তালডুবুরি ছোটো স্টেশন, ট্রেনটা এখানে দাঁড়ায় না । তাই, ঝড়ের বেগে স্টেশনটা চলে যেতেই সিট ছেড়ে উঠে পড়লাম । তিনটে স্টেশন আগে বনঝুড়িতে শেষ থেমেছিল ট্রেনটা । তার একটু পরেই কি একটা ঝামেলায় প্রায় পৌনে একঘন্টা মতো ঝোপ-আগাছায় ভর্তি একটা জনমানবহীন জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলো । গ্রাম দেশের জংলি ঘাসে ঢাকা পরিত্যক্ত অঞ্চলগুলিতে সূর্য ডোবার আগেই সন্ধ্যা হয়ে আসে । আর, ট্রেনের আলো বলতে তো সারা কামরায় সবেধন নীলমণি একটি মাত্র আলো ; সে আবার মুহুর্মুহু হুমকি দিয়ে চলেছে, সর্বক্ষণই আতঙ্কে থাকা কখন বিছানাপত্র বাঁধে ! এই রকম একটা পরিবেশে মশার দঙ্গলকে ফুর্তি করার সুযোগ দিয়ে বাচ্চাদের চঁযা-ভঁযা চিত্কার, বিড়ি-সিগারেটের ত্রক্রমবর্ধমান ধোঁয়া আর ভ্যাপসা গরমের গন্ধকে সহ্য করে স্থির হয়ে বসে থাকা ভগবানের পক্ষে কখনোই সম্ভব হোতো না বলেই আমার মতো অতি সাধারণ মানুষবর্গের জন্যে ট্রেনের বন্দোবস্ত করেছেন, এই রকম একটা কথা যখন স্থির বিশ্বাসে পরিণত হচ্ছে , তখনই বোধহয় নিজের আসন ভক্তের মনে অটুট রাখার উদ্দেশেই ঈশ্বর স্বয়ং ট্রেনটাকে আঙুল দিয়ে সামনে ঠেলে দিলেন । সেই ঠেলার চোটে গড়গড়িয়ে সোজা তালডুবুরি ছাড়িয়েও যখন গতি এতটুকু কমলো না, তখন হাঁচোড়-পাঁচোড় করে নিজের জিনিষপত্র নিয়ে ঠেলেঠুলে কোনোরকমে দরজার দিকে এগোলাম । যদিও ঝাউডিঙ্গা বড় স্টেশন নয়, তবু আজ এখানে প্রচুর লোক নামবে । আসলে শুক্রবারের বেলাশেষের গাড়িতে শহর থেকে অনেকেই ঘরে ফেরেন । সোমবার ভোরের ট্রেনে আবার দুগ্গা বলে বেরিয়ে পড়া । মধ্যে এই দুটো দিন গোটা সংসারের মনের আরাম । নেমে দেখা গেল যা ভেবেছিলাম, স্টেশনটা তার চেয়েও ছোটো । তেলচিটে একটা ঘরের ভিতর থেকে টিমটিমে আলোর উঁংইকঝঁংউকি দেখে বোঝা যায় যে সেটাই স্টেশনমাস্টারের ঘর । যে- ক'জন লোক নামছে, তারা বাদে আর কাউকে দেখা গেলো না । এমন কি লাল পাগড়িটা কষে বেঁধে নিতে নিতে সাদা ধুতি লাল-পাঞ্জাবী পরিহিত একজন কেউও এগিয়ে এলো না । এই সব জায়গায় কুলিদের জমায়েত নেই । তার কারণ বোধহয় এই যে গ্রামদেশের লোক নিজেদের বোঝা নিজেরাই বইতে জানে । এতো রাত্রে যানবাহন কি পাওয়া যাবে, আদৌ কিছু পাওয়া যাবে কিনা, সেই চিন্তা করতে করতে স্টেশন ছেড়ে বাইরে এলাম । সঙ্গে যারা নেমেছিলো, তাদের অধিকাংশই হাঁটা লাগালো । কেউ কেউ বা চেনা মুখের সাইকেলের এক পাশে পা ঝুলিয়ে রওনা হয়ে যাচ্ছে । দাদা, ভাই কি ভাইপো হবে হয়তো । আমাকে তো অন্য রাস্তা দেখতে হবে । একটু এগিয়ে দেখি, ভাঙা মেঠো রাস্তার ওপারে একটা ছোট্টো দোকান । দোকানী বলে আলাদা কাউকে দেখা যাচ্ছে না । একটা হ্যারিকেন রাখা আছে এক পাশে । কয়েকজন মানুষের আবছায়া রূপ ফুটে উঠছে বিড়ির ধোঁয়ায় । তার ঠিক পাশটাতেই একটা বিরাট গাছের তলায় গুটিকতক রিকশা দাঁড়িয়ে আছে । এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করবো কিনা ভাবছি , কাঁধের গামছা দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে একজন এগিয়ে এলো ।
- কোথায় যাবেন দিদি ?
- শরৎ চৌধুরীর বাড়ি চেনেন ?
- আজ্ঞে খুব । হেমনবাউলের ওষুধ খেয়িই তো আমার বৌটা ভালো হইয়ে গেলো । তা নৈলে আর দেখতি হোতোনি । রিশকা নিয়ে আসি তাইলে ।
- হেমনবাউল আবার কে ?
- এঁংএজ্ঞ, তেনির শিষ্যি মানুষ গো ! উনির নাম শুনেন নাই ?
- কার শিষ্য ? কার কথা বলছেন ?
- শরুত্বাবার শিষ্য এঁংএজ্ঞ ।
- শরত্বাবা ?
- এঁংএজ্ঞ । উনি সন্ন্যেসী মানুষ , কত শিষ্যদিষ্য, উসবের আমরা কি বুজি ! ন্যান, উঠেন ।
- কত নেবেন ?
- আগে যেইয়ে তো নিবেন । তা'পরে যেমনটি বোজেন । উঠেন, দিন আমারে জিনিষগুলা, এই পায়ের কাছে রেইখে দিচ্চি তবে -
- আরে না, না ; ওখানে রাখতে হবে না ; ওগুলো উপরেই থাক ।
রিকশা'র পাদানিতে শুকনো ধুলোর গুচ্ছ, না জানি কত লোকের পা পড়েছে । ওর মধ্যে ব্যাগ রাখতে ইচ্ছা করে না কিছুতেই । এ এক পুরানো বাতিক ।
- ধইরে বসতি হবে । রাস্তা খুব খারাপ এঁজ্ঞে । ভালো করি ধইরে না বসলি পইড়ে যাবেন এঁংএজ্ঞ ।
- না না, পড়ব না । আপনি চলুন না ।
সামান্য জিনিষপত্রটুকু সামলে নিয়ে ভালো করে বসতেই চলতে শুরু করল রিকশাটা । তারপর, অভ্যস্ত পায়ের নিপুণ ছন্দে কয়েক মিনিটের ভিতর স্টেশন চত্বর ছাড়িয়ে দোকানের নির্জন আলোটুকুও পার করে এলো । মনে হোলো, শহরের সঙ্গে একটা যে ক্ষীণ যোগসূত্র কোথাও থেকে গেছিলো, হঠাতি তার সঙ্গে সমস্ত যোগাযোগ একটানে ছিঁড়ে গেছে । নিকষ অন্ধকারে ঢাকা এই যে প্রাণীজগতের ধোঁয়াটে অবয়ব মুহুর্মুহু দৃষ্টিকোণ থেকে মুছে যাচ্ছে, এ এক অন্যরকম জগৎ । এখানে সূর্য নিজের হাতে প্রতি ভোরে প্রাণের বীজ রোপণ করেন । গোধূলির সঙ্গে সঙ্গে সেই চারাগাছগুলি ঝাপসা হতে হতে কালের কক্ষপথে হারিয়ে যায় । জীবনের ব্যাপ্তি এখানে বড়োই ছোটো । ছোটো হয়তো শহরেও, কিন্তু বাইরের চাকচিক্যে বোঝার উপায় থাকে না । এ-জগতের সব কিছু আমার একান্ত অচেনা । শহরের আপাত ছন্দোময় জীবনের সঙ্গে এর কোনো মিলই নেই । তাই সাততাড়াতাড়ি আসার সিদ্ধান্ত নেওয়াটা ঠিক হয়েছে কিনা ভাবছিলাম । না এসেও যে উপায় কিছু ছিলো না । রুণুমাসি'র চিঠি এসেছিলো কয়েকটা, একবার ঘুরে যাওয়ার জন্যে ।
রুণুমাসি আমার নিজের মাসি নন । মা'র বাল্যের সই । একসাথে পায়ে পায়ে বেড়ে ওঠার কোনো এক মুহুর্তে রুণুমাসির বাবা তাঁর মা-মরা মেয়েকে নিয়ে দূর গ্রামে চলে যান । ঠাকুর্দা-ঠাকুমা'র কাছে থাকতে পেলে রুণুমাসির ছোটকালটা আরো হাল্কা, সরল হতে পারতো হয়তো । সংসারের একরাশ বোঝ মাথায় নিয়ে বেড়ে উঠতে হত না । কিন্তু অন্যদিকে পড়াশুনা একেবারেই হত না । রুণুমাসির ঠাকুর্দা সেকেলে মানুষ, নাতনির পড়াশুনার ঘোর বিরোধী । এ'জন্যেই রুণুমাসির বাবা গ্রাম ছেড়ে গেলেন । কিন্তু যেখানে গেলেন, সেও আরেক গণ্ডগ্রাম । ভোরে উঠে লোকে হয় জমিতে যায় নয়তো ছয় ক্রোশ দূরের নদীতে মাছ ধরতে যায় । প্রাইমারী স্কুলও আছে একটা । কিন্তু তাতে যত ছাত্রের নাম লেখানো, ততজনকে শিক্ষকেরা কোনদিন চোখে দেখেন নি । সরকারী নিয়মকানুনের ব্যাপার । মোট কিছু সংখ্যক ছাত্রছাত্রী না থাকলে অর্থসাহায্য বন্ধ করে সরকার স্কুল উঠিয়ে দেবে । কাজেই বানানো নাম ঢুকিয়ে রাখা । ঐখানেই ভর্তি হলেন রুণুমাসি । বাবার বই পড়ার বাতিক ছিলো বলে মেয়েকেও সকাল-সন্ধ্যা বসতে হোতো বই নিয়ে । পড়ার বইয়ের বাইরেও পড়তে হোতো অনেক কিছু । কিন্তু যেখানে চাষীপাড়া আর জেলেপাড়ার চৌহদ্দির ভিতরেই ভোর ওঠে, ডুব দেয়, সেখানে একা বই আর কি করবে । মধ্যে মধ্যে রুণুমাসীর বাবা গ্রামে ফিরলে মাসী হুটহাট চলে আসতেন দিদার কাছে । রান্না শেখা, সেলাই দেখা, ঘর-দুয়ারের গল্প, সে সব তো ছিলো এ বাড়িতেই । কিন্তু সময় বড়ো দায় । এর পর আর মেয়ের পাত্র জুটবে না বলে রুণুমাসির ঠাকুর্দা নাতনীকে নিয়ে চলে এলেন একবার । মাসির বাবা বাধা দিলেন না । মা'-মরা মেয়েকে একা হাতে বড়ো করা মানুষটা একাকীত্বের চাপে ততদিনে মনোবল খুইয়ে বসেছিলেন । আর, রুণুমাসির তো তেমন আপত্তি ছিলোই না । যে কোনো মেয়ের কাছে বিয়ে ব্যাপারটা অন্য রকম আকর্ষণ নিয়ে আসে । বিশেষত:, গ্রামের ছোট্ট সীমানার ভিতর যেখানে বিনোদনের উপকরণ খুবই সামান্য, সেখানে লাল চেলি আর গোড়ের মালার ওজন অনেক । এর কিছুদিনের মধ্যেই রুণুমাসির ঠাকুর্দা ওঁর বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেললেন । গ্রামেরই ছেলে, এক কবিরাজ বংশের কুলপ্রদীপ । ছেলের বাপ-ঠাকুর্দা সকলেই কবিরাজী করেছেন । সাত গাঁয়ের মানুষ এক ডাকে চেনে । ছেলেরও কবিরাজীর দারুণ হাত । এই বয়সেই সে যত ভালো শিকড়বাকড় চিনতে শিখেছে, খ্যাতিতে বাপ-পিতামহকেও ছাড়িয়ে যেতে তার যে আর বেশী দেরী নেই, এ বিষয়ে সকলেই নি:সন্দেহ । বৈশাখের মাঝামাঝি বিয়েটা তো হয়ে গেলো । ততদিনে মা' কলকাতায় । বিয়ের পর রুণুমাসি কলকাতা এসেছিলেন বার দু'য়েক । প্রথমবার সদ্য বিয়ের পর । তারও প্রায় বছর সাতেক পর দ্বিতীয়বার এসেছিলেন ঠনঠনিয়ায় পূজা দিতে দিন তিনেকের জন্যে । সেবারই আমি দেখি ভালো করে, আর সেটাই মনে গেঁথে গেছিলো কেন জানি । হয়তো অন্য মাসীদের সঙ্গে কোথাও মেলাতে পারি নি বলে । তখনই রুণুমাসির পোষাকের দৈন্য দশা ছিল, আর মেসো প্রায়শই চুপচাপ একলা বসে থাকতেন, পারতপক্ষে কারুর সঙ্গে কথা বলার ঝামেলায় যেতেন না, সঙ্গ এড়িয়ে চলতেন । তখন কবিরাজী আর ডাক্তারীর তফাৎ অত বুঝি না । ভাবতাম, ডাক্তার মানুষের আবার এত কষ্ট কেন ? আজীবন যত ডাক্তার দেখেছি, কেউই তো এ'রকম নয় । কাজেই, মনের ভিতর গিজগিজ করত প্রশ্ন, রাখবার জায়গা পাওয়া যেতো না । মা'কে জিজ্ঞাসা করে শুধু জেনেছিলাম, গাঁয়ে ততো পশার নেই বলে । আরো ক'বছর পর, বড়ো হয়ে গেছি ততদিনে ; তখন জানলাম যে মেসোর নাকি আগেও সংসারে তত মন ছিলো না । চিকিত্সা করে পয়সা নিতেন না । এখন একেবারেই বিগড়েছেন । পুরোপুরিই সন্ন্যাসী হয়ে গেছেন মানুষটা । সেদিনের সেই মেসোই শরৎ সন্ন্যাসী । গত মাস কয় ধরে রুণুমাসির চিঠি এসেছিলো বেশ ক'টা । মা' তো কখনো আসেননি তাঁর বাড়িতে, যদি একবার আসেন । আর কখনো দেখা হবে কিনা, পুরানো দিন খুব মনে পড়ে ইত্যাদি । আমার কথাও খুব লিখতেন চিঠিতে । মা'কে দেখতাম চিঠিগুলি হাতে নিয়ে ছুটির দুপুরে বসে থাকেন । যাওয়ার ইচ্ছা আছে আঠারো আনা, কিন্তু বাবা ছুটি না পেলে মা'র পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয় । সুযোগ বুঝে একদিন কথাটা পাড়লাম । ওদের বদলে যদি আমি যাই । একেবারে অচেনা ভিড়ের ভিতর তো আর গিয়ে পড়ছি না, রুণুমাসির বাড়িতেই তো যাব । খানিকটা কথা চালাচালি হবার পর দু'জনেই রাজি হয়ে গেলেন । আমিও রুণুমাসিকে একটা পোস্টকার্ড ছেড়ে দিয়ে ট্রেনে চেপে বসলাম । এখন এই অন্ধকার এবড়ো-খেবড়ো মেঠো পথে গুঁংএতা খেতে খেতে চলেছি মাসির বাড়ি । খারাপ যে লাগছে , তা নয় । হোলোই বা গ্রাম, নতুন জায়গা তো । সময়ের অভাবে কলকাতার ঘোঁরপঁযাচ থেকে বেরনোই হয় না মোটে । তাছাড়া, সেই ছোটোবেলার পরিচিত মুখগুলোকে দেখার একটা কৌতূহল - সব মিলিয়ে ভালোই লাগছে ।
অনেকখানি খোলা প্রান্তরের ওপর বিশাল কিছু গাছের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাওয়া একটা বাড়ির সামনে এসে আমাকে নামিয়ে দিয়ে রিকশাঅলা ভাড়া নিয়ে ফিরৎ চলে গেলো । সদর দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম । বহু পুরানো কাঠের রীতিমতো বয়োবৃদ্ধ দরজা । রঙ চটে গেছে । কড়া নাড়তে যাব, ভিতর বাড়ি থেকে কথোপকথন কানে এলো ।
- অ সত্য, বলি খিড়কির দুয়োরটা টেনে দিয়ে তুই এবার ঘর যা বাবা ।
- আজ আর যাবনি মা' । এখেনেই এট্টু মাদুর পেতে শুইয়ে পড়ি গে । বড্ড রাত হইয়ে গেছে ।
- সেই ককন থিকে বলতিচি তোরে -
সব শুয়ে পড়ার তোড়জোড় করছে দেখে একটু জোরেই কড়া নেড়েছিলাম বোধহয় । সেই সত্য বলে ছেলেটিরই গলা কানে এলো আবার । - আমি দেখতিচি মা' ।
হাতে একটা ছোটো লন্ঠন নিয়ে সত্য এসে দরজা খুলে বাতিটা উঁচু করে আমার মুখ দেখতে লাগলো ।
- আচ্ছা, এটা কি শশাঙ্ক চৌধুরীর বাড়ি ?
ঝন-ঝনাৎ শব্দে লন্ঠনটা নীচে পড়ে চুরমার হবার আগেই এক লাফে সরে গেছি দূরে । তা নইলে এতক্ষণে আমার কাপড়ে নির্ঘাৎ আগুন লেগে যেত । কি ছেলে রে বাবা ! সত্য এদিকে চেঁচিয়ে চলেছে, উরি বাবা গো ! সন্ন্যিসী ঠাকুররি নাম ধরি ডাকতিচে, ই কি সব্বোনেশে নোক গো-! লন্ঠন ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে ওর ঐ রকম পরিত্রাহি চিত্কার শুনে এক মহিলা আলো হাতে দৌড়ে এসেছেন ততক্ষণে ।
- কি হইয়েচে রে সত্য ? আ মোলো-! রকম দ্যাকো ! বলি হইয়েচে কি বলবি তো ?
সত্য নাচতে নাচতেই আমার দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিলো । এবারে ভদ্রমহিলার খেয়াল হোলো যে কড়ার শব্দ শুনে এসেছিলো সত্য এবং সদর দরজাটা খোলা, আর, এক আগন্তুক সামনে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে । বোধহয় একটু রাগই হয়ে থাকবে । কাজেই, তাকে এক ধমকে থামিয়ে লন্ঠনটা উঁচু করে ধরেই এগিয়ে এলেন তিনি । - কে গা ? কাকে চাই ?
এবার আর আগের বারের মতো নি:সঙ্কোচে যাকে চাই, তার নাম বলতে সাহস হোলো না । তার বদলে বললাম, সন্ন্যাসী বাবা আছেন নাকি ? মানে এটা তাঁরই বাড়ি তো ?
- কে ? মৌ নাকি রে ?
- হঁযা । কিন্তু আপনি চিনলেন কি করে ?
- তুমি আমার সইয়ের মেইয়ে, তোমারে আমি চিনব নি- ; কিন্তু আপনি-আজ্ঞে করিস নে তো, গা জ্বইলে যায় । আমারে নিজের মায়ের মতোন তুমি কইরে কতা বলবি । আয় বাবা, ভেতরে আয় । আমার যে এখুনো বিশ্বেস হতিচে না গো । আহা, আগে জানলি টিশনে কাউরে পাঠায়ে দিতুম, গে নে আসতো । আর, সত্য'র কান্ডখানা দেখ-! আমি তো ভাবলুম বাড়ীতে ডাকাতই পড়লো বুজি । ছেলেটারে নিয়ে যে কি করি ! তোর বাবা-মায়ে এলোনি বুজি ? আসতে খুব কষ্ট হইয়েচে নারে ? কত বড়টি হইয়ে গিছিস ! তা তো আমি ভেবেছিলুমই অবিশ্যি । সে কি আর আজকের কতা ? কতদিন হইয়ে গেলো বল দেকিনি ? বলি ওমা ঠায় দাঁড়িয়ে রইলি কেন ? কতা বলবিনে বলে অ্যাদ্দুর এলি নাকি ? বলি আচ্ছা বিপদে পড়া গিয়েচে তো -
চুপচাপ দেখছি রুণুমাসিকে । অতি রোগাসোগা একটি মানুষ । খুব সাধারণ একটা ডুরে শাড়ি গাছ কোমর করে পরা । দু'হাতে শুধু একজোড়া শাঁখা-পলা । মাথায় মোটা করে সিঁদুর । কপালে সিঁদুরের বড়ো টিপ । আমার হাত ধরে টেনে ভিতরে ঢুকিয়ে মাদুর পাততে পাততে সেই যে কথা শুরু করেছেন, আর থামবার নামটি নেই । সত্যও আজব মুখ করে তাকিয়ে আছে দেখি । হঠাৎ খ্যা-খ্যা করে হাত-পা ছঁংউড়ে ভয়ানক হেসে উঠলো সে ।
- বলি তোর আবার কি হোলো ? আবার বিগড়েচে মাতা ? তা আর বিগড়োবে না ? মরণ আমার - !
- মাতা বিগড়োবে কেনো ? তুমি তো তারে কতা বলতেই দিচ্চনি ? পায়রার নেগে বকমবকম কচ্চো - বক-বকম-বক-বকম-
লাফাতে লাফাতে উঠানে আবার নাচ জুড়ে দিলো সে । হাতদুটো সামনে জোড়া করা । গলাটা বকের মতো একবার সামনে আনে, একবার পিছনে যায় - সঙ্গে তুড়ুক লাফ । আমি অবাক হয়ে দেখছি । এমন সময় মাসি কোমরে হাত রেখে ঘুরে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন ।
- বলি থামবি ? উ: হয়েছে আমার শত্তুর, যা তোর বাপের কাছে ।
- শত্তুর ! হে হে শত্তুর ! শত্তুর এক্কে শত্তুর, শত্তুর তিনে মালপো, শত্তুর ছয়ে জামরুল, পান্তা ভাতে ভীমরুল -
আজগুবি সব ছড়া কাটতে কাটতে উঠানের অন্য দিক দিয়ে ঝড়ের বেগে কোথায় অদৃশ্য হল সে । পিছন পিছন দৌড়ালেন মাসি ।
- বলি অ আমার তিন শত্তুরের পো, চললি কোতায় ? অ্যাতো রাত্তিরে ?
কোনো শব্দের কোনো উত্তর পাওয়া গেলো না দেখে দরজায় খিল দিয়ে ফিরে এলেন রুণুমাসি । হ্যারিকেনের আলোটা আর একটু বাড়িয়ে দিয়ে হাতপাখাটা নিয়ে দাওয়ায় বসে পড়ে বাতাস করতে লাগলেন । আমার মনে পড়লো প্রণাম করার সুযোগই পাইনি এতক্ষণ । উঠে পা ছঁংউয়ে প্রণাম করতে গেলাম, মাসি হাত ধরে ফেললেন ।
- পেণ্ণাম করিসনি মা, সন্নেসীর বাড়িতে মানষীর পায়ে হাত দে পেণ্ণাম করতি নেই ।
- কেন ?
- ওসব জানি নে বাপু, যা শুনিচি । পাপ হয় । এ বংশের নিয়মকানুনই সব উল্টোমুকো, নইলে কপালে এই দুর্ভোগ থাকে কারো ! ছাড়, ওসব কতা । এলি দু'দিন বেড়াতে । তা না, আসতে না আসতেই শুরু করে দিলুম ব্যাখ্যান ।
- সত্য কে মাসি ? মাথার মধ্যে যে প্রশ্নটা থিতু হতে পারছিলো না, সেটাকে এবারে ছেড়ে দিলাম ।
- ও আমার ননদ শত্তুরের পো ।
- এমন কেন ? কি হয়েছে ওর ? তখন ওমনি করে লন্ঠনটাই বা ফেলে দিলো কেন ? এখানে কি মেসোর নাম নেয় না কেউ ?
- নেবে না কেন ! আমারই মরণ হয় না, তাই ! বলবো তোরে সব । এয়েচিস য্যাখন । হাত মুখ ধুয়ে কিছু মুখে দে আগে । দুটো দিন থাকবি তো ?
- হঁযা, রোববার ফিরব ভাবছি বিকেলের ট্রেনে । মা'রও আসার ইচ্ছা ছিলো, বাবা কাজের চাপে ছুটি নিতে না পারায় আসতে পারলেন না ।
- তা হোক, না হয় পরে আসবে 'খন । তুই এয়েচিস, এই ঢের । নে বাবা, হাত-মুখ ধুইয়ে নে ।
মেসো কোথায় গেছেন, কখন ফিরবেন, এই সব প্রশ্নগুলো মনের ভিতর ভিড় করে আসছিলো । কিন্তু, ট্রেনজার্নির ধকল বওয়া বেশ কঠিন হয়ে পড়ছিলো ত্রক্রমশ । কাজেই, আর কথা না বাড়িয়ে হাত মুখ ধোওয়ার বদলে স্নানই করে নিলাম একেবারে । উঠানের একপাশে শিউলি ফুলের গাছের নীচে ইদারা । তার পাশে বেশ পোক্ত মোটা বাঁশ দিয়ে তৈরি করা বড়োসড়ো স্নানের জায়গার ভিতরে একটা চৌবাচ্চা । মাথার উপরে টালির ছাউনি । আপাতত চৌবাচ্চায় জল ভরাই ছিলো বলে আর ভরতে হোলো না । বালতি বালতি জল ঢাললাম । কতক্ষণ ধরে স্নান করেছি কি জানি । উঠানের এ পারের চালাঘরদুটোর একটাতে আলো জ্বলছে দেখে ঢুকলাম । দেখি, মাসির রান্না শেষ । ভাতের মাড় গালার তোড়জোড় করছেন । আমায় দেখে একটা আসন এগিয়ে দিলেন । সেটা পেতে বসে পড়লাম ।
- তোমাদের তো খাওয়া হয়ে গেছিলো, আবার শুধু আমার জন্যে রান্না করতে হচ্ছে । আমি কিছু করবো ?
- না, রান্না আর তেমন কি কিছু করে খাওয়াতি পারবো তোরে আজ ? আগে জানা থাকলি তাও নয় - । এই ধোঁকার ডালনা করলুম তাড়াতাড়িতে ভাতের সঙ্গে, আর দুটো বেগুনি করিচি । খা দিকিনি বসে ।
ভীষণ খিদে পেয়েছিলো । একটা ধোঁকা ভেঙে মুখে পুরে জিজ্ঞাসা করবো ভাবছি যে এতো তাড়াতাড়ি কি করে অসাধারণ ডালনাটা করে ফেললেন মাসি, মনে পড়ে গেলো যে একবারও যে মেসোকে দেখিনি এসে অবধি ।
- মেসো কোথায় মাসি ?
মনে হল মাসি কেমন চমকে তাকালেন ।
- আছেন ওখেনে । রাত্রে তো নাম করতি নেই সেখেনকার । তুই খা দিকিনি ।
- নাম করতে নেই ? তার মানে শ -
- চুপ চুপ, বলছি নে নাম করতি নেই -
- খেয়েদেয়ে গেছেন বুঝি ?
- দূর বোকা । খেইয়েদেইয়ে কেউ যায় নাকি ? আর খাওয়া । রাত্তিরে সেসবের পাট তো চুইকে গেছে কত্ত দিন ।
- তুমি খেয়েছো ?
- খা না তুই, আমি বিছানাটা পাতি গে । আজ আমার সঙ্গেই শুবি'খন । জানলাটা দে' ভালো হাওয়া আসে খুব, ভালো ঘুম হবে তোর । খেইয়ে নে, বললি নে তো ডালনা কেমন লেইগেচে ? তোর দিদমাই শিইকেছেলো ।
- খুব ভালো হয়েছে মাসি । কি করে করলে এত তাড়াতাড়ি ? আর করলেই যদি তো আজ নিজের জন্যেও করলে না কেন ? আমার সঙ্গে বসে খেতেই না হয় একটা দিন ।
- কতা শোনো মেইয়ের । বলি সন্দেবেলা অত্তগুলো মুড়ি খেইয়ে কি আর পেট খালি থাকে ? সেই যে মুড়ি খাবে বলে বায়না কোল্লো সত্য, তা দিলুম মেইখে ভালো করে কাঁচালঙ্কা দে - সেই খেইয়েই তো পেটটা - । চাদরটা আবার কোনদিকে রাখলুম -
মুড়ির বাহানা দিয়ে রুণুমাসি সরে গেলেন ওখান থেকে । আসলে খাননি কিছুই । কি আর বলবো ! কোনো রকমে খাওয়া শেষ করে শুতে এলাম । রুণুমাসি খিড়কির দরজা আর সদর দরজা ঠিকমতো বন্ধ আছে কিনা দেখে নিয়ে এলেন । হ্যারিকেনটা কমানো রইলো ঘরের বাইরে দাওয়ার উপর ।
-তোর মা একনো কলের গান শোনে ?
চমকে গেলাম প্রশ্ন শুনে । সত্য নামের সেই অদ্ভূত ছেলেটা সেই যে তখন গেলো, আর ফিরলো না তো । ছেলেটা কে, কোথায় থাকে, মেসো এত রাত্রে যেখানকার নাম করতে নেই, সেখানে কি করেন - এই সব প্রশ্নগুলো হাবুডুবু খাচ্ছিলো মনের মধ্যে । জিজ্ঞাসা করবো কিনা ভাবছি, এমন সময় এইরকম বিজাতীয় প্রশ্ন শুনে চমকে গেলাম ।
-হঁযা ।
-আমরা একবার গেরামে কলের গান শুনিচিলুম ।
-কোথায় ? -
হইয়েছে কি, তকনো বাবা আমারে নে চলি যায় নি । একদিন দুক্কুরে হাঁস আনতি যেতিছি শাপলাদীঘিতে; সেদিন আবার সক্কাল থিকে বাদল ছেইয়ে আচে । শিগ্গির করে যেতিচি । দেকি, তোর মা'ও এদিক পানে দৌড়ি আসতিচে । দম টানতিচে আর বলতিচে, কলের গান দেখতি যাবি ? আমি তো ভাবি বলে কি । তা বলে কিনা বটতলায় গান এয়েচে । কিন্তু পয়সা নাগবে বইলে তোর দিদুর শাড়ির আঁচল থে' খুইলে নে এয়েচে । বললুম হাঁস ক'টা উইঠে দি । তা শুনলি তো । কলের গান নাকি চলি যাবে । দৌড়ুতে দৌড়ুতে গিচি, সে কি এট্টুকুণি রাস্তা ! দম নেইগে গেচে । গে দিকি, ওমা কি কান্ড । চোঙার মতোন কি একটা জিনুষ, তার উপরে না নিচে কোতায় যেন গোল মতো কি একটা চাকতি ঢুকুচ্ছে আর তাই থে' গান বেরুচ্ছে । আর, কি সোঁদর আওয়াজ । বটতলা ভত্তি করে সব বইসে আচে নোকজন । একটুক দাঁড়াবো, সে জায়গাটুকু নেই কো । তাপ্পর তো কতখণ দাঁইড়ে ছিলুম হুঁশ নেই কো । ইদিকে নেমিছে হটাৎ ঝেঁইপে বিষ্টি । কি বিষ্টি, এক হাত দূরি নজর যায়নে কো । তকন হাঁসির কতা মনি পড়িচে । ফের দৌড়ে গিচি দীঘিতে, গে দেখি কিচ্ছুটি নেই ।
- ভিজতে গেলে কেন বৃষ্টিতে ? ঠান্ডা লেগে যায় নি ?
- লেইগেচিলো তো । তোর মা'র কি সদ্দিজ্বর । আমার কিচু হয়নে কো । তকন তো বিষ্টি ভালো লাগতো ।
- আর হাঁসগুলো ?
- বাড়ি চইলে গেছলো । ঠাকমা ভেইবেছেলো হাঁস ঢুইকে দে গিচি, তাই আর কিচু বলে নে কো ।
- মা'র থেকে তোমাদের ছোটোবেলার গল্প অনেক শুনেছি । আচ্ছা মাসি, মেসো কি একেবারেই সন্ন্যাসী হয়ে গেছেন ? বাড়িতে আর আসেন না ?
- আসেন মাজে মদ্যে । খুব কম ।
- আর কবিরাজী ?
- সেইটেই যা বাঁইচে রেকেছে, নইলে এমন দিনকালে কে আর কারে বইসে খাওয়ায় !
- কিন্তু বাড়ি না এলে কোথায় করেন চিকিত্সা ?
- রুগীরাই যায় ওঁর কাচে । যার যা দোওয়ার দে' যায় । উনি শিষ্যদের দে' বাড়ি পাইঠ্যে দেন । অনেকে বাড়িতে এসিই দে যায় । সন্ন্যাসী মেনিই হোক, আর ওষুধের গুণিই হোক, লোকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করে । মরসুমের ফলমূলটা দে যায় আমায় । যদিও কোনো দরকার নেই, অনেক বারণ করিচি, শোনে না কেউ । আমার তো প্রাইমারী ইস্কুলের টাকাতেই দিন চলি যায় । যাই দিনি একবার, ইস্কুল ঝাঁট দে, ধুইয়ে-মুছে, মাস্টারদের জল তুইলে, পূজার ফুল দে আসি । হেডমাশ্টার রোজ ঠাকুরের পায়ে ফুল চড়ায়ে তবে কাজে নাগেন ।
-
কত দূরে স্কুল ? - বেশী দূরে নয়, ক্রোশ তিনেক হবে । সময়ও এমনি করি কেইটে যায়, হেঁটিই কাটাই খানিকটা সময় সকাল-বিকেলে । অনেক চলিছি জীবনভোর । এখন থেমে গেলিই আমিও বাঁচি, তিনিও বাঁচেন, নিত্য আর এ বোঝ বইতে হয় না । চলে যেতি পারেন যে দিকে ইচ্ছা ।
রুণুমাসির গলা ভারি হয়ে এলো । এতক্ষণ বুঝিনি, এখন মনে হচ্ছে ঘরের ভিতরটা খুব গরম, যেন অনন্তকাল বাতাস ঢোকেনি । জানলার বাইরে রাত দুলছে অল্প ।
- বড়োঝিলের জলে মাজিমদ্যি চান করতি যাই, কলসী ডুবিয়ে জল নে ফিরি, সন্ধ্যেবেলা কীর্তন কি পাঠ শুনতি কারোর বাড়ি যাই । এ বাড়িতেও পাঠ হয় কত সময় । কি আর করবো, এই করেই সময় যায় । ছাড় ওসব, তোদের কতা বল ।
- আমাদের কথা তো সব জানোই তুমি, মা' তো দেখি ছুটির দিনে সময় পেলেই চিঠি লিখতে বসেন ।
- না লিখলি ওর রক্ষে রাখবো নাকি ?
বলেই হেসে গড়িয়ে পড়েন মাসি । হাসি আমিও ।
- সত্য'র খুব শখ, একবার কলকাতা যায় । তা নিয়েই বা যায় কে, আর ও ছেলেরে সামলানো কি আর সোজা কথা ! গাঁ-ঘরে সবাই সবাইরে চেনে নেহাত্, তাই হারানোর ভয় নেই কো ।
- সত্যর এ'রকম মাথার দোষ হোলো কি করে ?
- আর জন্মের পাপের বোঝা ছিলো ওর ঘাড়ে, তাই ।
- জন্মান্তরে বিশ্বাস হয় না আমার ।
- অমন কথা বলতি নেই রে, বলিস নে ।
- কিছু নিশ্চয়ই হয়েছিলো মাসি, এমনি এমনি কারো আর মাথার গণ্ডগোল হয় না ।
- হয়ে তো ছেলোই ।
- ছ'মাস বয়সে খাট থিকে গইড়ে নিচে পইড়ে কপাল ফাটালো ছেলে । ছোটোবেলায় তো কেউ বোঝে নে কো । ক' বচ্ছর পর দেকে কখুনো ঠিক থাকে, কখুনো মাতার দোষ হয় । ওর বাপেই তো মাছ ধরতেছেলো একবার, তা দেচে পিছন থেকে ধাক্কা মেইরে জলে ফেলে । তখন পাঁচ বছর বয়স । তা জল থেকে উটে কি মার ছেলেরে ! মাথা আর ঠিক থাকবে কি !
- মেসো ভালো করতে পারলেন না ?
- চেষ্টা তো আর কম করেন নে কো । কিছুই হোলো নি । সেই দু:খিই তো মনিষ্যিটা অমন হইয়ে গেলো । কিন্তু, তাই বলি যে আমারই বা এতে দোষ কি ? যদ্দূর পেরিচি করিচি, করতেচি এখনো । সাতপুরুষের ভিটে থেকে ঘরের বৌকে কেউ বার করে আনে নইলে তেনাদের ঘাড়ে চেপে সাধনা করবে বলে, আর আমারও তাকে তবুও এই পোড়ামুখ দেখানোর জন্যে বেঁচিবর্তি থাকতি হয় !
- তোমরা সত্যকে নিয়ে কলকাতায় দেখালে না কেন ?
- চেইয়েছিলুম । সত্য'র বাপটা নে যেতি দেয়নি । শহরের হাসপাতালে নাকি ওর ছেলেরে মেইরে ফেলবে !
- মেসো কিছু বলেননি ?
- এই মনিষ্যিটা তো কবে থিকে বোনের লেগে সংসারধর্ম ফেলি বিবাগী ! বলি, বোন কি আর কারো থাকে নে কো ?
- খুব ভালোবাসতেন বোনকে, না ?
- সে তো বাসত । বোনটাও ছেলো তেমনি । অমন লক্ষীমন্ত মেয়ে দুটি দেখা যায় না । এই পোড়ারমুখো দেশে জম্মেছে বলে তাই, অন্য কোতাও জম্মালে রাজরানী হতি পারতো । ভরা পেটে শাউড়ীর ব্যাগার খাটতি গে মরে ভূত হতি হোতো না ।
- তোমায় সত্য খুব ভালোবাসে না ?
- আমারেই তো মা' ডাকে । দেখলি নে তকন সন্দেবেলা ? কে যে ওরে শিকায়েচে ! কেমনি করে যে ন্যাওটা হোলো, জানি নে । নিজের তো আর হোলো নি কিচু । সত্য'র পোড়ারমুখো বাপটা বচ্ছর চার আগে আর একটা বিয়ে করে চুলোর দোরে গেচে । নিজের বাপ-মা'কেও দেখতো না । বুড়ো তো মরে বেঁচেছে, আজ ক'বর্ষা পার হইয়েচে । বুড়ি বাতের রুগী, আমি ওর সাত জন্মের শত্তুর, তাই আমার নামে নিন্দে-মন্দ করবার জন্যি টিঁকে আচে এখনো । নেহাৎ লোকে কথা গায় নেয় না তাই । মা-মরা ছেলেটা আমারেই জড়ায়ে বেঁচে আচে, আর আমিও বেঁচিছি ওরে পেইয়ে ।
- নে তুই ঘুমো এইবারে ।
মাসী পাশ ফিরে শুলেন । নিকষ রাত বাইরে । কৃষ্ণপক্ষ চলছে বোধহয় । ভাবছিলাম রুণুমাসির কথা । সন্ন্যাসী স্বামী আর এক ভাগ্নে ছাড়া তিনকূলে কেউ নেই । ওঁর বাবার তো স্বাস্থ্য ত্রক্রমশ:ই ভাঙছিলো শুনেছি । মেয়ের বিয়ের পর সেই যে পশ্চিমে গেলেন, আর ফেরেন নি । ঠাকুর্দা-ঠাকু'মারও তো বয়স হয়েছিলো । তাঁরাও চলে গেছেন এক সময় । মানুষটা এখন একেবারে একা ।
ঝিঁঝিঁর ডাক শুনতে শুনতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি । মাথার কাছের খোলা জানলা দিয়ে ঝরঝরিয়ে কামিনীর সুবাস এসে ঘুম ভাঙিয়ে দিলো । সূর্যদেব এখনো আসন ছেড়ে নামেননি । বালিশের পাশে রাখা হাতঘড়িটা দেখে চমকে গেলাম । ভোর পাঁচটা । এতো তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙলো কি করে ! কলকাতায় যে সাতটার আগে ঘুম ভাঙতেই চায় না । আড়মোড়া ভেঙে উঠানে বেরিয়ে দেখি রুণুমাসি উঠান ঝাঁট দিচ্ছেন । আমায় দেখে একগাল হাসলেন ।
- উঠলি ?
- ঘুম ভেঙে গেলো । বাড়িতে এতো ভোরে উঠি না জানো ।
- এখেনে তো ফুলের গন্ধ, পাখির ডাক ; ওখেনে ফুলও ফোটে দেরিতে, পাখিও ওঠে দেরিতে ।
হেসে ফেললাম । অদ্ভূত যুক্তি !
- মুখ ধুইয়ে নে, তোরে নে আজ বড়োঝিলে যাবো ভাবতিছি । বাদল করেছে না ?
- বড়োঝিল ?
- বিরাট বড়ো ঝিল । মাঝেমধ্যে ওখেনে ডুবসাঁতার দে আসি, মনটা ভালো হয় । ওর পাশিই মন্দির । মন্দিরের ভিতরপানে ছোটো ঝিল, সেইখেনে কি বড়ো বড়ো সব কাতলা-বোয়াল আছে, চল দেখাবো তোরে আজ ।
- কত বড়ো মাছ ?
- তার বয়সের গাছপাথর নেই । দু'তিনশো বছর বয়স হবে এক-একটার । দেবতার মাছ, মুড়ি খাওয়ালি পুণ্যি হয় । সঙ্গে নে যাবো এট্টুকুন ।
- বোয়াল মাছের বয়স দু'শো বছর ? ধ্যাৎ ।
- তোরা শহরে থেকি সব অবজ্ঞা কত্তি শিকিচিস, বলতেচি তোরে । আগে আমিও মানতি পারিনি, নিজে দেখে তবে বিশ্বেস হোলো ।
- দেখে বয়স বুঝলে কি করে ?
- অত বড়ো কি আর চাদ্দিনে হয় ? নে, আর কতা বাড়াসনি ।
মাসির কথা শেষ হওয়ার আগেই দুড়ুম করে খিড়কির দরজাটা খুলে গেলো, আর সত্য এসে ঢুকলো বাড়িতে । হাতে একগোছা কুমড়ো ফুল । সেগুলো থেকে তখনো জল ঝরছে ।
- ফুল এনিচি মেইয়ের জন্যি, ফুল এনিচি ।
এই বলে ফুল সমেত হাত মাথার ওপর তুলে খানিকটা ধেই ধেই করে নেচে নিলো সে ।
- নিবি নে ? নাচ শেষ হতে বেশ শান্ত হয়ে আমার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলো ।
- নেবো না কেন ? হাত বাড়ালাম ।
- ভেইজে খাবি । বাড়ি নে যা ।
- বাড়ি নিয়ে যাব কেন ? এখানেই খাই সবাই মিলে । তুমিও খাবে ।
- না, শুধু তুই খাবি । আমি তো সারাদিন ঐ খাই, ঠাকমা বলে আমি ছাগল । আচ্ছা, আমি ছাগল ?
- ছাগল হতি যাবি কোন দু:খে ? বুড়ির কামধাম নেই, সারাদিন সোনার ছেলেরে গালি দেওয়া । বলি ফুলগুলো ভিজালি কি কইরে ?
- ধুইয়ে এনিচি । তুমি ধুইয়ে নিতে বলো যে গো ।
- আহা ! কতা শোনার ঠ্যালায় গায়ে জ্বর আসে । তা, কোতায় ধুইয়েচিস ?
- কেন ? নালায় । মন্দিরের ষাঁড়টা জল ছাড়তেছেলো নালায় দাঁইড়ে । সক্কাল সক্কাল পেয়ে গেলুম তারে, বাবা মহাদেবের দয়া বলে কতা । তাই নালার জলেই ধুইয়ে এনিচি ।
- ও মা গো । কোন চুলোয় মরতি যাবো গো ? সাত সক্কালবেলা নালার জল নে এয়েচে; আবার বলে কিনা বাবার দয়া । দূর হ' পোড়ারমুখো, ফ্যাল গে যা ঐ জঞ্জাল ।
- এক্কুণি ঠাকমারে গাল দিতেছেলে ছাগল বলে শুইনে, এখন আবার পোড়ারমুখো বলতিচো কোন মুকে শুনি ?
- একনো যাসনি ? আজ তোর পিঠে এই ঝঁযাটার বাড়ি না মেরিচি তো আমার নাম নেই । সাত-সক্কালবেলা আবার আমায় সারা উঠোন গোবর নিকে কত্তে হবে, বেরো বলচি
মাসি ঝঁযাটা নিয়ে সত্যি সত্যি তেড়ে গেলেন দেখে সত্য এবার তুলসীমঞ্চের চারদিকে চরকি কাটতে আরম্ভ করলো ।
- গোবর নিকে তো এমনিতেও কত্তে হোতো । দিনে দশবার করে গোবর দে ঘর না নিকুলে তোমার শান্তি হয় নাকি ? ছঁংউতবাই কম নিকি ?
- কি ? আমার ছঁংউতবাই ? দিনে দশবার ঘর নিকুই ? তা তোমার মতো পুষ্যি একটি আছে য্যাখন ঘর না নিকিয়ে - দিলি তো তুলুসী মঞ্চ ছঁংউয়ে ? উফ মা গো, যা না হতচ্ছাড়া, আমার সাত জম্মের শত্তুর -
হাতের ঝঁযাটাটা গায়ের জোরে সত্য'র দিকে ছঁংউড়ে ফেললেন মাসি । সত্য বেঁকেচুরে সেটাকে পাশ কাটিয়েই খিড়কি দিয়ে যেমন দৌড়ে এসেছিলো, তেমনই ভাবে বেরিয়ে গেলো । মাসি ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লেন দাওয়ায় এসে । কোমরে জড়ানো আঁচল খুলে মুখ মুছতে লাগলেন । ভিতর ঘর থেকে হাতপাখাটা নিয়ে এসে বাতাস করতে লাগলাম ।
- এই যে গেলো, যদি ডাকতে না যাই, সন্দের আগে আর আসবেনি । হাঁফানি কমতে বললেন রুণুমাসি ।
- কেন ?
- সে যা কিছুই করুক, তারে বকা চলবেনি । সে বুড়ি তো চ্যালাকাঠ নে তাড়া করে । যত আহ্লাদ সব এইখেনে । মরণ হইয়েছে আমার ।
- ডাকতে কোথায় যাবে ?
- ঐ বড়ো ঝিলে যেতি আমবাগান পড়ে একটা । সেইখেনে আমগাছের তলায় গামছা পেতে শুইয়ে থাকেন । দেইখে যাব একবার যাওয়ার সময় ।
- এখন ঘর গোবর-লেপা করবে ?
- সে তো করতিই হবে । নালার জল ছইড়েছে উঠোনময় ।
- গোবর কোথায় পাবে ?
- কাল এনি রেকিচি সন্দেবেলা ।
একটা ভাঙা লোহার বালতিতে রাখা অনেকটা গোবরে আধ বালতি মতো জল ঢেলে গোবরটা ভালো করে মিশিয়ে নিলেন রুণুমাসি । কড়া সোঁদা গন্ধ এসে ঝাপ্টা মারলো নাকে । একটু করে সেই গোবর জল উঠানে ফেলেন, আর ঝাঁটা দিয়ে সেটাকে ভালো করে ছড়ান । গোবরের গন্ধে ত্রক্রমশ ঢেকে যেতে থাকে গ্রামীণ ভোর । মাঝে মধ্যে হাতের ঝাঁটা ফেলে সিধে হয়ে নিয়ে কোমর ছাড়িয়ে নেন, আবার শুরু হয় ধোয়া । তুলসীমঞ্চে তো ঝাঁটা ঠেকানো যায় না । হাত দিয়ে সেটাকে ভালো করে ধুয়ে বাকিটুকু নিয়ে খিড়কির বাইরে ছড়িয়ে দেন রুণুমাসি । কাজশেষে, ঝাঁটাটাকে উল্টোমুখো করে বালতিতে রেখে চানঘরে ঢুকে ভালো করে ধুয়ে ফেললেন দুটোকে । ভাবছিলাম, শহরের বাতাস হাল্কা করার জন্যে গোবরের শেষ চিহ্নটুকুও শুষে নিচ্ছে মানুষ । আর, যাবতীয় শহুরে চালচিত্র থেকে এতদূরে একজন একলা মানুষীর চতুর্পাশ নিমেষে শুদ্ধ হয়ে যায় ঐ গোবরের ছোঁয়ায় !
- তুই জামাকাপড় বেছেবুছে রাখ, আমি গা'য় এট্টু জল ঢেলিই বেরুবো । তোরে নে ঝিলের জলে চান করি আসবো আজকে । সাঁতার জানিস তো ?
চানঘরের ভিতর থেকে রুণুমাসির স্বর শোনা গেলো ।
- না, সাঁতার জানি না ।
- অমা, তালে গে কি করবি ?
- দেখতেও তো ভালো লাগবে, নাকি ? একটু বেড়ানোও হবে ।
- তাই হবে'খন তা'লে । বেরুই আগে দাঁড়া ।
উঠানের এপারে শোবার ঘরের দাওয়ায় দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলছি । উঠানের অপর দিকে দুটো চালাঘরের একটা রান্নাঘর, অন্যটা বোধহয় গুদামঘর । চালাঘরগুলির মাথা ছাপিয়ে উঠেছে কয়েকটা তাল গাছ । অল্প-স্বল্প ঝোড়ো হাওয়া দোলাচ্ছে আবছায়া সূর্যটাকে । সেই দোলানির টানে সূর্য থেকে তাপহীন ধোঁয়াটে আলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে ঘরের চালে, তালগাছের লম্বা ডগায়, গোবরলেপা মাটির উপর । কয়েকটা পায়রা ঝটপটিয়ে উড়ে এসে ডানা গুটিয়ে ঢুকে পড়লো ঘরগুলির চালের নিচটায় । দু'-তিনটে ছোটো বাক্স মতো ঝোলানো রয়েছে ওখানে, খড়ের কুটো দেখা যাচ্ছে তা থেকে । ঝড়ের মুখে ওদের নিজস্ব বাসার নিশ্চিন্ত আশ্রয় ।
-কাপড় পরে নেচিস ? মাসির স্বর শোনা গেলো ।
- না । আমি তা'লে স্নান সেরেই যাবো তোমার সঙ্গে ?
- না বাপু, আসতে যেতে ঘেমি যাবি ।
- কি পরে যাই ?
- অমা, যা পরি আচিস, তাই পরিই চ' । নয়তো শাড়ি এনিচিস ? - না তো । - বুজিচি, দাঁড়া আমার একটা শাড়ি বার করি গে । তোরে ঠিক এমনি করি পরায়ে দোব । নাকি পরতি পারবি ? কিচু নয়, য্যামন পরিস, তেমনিই পরবি, শুধু আঁচলটা ঘুইরে নে কোমরে গঁংউইজে নিবি ।
রুণুমাসি গা ধুয়ে বেরিয়ে একটা কচি কলাপাতা রঙা ডুরে শাড়ি বার করে দিলেন । সেটা পরে বেরিয়েছি, অচেনা গলার আওয়াজ শুনলাম । দেখি একজন মধ্যবয়সী মহিলা দরজায় ঠেকা দিয়ে দাঁড়িয়ে, সামনে একটা ছোটো ঝুড়ি নামানো রয়েছে ; তাতে এককাঁদি পাকা কলা, আর দুটো ডাব ।
- এই বুজি মেইয়ে ?
- হঁযা ।
- তা, বে হয়নি কেনো একনো ?
- সাততাড়াতাড়ি বে' কইরে কইরবেটা কি ? সেই তো হেঁসেল আর গুদোমঘর ।
- কি যে বলিস বৌ, ঐ তো মেইয়ে মানষীর সগগো ! তার বাইরে আবার জগৎ রইয়েছে নাকি ?
- থাকবে নি কেন খুড়ি, রাখতি জানলিই থাকে । আমাদের গাঁ-ঘরে আর চার নেই বলি কি কারো থাকবে নি ?
- তোর সঙ্গে কতায় পারিনে বৌ । যাক, এই দে' গেলুম দুটো ডাব । জামাইসন্ন্যেসীরে দিস'খন ; তুইও -
- তুমিই দাও গে যাও না খুড়ি, ঐ শ্মশ্মান-মশানে গিয়ে পতিধম্ম কত্তি পারবো নি আমি ।
- অমন চ্যাটাং চ্যাটাং কতা বলিস নি বৌ, বলতি নেই ; সোয়ামী হয় তোর -
- সেই জন্যিই তো মরিচি । এ জম্ম অমনিই গেলো আমার । বলে সাতজম্মের পুণ্যিতে শিবের মতো সোয়ামী মেলে । কোন জম্মের পাপে যে সন্ন্যেসী পেলুম -
- চুপ কর বৌ, বলিস নি । শুনলিও পাপ । অমন পুণ্যিবান সোয়ামী -
- অপরের ঘরে থাকলিই ভালো, নিজের থাকলি তকন বোঝে লোকে । ভালো কথা বলতি ভালো খুড়ি -
খুড়ি পদবাচ্যের মহিলাটির দিকে পিছন ফিরে কলসী উঠাতে ব্যস্ত হলেন রুণুমাসি । খুড়ির ব্যাজার মুখখানা দেখে বুঝলাম ঠোকরখানা লেগেছে জব্বর । হাঁটুর বয়সী বৌমা'র কথা হজম করে চলে যাবেন, এমন অপমানকর শিক্ষা তিনিও তো পান নি কোথাও ।
- ভালো কতা কইলেই নোকে খারাপ হয় বাছা ; নইলে আর আমি বইলে মরি ক্যানো ! যাক, মেইয়েরে নিয়ে এইসো না হয় সন্দেবেলা । আসি তা'লে এখন, বাতাসও বেইড়েছে । বিষ্টি নাব্বে বোধয় ও বেলায় । সক্কাল করে না গেলি আবার বড়িগুনো ভিজে জল হইয়ে যাবে ।
- এসো গিয়ে খুড়ি । দেখব'খন যেতে পারি যদি । আর, সত্যরে দেইখলে পেইঠে দিও ।
- দোব ।
ঝগড়া করার আর সুযোগ না পেয়ে নেহাৎ মুখ ভারি করে হাঁটা লাগালেন খুড়ি । আকাশে দিব্যি মেঘ জমে উঠেচে । কাজেই আর দেরি না করে বেরিয়ে পড়লাম আমরাও ।
মেঠো পথ দিয়ে এঁংএকবেঁংএক চলেছি । মাঝে-মধ্যেই আট-দশ ঘর বসতি নিয়ে এক-একটি ছোট্ট পাড়া । কারো ভিটের বেড়ার গাঁ ঘেঁষে কি কারোর গোয়ালের পিছন দিয়ে পথ ঢুকে গেছে । এই অসময়ে গোয়াল সব খালিই । একটা বাছুর বোধহয় এখনো চরতে যাওয়ার অনুমতি পায়নি; লুকিয়ে লুকিয়ে খেজুর পাতা চিবানোর চেষ্টায় ছিলো । আমাদের দেখে হুড়মুড়িয়ে সরে গেলো । সর্বত্র একই ছাঁদের গোবর লেপা মাটির বাসা, তফাৎ কেবল বাসার চালে ; বেশির ভাগই টালির চাল । একান্ত ছোটো কয়েকটা ভিটেবাড়ির চাল খড়ের । ধূসর রঙচটা খড় দেখে মনে হোলো এই বর্ষাতেও ঘর ভেসেছে তাদের, এ'বারেই খড় না পাল্টালে আগামি বর্ষাও ছেড়ে কথা বলবে না । পথের দু'পাশে প্রচুর গাছগাছালি কিংবা নিদেন আগাছার ঝাড় । ফুলগাছের চেয়ে তাতেই ফুলের বাহার বেশি । নাম না-জানা অচেনা ফুল সব, রঙবাহারে চলার পথকে ভরিয়ে তুলেছে । ছোটোখাটো কয়েকটা পুকুর চোখে পড়লো, প্রায় সব ক'টাতেই শাপলা ফুলের রাজত্ব । ঘরের বৌ-মেয়েরা রাতের এঁংএটা বাসনকোসন নিয়ে বসেছে জলের ধারে । এনামেলের হাঁড়ি কি থালাবাসনে চুড়ির ঠোকা লেগে শব্দ উঠছে অনর্গল । এদের অনেকেই এই রুণুমাসির মতো গোবর লেপে ঘর পরিষ্কার করে বাসনকোসন নিয়ে বেরিয়েছে । একেবারে স্নান সেরে কলসী ভরে ঘরে ফিরবে । তারপর, শুরু হবে আজকের সংসারযাত্রা । বটের ঝুরি ধরে দোল খাচ্ছে কয়েকটা বাচ্চা । বেয়ে উঠবার চেষ্টায় ছিলো একেবারে মগডাল পর্যন্ত । এদিকে ঝুরিগুলো গিয়ে নেমেছে পুকুরে । পড়লে সোজা পুকুরের মধ্যিখানে । এক মহিলা কলসী নিয়ে পুকুরে আসবার সময় দেখতে পেয়ে প্রবল বকুনি দিতেই ঝুরি থেকে ধুপধাপ নেমে পাঁইপাঁই দৌড় । একটা বাচ্চা নামেনি তখনো । বোধহয় দলনেতা জাতীয় কিছু একটা হবে, পালাতে মানে লাগছিলো তার । যারা পালাচ্ছিলো, তাদেরই মধ্যে একজন তাকে চেঁচিয়ে ডেকে সেটা ঘোষণা করে দিলো । কি আর করে বেচারা । গাছ থেকে লাফিয়ে পড়েই ঢিল হাতে তাড়া করলো পুরো দলটাকে । দিব্যি একটা ছোঁয়াছঁংউয়ি খেলা শুরু হয়ে গেলো নিমেষে । শিশুদের উচ্ছ্বলতায় এই অজ গ্রামের সবখানেই প্রাণচাঞ্চল্য, অদম্য খুশির রেশ । এই বাচ্চারা যখন পুরোদমে মেঘলা ভোরে ডুব দিয়েছে, তখন তাদেরই বয়সী আর একদল, মানুষ হবার আশায় বইখাতা, জল-খাবার পিঠে বেঁধে বাস ধরতে দাঁড়িয়েছে ব্যস্ত শহরের গলির মোড়ে মোড়ে ।
গ্রাম শেষ হয়ে একটা আমবাগান শুরু হল । এক-একটা আমগাছের কাণ্ড এতো মোটা যে তিনটে লোক একসঙ্গে দাঁড়িয়েও হাতে বেড় পাবে না । ডালগুলি যেন হাওয়ায় ভর করে সরলরেখা থেকে নেমে এসেছিলো ঘাসের কাছাকাছি কিংবা কচি সাহসে ভর করে মুখ বাড়িয়েছিলো সূর্যের দিকে, আজ থেকে কত যুগ আগে । কচি কচি ডালগুলোকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে টুক করে পালিয়েছে হাওয়া ! ওরা ওখানেই রয়ে গেছে সেই থেকে । বয়স বেড়েছে ত্রক্রমশ:, কঠিন হয়েছে রোদ-বৃষ্টিতে । এই এক-একটা ডালের বয়স আমার চতুর্গুণ, তারো বেশি বৈ কম নয় । আজ অবধি কত মানুষের স্পর্শ পেয়ে এসেছে এরা । মানুষ, সাপ, পাখি, পোকামাকড় । তাদের অধিকাংশই এখন আর ইহজগতে নেই । থাকলেও এতো বলিষ্ঠ নয় । নিজের সৌন্দর্য এমনভাবে ধরে রাখতে পারেনি তারা কেউই । পচা পাতায় সড়সড় শব্দ হচ্ছে পায়ে লেগে । এমনিতেই মেঘলা দিন, তার উপরে আমবাগানের ভিতর আলো প্রায় না ঢোকারই সামিল । ফল ফলানোর প্রয়োজনে যতটুকু না হলে নয়, সেটুকু এই বিরাট মহীরুহের দল নিজেরাই প্রকৃতির থেকে ছিনিয়ে নেয় । তা বাদে, এখানে দিনের আলোর কোনো অধিকার নেই । অন্ধকার জগৎ সাপেদের বৈঠকখানা । ভয়ে ভয়ে আছি, পচা পাতার দঙ্গলের কোনটা থেকে হঠাৎ সাপ বেরিয়ে আসে ।
- ঐ দেখতিচিস ক'টা তালগাছ আর মন্দির ? ওখেনেই যাব ।
সামনের জমিটা সামান্য উঁচু হয়ে উঠে গেছে । অনেকখানি জায়গা জুড়ে তালগাছের বন ; তার থেকে কিছুটা দূরে হলদে হয়ে আসা জীর্ণ মন্দির । বৃষ্টি তার চূড়ার উপর জমাট বাঁধছে ধীরে । তালবনের কাছাকাছি পৌঁছাতে দেখা গেলো ঝিলটা । বিরাট ঝিলে স্বচ্ছ টলটলে গভীর জল ; আর সেই জলে গা' ডুবিয়ে অসংখ্য পদ্মফুল । এর নাম বড়োঝিলের বদলে পদ্মসায়র হলেও কিচ্ছু ভুল ছিলো না ।
- এখেনি স্নান করবো । তুইও নাববি জলে ?
- ইচ্ছা তো করছে ভীষণ । কিন্তু সাঁতার জানি না যে ।
- নেইবে আয় না, তারপর আমি দেখতিচি -
- কেউ চলে আসে যদি -
হেসে কুটোপাটি হলেন রুণুমাসি ।
- আসবে নি । বড়োঝিলে পুরুষমানুষের আসা বারণ ।
- ওমা সে কি ? বারণ কেন ?
- জানি নে বাপু । জম্ম থিকে দেইখে শুইনে আসতিচি বড়োঝিলের জলে কখনো কোন পুরুষমানুষ চান করেনি কো । ঠাকুর-দেবতার ব্যাপার, তাই একনো লোকে মানতিচে ।
- ঠাকুরদেবতার ব্যাপার ?
- হঁযা রে বাপু । এই বড়োঝিল তো এখেনকার জমিদারে কেইটেছেলো না - । তা সেও তো বোধয় দশ কুড়ি বচ্ছর হবে । ঐ জমিদারের নে এট্টা গল্প শুনিচিলুম । জমিদারের মেইয়ে ধুমজ্বরে মইরতেছেলো, কবিরাজ-বদ্যিতে কিচ্ছু কাজ হচ্ছেলো নি । সক্কলে য্যাখন আশা ছেইড়ে দেছে, সেই সময় বাবা মহাদেব নাকি স্বপ্নে দর্শন দে বইলেছেলেন, মন্দির তৈরি কর আর ঝিল কাট । তোর মেইয়ে ভালো হবে, কিন্তু কোনোদিন ওমুখো হবি নে । শুধু মেইয়েরাই ঐ জলে নামতি পারবে । পুরুষমানুষে ঐ ঝিলপানে এলে তার বংশ নিব্বংশ হইয়ে যাবে ।
ডুবসাঁতারে অদৃশ্য হলেন মাসি ।
জলে পা ডুবিয়ে বসলাম । সাঁতার কাটতে জানলেও নামতে পারতাম না । শহুরে মানসিকতায় আটকে যেতো । এই বরং ভালো । বাতাস প্রবল রকম বেড়েছে বৈ কমেনি । ঝড় আসছে । তালগাছের মাথাগুলি দুলছে হাওয়ায়, পড়েই যেতো হয়তো । টেনে রেখেছে মাটি । ওদের মা । মায়ের টান বড়ো শক্ত টান । মেঘের গর্জন শুরু হয়েছে । পদ্মপাতার ওপর থেকে ডানা ঝটপটিয়ে কয়েকটা ঘুঘু উড়ে গেলো আমবাগানের দিকে । হঠাৎ ঝিলের মধ্যিখানে ভুস করে একটা মাথা ভেসে উঠলো । রুণুমাসি ! হাতে উঁচু করে ধরা একটা বিশাল পদ্মফুল ।
- আসবে না ? বৃষ্টি আসবে মনে হচ্ছে যে ।
- তাতে কি হইয়েছে ? অমনিও ভিজিই আছি, আট্টু না হয় ভিইজে যাবো ।
রুণুমাসির কথা শেষ হওয়ার আগেই হুড়মুড়িয়ে এসে গেলো বৃষ্টি । এবার সাঁতার দিয়ে ডাঙার দিকে আসতে লাগলেন মাসি । আমি ছুট লাগিয়েছি মন্দিরের দিকে । কিন্তু, ঐ ধুন্ধুমার বৃষ্টির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারলে তো ! ঝুপ্পুস হয়ে ভিজে গেলাম একেবারে । যা: । এমনি হবে জানলে যে বড়োঝিলে নেমে নাকানি-চোবানি খেয়েও অন্তত একটা ডুব দিয়ে আসতাম । মন্দিরের পাকা দাওয়ায় উঠে দাঁড়িয়েছি । দরজা খোলাই ছিলো । কপাটের যা অবস্থা, বন্ধ করাও যা, না করাও তাই । ভিতরে কালো পাথরের তৈরি একটা বিশাল শিবলিঙ্গ । পাশে খুব সম্ভবত পিতলের তৈরি তেমনই বড়ো একটা ত্রিশূল । টাটকা শিউলি ফুলের গন্ধে মন্দিরের ভিতরটা সুরভিত । শিবলিঙ্গের গলায় একটা গাঁদার মালা জড়ানো, তার চারপাশে শিউলি ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে গুচ্ছ ভরে । সঙ্গে আকন্দ ।
- দাঁড়া, পদ্মটা বাবারে দেই ।
রুণুমাসি কখন উঠে এসেছেন, দেখতে পাইনি । আধ হাত দূরের সব কিছু ঝাপসা হয়ে আছে বাইরে । পদ্মফুলটা শিবলিঙ্গের সামনে রেখে সটান শুয়ে মাথা ঠেকালেন মাসি । বাইরে এসে দাঁড়ালাম । কারুর প্রার্থনার সময় সেখানে থাকতে ইচ্ছা করে না । একটা বারান্দা মন্দিরটার চারপাশে ঘুরে এসেছে । পিছন দিকটায় বিরাট একটা শিরীষ গাছের নীচে আর একটা ছোটো মতো ঝিল । এখানেই বোধহয় মাছ আছে ।
- আমার তো জল থেকি উঠতে ইচ্ছা করতেছেলো নি । তোর জন্যি উঠতি হোলো ।
প্রণাম সেরে এসে মাসি চুল ঝাড়তে লাগলেন ।
- ঈশশ । এই বৃষ্টিতে কি করতে শুনি ?
- বিষ্টিতে সাঁতার কাটতি যে ভালো লাগে, কি আর বলবো ।
- মুড়ি আনবে বলেছিলে না ?
- এনিচি তো । ঐ যা:, ভিইজে গেছে । আগে বলবি তো । যাক, জলে পড়লিও তো ভিজতোই । ঐ দোব'খন । বাবারা রাগ না করলি হোলো ।
- কারা ?
- ঐ মাছেদের কথা কয়েছিলাম ।
- মাছ আবার রাগ করবে কি ?
- আ: ! মাছ-মাছ করিস নি কো । এমনি মাছ নয় তো, বাবার মাছ বলে কথা । তেনাদের তুষ্টু রাখতি হয় ।
হাসতে গিয়েও চেপে গেলাম, সকালের বকুনি মনে পড়ায় ।
- আচ্ছা মাসি, মন্দিরে ফুল দেয় কে ? কি সুন্দর করে সাজানো রয়েছে ।
- দেবে আবার কে ? ঐ ।
- ঐ মানে ?
- আরে, সত্য'র মামায় দেয় । ঐ করতি তো আচে । সংসার তো আর করল নি, ঠাকুররে সাজায়েই গেলো, নিজের বৌয়ের খোঁপায় কোনোদিন অ্যাট্টা ফুল গঁংউজে দেখলো নি - । তুই ছোটো মেইয়ে, কি বুঝবি ।
- ফুল এখানে কোথায় পান ?
- একানে আর কোতায় পাবে ? ভোর ভোর শ্মশ্মান থেকে বেইরে সন্নঝিলের জলে চান কইরে তার পাড়ের ফুলগাছ থেকে ফুল নে এসে পূজা কইরে আবার সারাদিনের মতো শ্মশ্মানে চইলে যান ।
- স্বর্ণঝিল ?
- হঁযা । এই যে শিরীষ গাছটা দেখতিচিস, এর নাক বরাবর আরো খানিক যেলে পর একটা এমনি বড়ো ঝিল । তারেই লোকে সন্নঝিল বলে । তার জলও এক্কেরে টলটলে । সেইখেনে যত্ত বক-সারসের রাজ্যি ।
- বকসারসের রাজ্যি মানে ?
- পাখিতে পাখিতে ছয়লাপ । এই দুটো ঝিলে অত পাখি আসে না । কেন জিগিস করিস নে বাপু, বলতি পারবো নি ।
- আমার সঙ্গে মেসোর দেখা হবে না, না গো ? ওখানে যাওয়া যায় না ?
- কি যে বলিস ! এয়ো মানষীর যেতি নেই সেখেনে । আর তোরেও যেতি দোব না ।
- আমার সঙ্গে কলকাতায় যাবে মাসি ? চল না ঘুরে আসবে ক'টা দিন ?
আমার এই কথায় কি যে হোলো, ডুকরে কেঁদে উঠলেন মাসি ।
- এই মন্দিরে বসে তোরে বলতিচি মা, আমার মতো কপাল করি য্যান কাউরে না আসতি হয় । সারা গেরামের লোক মানুষটারে ভক্তি-ছেদ্ধা করে । আর, আমি কতায় কতায় তার নামে যা নয় তাই বলি ; লোকে বোঝে না, কিন্তু আমার বুকের মদ্যেটা জ্বইলে যায় । কারে বলি, কারে বোঝাই যে ঐ মানুষটারেও ভালোবেসিছিলাম ? আর সে আমার দিকে চেয়েও দেখল নি ? আজ পঁচিশটা বচ্ছর এমনি করি বেঁচি আছি । এই ভগবানের মন্দিরে বইসে তোরে বলতেচি মা, তোর য্যান খুব ভালো বর হয়, সংসার হয়, তোরে য্যান কখনো বুঝতি না হয় ; শুধু এই মাসিটারে মইনে রাকিস ।
দু'হাতে মুখ ঢেকে কাঁদছেন আর বলছেন, - তোর মা' আমার ছেলেবেলার সই । তার সামনে আমি কোন মুকে গিয়ে দাঁড়াই, দাঁইড়ে বলি আমার দু:খের কতা ? সে য্যাখন আমার সোয়ামীরে ছোটো নজরে দেখবে, সে যে আমার সইবে না । মাঝেমইদ্যে অসহ্য হলি তোর মা'রে হয়তো কিছু লিকিচি, আসতি লিকিচি, কিন্তু ভেইবেচিলুম আসবে নি । তুই এলি, প্রাণটা ভইরে গেলো । আমার তো আর ছেলেপুলে হোলো নি । সত্য'রে নে আচি, থাকবো যে ক'টা দিন বাঁচি । তোর মা আসেনি কো, খুব ভালো হইয়েচে । নিজের সইয়ের কাচে স্বামীর সম্মান রক্ষা না কত্তি পারার মতো বড় জ্বালা আর হয় না । আমারে তুই কলকেতা নে যেতি চাস নি -
বলতে বলতে উঠে হঠাৎ দৌড়ে নেমে গেলেন মন্দিরের চাতালে । আকাশের দিকে মুখ তুলে দু'হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন । বৃষ্টি থামেনি তখনো । শরীরের সমস্ত অনু-পরমাণু দিয়ে সঁংঊচালো ঠান্ডা জল ঢুকে ছড়িয়ে যেতে থাকলো গভীরে । মন্দিরের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে থাকা সেই মানুষটির দিকে তাকিয়ে মনে হোলো, গ্রামের পরতে পরতে জড়িয়ে থাকা এই রমণীটি, যে কিনা সম্পূর্ণ দেহাতি ভাষায় কথা বলে, বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ঝিলে সাঁতার কাটে, ডুবসাঁতার দিয়ে এক দমে গিয়ে পদ্মফুল তুলে আনে, আবার সেই পদ্মফুল শিবের মাথাতেও চড়ায়, মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে বংশানুক্রমে চলে আসা গল্পকথায় ; এই মেয়ে তো আমার মায়ের বাল্যসখী, আমার রুণুমাসি নয় । এই মেয়েকে খঁংউজতে তো আসিনি আমি । যাকে খঁংউজতে এসেছিলাম, তাকে কোথাও পাইনি, এ সেই অন্য মেয়ে, অচেনা মানুষী যার চলার পথ ধূসর হতে হতে কালের বাঁকে ত্রক্রমবিলীয়মান । বৃষ্টিটা ধরে আসার আগেই দৌড়ে নেমে গেলাম চাতালে । তার দু'হাতের মুঠি আমার মুঠিতে নিলাম । তারপর, ঘুরতে শুরু করলাম দু'জনে যত জোরে পারি । জলের টানে দ্রুত, আরো দ্রুত ঘুরছি আমরা এক পাক, দুই পাক, তিন পাক । মসৃণ গতিতে সময় পিছিয়ে যাচ্ছে পঁচিশ বছর..... ।