এবারের শীতকালটা ঠাকুমা'র আদর খেয়ে কাটবে, সেটা আগে বোঝা যায়নি । কি করেই বা যাবে ! প্রত্যেক বার দূর্গাপূজার পর থেকে শুরু করে এ-পাশে বইমেলা পর্যন্ত টো-টো করে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর অঢেল সুযোগ পাওয়া যায় । এই সময়টা কলকাতার বাইরে যাওয়াও হয় না, আর যাওয়ার কথা চিন্তাও করা যায় না । বড়োজোর চড়ুইভাতি করতে কলকাতার ধারে-কাছে কোথাও একটা ঘুরে আসা হয়, ওই পর্যন্তই । তাছাড়া স্কুলের ফেস্টটাও তো বড়োদিনকে কেন্দ্র করেই হয় । তার জন্যেও এত সময় যায় যে বাইরে কোথাও আর যাওয়া হয় না । প্রত্যেকটা ক্লাসের প্রতিটা সেকশন এই কটা দিন ঝগড়া-ঝাঁটি শিকেয় তুলে রাখে বলেই এই সারা অঞ্চলের মধ্যে মৌলিদের স্কুলফেস্টটা এত বিখ্যাত । তাছাড়া আর সামলানোর কোনো উপায়ও নেই অবশ্য । খাবার থেকে শুরু করে হাতের কাজ, সবকিছুর প্রতিটি খুঁংইটনাটি সমস্ত কিছু ছাত্রীদের তৈরি বলেই এত সময় দিতে হয় সকলকে ফেস্টের কাজে । ঘুগনি থেকে শুরু করে এগ-রোল কি না পাওয়া যায় খাবারের স্টলে ! এছাড়াও সারা স্কুল পরিষ্কার করে সাজানোর ব্যাপারটা তো আছেই । স্কুলের মাঠদুটোতে খাবারের স্টল আর অডিটোরিয়ামে জিনিষপত্রের পসরা নিয়ে এই ক'টা দিন আর দম ফেলার সময় থাকে না কারুর । ঐ তিনদিন লোকে লোকারণ্য থাকে । বাইরে থেকে বিশেষ অতিথি ছাড়াও আরো প্রচুর লোক আসে । বিক্রিবাটাও হয় ভালো । সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় টিকোজি, টেবলক্লথ এইসব সেলাইয়ের রকমারি আর নানারকম ফ্যান্সি ডিজাইনের হাতের কাজ । এছাড়াও একটা প্রতিযোগিতা হয় এই সময় যেটার বছরদু'য়েক বয়স হলেও ইতিমধ্যেই বেশ জনপ্রিয় হয়ে গেছে । মোট দশটা থিমের মধ্যে থেকে প্রতিটি ক্লাস লটারির মাধ্যমে একটা থিম পায় । হস্তশিল্প প্রদর্শনীতে দশটি ক্লাসকেই নিজের নিজের থিমের ওপর একটি বিশেষ হাতের কাজ জমা দিতে হয় । সেরা তিনটি কাজ পুরস্কৃত হয় । চার্চের ফাদার নিজে পুরস্কার দেন । সুতরাং, এই ব্যাপারটার মজাই আলাদা । এবারে মৌলিদের থিম ছিল ঐতিহাসিক নদী । হাতের কাজে নদী ফুটিয়ে তোলা কি চাট্টিখানি কথা ! তার ওপর শুধু নদী থাকলেই তো হবে না, তার সঙ্গে মানুষের অনেক সম্বন্ধের কোনো একটাও বোঝাতে পারলে সবচেয়ে ভালো । এক মাস সময় দেওয়া হয় কাজটা করার জন্যে । প্রথম ক'দিন তো ঝগড়াঝাঁটিতেই কেটে গেল । আমার মনে হয় নীলনদের থেকে ভালো ক্যাণ্ডিডেট আর কেউ হতে পারে না, -- কপালের ওপর ছোটো করে কাটা অল্প ক'টা চুল পিছনে সরাতে সরাতে বলল রিয়া ।
-- কেন ? অন্য দেশে যাওয়ার কি দরকার ? ঝিলম নিয়েও তো করা যায় ; ঝিলমের ইতিহাস সস্তা নাকি ? শাশ্বতীর ঝটপট উত্তর । রিয়ার ঠিক উল্টো একটা কথা ও বলবেই, বিষয়টা যাই হোক ।
-- সস্তা-দামির কথা তো হচ্ছে না । কথাটা হল বিষয়টাকে আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে এবং আমার মনে হয় এই ব্যাপারে নিজের দেশকে প্রাধান্য দেওয়ার আইডিয়াটা ভালো । তোরা কি বলিস ? দুই ঝগড়ুটে শালিককে থামিয়ে দিয়ে বলল অনন্যা ।
-- ভালো কথা ; গঙ্গাকে নিয়ে করা যায় তা'লে । শিবের জটা থেকে শুরু করে গঙ্গোত্রী হয়ে একেবারে হাওড়া ব্রিজ পর্যন্ত এনে ফেলা যায় যদি, দারুণ হবে না ?
খ্যাক খ্যাক করে হেসে ফেলল নীপা আর ওর বন্ধুগোষ্ঠী । ওদের ঐ কাজ ! লোকের মুখের সামনে না হাসলে চলে না । রিয়া যে আসলে মোটেই মজা করেনি সেটা ও নীপার হাসি শুনে সকলের মুখের দিকে তাকাতে শুরু করাতেই বেশ বোঝা গেল । দিব্যি রেগেছেন, এবার ভঁযা করলেই ষোলোকলা পূর্ণ হয় !
-- শিবের জটা থেকে নদীর উথ্থান জাতীয় ব্যাপার একেবারেই অবিশ্বাস্য বলেই এড়িয়ে যাওয়া উচিত । নীপাদের হাসিটা সামাল দেওয়ার জন্যেই সঞ্চিতা বলে উঠল তাড়াতাড়ি ।
-- হঁযা, আমাদের থিমটা তো ঐতিহাসিক, পৌরাণিক নয় । চশমা মুছতে মুছতে বলল নীলাঞ্জনা ।
-- পৌরাণিক বিষয়গুলো তো ঐতিহাসিক বিষয়ের থেকেও আরো বেশি পুরানো ; তাহলে অসুবিধা কোথায় হচ্ছে ? রিয়ার রাগত স্বর ।
-- হচ্ছে এইখানে যে ইতিহাসের বাস্তব ভিত্তি আছে, পুরাণের নেই । রীতিমতো চেঁচাল শাশ্বতী ।
-- তুই বলতে চাস পুরাণ মিথ্যা ? তবে শিবরাত্রি করে কেন তোর দিদি ?
-- এর মধ্যে শিবরাত্রি আসছে কোথ্থেকে ? শাশ্বতী রেগে লাল । সকলের মাঝখানে দিদি'র শিবরাত্রির ব্যাপারটা ফাঁস হয়ে গেলে কি রকম রাগটা ধরে !
-- চুপ কর তো । ঝগড়া করতে হলে বেরো এখান থেকে ; মেয়েটা রোগাসোগা হলেও নীলাঞ্জনার গলা বয়সের তুলনায় বেশ ভারি হওয়ায় এক হাঁকেই চুপ করে যায় সকলে । সেই ফাঁকে গলা খোলে অনন্যা ।
-- আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে । তাজমহলের পটভূমিতে যমুনা কেমন হবে বলতো ?
-- দারুণ ! খুব ভালো । অনেক ক'টা গলা পাওয়া গেল প্রথমবার, একসঙ্গে ।
-- কিন্তু তাজমহল খুব খঁংউটিয়ে তৈরি না করলে তো--
-- খঁংউটিয়ে করা যেতে পারে ; ইলমার কাছে তাজমহলের একটা মডেল আছে খোদ আগ্রা থেকে কেনা । সেটার সাহায্য নিতে পারি আমরা । কি রে ওটা আনতে পারবি ক'দিনের জন্যে ? সঞ্চিতাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বলে ওঠে বিপাশা । সকলের দৃষ্টি এবার ইলমার দিকে ।
-- জিজ্ঞাসা করব আম্মিকে । ইলমার শান্ত স্বর শোনা গেল একপাশে । খুবই শান্ত মেয়ে ও, এক্কেবারে কথা বলে না ।
পরের দিন ইলমা নিয়ে এল মডেলটা । একটা কাঁচের বাক্সের ভিতর ধবধবে মার্বেল পাথরের ছোট্ট তাজমহল । এর পর কাজ শুরু হয়ে গেল । ছুটির পর ঘন্টাখানেকের ধাক্কা । সেটা সামলানো তেমন বড়ো কথা ছিল না । ঝামেলা হল অন্য জায়গায় । শক্ত কার্ডবোর্ডকে আর্ট পেপারের চকচকে দিকটা দিয়ে মুড়ে কেটেকুটে তাজমহল বানানো হল । কাটাকুটি করতে গিয়ে হাঁড়ির হাল । অত সূক্ষ্ম কাজ করা সোজা কথা ! দেশলাইয়ের কাঠি শিফন সুতোয় মুড়ে আঠা দিয়ে সেঁটে সেঁটে নদী তৈরি করা হল । ঢেউয়ের জন্যে বেশি কাঠি । জলে সূর্যাস্তের আলো খেলাতে তেমন অসুবিধা নেই ; নীল-হলুদ চুমকি তো আছে । সবটা শেষ হলে দেখা গেল যে যেমনটি ভাবা গেছিল, তার চেয়েও অনেক সুন্দর দাঁড়িয়েছে পুরো জিনিষটা । তিন সেকশনের ক্লাসটিচারা দেখে তো খুব খুশি । ওঁংএদর কারো কাছেই রেখে দেওয়া যেত । কিন্তু ওঁংএদর বিশ্বাস করা যায় নাকি ? কম্পিটিশন তো আমাদের মধ্যে, ওদের কি ? সব্বাইকে দেখিয়ে বেড়াবেন । নীচু গলায় ঝগড়াটির মতো মুখ করে বলা নীপার কথাগুলো দিব্যি মনে ধরে গেল সকলের । অগত্যা, ইলমা নিয়ে গেল ওটা ওর বাড়ি সবচেয়ে কাছে হওয়ায় । ফেস্টে ফার্স্ট প্রাইজের বদলে সেকেণ্ড প্রাইজ পাওয়ায় কারোরই মন খারাপ হয়নি । ক্লাস নাইনই যে এবার প্রথম হবে, সে বিষয়ে কারুর কোন সন্দেহ ছিল না । শিশু-শ্রমিকদের উপর অসাধারণ স্থাপত্য তৈরি করেছিল ওরা । এ'সব কাজ আত্রেয়ীদি' ভীষণ ভালো পারে । ওই করেছে বেশির ভাগ কাজটা । সব চুকেবুকে গেলে ছুটি পড়ে গেল স্কুলে, খুলবে সরস্বতী পূজার আগেটায় ।
স্কুল থেকে ফেরার পথে বৈরাগীদা'র মিষ্টির দোকানের সামনেটায় পৌঁছাতেই মৌলি দেখতে পেল রাস্তার উল্টোদিক থেকে ষাঁড়টা আসছে । বিরাট বড়ো ষাঁড়টা সচরাচর কারুর অনিষ্ট করে না ; আজ পর্যন্ত কাউকে গঁংউতোয়নি, কিন্তু কাউকে ধারে-কাছে ঘেঁষতেও দেয় না । ওকে সকলে খেতে দেয় পালা করে । আদর করে পাড়ার লোকে ওর নাম রেখেছে ভোলারামের ষাঁড় । তবু, ষাঁড় বলে কথা । মৌলির এই গাঢ় লাল স্কার্ট দেখলে কি আর রক্ষা থাকবে নাকি ! চট করে রাস্তাটা জরিপ করে নিল মৌলি । রাস্তার ওপারে শীতলা মন্দির । দূর্গাপুজাটা মন্দিরের চাতালেই বেশ জমকালো করে হয় প্রতি বছর । যে কোনো কারণেই হোক, ষাঁড়-বাবাজী ঐ পূজার চার দিন ছাড়া অন্য দিনগুলিতে কখনই মন্দিরের চাতালে ঢোকে না । রাস্তাটা কোনোমতে পেরিয়ে যেতে পারলেই ঢুকে যাওয়া যাবে শীতলা মন্দিরের চৌহদ্দিতে । আজ মন্দিরের পাশের গলি দিয়েই বাড়ির পথ ধরতে হবে । একটু ঘুরপথ হয়ে যাবে ঠিকই, কিন্তু কি আর করা ! ইতিমধ্যে, ষাঁড়টা যে মৌলির লাল স্কার্টটা দিব্যি নজর করেছে, সেটা তার তেরিয়া ভঙ্গি দেখেই বোঝা গেল । কি রকম ঘাড় বেঁকিয়ে ছুটে আসছে ! ষাঁড়ের হাত থেকে পালানোর জন্যে দৌড়ে রাস্তা পার হতে গিয়েই বিপদটা ঘটল । অত ভারি ব্যাগ নিয়ে টাল সামলাতে না পেরে সোজা হুমড়ি খেয়ে রাস্তায় । জোর লেগেছে হাঁটুতে । বেশ জ্বালা করছে যখন, নির্ঘাৎ কেটেছে । সামলে নিয়ে উঠতে যাবে, সামনে স্বয়ং নন্দী । কে কোথায় আছো, বাঁচাও বলে চিত্কার করতে গিয়েও পারল না মৌলি । গঁংউতো দেবে না খুরের বাড়ি ? ও মা ! এ যে মুখ বাড়ায় ! কানের কাছে মুখ নিয়ে আসে কেন ? বাবারে-গেছিরে ! ষাঁড়ে আমার কান খেয়ে ফেলল রে ! ছাড় ছাড় ! ওঁ নম:শিবায় নম: উরে বাবা, বাবাগো বাঁচাও গো ! আঊ ! বৈরাগীদা, দাও না ওকে দুটো ল্যাংচা, আউ ! টানিস না ওঁ নম:শিবায়--
-- অ্যাই ওঠ ওঠ, কি সব যা তা বকছিস ?
কোমরে একটা রামখোঁচা খেয়ে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে মৌলি । ও: ! এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল সে । মা যে-কোনো স্বপ্নের মানে বলে দেন খুব গুছিয়ে । মা'কে বলা যায় স্বপ্নটার কথা । কিন্তু কি বলবে ? ষাঁড়ে তার কান চিবুচ্ছিল ? নির্ঘাৎ বলবেন, নিজের বন্ধু ভেবে আদর করছিল ! দ্যুৎ । সাত সকালে যত্ত সব !
-- উঠিসনি এখনও ? ওঠ । তোরা যে কি কঁংউড়ের বেহদ্দ হয়েছিস ! মুখ ধুয়ে একেবারে স্নান সেরে নে । আমরা ছোটোবেলায় কত্ত ভোরে উঠে ফুল তুলতে যেতাম -- হঁযা রে, আজ কোন শাড়িটা পরবি ঠিক করেছিস ?
জেঠি স্নান সেরে ঘরে ঢুকেছেন । ভিজে চুল থেকে টুপটুপিয়ে জল পড়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে কাপড় । প্রথম কথাগুলি মৌলিকে বলা, এবং শেষের বাক্যটা মা'কে । জেঠির কথাবার্তার ধরনধারণই ঐ রকম ! কখন কার সঙ্গে কথা বলছেন, সেটা সামনের লোকটিকে বুঝে নিতে হয় । সে তো গেল, কিন্তু, এই সাতসকালে স্নান করতে হলে মরে যাবে যে । এই ঠাণ্ডা জল মানুষে গায়ে ঢালতে পারে ! গুটি গুটি জেঠুদের ঘরের দিকে এগোল মৌলি । অবুদা'টা এখনও ঘুমাচ্ছে কি না কে জানে । টোকা দিতে গিয়ে দেখা গেল দরকার নেই । দরজাটা একেবারে হাঁ, আর বিছানার ওপর তিনি উল্টো হয়ে বালিশের নীচে জেঠির ভাষায়, পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছেন । চিরকালের অভ্যাস । লোকে বালিশে মাথা রাখে, আর অবুদা' মাথায় বালিশ রাখে । ঘরটা দেখছিল মৌলি । ছোট্ট'র ওপর বেশ সুন্দর ঘর । জানলার সামনেটায় অনেকগুলি ফুলের গাছ । একটা গোলাপী রজনীগন্ধার ঝাড় অল্প অল্প দুলছে । গোলাপী রজনীগন্ধা এর আগে দেখেনি মৌলি । বোঝাই যায় যিনিই করুন বাগান, বেশ রুচি আছে তাঁর । ঘরটায় দ্বিতীয় আর একটা দরজা আছে দেখে এগোল মৌলি । বেরিয়েই বারান্দা, সামনে বাগান । আতাগাছের নীচে এখনও কয়েক পরত কুয়াশার রেশ । ছোটো ছোটো ফুলের গাছগুলির ওপর আধো কুয়াশা, আধো রোদের লুকোচুরিতে সকাল আড়মোড়া ভাঙছে, ধীরে । কুচিকুচি হিম হাওয়ার ডানায় চড়ে ফুল থেকে ফুলে । বাগানের একপাশে বোগেনভিলিয়ার ঝাড়ে ঢাকা লোহার গেটের ফাঁক দিয়ে বালি রঙের এক টুকরো পথ উঁংইক মেরে গেছে । এতক্ষণ ধরে সেই পথে একটি সাইকেল ছাড়া আর কাউকে যেতে দেখেছে বলে মনে পড়ল না মৌলির । এত সমাহিত ভোর কলকাতায় দেখা হয় না বলে কল্পনাও করা দুরূহ যে ভোর এত নিশ্চুপ হতে পারে । কালই এসেছে তারা । মৌলিদের ছোটঠাকুরদা' অর্থাৎ বাবাদের ছোটকাকা থাকেন এখানে । অনেকদিন ধরে চিঠি লিখছিলেন আসার জন্যে । অনেক আগে আসা হয়েছিল বার দু'য়েক ; তখন মৌলি খুব ছোটো । তারপর, বহুদিন দেখা-সাক্ষাৎ নেই । বয়স হয়ে যাচ্ছে ওঁর, এদিকে তাই এবার আসা হল । জায়গাটার নাম সোনবরসা-কচহরি । ট্রেনের বাঁশিতে কাঁচা ঘুম ভেঙে-ওঠা ভোরের বুকে এক চিলতে গ্রাম । ভোর পাঁচটার সময় স্টেশনে নেমে সেই প্রথম গ্রাম দেখা ; ট্রেনের জানলার শিক গলে দেখা নয়, হিমেল মাটির ওপর আঙুল ছঁংউইয়ে দেখা । কুয়াশাচ্ছন্ন স্টেশনে আচ্ছাদন বলতে কয়েকটা বিরাট নিম আর বট গাছ । সেগুলির নীচে বহু ব্যবহারে পাতলা হয়ে আসা ফুটিফাটা চাদর নাক পর্যন্ত চাপা দিয়ে বসে আছে কিছু লোক । মহিলাদের সামনে খানকতক ছোটো-বড়ো ঝুড়ি । একজন একটা গাছের নীচে উনুনে ভুট্টা সেঁকছে । উনুনের চারপাশে উবু হয়ে বসেছে ক'জন, মাঝে মাঝে আঁংএচর উপর হাত রেখে তাপ পুইয়ে নিচ্ছে । পায়চারি করছে কেউ কেউ ঠাণ্ডা কাটাবার জন্যে, কিন্তু হাওয়ার ঝাপটে ঠাণ্ডাটা তাতে বাড়ছে বৈ কমছে না । শহর থেকে অনেক দূরে প্রত্যন্ত অঞ্চলে অতি নিম্ন অর্থনৈতিক অবস্থা-সম্পন্ন মানুষের মধ্যেই গ্রাম বেঁচে আছে এখনও । এছাড়া, আর কোথাও তার অস্তিত্ব নেই । মফস্বলগুলো গ্রামের লক্ষণরেখা পেরিয়ে এসে শহরের প্রবেশপথেই আটকে গেছে । ফলে তাতে না আছে শহরের খোলা হাওয়ার চটক, না আছে গ্রামের কল্পলোকের ছোঁয়া । এই জগাখিচুড়ি অবস্থাটা ত্রক্রমশই আরো জট পাকাচ্ছে । সোনবরসা-কচহরি শহর তো নয়ই, মফস্বলও নয়, বরং বিহারের একটি প্রত্যন্ত গ্রামই বলা যায় তাকে । গ্রামটিতে আদর-আঙুল বুলিয়ে গেছে কোশী । বর্ষা বাদে বাকি সময়টা সে ক্ষীণতোয়া ।
-- আঁহা এত্তে ঠাণ্ডহা মে কি করয়ছিয়ে বাহার ?
পিছন থেকে একটা নরম, ভীষণ নীচু গলার চিকন স্বর কানে এলে স্টেশনের ভোর কেটে আবার বাগানে ফিরে এল মৌলি । প্রায় সমবয়সী একটি শ্যামলা মেয়ে পাতলা ফ্যাকাশে একটা চাদর গায়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । দেহে শাড়ীটা এমন ভাবে জড়িযে রয়েছে যে কোনটা বেশি দুর্বল, শাড়ীটা না ওর দেহটা-- সেটুকু আর আলাদা করে ঠাহর করা যাচ্ছে না । মুখে অল্প হাসি । হাতে দুটো চুড়ি ঢলঢল করছে, কবজি আর সামান্য রোগা হওয়ার অপেক্ষা ; যে-কোনো মুহূর্তে খুলে পড়ে যাবে । মাথার চুলে তেল পড়ে না, কোনোদিন পড়েছে কিনা সন্দেহ । সিঁথিতে এককণা গাঢ় গোলাপী আবীর ধরনের কিছু একটা । সিঁথিতে কি কেউ আবীর লাগায়, তাও বছরের এই সময় ? দেখতে হবে জিজ্ঞেস করে ।
-- অন্দর নয় যায়বেয় কি ? চায় বনলছেয় । আঁহাকে সব খোঁজয়ছেয় ।
পাড়ার এক বন্ধুর দৌলতে মৈথিলীটা জানা ছিল বলে ওর কথাগুলো বুঝতে পারল মৌলি । ভেতরে চা তৈরি হচ্ছে, এবং অবধারিত ভাবে শাড়ি-বাছা শেষ হওয়ার পর মা'র খেয়াল পড়েছে তার কথা ।
-- তোহর নাম কি ছৌ ?
-- শীলা । হেসে ফেলল শীলা ।
-- কিয়া হাসয়ছিহি ?
-- হাসয় নই ছিয়ে । বলে আবার হেসে ফেলে পালিয়ে গেল মেয়েটা ।
মৌলির মৈথিলীর টান শুনেই যে হেসেছে, সেটা বোঝা গেল বেশ । তা কি করা যাবে আর । কলকাতায় ওদের পাশের বাড়িতে রমনারা এসেছে বছর দুয়েক হল । ওকে বাংলা শেখানো আর ওর থেকে মৈথিলী শেখা, এই ভাবেই তো মৌলি কোনোরকমে শিখেছে ভাষাটা । তাও কি শেখাতে চায় । হিন্দীটা জানা ছিল বলে খুব একটা অসুবিধা হত না ভাষাটা বুঝতে, এই যা রক্ষে । তাই মোটামুটি তাড়াতাড়িই শিখে ফেলতে পারা গেছে । হিন্দীর থেকে মৈথিলীটাই বেশি ভালো লাগে মৌলির, খুব নরম-সরম ভাষা । একটা সুরেলা রেশ রেখে যায় ।
-- কি রে, একলা দাঁড়িয়ে আছিস কেন ? কাকি ডাকছে । আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বলল অবুদা ।
-- এতক্ষণে ওঠার সময় হল তোর ?
-- না তো কি ? ঘুরতে এসেছি না ? পড়ে পড়ে ঘুমাব ।
শেষের কথাটা জেঠিকে উদ্দেশ্য করে একটু জোরে বলা এবং ঢিলটা লেগেছেও কষে ।
-- ঘুমাবে না তো কি ? রাজপুত্তুর হয়েছ সব ইত্যাদি ইত্যাদি শোনার সঙ্গে সঙ্গে নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে শীলাকে দেখতে পেল মৌলি । শাড়ীর আঁচল সামলাতে সামলাতে বাটনা বাটছে ।
দুপুরের খাওয়া শেষ হতে ছাতে গেল মৌলি । ছাতটা বিরাট বড়ো । যত বড়ো বাড়ি, ছাতও তো তত বড়োই হবে । ছাত থেকে দেখা গেল অবুদা'কে । দু'-তিনটে ওর বয়সী ছেলের সঙ্গে বেরিয়ে যাচ্ছে । দুই-তিনটে বাড়ি পরেই দাদুর পুরানো বন্ধু সৌমেন দত্ত থাকেন । উনি এসেছিলেন সকালে । সমবয়সী হলেও দাদুর থেকে অনেক বেশি বুড়ো দেখায় ওঁংএক । অসুস্থ মানুষ । তাই ওঁর নাতি এসেছিল পৌঁছাতে । তখনই দাদার সঙ্গে আলাপ । আর, দিব্যি কেমন ভাব জমিয়েছে । এই ভর দুক্কুরবেলা একা ফেলে টো-টো করতে বেরিয়ে গেল । দাদা না কচু ! মোটে চার বছরের বড়ো, আবার দাদা বলতে হবে ! শখ কত । বলবে না তো, আর কক্ষণো দাদা বলবে না । হাল্কা একটা হাওয়া দিতে গা'টা শিরশিরিয়ে উঠল । চাদরটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিল মৌলি । কলকাতায় তো চাদর গায়ে দেওয়া হয় না । পাতলা সোয়েটারেই কাজ চলে যায় । এখানে এসেই প্রথম চাদর গায়ে দিয়ে নিজেকে বেশ বড়ো বড়ো লাগছে । আলতো পায়ে বিকেলের কাছে যেতে যেতে ঝিরঝিরে হিমেল রোদে দুপুরটা জড়িয়ে যাচ্ছে ত্রক্রমশ: । কোথ্থাও একটা পাখিও দেখা যাচ্ছে না । শুধু একটা ঠুক-ঠুক শব্দ আসছে বেশ কাছ থেকে । পূবদিকে অনেকগুলি নারকেল গাছ ; প্রত্যেকটাতেই ডাব ধরেছে চার-পাঁচটা করে । একটাই গাছ আছে যেটাতে মাত্র একটা ডাব । তার পাতার ঠিক নীচেটায় বসে একটা কাঠঠোকরা, গাছটার এপাশ থেকে ওপাশে যাচ্ছে । এক জায়গায় বসছে, আর ঠুকে দেখছে একবার-- শব্দ উঠছে ঠুক ঠুক । আবার উড়ে গিয়ে অন্য পাশে আর একটু ওপরে বা নীচে বসে আবার একবার ঠুকে দেখছে ; ফের শব্দ উঠছে ঠুক ঠুক । আওয়াজটায় স্বরের পার্থক্য হচ্ছে প্রতিবারই । গাছের চামড়া যেখানে খুব মোটা, সেখানে শব্দটা শোনাচ্ছে ঢুক-ঢুক ; আবার খুব হাল্কা ছালের উপর টুক-টুক । এই চলল অনেকক্ষণ ধরে । শেষে গাছের চামড়ার একটা জায়গার ভারি আর হাল্কার আনুপাতিক হারে সন্তুষ্টি হল পাখিটার । দুই পায়ে ভালো করে ভর রেখে ঠোকা শুরু করল । অবিশ্রান্ত শব্দ উঠল এবার, ঠুক-ঠুক-ঠুক-ঠুক । এবার গানের মতো তার তাল বদলালো কিছুক্ষণ ধরে । তারপর, একটানা একই রকম সুর ভেসে আসতে লাগল রোদেলা হাওয়ায়, ঠুক ঠুকঠুকঠুক । নিস্তব্ধ দুপুরে পাতার ফিসফাস কথা ছঁংউয়ে টুকরো হাওয়ার ওড়াউড়ি বাদ দিলে কাঠ ঠোকার নির্মম শব্দটুকুই শুধু চেপে বসে মাথার ভিতর । আর কোথাও কোনো শব্দ নেই ; কোনো দোলাচল নেই ; হয়তো বা একটা আধপোষা বিড়াল নি:শব্দে আমগাছের ছায়া মাড়িয়ে গৃহস্থের রান্নাঘরের চালার নীচে নিশ্চিন্ত আশ্রয় খঁংউজে নেয় ; দুটো কুকুর অকারণ রাস্তা পেরিয়ে এসে কুণ্ডলী পাকিয়ে যায় বেড়ার গা ঘেঁষে । তারপর, সর্বত্র অপার শূন্যতা । এই শূন্যতাটুকু ত্রক্রমশ আকারে বড়ো হতে হতে অবশেষে স্নায়ুতে আঘাত করে । সেই আঘাতে দুপুরের কপাল, আর রগ বেয়ে ঘুম গড়িয়ে নামে, নির্ভেজাল কালো ঘুম ছেয়ে ফেলে দৃষ্টিশক্তি, বোধসত্তাকে । ছাতে পাতা মাদুরের ওপর জমা গরম রোদে পিঠ ডুবিয়ে এইভাবে তন্দ্রা এসে যাচ্ছিল মৌলির । সিঁড়িতে পায়ের শব্দে সেটুকু চলে গেল । ডেকচি, আর একটা সাদা পাতলা কাপড় নিয়ে ছোটদিদার সঙ্গে মা-জেঠিমা উঠে এসেছেন ছাতে ।
-- নাতনির ঘুম পাইসে ? মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন দিদা ।
-- না না, ঘুম পায়নি ।
-- ঝাড়ু লাগাইয়া দেই সাতটায় একবার ? ডেকচিটা নামিয়ে রেখে জিজ্ঞাসা করলেন জেঠি ।
-- সাড়ান দ্যাও । একটু আগেই ধোয়াইয়া পরিষ্কার করাইসি শীলারে দিয়া । মাইয়াটা কাজেকম্মে পাকা ।
-- এই এত বড়ো ছাতটা শীলা একা ধুয়েছে দিদা ?
-- হ, ধুইসে তো । ক্লান্ত হইয়া গেসিল । তাই আইজ রান্নাঘর ধুইতে দিই নাই । সোট মাইয়্যা, নেহাৎ প্যাটের দায়ে লাইগ্যা আসে ; নৈলে ওর কি অহন লোকের বাড়ি কাজের সময় !
এত বড়ো ছাতটা একা ধুয়েছে শীলা, ভাবতেই খুব খারাপ লাগছিল মৌলির । বাড়িতে মাঝে-মধ্যে কাজের মাসী না এলে ঘর ঝাড়-মোছের দায়িত্বটা নেয় সে । মা' করতে দিতে না চাইলেও জোর জবরদস্তি করে মোছে সে । মাঝে-মধ্যে ঐ রকম ঘর মুছতে তো খুব ভালো লাগে । কিন্তু, কাজ শেষ হলে কোমর ব্যথায় আর সোজা হয়ে দাঁড়ানো যায় না । আর, এই এত বড়ো ছাত ধোয়া কি চাট্টিখানি কথা ! সঙ্গে বাটনা বাটা, বাসন মোজা, ঘরবাড়ি ঝাড়মোছ -- এর আগে কখনও ভাবেনি মৌলি এইভাবে । কিন্তু আজ ভাবতে গিয়ে খুব মন খারাপ হল ।
-- এইদিকটায় পাইত্তা দিমু কাপড়খান ? সাদা কাপড়ের টুকরোটার ভাঁজ খুলেছেন মা ।
-- না, সাতের মাঝখানটায় রোদ আসব সারাদিন ধইর্যা ।
-- কি করবে গো তোমরা ? মাদুরটা টেনে সরাতে সরাতে জিজ্ঞাসা করল মৌলি । ছাতের মাঝখানটাতেই মাদুর পাতা ।
-- বড়ি দিমু মা । অহন তো বড়ি দেওনের কথা আসিল না । আমাগো লেইগ্যা বড়ি বানাইয়া রাখসি আগেই । তোমরা আইলা দেইখ্যা ইচ্ছা হইল দিয়া দিমু । ফির্যা গিয়া খাইবা ।
মাদুরে জমিয়ে বসে এরপর বড়ি দিতে লাগলেন দিদা । ডেকচি থেকে এক খাবলা করে কাই তোলেন । তারপর সেই কাই হাতে রেখেই হাত মুঠো করে, মুঠির নীচ দিয়ে, কখনো বা উপরের ফাঁকটুকু দিয়ে অল্প অল্প করে কাপড়ের ওপর বড়ি ফেলে ফেলে যান । মাঝেমাঝে হাত খুব আঠা-আঠা হয়ে গেলে পাশে রাখা জলের বাটিতে হাতটা ধুয়ে বাড়তি জলটুকু বাটিতেই কাঁচিয়ে হাত ঝেড়ে নেন । তারপর আবার বড়ি দেন । মা'-জেঠিমাও হাত লাগিয়েছেন ।
-- বড়ি শুকাতে কতদিন লাগবে ঠাকু'মা ?
-- আইজকার মত রোদ হইলে তিন-সার দিনে শুকাইয়্যা যাইব গিয়্যা ।
-- এমনিভাবে একটানা চার দিন থাকবে ?
-- না গো নাতনি ; রাত্রিতে সরাইয়্যা রাখন লাগব ঘরের ভিতর ; নাইলে হিম পইড়যা ভিইজ্যা যাইবনি । সকালে কুয়াশা কাটনের পর রোদে পড়ব । উল্টাইয়াও দিতে লাগব মইধ্যখানে যাতে দুই পাশটাই শুকাইতে পারে ।
-- আচ্ছা ঠাকু'মা, শীলার বাবা-মা নেই ? এতক্ষণ ধরে মাথার ভিতর কুটকুটিয়ে কামড়ে চলা প্রশ্নটা বার করে ফেলল মৌলি ।
-- আসে মা । কিন্তু, মাইয়াটা মামার বাসায় থাকতে আসে অহন । নিজের বাসায় ঠাঁই পায় না ।
-- ক্যান খুড়ি ? নিজের বাসায় যায় না ক্যান ?
-- অর বিয়া হইয়া গেসে । এদের সমাজ বড়ো কঠিন । বিয়া হইলে মাইয়্যারে আর বাসায় নেয় না ।
-- ও, তাই ওর মাথায় কমলা আবীর ?
-- আবীর না, সিঁদুর । ওরা লাল সিঁদুর লাগায় না । মা বললেন ।
-- কেন ? লাগায় না কেন ?
-- লাল সিঁদুর উঁচু জাতের লোকেদের লাইগ্যা । এত সুন্দর দ্যাশ, জাতপাতেই খাইসে ।
-- ওরা নীচু জাত ?
-- ও: থামবে তুমি ? রাশি রাশি প্রশ্ন করে বিরক্ত কোরো না । মা রেগে গিয়ে বললেন ।
-- থাক না মা, জানুক, বুঝুক নিজের দ্যাশটারে । বড়ো হইত্যাসে । অহন তো আর সোট্টটি নাই । দীর্ঘশ্বাস ফেললেন দিদা ।
-- নীচু জাত তো বটেই মা --
ঠাকু'মার কথা শেষ হওয়ার আগেই একটা ছায়া এসে পড়ল সকলের মাঝখানে ।
-- মালকিন, হামে বর্তন ধোয়কে কল মে যায়ছিয়ে । দরজায় দাঁড়িয়ে দিদাকে কথাগুলি বলল শীলা ।
-- খায় লেলহি তু ?
-- হাঁ । নাহাবেলে আয় রহে না-- । ভুখ লাইগ যেতে ।
হাসল শীলা । স্নান করে এসে খিদে পেয়ে গেছিল বলে খেয়ে নিয়েছে-- সেটা বলতেই এত হাসি তার ।
-- ঠিক ছে । জলদি কর । শাম মে পানি পাকড়কে ঠাণ্ড লাইগ যেতে । পহলে বর্তন ধোয়কে ফির ঘর মে ঝাড়ু দেয় দিহি ।
মা-জেঠিমা হিন্দীই বোঝেন না মোটে । রমনা'র মা'র সঙ্গে মা সাংঘাতিক হিন্দী বলেন, বলে বলে অল্প-স্বল্প শিখাতে পেরেছে মৌলি । তাও, সেটা বিশেষ সন্তুষ্টিজনক নয় । কাজেই, ঠাকু'মা আর শীলার গতিময় মৈথিলী যে বিন্দু-বিসর্গও বুঝছেন না, সেটা ওঁদের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল । তাই, অনুবাদ করে বলে দিল মৌলি । ঠাকু'মা ওকে বললেন যে এখন বাসন ধোয়াটাই ঠিক হবে । সন্ধ্যা হয়ে গেলে জল ঘেঁটে ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে । বরং ঝাঁট দেওয়ার কাজটা পরে করা যেতে পারে ।
-- মৌ মৈথিলী শিখসে কোথায় ?
ঠাকু'মা যে ওর অনুবাদ-কাণ্ডটা শুনেছেন, প্রশ্নেই পরিষ্কার । অপেক্ষা না করে নেমে এল মৌলি । শীলার সঙ্গে কথা বলতে খুব ইচ্ছা হচ্ছে তার । এখন বড়োরা ওপরে । বাবা-জ্যাঠা বিশেষ নিষেধাজ্ঞার ধার ধারেন না ; দাদু তো আরোই না । কাজেই নিশ্চিন্তে নিজের ইচ্ছামতো কাজ করা যাবে ।
নীচে নেমে মৌলি দেখতে পেল বাগানের সামনের বারান্দাতে ছোটঠাকুরদা বাবা আর জেঠুর সঙ্গে বেতের চেয়ারে জমিয়ে বসেছেন । নানা রকম বিষয় নিয়ে চলছে খোলা আড্ডা । শীলা কলে বাসন মাজতে বসেছে । একের পর এক বাসন মেজে একটা বড়ো গামলায় জমা করছে । পরে একসঙ্গে কল চালিয়ে ধুয়ে নেবে ভালো করে । একটা করে বাসন মেজে প্রতিবার টিউবওয়েলে ধোয়া সম্ভব নয় বলে এই ব্যবস্থা । রান্নাঘরের চাতালে পাতা খাটিয়াটাতে বসে শীলার সঙ্গে কথা বলা যায় । কি কথা বলবে জানে না মৌলি । তবুও আলতো পায়ে খাটিয়াটার দিকে এগোলো সে । বসতেই কঁযাচ করে একটা আওয়াজ হল, আর সেই শব্দে মুখ ফেরাল শীলা । সেই হাসি ।
-- আঁহা য়ঁহা কি করয়ছিয়ে ?
-- ওনাহি এলিয়ে । তোরা সাথ বাত করবেয় । (এমনিই এলাম, তোর সঙ্গে গল্প করব ) ।
-- হামরা সাথ আঁহা কি বাত করবেয় ? শীলা হেসে লুটিয়ে পড়ে আর কি !
-- তোহর ঘর কাঁহা ছৌ ?
-- বাজার কে উস পার ।
-- কত্তে দূর ছে ? (কত দূর ?)
-- বহুত দূর ছে দিদি । টিশন কে উস পার ।
স্টেশন এখান থেকে অনেক দূর । রিকশায় আসতে তাদের কুড়ি মিনিট মতো লেগেছে । অতদূরে বাড়ি এই মেয়েটার ? এতখানি পথ হেঁটে আসে রোজ ভোরে ?
-- এত্তে দূর সে রোজ তু আবয়ছিহি ? অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে মৌলি ।
-- হাম ওঁহা নয় রহয়ছিয়ে । উ হামার সসুরাল ছেয় না দিদি ।
-- সসুরাল ? কিয়া না রহয়ছিহি ওঁহা ? ( কেন থাকিস না ? )
-- হামার পতি হামরা সাথ নয় রাখয়ছেয় । দোসর শাদি কয়র লেলকে । ( দ্বিতীয় বিয়ে করেছে, আমায় নেয় না )
এই প্রথম শীলার মুখে এলোমেলো বিষণ্ণতা । মশা তাড়াবার ভঙ্গিতে মুখের ওপর ভেজা হাত চালায় সে, জল ছিটকে পড়ে । মৌলির মনে হল চোখ মুছল শীলা ; নাকি শীতের দুপুর তাড়াতাড়ি নিভে আসে-- । বাড়ি কোথায় জিজ্ঞাসা করলে যে-বাড়ির কথা বলে সে, সে-বাড়িতে তার ঠাঁই নেই । সে-বাড়িতে তার নিজের লোক একটিও নেই ; অথচ এক কণা সিঁদুরের সূত্রে সে ঐ বাড়ির লোকেদের সঙ্গেই আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা ; সেই সিঁদুর যার কোনো মূল্য একমাত্র সে বাদে পৃথিবীতে আর কারো কাছে নেই । সেই সিঁদুর যা তাকে বঞ্চনা ছাড়া কিছু দেয়নি, দেবে এমন সম্ভাবনাও নেই । তবু এই শূন্যতাকে সে পরম যত্নে বয়ে চলেছে । একে জড়িয়েই তার আপাত বেঁচে থাকা ।
-- শীলা --
ঠাকু'মার গলা পাওয়া গেল । নেমে এসেছেন নীচে ।
-- মুঙ্গ কা দাল লায় দিভি বেটা ? জাড়া মে কমর দর্দ করয়ছে ।
-- কিয়া না লায়বেয় ? কত্তে লাবয়কে ছেয়, বোল দিও (আনব না কেন ? কতটা আনব বলে দিন । )
-- আড়াইসো গ্রাম সে কাম চইল যেতে । পয়সা লেকে আবয়ছিয়ে হমে । (আড়াইশোতেই হবে ; আমি টাকা নিয়ে আসছি-- )
-- ঠাকু'মা, আমিও যাব ওর সঙ্গে ? খুব ইচ্ছা করছে-- বাড়ি থেকে বেরোবার সুযোগটা ছাড়তে চাইল না মৌলি ।
-- তর মায়ে রাইগ্যা যাইব না ? অহন সন্ধ্যা হইয়া আসতাসে--
-- সন্ধ্যা হতে এখনো অনেক বাকি ; তুমি মা'কে বলনা ঠাকুমা, তুমি বললে ঠিক রাজি হয়ে যাবে--
-- বুঝস না -- আইচ্ছা যা ; গরম কাপড়ে ঢাইক্যা-ঢুইক্যা যা । বিহারের ঠাণ্ডা কহন লাইগ্যা যায়, বুঝন যায় না । অবু কই ?
-- অবু'দা তো ঐ বন্ধুদের সঙ্গে বেরোল । দত্তদাদুর ছেলে এসে ডেকে নিয়ে গেল না দুপুরে ?
-- অ । যাই, ফোন করুম অনুরে । তাড়াতাড়ি ফিরস ; খাড়াইয়া যাইস না ।
-- আচ্ছা ঠাকু'মা । বলে আর উত্তরের অপেক্ষা না করে ঘরের দিকে দৌড় লাগাল মৌলি । জামাটা শুধু বদলে নিলেই হবে ।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে সরু কাঁচারাস্তায় এসে পড়ল ওরা । অনেক দূরে দূরে বিক্ষিপ্তভাবে মাঠের মধ্যে ছড়িয়ে আছে কয়েকটি কাঁচা-পাকা বাড়ি । কয়েকটি বাড়িতে টালি কিংবা খড়ের চাল দেখে বোঝা যায় যে সেগুলি আসলে মাটির বাড়ি ; আংশিক পরিণত চেহারা দিতে একপাশের দেওয়ালে সাদা রঙ লেপে দেওয়া হয়েছে । কোনোটার উপর আবার স্থানীয় রাজনৈতিক দলের রঙিন ছাপ । ঠিক মাঠ বলা যায় না অবশ্য এলাকাটাকে, বরং জমি বলাই ভালো । চাষজমি নয়, সাধারণ অমসৃণ ঘাসমাটিপাথরের আবাস । তারপর, ফাঁকা মাঠ । পথটা দুইপাশে বেশ ঢালু হয়ে জমিতে মিশেছে । দুইজনের চলার মতো পথ । অন্য কেউ সামনে বা পিছন থেকে এলে জায়গা ছেড়ে দিতে একজনকে আগুপিছু হয়ে যেতে হয় । হঠাৎ কাঁচা পথ ছেড়ে পাশের জমিতে নেমে পড়ল শীলা । তুমুল শাখা-প্রশাখায় ঢাকা একটা ঘোর সাংসারিক বটগাছ পার হয়ে অল্প এগোতেই একটা টিমটিমে আলো দেখতে পেল মৌলি । ছোট্ট একটা দোকান বলেই মনে হচ্ছে । কাছে এগিয়ে আসতে বোঝা গেল, দূর থেকে ছোটো মনে হলেও সেটা তেমন ছোটো নয় । আসলে দুটো মাঝারি সাইজের দোকান পাশাপাশি মিলে একটা বড়ো দোকানের মতো দেখায় যদিও দু'টোর মধ্যে দেওয়াল আছে ; দু'জনের কারবার আলাদা । যে দোকানটার সামনে থামল শীলা, তার ডান পাশের দোকানে একটা লন্ঠন ঝুলছে ঘরের চালা থেকে ; ওপর থেকে সেটা শক্ত দড়ি দিয়ে বাঁধা । বেশ ক'জন চায়ের ভাঁড় হাতে ভাঙাচোরা বেঞ্চে বসে আড্ডা জমিয়েছে সেখানে । সাধারণ গ্রাম্য মানুষ, তাকে দেখে সকলের মুখে একটা প্রশ্নচিহ্ন জেগে উঠল । ছোটো জায়গা, এখানে সকলে সকলকে চেনে । নতুন মানুষ, তাই কৌতূহলের কারণ ঘটে ; এদের গণ্ডিতে আটকানো জীবনে নতুন ঢেউ ওঠে, অল্পক্ষণের জন্যে হলেও সময়ের হিসাব থাকে না ।
একজন স্থানীয় লোককে চা মেপে দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে দোকানদারের অবাক দৃষ্টি ছঁংউয়ে যাচ্ছিল মৌলিকে । ধপধপে চুড়িদার কামিজ এবং সোয়েটারে সে এখানে অনেকটাই বেমানান । এমন নয় যে ওরা এই রকম মেয়ে আগে দেখেনি । কিন্তু তারা সকলেই মুখ চেনা এবং এখানকার সংষ্কৃতির ধারক ও বাহক । চায়ের দোকানের তর্ক-বিতর্কও মৃদু হয়ে এসেছে । সকলেই এই নতুন লোকটিকে মেপে নিতে উত্সুক । খাটো ধুতি-ফতুয়া এবং মোটা চাদরের দেহাতী দোকানদার নিপুণ হাতে ডাল মেপে নিতে নিতে তাকে লক্ষ করে শীলাকে জিজ্ঞাসা করল,
-- কে ছথিন ? ( ইনি কে ? )
দোকানদারের প্রশ্নে নিহিত সম্ভ্রমের সুরটা কানে লাগল মৌলির । সে ঐ মানুষটির মেয়ের বয়সী হবে । তবুও উনি এমনভাবে কথা বলছেন যেন সে অনেক বড়ো মানুষ এবং যথেষ্ট সম্মান পাওয়ার যোগ্য । এঁর মেয়েকে দেখে শহরের কেউ হয়তো জিজ্ঞাসা করত, "এটা কে রে ?" শহর আর গ্রামের এ এক চিরকালীন পার্থক্য । স্বাভাবিক লাজ-সম্ভ্রম আর আন্তরিক সৌহার্দ্যের সুর গ্রামের মাটি ছেড়ে এখনো বাস ওঠায়নি ।
-- দাদাজি কি পোতি ছথিন । শহর সে আইলছথিন । ( দাদাজির নাতনি, শহর থেকে এসেছেন )
-- কে দাদাজি ?
-- ময়দান কে পাস জো লাল ঘর ছে, উ ঘর কে মালিক । (মাঠের পাশে যে লাল বাড়ি, তার মালিক )
-- পণ্ডিতজী কি পোতি ?
-- হাঁ ।
-- হমার গাঁও আহাঁকে কেহন লাগয়ছে ? ( আমাদের গ্রাম আপনার কেমন লাগছে ? )
-- বহত নিক লাগয়ছেয় । বহত দিন রহকে মন করয়ছে । ( খুব ভালো লাগছে ; অনেক দিন থাকতে ইচ্ছা করছে । )
মুখে কাপড় চাপা দিয়ে হি হি করে হাসতে লাগল শীলা । যেন এইরকম আজব কথা সে আগে শোনেনি কখনো ! দোকানদারও হেসে ফেলল ।
-- গাঁওমে আঁহাকে কি আচ্ছা লাগলয় ? শহর মে তো সব সুখ-সুবিধা ছে । (গ্রামে কি ভালো লাগল ? এখানে তো শহরের মতো সুখ-সুবিধা নেই )
-- আঁহাকে শহর আচ্ছা লাগয় ছে, হমে গাঁও অচ্ছা লাগয় ছে । (আপনার শহর ভালো লাগে, আমার গ্রাম । )
-- ফির অয়বেয় । ( আবার আসবেন । )
শীলার ডাল নেওয়া হয়ে গেছিল । দোকানদারের কথায় ঘাড় হেলিয়ে পিছন ফিরল মৌলি । আর কবে আসবে ? তখন এই দোকান, দোকানদার আর গ্রামটা ঠিক এমনই থাকবে কি না সন্দেহ । বিকেল শেষ হয়ে গেছে এতক্ষণে, কিন্তু সন্ধ্যা নামতে ঈষৎ দেরি । মশার ডানার মতো ফিনফিনে অন্ধকারের জাল ছড়িয়ে যাচ্ছে চতুর্দিকে । ত্রক্রমশ সে বুনট আরো দৃঢ় হলে রাত নামবে তার যাবতীয় স্বাতন্ত্র্য নিয়ে । শুকনো পাতার দঙ্গল মাড়িয়ে আবার কাঁচা রাস্তায় পড়তেই ট্রেনের সিগন্যাল শোনা গেল । আসার সময় খেয়াল হয়নি ; ফিরতি মুখের জমির ভিতর দিয়ে চলে গেছে রেললাইন, যদিও তা এখান থেকে অনেকটা দূর ; কিন্তু এই প্রায়ান্ধকার গোধূলিতে ট্রেনের টিমটিমে এক চিলতে আলো অনেক কাছের বলে মনে হচ্ছে । ঐদিকে আঙুল পেতে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল শীলা ।
-- রেল যায়ছেয় দিদি । হামার ঘর ওঁহা ছেয় ! ( ট্রেন যাচ্ছে দিদি, ওখানে আমার ঘর ।)
-- কাঁহা ?
-- হামার সসুরাল টিশন কে পাস ছে ।
-- ঔর তোহর নৈহর কাঁহা ছৌ ? (আর, তোর বাপের বাড়ি কোথায় ? )
-- নদী কে ওয় পার এক গাঁও ছে, দমগড়ি ; ওঁংইহ হামার নৈহার ছে । লেকিন হমে তো মাইকে সাথ নয় রহয়ছিয়ে । (কোশী নদীর ওপারে দমগড়ি গ্রামে আমার বাপের বাড়ি )
-- তো কাঁহা রহয়ছিহি তু ? মা'র কাছেও থাকে না, স্বামীও নেয় না -- থাকে কোথায় মেয়েটা ? অবাক হয়ে গেল মৌলি ।
-- মামা কে পাস রহয়ছিয়ে । ( মামার কাছে থাকি ।)
-- মামা কে পাস ? মা'কে ঘর মে কিয়া না রহয়ছিহি ? ( মা'র কাছে থাকিস না কেন ?)
-- নয় দিদি, হমার তো শাদী ভ্যায়গলে ; হম তো আপন নৈহর মে নয় রহ সকয়ছিয়ে । ( আমার তো বিয়ে হয়ে গেছে ; বাপের বাড়িতে থাকতে পারি না তাই ।)
-- কিয়া ? ( কেন ? )
-- উও হমে না জানয়ছিয়ে । ( তা বলতে পারব না ।)
-- তোহর পতি আপনা সাথ কিয়া না রাখয়ছৌ ? ( তোর স্বামী তোকে নিজের সঙ্গে রাখে না কেন ? )
-- বহত জায়দা তিলক মাঙে রহে ; বাপু সাইকেল তো দে দেলকে ; লেকিন টিভি নয় দে সকলকেয় । ইহা লেল হমরা অপনা সাথ নয় রাখয়ছেয় । মামী সে হমার নয় পটয়ছেয়, লেকিন হমে যায়বেয় কাঁহা ? ( অনেক বেশি পণ চেয়েছিল ; বাবা সাইকেল দিলেও টিভি দিতে পারেনি । তাই, আমায় নিজের সঙ্গে রাখেনি । মামীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালো নয়, কিন্তু কোথায় যাব ? )
মাথা নামিয়ে জোরে পা চালাল শীলা । বিয়ের সময় পণ হিসাবে সাইকেল দিতে পেরেছে শীলার গরীব বাবা । টিভি দেওয়া সম্ভব হয়নি । তাই, মেয়েকে ফেলে দিয়ে গেছে । সমাজের কঠিন বিধান, সে গাঁয়ে থাকতে পারবে, কিন্তু নিজের বাবার ঘরে নয় । তাই, মামার ঘরে সব অত্যাচার সহ্য করেও পড়ে থাকতে হচ্ছে তাকে । কোথ্থাও যাওয়ার নেই ওর । মন ভারি হয়ে গেল মৌলির । একটা টিভি দিতে পারেনি বলে তারই বয়সী একটা মেয়ে এত্ত একা ? যে টিভি তারা হেলাফেলায় দেখে, সেই টিভি একটা মেয়ের ভাগ্য নির্ধারণ করে এইভাবে ? চুপচাপ হাঁটতে হাঁটতে কখন গেট এসে গেছে বাড়ির । ঠাকু'মা তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বালাচ্ছেন । শঙ্খধ্বনি ছড়িয়ে পড়ছে সন্ধ্যা ছঁংউয়ে ।
পরের সপ্তাহখানেক জমিয়ে ঠাণ্ডা পড়ল । প্রত্যন্ত গ্রাম ; সেখানে শহরের নানা রকম দূষণ পৌঁছায়নি এখনও । তাই, এখানে পশ্চিমবাংলার গ্রামের মতোই কলকাতার থেকে অনেক বেশি ঠাণ্ডা পড়ে । শান্ত নিবিড় জীবনযাত্রার কুয়াশা কাটাতে অনেক রোদ পোয়াতে হয় । এত ঠাণ্ডাতেও শীলার কামাই নেই । ওকে দিয়ে ঘর-মোছানো বন্ধ রাখিয়েছেন ঠাকুরমা এই ক'দিন, কাপড় ধোয়াও বারণ । কিন্তু, বাসন তো মাজতেই হচ্ছে । হাড়-কাঁপানো ঠাণ্ডা জল ঘাঁটতে ঘাঁটতেও মুখে হাসিটি তবু লেগেই আছে । জিজ্ঞাসা করলে বলে, অভ্যাস হয়ে গেছে । সাড়ে চার বছর আগে কুলু থেকে আনা একটা গরম চাদর ওকে দিয়েছেন জেঠি । কিন্তু, সেটা ও এখানে গায়ে দিয়ে কাজ করে এখানেই রেখে যায়, কিছুতেই বাড়ি নিয়ে যাবে না । ওর মামী নাকি কেড়ে নেবে ! মৌলিকে আরো অবাক করে শেষে বলেই ফেলল সত্যি কথাটা ; বাড়িতে বসে থাকলে মামী চ্যালাকাঠের বাড়ি মারবে ! তাই কষ্ট হলেও বেরোতেই হয় ওকে, আর বেরোনোর আগে ঘর গোবরলেপা করে, উনুন ধরিয়ে তবে আসে । ওকে অবিশ্বাস করার কোনো কারণ ছিল না ; কারণ, ওর শরীরে সর্বত্র বড়ো ক্লান্তির ছাপ । বিকেলে চা নিয়ে বসলে অপার ঘুম ভেঙে আসে ওর চোখে । কিন্তু ঠাণ্ডা জলের ঝাপটা মেরে বেরিয়ে পড়ে শীলা । ফিরতি পথে সন্ধ্যা আর সকালের উনুনের জন্য ডালপালা কুড়িয়ে নিয়ে যেতে হবে তো । শীলা থাকতে আসার পর থেকে তার মামীর কয়লার খরচটা বেঁচে যাচ্ছে অনেকটা । বাড়িতে থাকতে দিচ্ছে যখন, হিসেব মিটিয়ে নিতে কি আর ছাড়ে !
দিন তিনেক পর শীত খানিকটা কমলে মৌলির বায়নায় কোশী নদীর তীরে চড়ুইভাতি করতে যাওয়া হল সবাই মিলে । এত কাছে এসেও কোশী দেখা হবে না, ভাবতেই খুব খারাপ লাগছিল । মোটামুটি চওড়া নদী ; এখন বালির তলায় শীতঘুমে । বর্ষায় এর প্রলয়ঙ্করী রূপ দেখে চেনা দুষ্কর হয়ে পড়ে । ঠাকুরদার কাছে ছিপ না থাকায় একটা পাতলা গামছা আলাদা করে নিয়ে এসেছিল অবু'দা চুনোপঁংউটি ধরবে বলে । ছপাৎ ছপাৎ করে গামছা ডোবায়, আর এককাঁড়ি করে বালি তুলে ভর্তি করে । মিনিট পঁয়তাল্লিশের অক্লান্ত চেষ্টায় জামা-কাপড় ভিজিয়ে ফেলে ধপাস করে বালিতে বসে পড়ে বলল, "দুস-এই পঁংউচকে নদীতে মাছ নেই ।"
-- যে হারে জলের ওপর নাচনকোঁদন হচ্ছিল, তাতে মাছ কেন, মাছের বাবারাও ওখানে আর আছে কিনা সন্দেহ ! জেঠুর ঈঙ্গিত পরিষ্কার ।
-- শিয়ালের গল্পটা তর মনে আসিল না, নাতি ? ঠাকুরমা শুদ্ধু সুযোগটা ছাড়লেন না !
ওদিকে ওর কাণ্ড দেখে হাসতে হাসতে শীলার পেটে খিল ধরে যাবার যোগাড় ! খানিক পরে গামছাটা তুলে নিয়ে একটু দূরের জলে গিয়ে আধঘন্টার মধ্যে এক কোঁচড় চুনোপঁংউটি এনে হাজির করল । তরি-তরকারি কাটাকাটিটা মা-জেঠিমা করলেও রান্নাটা কিছুতেই ঠাকুমা' করতে দিলেন না । চুনোপঁংউটির চচ্চড়ি ঠাকু'মার হাতে অমৃত । কলাপাতা নিয়েই আসা হয়েছিল ; রোদ্দুর-মোড়া দিনটা নদীর পাড়ে ঝরঝরিয়ে কেটে গেল ।
ছুটি শেষ হয়ে এসেছে । আজই ফিরতে হবে । ঠাকুরদা-ঠাকু'মা একা হয়ে যাবেন আবার । আগামী বছর মৌলির স্কুলে গরমের ছুটিতে আবার নিয়ে আসবেন বলেছেন বাবা অফিস থেকে ছুটি নিতে পারলে, জেঠুরও ইচ্ছা আছে । যাওয়ার দিন বড়িগুলো মুড়েঝুড়ে ব্যাগে ঢোকানোর সময় মা'কে রাজি করিয়ে একটা সোয়েটার বার করে নিল মৌলি । এককোণে ডেকে নিয়ে শীলাকে দিতে, সে অবাক । কেঁদে ফেলল । চোখ মোছার কোনো রকম চেষ্টা না করে জড়িয়ে ধরল মৌলিকে । যাওয়ার সময়, রিকশার পিছনের পর্দা উঠিয়ে রইল মৌলি যতক্ষণ দেখা যায় । হাত নাড়ছে শীলা ; কনুই পর্যন্ত নেমে গেছে চুড়িগুলো । এমন সময় বাঁক নিল রিকশাটা । ট্রেন আসতে দেরি করেছে ঘন্টাদেড়েক । ছাড়তে ছাড়তে আরো কিছু দেরি । বাঁশি বাজতেই ঝুপ করে একগোছা অন্ধকার পড়ল জানলার বাইরে । রাতভর ট্রেনের ধকল সেরে আবার হাওড়ার কুচকুচে ব্রিজ, ধূসর গঙ্গা, চেনামুখ, বন্ধু-বান্ধব, খেলাধূলা, স্কুলের ব্যস্ততা । অন্যান্যবার কোথাও বেড়াতে গেলে একটু হলেও উত্সাহ থাকে ফেরার । এবার কেমন খালি খালি লাগছে । আচ্ছা, শীলাকে মূল বিষয় করে কিছু তৈরি করতে হলে আত্রেয়ীদিরা' কি করত ? শিশু-শ্রমিকের কাহিনী নাকি বাল্যবিবাহ ? একটা জীবন্ত মানুষকে শিল্পরূপ দেওয়া সম্ভব । কিন্তু, তার অনুভূতি ? তাকেও কি একই ভাবে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব ? কামরায় নিস্তব্ধতা । শুধু অবুদা'র ওয়াকম্যান থেকে ভেসে আসছে একটা গান--
"-- তবুও কিছুই যেন
ভালো যে লাগে না কেন
উদাসী পথের বাঁকে মন পড়ে থাকে কেন
কোথায় রয়েছে ভাবি লুকিয়ে বিষাদ
তবুও..."