• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ২৮ | নভেম্বর ২০০২ | রম্যরচনা
    Share
  • কথার কথা : সোডা জল

    ॥ শূন্য কুম্ভ ॥


    কচি কালো পাঁঠার ঝোলের গন্ধে বাগানের বাতাস আকুল হয়ে আছে । মেজোদাদু পাটভাঙা ধুতি-পাঞ্জাবি পরে মুখে একটা অনভ্যস্ত হাসি ঝুলিয়ে বসে আছেন । দিদিমা সকালবেলা লালপাড় শাড়ি পরে পায়ের ধূলো নিয়েছেন । গ্যাঞ্জাম সেসব টকাটক ক্যামেরায় তুলে রেখেছে । কংকাবতী সেজেগুজে এসেছিলেন, কিন্তু ফটো-সেশন তার আগেই শেষ হয়ে গেছে শুনে একটু মুষড়ে পড়েছেন । সত্যসাধন এখনো পৌঁছননি, রাতে নাকি ভাল ঘুম হয়নি, পরে আসবেন ।

    ভাবগম্ভীর পরিবেশ । অংকস্যার চারদিক দেখে নিয়ে চাপা গলায় বললেন -- যুদ্ধ শুরু হল বলে ।

    কংকাবতী চমকে উঠলেন -- বলেন কী !

    মেজোদাদুর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল ।

    অংকস্যার একটা লম্বা শ্বাস ছেড়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন -- বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক । ইওরোপে তখন যুদ্ধ শুরু হল বলে । ইংরেজরা ক্রিপ্টোঅ্যানালিসিস নিয়ে উঠেপড়ে লাগল । লণ্ডনের একটা বিল্ডিংয়ের চল্লিশ নম্বর ঘরে ক্রিপ্টোঅ্যানালিসিসের দলের কাজ শুরু হয়েছিল । সেই থেকে দলটার নামই হয়ে গেল `রুম-ফর্টি' । ব্যাপারটা কিন্তু কাজে দিয়েছিল । যুদ্ধ যখন সত্যি সত্যি লাগল, জার্মানদের বেশিরভাগ সংকেতই এরা ভেঙে ফেলেছিল ।

    পড়তায় পুষিয়েছে তাহলে । - কংকাবতী নিশ্চিন্ত ।

    অংকস্যার বললেন -- টেলিগ্রাফের মত বেতারের আবিষ্কারও ক্রিপ্টোগ্রাফির ইতিহাসে একটা বড় ঘটনা । বেতারে পাঠানো যে-কোনো বার্তাই অন্য কেউ ধরে ফেলতে পারে । ফলে ক্রিপ্টোগ্রাফির গুরত্ব বাড়ল । প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্রান্সে অনেকগুলো রেডিও-স্টেশন ছিল । ফলে জার্মানদের বেতারবার্তা সেখানে ধরা পড়ে যেত ।

    উনিশশো সতেরোতে আমেরিকানরা এম,আই-৮ নামে একটা অফিস খুলল । এদের কাজ ছিল সাংকেতিক বার্তা কিংবা লুকোনো কালিতে লেখা চিঠি সুদ্ধ সবরকমের গোপন বার্তা ভেঙে দেখা । এদের ডিরেক্টর ছিলেন হারবার্ট অসবোর্ন ইয়ার্ডলি । কাজকর্ম ভালোই চলছিল -- প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, এমনকি তার পরেও । কিন্তু উনিশশো উনত্রিশে অফিসটার পাট গুটিয়ে ফেলা হয় । ইয়ার্ডলির তখন অবস্থা করুণ -- অর্থনৈতিক মন্দার সময় কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে পথে বসার দাখিল । তাই ভদ্রলোক করলেন কি -- এম,আই-৮ এর কার্যকলাপ নিয়ে একটা বই লিখে ফেললেন -- দ্য আমেরিকান ব্ল্যাক চেম্বার । সে বই বাজারে পড়তে না পড়তেই রমরম করে বিক্রি হয়ে গেল । অবশ্য গালাগালও খেয়েছিল ভালই -- গোপন তথ্য ফাঁস করার জন্য কম সমালোচনা হয়নি ।

    নিন্দুকের অভাব নেই স্যার -- গাংলুর দীর্ঘশ্বাস -- কেউ দুটো ভালো কবিতা লিখুক, সঙ্গে সঙ্গে ফিসফাস - এসব অরিজিনাল নয়, রবি ঠাকুরকে প্ল্যানচেটে ডেকে লেখানো । রিডিকিউলাস ।

    গ্যাঞ্জাম একটু অপ্রস্তুত । গাংলুদের পত্রিকায় একটা লেখা দেখে তার এরকম ধারণা হয়েছিল । কথাটা সরল মনেই বলেছিল সে । সেটা যে গাংলুর মনে এমন দাগা দেবে ভাবতে পারেনি । গাংলু যে ছদ্মনামে লেখে -- সেটাই বা কে জানত ? তাছাড়া বিজনেস প্ল্যানটাও মনে ধরেছিল গ্যাঞ্জামের । প্ল্যানচেটে কী-ই বা খরচা ? ওইদিকে একেবারে যদি ডজনখানেক কবিতা মুফতে পাওয়া যায় --

    অংকস্যার বললেন -- ক্রিপ্টোগ্রাফিক মেশিন চালু হওয়াটা আরেকটা বড় ঘটনা । সংকেত বানানোর পদ্ধতিটা একই রইল, তবে এবার সেটার প্রয়োগ শুরু হল ইলেকট্রোমেক্যানিকাল পদ্ধতিতে । জার্মানদের এনিগমা মেশিনটা যেমন । একদল ব্রিটিশ দল আর একদল পলাতক পোলিশ ক্রিপ্টোঅ্যানালিস্ট মিলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গোড়ার দিকেই এনিগমার তৈরি সংকেত ভেঙে ফেলেছিল । সে-জন্য মিত্রশক্তি অনেকটা সুবিধে পেয়ে যায় । ওদিকে আমেরিকানরাও জাপানীদের সংকেত ভাঙায় যথেষ্ট সাফল্য পেয়েছিল ।

    এইসময় সত্যসাধন ঢুকে পড়লেন -- সরি । দেরি হয়ে গেল ।

    রাতে কোথাও বেরিয়েছিলেন বুঝি ? -- ক্ষমাসুন্দর হাসি মেজোদাদুর ।

    আরে না না, বেরোব কোথায় ? -- সত্যসাধন তটস্থ ।

    যাবার জায়গার কি অভাব আছে এখানে ? কত লোকই তো গভীর রাতে ঝোলা আর শাবল নিয়ে বেরোয় -- ভোরবেলা প্যান্টে চোরকাঁটা আর কাদা নিয়ে ফিরে আসে । ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি -- মেজোদাদুর গলা শান্ত ।

    তা নয়, আসলে স্বপ্ন দেখতে গিয়ে সারারাত ঘুমই হল না -- আশ্বস্ত করেন সত্যসাধন -- মাথায় সিনেমা চললে কি আর ঘুমোনো যায় ?

    কী দেখলেন ? মনেটনে আছে ? -- অংকস্যার কৌতূহলী ।

    সাড়ে-তিন ঘন্টার ছবি প্রায় । লাস্ট সিনটাই যা মনে আছে আর কি । সত্যসাধন মোটামুটি সিচুয়েশনটা বললেন ।

    পাহাড়ে ঘেরা একটা পাথুরে জায়গা । তার ঠিক মাঝখানে মেজোদাদুর কলসী জড়িয়ে একখানা সাপ ফনা উঁচিয়ে পোজ দিয়েছে । সত্যসাধন ডাকাতদের হাতে বন্দী । কলসীর ভেতরেই যথাসর্বস্ব । ডাকাতদের সর্দার একটা ফিনাইলের বোতল ভেঙে চারদিকে কাঁচের টুকরো ছড়িয়ে হুংকার দিয়ে উঠল -- নাচ ।

    নাচলেন ? -- সাসপেন্সের মধ্যে অংকস্যারের গলা ।

    অফ কোর্স । হাফপ্যান্ট পরে ধেই ধেই করে শুরু করলাম -- চল কোদাল চালাই, ভুলে মনের বালাই । ব্রতচারীর শিক্ষা যাবে কোথায় ! আর কী চমত্কার নাচ -- নিজেই দেখে মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি । তবেই না ডাকাতসর্দার খুশি হয়ে সাবাস বেটা বলে কলসীতে হাত ঢুকিয়ে ফেরত দিয়ে দিল । তারপরেই তো ঘুমটা এল । অতক্ষণ নাচের একটা ধকল নেই ? ফিনাইলের গন্ধে ঘুমটা হয়ত ভালো --

    কলসীতে ছিলটা কী ? -- কংকাবতী এই সুযোগে গোপন পৈত্রিক সম্পত্তির কথা জেনে নিতে চান ।

    কেন, আমার মানিব্যাগ । ভেতরে তেইশ টাকা পঁচাত্তর পয়সা । আর একটা মান্থলি ।

    কিন্তু সাপটা ? -- গ্যাঞ্জাম অত সহজে ছাড়ার পাত্র নয় ।

    সত্যসাধন অবাক হয়ে বললেন -- রবারের সাপ নিয়ে অত ভাবনা কিসের ? ওখানেই কোথাও রাখা হল । খুঁজে দেখলেই পাওয়া যাবে ।

    কলসীটা কি ওখানেই রয়ে গেল ? -- অংকস্যার পয়েন্টে ফিরে এলেন ।

    হ্যাঁ । শূন্য কুম্ভ । ওরাই রাখুক -- সত্যসাধন এবার দানসাগর -- জলটল ভরতে কাজে লাগবে । কী বলেন, খোকাবাবু ?

    শুভদিনে এই কলসী-প্রসঙ্গে মেজোদাদুর একটু অস্বস্তি হচ্ছিল । তাড়াতাড়ি কথা ঘুরিয়ে বললেন -- পাহাড় অতি বিচিত্র জায়গা । আমি গাড়োয়ালে থাকতে এক বাঙালি সন্ন্যাসীর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল ।

    দিদিমা সবাইকে খেতে ডাকতে এসেছিলেন । সন্ন্যাসীর কথা শুনে দাঁড়িয়ে পড়লেন ।

    মেজোদাদু বললেন -- বাঙালি ভদ্রলোক, কাছেই একটা গুহায় থাকেন । খুব করে নেমন্তন্ন করে গেলেন -- রোজ একা-একা হাত পুড়িয়ে রান্না করে খাই, একদিন আসুন না । গেলাম একদিন । গুহায় ঢুকে চক্ষুস্থির । গুহার দেয়াল জুড়ে লম্বা লম্বা ছাল ঝুলছে । ভদ্রলোক একটু লাজুক হেসে বললেন -- একটু সাজিয়ে নিয়েছি । ইন্টিরিয়ার ডেকোরেশনে ডিগ্রি ছিল তো । জিজ্ঞেস করলাম ছালগুলো কিসের । তাতে আরো লজ্জা পেয়ে বললেন -- এ অঞ্চলে আর ইয়েতি-টিয়েতি কোথায় ।

    মা-মানুষ ? -- কংকাবতী স্তম্ভিত ।

    মেজোদাদু কোন উত্তর না দিয়ে বললেন -- গুহার ভেতরে গিয়ে দেখি অনেকগুলো কাটা হাত পরপর রাখা আছে । ভদ্রলোক বললেন -- বরফটাই বাঁচিয়ে দেয় । নইলে সব পচে যেত । রোজ একটা করে পুড়িয়ে রেঁধে খাই । শুনে তো আমি অভিভূত ।

    পিন পড়লে ঝন ঝন করে উঠবে -- এমন নিস্তব্ধতা কুড়ি সেকেণ্ড । অংকস্যার একটু কেশে বললেন -- দীক্ষাটিক্ষা নিলেন নাকি ?

    সে আর হল কই -- মেজোদাদু হতাশ -- ভদ্রলোক তখন বাসা বদলাতে চলেছেন । আরো উত্তরে একটা গুহা দেখেছেন -- বেশ বড়সড়, অতিথিটতিথি এলে আপ্যায়নের সুবিধে । কদিন পরেই বদলি হয়ে গেলেন আমাকে গৃহপ্রবেশের নেমন্তন্ন করেছিলেন । যেতে পারিনি । পাহাড়ের কিনারায় অমন বাড়ি মোহন -- ধরো কিছু উটকো লোকজন এসে জুটেছে, ঘাড়ে একটি রদ্দা কি গলাধাক্কা দিলেই সোজা দশ হাজার ফুট --

    মেজোদাদু হয়তো আরো কিছু বলতেন, কিন্তু এইসময় আখতার গজনভি ঢুকেই বললেন -- তিনটে প্রশ্ন । এক, প্ল্যানচেটে কবিতা লেখার কথা কে তুলেছিল ? দুই, মানুষের ছাল কী রঙের দেয়ালে মানাবে ? তিন, উটকো লোকজন বলতে কাদের কথা বলা হচ্ছে ?

    আখতার গজনভি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ডায়েরি খুলে একটা পেনসিল নিয়ে আস্তে আস্তে টোকা দিচ্ছেন । পাশে দাঁড়িয়ে নীলমানুষ চোখ পিটপিট করছে । সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করে বোঝার চেষ্টা করছেন উত্তর দেওয়ার জন্য হাত তোলাটা ঠিক হবে কি না । এই সময় গেট খুলে চম্পটকে ঢুকতে দেখা গেল । সে একগাল হেসে বলল -- বেড়ে গন্ধ ছেড়েছে দিদিমা ।

    দিদিমা খুশি হয়ে নতুন অতিথিদের আপ্যায়নের তোড়জোড় শুরু করলেন ।
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments