• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩০ | মে ২০০৩ | গল্প
    Share
  • আত্মজা : সাবর্ণি চক্রবর্তী

    [। ১ ।]

    বাসটার ড্রাইভারের কেবিনের গা বরাবর লম্বা সীটটা মহিলাদের জন্যে সংরক্ষিত । রোগা, মোটা মিলিয়ে জন ছয়েক মহিলা চাপাচুপি করে বসে যেতে পারেন । সেই সীটের ওপর শুয়ে নাক ডাকাচ্ছিল তপা । বাসটার নম্বর সাতশো আটষট্টি । বেসরকারি বাস । তপা চালায় । এই সীটটা ওর দৈর্ঘের সঙ্গে মানানসই । ও দিব্যি পা টানটান করে শুতে পারে ।

    বাসের সামনের দরজা দিয়ে জগা ভেতরে ঢুকে এল । তপার গায়ে জোরে ধাক্কা দিল - এই এই তপা, উঠে পড় গুরু । প্রথমে আমাদের টিপ । আটটায় বাস ছাড়তে হবে ।

    ঘুম ভেঙে চোখ না খুলেই বিরক্তিতে মুখ বাঁকাচ্ছিল তপা । জগা আর ওর দিকে তাকাল না । সীটের মাথার ওপরে ছোটো একটা র্যাকের মতো আছে । সেখানে ওর চামড়ার ব্যাগ, বাসের টিকিট, এসব থাকে । ও ব্যাগ, টিকিট নিয়ে ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বাস থেকে নেমে গেল ।

    বাসের দুই দরজায় দুজন কণ্ডাক্টার । সামনের গেটে সাধারণত জল থাকে । জগা অর্থাৎ জগন্নাথ । পেছনের গেটে হারাধন - সবাই ডাকে হারু । একটা বছর কুড়ির ক্লিনারও আছে । ওর নাম নান্টু । এখনো রোজ গোঁফ কামাবার দরকার পড়ে না । ও বাসের দরজার হ্যাণ্ডেল ধরে ঝোলে - কখনো সামনে, কখনো বা পেছনের দরজায় ।

    উঠে বসে দুহাত ওপরে তুলে আড়মোড়া ভাঙল তপা । ঘুমের সময় মুখ থেকে বেরনো লালা ঠোঁটের কষে জমে আছে । ডান হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে তা মুছে নিল । ঝাঁকড়া রুক্ষ চুলের ভেতর দু'হাতের দশ আঙুল ঢুকিয়ে ঘ্যাস ঘ্যাস করে চুলকোল খানিকক্ষণ । শালা এত চুলকোয় - মাথায় উকুন-টুকুন হোল কিনা কে জানে । উকুন হয়ে থাকলে নির্ঘাৎ মানদার চুলের থেকে এসেছে । মেয়েমানুষটার বিরাট চুল । উকুনের বাসা থাকতেই পারে ।

    সীটের পাশে খুলে রাখা চটিজোড়া পায়ে গলিয়ে পরে নিল তপা । তারপর বাস থেকে নামল । জগার কথা ওর কানে গিয়েছে । স্টার্টার নিমাইটা অতি হারামি । একটু দেরি হলেই ফাইন করে দেবে ।

    দুটো রুটের বাস এ-জায়গাটা থেকে ছাড়ে । যায় অনেক দূর । প্রায় কুড়ি পঁচিশ কিলোমিটারের লম্বা পাড়ি । যে সব বাসগুলো সকালে এদিক থেকে ছাড়ে সেগুলো ফিরে রাতে এখানেই থাকে । রাস্তার দু'পাশ জুড়ে বাসের লম্বা লাইন । গোটা পনের কুড়ি বাস তো থাকেই । দু'সারি বাসের মাঝখানে যে জায়গাটুকু পড়ে থাকে তা দিয়ে কোনমতে দুটো গাড়ি পাশাপাশি চলতে পারে । একবার সরকারি আইন কড়াকড়ি শুরু করেছিল । হুকুম এল রাস্তায় এভাবে বাস রেখে দেওয়া চলবে না । তা হুকুম করলেই তো আর হয় না । বাসগুলো তাহলে যাবে কোথায় ? অফিস টাইমে বড় রাস্তার ওপর এদিক ওদিক করে বাস ফেলে রেখে প্রতিবাদ করা হোল । সারা রাস্তায় জ্যাম, লোকের চেঁচামেচি - খবরের কাগজে লেখালেখি । বেগতিক দেখে প্রশাসন চুপচাপ এই ফতোয়ার কথা ভুলে গেল । যা ব্যবস্থা ছিল তাই চালু রইল ।

    রাস্তার একপাশে খানিকটা জায়গা একটু উঁচু করা । ঠিক ফুটপাথ বলা যাবে না । কারণ জায়গাটা শান বাঁধানো হয়নি । সেখানে হরনাথের চালা । মাটিতে চারটে বড় বড় বাঁশ পোঁতা । সেই বাঁশের ওপর একটা মোটা ত্রিপল টানটান করে খাটিয়ে মোটা শক্ত নারকেল ছোবড়ার দড়ি দিয়ে মজবুত করে বাঁধা । এই চালাটার একটা দিক একটা বড় খালি জমির পাশের উঁচু লম্বা টানা দেয়াল দিয়ে আটকানো । অন্য তিনটে দিক এখন গরমকাল বলে খালি । বর্ষার সময়টায় এই তিনটে দিকও ত্রিপল দিয়ে ঢাকতে হয় হরনাথকে । চালার নিচে তিনটে পাকাপোক্ত উনুন - ইঁট সাজিয়ে তৈরি । জ্বালানি কয়লা আর কাঠ । একটার ওপর গরম তাওয়ায় রুটি সেঁকছে বীণা - হরনাথের মেয়ে । আর একটাতে পাঁচ নম্বর সাইজের একটা কড়াতে টগবগ করে ফুটছে ডুমো ডুমো করে কাটা খোসা ছাড়ানো আলু আর পটল । প্রচুর পরিমাণে পেঁয়াজের কুচি আর লঙ্কাবাটা ঢালা হয়েছে তাতে । পরের উনুনটা চেহারায় ছোটো - তাতে বড় মাপের কেটলিতে চায়ের জল সমানে ফুটছে । কেটলির তলাটা পুড়ে গিয়ে একেবারে কুচকুচে কালো । হরনাথের বউটা মাঝবয়েসী - মোটাসোটা গাব্দাগোব্দা চেহারা । ওর দুটো হাতে সাদা, লাল, কালো বিভিন্ন রঙের সূতো দিয়ে বাঁধা নানা সাইজের মাদুলি । সেই দুই হাতে সমানতালে কাজ করে যায় হরনাথের গিন্নী । খুন্তি নাড়ে আর লঙ্কাবাটার লালে লালচে হলদে ঘন ঝোলের আলু পটলের তরকারি তৈরি হয়ে ওঠে - শালপাতায় ঢেলে পরিবেশন করলেই হল । বীণার রোগা লম্বাটে চেহারা - গাল দুটো বসা - গায়ের রঙ কুচকুচে না হলেও বেশ কালো । ওর ডান হাতে খুন্তি, বাঁ হাতে সাঁড়াশি । খুন্তি দিয়ে রুটি তাওয়াতে এপিঠ ওপিঠ সেঁকে নিয়ে বাঁ হাতের সাঁড়াশি দিয়ে চট করে তাওয়াটা সরিয়ে ফেলে গনগনে আঁচে খুন্তির ওপর রুটি ধরে - চমত্কার ফুলে ওঠে রুটি । সেই ফুলকো রুটি খুন্তির ওপর থেকেই ওর ডান দিকে রাখা একটা বড় বাসনের ভেতর ছুঁড়ে দেয় - সঙ্গে সঙ্গে বাঁ হাতের সাঁড়াশি দিয়ে তাওয়াটা আবার উনুনের ওপর বসিয়ে দিয়ে বেলে রাখা কাঁচা রুটির ডাঁই থেকে ওপরেরটা খুন্তি দিয়ে তুলে তাওয়ায় চাপিয়ে দেয় ।

    তপা বাস থেকে নেমে এসে বীণার কাজ দেখছিল, ওর মুখের দিকেও তাকাচ্ছিল । বীণাকে দেখতে খুব একটা সুবিধের না হলেও ওকে তপার বেশ ভাল লাগে । মাঝে মাঝে ফষ্টিনষ্টি করার চেষ্টা করে দেখেছে । সুবিধে হয় না । জবাব দেওয়া তো দূরের কথা, বিশেষ তাকিয়েও দেখে না তপার দিকে । কি যে এত কাজ করে মেয়েটা । দু বছর এই লাইনে বাস চালাচ্ছে তপা । মাঝে মাঝে রাতে এখানেই বাসে শুয়ে থাকে । তাতে করে ওদের অনেকদিন ধরে দেখছে । হরনাথের তো এখন একটাই সন্তান - এই মেয়ে । আদতে হরনাথ পূব বাঙলার লোক । আগে বনগাঁ না বসিরহাট কোথায় একটা থাকত । দেশে বান হবার পর এসে ঘাঁটি গাড়ল কলকাতার ফুটপাথে । এখন এই দোকান । দিব্যি চলছে । এই সব বাসের ড্রাইভার, কণ্ডাক্টর, ক্লীনার সকালে কাজে বেরোবার আগে হরনাথের এই চালার নীচে তৈরি রুটি তরকারি খেয়ে বাস ছাড়বে । সেই সঙ্গে চা । একটা ছেলেও ছিল হরনাথের । বীণার দাদা । একটা দলের সঙ্গে ভিড়ে ডাকাতি করতে গিয়ে গ্রামের লোকের হাতে ধরা পড়ে গিয়েছিল । পুলিশের হাতে আর পড়তে হয়নি । লোকজনের হাতে পাইকারি মার খেয়েছিল - মারা গিয়েছিল সেখানেই ।

    বীণার দিকে এক পা এগিয়ে এল তপা । খোঁচা খোঁচা দাড়িতে ভর্তি মুখে একগাল হেসে বলল, তুই কি সোন্দর কাজ করিস রে বীণা । তোর হাত দুটো যে ঘোরে - একেবারে সার্কাসওয়ালিদের মতো ।

    বীণা তাকালই না ওর দিকে । ওর মা একবার মুখ তুলে কড়া চোখে চাইল ওর দিকে । তারপর মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে গরম কড়াইয়ের দুটো হাতল ধরে সবটা ঢেলে দিল মেঝেয় রাখা একটা বড় সসপ্যানে । তরকারিটা তৈরি হয়ে গেছে । তারপর ডাকল - ও বীণা, আর কটা আলু পটল কুটে দে দেখি । আমি ছাড়িয়ে নিচ্ছি ।

    ঘুম থেকে ওঠার পর মুখে থুতু জমে রয়েছে । পিচ করে দাঁতের ফাঁক দিয়ে থুতু ছুঁড়ে ফেলল তপা । হরনাথের দিকে সরে এসে বলল, দে বাবা হরনাথ - দুটো রুটি দে । জোর খিদে পেয়ে গেছে । আর তরকারি দিতে কিপ্টেমি করিস নে যেন ।

    চার পাঁচটা শালপাতা কাঠি দিয়ে জুড়ে বড় বড় থালা, তাতে রুটি সাজিয়ে দিল হরনাথ । রুটির ওপর চার টুকরো আলু, চার টুকরো পটল । রুটি পিছু দুটো করে টুকরো । দামের হিসেবে সব কিছু সে ভাবেই ঠিক করা আছে । কর্তা, গিন্নী আর মেয়ের মধ্যে হরনাথই কাজ করে সবচেয়ে কম । ও রুটি তরকারি পরিবেশন করে । চা বানায় - গেলাসে ঢেলে তা খদ্দেরের হাতে ধরিয়ে দেয় । একটা বড় ভাঙা প্ল্যাস্টিকের বালতিতে ডাঁই করে জমা হয় তরকারির খোসা, পেঁয়াজের খোসা । সে সব নিয়ে গিয়ে কাছের ডাস্টবিনটায় ফেলে আসে । বীণা বঁটিতে এর মধ্যেই বেশ কিছু আলু পটলের খোসা ছাড়িয়ে ফেলেছে । একটা বড় গামলায় রাখা জলে সেগুলো ডুবিয়ে ধুয়ে নিচ্ছে । ওর মা মাটিতে পিঁড়ি পেতে বসে একগাদা পেঁয়াজের খোসা ছাড়িয়েছে - এখন বাটবে বলে শিলের ওপর একমুঠো শুকনো লঙ্কা ছড়িয়েছে ।

    তপা সেখান থেকে সরে এল । তপা আর হারু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাচ্ছে । হরনাথের চালায় বসার কোন ব্যবস্থা নেই । ওর খদ্দেররা সবাই হয় রাস্তায় দাঁড়িয়ে খেয়ে নেয়, নয়তো বাসে উঠে সেখানে বসে খায় । নান্টু মাটিতে উবু হয়ে বসে বিড়ির ধোঁয়া ছাড়ছে । রাস্তার ওপাশে বড় হোর্ডিংএ সিনেমার নায়িকার সাঁতারের পোষাক পরা ছবি । খুব মন দিয়ে তা দেখছে । জগা পায়ের চটির ডগা দিয়ে ওর পাছায় খোঁচা দিল - কিরে ব্যাটা, অত হাঁ করে দেখছিস কি, এঁযা ? যা, নিমাইয়ের থেকে গাড়ি ছাড়বার টাইম লিখিয়ে নিয়ে আয় ।

    মুখ ব্যাজার করে উঠে দাঁড়াল নান্টু । তারপর পা ঘষে ঘষে নিমাইয়ের কাঠের খোপটার দিকে এগোল । হারু হি হি করে হাসে । জগাকে বলে - নান্টেটার বয়েস কম - দেখছিল বেশ । ওকে কাজে না পাঠালেই পারতিস ।

    প্রায় সাড়ে সাতটা বাজে । অন্যান্য বাসের লোকজনও এসে হরনাথের দোকানে ভিড় করতে শুরু করেছে । খাওয়া শেষ করল তপা । এঁটো শালপাতা ফেলার জন্যে হরনাথ একটা বড় অকেজো জলের ড্রাম রেখেছে । হাতের খালি শালপাতা সেখানে ফেলল । আঙুলে, হাতের পাতায় তরকারি ঝোল লেগে আছে - জিভ দিয়ে চেটে সাফ করে নিল । তারপর হরনাথের কাছ থেকে গেলাসে চা নিয়ে তাতে চুমুক দিতে লাগল ।

    চা শেষ করে খালি গেলাস ফিরিয়ে দিয়ে চা আর খাবারের দাম মিটিয়ে দিল তপা । দিয়েই ছুট মারল । একই চায়ের পাতা বারবার ফোটায় হরনাথ - সকালে সেই চা খেয়ে সঙ্গে সঙ্গে পেটে চাপ । কাছেই একটা সুলভ শৌচাগার আছে । মুখ ধোওয়া আর পেচ্ছাপ করা বিনে পয়সায় - বড় কাজটার জন্যে নগদ পঞ্চাশ পয়সা দিতে হয় । খুচরো না থাকলে অনেকদিন ঝামেলা হয় । যে ছেলেটা পয়সা আদায় করে সেটা ভারি বদমাশ । এক টাকা দিলে বলে খুচরো নেই । পেটের ভেতর পাক দিচ্ছে, তখন কি আর কখন ছেলেটার কাছে খুচরো হবে তার জন্যে অপেক্ষা করা যায় ? মাঝখান থেকে ছেলেটার পঞ্চাশ পয়সা লাভ হয়ে যায় ।

    আটটাতেই ওদের বাস ছাড়ল । বাস চলছে গড়িয়ে গড়িয়ে, প্রায় পা ঘষে ঘষে । তপার বাঁ হাত স্টিয়ারিং-এ, ডান হাত পাশের জানালা গলিয়ে বাইরে রেখেছে - তার দু আঙুলে জ্বলন্ত সিগারেট । তপা বিড়ি খায় না । বাস এখন প্রায় খালি - সারা বাসে পাঁচ ছ জন যাত্রী ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে । এখন বাস এরকম আস্তে আস্তে চলবে, আর রাস্তায় যাত্রী দেখলেই সেখানে থেমে পড়ে লোক তুলে নেবে । বাস যত ভর্তি হবে স্পীডও সেভাবে বাড়বে । তারপর যখন লোক বোঝাই হয়ে দরজা থেকে ঝুলতে থাকবে তখন তপা নিজের সীটে সোজা হয়ে বসে অ্যাক্সিলারেটর চাপবে - হৈ হৈ করে বাস ছুটবে । এভাবে না চালালে বেশি করে যাত্রী তোলা যায় না - আর বাসে যদি লোকই না ওঠে তবে পয়সা রোজগার হবে কি করে ? মালিকের সঙ্গে ঠিক করাই আছে - বাস যে-কদিন বেরোবে, মালিককে দিনপিছু চারশো টাকা করে দিতে হবে । মালিকের খরচা বলতে খালি মেরামতির । বাকি সব তপা জগাদের । এভাবে না চালালে আর একটা অসুবিধে আছে । রুটের জায়গায় জায়গায় টাইম-কীপার রয়েছে । সেসব জায়াগায় পৌঁছতে দেরি হলে ফাইন করে দেবে ।

    রাস্তার মাঝখানটা জুড়ে বাস চালাচ্ছে তপা । পেছনে একটা মারুতি গাড়ি । বাসটাকে ওভারটেক করার চেষ্টা করছে । কিন্তু বেরিয়ে যেতে পারছে না । রাস্তার ওদিক থেকে গাড়ি, বাস এসব সমানে আসছে । রাস্তা না পেয়ে হর্ন দিচ্ছে গাড়িটা । তপা বাসের ডানদিকে লাগানো রিয়ার ভিউ মিররে গাড়িটা দেখতে পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু জায়গা ছাড়ছে না । ভারি তো পুঁচকে একটা প্রাইভেট গাড়ি, তাকে আবার রাস্তা ছাড়বে কী ? এর পর তপা যখন ওর বাসকে ঘোড়দৌড় করাবে তখন এ সব গাড়ির পেছনে গিয়ে জোরে হর্ন বাজাবে - ভয়ে রাস্তার বাঁদিকে সরে যাবে এসব গাড়ি । এ সব ছোটো গাড়িকে ওভারটেক করার সময় তপা ওদের আবার একটু বাঁয়ে চেপে দেয় । ছোটো গাড়িটা স্পীড কমিয়ে বাঁদিকে সরতে থাকে আর নান্টু বাসের পাদানিতে ঝুলতে ঝুলতে চেঁচিয়ে ওই গাড়ির ড্রাইভারকে ধমক দেয় - হেই, হেই প্রাইভেট, হেই ।

    ড্রাইভিং লাইসেন্সে তপার নাম লেখা আছে তপন মণ্ডল । দুটো লাইসেন্স করানো আছে । একটা কলকাতার । অন্যটা বিহারের । কোন কারণে পুলিশ যদি একটা নিয়ে নেয় অন্যটা দিয়ে কাজ চালাবে ।

    ঝামেলা হয়েছিল বাপের নাম লেখা নিয়ে । লাইসেন্সের দালাল জিগ্যেস করে, বাপের নাম কি ? তপা জানে থোড়ি । জ্ঞান হয়ে থেকে খালি মাকেই দেখেছে । মা বলে দিল, তোর বাপের নাম ছিল গনেশ । গনেশ কি ? আরে লিখে দাও কিছু একটা - লেখ গনেশ মণ্ডল । সেই থেকে তপা হচ্ছে তপন মণ্ডল ।

    মা যখন মারা গেল তখন তপা বাস চালাতে শুরু করেছে । সারা জীবন বাবুদের বাড়িতে কাজ করেছে ওর মা । এমনিতেই রোগা শরীর ছিল । মারা যাবার আগে শুকিয়ে কাঠি হয়ে গিয়েছিল । হয়েছিল কালরোগ । মুখ দিয়ে যখন রক্ত উঠতে শুরু করল তখন তপা সরকারি হাসপাতালে দিয়েছিল । সেখানে ছিল প্রায় একমাস । তারপর টেঁসে গেল । মাকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার সময় জগা, হারু, নান্টু এরা সবাই খাটিয়াতে কাঁধ দিয়েছে । সেদিন ওদের বাস রাস্তায় বেরোয়নি । মালিক একটু মুখ ব্যাজার করেছিল - কিন্তু সেদিনকার টাকাটা শেষ পর্যন্ত নেয়নি ।

    সুমতি এসে তপার খালি ঘর ভরিয়েছিল । অনেকটা মায়ের মতোই চেহারা - সেরকম রোগা, ছোটোখাটো । কিন্তু রাগলে ভয়ঙ্করী । সুমতি যখন বেঁচিয়ে ঝগড়া করে তখন তপা ওকে কুমতি বলে ডাকে । আর যখন বউ ঝাঁটা, খুন্তি এসব ছুঁড়ে মারে তখন ওর চুলের মুঠি ধরে । কিন্তু চড়টা, ঘুষিটা, খুব জোরে বসাতে পারে না । ওগুলো বউ এর ঘাড়ে, মাথায়, গালে একটু আস্তেই নামে । বউটা যে অনেকটা মায়ের মতোই দেখতে । সুমতির এখন পাঁচমাস চলছে । আগেভাগেই ওকে ওর গাঁয়ে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে তপা । ওর বাপ বেঁচে নেই । মায়ের অবস্থা মোটামুটি ভাল । কিছু চাষের জমি আছে, বাড়িতে পোষা গরু আছে । প্রসব করাবার জন্যে ওদের গাঁয়ে অভিজ্ঞ দাই আছে । হেলথ সেন্টারও আছে । যা দরকার ওর মা-ই সব ব্যবস্থা করবে । তপা স্বামীর কর্তব্য অর্থাৎ বউ এর পেট করে দিয়ে খালাস ।

    খেপ শেষ করে তপা যখন বাস নিয়ে ফিরল তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে । এখন ওর ছুটি । টানা তিনদিন বাস চালিয়েছে । এ বাস আবার তপা চালাবে পরেরদিন দুপুরের পর । দুপুরের খাওয়া হয়নি এখনও । হরনাথ দুপুরে ভাত বানিয়েছিল । সেই ভাত এখন ঠাণ্ডা । খিদের মুখে তাই গপাগপ গিলে নিল তপা । বীণা ওর দিকে পেছন ফিরে মাটিতে উবু হয়ে বসে রাত্তিরের রান্নার জন্যে সব্জি কুটে রাখছিল । ওর শাড়ির আঁচল কাঁধের ওপর দিয়ে পিঠের ওপর পড়েছে । ব্লাউজ আর শাড়ির মাঝখানে পিঠের খানিকটা জায়গা দেখা যাচ্ছে - রোগা কালো শরীরে শিরদাঁড়াটা উঁচু হয়ে রয়েছে । তপা খানিকক্ষণ দেখল ওকে । তারপর ঠিক করল মানদার কাছে যাবে । রাতটা ওখানেই কাটাবে ।

    মানদা যে বস্তিটায় থাকে সেটা একেবারে বড় রাস্তার ওপর । তপার বাসের টার্মিনাস থেকে বেশ দূরে । বাসে করে যেতে হয় । তপা যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছল তখন দিনের আলো প্রায় নিবে গিয়েছে, কিন্তু রাস্তার সব আলো তখনও জ্বলেনি । বস্তিটা লম্বা আর সরু । বড় রাস্তার ফুটপাথ থেকে খুব সরু একটা গলি এঁকেবেকে অনেকখানি ভিতরে চলে গিয়েছে । দুপাশে সব ছোট্ট ছোট্ট আলাদা আলাদা ঘর । গলিটার মুখে রাস্তার ওপরে একটা মাংসের দোকান । দুটো পাঁঠা ছাল ছাড়ানো অবস্থায় দোকানের সামনে লম্বালম্বি ঝুলছে - ওদের পেছনের পা দুটো একসঙ্গে জড়ো করে দোকানের চালে লাগনো দুটো শক্ত হুকের সঙ্গে বাঁধা । সন্ধে থেকেই খদ্দের আসতে শুরু করবে - সবাই প্রথমে চাইবে উরুর মাংস । ভাল মাংস বিক্রি করে বলে এ দোকানের নাম আছে । দোকানের সামনে ফুটপাথের ওপর রাস্তার গা ঘেঁষে একটা ল্যাম্পপোষ্ট । জমি থেকে হাত দুই ওপর পর্যন্ত ল্যাম্পপোস্টের চার পাশ সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো । সেই বাঁধানো জায়গাটুকুর ওপর একটা পাঁঠাকে তুলে দেওয়া হয়েছে - গলাটা দড়ি দিয়ে ল্যাম্পপোস্টের সঙ্গে বাঁধা । জন্তুটার ভাল করে দাঁড়াবার জায়গা নেই - কোনরকমে পোস্টটার গায়ে গা ঠেকিয়ে জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে । আধবোজা চোখে ভাবালু দৃষ্টি - পেছনের দু পায়ের কাছে কিছু ছাগলের লাদি পড়ে আছে - মুখটা ছাল ছাড়ানো জাতভাইদের দিকেই ঘোরানো । মানুষ নামের দু পেয়ে একটা প্রাণী ওকে নিয়ে যা কিছুই করুক, তাতে ওর কিছু যায় আসে না ।

    ঐ সরু গলিটা দিয়ে বেশ একটু ভেতরে ঢুকে মানদার ঘর । ঘরের দরজার ওপরের খিলান আর ঘরের টালির চালের মাঝখানের দেয়ালটুকুতে সাদা চুণকামের ওপর সবুজ রঙ দিয়ে বড় বড় করে ইংরেজিতে লেখা আছে - ওয়েলকাম । একথা লেখা থাকলেও সবাই যে মানদার ঘরে স্বাগত, তা নয় । মানদা আসলে হাতকাটা গণার বাঁধা মেয়েছেলে । যদিও বাঁ হাতটা নেই এ-তল্লাটটায় গণার অপ্রতিহত প্রতাপ । গণা এক জায়গায় এক রাতের বেশি কাটায় না । পুলিসে ধরতে পারে - কোন বিপক্ষ দল এসে বোমা মেরে দিয়ে যেতে পারে । গণা যেদিন আসে বেশিরভাগ সময়েই আগে থেকে খবর চলে আসে মানদার কাছে । সেদিন ঘরে অন্য কাউকে ঢুকতে দেয় না মানদা ।

    গণা ছাড়া মানদার আর যে-কজন প্রণয়ী আছে তপা তাদের মধ্যে একজন । মানদা তপাকে একটু সুনজরে দেখে । টাকা পয়সাও একটু কম করে নেয় । ত্রিশ বত্রিশ বছর বয়েস মানদার - গায়ে গতরে দিব্যি ভারি শরীর । গণা রোগা চেহারার মেয়েছেলে পছন্দ করে না - মুখটা সুন্দরপানা হলেও নয় । মা মরেছিল ছোটোবেলায় । ষোল সতের বছর বয়েসে বিয়ে দিয়েছিল ওর বাপ । কিছু দিন পর বর ওকে বাড়ি থেকে তাড়াল - আর একটা বিয়ে করে বউ আনল ঘরে । মানদা এসে উঠল বাপের বাড়ি, পেটে বরের দেওয়া বাচ্চা । বাপের বাড়িতে দুই দাদা রয়েছে - আছে তাদের দুই বউ । মানদা হোল দুই বউদির কেনা বাঁদী । - সব কাজ ওর ঘাড়ে - সেই সঙ্গে গালাগাল - মাঝে মাঝে কিল, চড়, ঝাঁটার বাড়ি । বুড়ো বাপ চুপ করে দেখত আর দাওয়ায় বসে বিড়ি টানত । বিয়ে দিয়ে দেওয়ার পরে আবার বাপের বাড়ি এসে উঠেছে - মারধর তো খাবেই । আর তাছাড়া বুড়োই বা করবে কী ? ছেলেরা তাড়িয়ে দিলে ও তো নিজেই খেতে পাবে না ।

    ছেলের যখন চার বছর বয়েস তখন মানদা ভাগল । ছেলেকে বাপের বাড়িতে ফেলে রেখে । কলকাতায় এসে শরীর ভাঙিয়ে ব্যবসা শুরু । তারপর কপাল খুলল - গণার চোখে পড়ে গেল । গণা ওকে এখানে রেখেছে । এখন মানদার ভাল রোজগার । দেশে জমি কিনেছে । ছেলে বাপের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করে - তার সব খরচা দেয় । দাদা-বউদিরা ওর ছেলেকে যত্নআত্তি করে । দুই দাদার পাঁচ মেয়ে । ওরা আশা করে আছে মেয়েদের বিয়ের সময় মানদা ভাল টাকা দেবে । বাপটা এখন খুব বুড়ো - প্রায় জরদগব হয়ে গেছে । তার খাই-খরচার জন্যে মানদা দাদাদের টাকা দেয় । দুই দাদা পালা করে মাসে মাসে আসে । মানদার কাছ থেকে টাকা নিয়ে যায় । বাপের জন্যে যা খরচা করে তার থেকে বেশ কিছু বেশিই নেয় ।

    বস্তির অন্যান্য লোকেরা মানদাকে ভাল চোখে দেখে না । কিন্তু মুখে কিছু বলে না । বরং দেখা হলে খুব খাতির করে কথা বলে । গণার বাঁধা মেয়েমানুষকে চটাবে এমন সাহস করবে কে ? বস্তির ভেতর একটা জলের টেপাকল আছে । মানদা যখন হাতে বালতি নিয়ে জল আনতে যায় সব মেয়ে বউরা ওকে জায়গা ছেড়ে দেয় - এস এস মানদাদি - তুমি আগে জল নিয়ে যাও । মানদা জলভরা বালতি হাতে ওর ঘরের দিকে হাঁটে - মেয়েরা পেছন থেকে ওর ভারি শরীরের দোলানি দেখে । মনে মনে গাল দেয় - বেশি মাগি কোথাকার ।

    মানদার ঘরটা বেশ বড় । এক পাশে খাট বিছানা রয়েছে । আর এক পাশে গোটা দুই আখাম্বা চেহারার আলমারি - একটাতে আবার একটা প্রমাণ সাইজের আয়না লাগানো রয়েছে । এ ছাড়াও ট্রাঙ্ক, হাঁড়ি, কড়াই, বাসনপত্র, রান্নার স্টোভ, জলের বড় বড় বালতি রাখা আছে । বাসন কিছু খাটের নিচে, কিছু ঘরের এক কোনায় । মেঝের বাকি জায়গাটুকুতে মাদুর পাতা । দরজা আর মাদুরের মাঝখানকার জায়গাটাতে জুতো খুলে রাখতে হয় । ঘরের দুটো দেয়াল সাদা রঙ করা, অন্য দুটো ফিকে সবুজ । এক দেয়ালে মা কালীর ছবি টাঙানো - অন্য দিকে একটা অনেক বছরের পুরনো ক্যালেণ্ডার, তাতে নধর চেহারার বাল গোপালের ছবি । ঘরে টিউব লাইট জ্বলে, মাথার ওপর ফ্যান ঘোরে । দু দিকের দেয়ালে জানালা রয়েছে । কিন্তু ঘরে লোক আসে বলে সন্ধের পর থেকে মানদা জানালা বন্ধই রাখে । একই কারণে মাঝে মাঝে দিনের বেলাতেও জানালা বন্ধ রাখতে হয় । পাশের ঘরগুলোর থেকে খোলা জানালা দিয়ে মানদার ঘরের সব কিছু দেখা যায় ।

    খাটে মানদার পাশে শুয়ে তপা ঘামছিল । রাত দুপুর হয়ে গেছে । ঘুম আসছে না । অনেকক্ষণ ধরে লোড শেডিং চলছে - বিদ্যুৎ নেই । ঘরের জানালা দরজা সব বন্ধ - ভেতরে দমচাপা গুমোট । মানদা দিব্যি ঘুমোচ্ছে । ওর গায়ে একটা জান্তব গন্ধ, ঘামলে তা আরও তীব্র হয় । ওর মাথায় চুলে মাখা নারকেল তেলের গন্ধ । ওর মাথায় একরাশ চুল - তা এখন বালিশ ছাপিয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে আছে । তপা ওর দিকে মুখ ঘোরাতে গেলেই ওর গালে মুখে মানদার চুল লেগে যাচ্ছে । তপার পেটটাও ভারি হয়ে আছে । সন্ধেবেলা বড় রাস্তার দোকান থেকে কাল কষা মাংস আর পরটা কিনে এনেছিল তপা । পেট পুরে দুজনে সাঁটিয়েছে - সেই সঙ্গে টিউবওয়েলের জল মিশিয়ে কালিমার্কা দেশি । এখন এই গুমোটে তপার অস্বস্তি হচ্ছে । পিরীতের পালা শেষ হবার পর মানদা দিব্যি ঘুমিয়ে পড়ল - আর জেগে থাকবার বেলায় তপা । বাসের চারপাশের খোলা জানালা দিয়ে গরমকালের এমন রাত্তিরে সুন্দর ফুরফুরে হাওয়া আসে । শালা, রাতে বাসে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে অভ্যেসটাই খারাপ হয়ে গিয়েছে ।

    ঘরের দরজায় দুম দুম করে লাথি পড়ল । সেই সঙ্গে বাজখাঁই গলায় মাতালের চিত্কার, এই মাগি, দরজা খোল ।

    চমকে বিছানার ওপর উঠে বসল তপা । মানদাও জেগে গিয়ে তড়াক করে উঠে বসেছে । ওর গায়ে বিশেষ কিছু নেই । এক হাতে শাড়িটা জড়াতে জড়াতে অন্য হাতে প্রায় ঠেলেই ও তপাকে খাট থেকে নামিয়ে দিল । ফিসফিস করে বলল, শীগ্গির খাটের তলায় ঢুকে পড় । গণা ঘুমিয়ে পড়লে খুব জোরে নাক ডাকবে - তখন দরজা খুলে চুপচাপ বেরিয়ে যাস । তপার ছেড়ে রাখা জামাগুলোও ছুঁড়ে খাটের নিচে ঢুকিয়ে দিল মানদা । দরজায় ততক্ষণে আরও জোরে লাথি পড়ছে - গালাগালের মাত্রাও বাড়ছে । দৌড়ে দরজার কাছে গেল মানদা । তপার চটিজোড়া ও বেশ তাক করে খাটের তলায় ছুঁড়ে দিল । তারপর দরজা খুলল ।

    এত দেরি হোল কেন রে শালি - কার সঙ্গে শুয়েছিলি, অ্যাঁ ? ভেতরে ঢুকে ধড়াম করে দরজা বন্ধ করল গণা, কিন্তু খিলটা আর লাগাল না । ওর গলার আওয়াজ জড়িয়ে আসছে, নেশায় সারা শরীর টলছে । মানদার হাত চেপে ধরে ওকে হিঁচড়ে টানতে টানতে খাটের দিকে নিয়ে গেল গণা । মানদা বলছিল, আ: আ:, লাগে লাগে । ওর কথার কোনরকম পরোয়া না করে ওকে খাটের ওপর ফেলে দিল গণা, তারপর জুতো না খুলেই নিজেও হুড়মুড় করে খাটে উঠে পড়ল । মচমচ করে উঠল কাঠের খাট ।

    খাটের নিচে মেঝেটা ধুলোয় ভর্তি । মাকড়শার জালের ওপর ধুলো পড়ে মোলায়েম রেশমের কাপড়ের মতো চাঁদোয়া এখন তপার মাথার ওপর । খাটের নিচে হামা দিয়ে রয়েছে তপা, ওর পায়ের ওপর দিয়ে আরশোলা ঘুরছে - একটা ছোটো ইঁদুর ও বোধহয় ওর পায়ের পাতা ঘেঁষে দৌড়ে বেরিয়ে গেল । বাঁ হাত দিয়ে নিজের বাঁ গালটা আস্তে আস্তে ঘষছিল তপা । মানদা যখন ওর চটি জোড়া খাটের তলায় ছুঁড়ে দিয়েছিল তখন একপাটি এসে ওর গালে লেগেছে । ভাগ্যিস চোখে লাগেনি । এখন তপা কান খাড়া করে রেখেছে, কতক্ষণে জোরে গণার নাক ডেকে উঠবে । তখন কি কি করতে হবে তা মোটামুটি ছকে ফেলেছে তপা । প্রথমে খাটের নিচ থেকে বেরিয়ে জামাটামাগুলো ঠিক করে পরে নিতে হবে । ওর সঙ্গের টাকা পয়সা ওর প্যান্টের পকেটেই আছে । তারপর পায়ে চটি গলিয়ে খুব আস্তে আস্তে ঘরের দরজা খুলে বাইরে বেরোতে হবে - একদম যেন কোন আওয়াজ না হয় । ও জানে গণার সাকরেদরা এদিক ওদিক পাহারায় আছে । আজ তো গণার আসার কোন খবর ছিল না - হঠাৎ ওর মানদার জন্যে প্রেম জাগল কেন কে জানে । ভাগ্যিস এখন লোডশেডিং হয়ে কোন বিদ্যুৎ নেই । তা নাহলে গণা আলো জ্বাললেই তপা ধরা পড়ে যেত । প্রাণে না মারলেও বেদম ধোলাই তো দিতই - মানদাও বাদ পড়ত না । খুব বাঁচিয়ে দিল এই অন্ধকার ।

    মাঝরাতে হেঁটে হেঁটে নিজের ঘরে গেল তপা । সুমতিকে দেশে পাঠিয়ে দেবার পর থেকে এই ঘরে ও প্রায় থাকেইনি । ধুলোয় ঘর একেবারে নোংরা হয়ে আছে । মেঝেয় পাতা শতরঞ্জি, তার ওপর গুটিয়ে রাখা বিছানা - সব ধুলোয় ভর্তি । এই রাতে কে আবার ধুলো ঝাড়বে । ওই বিছানাই খুলে নিয়ে তার ওপর লম্বা হয়ে পড়ল তপা । সকাল হলে ওর বাসের আড্ডায় যাবে । বীণার হাতে তৈরি রুটি তরকারি খাবে ।



    [। ২ ।]


    দুপুরবেলা । টেনে বাস চালাবার চেষ্টা করেও পেরে উঠছিল না তপা । এখন রাস্তায় বাস, মিনিবাস, গাড়ি, ট্যাক্সির ভিড় । তার ওপর স্কুলগুলোর ছুটির সময় । জায়গায় জায়গায় স্কুলের ছেলেমেয়েরা ভিড় করে আছে - তাদের সঙ্গে আছে তাদের মা বাবারা - বাড়ির লোকজন । তবুও তপা এর মধ্যে দিয়ে বাস নিয়ে জোরে বেরিয়ে যেতে পারত । কিন্তু তেরোশো বাহাত্তর ওকে ওভারটেক করে নিয়েছে । ওর আগে আগে যাচ্ছে । তেরোশো বাহাত্তর নম্বর ওদেরই রুটের বাস । ওর পরে ছেড়েছে । রাস্তায় বাসে বেশি লোক তুলতে গিয়ে তপা একটু দেরি করে ফেলেছিল । বাসু ব্যাটা বাস নিয়ে ওর আগে বেরিয়ে গেছে । বাসু মানে বাসুদেব দাস । তেরোশো বাহাত্তর চালায় । ওর বাসটা এখন আগে আগে সব যাত্রী তুলতে তুলতে যাচ্ছে । তপার বাস লোক পাচ্ছে না । তার ওপর রাস্তায় টাইম কীপার আছে । সে যখন দেখবে পরের বাস আগে বেরিয়ে গেছে তখন তপাকে বিরাট ফাইন করবে । বাসের যাত্রীরাও গজ গজ করতে শুরু করেছে । কয়েকটা ছোকরা গোছের লোক হারুর ওপর চেঁচাচ্ছে - ও দাদা, আপনার ড্রাইভার কি ঘুমোচ্ছে ? পেছনের বাস আগে বেরিয়ে গেল, আর এই বাসটা টিকটিক করে চলছে । কয়েকজন আবার তপাকেই বলছে - টানুন দাদা, বাসটাকে একটু টেনে চালান ।

    কিন্তু তপা এগোবে কি করে ? তেরোশো বাহাত্তর যে কিছুতেই রাস্তা ছাড়ছে না । যতবার তপা ওকে কাটিয়ে ওর ডানদিক দিয়ে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করছে ওদিক থেকে এসে পড়ছে গাড়ি বা বাস । বাসু ব্যাটাচ্ছেলে যখন বাসটাকে থামাচ্ছে তখন রাস্তার এ পাশটা জুড়ে বাসটাকে বাঁকিয়ে দাঁড় করাচ্ছে যাতে তপা বেরিয়ে যাবার জায়গা না পায় । নান্টু বাসের সামনের গেটের বাইরে শরীর ঝুঁকিয়ে দিয়ে আপ্রাণ চেঁচাচ্ছে - এই তেরোশো বাহাত্তর - এই । তেরোশো বাহাত্তরের পেছনের গেটের কণ্ডাক্টর বনমালী - চলতি কথায় বুনো । নান্টু এক বার করে চেঁচায়, আর বুনো তেরোশো বাহাত্তরের পেছনের গেট দিয়ে মাথা বাড়িয়ে পেছনে নান্টুর দিকে তাকিয়ে মিচকি মিচকি হাসে - আবার মুণ্ডু বাসের ভেতর ঢুকিয়ে নেয় ।

    কিন্তু এতক্ষণে একটা মওকা পেয়েছে তপা । তেরোশো বাহাত্তর দাঁড়িয়ে পড়ে লোক নামাচ্ছে । এই মাঝরাস্তায় বেশিরভাগ সময়েই বাস পুরোপুরি থামায় না - বাসের চাকা অল্প অল্প গড়ায়, সে অবস্থাতেই যাত্রী বাস থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ে । কিন্তু এখন মেয়েছেলে নামছে, সঙ্গে ছোটো বাচ্চা - কাজেই বাসুকে বাস থামাতে হয়েছে । ও বাসটাকে বাঁকিয়ে দাঁড় করিয়েছে ঠিকই কিন্তু এই মুহূর্তে ওপাশ থেকে গাড়ি আসছে না । তপার ডানদিকটা এখন ফাঁকা ।

    অভ্যস্ত হাতে দ্রুত স্টিয়ারিং ঘোরাল তপা । তেরোশো বাহাত্তরের পাশ কাটিয়ে চট করে গিয়ার পাল্টে অ্যাক্সিলেটর চাপল । শালা বাসু - এইবার তপার খেলটা দ্যাখ ।

    ঠিক তখনই ব্যাপারটা ঘটে গেল । ব্রেক কষার সময়ই পায়নি তপা । যখন ব্রেক টিপল তখন দেরি হয়ে গেছে । স্কুল ফেরৎ একটা বাচ্চা মেয়ে । এই দশ-এগারোর মতো বয়েস হবে । থেমে থাকা তেরোশো বাহাত্তরের সামনে দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছিল । তপা তখন ফুলস্পীডে তেরোশো বাহাত্তরকে ওভারটেক করছে । ওরকমভাবে একটা বাচ্চা হঠাৎ তেরোশো বাহাত্তরের আড়াল থেকে ওর বাসের একেবারে সামনে এসে পড়বে সেটা তপার হিসেবের ভেতর একেবারেই ছিল না ।

    তপা ড্রাইভারের দরজা খুলে লাফিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ল । তারপরই টেনে ছুট । এখন লোকজন ধরতে পারলে পিটিয়ে লাশ করে দেবে । ব্যাপারটা কি হোল কেউ কিছু বোঝার আগেই এখান থেকে ভেগে যেতে হবে । এ রাস্তার পাশে একটা গলি । একটু এগিয়েই সেটা আর একটা ছোটো রাস্তায় পড়েছে । সে রাস্তা দিয়ে একটা বাস যাচ্ছিল । চলতি বাসটায় লাফিয়ে উঠে পড়ল তপা ।

    বাসের কণ্ডাক্টার তপার মুখের কাছে হাতে ধরা টিকিটের গোছাটা এনে সেটার ওপর বুড়ো আঙুল দিয়ে ঘষে একটা চ-র-র-র করে আওয়াজ করছিল - অর্থাৎ টাকা দিয়ে টিকিট নাও । টাকা বার করবার জন্যে তপা পকেটে হাত ঢোকাল । সেই সঙ্গে চিন্তা করল - কোথায় যাবে । তখন মনে পড়ল - বাসটায় ওঠবার আগে বাসের গায়ে লাল রঙ দিয়ে লেখা বাসরুটের নম্বরটা ওর চোখে পড়েছিল । বাসটা মানদার বস্তির কাছাকাছি একটা রাস্তা দিয়ে যাবে । সেখানে নেমে পায়ে হাঁটলে মানদার ঘর দশ মিনিট । তপা একটা পাঁচ টাকার নোট কণ্ডাক্টারের দিকে এগিয়ে দিল । বলল - একটা, তিন টাকা ।

    বাস থেকে নেমে মানদার বস্তিতে যাবার রাস্তাটা দিয়ে হাঁটছিল তপা । এ রাস্তাটা ছোটো - গাড়ি টাড়ি বিশেষ নেই । দুপুরের রোদ ঝাঁ ঝাঁ করছে - রাস্তায় খুব বেশি লোকজন নেই । তপার মাথা এখন অনেকটা স্থির । ও এখন দুর্ঘটনার জায়গা থেকে অনেক দূরে চলে এসেছে - পাবলিকের হাতে হাটুরে মার খাবার ভয়টা আর নেই । পুলিশ অবশ্য এখন ওকে খুঁজবে । কিন্তু পুলিশের চিন্তাটা ছাপিয়ে একটা ছবি বার বার ওর চোখের সামনে ভেসে উঠছিল । পরণে স্কুলের ইউনিফর্ম, সাদা ফ্রক, কোমরে লাল ইলাস্টিকের বেল্ট, সাদা মোজা, কালো জুতো - মাথার চুল লাল রিবন দিয়ে বাঁধা । রাস্তার ওপর পড়ে আছে - মাথার একপাশ থেঁতলে গিয়ে ঘিলু বেরিয়ে পড়েছে । আর রক্ত - জামায়, মুখে, রাস্তায়, পাশে ছিটকে পড়া স্কুলব্যাগটার ওপর । তপা যখন ছুট মারল তখন রক্ত বেরোচ্ছে - বেরিয়েই চলেছে - রাস্তার ওপর অনেকটা জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে ।

    হাঁটতে হাঁটতেই মাথায় ঝাঁকুনি দিল তপা । একটা সিগারেট ধরিয়ে জোরে জোরে টান দিতে লাগল । ছবিটা মুছে ফেলবার জন্যে মানদার কথা ভাবতে লাগল । এই তো কাল রাতেই মানদার সঙ্গে শুয়েছিল । আজ কোথায় শোবে ? কার সঙ্গে ? ধুত্তোরি - যত সব বাজে চিন্তা ।

    মানদা তখন সবে দুপুরের খাওয়া শেষ করেছে । থালাটালা ধুয়ে ঘরে এসে ঘুম দেবার জোগাড় করছে । গরমকালের দুপুরে মাদুরের ওপর শাড়ির আঁচল ছড়িয়ে শুয়ে ঘুমোয় মানদা । দিনের বেলায় খাটের ওপরের গদির বিছানার চাইতে মেঝেয় বিছানো মাদুর অনেক বেশি ঠাণ্ডা, এই সময় তপাকে দেখে অবাক হয়ে গেল, বিরক্তও হলো ।

    - আ মরণ, মিনসে এই দিন দুপুরে এসেছিস কেন ? এখন আমি তোকে কোলে নিয়ে বিছানায় উঠতে পারব না । এখন যা এখান থেকে । আমাকে শান্তিতে ঘুমোতে দে ।

    তপা মাদুরের ওপর বসে পড়ল । করুণ মুখ করে বলল - মানদারে, আমার বড় বিপদ । তারপর ভেঙে বলল কি হয়েছে ।

    সব শুনে মানদা আরও রেগে গেল । তপার খোঁজে পুলিশ এখানে আসতে পারে । তখন মানদাকে নিয়ে টানাটানি করবে । আর গণা যদি জানতে পারে এখানে পুলিশ এসেছিল তাহলে মানদাকে ধরে বেধড়ক ঠ্যাঙাবে । এমনকি ওকে তাড়িয়েও দিতে পারে । তাহলে তো মানদার হয়ে গেল ।

    জোরে মাথা নাড়ল মানদা । বলল, যাই করে থাকো, আমি তোমাকে এখানে রাখতে পারব না । তাছাড়া আজ গণা আসবে । তোকে দেখলে গুলি করে তোর পেট ফুটো করে দেবে ।

    গণার আসার কথাটা সত্যি নয় । কিন্তু মানদার তপাকে তাড়ানোর দরকার । সেজন্যে ভয় দেখানো ।

    ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলল তপা । বাইরে প্রচণ্ড গরম - হাওয়াটা গায়ে লাগলে মনে হয় ফোস্কা পড়ে যাবে । এ ঘরের ভেতরটা কি সুন্দর ঠাণ্ডা । মেঝেয় বিছানো মাদুরে মানদার চুলের তেলের আর গায়ের ঘামের গন্ধ । তপা গালের দাড়ি চুলকোল । বলল, গলাটা বড় শুকিয়ে গেছে । একটু চা খাওয়াবি ?

    মানদা রেগে গাল দিল - হারামির বাচ্চার চা খাওয়ার শখ হয়েছে । কিন্তু তবুও উঠল । স্টোভ ধরিয়ে চা বানাল । সেই চা একটা অ্যালুমিনিয়ামের গেলাসে ঢেলে তপাকে দিল । সেই সঙ্গে দুটো লেড়ো বিস্কুট ।

    তপা বিস্কুট চিবোয় আর সেই সঙ্গে গরম ধোঁয়ানো চায়ে লম্বা চুমুক দেয় । মানদা ওর চা খাওয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করছিল । এখন বলল, এবার ওঠো তো সোনার চাঁদ । ঘর থেকে বেরিয়ে আমাকে ধন্য করো ।

    তপা তবুও ওঠে না । খালি জুলজুল করে মানদার দিকে তাকায় । তখন মানদাই এসে ওর হাত ধরে টেনে তুলল । বলল, ওঠ শালা হারামি । বেরো এখান থেকে । ওকে দরজার বাইরে বার করে দিয়ে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে খিল লাগিয়ে দিল । বাব্বা: - এতক্ষণে নিশ্চিন্ত । এবার আরাম করে দুপুরের ঘুম লাগানো যাবে ।



    [। ৩ ।]


    কার্তিক রায়ের বাড়ির বাইরের ঘরে বসে অপেক্ষা করছিল তপা । ঘরে বসার জন্যে সোফা, চেয়ার এসব রয়েছে । কিন্তু তপা বসেছিল ঘরের মেঝেতে - এককোণে, খুব জড়োসড়ো ভাবে । কার্তিক রায় বাড়ি নেই । যে স্ত্রীলোকটি এবাড়ির ঘরের কাজ করে সে তপাকে অপেক্ষা করতে বলে ভেতরে ঢুকে গেছে । কার্তিক রায়ের স্ত্রী একটা কলেজে অধ্যাপিকা । তিনিও বাড়ি ছিলেন না, ফিরেছেন কিছুক্ষণ আগে । ঘরের কোণে তপাকে বসে থাকতে দেখে একবার ওর দিকে তাকিয়ে পায়ের জুতো এঘরে ছেড়ে রেখে ভেতরে চলে গিয়েছেন । এরকম দৃশ্য কিছু নতুন নয় । কার্তিক রায়ের সঙ্গে দেখা করে কথা বলবার জন্যে অনেকেই এসে বসে থাকে । আজ তো মোটে একজন । কোন কোনদিন লোকের ভিড় লেগে থাকে এ-ঘরে ।

    ঘরের দেয়ালে সিলিং এর কাছাকাছি একটা গোল দেয়ালঘড়ি লাগানো । তপা মুখ তুলে ঘড়ি দেখল । সাড়ে-সাতটা । কার্তিক রায়ের ফিরতে কত রাত হবে কে জানে । উনি বাস ট্যাক্সি মজদুর সঙ্ঘের একজন ক্ষমতাশালী জনপ্রিয় নেতা । সব সময়েই খুব ব্যস্ত । তপাদের কাছের লোক, ওদের সবাইকে চেনেন । তপারা কার্তিকদা বলে ডাকে । এই বিপদে কার্তিক রায়ই ভরসা । বাসের মালিকের কাছ থেকে কোন সাহায্য পাওয়া যাবে না । রাখলে কার্তিকদা, মারলেও কার্তিকদা ।

    কার্তিক রায় ফিরলেন নটা বাজিয়ে । দরজায় বেলের আওয়াজ শুনে কাজের স্ত্রীলোকটি ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে দরজা খুলে দিয়ে আবার ভেতরে চলে গেল । উনি ঘরের ভেতর ঢুকতেই তপা ধড়মড় করে দাঁড়িয়ে উঠল । ডাকল - কার্তিকদা ।

    কার্তিক রায় এদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তপাকে দেখলেন । বললেন - আচ্ছা - এই ব্যাপার । গণ্ডগোল বাধিয়ে দিয়ে আমার বাড়িতে এসে ঘাপটি মেরে বসে আছিস ।

    তপা বুঝল কার্তিক রায় ব্যাপারটা জানেন । আর উনি তো জানবেনই । শহরে একটা বাস দুর্ঘটনা হয়ে গেল আর খবরটা ওনার কানে যাবে না, তা হতেই পারে না ।

    ঘরের বিজলী পাখাটা সুইচ টিপে চালু করে দিয়ে এসে সোফায় বসলেন কার্তিক রায় । পাজামা পাঞ্জাবি পরে আছেন - পাঞ্জাবির পকেট থেকে রুমাল বার করে মুখ আর ঘাড়ের ঘাম মুছে নিলেন । বললেন, উফ, অসহ্য গরম পড়েছে ।

    তপা ঘরের কোনেই দাঁড়িয়ে ছিল । খুব অপরাধীর মতো ঘাড় নেড়ে তাতে সায় দিল ।

    একটা সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়লেন কার্তিক রায় । ওপরে ঘুরন্ত পাখাটার দিকে তাকিয়ে বললেন, পাবলিক দুটো বাসই জ্বালিয়ে দিয়েছে । তোর বাসটা আর তেরোশো বাহাত্তর । তোকে হাতের কাছে পায়নি - বাসুদেবকে খুব মেরেছে । ও এখন হাসপাতালে । কণ্ডাক্টার ক্লীনাররাও ভালই মার খেয়েছে । দু-ঘন্টা পথ অবরোধ ছিল । তার জেরে বিরাট ট্রাফিক জ্যাম । পুলিশের বড়কর্তারা এসে অনেক কথাবার্তা বলার পর অবরোধ উঠেছে । পুলিশ এখন তোকে খুঁজছে ।

    তপা কাঁচুমাচু মুখ করে সেখানেই দাঁড়িয়েছিল । কার্তিক রায় এবার ওর দিকে তাকালেন । বললেন, তোর মতো পাকা ড্রাইভার এরকম একটা ভুল করল । কি ফ্যাসাদ বাধিয়েছিস দ্যাখ দেখি ।

    তপা এবারও চুপ । কার্তিক রায় দাঁড়িয়ে উঠলেন । বললেন, দাঁড়া খেয়ে আসি । তোর এই কাণ্ডের জন্যে আমার সারাদিন খাওয়া হয়নি । খবর পেয়েই আমি দুর্ঘটনার স্পটে চলে গিয়েছিলাম ।

    ভেতরে যাবার জন্যে পা বাড়াতে গিয়েও থেমে গেলেন কার্তিক রায় । জিজ্ঞেস করলেন, তোর খাওয়া হয়েছে ?

    তপার মুখে কথা নেই । খালি ঘাড় নেড়ে জানিয়ে দিল খাওয়া হয়নি । হুঁ - বলে ভেতরে চলে গেলেন কার্তিক রায় ।

    একটু পরে বাড়ির কাজের স্ত্রীলোকটি এ-ঘরে এল । ওর একহাতে একটা থালা, আর একহাতে এক গেলাস জল । থালায় গরম ভাত বেড়ে দিয়েছে । তার ওপর ঢেলে দেওয়া ডাল, পাতের পাশে কুচিয়ে কাটা আলুভাজা, ছোটো এক টুকরো পাতিলেবু, এক চিমটি নুন আর একটা লম্বা বোঁটাওয়ালা কাঁচালঙ্কা । থালার অন্য দিকে রুই মাছের একটা ছোটো টুকরো, আর খানিকটা মাছের ঝোল । তপার সামনে থালা গেলাস নামিয়ে দিয়ে বলল, হাত ধুতে হলে ভেতরের খাবার ঘরে বেসিনে ধুয়ে নিন ।

    তপা জানে বেসিনটা কোথায় । এ-বাড়িতে ও বেশ কয়েকবার এসেছে । ভেতরের ঘরে ঢোকার দরজার পর্দা সরিয়ে উঁকি মেরে দেখল খাবার ঘরে কেউ আছে কিনা । কার্তিক রায় স্ত্রীর সঙ্গে খাবার টেবিলে বসে খাচ্ছেন - এখন এ-ঘরে ঢোকা উচিত হবে না । তপা ফিরে এসে নিজের থালার সামনে বসল । থালায় গরম ধোঁয়ানো ভাত - লেবু, লঙ্কা, ডাল, মাছ - তার সুগন্ধে তপা বুঝতে পারছে ওরও প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে । হাত ধোবার আর দরকার নেই । পাতের ভাতে হাত লাগাল তপা ।

    খাওয়া শেষ করে তপা নিজের এঁটো হাতের দিকে তাকাল । এবার কিন্তু হাত ধোবার দরকার । এখন খাবার ঘর খালি ; কার্তিকদা, তার স্ত্রী, দুজনেই খাওয়া শেষ করে উঠে গিয়েছেন । কাজের স্ত্রীলোকটি টেবিল থেকে এঁটো বাসন তুলছে, তপা বেসিনে হাত মুখ ধুয়ে নিল । বড় ভাল খাওয়া হয়েছে । খালি ভাত যদি আর দু-মুঠো বেশি দিত । এই কাজের মেয়েমানুষটা নিশ্চয়ই খুব কিপটে ।

    হাত ধুয়ে ভেজা হাত নিজের প্যান্টে মুছে নিল তপা । বাইরের ঘরে এসে ওর ওই কোনাটাতেই বসল । একটু পরে কার্তিক রায় বেরিয়ে ভেতর থেকে । বললেন - চল, বেরোতে হবে ।

    তপা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যেতে হবে ?

    পুলিশ থানায় চল - কার্তিক রায় বললেন । সারেণ্ডার করবি ।

    তপার মুখ শুকিয়ে আমসি । থানায় ? সারেণ্ডার ?

    হ্যাঁ, হ্যাঁ, সারেণ্ডার । আইন ভেঙেছ - তার গুনাগার দিতে হবে না ?

    পুলিশ যে বড্ড মারবে কার্তিকদা ? - তপা কাতরভাবে বলল ।

    কার্তিকদা আশ্বাস দিলেন - তোকে তো আমি নিয়ে যাচ্ছি । নাহয় বড়বাবুকে বলে দেব । তাহলে আর মারধর করবে না । আজ রাতটা তোকে থানার হাজতেই থাকতে হবে । দেখি কাল যদি তোর জামিনের ব্যবস্থা করা যায় ।



    [। ৪ ।]


    দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে নিজের ঘরে বিছানার ওপর তপা চুপ করে বসেছিল । বাইরে অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে । আকাশ একই রকম কালো হয়ে আছে । কাজেই বৃষ্টি শীগ্গির থামবে বলে মনে হয় না । তিন চার ঘন্টা ধরে টানা বৃষ্টি - শহরের জায়গায় জায়গায় রাস্তায় জলও জমে গিয়েছে বোধ হয় ।

    আজ তপার কাজ নেই । এখন সপ্তাহে দু-আড়াই দিনের বেশি কাজ পায় না । সাতশো আটষট্টি নম্বর বাস জ্বলে যাবার পরে মালিক সে-জায়গায় আর নতুন বাস বার করেনি । মালিকের আরও দুটো বাস আছে । কিন্তু তাদের ড্রাইভার তো আগে থেকেই ছিল । ঐ ড্রাইভাররা তাদের শিফটের মাঝখানে যখন ছুটি পায় তখন তাদের বাস চালায় তপা । কাজেই রোজগারও খুব কমে গেছে ।

    মালিকের তপাকে কাজে রাখার ইচ্ছে খুব একটা ছিল না । কিন্তু কার্তিক রায় চাপ দিয়েছেন । দুর্ঘটনা কেউ ইচ্ছে করে ঘটায় না । দুর্ঘটনা হয়েছে - তার জন্যে দেশের আইন আছে । সেজন্যে একজন পুরনো ড্রাইভারকে তার কাজ ছাড়িয়ে দেওয়া চলবে না ।

    সে-রাতটা তপা পুলিশ হাজতে ছিল । পরের দিন জামিনে খালাস পেয়েছিল । জামিন কার্তিকদারই ব্যবস্থা । পুলিশ একটা ফৌজদারি মামলা দায়ের করেছে ওর বিরুদ্ধে । র্যাশ অ্যাণ্ড নেগলিজেন্ট ড্রাইভিং - তার সঙ্গে অনিচ্ছাকৃত নরহত্যা এসবও কিছু আছে বোধহয় । তপা অত জানে না । কার্তিকদার দয়ায় হাজতের বাইরে আছে, কাজকর্ম করে যেতে পারছে - এই যথেষ্ট । ওর মামলা এখনও কোর্টে ওঠেনি । কবে উঠবে জানা নেই । আদালতের সমন এলে তখন দেখা যাবে । আবার গিয়ে কার্তিকদার বাড়ির দরজায় ধর্না দিতে হবে ।

    কিন্তু যদিও তপার ড্রাইভিং-এর কাজটা টিঁকে আছে ওই দুর্ঘটনাটা ওর মনে একটা ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে । এখন আগেকার মতো হৈ হৈ করে বাস ছোটাতে একটু ভয় ভয় করে । মনে ভয় থাকলে বাস চালানোটা একটু শক্ত হয়ে যায় । মাঝে মাঝেই কণ্ডাক্টাররা তপাকে তাড়া দেয়, - টান গুরু, গাড়িটা একটু টেনে চালা । তপা তখন আবার রাস্তার ওপর নজর দেয় - ঠিকমতো চালাবার চেষ্টা করে ।

    আর একটা মুস্কিল হয় দুপুরবেলা । স্কুলগুলোর ছুটি হবার সময় । ছোটো ছোটো মেয়েরা স্কুল থেকে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে । বাসের সামনে দিয়ে রাস্তা পার হয় । মাঝে মাঝে এক ঝলক মনে পড়ে । সাদা জামা, সাদা মোজা পরা চুলে লাল রিবন বাঁধা ফুটফুটে একটা মেয়ে হঠাৎ একেবারে ওর বাসের সামনে । তার পরেই মেয়েটা আর নেই । রাস্তায় পড়ে আছে একটা শরীর - মাথাটা থ্যাঁত্লানো, সাদা জামা রাস্তার ধুলো আর রক্তে মাখামাখি - ওই মাথা আর শরীর থেকে রক্ত বেরিয়ে গোল হয়ে বৃত্তাকারে রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ছে চেহারা নিচ্ছে । তখন তপার বাসের গতি ধীর হয়ে যায় । বাসের গেট থেকে কণ্ডাক্টারের অধৈর্য গলার আওয়াজ পাওয়া যায় - আরে কি হোল - পেছনের গাড়ি আগে বেরিয়ে যাবে যে ।

    তপার ঘরের দেওয়াল এক ইঁটের - নোনা ধরা, বর্ষার জলে ভিজে স্যাঁত্স্যাঁতে । ঘরের মেঝেটাতেও একটা ঠাণ্ডা, ভিজে ভাব । ওর বিছানার সরু, পাত্লা, পুরনো তোষকে সে ঠাণ্ডা যায় না । ওর একটু শীত করছিল । সোজা হয়ে বসে বুকে হাত দিয়ে খানিকক্ষণ কেশে নিল তপা । এই বর্ষাটায় এরকম হচ্ছে । মাঝে মাঝেই গলা খুসখুস করে, কাশি আসে ।

    একটু চা খেতে পেলে ভাল হোত । গরম, ধোঁয়া ওঠা চা । সকাল থেকে খাওয়া হয়নি । বৃষ্টির জন্যে বাইরে বেরোতেই পারেনি । ঘরে চা দুধ চিনি এসব নেই । চাল ডাল হয়তো বা এক দু মুঠো রয়েছে, কিন্তু স্টোভে তেল নেই । ঘরেও কেরোসিন নেই । সকালে দু মুঠো মুড়ি চিবিয়ে নিয়েছে । দুপুরে খেতে হলে আবার বেরোতে হবে । খাবার কিনে খেতে বড় খরচা । এক করা যায় ওদের বাস টার্মিনাসে গিয়ে হরনাথের কাছে ধারে খাওয়া । কিন্তু ও শালা বুড়ো জানে এখন তপা রোজ কাজ পায় না । খাবারটা এগিয়ে দিয়েই তার দাম চায় । ওখানে এখন বীণা নেই । বর্ষার গোড়াতেই পালিয়ে গেছে । ওদের বাস টার্মিনাসের একটা ক্লীনার ছোকরার সঙ্গে । কোথায় গেছে ঠিক জানা নেই । কেউ কেউ বলে ওরা অনেক দূরে গিয়ে ঘর ভাড়া নিয়েছে । ওই ছোকরা নাকি এখন ট্যাক্সি চালাচ্ছে । হরনাথই এখন রুটি বানায়, তরকারি কুটে দেয় । কাজ বেড়েছে, বুড়ো মুখ ব্যাজার করে থাকে ।

    বৃষ্টিটা কমেছে । মাঝে মাঝে দুটো একটা ছোটো ছোটো ফোঁটা পড়ছে । তপা বিছানা ছেড়ে উঠল । ওর ঘরের দেয়ালে একটা পেরেক পোঁতা - ওই পেরেক ওর শার্ট প্যান্ট টাঙানো আছে । ওই প্যান্টের পকেটেই ওর যাবতীয় টাকা পয়সা পকেট হাত্ড়ে টাকা বার করে গুনল তপা । নতুন পুরনো নোট মিলিয়ে সাঁইতিরিশ টাকা আছে । রেজকিতে আরও দু টাকার মতো । মনে মনে হিসেব করল তপা । কালকের দিনটা কাজ পাবার সম্ভাবনা আছে । তাহলে কাল হাতে কিছু টাকা আসবে । এবেলাটা বাইরে খেয়ে আসা যায় । বাস রাস্তায় একটু এগিয়ে প্রথম মোড়টায় একটা বাজার । সেখানে একটা ভাত খাবার হোটেল আছে । পনের টাকায় ভাত, ডাল আর একটা সব্জি । প্রতি হাতা বাড়তি ভাত এক টাকা, ডাল দু টাকা, আর সব্জি তিন টাকা । তপা গায়ে শার্ট প্যান্ট চড়াল । বৃষ্টি আবার জোরে আসার আগেই গিয়ে খেয়ে আসা যাক ।

    ফিরে এসে দরজার বাইরে লাগানো তালায় চাবি ঢুকিয়ে তালা খুলছিল তপা । ওর পাশের ঘরের দরজা খুলে মোক্ষদা বুড়ি বেরিয়ে এল । একগাল হেসে বলল, ও তপা, তোমার মেয়ে হয়েছে যে । শ্বশুরবাড়ি থেকে তোমার কুটুম এসে খবর দিয়ে গেছে । তুমি ঘরে ছিলে না - আমার দরজায় কড়া নেড়ে বলে গেল । একটা চিঠি লিখে গেছে । আমার কাছ থেকেই কাগজ চেয়ে নিয়ে লিখল । কাগজটা তোমার দরজার তলা দিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে ।

    ফোকলা মুখে আবার হাসল বুড়ি । বলল, বউ-মেয়েকে নিয়ে যখন ফিরবে তখন মিষ্টি না খাইয়ে ঘরে ঢুকতে পাবে না কিন্তু ।

    তপাও হাসল । বলল, হবে হবে । ওরা আসুক আগে । তারপরে নিজের ঘরে ঢুকল ।

    ঘরে ঢুকে কাগজটা মেঝে থেকে কুড়িয়ে নিয়ে চিঠিটা পড়ল তপা । রুল-টানা কাগজে পেন্সিল দিয়ে লেখা । কাগজটা কোন খাতার থেকে ছেঁড়া । মোক্ষদার ছোটো নাতি এখানেই থাকে, প্রাইমারি স্কুলে পড়ে । এই কাগজ বোধহয় ওর খাতার থেকে এসেছে । পেন্সিলটাও হয়তো ওরই । এসেছিল শ্রীমন্ত দাস - তপার দূর সম্পর্কের বড় শালা । আজ কলকাতায় এসেছে ওর কোন দরকারি কাজে । সেজন্যে এখানে বসতে সময় পায়নি - সেটাও লিখেছে চিঠিতে । তারপর লেখা - আজ সকালে সুমতির মেয়ে হয়েছে । মা আর বাচ্চা দু জনেই ভাল আছে ।

    চিঠি কোলে করে ভাবতে বসল তপা । শ্বশুরবাড়ি খুব দূরে নয় । বাসে কলকাতা থেকে ঘন্টা দুই লাগে । কিন্তু মুস্কিল হচ্ছে পকেট একেবারে খালি । লোভে পড়ে এক এক হাতা ভাত আর তরকারি বেশি খেয়ে ফেলেছে । পকেটে এখন যা আছে কুড়িয়ে কাচিয়ে বিশ টাকাও হবে না ।

    একটা কাজ করা যায় । কালকের দিনটা বাস চালিয়ে হাতে যে টাকাটা আসবে সেটা নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যাওয়া যায় । কিন্তু তার জন্যে মালিকের সঙ্গে কথা বলা দরকার । কাল কোন বাসের ড্রাইভারের ছুটি থাকবে সেটা জানা নেই এখনও ।

    বাসের মালিক বাড়িতে নেই । ব্যবসার কাজে কলকাতার বাইরে গেছেন । দু দিন পরে আসবেন । মালিকের স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলল তপা । বাস চালানোর ডিউটি চার্টের একটা কপি মহিলার কাছে ছিল - সেটা উনি দেখালেন তপাকে । আগামী কয়েকদিনের মধ্যে তপার কোন কাজ পাবার সম্ভাবনা নেই ।

    মালিকের বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এল তপা । মাথায় একরাশ চিন্তার বোঝা । এই খালি পকেট নিয়ে দু দিন খাবে কি ? কি করে শ্বশুরবাড়ি যাবে ? মালিক থাকলে না হয় কিছু টাকা আগাম হিসেবে পাওয়া যেত । ওর স্ত্রীর কাছে টাকা চাইতে তপা লজ্জা পাচ্ছিল । তবুও মরিয়া হয়ে দুশো টাকা চেয়ে ফেলেছিল । মহিলা দেননি । ওসব টাকার হিসেব উনি কিছু জানেন না । বাড়ির কর্তা আগে ফিরে আসুন । টাকা-পয়সার যা কিছু কথা ওনার সঙ্গেই হবে । তপা রাস্তায় দাঁড়িয়ে একটুখানি ভাবল । তারপর একটা বাসকে হাত দেখিয়ে থামিয়ে তাতে উঠে পড়ল ।

    বিকেল হয়ে এসেছে । মানদা ঘুম থেকে উঠে বড় একটা গেলাসে চা নিয়ে খাচ্ছিল । সঙ্গে আলুর চপ, কুচো পেঁয়াজ আর আস্ত লঙ্কা । একটা ফিরিওয়ালা আলুর চপ, সিঙাড়া এসব ভেজে মাঝে মাঝে এখানে বিক্রি করতে আসে । আজ এসেছিল । মানদা কিনেছে ওর থেকে ।

    দরজার কড়া নড়ে উঠল । মানদা চায়ের গেলাস আর আলুর চপের শালপাতা মেঝেয় রেখে উঠল । দরজা খুলে তপাকে দেখে অবাক হয়ে গেল । একটু খুশিও হোল । বলল, অনেকদিন পরে এলি, আয়, ভেতরে আয় ।

    তপা ভেতরে ঢুকে মাদুরে বসল । মানদা নিজের গেলাস থেকে খানিকটা চা আর একটা গেলাসে ঢেলে ওকে দিল । বলল, চা খা । আলুর চপ খাবি ? - খানিকটা চপ ভেঙে তুলে দিল ওর হাতে ।

    তপা চুপচাপ চা আর খাবার শেষ করল । মানদা ওকে দেখছিল । বলল, তুই খালি খেতেই এখানে এসেছিস নাকি ? কথা বলছিস না যে ? রাতে থাকবি, না চলে যাবি ? যদি থাকিস তো বল - তোর জন্যে খাবার বানাব ।

    তপা বলল, জানিস মানদা, আজ সকালে আমার মেয়ে হয়েছে ।

    মানদা হেসে ফেলল । বলল, সত্যি ? যাক, এতদিনে একটা পুরো মরদ হতে পারলি । তা তোর মেয়ে হবার জন্যে আমাকে কি দিবি বল ?

    তপা মুখ গম্ভীর করে রইল । বলল, মেয়েকে দেখতে যাব । কিন্তু পকেট একেবারে খালি ।

    শুনেই মানদা ওকে প্রায় মারতে ওঠে আর কি । আরে হারামি, সোহাগ করে বউ এর পেট করবে তুমি, আর তার জন্যে আমার গতর খাটানোর টাকা দেব আমি ? যা ভাগ, বেরো এখান থেকে ।

    তপা ওঠে না । মুখটা খুব করুণ করে বলল, দে না মাইরি দুশো টাকা । ধার হিসেবে দে । বাস চালিয়ে টাকা পেলে শোধ করে দেব ।

    মানদা আবার তেড়ে উঠতে যাচ্ছিল । থেমে গেল । ওর ছেলেটা দেশে রয়েছে । অনেকদিন চোখে দেখা হয়নি ।

    আলমারি খুলে টাকা বার করে আনল মানদা । টাকা তপার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল - এই নে, দুশোই দিলাম । শোধ দেবার সময় তিনশো টাকা দিবি কিন্তু ।

    শ্বশুরবাড়ির গ্রামে যখন তপা বাস থেকে নামল তখন সন্ধে হয়ে গেছে । রাস্তাঘাট অন্ধকার । বর্ষার জলে ভিজে কাদা হয়ে আছে । এসব জায়গায় যাদের সন্ধের পর হেঁটে যেতে হয় তাদের সঙ্গে টর্চ থাকে । তপার সঙ্গে ওসব কিছু নেই । রাস্তার পাশে পুকুর, অবিশ্রান্ত ব্যাঙের ডাক ভেসে আসছে সেদিক থেকে । মাটির কাঁচা রাস্তা - অন্ধকারে সাপের ল্যাজে পা দিলে সঙ্গে সঙ্গে ছুবলে দেবে । তবে রাস্তাটা চেনা । মোটামুটি আন্দাজের ওপর এগিয়ে চলল তপা ।

    প্রথমে দেখা শাশুড়ির সঙ্গে । বুড়ি লন্ঠন হাতে নিয়ে বাড়ির বাইরের দাওয়ায় বেরিয়ে এসেছিল । তপাকে দেখে জিজ্ঞেস করল, কে গো ?

    আমি - তপা সাড়া দিল ।
    লন্ঠনের আলো তপার মুখের ওপর পড়েছিল । এবার চিনতে পেরে বুড়ি বলল - অ-অ-অ, এসো এসো । কখন খবর পেলে ?

    এই তো, আজ দুপুরে - তপা বলল । শ্রীমন্তদা গিয়েছিল । আমি তখন বাড়ি ছিলাম না । চিঠি লিখে আমার ঘরে রেখে গিয়েছিল ।

    হাত মুখ ধুয়ে নাও । আমি চা বানিয়ে দিচ্ছি - বুড়ি বলল । কোণের বড় ঘরটা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, সুমতি আর বাচ্চা ঐ ঘরে আছে ।

    একটু থেমে শ্বাশুড়ি আবার বলল, মেয়ের তো আমার খুব কাহিল শরীর । বড় কষ্ট পেয়েছে দু দিন ধরে । শেষ পর্যন্ত তো ডাক্তারখানায় নিয়ে যেতে হ'ল । ডাক্তার বলছিল পেটকেটে বাচ্চা বার করতে হতে পারে । তাহলে তো আবার এ-গাঁয়ে করা যেত না । মেয়ে ব্যাথায় কাত্রাচ্ছে - সে অবস্থায় বড় হাসপাতালে কি করে নিয়ে যেতাম কে জানে । ঠাকুর দয়া করেছেন - শেষ পর্যন্ত তার দরকার পড়েনি ।

    তারপরই বুড়ি মুখটা একটু ব্যাজার করল । বলল, আমি তো খুব আশা করেছিলাম ছেলে হবে । ভগবান দিলেন না । কি আর করা যাবে ।

    হাত-পা ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে নিয়ে ঘরে গিয়ে ঢুকল তপা । ঘরের ভেতর লন্ঠন জ্বলছে । মোটামুটি আলো হয়েছে তাতে । মেঝের ওপর পুরু করে খড় বিছানো । তার ওপর প্রসূতির বিছানা । সুমতি শুয়ে আছে । বাচ্চা হওয়ার ধাক্কায় আরও যেন রোগা হয়ে গেছে - মুখটাও ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে ।

    তপা সুমতির পাশে গিয়ে বসল । ওর কপালে হাত রাখল । সুমতির মুখে হাসি । দুর্বল শরীরে গলায় জোর নেই - ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, মেয়ে পছন্দ হয়েছে ?

    সুমতির পাশ থেকে উঠে গিয়ে ঘুরে এদিকে এসে মেয়ের পাশে উবু হয়ে বসল তপা । সুমতির পাশে শোয়া অতি ছোটো একটি প্রাণী । তপার হাতের তালুর চাইতেও ছোটো একটা মুখ, তার নিচের শরীরটুকু চাদর দিয়ে ঢাকা । চোখ দুটো বোজা । আরামে ঘুমোচ্ছে বাচ্চা ।

    লন্ঠনের আলোয় তপা বাচ্চাকে দেখছিল । মেয়ে আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে ওর চোখের সামনে । ফুটফুটে একটা ছোট্ট মেয়ে । পরণে সাদা ফ্রক, সাদা মোজা, পায়ে কালো জুতো, কোমরে লাল বেল্ট - মাথার চুল লাল রিবন দিয়ে বাঁধা । ভারি স্কুলব্যাগটা পিঠে ঝোলানো । স্কুল ছুটি হবার পর বাড়ি যাবার জন্যে তাড়াতাড়ি হাঁটছে । রাস্তা পার হতে গেল, আর ঠিক তক্ষুণি একটা বাস - চিত্কার করে উঠে দাঁড়ায় তপা । সুমতি ভয় পাওয়া অবাক চোখে তাকায় ওর দিকে । বলে - কি হলো ?

    আওয়াজ শুনে ওর মা বুড়িও ছুটে এসেছে, দরজার চৌকাঠ ধরে দাঁড়িয়ে আছে ।

    তপা বাচ্চার দিকে তাকায় । আধ হাতের ছোট্ট প্রাণীটা মায়ের পাশে শোয়া - তপার গলার আওয়াজেও ওর ঘুম ভাঙেনি ।


  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments