাঁচবে না যে ।
মুনিয়ার সেই থেকে ভয় - মুংলি এসে আবার যদি খালের জলে পড়ে যায় । মুংলিকে আটকাবার জন্য সে খালের পারে বেড়া দিতে লেগে গেল সেদিনই । আম, জাম, পিটোলি, কুল নানা গাছের হাতে নাগাল-পাওয়া ডাল ভেঙে নিয়ে এসে জমা করতে লাগল খালের ধারে । নাগিনা ছেলের কাণ্ড দেখে মনে মনে হাসে ।
মুনিয়াও তো এখানেই জন্মাল । সেও আজ পাঁচবছর হয়েছে । তারপর দেবতাকে কত ডাকল রঙ্গিনী, কিন্তু একটা মেয়ে আর কোলে পেলো না । খালের ওপারে মুসলমান বসতি । একটা ছোট্ট মেয়ে হঠাৎ হঠাৎ বেরিয়ে আসে একপাল মুরগীর পিছু পিছু, রঙ্গিনীর বুকটা কেমন করে ওঠে । ইচ্ছে হয় ছুটে গিয়ে মেয়েটাকে কোলে টেনে তোলে । কিন্তু সেটি হয়ে ওঠে না । অথচ ভাইএর বোন না থাকলে সংসার কিরকম খালি খালি লাগে । রঙ্গিনীর সব সময় একটা অভাব অভাব মন । তেল নুন ডাল চালের অভাব-তো আছেই, মনের অভাব মানুষের তার চেয়েও মারাত্বক সে কথা রঙ্গিনীর মতো কেউ বুঝি জানে না ।
মাঝে মাঝে রঙ্গিনী চুপচাপ বসে থাকে, কি যেন ভাবে । সে যেন দেখতে পায় তার মা মাসিরা শেওড়া গাছে ঢেলা বেঁধে কামনা করছে - যদি ছেলে হয়, যদি মেয়ে কোলে আসে তাহলে দেবতাদের পাঁচপোয়া সরুচাল পাঁচটা কলা আর পাঁচপয়সার বাতাসা কিনে ভোগ দেবে । ভাবতে ভাবতেই তার মনে পড়ে যায় এই সেদিনের কথা, মুনিয়ার জন্য কি কি সাধ্য সাধনা করতে হয়েছে । কিন্তু মনটা আবার এগিয়ে যায় রঙ্গিনীর, আবার নূতন শিশু চাই -সে হবে মুনিয়ার বোন, মনে মনে নামটাও ঠিক করে রাখে- মুন্নি ।
বাড়ির পিছনের সেই ঢিবিটাতে তালগাছগুলোর পাশেই একটা পুরনো শেওড়াগাছও খুঁজে বের করল রঙ্গিনী । খুব চুপি চুপি এক শনিবারের সন্ধেবেলায় ঢিল বেঁধে রেখে এল পাছে । এখন অপেক্ষায় আছে মেয়ে কোলে আসে কবে ।
নাগিনাও রঙ্গিনীর মন জানে । সেও মাঝে মাঝে আকাশের দিকে তাকিয়ে জোড়হাত করে কি যেন বলে, ঠোঁট নড়তে দেখা যায় কিন্তু শোনা যায় না কোনো কথা । রঙ্গিনী লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে আর মনে মনে খুশি হয় ।
মেয়ে তবু আসে না কোলে । নাগিনা রঙ্গিনীর অন্যমনস্কতা লক্ষ করে, বুঝতে পারে শুধু মুনিয়াকে নিয়েই সে তৃপ্ত নয় । মুনিয়া আর এখন ঠিক সেই কোলেরটি নেই তো । নাগিনা অনেক খুঁজে পেতে কোথা থেকে একটা বিড়ালছানা নিয়ে এসে চুপি চুপি ছেড়ে দিল রঙ্গিনীর রান্নাঘরে ।
হঠাৎ মিউ মিউ রব শুনে রঙ্গিনী ছুটে গেল । ভারি সুন্দর দেখতে যেন চাঁদের বুড়ির এক ফঁংউ থেকে বেরিয়ে এসেছে এই তুলতুলে বেড়ালছানাটা । দেখলেই ওকে ঠোঁট মুখ মাখিয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে করে । রঙ্গিনীর বুকের ব্যাথা কিছুটা আরাম হল এই নূতন সঙ্গীটি পেয়ে ।
মুনিয়া মায়ের দুধ ছেড়েই দিয়েছিল । মিনিটা ওর মায়ের দুধ চুষছে দেখতে পেয়ে ওর বুঝি হিংসে হল । তাই সে ভীষণ হয়ে উঠল । মিনিতে মুনিয়াতে রঙ্গিনীর বুক নিয়ে লাগলো কাড়াকাড়ি । রঙ্গিনী কাউকেই বিমুখ করতে চায় না । দুটি দুধ দুজনের মুখে তুলে দিয়ে চুপচাপ বসে থাকে । আরামে দুচোখ বুজে আসে তার । হঠাৎ চোখ ছেড়ে গেলে তাকিয়ে দেখে মিনি আর মুনিয়া দুটোই ঘুমিয়ে পড়েছে । মিনির পিঠে এক আর মুনিয়ার পিঠে আরেক হাত রেখে রঙ্গিনী বলে, পিঠোপিঠি ভাইবোন ঠিক এমনি কাড়াকাড়ি মারামারি করে আর কাছাকাছি থাকে ।
নাগিনা দূর থেকে দেখে আর মনে মনে হাসে । যেন একটা সমস্যার সমাধান হয়েছে ওর । দুহাত জোড় করে আকাশের দিকে তাকিয়ে কি যেন বলে, তার হৃদয়দেবতা ছাড়া সে-কথা আর কেউ শুনতে পায় না ।
রঙ্গিনীর মাথাটা নুয়ে নুয়ে হঠাৎ কখন মাটিতে ঠেকে গিয়ে । ধড়মড়িয়ে উঠে চোখ মেলে তাকায় আর লজ্জা পেয়ে ঘোমটাটা টেনে একটু বাড়িয়ে দেয় ।
মুনিয়া চুপি চুপি মিনিটাকে ঘাড়ে ধরে তুলে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেয় । রঙ্গিনী হায় হায় করে ওঠে । গুম গুম করে দুটো কিল বসিয়ে দেয় মুনিয়ার পিঠে । মুনিয়া শুকনো চোখ মুছতে মুছতে ছুটে যায় মুংলির কাছে । মুংলি এখন ঘরের ভিতর বন্ধ, ওকে জড়িয়ে মুনিয়া বসে থাকে আর একা একা আপন মনে কত কি বলে চলে ।
নাগিনা দেখতে পায় সে দৃশ্য । চুপি চুপি রঙ্গিনীকে বলে, ভাগ্যিস, পুনিকে পেয়েছিলাম । ভাগ্যে মুংলি এল, তবে-ত মুনিয়া পেল ওর খেলার সাথী । না-হলে কি-যে মুশকিলই হত আমাদের ।
রঙ্গিনী বলে, দেখো না, মিনির সঙ্গে যেন ওর আদায় কাঁচকলায় । মিনিটাকে দুচোখে দেখতে পারে না তোমার মুনিয়া ।
এসব কথা উঠলেই কাজকর্ম থেকে মন সরে যায় নাগিনার । পিছনের দিনগুলিতে কখন যে ফিরে যায় নিজেই তা বুঝতে পারে না । ছবির মতো ভেসে ওঠে সেই একটা স্মরণীয় দিন, বিকেলবেলা লাঠি কাঁধে নিয়ে ছুরি দুটো কোমরে গুঁজে শিকারে বেরিয়েছে সে । গাঁয়ের চার ধারের গোপাট তন্ন তন্ন করে খুঁজছে - একটাও জোটেনি । নিরাশ হয়ে বাড়ি ফিরছে এমন সময় দেখে একটা গাই খালের ধারে পড়ে ছটফট করছে । ওর পেট থেকে বাছুর বের করে না নিলে গাছ-গুটা দুই-ই যাবে । ধাত্রীবিদ্যা জানা ছিল নাগিনার । একটু বেগ অবশ্য পেতে হল, তবু বাছুরটা তো বাঁচল । গাইএর মালিক এসে বলল, তুমি প্রসব করালে, এ বাছুর তোমার, আমি এমন মা-মরা বাচ্চা পুষব কি দিয়ে । মায়ের চামড়া কাঁধে আর তারই বাচ্চা কোলে নিয়ে নাগিনা ফিরল ঘরে ।
রঙ্গিনী সে বাছুরটা পেয়ে কি খুশিই হয়েছিল । কিন্তু দুশ্চিন্তাও বেড়েছিল তার - এমন শিশুকে খাইয়ে বাঁচাবে, এর পেট যে মিনির চেয়ে মুনিয়ার চেয়ে অনেক বড়ো ।
মুনিয়া মায়ের বুকের সব দুধ খেতে পারত না । বাছুরটা তার ভাগ পেতে লাগল । অভাবের সংসার নাগিনার । রঙ্গিনী তাই একদিন বলল নাগিনাকে, বাজার থেকে আর দুধ কিনে কাজ কি, আমার বুকের দুধেই আমি এদের দুজনকে পুষতে পারব । তারপর ঘাসে না ধরা অবধি বাছুর মুনিয়ার মায়ের দুধই খেয়েছে । সবাই এখনও সেকথা নিয়ে গল্প করে । কেউ বিশ্বাস করে, কেউ ঠাট্টা করে ।
সেই বাছুরটা যেদিন এসেছিল নাগিনার বাড়ি - সে ছিল এক রাসপূর্ণিমা । রঙ্গিনী অবাক হয়ে ভাবে - মানুষদের বড় হতে এত দেরি হয় কেন?
মুনিয়াও আগের চেয়ে বড় হয়েছে নিশ্চয় । এখনতো সে আর যখন খুশি মাকে এসে বিরক্ত করে না । একটানা অনেকক্ষণ কাজে বসে থাকতে পারে নাগিনাও । এখন আর তার কাজের ঘরে ঢুকে মুনিয়া এটা ওটা ধরে টানাটানি করেনা, হাজার কথা বলে বলে নাগিনার ধৈর্যচ্যুতিও ঘটায় না ।
রঙ্গিনীও এখন একটু নিশ্চিন্তমনে থাকতে পায় রান্নাঘরে । আগে এটি হবার জো ছিল না । হয়ত নুন লংকা তেল হলুদ এটা ওটা চারিদিকে সাজিয়ে নিয়ে বসেছে রান্না করতে, হঠাৎ ঝোড়ো হাওয়ার মতো মুনিয়া ঢুকল ঘরে আর দিল সব ফেলে ছড়িয়ে একাকার করে । তৈরি তরকারিতে জল ঢেলে, হাঁড়িতে বালি ছেড়ে, উনুনের আগুন নিবিয়ে দিয়ে সব লণ্ডভণ্ড করত এই মুনিয়া । নাগিনা এজন্য ছেলেকে কিছুই বলত না । গালমন্দ করত রঙ্গিনীকেই । ভাতের গ্রাস মুখে তুলে দাঁতে বালি লাগলে উঠে পড়ত পাত থেকে । কি রকম হঠাতি যেন ক্ষেপে উঠত শান্তশিষ্ট মানুষটা - এঁটো হাতে কিল জুড়ত গিয়ে রঙ্গিনীর পিঠে, বলত, একটা বাচ্চাকে তুই সামলে রাখতে পারিসনে ? লোকে তো চারটে ছটা ছেলে পিলেও মানুষ করে ।
রঙ্গিনী ভোলেনি সেসব দিনের স্মৃতি । বড় ভীষণ দু:খের সেই কালো মুহূর্তগুলি আজ মনের মধ্যে এক আকাশ তারার মতো জ্বল জ্বল করে । হঠাৎ নাগিনাকে আবেগে বলে ওঠে, সত্যি মঙ্গলচণ্ডী এল আমাদের ঘরে, ওর জন্য তৈরি করলাম এই কড়িহার এক ছড়া - দেখো ।
একটা চামড়ার বেল্ট-এর ওপর বড় বড় কড়ি সারবন্দী করে বসিয়ে সুন্দর করে মালার মতো গেঁথেছে রঙ্গিনী । নাগিনা দেখে অবাক হয়ে বলে, এই মালাটা যদি আমার গলায় কেউ পরিয়ে দিতো ।
নাগিনা কোনো কোনো দিন রঙ্গিনীর পাশে বসে এ দৃশ্য দেখতে পায় । দেখতে দেখতে মনে হয় মুনিয়ার কথা । ছেলেটা সারাদিন আছে মুংলিকে নিয়ে মেতে । হঠাৎ তার দুচোখের কোণে জল ছাপিয়ে ওঠে, একটা দু:খের কথা মনে পড়ে - মুনিয়া এ-সব দই দুধের কোনোটাই পাতে নেয় না ।
এইটুক্কুনি ছেলের মনে কি জানি ঢুকেছে । পীড়াপীড়ি করলে সে বলে, মুংলির মায়ের দুধ মুংলি খাবে শুধু, আমি তাতে ভাগ বসাতে যাবো কেন ?
রঙ্গিনী কতদিন মুনিয়াকে ধরে এনে বুকে চাপিয়ে রেখে সোহাগ করে বলেছে, বাপ আমার, সোনা আমার, লক্ষ্মীঠাকুর, মানিক, তোমার জন্য গাই পুষলাম আর তুমিই মুখে নেবে না এর দুধ । কতদিন ঘোল ছেঁকে মাখন তুলে টাটকা মুনিয়ার মুখের কাছে নিয়ে গিয়েছে সে আদর করে, মুনিয়া ওয়াক শব্দ তুলে ঘেন্নার ভাব দেখিয়ে ছুটে পালিয়েছে । রঙ্গিনীর বুক দু:খে ভেঙে গিয়েছে কতবার । এমন যে ভগবান কৃষ্ণ, তিনিও তো মা যশোদার হাতে কত দলা দলা মাখন খেয়েছেন মাখন তাঁর বড় প্রিয় ছিল । কতদিন মাখনের ভাণ্ড ভেঙে দিয়ে পালিয়েছেন । কৃষ্ণলীলার গান কুনকুনিয়ে গায় রঙ্গিনী ।
হাতে বাড়ি নন্দরানী চলছে ধেয়ে ধেয়ে
লম্ফ দিয়ে ওঠে কৃষ্ণ কদম্ব ডাল বেয়ে ।
গাইতে গাইতে তার চোখ ছলছলিয়ে ওঠে । কতদিন সেই বোষ্টমী ঠাকরুণটা আসে না ভিক্ষে করতে । বোষ্টমীর কাছেইতো গান শেখা রঙ্গিনীর, আর কৃষ্ণলীলার আগাগোড়া সকল কাহিনী শোনা । বোষ্টমী সত্যি এক আশ্চর্য মানুষ । সংসারে কোনো লোকই বোষ্টমীর পর নয় । জাতিতে মুচি তাই নাগিনার বাড়ি গ্রামের এক প্রান্তে । বাকি গ্রামবাসীর সঙ্গে সকল রকমের স্পর্শের সংস্রবশূন্য এই পরিবার । যাতায়াত করে লোকে নেহাৎ নিজেদের চটি, চপ্পল, ঢাক, ঢোল, খোল মেরামত করার দায়ে পড়ে । কিন্তু বোষ্টমীর সে দায় নেই । অন্য সবাই যেমন স্পর্শ বাঁচিয়ে চলে, বোষ্টমীর তা নয় । রঙ্গিনী তাকে চাল ডাল যা দেয় - সবই বোষ্টমী খুশি হয়ে নিয়ে যায় । সুবচনী ওয়ালাও তাই । তবে সুবচনীর ভয়েই রঙ্গিনী ওই লোকটাকেও খাতির করে । ওর গানটা বোষ্টমীর গানের মতো অতো ভালো নয় । বোষ্টমীর ঐ একটাই গান নয়, কৃষ্ণের জন্ম থেকে আরম্ভ করে দ্বারকায় রাজা হওয়া পর্যন্ত নানা সময়ের বহু গান বোষ্টমী তাকে শুনিয়েছে । বোষ্টমীর কাছে শেখা সেই কৃষ্ণের কত গপ্পই রঙ্গিনী মুনিয়াকে শুনিয়েছে, কিন্তু এখন আর ছেলেটা মোটে কাছেই আসতে চায় না । এখন কৃষ্ণ যশোদার কথা তুললেই সেই ছেলে বলে, তোমার বুকের দুধ তুমি আমাকে না-দিয়ে, দিয়েছিলে কখনো আর কাউকে, বলো ! রঙ্গিনী উল্লসিত হয়ে বলে, দিয়েছিলাম বৈকি পুনির ভাগ্যে কি ওর নিজের মায়ের দুধ জুটেছিল এক ফোঁটা ! পুনি তো তোমার সঙ্গে সঙ্গেই আমার বুক চুষেছে ।
মুনিয়া হি হি করে হাসতে থাকে
রঙ্গিনী বলে, হাসছিস যে । মিনির মতো আমার বুকে মুংলি মুখ অবশ্য লাগায়নি, কিন্তু দুধ সে খেয়েছে-ত !
মুনিয়া অবাক হয়েই শুধায়, সত্যি বলছ মা ?
রঙ্গিনী জানালো যে সন্তানের কাছে মা যদি কখনও মিথ্যে কথা বলে তাহলে সন্তানও মিথ্যেবাদী হয় । আর বলল সে, অত ছোটবেলাকার কথা তোমার কিছুই মনে নেই বাছা ।
মুনিয়া চুপ করে থেকে কিছুক্ষণ কি ভাবল, তারপর হঠাৎ বলল, আচ্ছা মা, পুনি যদি আমার একই সঙ্গে বড় হল, তাহলে পুনি অত বুড়ো হয়েছে কেন ?
রঙ্গিনী বলল, বুড়ো হয়নি, বড় হয়েছে বলো ।
কেন বড় হল, কেমন করে বড় হল, তুমি আমাকে কম দিয়ে ওকে বেশি দুধ খাইয়েছিলে ?
রঙ্গিনী হাসতে হাসতে বলে, হয়ত তাই । ওর পেটটা দেখচ না কত বড় । তোমার মতো দুচুমুকে তো ভরে না ওটা । বলেই রঙ্গিনী ভাবল, ছেলের প্রশ্নটা সহজ নয় । উত্তর কি এমন সহজ ভাষায় দেওয়া যায় ? তবু ছেলেভুলানো কথা দুটো বলতে হয় তাই বলা । কিন্তু ছেলে যদি আবার প্রশ্নটা তোলে । ভাবনায় পড়ল রঙ্গিনী । এমন সময় গোয়ালঘর থেকে ডাক এল "মুনিয়া .... মুনিয়ারে .......
নাগিনা ডাকছে । গাই দুইতে গিয়েছে । বাছুরটাকে ধরতে হবে একটু । মুনিয়ার এ-কাজটাতে মোটে ইচ্ছে নেই । তবু বাপের কথা না শুনলে মুশকিল । কাজেই যেতে হল । আগে থেকেই নাগিনা চটে আছে । গালমন্দ শুরু করেছে - পাজি, নচ্ছার গাই, দিনরাত তোমাকে শুধু খাওয়াই আর খাওয়াই, আর তুমি তোমার বাচ্চাকে তাজা করো দুধচুরি করে রেখে - চোর নয়, ডাকাত তুমি, ডাকাত ।
মুনিয়া অবাক হয়ে ভাবে, গাই আবার চোর - ডাকাত ।
নাগিনা বলে ছেলেকে সাক্ষী করে দ্যাখ না, আমি দুইতে এলেই বাঁটের দুধ সব বুকে তুলে নেয় । মুংলি এসে যেমনি মুখ দেবে, তখন ধীরে ধীরে দুধ নামাবে, চুক চুক করে দুধ খাবে সেই দুষ্টু বাছুর - ফেনা বেয়ে পড়বে দুদিকের মাড়ির ফাঁকে ফাঁকে । এত দুধ একলা খেতে পায় বলেই তো বাছুরটার ঘাসে মোটে রুচি নেই । বলতে বলতে পুনির দুগালে দুটো চড বসিয়ে দিল নাগিনা । কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল ত্রক্রুদ্ধ দৃষ্টি দিয়ে ।
[ক্রমশ:]